অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৩৯.

0
2

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৩৯.

রুদ্র-প্রিয়তার বিয়ের মাত্র দুদিনই বাকি। বিয়ের অনুষ্ঠানটা আমের ভিলায় হচ্ছেনা। আলাদা একটা বাড়ি ভাড়া করেছেন রাশেদ। জাঁকজমক করে সাজানো হচ্ছে সেই বাড়ি। অনুষ্ঠানের এই ব্যপারটায় সন্তুষ্ট নয় রুদ্র। ও চেয়েছিল ঘরোয়াভাবে বিয়েটা সেরে ফেলতে। লুকিয়ে আঘাত করার জন্যে ভীড় মোক্ষম জায়গা। ভালো সুযোগ। যেই সুযোগটা ও কাউকে দিতে চাইছেনা। তাই রাশেদকেও নিজের আপত্তির কথা জানিয়েছিল রুদ্র। রাশেদ থমথমে গলায় জবাব দিয়েছেন, ‘আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে আমি কারো ভয়ে লুকিয়ে দেবনা। কাপুরুষদের মোকাবেলা করার ক্ষমতা আমার আছে। তোমারও থাকা উচিত।’

উত্তরে কিছু বলতে পারেনি রুদ্র। ও নিজেকে নিয়ে ভাবছেনা। কোনদিন ভাবেও নি। এটা অন্ধকার জগতের ভয়ংকর খেলা। সে খেলায় বরাবরই অভ্যস্ত এবং দক্ষ খেলোয়ার রুদ্র আমের। কিন্তু প্রিয়তা? তারতো এ জগতের সঙ্গে কোন লেনদেন নেই। ছিলোওনা। নির্দোষ মেয়েটার কোন ক্ষতি হয়ে গেলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেনা রুদ্র। যেখানে একপ্রকার জোর করে, নিজের প্রয়োজনে প্রিয়তাকে বিয়ে করছে সে।

সন্ধ্যায় বৈঠক বসল আমের ভিলায়। মাগরিবের আজানের ঠিক আধ ঘন্টা পরে। বৈঠকে আছে রাশেদ, রুদ্র, জাফর, ইকবাল, উচ্ছ্বাস। সবাই নিজেদের নির্ধারিত চেয়ারে বসে আছে। আজ বৈঠকঘরের পরিবেশ ভিন্ন। বরাবরের মতো সবার কপালে চিন্তার ছাপ নেই। চেহারায় গাম্ভীর্য নেই। আছে কেবল প্রসন্নতার ছাপ। মুক্ত, ঝরঝরে পরিবেশ। প্রথম কিছুক্ষণ অতিথি, ডেকোরেশন, খাবারের ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা চলল। ইকবাল সব আয়োজন ও খরচের হিসেব দিল রাশেদকে। রাশেদ কাগজগুলোয় চোখ বোলালেন। মনোযোগ দিয়ে বুঝে নিলেন সব হিসেব। অতঃপর বললেন, ‘এবার আসল কাজের কথায় আসা যাক।’

বলে একটা সিগারেট ধরালেন রাশেদ। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অতিথি অনেক আসবে। ভীড় হবে অনেক। সুতরাং নিরাপত্তার ব্যবস্থাও কঠোর হওয়া প্রয়োজন। তোমার এ বিষয়ে কী মত?’

রুদ্র এতক্ষণ চুপ ছিল। কারণ বিয়ের আয়োজনের কথাবার্তায় ও থাকতে চায়না। রাশেদ প্রশ্ন করায় এবার বলল, ‘এখানে মতামতের কিছুই নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতেই হবে। কোন বিকল্প নেই।’

ইকবাল বলল, ‘ কিন্তু গুলশানে ঢুকে আঘাত করার মতো সাহস কেউ করবে? নিরাপত্তা যে কঠোর হবে ঐটুকু ধারণা ওদের থাকবে না?’

