#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৭৫. (বর্ধিতাংশ)
কখনও কখনও কিছু কাঠামো যে প্রেক্ষাপট, ভিত্তি ও উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে, তা পরবর্তিতে পর্যায়ক্রমে বাস্তব প্রয়োগে অকার্যকর ও হিতে বিপরীত হয়। সুবিধার জন্য গড়ে উঠে ক্রমে তা অসুবিধার জনক হয়ে ওঠে। সেই কাঠামোর ওপর দ্বিধা জটিলতার প্রলেপ লেগে যায়।
কমিউনিজম কাঠামোটি তেমন কিছুই হয়ত! তা গড়ে উঠেছিল শোষিত মানুষদের কাতরতা রোধে। একই সমাজে কেউ গরীব কেউ ধনী। গরীবেরা ধনীর গোলাম, নেই তাদের ন্যায্য প্রাপ্তি, পরিশ্রমের মূল্য; খাটছে কেবল খাটছে। ডিম দেয় হাস, খায় দারোগা বারো মাস–ধরণের ব্যাপার।
কিন্তু কেউ জমিদার, কেউ তার জমির হালচাষী–এই সমাজকে বদলাতে একবার সাম্যবাদী সমাজতন্ত্রের উদ্ভব হলো। এটা সেই সমাজের কল্পতত্ত্ব –যেখানে কেউ রাজা নয়। আর কেউ রাজা না হলে বাকিরা প্রজা হয় না। সুতরাং সেখানে সবাই রাজা, তারাই প্রজা!
পরিশ্রম যে-ই করুক, তার ফল কেউ বেশি বা কম পাবে না। কেননা তার মালিকানা পরিশ্রমকারীর নয়, সমাজের। কোরবানীর মাংস ভাগের মতো। সবার নিজস্ব কোরবানীর পশুর একাংশ সমাজের হাতে যাবে। সমাজ সেখান থেকে জনপ্রতি সবার জন্য সমান ভাগে ভাগ করে সবার চাহিদা মেটাবে। কিন্তু কোরবানী একটি উৎসর্গ। পরিশ্রম করে ফলানো ফসল তা নয়।
সবাই সমান পাবে। এটা হলো সমবণ্টনতত্ত্ব। তবে এটা ন্যায্য প্রাপ্তি কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে বটে! যে পরিশ্রম করছে সে পাচ্ছে, এটা তার অর্জন। কিন্তু কেউ পরিশ্রম না করেও সেই সমান পাচ্ছে, এটাও বোধহয় সেই অসমবণ্টনের পর্যায়েই পড়ে। যদিও সাম্যবাদের ভিত্তি অনেকটা এরকমই।
তবু কখনও কখনও কোনো অঞ্চলের সামাজিক পরিস্থিতি যখন ধানমন্ডি অভিজাত এলাকা ও তারই পাশে গড়ে ওঠা মোহাম্মদপুর বস্তির মতো হয়ে ওঠে, তখন সমাজে সমাজতন্ত্রের বড় প্রয়োজন পড়ে যায়।
ধানমন্ডিতে বাংলাদেশের শীর্ষ নেতাগোষ্ঠী, শিল্পজীবী ব্যবসায়ীদের বাস। যেখানে টাকা পকেটে থাকা ওয়ালেট টিস্যুর মতোন। নাকে সর্দি এলে একটা নোট বের করে নাক মুছে ডাস্টবিনে ফেলা ব্যাপার। তারই পাশে মোহাম্মদপুর বস্তির অভুক্ত পেটের চোঁ চোঁ আওয়াজের রোল, মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া নোংরা হাড্ডিসার শরীরগুলো, গ্রামের ক্ষেতে দিন দুই লিটার ঘাম ঝরিয়ে ফসল ফলানো কৃষক পায় না ন্যায্য মূল্য, কিন্তু ধানমন্ডিওয়ালাদের সিন্ডিকেটে বাজার গরম, খেটে খাওয়া আরেক শ্রেণীর মানুষের জন্য আধা কিলো আলু এক টুকরো রৌপ্য! ধানমন্ডিওয়ালাদের কারখানায় পুড়ে কয়লা হওয়া শ্রমিকের পরিবার পায় না শ্রমিকের জানের মূল্য অথবা শ্রমিজীবীরা বেঁচে থাকতেও পায়নি ন্যায্য পারিশ্রমিক…
এ সময় সাম্যবাদের জয়গান গাইতে ইচ্ছে করে চট করেই। যেভাবে গেয়ে উঠতেন কাজী নজরুল ইসলাম,
দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি বলে এক বাবুসাব তারে নিচে ফেলে দিলে ঠেলে!
চোখ ফেটে এলো জল,
এমনি করিয়া কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দূর্বল?
