অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৪১.

0
3

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৪১.

স্ট্রেচারে করে লা-শ আনা হয়েছে গার্ডেন এরিয়ায়। কিছুক্ষণ আগেই নববধূর আগমনে গমগম করছিল চারপাশ। তা এখন পিনপতন নীরবতার রূপ নিয়েছে। রুদ্র আশেপাশেএকবার চোখ বুলিয়ে নিল। গাড়ি থেকে নেমেও দেখেছে। তবুও কুহু, জ্যোতি, মীরাকে সুরক্ষিত দাঁড়ানো দেখে ভেতরে ভেতরে স্বস্তি পেলো। রাশেদ আমের গম্ভীর গলায় বললেন, ‘কুহু মা, তুমি ঘরে যাও। প্রিয়তা, তুমিও ‍যাও কুহুর সাথে।’

কুহু লা-শের কথা শুনেই প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। বাকি সকলেই স্তম্ভিত। ইন্সপেক্টর আজিজ আপত্তি জানিয়ে বলল, ‘কুহু ভেতরে যাক। কিন্তু প্রিয়তা ম্যাডামকে একটু বাইরে যেতে হবে। উনি নববধূ। যেহুতু সব মহিলা সার্ভেন্ট ওনার জন্যেই রাখা হয়েছিল। হয়তো উনি কিছু বলতে পারবেন।’

রাশেদ আর আপত্তি করলেন না। রুদ্র কিছু বলতে গিয়েও বলল না। কুহু ব্যতিত বাড়ির সকলেই পা বাড়াল গার্ডেন এরিয়ার দিকে।

লা-শটা দেখেই রুদ্রর শেরওয়ানি খামচে ধরল প্রিয়তা। ওকে এক হাতে আগলে রাখল রুদ্র। বাহুতে মৃদু চাপ দিয়ে অভয় দিল। সকলেই গম্ভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে লা-শটাকে। গলায় ছু-রি গেঁথে দেওয়া হয়েছে। ফলে গভীর এক ক্ষ-ত সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। এছাড়া শরীরে আর কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই। চল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশের মতো হবে মহিলার বয়স। রাশেদ বা রুদ্র কেউই মহিলাকে চেনে না। মহিলা সার্ভেন্ট নিয়োগের দায়িত্বে উচ্ছ্বাস ছিল। ও-ই প্রত্যেকের ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে, নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তবেই নিয়োগ দিয়েছিল।

প্রিয়তা হঠাৎ বলে উঠল, ‘উনিতো আমাকে খাবার দিতে আসতেন। কাল রাতের ডিনারটাও উনিই দিয়ে গিয়েছিলেন আমায়।’

জ্যোতি সম্মতি জানিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ। প্রিয়তার খাবারের দায়িত্বে ছিলেন উনি।’

উচ্ছ্বাস বলল, ‘এদের সবাইকে এন্টার করার এপ্রুভাল আমিই দিয়েছি। আমার কাছে সবার ছবিসহ বায়োডাটা আছে। ওটা চেক করলেই আপনি এনার পরিচয় পেয়ে যাবেন।’

ইন্সপেক্টর আজিজ বলল, ‘থ্যাংক ইউ। দরকার হবে ওটা।’ তারপর লাশটার দিকে আরও একবার তাকিয়ে আবার বললেন, ‘দোতলায় করিডরের বাঁ দিকের কর্ণারের রুমটায় পাওয়া গেছে লাশটা। বাথরুমে। ঐ ঘরে কে ছিলো?’

উত্তরে রুদ্র বলল, ‘ঐ ঘরটা ফাঁকা ছিল। মাঝের দুটো ঘরের একটাতে কুহু আর জ্যোতি, অন্যটাতে প্রিয়তা আর মীরা ছিল। কর্ণারের কোন ঘরে ওদের রাখিনি আমরা।’

মাথা ঝাঁকাল ইন্সপেক্টর। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শেষ কখন ওনাকে দেখেছিলেন আপনি?’

প্রিয়তা দু সেকেন্ড ভেবে বলল, ‘ গতকাল রাতে। আমায় খাবার দিতে এসেছিল। বলেছিল আবার আসবে দুধ দিতে। কিন্তু আসেননি।’

ভ্রুকুটি করল আজিজ, ‘দুধ নিয়ে এলেন না! আপনি খোঁজ করেন নি?’