ইকবালের যুক্তিকে খণ্ডন করে জাফর বলল, ‘ শত্রুকে দুর্বল ভাবাটা বোকামি। ওরা হয়তো আমাদের এমনই কোন এক বোকামির অপেক্ষায় থাকবে। হু নোজ্? সাবধানের মার নেই।’

রুদ্র সোজা রাশেদের দিকে তাকাল। গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘নিরাপত্তা প্রয়োজন। এ বিষয়ে তর্কের কোন অবকাশই নেই। আলোচ্য বিষয় এটাই কীভাবে আর কতটা।’

মাথা ঝাঁকালেন রাশেদ। গালভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘যেহেতু আমি একজন ব্যবসায়ী। আমার প্রাণের পেছনে অনেকেই পড়ে আছে। ব্যবসায়ীক দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিগত আক্রোশ ইত্যাদি ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে আইনি নিরাপত্তা পাওয়া আমার অধিকার। কমিশনারের সঙ্গে কথা বলছি আমি। উনিই ব্যবস্থা করবেন।’

রুদ্র কিছুটা চিন্তা করে বলল, ‘কমিশনারের দেওয়া নিরাপত্তা যথেষ্ট হবেনা। উনি অসাধু ব্যবসায়ীদের ক্ষমতার দৌড় জানেন। ততটুকুই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু ভয়ানক কিছু আন্ডারওয়ার্ল্ডের দলের ক্ষমতা এবং তৎপরতা তারচেয়েও কয়েকগুন বেশি। তার ওপর দায়িত্ব দিয়ে শতভাগ নিশ্চিন্ত হওয়া যাবেনা। আমাদের নিজস্ব লোকদের কাজে লাগাতে হবে।’

জাফর ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘কীভাবে? বিয়েটা খোলা জায়গায়, ওপেনলি হচ্ছে। সেখানে আমাদের ইলিগাল অস্ত্রগুলো দিয়ে কোনরকম নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হবেনা। জবাবদিহি করতে হবে। আমাদের হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া বাকি কারো কাছেই পি-স্ত-ল রাখার লিগাল রাইট নেই।’

‘পুলিশ প্রটেকশন তাদের মতো থাকবে। কিন্তু গোটা বাংলো জুড়ে থাকবে আমাদের লোক। খাবার সার্ভ করার লোক থেকে শুরু করে দরজার কাছের প্রহরী, সবার কাছে সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল থাকবে। লুকানো। শুধুমাত্র প্রয়োজন পড়লেই ব্যবহার করা হবে সেগুলো।’

এটুকু বলে থামল রুদ্র। পুনরায় কিছু একটা চিন্তা করে আবার বলল, ‘আর হ্যাঁ! ঐ বাংলোর আশেপাশের যতগুলো বিল্ডিং আছে। যেখান থেকে রা-ই-ফে-ল সাইটে রেখে টার্গেট করা সম্ভব। সে সকল বিল্ডিং এ আমাদের লোক থাকবে। সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলসহ।’

ঘরের কেউ কোন কথা বলল না। সবাই তাকিয়ে আছে রাশেদের দিকে। রাশেদ একমনে সিগারেট টানছেন। ভাবছেন কিছু। হঠাৎই সোজা হয়ে বসলেন রাশেদ। অ‍্যাশট্রেতে ছাই ঝেড়ে বললেন, ‘সবদিক দিয়ে ভেবে দেখলাম, এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়। এভাবেই করা হবে সব।’

এতক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছিলো উচ্ছ্বাস। অন্য জগতে হারিয়ে গিয়েছিল যেন। হঠাৎই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘কিন্তু ব্যপারটা রিস্কি হবেনা? যদি পুলিশ কোনভাবে টের পেয়ে যায়?’

রুদ্র যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘টের পাওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই। আর যদি পেয়েও যায়, আমি বুঝে নেব।’

সোজা হয়ে বসলেন রাশেদ। সিগারেটটা অ‍্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘তাহলে সে কথাই রইল। আমি কমিশনারের সঙ্গে কথা বলছি। তোমরা বাকিটা দেখ।’

মৌনতা দিয়েই সম্মতি জানালো সকলে। রুদ্র বলল, ‘তাহলে উঠব আমি?’

রাশেদ বললেন, ‘দাঁড়াও। তোমার সিদ্ধান্তে তুমি অটল? কোন ফাংশন করতে চাইছো না?’