যেকোনো অঞ্চলের স্বাধীনতা সংগ্রামের পরবর্তি অবস্থা যুদ্ধরত অবস্থার চেয়ে বেশি ভয়াবহ হয়। বাংলাদেশ গঠনে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তি পরিস্থিতিও এই নীতি এড়াতে পারেনি।
যুদ্ধবিদ্ধস্ত এই দেশটির পুনঃসংস্করণ প্রায় অসম্ভবের মতোন হয়ে উঠেছিল। রাষ্ট্রীয় সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি, তার ওপর ভারতে থাকা শরণার্থীরা ফিরলে আরও সংকট বাড়ল।
আওয়ামী সরকারের দূর্বল নেতৃত্ব, অধিপত্য বিস্তারের নেশা, অদক্ষতা আর খুবই ভালো পর্যায়ের দূর্নীতি আকাশ ফুঁড়ে ওঠার জোগাড় হয়েছিল। চারদিকে হাহাকার ও দূর্নীতি সমানুপাতিক হলো। হাসাকার যত বাড়ছে, আরেক শ্রেণীর মানুষের দূর্নীতিও সমান বা অধিক হারে।
এসব দেখতে দেখতে জাভেদ আমির কেমন ক্লান্ত হয়ে উঠলেন। সেসময় ঘটনাক্রমে কমিউনিস্ট পার্টি বঙ্গবন্ধুর বাকশালে যোগদান করলেও একসময় তারা বাকশাল ছেড়ে দিলো। হতে পারে তারা টের পেয়েছিল যে বঙ্গবন্ধু তার অদক্ষ, অনৈতিক শ্রেণীগত অধিপত্য বিরাজমান রাখতে বাকশাল গঠন করেছে। যা গরীবকে কবরে নিচ্ছিলও সুযোগসন্ধানী দুর্নীতিবাজদেরকে আকাশে তুলছিল।
এই শ্রেণী-শোষন কমিউনিজম মানে না। স্বভাবতই তারা আবারও নিজেদের বামপন্থী চেতনায় ফিরে গেল। বিরোধ তৈরি হলো তৎকালীন সরকারব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের সাথে।
জাভেদ আমির কলেজ ছাত্র থাকাকালীন দেশে দুর্ভিক্ষ এলো। সাল ১৯৭৪ এর মার্চ। সরকার বলেছিল, এই দুর্ভিক্ষের কারণ তখনকারল এলাকাগত বন্যা ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি। কিন্তু বিশ্লেষকেরা এটা মানতে নারাজ। অবশ্য এর পেছনে তাদের একটা যুক্তি আছে–
তারা দেখেছে, সে বছর দেশে এলাকাভিত্তিক যথেষ্ট ফসল ফলেছিল। কিন্তু তা মজুতকরণে যে ব্যবস্থাগ্রহণ দরকার, তা করা হয়নি। বরং তখন সরকার নিজেকে গদির সাথে শক্ত করে আটতে ব্যস্ত। যেমন ভারতের সাথে ভালো সম্পর্ক স্থাপন করতে দেশের সম্পদের ভাগ-বাটোয়ারা, চোরাচালান, বাজার দুর্নীতির কারবার জেনেও পদক্ষেপ না নিয়ে প্রশ্রয় দিয়ে দল ভারী করা।
আবার যা মজুত ছিল, তাও দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ হাতে পাচ্ছিল না। এর একটা কারণ আছে। বাজার তখন বড় শ্রেণীর হাতে। খাটে গরীব, তার অধিপতি উপরমহল শ্রেণী। আম জনতার হাত খালি। বড় শ্রেণীর মানুষ হতে গেলে দুর্নীতির বিকল্প নেই বললেই চলে। সুতরাং যাদের হাতে বাজারপণ্য, তারা একটু দুর্নীতি করবেই। এক্ষেত্রেও করল। গরীবের ক্ষুধার্ত পেট ও এক মঠো চাল-ভাতের আশায় হাতে ধরে রাখা খালি টিনের থালাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা শস্য ও পণ্য কালো বাজারে বেচাকেনা করল।
এসব সময় কমিউনিজমকে বড় মনে পড়ে। কেননা কমিউনিজম এই সমাজ ও রাষ্ট্রের এই রোগের ওষুধ হিসেবেই তো গঠিত হয়েছে! জাভেদ আমির আর পরিণতি ভাববার সময় পেল কোথায়? এই দুর্ভিক্ষ, মানুষের হাহাকার, নতুন তথাকথিত স্বাধীন দেশের নাটকীয় মঞ্চ তাকে বামে ঠেলে দিলো। এই বামে সে সমাজতন্ত্র দেখেছিল। যে দিকের নীতি অন্তত শ্রেণীকে এক করে। বড় শ্রেণী, ছোট শ্রেণীর নীতির কবরের নাম সাম্যবাদ। যেখানে গরীবের পেটেও সেই খাবার এবং ততটুকু খাবার পড়ার কথা যা বড়লোকের পেটে পড়ে।
জাভেদ আমির যুদ্ধ শেষে একটু নিস্তেজ হয়ে পড়লেও সেটা ক’দিন পর পরিবর্তিত দৃষ্টিকোণ হিসেবে আবার ফিরল। গণতন্ত্রের সরকার ব্যবস্থাকে ঘেন্না করার রোগে ধরল তাকে। সমাজতন্ত্রের উল্লেখযোগ্য অপকারিতাকে একপাশে সে বহুবছর ছুটেছে সাম্যবাদের পেছনে।
পরিশ্রমী শ্রমিকদের ঘাম ও গরীবের পেটের ক্ষুধার মূল্য চাইতে চাইতে সংসারজীবনে আসতে তার বয়স হয়েছিল একত্রিশ! জয়নাল আমিরের সাথে তার সম্পর্ক এক জটিল রূপ নিয়েছিল। দুজনই দুজনের কর্মকাণ্ডকে বাঁধা দেবার চেষ্টা করেনি। দুটোই সঠিক তাদের কাছে। জয়নাল মানুষ মারে, তাদেরকে মারে যাদের ওপর জাভেদের ক্ষোভ রয়েছে। কারণ তারা শোষক শ্রেণী, যার বিরুদ্ধে জাভেদের আক্রোশযাত্রা। কিন্তু দুই ভাই-ই চাইতো অপরকে নিজের নীতিতে আনতে। দুজনের উদ্দেশ্য এক, রাস্তা আলাদা।
জাভেদ চেয়েছিলেন জয়নাল কমিউনিস্ট করুক, জয়নালেরর ধারণা ছিল ওসব আন্দোলন-ফান্দোলনে কিছু হবে না। যে বেলাইনে হাঁটবে প্রথমত তার দু পা, পরে মাথাটা কেটে নিলেই ঝামেলা খতম।
এই দ্বন্দ্বে দুজন কোনোদিন কাছাকাছি আসতে পারেনি। অথচ উদ্দেশ্য এক বলে তাদের শত্রু একই!
বহুবার হুমকি পাবার পরেও জাভেদ রাস্তা ছাড়লেন না। গণতন্ত্রের প্রতি তার ঘেন্না ফুরোবার নয়। গরীব তখনও না খেয়ে ফুটপাতের এককোণে নোংরা চাদরের নিচে জড়োসরো হয়ে রাত কাটায়। কৃষক-শ্রমিক তখনও শ্রমের মূল্য পেয়ে ওঠেনি। জাভেদ কেন রাস্তা ছাড়বেন?