প্রিয়তা একবার জ্যোতির দিকে তাকাল। মাথা নিচু করে বলল, ‘দুধতো জ্যোতি আপু নিয়ে এসেছিল। তাই আমি আর..’

ইন্সপেক্টর আজিজ এবার জ্যোতির দিকে তাকাল। জ্যোতি নির্বিকার। ইন্সপেক্টর প্রশ্ন করার আগেই প্রশ্নটা করল রুদ্র, ‘তুই কেন এনেছিলি?’

জ্যোতি রুদ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নিচে পেঁয়াজ কাটার জন্যে লোক দরকার ছিল। তাই আমি ওকে নিচে পাঠিয়ে নিজেই দুধ নিয়ে আসছিলাম।’

স্পষ্ট, ভীতিহীন বক্তব্য। এবার আজিজ বলল, ‘এরপর আর দেখেননি ওনাকে?’

‘ না।’ একইভাবে স্পষ্ট জবাব দিল জ্যোতি।

ইন্সপেক্টর আজিজ আপনমনেই বলল, ‘ লা-শ বেশ কয়েক ঘন্টা আগের বলেই মনে হচ্ছে।’ এরপর রাশেদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনাদের সহযোগিতা লাগবে আমার। এস আই ফারুক পুরো বাংলোটা চেক করছেন। জিজ্ঞাসাবাদ করছে ওখানে উপস্থিত আপনাদের সব কর্মচারী এবং সার্ভেন্টদের। বিয়েতে উপস্থিত আপনাদের সকল স্টাফ, সার্ভেন্ট এবং বিয়েতে নিমন্ত্রিত অতিথিদের একটা লিস্ট চাই আমার। আজকের মধ্যেই দিতে পারলে খুশি হবো।’

ভ্রুকুটি করে দু সেকেন্ডের মতো চুপ থাকলেন রাশেদ। তারপর বললেন, ‘অবশ্যই। কিন্তু অযথা বিরক্ত করবেন না ওদের।’

প্রিয়তার দিকে একপলক তাকাল রুদ্র। ইন্সপেক্টরকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ওদের (মেয়েদের) এবার ভেতরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওদের কাছে আর কিছু জানার নেই নিশ্চয়ই।’

‘না, ওনারা এবার যেতে পারেন। তবে যেহেতু ছু-রিটা পাওয়া গেছে। প্রত্যেকের হাতের ছাপ দরকার হবে আমার। খুনি ইচ্ছে করে ছু-রিটা ছেড়ে যায়নি। সময়ের অভাবে ছু-রিটা নিয়ে পালাতে পারেনি। সুতরাং হাতের ছাপ পাওয়া যেতে পারে। একদম দক্ষ হাতে গাঁথা হয়েছে ছু-রিটা। ঠিক জায়গামতো লেগেছে। সোজা শ্বাসনালী। পাকা হাত।’

রুদ্রের কথামতো জ্যোতি আর মীরা প্রিয়তাকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। যাওয়ার আগে রুদ্রর দিকে ফিরে তাকাল প্রিয়তা। রুদ্র পুনরায় চোখ টিপে আশ্বস্ত করল ওকে।

ওরা চলে যেতেই আজিজ হাবিলদারদের ইশারা করল। তারা চলে গেল লাশটা নিয়ে। আজিজ যেতে নিয়েও থেমে গেল। রাশেদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘অদ্ভুত ব্যপার তাইনা? গুলশানে খুন বা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই আপনার কর্মচারীদের ওপর দিয়েই যায়। খোকন, সবুজ, তপু, স্বপন এখন এই মহিলা। বিপদ আপনাদের কাছে হেঁটে আসে? নাকি আপনারা নিজেরাই বিপদ?’

রাশেদ কিছু বললেন না। ইন্সপেক্টরের চোখে চোখ রেখে হাসলেন। ইন্সপেক্টর আজিজ হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ার ভান করে বলল, ‘ওও কর্মচারীর কথায় মনে পড়ল। আপনার আরেক কর্মচারী স্বপনকেও তো কেউ এভাবেই গলায় ছু-রি গেঁথে মেরেছিল তাইনা? মনে পড়ে?’