রুদ্র স্পষ্ট গলায় জবাব দিল, ‘ না বাবা। তবে প্রিয়তার জন্যে সবরকম ফাংশনই করা হবে। যা যা হয় আরকি।’

রাশেদ কিছু বললেন না। এসবে মাথাব্যথা নেই তার। জাফর আর ইকবাল কিছু বলতে নিয়েও বললেন না। সবাই মিলে অনেকবার বুঝিয়েছে রুদ্রকে। কোন লাভ হয়নি। ওর একটাই কথা, এসব আমার দ্বারা হবে না। অর্থাৎ হবেনা।

একটু বেলা করেই ঘুম ভাঙল রুদ্রর। বেশ ভালো ঘুম হয়েছে আজ তার। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে একদম হালকা করে ফেলল নিজেকে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই দেখতে পেলো উচ্ছ্বাস, জ্যোতি আর রঞ্জুকে। ওর বিছানায় একগাদা জিনিসপত্র ছড়িয়ে রেখেছে। নেড়েচেড়ে কীসব করছে তিনজন। ভ্রু কুঁচকে গেল রুদ্রর। টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে বলল, ‘এগুলো কী?’

জ্যোতি উত্তর দিলোনা। নিজের মতো দেখছে জিনিসগুলো। উচ্ছ্বাস শেরওয়ানিটা তুলে নিল। ঘিয়ের মধ্যে লাল রঙের অসাধারণ এক ডিজাইনস। রুদ্রর সামনে গিয়ে গায়ের ওপর ধরে দেখল উচ্ছ্বাস। মুচকি হেসে বলল, ‘পার্ফেক্ট আছে।’

রুদ্র হাত দিয়ে সরিয়ে দিল সেটা। সাজগোজের ওপর বিশেষ কোন আগ্রহ নেই ওর। বিয়েটা হলেই হল। পাশ কাটিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রুদ্র। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ‘সাইজ অনুযায়ী-ই অর্ডার করা হয়েছে।’

‘ তবুও দেখে নিতে সমস্যা কোথায়?’

রুদ্র জবাব দিলোনা। তোয়ালে রেখে শার্ট পরতে পরতে জ্যোতিকে বলল, ‘ব্রেকফাস্টটা রুমে নিয়ে আয়। নিচে যাব না এখন আর।’

জ্যোতি এবারেও কোন উত্তর দিলোনা। জিনিসগুলো রেখে নিরুৎসুক ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। উচ্ছ্বাস রুদ্রর দিকে তাকাল। একটু ভেবে কোনরকম ইতস্তত করে বলল, ‘বেশি কিছু না। জাস্ট হলুদের অনুষ্ঠানটা..’

নিজের বাক্য শেষ করতে পারল না উচ্ছ্বাস। রুদ্র এমনভাবে তাকাল যে আপনাআপনি চুপ হয়ে গেল ও। মেকি হেসে বলল, ‘এমনিই বলছিলাম আরকি। তোর বিয়ে, তোর ইচ্ছে। আমার কী?’

‘ বিছানা থেকে এগুলো সরিয়ে ভাগ। আমার দেখার কিছু নেই।’ বিরক্ত হয়ে বলল রুদ্র। বিয়েই তো করবে। এতো বাড়তি ঝামেলা করার কী আছে? আশ্চর্য!

উচ্ছ্বাস বলল, ‘প্রিয়তার জিনিসগুলোও সরিয়ে রাখব? এখান থেকেই শাড়ি, গহনা কসমেটিকস্ সব বাছাই করে বিকেলে পাঠানোর কথা। রাশেদ বাবা তোকে দিয়েই সিলেক্ট করতে বলেছিল। কিন্তু তোর যখন বিরক্ত লাগছে তখন_। রঞ্জু সরিয়ে ফেলতো দ্রুত।’

রঞ্জু হকচকিয়ে গেল। কোনমতে দাঁত কেলিয়ে বলল, ‘জ্বি ভাই নিশ্চয়ই। ভাবির জামাকাপড় না হয় আমরাই বাইছা দিলাম। সমস্যা কী? ভাইয়েরে আর না জ্বালাই।’

