অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল
৪৩.
রোদ ঝলমলে মিষ্টি সকাল। গতকাল ঝড় হওয়াতে আকাশটা পরিষ্কার। এক টুকরো মেঘেরও দেখা নেই। ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গেছে রুদ্র-প্রিয়তার। বেলা অনেক হয়েছে। কিন্তু কেউ ডাকতে আসেনি ওদের।
রুদ্র শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে দেখল প্রিয়তাকে। আজ হাতা ছেড়ে দিয়ে বাসন্তি রঙের শাড়ি জড়িয়েছে গায়ে। সঙ্গে লাল রঙের ব্লাউজ। ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে আছে পিঠজুড়ে। ড্রেসিং-টেবিলের সামনে বসে লোশন মাখছে গায়ে। লোশনের মিষ্টি ঘ্রাণ গোটা রুমে ছড়িয়ে গেছে। দ্রুত হাত চলছে প্রিয়তার। কেমন শুকনো দেখাচ্ছে মুখটা। মন ভালো নেই নাকি! ঘুম থেকে উঠে এখনো প্রিয়তাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করার সুযোগ পায়নি রুদ্র। মেয়েটা ওকে জাগিয়ে দিয়েই শাওয়ার নিতে চলে গেছে। শাওয়ার নিয়ে বের হওয়ার সাথেসাথেই ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিয়েছে রুদ্রকে। দেরী হওয়ার অযুহাতে।
রুদ্রকে দেখেই ঝট করে উঠে দাঁড়াল প্রিয়তা। চোখ সরিয়ে ব্যস্ত সুরে বলল, ‘আপনার হয়ে গেছে? ব্রেকফাস্ট নিচে করবেন নাকি নিয়ে আসব?’
‘অনেক বেলা হয়ে গেছে। ঘরেই নিয়ে এসো।’
প্রিয়তা রুদ্রর দিকে না তাকিয়েই দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠেই রুদ্রকে এড়িয়ে যাচ্ছেন মেয়েটা। কারণটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি রুদ্রর। গতরাতের সেই মুহূর্তগুলো মনে পড়ল। কী স্বর্গীয় অনুভূতি! অনেক মেয়েকেই নিজের শয্যাসঙ্গিনী বানিয়েছিল ও। তাতে কেবল জৈবিক চাহিদা ছিল। আর কিছুই না। অথচ কাল প্রিয়তার সংস্পর্শে থাকা প্রতিটা সেকেন্ড কত শান্তিময়, তৃপ্তিময়, অনুভূতিময় ছিলো। ওর একেকটা স্পর্শে কেমন অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠছিল প্রিয়তা। প্রিয়তার শরীরের প্রতিটা কম্পনে রুদ্র নিজেও শিউরে উঠছিল। কী পবিত্র অনুভূতি! কতো স্বস্তি! বৈধতার স্বস্তি। এর আগে কোনদিন এরকম অনুভব করেনি রুদ্র। একটা সময় পর প্রিয়তাও লাজ-লজ্জা ভুলে গিয়েছিল। বিভোর হয়ে গিয়েছিল রুদ্রতে। নিজের সেই আচরণের লজ্জাতেই শেষরাতে মুখ লুকিয়েছিল রুদ্রর উন্মুক্ত বুকে। রুদ্র ফিসফিসিয়ে ডেকেছিল, ‘প্রিয়, তাকাও।’
তাকায়নি প্রিয়তা। আরও গভীরভাবে নিজের মুখ লুকিয়ে ফেলেছিল সবচেয়ে প্রিয় বক্ষস্থলে। রুদ্রও আর ডাকেনি। প্রেয়সীকে বুকে আগলেই ঢলে পড়ে শান্তির ঘুমে।
কিন্তু সেইযে মেয়ে মুখ লুকোলো, এরপর আর ঠিককরে তাকায়নি রুদ্রর দিকে। একটা বিষয় নিয়ে আফসোস হয় রুদ্রর। যদি প্রিয়তা ওর স্পর্শ করা প্রথম নারী হতো! নিজের কোন কাজের জন্যেই আফসোস বা অনুতাপ ছিলোনা রুদ্রর। এই প্রথমবার হচ্ছে। কিন্তু অতীতকে চাইলেও বদলানো যায়না। যা ঘটে গেছে তাতে আর কিছু করার নেই ওর। তবে যে হাতে একবার নিজের প্রিয়কে স্পর্শ করেছে, সেইহাতে কোনদিন অন্যকোন মেয়েকে স্পর্শ করতে পারবেনা ও। চাইলেও পারবেনা। সেই সাহস, ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনটাই ওর নেই।
–
প্রিয়তা সিঁড়ি বেয়ে নামতেই দৌড়ে এলো কুহু। দু হাতে জাপটে ধরে দুবার দোল খেলো। প্রিয়তা প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও পর হেসে ফেলল। নিজেকে ছাড়িয়ে কুহুর দুটো গাল টেনে দিয়ে বলল, ‘এতো খুশি কেন মিষ্টি ননদিনী? কী হয়েছে?’