রাশেদ তীক্ষ্ম চোখে তাকালেন আজিজের চোখে। হেসে ফেললেন। রাশেদের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দেখে একটু অপ্রস্তুত হল আজিজ। তবে বুঝলো, খোঁচাটা জায়গা মতো লেগেছে। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল রুদ্র। ওনাদের সব কথাই শুনতে পাচ্ছিল। হঠাৎ বলে উঠল, ‘অথচ এতগুলো মাস কেটে গেলেও খু-নিকে খুঁজে বের করতে পারলেন না আপনি। ব্যাপারটা দুঃখজনক।’

পাল্টা খোঁচাটা হাসিমুখে হজম করে নিল আজিজ। অভ্যাসবশত গোঁফে আঙুল বুলিয়ে বললেন, ‘ দুঃখজনক-ই বটে। আমি পারিনি। হয়তো ভবিষ্যতে কেউ একজন আসবে। ‍যে এই সোলার সিস্টেম আর তার পেছনের লুকোনো গোপন রহস্য, সবটাই খুঁজে বের করবে। আমার না পারার সব গ্লানি মুছে দেবে সে।’

রাত ন’টা বাজে। প্রিয়তাকে জ্যোতি আর কুহুর ঘরেই রাখা হয়েছে। প্রিয়তা বাড়তি গহনা, ঘোমটা সব খুলে ফেলেছে। ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে হাত মুখ ধুয়ে। কুহু আর মীরা বসে আছে ওর দুপাশে। জ্যোতি রুমে নেই। হঠাৎই খু-নের ব্যপারটায় ভয় পেয়ে গিয়েছিল কুহু। এই প্রথম এরকম ঘটনা দেখল। রাশেদ আর রুদ্র এসব খু-ন, খারাবির আঁচটুকুও কখনও আসতে দেয়নি কুহুর গায়ে। প্রিয়তা আর মীরা ঠাট্টা মজা করে স্বাভাবিক করে ফেলেছে ওকে। রুদ্র যাওয়ার আগে প্রিয়তাকে ইশারায় বলে গিয়েছিল, কুহুকে সামলাতে। প্রিয়তা বুঝেছে। রুদ্র জানে প্রিয়তা আর মীরাও ভয় পেয়েছে। তবে কুহুর ব্যপারটা আলাদা।

হঠাৎই মীরা প্রিয়তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কোথায় এসে পড়লি বোন? আসতে না আসতেই লা-শ পড়ে গেল একটা। আগেই বলেছিলাম তোকে। দুলাভাইটাও কোথায় গিয়ে বসে আছে। আদৌও আজ তোদের বাসর হবে তো?’

প্রিয়তা ভ্র কুঁচকে তাকাল মীরার দিকে। চাপা গলায় বলল, ‘একটু চুপ থাকা যায় না?’

মীরা ঠোঁট ফোলালো। আঙুল দিয়ে চশমা ঠিক করে বলল, ‘ভালো কথার ভাত নাই।’

প্রিয়তা কিছু বলার আগেই জ্যোতি এলো। ওর পেছন পেছন দুজন মহিলা এলেন খাবার নিয়ে। মহিলা দুজন বিছানায় খাবার রেখে যেতে নিলে জ্যোতি বলল, ‘তোমরাও সবাই খেয়ে নিও। বোধ হয় অনেক রাত হবে ফিরতে ওদের।’

বলে প্রিয়তার দিকে তাকাল জ্যোতি। প্রিয়তাও তাকিয়ে আছে। মহিলা দুজন মাথা নেড়ি চলে গেল। জ্যোতি বিছানায় বসে বলল, ‘চারজন খাব তাই ঘরেই নিয়ে এলাম খাবারটা।’

কুহু ইশারায় প্রশ্ন করল, ‘বাবা, ভাইয়া ওরা আসবেনা?’

দেয়াল ঘড়ির দিকে একবার তাকাল জ্যোতি। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘জানিনা। ওদের ঠিকঠিকানা আছে না-কি?‍ যাই হোক। সারাদিন সবার অনেক ধকল গেছে। এবার খেয়ে নেওয়া উচিত। বিশেষ করে প্রিয়তার।’

প্রিয়তা খানিকটা ইতস্তত করল। নিচু গলায় বলল, ‘ওনার সঙ্গে কথা হয়েছে তোমার?’

জ্যোতি প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে চোখে হাসল। প্লেটগুলো সাজিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘কথা হলেতো বলতেই পারতাম কখন আসবে। হয় নি।’

মীরা চশমা ঠিক করে বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘এটা কেমন কথা? আজতো ওদের বাসর। বাসর রাতে বর থাকবেনা? এটা কিছু হল!’