জয়কে তুলে নেবার আশঙ্কা কতবার দেখা দিয়েছে! কিন্তু জয়নাল আমিরের জন্য সম্ভব হচ্ছিল না। তবে গনতন্ত্রের পূজারীরা এভাবে বেশিদিন চলতে দেবে কেন? যখন স্বৈরাচার হুসাইন মহম্মদ এরশাদের রাজ কায়েম হলো, তখন বাংলাদেশের গনতন্ত্রের দুই প্রধান দল আওয়ামী ও জাতীয়তাবাদী দল অল্পদিনের জন্য হলেও একজোট হয়েছিল। এছাড়া দু-দলই যখন গনতান্ত্রিক, তখন গনতন্ত্রের বিরোধীরা যেকোনো সময়েই তাদের দুজনেরই শত্রু! কেননা কমিউনিজম সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র মানে।
১৯৯৪ এর এক রাতে কয়েকদিন পর জাভেদ আমিরের রাজধানী থেকে ঢাকা ফেরাই দুই দলের সম্মিলিত হামলার মোক্ষম দিন হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির যে আওয়ামী বিদ্বেষের রোগ, তা ছড়িয়ে পড়িয়েছিল। তারা ক্রমান্বয়ে একেক কর্মসূচি দেখিয়েছে আওয়ামীর বিরুদ্ধে! তাহলে আর ছাড়াছাড়ি কেন?
দুই দলের মিলিত বিদ্বেষ ও হামলায় আমির পরিবার নিঃশেষ হলো এক অবরুদ্ধ নিশীথে। জানা নেই সমাজতন্ত্রের অসুবিধা ও সুবিধার অনুপাত কত! কিন্তু জাভেদ আমির একটি এমন সমাজের জন্য লড়াই করেছেন, যা হয়ত সকল কমরেডই স্বপ্ন দেখেন, কিন্তু বাস্তবায়ন অসম্ভব প্রায়! অপকারিতাগুলো প্রকট হয়, উপকারিতা তলিয়ে যায়। তবু জাভেদ আমির এক জীবন সাম্যবাদের পেছনে দিলেন। যেই তত্ত্বে শ্রেণী-গোত্র, শ্রমিক-মালিক নির্বিশেষে সবাই সমান।
○
মুস্তাকিন একটু হাসে, “কক্ষনোও ভাবিসনি এমন করে, না?ʼʼ
জয় কিছুক্ষণ আনমনে হাত দিয়ে ঠ্যাংয়ের ওপর ঢোল বাজালো, তারপর ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল, “অত ভাবাভাবি ভালো না রে পাগলা। ভাবলে ক্যালরি অপচয় হয়। অপচয়কারী শয়তানের ভাই। কিন্তু আমি একজন ভালো লোক।ʼʼ
-“ঠিকই তো! খুব সহজে আপাত দূর্বল যাকে-তাকে শত্রু বানিয়ে নিয়ে তাদের ধ্বংসের পেছনে লেগে যাওয়াটা অনেক সহজ এত ভাবাভাবির চেয়ে। তুই আসলেই একজন সচেতন নাগরিক।ʼʼ
জয় দু পাশে দুই হাত প্রসারিত করে প্রশংসা নেবার ভঙ্গিতে মাথা নোয়ায়।
এরপর চুপ সব। অন্তূ কপালে আঙুল চেপে বসে ছিল। তার আবারও মনে হলো, এই জীবনে জানা ও অভিজ্ঞতার শেষ নেই। রূপকথা আজগর একদিন অমূল্য একখানা কথা তাকে বলেছিল। দিন যত যাচ্ছে, অন্তূর মনে হচ্ছে সে এক অমীমাংসিত প্যারাডক্সে কয়েদ হয়ে যাচ্ছে। যেখানে শুরু বা শেষ নেই। এখানে শেষ থেকে শুরু হয় এবং সেই শুরু থেকে আবার শেষের দিকে ধাবিত এক প্রবাহে ভেসে যেতে হয়! কেন এখানে কোনো সিদ্ধান্তে স্থির থাকা যায় না, ভাঙন ধরে যায়। কেন যা-ই করতে মনস্থির করা যায়, তা-ই কোনো এক পর্যায়ে অসমাচিন মনে হয়! অন্তূ ভাবতে লেগে যায়।
মুরসালীন জীবনের এ পর্যায়ে বোধহয় বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। নিজের শরীরের ব্যথার চেয়ে বড়ঘরে লাশের মতো পড়ে থাকা ছোট ছোট দেহের কাতর আর্তনাদ তার বিদ্রোহ ও জেদকে পরিশ্রান্ত করে তুলেছিল। তারা যখন ডেকে ওঠে ‘মুরসালীন ভাই!ʼ বলে, মুরসালীনের লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে। ওদের জন্য মুরসালীন কী করতে পেরেছে? ওদের নিস্তেজ অসুস্থ, ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত শরীরগুলো মৃত্যুর প্রহর গুনছে। আর সেই প্রহর খুব কাছে।
মুরসালীন আন্দাজ করল, হামজা এখনও ফেরেনি। ফেরার পর ঘটনাচক্র পাল্টি খাবে, সবকিছুতে একটা ধাক্কা লাগবে, সেই ধাক্কার প্রস্তুতিই চলছে যেন চারদিকে! হামজা বুঝবে মুরসালীনকে দিয়ে তার স্বার্থ হাসিল হবে না। সব বিগড়ে গেছে, সাথে মুরসালীন অটল। এবং মুরসালীনের দিনের শেষ সেখানেই!
সেই প্রেক্ষিতেই মুরসালীন এইদিন প্রথমবারের মতোন জয়কে কাতর কণ্ঠে বলেছিল, শোন জয়, তোরা যে ভয় পাস এরা বড় হয়ে জঙ্গি-সন্ত্রাস, তোদের বিরোধী হয়ে উঠবে, মাদ্রাসাগুলো এসব তৈরির কারিগর…..তোদের কথাই রইল। ওদেরকে ওদের বাড়ি পৌঁছে দে। ওরা আর মাদ্রাসায় যাবে না। আমাকে একটা কাগজ আর কলম দে, আনসারী চাচার কাছে চিঠি লিখে দিই, মাদ্রাসার স্থগিত কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হোক।ʼʼ
জয় উঠে দাঁড়ায়। অন্তূ ছটফট করে উঠল, সে কিছু বলতে চায় এই মুহুর্তে। যা বলাটা অনিবার্য দরকার। তার আগেই মুরসালীনকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে দেয়া যাবে না।
কিন্তু জয় বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়ালে মুরসালীন ডেকে বলে, “দুই টুকরো কাগজ আর কলম দে আমাকে। শেষমেষ একটু আঁকিবুকি করি!ʼʼ
অন্তূ জয়কে সেদিন মদ খেতে দিলো চুপচাপ। সে খুব ভাবলো। জয়কে দেখল–ওই জটিল চেহারায় অনুশোচনা আছে কিনা! ঠিক বোঝা যায় না! কিছু ঝাল পকোড়া, কাঁচা আদা মচমচ করে চিবিয়ে খাচ্ছে।
আরাম করে বসে মনোযোগ সহকারে ড্রিংক তৈরি করছে যেন সে সেই মদের তরলে ডুবতে চায়, কিছু খুঁজতে চায়। এক বোতল রাম খুলে কয়েক ঢোক ঢকঢক করে গিলল। আবার কী মনে করে একটা ড্রিংক বানাতে বসল।
এক শট রাম-লিক্যুইড, বিট লবন, চিনি, সোডা ওয়াটার, লেবুর রস, আইস কিউব…
তার চোখেমুখে চিন্তার ভাব নেই। অন্তূ হিসেব কষে–জয় বারবার বলে তার জীবনে অভিজ্ঞতা বেশি। অন্তূ টের পায়, আসলেই অতিরিক্ত বেশি। সেক্ষেত্রে জয় আজ আর চমকায় না, থমকায় না, চিন্তা-ভাবনা ও পথ বদলায় না, এবং যেন সে জানে কী হবে, কী হচ্ছে, কী হতে পারে…সব জেনে সে সেদিকে বড় আরাম করে এক কদম দু’কদম করে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রেম-পূর্ণতা সেটা জয়ের ক্ষেত্রে। জয় তার প্রেমকে আলিঙ্গন করতে এগোচ্ছে!