কুহু ইশারায় করে কিছু বলল। প্রিয়তা বুঝল না। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমিতো এখনো বুঝিনা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ।’
উচ্ছ্বাস সোফাতেই বসে ছিল। কফি খাচ্ছিল। ওদের কথা শুনে সকৌতুকে বলল, ‘ওটা স্পেশাল ল্যাঙ্গুয়েজ বউমনি। দ্য ডান্সিং ল্যাঙ্গুয়েজ। আমিও বুঝিনা।’
প্রিয়তা বলল, ‘ কত্তো কিউট একটা ল্যাঙ্গুয়েজ। আপনি এতোদিনেও শিখতে পারেননি সেটা আপনার ব্যর্থতা। তবে আমিতো শিখে নেব। কুহু বলেছে। শিখিয়ে দেবে আমাকে।’
কুহু উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে সদম্ভে ভ্রু নাচাল। অর্থাৎ “দেখেছো?” উচ্ছ্বাস মুখ ছোট করে প্রিয়তাকে বলল, ‘এটা কেমন হলো বউমনি? এসেই ননদের দলে ভিড়ে গেলে! দেবরটাকে চোখে পড়ল না?’
কুহু জিভ বের করে ভেংচি কাটল। উচ্ছ্বাস চোখ পাকিয়ে চড় দেখালো ওকে। ভাইবোনের খুনশুটি দেখে ঠোঁট চেপে হাসল প্রিয়তা। দ্বিতীয়বার এখানে আসার পর উচ্ছ্বাসের সাথে মাঝেমাঝে কথাবার্তা হয়েছে ওর। বিয়ের সুত্রে তা আরও বেড়েছে। দুজনে এখনো খুব বেশি ফ্রী না, কিন্তু স্বাভাবিক। প্রিয়তা উচ্ছ্বাস আর কুহুকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তোমরা খেয়েছো?’
দুজনেই সম্মতি জানালো। প্রিয়তা এবার রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। পথেই দেখা হল জ্যোতির সঙ্গে। জ্যোতিকে দেখে হাসল প্রিয়তা। উত্তরে জ্যোতিও হাসি দিল। এগিয়ে এসে বলল, ‘এতো তাড়াতাড়ি নেমে এলে যে?’
প্রিয়তা অস্বস্তিবোধ করল। ওর জানামতে ও বেশ দেরী করে উঠেছে। নামতেও দেরী করেছে। তাই খানিকটা ইতস্তত করে বলল, ‘দুঃখিত। আসলে ঘুম থেকে উঠতে দেরী_’
জ্যোতি এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করছিল প্রিয়তাকে। তীক্ষ্ণ চোখে দেখছিল প্রিয়তার ভেজা চুল, গলায় ঘাড়ে থাকা অস্পষ্ট লালচে দাগ। কোনমতে নিঃশ্বাস আটকে ক্লিষ্ট হাসল জ্যোতি। ধীরসুস্থে বলল, ‘দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। আজকের সকালে উঠতে একটু দেরী হবে এটাই স্বাভাবিক।’
হঠাৎই লজ্জা পেলো প্রিয়তা। দ্রুত কথা ঘোরাতে বলল, ‘বাবা, কাকা সবাই খেয়েছেন?’