জ্যোতি জবাব দিলো না। প্রিয়তা কনুই এর খোঁচা দিল মীরাকে। চোখ রাঙিয়ে বলল চুপ থাকতে। কুহুও মুখ গোমড়া করে ফেলল। আজই এমন হতে হলো?

করিডরের জয়েন্ট ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা। এখান থেকে বাইরের গেইটটা স্পষ্ট দেখা যায়। প্রিয়তা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে গেইটের দিকে। মনটা খারাপ হয়ে গেছে ওর। রাত একটা বাজে। অথচ রুদ্র আসেনি। উচ্ছ্বাস ফোন করেছিল। ওদের ঘুমিয়ে পড়তে বলেছে। ওরা রাতে কখন ফিরবে ঠিক নেই। কুহু, জ্যোতি, মীরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কুহু আর জ্যোতি তাদের ঘরে। প্রিয়তা মীরার সঙ্গে গেস্ট রুমটাতেই শুয়ে ছিল এতক্ষণ। ওখানেই শোবে। রুদ্রের ঘরে ঘুমাতে বলা হয়েছিল ওকে। কিন্তু ও যায়নি। অভিমানের ঘন মেঘ জমে আছে মনে। মনটা খারাপ। তাইতো বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে।
হঠাৎ প্রিয়তার মনে হল ওর ঠিক পেছনে কেউ আছে। অদ্ভুত অনুভূতি হল ওর। আচমকাই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকিয়ে চমকে উঠল ও। কোনমতে রেলিং ধরে সামলে নিল নিজেকে।
জ্যোতি দাঁড়িয়ে আছে। জ্যোতিকে দেখে স্বস্তি পেল প্রিয়তা। জ্যোতি এগিয়ে এসে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বলল, ‘ভয় পেলে?’

‘ঘুমাও নি তুমি?’

‘না, পানি আনতে গিয়েছিলাম নিচে। তোমাকে দেখতে পেয়ে এলাম।’

‘ওহ।’

‘মন খারাপ?’

প্রিয়তা তাকাল জ্যোতির দিকে। কিছু বলল না। জ্যোতি বলল, ‘এতো অল্পতেই মন খারাপ করোনা। অভ্যেস করে নাও। এগুলো রুদ্রর জীবনের রোজকার ঘটনা। রুদ্র আমেরকে যখন বিয়ে করেছো তুমি। যখন করেছোই, তখন আর পাঁচটা দাম্পত্য জীবনের মতো স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন আশা করোনা। রুদ্রের সাথে সাথে মৃ-ত্যু, বিপদ, লা-শ, খু-ন এগুলোও মেনে নিতে হবে তোমায়। ওর জীবনটাই এসবের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তবে আজকের রাতটায় এমন না হলেও পারতো। মানছি।’

প্রিয়তা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল জ্যোতির দিকে। মৃদু হেসে বলল, ‘ওনাকে খুব ভালো করে চেনো তুমি তাইনা?’

জ্যোতিও হাসল। যেন হারিয়ে গেল গভীর অতীতে। আনমনে বলল, ‘ছোটবেলা থেকে। ওকে দেখেইতো আমার শৈশব, কৈশোর সব কেটেছে। ওর সবটা আমার মুখস্থ।’

প্রিয়তা বিস্মিত চোখে তাকাল জ্যোতির দিকে। তবে কী ওর ধারণাই ঠিক? নিজেই নিজেকেই প্রশ্ন করল একবার। জ্যোতি প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘যাই হোক। তুমি রুদ্রের ওপর রাগ করোনা। বুঝতেই পারছো খু-নের ব্যাপার। চেষ্টা করেও হয়তো আসতে পারছেনা বেচারা।’

প্রিয়তা কিছু না বলে মাথা নিচু করে ফেলল। খুনের ব্যাপারটা মাথায় আসতেই রোমাঞ্চ অনুভব করল ও। কালকে অবধি যেই মানুষটা ওকে খাবার দিয়ে যেতো। মিষ্টি করে ‘ছোট ম্যাডাম’ বলে ডাকতো। সে আজ নেই! হঠাৎই জ্যোতি ভীষণ ঠান্ডা গলায় বলল, ‘ঐ ছু-রিটা কিন্তু তোমার গলায়ও বসতে পারতো প্রিয়তা। কে বলতে পারে, ছু-রিটা হয়তো তোমার গলাতেই বসার কথা ছিল।’