—
পরদিন দুপুরে কামরুলকে মারার দ্বায়ে এমপির কাছে অন্তূকে ধরিয়ে দেবার প্রসঙ্গ উঠলে জয় বলেছিল, “আমার হাতে এবার একটা এমপি খুন করাতে চাও?ʼʼ
অন্তূ জিজ্ঞেস করেও জবাব পায়নি, এর আগে অন্তূকে কারও হাতে তুলে দেবার প্রশ্নে জয় আমির কার প্রাণ নিয়েছে। জয় গোসল শেষে বের হলেও অন্তূ একবার জিজ্ঞেস করেছিল, জয় গ্রাহ্যই করেনি। অন্তূ বসল বিছানার ওপর।
সেদিকে একবার, দু’বার তাকায় জয়, নজর সরিয়ে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগতে আয়নায় নিজেকে দেখে স্মিত হেসে মাথা নাড়ে, “ডোন্ট লিসেন টু ইওর হার্ট, মাই বয়! কজ ইট’স অন ইওর লেফ্ট সাইড! অ্যান্ড দ্য লেফ্ট সাইড ইজ দ্য ডিরেকশন অফ ডেস্ট্রয়িং এনিথিং, এভরিথিং…. দেন ইউ হ্যাভ টু ফাকড-আপ অ্যান্ড গেট টার্ন-অভার অন ইওর ওয়ে!ʼʼ
সেদিন জয় চারদিকের এত্ত বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন কর্মসূচি ফেলে সে অন্তূকে নিয়ে রওনা হলো ঘোড়াহাঁটের দিকে। এমপির সাথে দেখা করা ফরজ ছিল। কারাগারে যাবার ছিল। শরীর ও মনের ভেতরটায় কেয়ামতের তান্ডব অগ্রাহ্য করে অন্তূর হাতটা ধরে বাসে চেপে বসল বাঁশের হাঁট থেকে ঘোড়ারহাঁটের উদ্দেশ্যে।
বাসের ভেতরে এক মহিলা, বয়স পয়তাল্লিশের ওপাড়ে। কিন্তু সাজসজ্জায় কিশোরী হবার প্রয়াস। এটা খারাপ না, কিন্তু জয়ের গা চুলকানি আছে এসবে।
তার ওপর মহিলাটি বিশাল এক পর্বতের অত বড় ব্যাগ দেখিয়ে জয়কে বলল, “ভাইয়া, এটা একটু উপরে তুলে দেবেন, প্লিজ?ʼʼ
জয় দু’পাশে মাথা নাড়ে, “না, খালা। প্রশ্নই ওঠে না!ʼʼ
মহিলা চিকন সুরে চিটমিট করে উঠল, “মানে? খালা মানে কী?ʼʼ
-“খালা মানে হলো সম্বন্ধির চেংরি।ʼʼ
-“হোয়াট ননসেন্স! আমি খালা? খালা মনে হয় আমাকে?..ʼʼ
জয় একটু নিচু স্বরে চিবিয়ে বলে, “না। তোর মতোন দামড়া মহিলাকে খালা মনে হবে, এত ভালো না আমার রুচি।ʼʼ
মহিলা কথা ভুলে গেল, “সম্বন্ধির কী? খালা… ? বেয়াদব লোক? অসভ্য, জানোয়ার। এক্ষুনি শিক্ষা দিচ্ছি। কত বড় সাহস! এসব জঙ্গল থেকে উঠে আসে, রাবিশ। কন্টাক্টর?ʼʼ
কন্টাক্টর ফুল একশন মুডে এসে দাঁড়াল। জয় শুধু সেদিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হি হি করে হাসল একবার। কন্টাক্টর পড়িমরি করে সালাম ঠুকে আবার চলে যায়।
জয় মহিলাকে সবিনয়ে বলল, “যাইহোক আমি দিনদিন ভালো হয়ে যাচ্ছি তাই আপনাকে প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষায় বলতে পারলাম না যে ‘এই শালি, খাসি শালি নাম বাস থেকে। নয়ত আধ মনে ওজনবিশিষ্ট কোমড়ের ওপর দুম করে এক লাত্থি মারব, জানালা ভেঙে বাসের বাইরে গিয়ে পড়বি।ʼ যান নিজের সিটে যাইয়ে বসেন। ব্যাগটার ওপর এখন আমি পা রাখব।ʼʼ
জয় ব্যাগটা বাসে মেঝেতে পায়ের কাছে এগিয়ে নিয়ে পাদানি বানিয়ে আরাম করে বসে। অন্তূ লজ্জায় কুঁকড়ে উঠল। এত অসভ্য, জঙলি একটা লোকের সাথে সে যাচ্ছে, ইচ্ছে করল বাস থেকে নেমে যেতে। মুখে দু’হাত চেপে বসে রইল।
মহিলা কাচুমাচু হয়ে নিজের সিটে বসে। অন্তূ বলে, এত জাহিল কেন আপনি? নারীকে ইজ্জত দিতে কোথায় ব্যথা পান?