‘ হ্যাঁ, ওনারা খেয়ে-দেয়ে অনেক আগেই বেরিয়ে গেছেন। আর সবাইকে বলে গেছেন খুব দরকার ছাড়া তোমাদের না ডাকতে।’
প্রিয়তার কান লাল হয়ে উঠল। এ কেমন বাড়ি! মুখে বলল, ‘ইশ! আমার আগেই উঠে যাওয়া উচিত ছিল।’
ব্যপারটা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে জ্যোতি বলল, ‘ছাড়োতো! এটাকে টিপিকাল শ্বশুরবাড়ির মতো ভেবোনা। এখানকার লোকজন সবাই ইউনিক। এখানে তোমাকে ঘুম, খাওয়া, কাজ নিয়ে খোটা দেওয়ার মতো কেউ নেই। শাশুড়ি না থাকার একটা সুবিধা বলতে পারো। তাছাড়া দ্য রুদ্র আমেরের বউকে কে কী বলবে? যাক গে, তোমরা কী ওপরে খাবে নাকি নিচে? সবার কিন্তু খাওয়া শেষ। তোমরা দুজনেই বাকি।’
‘ব্রেকফাস্টটা ওপরেই নিয়ে যাই। এখন নিচে নামবেন না উনি। আর মীরা কী ওঠেনি এখনো?’
‘উঠেছিল। খেয়ে এখন আবার ঘুমোচ্ছে। রাতে নাকি এলার্জি উঠেছিল বলে ঘুমাতে পারেনি ঠিকভাবে। তুমি কিচেনে যাও। নার্গিস খালা বা অন্যকেউ খাবার দিয়ে দেবে।’
প্রিয়তা মাথা নেড়ে ভেতরে চলে গেল। জ্যোতি দমবন্ধকর অনুভূতি নিয়ে ফিরে এলো সেখান থেকে। সপ্তাহখানেক আগে অবধি এই কাজগুলো ও-ই করতো। ওকে বারণ করার পরেও করতো। খুশি মনে। কিন্তু আজ সেই অধিকার ওর নেই। এখন রুদ্রর দেখাশোনা করার জন্যে স্থায়ীভাবে কেউ এসে গেছে। রুদ্রর স্ত্রী। রুদ্রর সবকিছুতেই এখন তারই অধিকার। শুধু রুদ্রর ওপর নয়। এই বাড়ির ওপরেও প্রিয়তার অধিকার। এটা প্রিয়তার নিজের সংসার। জ্যোতি কেবলই এক বাইরের মেয়ে মাত্র। আশ্রিতা!
জ্যোতি বসার ঘরে গিয়ে দেখল উচ্ছ্বাস আর কুহুর খুনশুটি, ঝগড়া। দুজনে মুখে মুখে ঝগড়া করছে। মাঝেমাঝে মা-রছে একে অপরকে। রাশেদও বাইরে নিজের কাজে ব্যস্ত। সবাই ঠিক আছে। সবাই নিজেদের মতো ভালো আছে। ওর মনের খেয়াল রাখার মতো কেউ নেই। ইদানিং ওর মনে হয় সত্যিই এ বাড়ির আশ্রিতা ও। কেউ কোনদিন ওর কথা ভাবেনি। গুরুত্ব দেয়নি। ওর সত্যিই কোন দাম নেই এ বাড়িতে।
–
প্রিয়তা ওদের খাবার নিয়ে ঘরে ফিরে এলো। দেখল, রুদ্র বিছানায় হেলান দিয়ে ফোন দেখছে। প্রিয়তা সামান্য গলা ঝেড়ে রুদ্রর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। রুদ্র তাকাল। প্রিয়তা ট্রেটা বিছানার ওপর রাখল। নিচু গলায় বলল, ‘আপনি খেয়ে নিন। আমি একটু আসছি।’
বলে প্রিয়তা চলে যেতে নিচ্ছিল। হাত ধরে ফেলল রুদ্র। প্রিয়তা দাঁড়িয়ে গেল। রুদ্র মাঝারি গোছের এক টান দিয়ে নিজের কোলে বসালো ওকে। প্রিয়তা হতবাক হয়ে তাকাল। রুদ্র ওর কোমর চেপে ধরে বলল, ‘সকাল থেকে এভাবে পালাচ্ছো কেন?’
‘কই পালাচ্ছি? ওয়াশরুমে জামা রেখে এসছেন। ধুয়ে আসছিতো।’
‘খেয়েছো?’
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকাল রুদ্রর দিকে। বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আমিতো রোবট। দেখলেন না নিচে গেলাম আর এলাম। এতো অল্প সময়ে খাওয়া যায় বুঝি?’