চকিতে তাকাল প্রিয়তা। দু চোখে ভয় স্পষ্ট। প্রিয়তাকে ভয় পেতে দেখে উচ্চস্বরে হেসে উঠল জ্যোতি। জ্যোতির হাসির আওয়াজে আরও ভয় পেল মেয়েটা। শিরদাঁড়ার বেয়ে যেন ঠান্ডা, শীতল স্রোত নেমে গেল। জ্যোতি কোনমতে হাসি থামিয়ে বলল, ‘রুদ্র আমেরের বউ হয়ে এতো ভয় পেলে চলবে? ভুলে যেওনা রুদ্রের অন্যতম দুর্বল জায়গা হয়ে গেছো তুমি। আর বুদ্ধিমানেরা সবসময় শত্রুর দুর্বল জায়গাতেই আঘাত করে। রুদ্রের শত্রুর যে অভাব নেই, তুমি তা জানো। সাবধানে থাকো।’

প্রিয়তা এখনো তাকিয়ে আছে জ্যোতির দিকে। ঘামে ভিজে গেল ওর হাত-পা। জ্যোতি প্রিয়তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘যাও ঘুমিয়ে পড়। মন খারাপ করো না এখন।’

গভীর রাত। আমের ফাউন্ডেশনের অফিসে গম্ভীর মুখে বসে আছে দলের প্রধান পাঁচজন। কারো মুখে কোন কথা নেই। স্তব্ধ, নীরব পরিবেশ। ঘরে তেমন আলোও নেই। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে কেবল। সব ঝামেলা মিটিয়ে এতক্ষণে আলোচনায় বসার সুযোগ পেয়েছে তারা। নীরবতা ভেঙ্গে সবার আগে বলল জাফর, ‘বাংলোর এতো কড়া প্রটেকশনের মাঝে এমন কাজ করার সাহস করল কে? আর কাজটা করে বের হল কীকরে?’

ইকবাল বলল, ‘বের হয়নি। গার্ডদের জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি। সন্দেহভাজন কাউকে বের হতে বা ঢুকতে দেখা যায়নি। হয় ভেতরের কেউ, নয়তো ইনভাইটেডদের মধ্যে কেউ করেছে কাজটা। কিন্তু একজন সার্ভেন্টকে মেরে কার কী লাভ হলো?’

উচ্ছ্বাস হাতে ধরে রাখা কাগজে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘ ঐ মহিলার বায়োডাটা দেখেছি আমি। উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই নেই। সাধারণ একজন গরিব মহিলা।’

খানিকক্ষণ ভাবল রুদ্র। গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘উদ্দেশ্য ঐ মহিলা ছিলোনা। যেই খু-নটা করে থাকুক, তার উদ্দেশ্য অন্যকিছু ছিল। কিন্তু এমন কিছু হয়েছে যার কারণে ঐ মহিলাকে মা-র-তে হয়েছে তার। আর আমি বোধ হয় জানি খুনটা কখন হয়েছে।’

অবাক হল উপস্থিত সবাই। নড়েচড়ে বসল। রুদ্র সবার দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে বলল, ‘কাল বারোটার পর আমি একবার গিয়েছিলাম ঐ বাংলোতে। সবটা নিজে একবার দেখে নিতে। হঠাৎই লাইট চলে যায় কিছুক্ষণের জন্যে। প্রিয়তা ঠিক আছে কিনা দেখতে যখন আমি বাংলোতে ঢুকলাম, তখন করিডরে কারো উপস্থিতি টের পেয়েছিলাম আমি। প্রিয়তাও একই কথা বলেছে। ইন্সপেক্টরও কিছুক্ষণ আগে জানালো যে খুনটা কাল রাত এগারোটা থেকে একটার মাঝে হয়েছে। আমার ধারণা লাইট অফ থাকার ঐ সময়টাতেই খু-নটা হয়েছে। কিন্তু খু-নি ঠিক কাকে মা-র-যে এসেছিল ওখানে, ঐ মহিলাকেই বা মা-র-তে হলো কেন? এটাই আসল প্রশ্ন।