বলেই ব্যস্তহাতে জিনিসগুলো সরাতে গেল রঞ্জু। রুদ্র গলা ঝাড়র। গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘প্রিয়তার জিনিসগুলো রেখে বাকিগুলো সরিয়ে রাখ। ওগুলো থেকে আমি সিলেক্ট করে পরে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।’

রুদ্রর কথা শুনে ঠোঁট চেপে হাসল উচ্ছ্বাস। রঞ্জুও মিটমিটিয়ে হাসছে। ধমকের ভয়ে জোরে হাসতে পারছে না। তাই প্রিয়তার জিনিসগুলো রেখে, কোনরকমে বাকি জিনিসগুলো তুলে কেটে পড়ল দুজন।

বিকেল চারটা বাজে। ভাড়া করা বাংলোটার ছাদ বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। সবুজ আর গাঢ় খয়েরী থিমে সাজানো হয়েছে ছাদটা। পশ্চিমপাশে কাঠ দিয়ে দু ফুট উচু করে চৌকি মতোন বানানো হয়েছে। তার ঠিক মাঝখানে বসে আছে প্রিয়তা। পরনে গাঢ় খয়েরী গ্রাউন, একপাশে সুন্দরভাবে ঝুলিয়ে রেখেছে লাল ওড়না। মীরা মেহেদী পরিয়ে দিচ্ছে প্রিয়তার হাতে। জ্যোতি লাগেজে করে রুদ্রের দেওয়া জিনিসগুলো নিয়ে এসেছে। কুহু নেড়েচেড়ে দেখছে সেগুলো। ওদের পরনে খয়েরী ওড়নাসহ সবুজ স্যালোয়ার কামিজ। ছোট্ট সাউন্ডবক্সটাতে মৃদু শব্দে গান বাজছে। গানের তালে মাঝেমাঝে গুনগুনিয়ে উঠছে ওরা। কিছুক্ষণ পরপরই চলছে মহিলা মেইডদের আনাগোনা। জ্যোতি প্রিয়তাকে বলল, ‘কী ব্যপার প্রিয়তা? তোমার বর কী কী পাঠালো দেখবেনা?’

প্রিয়তা হাতের মেহেদী দেখতে দেখতেই মৃদু হেসে বলল, ‘পরার সময়তো দেখতেই পাবো আপু। এখন তোমরা দেখো।’

কুহুর মুখটা মলিন হয়ে উঠল। গাল ফুলিয়ে ইশারায় কিছু বলল। প্রিয়তা হেসে ফেলল। খালি হাতটা কুহুর গালে রেখে জ্যোতিকে বলল, ‘আমার মিষ্টি ননদিনী গাল ফুলিয়ে কী বলছে?’

জ্যোতিও হেসে ফেলল এবার। বিছানায় বসে বলল, ‘তোমার বর কোন রিচুয়ালই মানবেন না। সেইজন্যই মন খারাপ সবার। বড্ড ঘাড়বাঁকা সে।’

প্রিয়তা হতাশ হলো। সকাল থেকে তিনবার ফোন করে অনুরোধ করেছে রুদ্রকে। কিন্তু রুদ্র মানতে নারাজ। মনে মনে রাগও হচ্ছে ভীষণ। একটাদিনও নিজের ইগো ছাড়তে পারে না লোকটা! কী হয় সবার কথা মেনে নিয়মগুলো মানলে? তবে প্রিয়তাও ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। কিছু একটা ভাবল প্রিয়তা। অতঃপর কুহুর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘আমার বিয়ের দিন আমার মিষ্টি ননদের মন খারাপ থাকবে? হতেই পারেনা।’

মীরা মেহেদী দেওয়া ছেড়ে চোখ তুলে বলল, ‘ কী করবি?’