রুদ্র হাসল। প্রিয়তার ভেজা চুল নেড়ে দিয়ে বলল, ‘এইতো! মুখে খই ফুটেছে। তোমাকে এভাবেই ভালো লাগে। তুমি চুপচাপ থাকলে আমার মনটাও কেমন খারাপ হয়ে যায়। চুপ থাকবে না।’
রুদ্রর এতো সহজভাবে কথা বলাতে ওর সংকোচটাও কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ও রুদ্রর চুলে মাঝে আঙুল গলিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমাকে ছেড়ে খেয়ে নিন এবার। বের হবেন না আজ?’
রুদ্র প্রিয়তার চোখে চোখ রেখেই হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল। এরপর হাত বাড়িয়ে নিয়ে এলো খাবারের ট্রেটা। খাবার তুলে প্রিয়তার মুখের সামনে নিয়ে বলল, ‘হা করো।’
প্রিয়তা কথা না বাড়িয়ে হা করল। রুদ্র নিজের হাতেই খাইয়ে দিল প্রিয়তাকে। সঙ্গে নিজেও খেলো। খাওয়া শেষে প্রিয়তা বাসনগুলো নিচে রেখে আবার ফিরে এলো রুমে। আসতেই রুদ্র বলল, ‘প্রিয়, বাবা কল করেছিল। বের হবো আমি। আমার পোশাকটা বার করে দাও।’
প্রিয়তা খানিকটা অবাক হয়ে বলল, ‘আমি?’
ভ্রু কুঁচকে ফেলল রুদ্র। আড়চোখে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার কী আরও দু চারটা বউ আছে?’
প্রিয়তা গিয়ে কাবার্ড খুলতে খুলতে বলল, ‘এখন তো দূরের কথা। আমি মরে গেলেও যদি অন্যকারো দিকে চোখ তুলে তাকান না, পেত্নী হয়ে এসে আপনার ঘাড় মটকাবো বলে দিলাম। যা আমার, তা শুধুমাত্র আমারই। আপনি আমার। মানে আমারই মিস্টার।’
রুদ্র মুখটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল। কিছু বলতে গিয়েও বলল না। পোশাক পরে তৈরী হয়ে নিল। জ্যাকেটটা প্রিয়তাই পরিয়ে দিল। পরানোর সময় রুদ্র প্রিয়তার কোমরে দুহাত রেখে বলল, ‘মন খারাপ কেন? সকাল থেকে লক্ষ্য করছি। কী হয়েছে?’
‘কই? কিছুনা।’
‘আমাকে কখনও মিথ্যে বলবেনা প্রিয়। পছন্দ না আমার।’
প্রিয়তা হাত থেমে গেল। অযথাই জ্যাকেটের জিপার নাড়তে নাড়তে ব্যথিত গলায় বলল, ‘আমার যদি একটা পরিবার থাকতো! আজ সকালে আমরাও সেই বাড়িতে যেতাম তাইনা? আমার মা আপনাকে যত্ন করে রান্না করে খাওয়াতো। আপনি বাজার করতেন। বাড়ির সবাই একসঙ্গে মজা করতো। সবকিছু কত সুন্দর হতো।’
রুদ্র মৃদু হাসল। প্রিয়তার দু গালে হাত রেখে বলল, ‘জীবন একটাই প্রিয়। আর এক জীবনে সবার সবকিছু থাকেনা। অপূর্ণতা নিয়েই জীবন। তাই এসব নিয়ে মন খারাপ করোনা। তাড়াতাড়ি চলে আসব আজ। বিকেলে তোমাকে নিয়ে আশেপাশে কোথাও থেকে ঘুরে আসব। ভালো লাগবে।’
প্রিয়তা মুচকি হাসল। চোখের ইশারায় বোঝালো, ঠিক আছে। রুদ্র খুব সযত্নে, সময় নিয়ে চুমু খেলো প্রেয়সীর কপালে।
–
চট্টগ্রাম শহর। শহরের প্রায় শেষপ্রান্তে ব্লাক হোল গ্রুপের লীডার, করিম তাজওয়ারের নিজস্ব বাড়ি। আগে ঢাকাতেই থাকতেন ওনারা। কিন্তু সোলার সিস্টেমের তোপের কারণে ওখানে থাকা সম্ভব হয়নি। শত্রুতার শুরু তো সেখান থেকেই। কিন্তু এখন সেই শত্রুতাকে পরিণতি দেওয়ার সময় উপস্থিত। অনেক হয়েছে সাপসিঁড়ি খেলা। এবার মরণছোবল মারার সময়। হয় এসপার, নয় ওসপার!