ইকবাল আবার বলল, ‘ভাগ্যিস আমরা বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র লোকগুলো সব বেরিয়ে গিয়েছিল। ওরা থেকে গেলে বাকি কর্মচারীদের মতো পুলিশ ওদেরও আটকে দিতো। আর সার্চ করে বেআইনি অস্ত্রগুলো পুলিশ হাতে পেলে ফেঁসে যেতাম আমরা।’

এতক্ষণ সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে সবার বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন রাশেদ। সবাই থামার পর ধীরেসুস্থে উনি বললেন, ‘এই প্রথম আমাদের সঙ্গে জড়িত কোন খু-নের কেস সরাসরি পুলিশের কাছে গেল। ব্যপারটা ছোট করে দেখার মতো না।’

অ‍্যাশট্রেতে ছাই ঝাড়লেন রাশেদ। আবার বলতে শুরু করলেন, ‘পুলিশ যাতে কোনভাবেই খু-নির কাছে পৌঁছতে না পারে সেটাই দেখো। দরকারে নিজেরাই খু-নিকে খুঁজে বের কর। মে-রে ফেল। বিয়ের সব ঝামেলা আশা করি কালকের মধ্যেই মিটে যাবে। এরপরেই আবার মিটিং এ বসব আমরা। হাতে সময় কম। সামনের সপ্তাহ থেকে অফিশিয়ালি নতুন কাজটায় হাত দেব আমরা।’

তারপর উচ্ছ্বাসকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘ যেই মহিলা মা’রা গেছে তাদের বাড়িতে পর্যাপ্ত টাকা পাঠিয়ে দিও। আর যেকোন সমস্যায় পড়লে যাতে আমের ফাউন্ডেশনে আসে। আজ থেকে ঐ পরিবারের সকল দায়িত্ব আমের ফাউন্ডেশনের।’

রাশেদের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়েই শেষ হল অনাকাঙ্ক্ষিত, আচমকা বসা ছোট্ট মিটিং।

রাত সাড়ে তিনটায় বাড়ি ফিরল ওরা সবাই। সবার শেষে ভেতরে ঢুকলো রুদ্র আর উচ্ছ্বাস। সিঁড়িতে ওঠার সময় উচ্ছ্বাস সকৌতুকে বলল, ‘আজ তোর বাসর গেল। দেখ গিয়ে বউ গাল ফুলিয়ে রেখেছে। একেই বলে কপাল। বাসরটাও মিস, বউয়ের ঝাড়ি বোনাস! হ্যাপি ফার্স্ট নাইট বস।’

রুদ্র কিছু বলল না। ক্লান্ত ও। তারওপর মনটাও ভালো নেই। উচ্ছ্বাসও আর খোঁচালোনা। যথেষ্ট হয়েছে আজ।
নিজের ঘরে গিয়ে প্রিয়তাকে দেখতে না পেয়ে একটু অবাকই হল রুদ্র। ওয়াশরুম, বারান্দাতেও চেক করল। না পেয়ে বুঝলো অন্যঘরে ঘুমিয়েছে। অনুমান করল, মীরার সাথেই ঘুমিয়েছে তার বউ। চেঞ্জ না করেই বেরিয়ে গেল মীরার ঘরের দিকে। দরজাটা ভিড়ানো ছিল। আলতো করে দরজাটা ফাঁক করতেই দেখতে পেল প্রিয়তাকে। ঘুমোচ্ছে। হয়তো নীরবে অপেক্ষা করছিল ওর জন্যে। মনে অভিমানের মেঘ জমিয়ে রেখেছে নিশ্চয়ই। এতো রাতে আর ওদের বিরক্ত করল না রুদ্র। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে এলো নিজের ঘরে। ওরও ঘুম পেয়েছে। বিশ্রাম দরকার।