জয় খুব বিজ্ঞের মতো বোঝালো অন্তূকে, “ব্যথা না, ঘরওয়ালি! এটা একটা চিন্তা–কেউ একজন বলেছিল, ‘যদি সবাইকে ইজ্জত দেইর তো বেইজ্জত করব কার?’ বিষয়টা কিন্তু আসলে ভাবার মতো। ঠিক না?ʼʼ
অন্তূ কপালে একটা চামড় মারে। জয় সাবধান করল, “নিজে চাপড়ে কপাল ফাটিয়ে আমার দোষ দেবে। সরল পাইছো তো, লুটে খাচ্ছ। নট ফেয়ার।ʼʼ
ঘোড়াহাঁটের গ্রাম্য ঐতিহ্যের রূপ বদলেছে। আমির নিবাস এ অঞ্চলে ভৌতিক বাড়ির লোককাহিনিতে পরিণত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারদের হামলা হওয়া বাড়ি ওটা। এছাড়া এ বাড়িতে জলিল আমিরের মাথা কাটা অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায়, জাভেদ আমিরকে দেখেছে লোকে! সরকার দ্বারা বাজেয়াপ্ত হওয়া বাড়িটা ২০১০ এ জয় হাইকোর্টে রিট করে, কত কী করে তা ফেরত এনেছিল। কিন্তু কখনোই তাকে এ বাড়িতে আসতে দেখা যায় না তেমন।
ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ কী যেন দেখল জয়। লোহার ফটকে মরিচা ধরে খসে পড়ছে। বাড়িটা হান্টিং-হাউজের খেতাব না পেলে এটুকু অক্ষত থাকতো না নিশ্চিত। ভৌতিক অতীতের গল্প প্রচলিত থাকায় লোকে আশপাশে আসে না। কিন্তু চোরের কাছে ভূত কাবু। রাত পেরোলেই বাগানের দামী দামী গাছ উধাও হওয়া ঠেকাতে জাভেদ আমির ও জলিল আমিরের মাথাকাটা ভূতও পারেনি।
অন্তূ অবাক হয়ে দেখে আমির নিবাসের সীমানার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা চিলেকোঠা বিশিষ্ট দোতলা বাড়িটিকে। চারধারে বিশাল প্রাচীর লতানো উদ্ভিদ ও শেওলায় ঢাকা পড়েছে। প্রাচীর ঘেরা সীমানার পরিমাণ বিঘাখানেকের কম হবে না।
অন্তূর মনে হলো–পরিত্যক্ত প্রাসাদ বটে! বিশাল এক বহরে বুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিস্তৃত এক পতিত ভূমির মাঝখানে। উত্তর দিকে প্রাচীর ঘেঁষে শান বাঁধানো মৃত পুকুর। পাকা পাতা, শেওলা ও নোংরায় জল আরকাতরার মতো দেখা যায়।
বাড়িটা জলিল আমিরের অভিজাত রুচিবোধের পরিচয় বহন করছে এখনও। আমির নিবাস জানান দেয়–ঐতিহ্যের মাঝেও আধুনিকতাকে ঠেসে ঠেসে ভরে রাখা যায়।
ফটকে চাপ দিতেই মরিচা ধরা ধাতব আওয়াজ উঠল। জয় আলগোছে অন্তূর হাতখানা চেপে ধরে বলে, “ঘরওয়ালি! আপনার পছন্দ হয়েছে শ্বশুরবাড়ি?ʼʼ
অন্তূ পুরোনো দ্বিতল বাড়িটির দিকে দৃষ্টি রেখেই জিজ্ঞেস করে, “আপনাদের পারিবারিক পেশা কী ছিল?ʼʼ
জয় হাসে, অন্তূর কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলে, “আমার পারিবারিক ব্যবসা যেহেতু, ইললিগ্যাল কিছুই হবে! এই যেমন ধরো, মুরগীর দুধ, পাঠার ডিম, মাছের লেগপিসের স্মাগলিং, এরকম টাইপের অনৈতিক ব্যবসা ছিল।ʼʼ
অন্তূ কটমট করে তাকিয়েও হেসে ফেলল অনিয়ন্ত্রিতভাবে। জয় তা দেখে নাক কুচকায়, বাড়ির আশপাশে নজর ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে বলে, “মসলা, কয়লা, পেট্রোলিয়াম টাইপ কাঁচামালের ব্যবসা ছিল।ʼʼ
অন্তূ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এক মুহুর্তের জন্য তার মস্তিষ্কে একটা অযাচিত বাচ্চা বাচ্চা খেয়াল এলো–ঘটনাক্রমে সে ঐতিহ্যবাহী বিশাল এক ব্যবসায়ী, বনেদি বাড়ির বউ হয়ে গেছে। মানব মস্তিষ্ক এমনই জটিল। হুটহাট পরিস্থিতি ভুলে সুখের চিন্তায় মত্ত হতে তার পরিস্থিতির কাছে অনুমতির দরকার পড়ে না।
বাড়ির সীমানায় পা ফেলার পর জয়ের শরীরটা আচমকা ঝাঁকুনি খেয়ে উঠল সামান্য। অন্তূ তা টের পায়। আড়চোখে একবার দেখে। কেউ তাকে ডেকে বলে–জয় আমির জীবন্ত পাথর। সে পাথর তবে জীবন যেহেতু আছে তাই আজও সে শিউরে ওঠে ভূতকালের ঘটনাগত আতঙ্কে।
অন্তূকে নিয়ে ভেতরে এগিয়ে যায় জয়। দু-চারজন ওদেরকে পেছন থেকে ঘুরে দেখে যায়। কৌতূহল ও সমীহে ভরপুর তাদের চেহারা। এই আমিরদের নুন খেয়ে তাদের দিন চলেছে, আজ আমিরেরা ঘোড়াহাঁটের অতিথি! জয়কে সবাই একনজর দেখতে দাঁড়িয়ে থাকে টাকফাটা রোদে। জয় পেছন ফেরে না। সোজা গিয়ে প্রবেশ দরজায় দাড়ায়।
শালকাঠের দরজার হুড়কোখানা ভারী লোহার। তার সাথে কত পুরোনো এক জং ধরা তালা ঝুলছে। মাকড়সার জাল ও নোংরায় হাঁচি উঠে এলো। অন্তূ দরজাটা দেখে। তার উচ্চতার তিনগুণ কমপক্ষে। কালো হয়ে উঠেছে রঙটা।