নিজের চেয়ারে বসে বসেই কথাগুলো ভাবছিল করিম। ঠোঁটের মাঝে জ্বলন্ত সিগারেট ধরে রেখেছে। ছাই জমে লম্বা লাইন তৈরী হয়ে গেছে। গভীর চিন্তায় টানতেও ভুলে গেছে সে। কারণ এবারের খেলাটা ভয়ংকর। জয়টা যারই হোক। পরিণতি যে সকলেরই হাড় কাঁপিয়ে দেবে, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
ওনার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে সশব্দে ঘরে প্রবেশ করল উঠল কেউ। ভ্রু কুঁচকে তাকাল করিম। সিগারেটে জমা ছাইটুকু খসে পড়ল। বেশ লম্বা, সুঠামদেহী এক যুবক। ফর্সা। চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করে রাখা। প্রচন্ড রাগে ফুঁসছে সে। করিম তাজওয়ারের ছোট ছেলে। সম্রাট তাজওয়ার। বড় ছেলের নাম ছিল শাহজাহান তাজওয়ার। মৃত্যু হয়েছে পাঁচ বছর আগেই। পুলিশ এনকাউন্টারে। সম্রাট হনহনে পায়ে এসেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল একটা চেয়ার। ছেলের বেয়াদবিতে জ্বলে উঠল করিম। ধমক দিয়ে বলল, ‘সম্রাট!’
সম্রাট গর্জে উঠল। লাথি মারল আরেকটা চেয়ারে। ফোঁস করে শ্বাস ফেলল করিম। নিজেকে শান্ত করে বলল, ‘মাথা ঠান্ডা করো। বসো!’
সম্রাট জ্বলন্ত চোখে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘তোমার মতো বসে বসে তামাশা দেখার ধৈর্য্য আমার আর নেই। তুমি সারাজীবন চেয়ারে বসে বসে ভেবেই যাও। না ঢাকা ছাড়া হওয়ার সময় কিছু করতে পেরেছিলে। না নিজের বড় ছেলের এনকাউন্টারের সময়। আর না এখন পারবে। ওরা গোটা পুরো ব্লাকহোলের ** ** দিলেও তুমি চেয়ারে বসে ভেবেই যাবে।’
‘ভাষা সংযত করো সম্রাট। বাপ আমি তোমার।’
‘সেটা নিয়েও আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’
হতভম্ব হয়ে তাকাল করিম তাজওয়ার। কিছু বলতে গিয়েও বলার ভাষা পেল না। কী জন্ম দিয়েছে এটা! আক্ষেপ ছেড়ে ধাতস্থ করল নিজেকে। নতুন একটা একটা সিগারেট ধরাল। সম্রাটের দিকে সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘বসো! এতো রাগ করছো কেন? একটা কথা ভুলে যেওনা শুধুমাত্র তোমার জন্যে, তোমার জন্যেই ডার্ক নাইটের প্রস্তাবে রাজি হতে হয়েছে আমাকে। হাত মেলাতে হয়েছে ওদের সঙ্গে। যেখানে ওরাও আমাদের শত্রুই ছিল।’
সম্রাট সশব্দে টেবিলে দু হাত রেখে ঝুঁকে গেল, ‘শুধু আমার জন্যে? এছাড়া আর কোন উপায় ছিল তোমাদের কাছে? এককভাবে সোলার সিস্টেমের বা* ছেড়ারও যোগ্যতা নেই তোমাদের। তাই এক হয়েছো। সব দায় আমার ওপর চাপাবে না।’
করিম মাথা নেড়ে বলল, ‘ মানছি। কিন্তু তুমি যেটা চাও সেটাতো হবেই। তাহলে এতো চিন্তার কী আছে? আর এবারের জালটা যেভাবে সাজানো হয়েছে, ওদের জেতার কোন সম্ভাবনা নেই। তবুও কোনভাবে, ভাগ্যগুণে কোনভাবে যদি ওরা জিতেও যায়; নিজেদের ধ্বংস করেই জিততে হবে। অন্যকোন কোন পথ নেই।’
সম্রাট উত্তর দিলোনা। মেজাজ ঠিক হচ্ছেনা ওর। এ নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক হয়ে গেছে। এসব নিয়ে কম ঝামেলা হয়নি বাপ-ব্যাটার মধ্যে। নিজেকে নিয়ে সামলে নিয়ে চেয়ারে বসল সম্রাট। বলল, ‘সে যাই হোক। রুদ্রকে আমার চাই। ওকে আমি নিজের হাতে খু-ন করব। নিজের হাতে।’
করিম তাজওয়ার হেসে বললেন, ‘সে দেখা যাবে। আগে আমাদের প্ল্যানমতো সব এগিয়ে যেতে দাও। যেভাবে..’