বেশ বেলা হয়েছে। কড়া রোদ ছড়িয়ে পড়েছে রুমজুড়ে। এখনো বিছানা ছাড়েনি রুদ্র। স্যান্ডো গ্যাঞ্জি আর পাজামা পরা অবস্থাতেই উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। প্রায় ভোররাতে বাড়ি ফিরেছে ও। সবাই জানে। তাই কেউ আর ডিস্টার্ব করেনি ওকে। প্রিয়তা সকাল সকালই রুদ্রর ঘরে চলে এসেছে লাগেজ নিয়ে। মনে মনে রেগে আছে ঠিকই, তবে আজ থেকেতো এ ঘরেই থাকতে হবে। রুদ্রের ওয়াশরুমেই ঢুকেছে গোসল করতে। বেরিয়ে এসে দেখল এখনো ঘুমোচ্ছে রুদ্র। প্রিয়তা চোখ সরিয়ে নিল। কাবার্ড খুলে রুদ্রর পোশাকগুলো সরিয়ে রাখল একপাশে। লাগেজ থেকে নিজের জামাকাপড় গুলো বের করে সাজিয়ে রাখতে শুরু করল। টুকটাক আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল রুদ্রর। তাকিয়ে দেখল প্রিয়তা ওর কার্বাড দখল করছে। দু সেকেন্ডর জন্যে বোকা বনে গিয়েছিল রুদ্র। স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। তখন গিয়ে মনে পড়ল গতকালই বিয়ে করেছে ও। প্রিয়তা এখন ওর বউ। মৃদু হেসে প্রিয়তাকে লক্ষ্য করল রুদ্র। গাঢ় গোলাপি রঙের শাড়ি জড়িয়েছে গায়ে। ভেজা চুল, স্নিগ্ধ মুখ। অপূর্ব লাগছে। রুদ্র আস্তে করে উঠে বসল।

প্রিয়তা নিজের কাজে মগ্ন। খেয়াল করেনি যে রুদ্র জেগে গেছে। পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেতেই ঘুরে তাকাল ও। রুদ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অপ্রস্তুত হল। পিছিয়ে গেলো দু পা। কপালের ভেজা চুলগুলো সরিয়ে নিল হাত দিয়ে। পাশ কাটাতে গেলে দু বাহু ধরে আটকে ফেলল রুদ্র। প্রিয়তা দাঁড়িয়ে রইল মাথা নিচু করে।
রুদ্র কয়েক সেকেন্ড মনোযোগ দিয়ে দেখল প্রিয়তাকে। তারপর নরম গলায় বলল, ‘কালকে রাতের জন্যে দুঃখিত। এমনভাবে আটকে গিয়েছিলাম যে_’

প্রিয়তা জবাব দিলোনা। তাকালোও না। রুদ্র হাসল। দু হাত গালে রেখে উঁচু করে ধরল অভিমানিনীর মুখ। প্রিয়তা তবুও তাকালো না। রুদ্র বলল, ‘মাফ করবেনা?’

প্রিয়তা এবার তাকাল রুদ্রের চোখে। গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। নিচে সবাই অপেক্ষা করছে।’

বলে নিজেকে ছাড়িয়ে চলে গেল। রুদ্রও আটকানোর চেষ্টা করল না। প্রিয়তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আপনমনেই হাসল। ভাবল, এখন পালাচ্ছো পালাও। রাতে কোথায় পালাও সেটাই দেখব।

আধঘন্টা পর নিচে নামল রুদ্র। নিচে নেমেই ভ্রু কুঁচকে গেল ওর। সবাই হলরুমেই উপস্থিত। ইন্সপেক্টর আজিজ এসেছে। কিছু বলছেন উনি। আরেকটু এগোতেই রুদ্র শুনতে পেল সব কথা। আজিজ বলছে, ‘মহিলা সার্ভেন্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছি আমি। সেই মহিলা পেঁয়াজ কাটতে নিচে যায়নি। অর্থাৎ আপনাকে দুধের গ্লাস দিয়ে উনি নিচে নামেন নি।’

রুদ্রের দিকে চোখ পড়তেই একবার থামল। আবার বলল, ‘আর ছু-রিটাও আপনাদের ওখানকার ছু-রি। ওখানকার কাজের জন্যে যে ছু-রিগুলো আনা হয়েছিল তারই একটা দিয়ে খু-নটা হয়েছে। অনেক হাতের ছাপও পাওয়া গেছে। সার্ভেন্টদের হাতের ছাপ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তবুও আমরা ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচ করাব। অস্বাভাবিক কেউ অর্থাৎ কাজের লোক ছাড়া আর কারো হাতের ছাপ পাওয়া যায় কি-না দেখার জন্য। ‘

সবাই তাকিয়ে রইল ইন্সপেক্টরের দিকে। তারমানে আরও একটা অপেক্ষা। ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিপোর্ট আসার।

#চলবে…

#অন্তর্নিহিত_কালকূট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here