চাবি ঢুকতে চাইছিল না। অন্তূ খেয়াল করে শুধু তালার ঝং দায়ী নয় এর জন্য, বরং জয়ের হাত ঘেমেছে, হাতের মৃদু কাঁপুনি বোধহয় চোখে ধরা পড়ল।
চাবি ভেতরে ঘুরলেও তালা আঁটকে রইল। অন্তূকে নিজের পেছনে সরিয়ে হাই বুট দিয়ে দুম দুম করে দটো লাত্থি মারল তালার ওপর। ছিটকে খুলে এলো তালা।
জয় দরজা ঠেলে না। দরজা ঠেললেই চোখের সামনে বিছিয়ে যাবে সদরঘর। সেখানে আছে জলিল আমিরের আরাম কেদারাখানা। শেষবার জয় যখন এই সদরঘর দেখেছে, সেই আরাম কেদারার পায়ার কাছে দাদুভাইয়ের মাথাকাটা লাশটা পড়ে ছিল। জয়নাল আমির হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে গেছিলেন তাকে কোলে নিয়ে।
জয়ের ভয় হয় ওই সদর দরজা খুলতেই এক্ষুনি সে দেখতে পাবে দাদুর মাথাকাটা দেহটা পড়ে আছে মেঝের ওপর, এক দলা রক্ত জমাট বেঁধে আছে মেঝের ওপর। জয় বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ওঠে। সে নিজেকে জানিয়েছে, সে সব ভুলে গেছে। তার কিচ্ছু মনে নেই। সে তার মা, বাবা, দাদু কারও চেহারা মনে করতে পারে না।
জয়ের চেতনা ফেরে দরজার ক্যাচক্যাচ আওয়াজে। অন্তূ দরজা খুলে জয়কে বলে, “অসুস্থ লাগছে?ʼʼ
জয় হাসে, “নাহ্। একদম ফিট আছি।ʼʼ
সে বলতে পারে না, সে তার নিজ ঠিকানায় আজ একুশটা বছর পর পা রেখেছে। সেই রাতের পর আর কখনও জয় আমির নিবাসে পা রাখেনি। ষোলো বছর পর ২০১০ এ সরকারের কাছ থেকে নৈতিক-অনৈতিকতাকে এক করে সে বাজেয়াপ্ত এই সম্পত্তি উদ্ধার করেছিল। তার এই নিজ ঠিকানায় একবার ভাঙাচোরা দেহটা নিয়ে উপস্থিত হবার জন্য সে ব্যাকুল হয়েছে, কিন্তু আসার জন্য মানাতে পারেনি নিজেকে। অন্তূকে সঙ্গে নিয়ে নিজ ঠিকানায় পা রাখবার লোভে সে বারবার অন্তূকে নিয়ে আসতে চেয়েছে এখানে। অন্তূটা একমাত্র তার নিজের। আর কেউ ছিল না কখনও তার হাতের কাছে, যাকে নিজের বলা যায়, যাকে নিয়ে নিজেদের পরিচয়ের কাছে ফেরা যায়।
এই সম্পত্তি উদ্ধারের পর সে জিন্নাহকে খুঁজতে আরও বেশি পাগল হয়েছিল। জিন্নাহকে সাথে নিয়ে দুই ভাই আমির নিবাসে ফিরবে। সে জিন্নাহকে পায়নি। তারপর এক অন্তূ তার স্ত্রী। যার সমান হক আছে আমির নিবাসের ওপর, যাকে সাথে নিয়ে সে আমির নিবাসে বসবাস করতে পারে বাকি এই জনমটা।
অন্তূর হাত ধরে সদরঘরে পা রাখে জয়। কোথাও একটু পরিবর্তন নেই। শুধু আসবাবগুলো দুই যুগের ব্যবধানে পুরোনো হয়েছে। ধুলোর স্তর পুরু হয়েছে সেসবের গায়ে। মাকড়সারা নিজেদের রাজত্ব গড়ে তুলেছে ঘরের আনাচে-কানাচে।
জয় স্তব্ধ পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখদুটো আলতো কোরে বুজে নেয়। শিকারী এই বাড়িতে তার শৈশব, কৈশোরের হক ছিল। সে বঞ্চিত হয়েছে। এই অভিজাত্যে, এই বনেদি আবাসস্থলে তার ঠাঁই মেলেনি। অথচ এর সবটাই তার অধিকার ছিল।
অন্তূ চারদিকটা চোখে গিলে নিতে চায়। বিশাল হলরুমটা ধুলোয় স্নান করেও এক টুকরো আভিজাত্য হারায়নি। জানালা খুলে দিলো অন্তূ। পশ্চিমে ঢলতে থাকা সূর্যের চকচকে আলো আছড়ে পড়ল ঘরটার ভেতরে, বহুবছরের অবরুদ্ধ নিশীথের আঁধার কেটে আলো পড়ল সেখানে। ঘরটা কি চমকে উঠল এতে?
ধুলোয় ভারী হয়ে ওঠা মখমলের পর্দা ঝুলছে জানালায়। অন্তূ এই দিনক্ষণে এক অদ্ভুত ও অচেনা অনুভূতি প্রবণতার শিকার হয়েছিল। যা নারীসূলভ, আবেগপ্রবণ। যা এড়ানোর সাধ্যি নারীর থাকে না। অন্তূর ভেতরে কেউ খোঁচায়–এটা তার শ্বশুরবাড়ি! এই আসবাব, ঘরসংসার, গোটানো বাড়িখানায় তার নারীত্বের অংশীদারিত্ব রয়েছে। সে এ বাড়ির বউ!
অন্তূ বিস্ময়ে থমকে ওঠে। ভেতরের যে অংশ তাকে এসব কথা বলছে, তা কি জানে আজ অন্তূ কেন এসেছে এখানে? অন্তূ কী বলতে চায় তার স্বামী নামক আসামীকে! তাহলে এই দ্বিধা কীসের? অন্তূর ভেতরটা চিড়ে যাচ্ছে কি! বিভক্ত হয়ে উঠছে তার চিত্ত। দোটানা বড় যন্ত্রণাদায়ক। সেই দোটানা অন্তূকে হতবিহ্বল করে তুলল। ভেতরে কোথাও একটা নারীসুলভ দাবীর সাথে তার সিদ্ধান্তের তুমুল লড়াই শুরু হয়েছে।
অন্তূ অবাক হয় এই ভেবে–আজও কোথাও একটা তার ভেতরে নারীত্ব আছে। সেই নারীত্ব, যা তার ভেতরে মৃত ঘোষিত হয়েছে সেই কবে!