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল করিম তাজওয়ার। কিন্তু তার টেবিলে রাখা টেলিফোন বেজে উঠল। কথা থামিয়ে একবার তাকাল সম্রাটের দিকে। এরপর রিসিভার তুলে বলল, ‘হ্যালো?’
ওপাশ থেকে বেশ সময় নিয়ে কিছু বলল। সব শুনে তেঁতে উঠল করিম। ঝাড়ি দিয়ে বলল, ‘এখানে ফোন করতে কে বলেছে! এইটুকু বুদ্ধি নেই মাথায়?’
ওপর পাশ থেকে আবার কেউ কিছু বলল। ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে করিম। খানিকটা ভাবল সে। অতঃপর শান্ত হয়ে বলল, ‘আচ্ছা চিন্তা করো না। আমি দেখছি। তুমি যেভাবে আছো থাকো। এখানে ফোন করো না। আমি সামলে নেব।’
বলে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল। বিরক্তি নিয়ে তাকাল সম্রাটের দিকে। সিগারেট বের করছে সম্রাট। করিম রাগে গজগজ করে বলল, ‘গাধা পুষছি সব। এখানে ফোন করেছে। কোনভাবে ধরা পড়ে গেলে!’
সম্রাট ঠোঁটে চেপে ধরা সিগারেট আগুন ধরিয়ে বলল, ‘ওকে এখন এমনিতেও খরচের খাতাতেই ফেলে দাও। তোমার কী মনে হয়, ও ধরা পড়বেনা? এতোদিন কোন ঝামেলা হয়নি। রুদ্র নিজেও বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু এখন, বিশেষকরে খু-নটা হওয়ার পর আর না। ও এখন পাতালে গিয়ে লুকোলেও এক সপ্তাহের মধ্যে ওর ডেড বডি পাবে। লিখে রাখো।’
‘ কী করতে পাঠিয়েছিলাম আর কী করল। মারল কাকে? একটা কাজের মহিলাকে। ইডিয়ট!’
‘ ছাড়ো। আপাতত এটাতো জানা গেছে যে পরের সপ্তাহ থেকে কাজ শুরু করবে ওরা। আপাতত এটুকুই যথেষ্ট। ওকে আর প্রয়োজন নেই। ফেলুক মেরে। কিন্তু পুলিশের হাতে পড়লে ঝামেলা। হাতের ছাপ নেইতো ছু-রিতে?’
সোজা হয়ে বসল করিম। ইতস্তত করে বললেন, ‘সেটাতো জিজ্ঞেস করিনি।’
সম্রাট তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘লীডারের এই হাল হলে চ্যালারাতো সব গাধা হবেই। এজ এক্সপেক্টেড।’
করিম কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। সম্রাটের এধরণের কথা এখন তার হজম হয়ে যায়। সম্রাট বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মাঝেমাঝে আমার সন্দেহ হয় আমি আদোও তোমার ছেলে কি-না। আমার নিজের বাপ এতো গভেট হয় কীকরে!’