প্রিয়তা আয়েশ করে বসে বলল, ‘ ব্রহ্মাস্ত্র ছুড়বো।’

জ্যোতি, কুহু, মীরা কেউ কিছুই বুঝলো না। বোকার মতো তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে।

লাঞ্চটা রুদ্র আর উচ্ছ্বাস একসঙ্গেই করেছে। রুদ্রর ঘরে। সারাদিনে আজ ঘর থেকে বের হয়নি রুদ্র। দরকারও পড়েনি। এদিকে উচ্ছ্বাস সারাদিন-ই ব্যস্ত ছিল। বিয়ে বাড়ির হাজারটা কাজে প্রায় পিষ্ট ছেলেটা।
বিকেলের দিকে করিডরের জয়েন্ট ব্যালকনিতে গিয়ে বসল রুদ্র। সঙ্গে উচ্ছ্বাসও এলো। এতক্ষণে একটু বিশ্রামের অবকাশ পেয়েছে ও। বাড়ির এই গমগমে পরিবেশে এখন এটাই নিরিবিলি জায়গা। রেলিং এর ওপর উঠে বসল রুদ্র। উদাস চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা সিগারেট ধরালো। গম্ভীরভাবে কিছু ভাবছে। দেখাদেখি উচ্ছ্বাসও একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বলল, ‘কাল তোর বিয়ে। আজকেও মুখটা বাংলার পাঁচ না করে রাখলে হচ্ছেনা?’

রুদ্র ঠোঁটের মাঝে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে রেখেই বলল, ‘প্রিয়তারা ওখানে পৌঁছাবে কখন?’

‘পৌঁছে গেছে। কেন?’

‘তুই কখন যাচ্ছিস?’

‘আটটার দিকে। চিন্তা করিস না। আজকে থেকেই গার্ড দেওয়া হচ্ছে। এতক্ষণে সবাই যার যার পজিশন নিয়ে নিয়েছে। আমি চেক করে এসেছি। ইকবাল ভাই আছেন ওখানে।’

রুদ্র কিছু বলতে যাচ্ছিল। তখনই ফোন বেজে উঠল ওর। প্রিয়তার কল। রুদ্র জানে ও কেন কল করেছে। এই নিয়ে চারবার। অযথাই চেষ্টা করছে মেয়েটা। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে কলটা রিসিভ করে বলল, ‘ হ্যাঁ বলো। কোন সমস্যা হয়েছে?’

ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো গলায় প্রিয়তা বলল, ‘আপনি নিজেই তো আস্ত একটা সমস্যা। এই, সত্যি করে বলুন তো নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করছেন? নাকি বাবা আপনার মাথায় ব-ন্দু-ক ধরে করাচ্ছেন? সত্যি কথা বলবেন।’

রুদ্র বুঝতে পারল প্রিয়র রাগের কারণ। কিন্তু সেটাতে পাত্তা দিল না। নির্বিকারভাবে বলল, ‘দুটোই।’

প্রিয়তা অস্থির কন্ঠে বলল, ‘মজা করছিনা আমি।’

রুদ্র গম্ভীর গলায় বলল, ‘প্রিয়, সকাল থেকে একই কথা বলে যাচ্ছো। আমার উত্তরটাও একই ছিল। বারবার এক কথা বলতে ভালো লাগেনা আমার। কালকে রেডি হয়ে যাচ্ছিতো। কিন্তু বারবার এভাবে সং সেজে বসে থাকতে পারব না আমি। জেদ করোনা।’

‘অদ্ভুত! বিয়ে কী রোজ রোজ করব নাকি? আমার শখ আহ্লাদ থাকতে নেই?’

‘তোমাকে তো কিছুতে বাঁধা দিচ্ছিনা আমি। তুমি যা যা করতে চাও সব করা হবে। করা হচ্ছেও। কিছু বাদ গিয়ে থাকলে বলো। আমি এক্ষুনি ব্যবস্থা করছি। কিন্তু আমি এসবে নেই।’

‘ কিন্তু..’

‘ জেদ করোনা, প্রিয়তা।’ অনেকটা ধমকের মতো শোনালো রুদ্রর গলা।

প্রিয়তার অভিমান হলো। অসহায় মুখ করে তাকাল ওর কানে ফোন ধরে রাখা মীরার দিকে। কুহুও হতাশ হল। জ্যোতি নির্বিকার। যেন জানতো এমনটাই হবে। সবাই বুঝল যে চিড়ে ভিজবে না। প্রিয়তা এবার কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘বেশ বুঝেছি, কোন কিছু পেয়ে গেলে তার আর মূল্য থাকেনা। যে লোক বিয়ের আগের দিনই আমার ছোট্ট একটা ইচ্ছের মূল্য দেয়না, বিয়ের পর যখন পুরোনো হয়ে যাব তখন কতটা দেবে বোঝা হয়ে গেছে আমার। কিচ্ছু করতে হবেনা আপনাকে। আমিও করবোনা কিচ্ছু। রাখলাম।’

‘এসব কেমন বাচ্চামো কথা? আমি..হ্যালো? প্রিয়? প্রিয়?’