অন্তূ ছটফটিয়ে ওঠে। ফিরে আসে হলঘরের মাঝখানটায়। জয় সেই আরামকেদারায় বসা। মৃদু দুলছে জলিল আমিরের চেয়ারখানা। এই চেয়ারে জলিল আমির বসে ছিলেন সেই রাতেও! দাদু যাতে বসতে না পারে বা বসলেও হেনস্থা হয় এজন্য জয় মুঠো ভরে ধুলোমাটি এনে চেয়ারে মেখে রাখতো।
একটা সিগার জ্বালায় জয়। চোখ দুটো বুজে সিগারে টান দেয়। এক পাঁজা ধোঁয়া বিশাল হলরুমের নিস্তব্ধ ছাদে গিয়ে মেশে। অন্তূর কাছে আমির বাড়ির বিশালাকায় এই হলরুম স্বপ্নের রাজদরবারের মতো লাগছে! পুরোনো এসব আসবাব কমপক্ষে অর্ধশত বছর পুরোনো। সেরকম এক শালকাঠের দোল-কেদারায় সাহেবদের মতো পোশাক ও হাইবুট পরা জয় আমিরকে দু’হাত দুই-হাতলে মেলে বসে দোল খেতে দেখে অদ্ভুত লাগে! জয় কোথাও ডুবে যাচ্ছে। তার দেহটা দুলছে, সে এই সময়-ধারায় নেই। এক দুলুনিতে কেদারার শব্দটুকু বদ্ধ হলরুমে অদ্ভুত শোনায়।
অন্তূর মনে হয় জয়কে সে আজ প্রথম তার নিজস্ব জায়গায়, নিজস্ব রূপে দেখছে। জয়ের দুষ্টু-বখাটে, জটিল রসিক চেহারায় যে অভিজাত্য ফুটে ওঠে, তা হামজার বদৌলতে নষ্ট হতে হতে নিঃশেষ প্রায়। অথচ তার জন্ম এরকমই এক বনেদি আবাসে!
অন্তূ উদাস চিত্তে পা দুটো গুটিয়ে দোল-কেদারার পায়ার কাছে নোংরা মেঝেতে বসে। তখন বিকেলের নরম পরিবেশে নিস্তব্ধ, শিকারী আমির নিবাসের হলরুম রহস্যে মাখোমাখো হয়ে উঠছিল যেন। জয়ের আঙুলের মাঝে চেপে ধরা সিগারের ধোঁয়ায় বমি ঠেলে আসে অন্তূর। আজ দুটো দিন শরীর তুলনামূলক ভালো।
-“আপনার বাড়ন্ত বয়সটা ভালো কাটেনি।ʼʼ
অন্তূর গলার আওয়াজে জয় আচমকা একটু নড়ে ওঠে, চোখ মেলে তাকায়। শরীরটা সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে সিগার ঠোঁটে গুজে চিরচেনা ভঙ্গিতে হেসে মাথা নাড়ে, “তা আমার খারাপ হওয়াকে তরান্বিতও করেনি। আমি খারাপ, তাই আমি খারাপ, কারণ আমি খারাপ।ʼʼ
-“নাটক করবেন না। খুব অপছন্দের আমার।ʼʼ
জয় হাসল, “নাটক কে না করে, ঘরওয়ালি?ʼʼ
-“আমিও করি। প্রয়োজনের তাগিদে। কিন্তু আপনি এটাকে নিজের পুঁজি বানিয়ে নিয়েছেন।ʼʼ
-“আমার খারাপ হবার পেছনে আমার পেছনের ঘটনার প্রভাব নেই। মেনে নাও।ʼʼ
-“আছে–এটা বরং আপনি মুখে স্বীকার করে নিন।ʼʼ
জয় ঝুঁকে বসে, ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে হেস বলে, “তো তাহলে কি সব মাফ?ʼʼ
-“কিন্তু তা পুরোটা নয়, তা আংশিক।ʼʼ
জয় হাসল, “আংশিক?ʼʼ
-“হ্যাঁ। আংশিক। কারণ অতীত মানুষকে দ্রোহীতার আশ্রয়ে আনে কিন্তু তাকে জানোয়ার বানায় না। আপনি জানোয়ার। কিন্তু আবার পুরোপুরি তাও নন। অতীত আপনাকে না মানুষ থাকতে দিয়েছে, আর না কিছু ক্ষেত্রে পুরোপুরি জানোয়ার হতে দিয়েছে। মানুষ-অমানুষের ঝুলন্ত সেতুতে আপনার অবস্থান।ʼʼ
-“বাপরে! মাইরি কী পর্যবেক্ষণ। বিষয়টা উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করো তো।ʼʼ
-“ব্যাখা ছাড়ুন। উদাহরণ–আপনি সরাসরি ধʼর্ষ’ণকে ভয় পান। কারণ…অতীতের একটি ঘটনা! কিন্তু আপনি অন্য যেকোনোভাবে যেকোনো নারীর সম্মানহানিকে উপভোগ করেন। এক্ষেত্রে আপনার আসল প্রকৃতি কাজ করে, যা জানান দেয় আপনি নোংরা। কিন্তু অতীতের একটি ঘটনা আপনাকে সরাসরি নিকৃষ্ট কাজটিতে লিপ্ত হতে দেয় না। এভাবেই কখনও অতীত আপনাকে সর্বোচ্চ খারাপ বানিয়েছে, যা আপনি ছিলেন না। আবার কখনও আপেক্ষিক ভালো বানিয়েছে যা আপনি নন।ʼʼ
-“শালার! কয় কী রে! তুমি কি আমাকে নিয়ে গবেষণা করার জন্য কি কোনো গবেষণা কেন্দ্র-টেন্দ্র খুলেছ নাকি?ʼʼ
-“প্রয়োজন পড়ে না।ʼʼ
-“বাহ! তো তোমার ধারণা তুমি আমাকে খুব বোঝো?ʼʼ
-“যেটুকু বাকি ছিল, তাও পূর্ণ হয়ে গেছে। এখন হিসেবে তা-ই।ʼʼ