করিম পুনরায় হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। বলতে গিয়েও বললেন না, মাঝেমাঝে তার নিজেরও সন্দেহ হয়। এটা তারই ছেলে তো? কিন্তু স্ত্রীর সম্মানের কথা ভেবে সন্দেহটা সঙ্গেসঙ্গেই মনে দাফন করে ফেলে।
*
বর্তমান~
গুলশান থানায় বসে আছে তুহিন। চিন্তিত ভঙ্গিতে চুমুক দিচ্ছে চায়ের কাপে। দ্বিতীয়বার আমের ভিলাটা সার্চ করেও বিশেষ কিছুই পায়নি সে। কয়েকটা কাগজপত্র ছাড়া। গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তাই ওগুলো রেখে দিয়েছে নিজের কাছে। একান্তে নিড়িবিলি সময়ে পড়ে দেখবে। আর একটা জিনিস খেয়াল করে দেখেছে ও। আমের ভিলা হঠাৎ ফাঁকা হয়নি। বরং ইচ্ছাকৃতভাবেই ত্যাগ করা হয়েছে। বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে সবাই। কিন্তু কেন? আর কোথায় আছে ওরা? আর ঐ পাগল মহিলা কে ছিল? ওরকম হাড় হিম করা হাসি হেসে একা একাই কীসব বকতে বকতে চলে গেল। কিন্তু সেই মহিলার একটা কথা নাড়া দিল তুহিনকে। “খু-ন! খু-নের পর খু-ন হয়েছে। যাস না। এরমধ্যে ঢুকিস না। ঢুকলে তুইও খু-ন হবি।” আরও খুটিয়ে ভাবল তুহিন। আমের ভিলার মধ্যকার কেউ যদি খু-ন হয়ে থাকে তার কারণ দুটো হতে পারে। এক, বিশ্বাসঘাতকতা। দুই, অন্য গ্রুপের টার্গেট হওয়া। দুটো কারণই ওর কেইসের জন্যে জরুরী। বিশ্বাসঘাতকটা কে ছিল সেটা জানাই সবচেয়ে জরুরী। সেটা জানতে পারলেই হয়তো এই কেইসের জট অনেকটা খুলবে। তাই ওখান থেকে সোজা থানায় চলে এসছে তুহিন। কিছু তথ্য প্রয়োজন।
এরমধ্যেই আজিজ চলে এলো। নিজের চেয়ারে বসে বলল, ‘সরি স্যার। অপেক্ষা করতে হল আপনাকে। বলুন। কিছু জানতে পারলেন?’
আজিজের প্রশ্নের উত্তর দিলোনা তুহিন। কাপটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘আমের ভিলাতে ঠিক কতগুলো খু-ন হয়েছিল? যেগুলো আমি জানি, ওগুলো বাদে।’
কয়েক সেকেন্ডের জন্যে থমকে গেল ইন্সপেক্টর। তারপর বলল, ‘এমনিতে যেসব মার্ডার হতো, সেগুলো কোনভাবে সোলার সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত হলেও আমের ভিলায় বা বাড়িতে হতোনা। কিন্তু প্রথমবার এটা হয়েছিল, সেদিন।’
‘কোনদিন?’
‘রুদ্র আর প্রিয়তার বিয়ের দিন।’
একটু অবাক হল তুহিন। রুদ্র তাহলে প্রিয়তাকেই বিয়ে করেছিল! ‘কিন্তু, খু’নটা কার হলো?’
‘ওদের এক মেইড সার্ভেন্টের।’
তুহিন ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ মেইডকে মেরে কার কী লাভ?’
‘কারণটা বের করতে পারিনি। তবে এইটুকু নিশ্চিত যে উদ্দেশ্য ঐ মহিলাকে মারা ছিলোনা। কোন কারণে মারতে হয়েছে।’
‘খু-নি কে সেটা বের করতে পেরেছিলেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে কারণটা বের করতে পারলেন না কেন?’
মৃদু হাসলেন আজিজ। তুহিনকে অপেক্ষা করতে বলে উঠে গেলেন। প্রায় পনেরো মিনিট পর ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে ফিরে এলেন একটা পুরোনো ফাইল নিয়ে। সেটা তুহিনের সামনে রেখে বললেন, ‘পড়ে দেখুন।’
তুহিন কথা না বাড়িয়ে ফাইলটা খুলে বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করল। পড়ে যা জানল, তাতে চমকাতে বাধ্য হলো তুহিন। বুঝতে পারল, এই জাল ভয়ংকর জাল। যেটাতে ভালোভাবেই জড়িয়ে গেছে তুহিন। এই জাল কেটে বের হতে ওকে খাটতে হবে। আরও অনেক খাটতে হবে।
#চলবে…
#অন্তর্নিহিত_কালকূট