সাড়া পেলোনা রুদ্র। কল কেটে দিয়েছে প্রিয়তা। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা নামিয়ে রাখল রুদ্র। উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে দেখল, মিটমিটিয়ে হাসছে সে। রুদ্র বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এতো হাসার মতো কিছুই হয়নি। বিদেয় হ।’

উচ্ছ্বাস লাফিয়ে নামল রেলিং থেকে। সকৌতুকে বলল, ‘ যত বিশাল সিংহই হও বাছা। বউয়ের সামনে বেড়াল হয়েই থাকতে হবে। গোটা দেশ শাসন করে রাজা। কিন্তু রাজাকে শাসন করে রাণী। ইতিহাস, বর্তমান তাই বলে। ভবিষ্যতও একই কথা বলবে বলে আমার ধারণা। এ নিয়ম চিরন্তন। বিয়েটা হোক। সবই ক্রমশ প্রকাশ্য। ‘

রুদ্র চোখ পাকিয়ে তাকাতেই উচ্ছ্বাস কেটে পড়ল। অনেক কথা বলে ফেলেছে। এখন ওর সামনে থাকা মানেই বিপদ। ক্ষেপে আছে রুদ্র বারান্দা থেকে এক ধাক্কায় নিচে ফেলে দিলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

কিছুক্ষণ আগেই গায়ে হলুদ সম্পন্ন হল রুদ্রর। হ্যাঁ, প্রিয়তার জেদের কাছে হার মেনেছে সে। আপন বলতে কেউ নেই মেয়েটার। বিয়ে উপলক্ষ্যে হবু বরের কাছে এটুকু আবদার করতেই পারে। সবসময় জেদ চলেনা। বউয়ের জন্যে একটা দিন না হয় করল কম্প্রোমাইজ। এই বলেই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছে রুদ্র।
তবে গোটা ব্যপারটাতে বেশ বিরক্ত হয়েছে ও। রুদ্র রাজি হয়েছে শুনে কুহু, জ্যোতি, মীরা এসেছিল হলুদ মাখাতে। উচ্ছ্বাস একটু ক্ষেপাতে চেয়েছিল। কিন্তু এইমুহূর্তে রুদ্রকে না ঘাটানোই ভালো মনে করল। রুদ্র ওদের স্পষ্ট বলে দিয়েছে, যা করার দশ মিনিটের মধ্যে করতে। রুদ্রকে যমের মতো ভয় পায় সবাই। তাই ওকে বিরক্ত করার সাহস করেনি কেউ। কোনরকমে স্টেজ সাজিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করেছে। যদিও দশ মিনিটে কিছুই হয়নি। একঘন্টা লেগে গেছে সবটা শেষ করতে। রুদ্রর গায়ে হলুদ ছোঁয়াতে গিয়ে হাত কাঁপছিল কর্মচারীদের। এমনও দিন আসবে কোনদিন কল্পনাও করেনি তারা কেউ। আড়ালে সবাই ছোটসাহেব বলতে অজ্ঞান হলেও, সামনাসামনি যম সমতুল্য ভয় পায় রুদ্রকে। এই ব্যপারটা ওদের কাছে সিংহের মাথায় হাত বুলিয়ে আসার মতোই ছিল। এমন অসাধ্য সাধনের জন্যে প্রিয়তার প্রশংসার গুঞ্জনে মুখরিত হল আমের ভিলা।

গালে, কপালে হলুদ নিয়ে খুব বিরক্ত রুদ্র। অসহ্যকর অনুভূতি। এক্ষুনি শাওয়ার নেওয়ার তাগিদ অনুভব করল রুদ্র। দ্রুতপায়ে রুমে যাওয়ার সময় করিডরে দেখা হল জ্যোতির সঙ্গে। ওকে দেখেই হাসল জ্যোতি। তাচ্ছিল্য মিশে ছিল সেই হাসিতে। হাসতে হাসতেই বলল, ‘ বাড়িতে বউ না আসতেই দেখি তার গোলাম হয়ে গেছো দেখছি। এখনই আঙ্গুলের ইশারায় নাচাচ্ছে তোমাকে।’

রুদ্র জবাব দিলোনা। পাশ কাটিয়ে চলে গেল রুমে। মেয়েটা ইদানিং প্রায়ই খোঁচা দিয়ে কথা বলছে। ঠাট্টার ছলে। রুদ্র বুঝেও কিছু বলেনা। তাতেই সাহসটা আরও বেশি পাচ্ছে বোধ হয়। তবুও জ্যোতির মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে ছাড় দেয় রুদ্র। এড়িয়ে যায়। কিন্তু সবকিছুর-ই একটা সীমা আছে। সীমা পার হলে ছাড় দিতে পারবে কি-না জানেনা রুদ্র।
রুদ্রর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল জ্যোতি। এই ভালোবাসা, এই আনুগত্য, প্রশংসার গুঞ্জনতো শুধু ওর পাওনা ছিল। এটা ওর অধিকার। যা রুদ্র অন্যায়ভাবে অন্যকে দিয়ে দিচ্ছে। জ্যোতির এমনটাই ধারণা। চারপাশে প্রিয়তার এতো গুনগান, প্রিয়তার প্রতি সবার এতো ভালোবাসা, রুদ্রর এতো গুরুত্ব দেওয়া; এসব দেখে অস্বস্তি হচ্ছে ওর। চেষ্টা করেও স্থির রাখতে পারছেনা নিজেকে। কিন্তু এখন ওর স্থির থাকা ভীষণ প্রয়োজন। না চাইলেও সবটা মেনে নিতে হবে সবটা।

রুদ্রের গায়ে হলুদের কাজ শেষ করে; সবকিছু নিয়ে ভাড়া করা বাংলোতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আটটা বেজে গেল ওদের। প্রিয়তাকে সাজিয়ে, সব গোছগাছ করে রাত নয়টায় হলুদের অনুষ্ঠান শুরু করা হল। বাহিরের কোন অতিথি নেই। কেবল আমের ভিলার সদস্য, সার্ভেন্ট আর কর্মচারী। তবে এলাহী আয়োজন। নাচ, গান, খাওয়াদাওয়া যতরকমের ব্যবস্থা করা যায়, সব করা আছে। কোথাও কোন ত্রুটি নেই।
সকলের মাঝে হঠাৎ নাজিফাকে দেখে অবাক হল উচ্ছ্বাস। আজ ওর উপস্থিতি আশা করেনি ও। কাল আসার কথা ছিল। পরে জানতে পারল রাশেদ নিজেই ডেকেছেন ওকে আজ। হাতেহাতে সাহায্যের জন্যে।

অনুষ্ঠানের মাঝেই ওখানে উপস্থিত হলেন স্বয়ং রাশেদ আমের। ওনার উপস্থিতিতে হকচকিয়ে গেল সবাই। এই মুহূর্তে কেউ আশা করেনি তাকে। স্টেজে বসে থাকা প্রিয়তাও থমকে গেলো। স্থির চোখে তাকিয়ে রইল সেদিকে। রাশেদ দৃঢ় চলন এসে বসলেন ওর পাশে। হলুদের বাটি থেকে হালকা হলুদ নিয়ে ছুঁইয়ে দিলেন প্রিয়তার গালে। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছে। একি দৃশ্য! প্রিয়তা দ্বিধান্বিত চোখে তাকাল রাশেদের দিকে। রাশেদ ওর মাথায় আলতো করে হাত রেখে বললেন, ‘তোমার বাবা-মা থাকলে এটা তারাই করতেন। মেয়ে বলেছি তোমাকে। তাই বাবার দায়িত্ব পালন করে গেলাম। তোমার উপহার কাল আমের ভিলায় প্রবেশের সময় পাবে।’

বলে চামচে খানিকটা মিষ্টি তুলে এগিয়ে দিল প্রিয়তার মুখের দিকে। প্রিয়তা মৃদু হাসল। চোখের কোণে হঠাৎই জল জমা হল। অনেক কষ্টে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে মুখে নিল মিষ্টিটা।
আরও একবার অবাক হলো আমের ভিলার সঙ্গে জড়িত প্রতিটা মানুষ। প্রিয়তার আগমনে আরেক পরিবর্তনের সাক্ষী হলো তারা।
রাশেদ বেশিক্ষণ থাকলেন না। চারপাশটা ঘুরে সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখলেন একবার। এরপর চলে চলে গেলেন বাংলোটা ছেড়ে।

পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল উচ্ছ্বাস আর নাজিফা। এই দৃশ্য দেখে নাজিফা বলল, ‘ রাশেদ বাবার মতো শ্বশুর ভাগ্য করে পাওয়া যায়। তাইনা?

হাসল উচ্ছ্বাস। বলল, ‘ সে ভাগ্য বউমণি দখল করে নিয়েছে।’

‘আরেকজনও কিন্তু পাবে সেই সৌভাগ্য।’

উচ্ছ্বাস ভ্রু কোঁচকালো। বুঝতে না পেরে বলল, ‘কে পাবে?’

নাজিফা উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার বউ। উনি তোমাকে নিজের ছেলের মতোই দেখেন। আর তোমার বউকে প্রিয়তা ভাবির চেয়ে কম ভালোবাসবেন বলে মনে হয়না। সে হিসেবে তোমার বউও ভাগ্যবতী হবে।’

কথাটা বলে সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে ফেলল নাজিফা। উচ্ছ্বাস অপলক চোখে তাকিয়ে রইল নাজিফার দিকে। নাজিফা নিজের দিকে ইঙ্গিত করে বলল না-কি কথাটা? বেশি ভাবতে গেলোনা উচ্ছ্বাস। সবকিছু ভাবার অধিকার নেই ওর।

সকলের উপস্থিতি, আনন্দ, উৎসব, ছদ্মবেশী গোপন প্রহরীদের পাহারা; সব মিলিয়ে বেশ জমজমাটভাবেই রুদ্র-প্রিয়তার হলুদের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো।
কিন্তু কেউ বোঝেনি, উৎসবমুখর এই আনন্দ উৎসবকে ঘিরে ঘটছে হাড় হিম করা ভয়ানক এক ষড়যন্ত্র!

বিশ্বস্ত লোকদের কাজ বুঝিয়ে দিয়েও সন্তুষ্ট হতে পারেনি রুদ্র। নিরাপত্তার ব্যবস্থা ঠিক ওর নির্দেশনা মতো করা হয়েছে কি-না; নিজ চোখে না দেখে স্বস্তি নেই ওর। তাই রাত বারোটার দিকে নিজেই চলে এলো সেই বাংলোতে। রাতের আধারে হরেক রকমের লাইটে সুসজ্জিত বাংলোটা দেখতে অসাধারণ লাগছে।
পুরো এরিয়াটা হেঁটে হেঁটে নিজে সবটা দেখে তবেই সন্তুষ্ট হলো রুদ্র। সবার মুখে মুখে রাশেদের আচমকা এখানে আসা। প্রিয়তার হলুদ ছোঁয়ানোর কথাটাও শুনলো। আপন মনেই হাসল রুদ্র। প্রিয়তার কথা মনে পড়ল ওর। এখানে এসেছেই যখন একবার দেখা করে যাবে কি-না ভাবছে। তখনই ভয়ানক এক কাণ্ড ঘটল। হঠাৎই সব আলো নিভে গেল। পুরো বাংলোসহ এরিয়াটা অন্ধকার হয়ে গেল নিমেষেই। সকলের চেঁচামেচি, গুঞ্জন কয়েকগুন বেড়ে গেল এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায়।
আশঙ্কায় কেঁপে উঠল রুদ্রর বুক।

#চলবে…

#অন্তর্নিহিত_কালকূট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here