জয় সিগারে টোকা মেরে ছাই ফেলে বলে, “এইটা অন্তত ব্যাখ্যা করো তো, শুনি। প্রথমবার কারও মুখে আমার ব্যাখ্যা শুনতেছি। ই-ন্টা-রেশটিং, ইন্টারেস্টিং। বলো বল শুনি।ʼʼ
-“তার আগে আপনি আজ হেয়ালি থেকে বেরিয়ে আসুন। নিজে মুখে স্বীকার করুন আপনার অতীত আপনার বর্তমানকে একটু হলেও সার্কুলেট করেছে।ʼʼ
জয় ঝুঁকে এলো অন্তূর মুখের ওপর, “কখনও করিনি। এজন্য জেদ করছো?ʼʼ
অন্তূ মুখ পিছিয়ে নেয়, “আজ করবেন।ʼʼ
জয় ভ্রু নাচায়, “জোরপূর্বক করাবে নাকি?ʼʼ
-“না। আপনিই করবেন।ʼʼ
-“বিশ্বাস?ʼʼ
-“যা-ই ভাবুন।ʼʼ
-“তাতে ফায়দা?ʼʼ
অন্তূ হাসল, “আপনি একদিন বলেছিলেন, সবকিছুর ফায়দা এবং ফজিলত খুঁজতে নেই। তাহলে নিজেকে হারিয়ে ফেলার চান্স থাকে। এবং কথাটা সত্যি ছিল আমার ক্ষেত্রে।ʼʼ
জয় নাটকীয় স্বরে বলল, “কবে যেন বলেছিলাম এই কথা, আরমিণ?ʼʼ
-“যেদিন প্রথম আপনার সম্মুখীন হয়েছিলাম। সেই আধখাওয়া সিগারেটটা আলমারীতে এখনও তোলা আছে। সেটার ফজিলতও জানার ইচ্ছে ছিল একসময়।ʼʼ
-“জানতে চাও নাই কেন?ʼʼ
-“ওই যে–সবকিছুর ফজিলত খুঁজতে নেই।ʼʼ
জয় মাথা নত করে হাসল। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“খারাপ-ভালো মুদ্রার দুই পিঠ। তার মানে বোঝো? দেহখন্ড কিন্তু একটাই, শুধু পৃষ্ঠ বিপরীত। মানুষ জন্মের সময় সেই মুদ্রার মাঝের ব্যবধানটুকুর মাঝখানে নিরপেক্ষ অবস্থায় জন্মায়। তারপর মানুষ ধীরে ধীরে যেকোনো এক পিঠে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু অপর পিঠ কিন্তু তখনও বিপরীত। তার মানে পিঠ বদলালে ভালোর খারাপ আর খারাপের ভালো হবার সুযোগ থাকে। আমার সেই সুযোগ ছিল না।ʼʼ
অন্তূ আফসোসের হাসি হাসে, “এত বোঝেন, তবু ফিরলেন না!ʼʼ
জয় ধোঁয়া ছেড়ে হাসে, “সহজ হতো না।ʼʼ
-“আপনার এই জীবনটাও সহজ না।ʼʼ
-“আপন লাগে।ʼʼ
-“পাপকে আপন লাগে?ʼʼ
-“উমম। নিজের নিজের লাগে। ভালোটাকে অপরিচিত লাগে, মনে করো দুঃসম্পর্কের অচেনা কিছু একটা। পাপটা আমার, আমার কাছের, পাশের, সাথের। কেউ কেউ দুনিয়ার পাপের থলে ভারী করতেই জন্মায়, ম্যাডাম! আপনারা আছেন তো তার বিপরীত।ʼʼ
-“অসুস্থ ধারণা।ʼʼ
-“সুস্থটা কী?ʼʼ
অন্তূ কিছুক্ষণ পলক না ঝাপটে চেয়ে থাকল জয়ের চোখ বরাবর। ঘন পাপড়ির মায়াবী-তীক্ষ্ণ চোখদুটো জয়কে একটু অবশ করল। কথা বলা চোখের এই এক দোষ। চোখের ভাষা মারাত্মক ধ্বংসাত্বক হয়। জয় চট করে চোখ ফেরালো।
অন্তূ খুব আন্তরিক স্বরে বলল, “আজ আপনার সাথে আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলাপে বসেছি, জয় আমির। আপনার মনোযোগ পেতে পারি?ʼʼ
-“পাচ্ছ না?ʼʼ
-“আরেকটু।ʼʼ
-“এত মনোযোগ দিয়ে কী হবে?ʼʼ
-“ভয় পাচ্ছেন?ʼʼ
-“পেতে হয় একটু।ʼʼ
-“কেন?ʼʼ
জয় হেসে ফেলল অন্তূর চোখে তাকিয়ে, “কোথাও মনোযোগ দেয়া আমার স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো না। বিশেষ করে তা যদি আপনার মতো বিপরীত মেরুর মানুষের আইনি তত্ত্ব হয়।ʼʼ
অন্তূ জিজ্ঞেস করে, “আইনে খুব ভয় আপনার?ʼʼ
-“নিয়ম-নীতি, আইন-শাসন…পোষায় না আমার।ʼʼ
-“মনোযোগ কেন অস্বাস্থকর আপনার জন্য?ʼʼ
-“মনোযোগে কিছু গড়ে উঠার সম্ভাবনা প্রবল থাকে। তুমি ততদিন মজবুত যতদিন তুমি গড়ে ওঠোনি। কারণ ভেঙে পড়ার একমাত্র পূর্বশর্ত গড়ে ওঠা। যা কখনও গঠিত হয়নি তার ভেঙে পড়ার সুযোগ নেই। আমি কখনও আমায় ঘিরে কিছু গড়ে উঠতে দেই না।ʼʼ
অন্তূ হাসল, “বিশেষ করে পিছুটান আর সম্পর্ক-সমীকরণ!ʼʼ
জয় মাথা দুলিয়ে হাসে, “আমার সাথে যায় না ওসব।ʼʼ
-“আপনার জানা উচিত ছিল–অসম্পর্কও এক প্রকার সম্পর্ক–সবচেয়ে জটিল সম্পর্ক। তা-ই আপনি আমার সাথে গড়েছেন। এর দায় পরিশোধ করবেন না?ʼʼ
জয় একটু মনোযোগী হয়, বোঝার চেষ্টা করে যেন কিছু অন্তূর চোখে চেয়ে, অন্তূ কী বলছে! সে শুধায়, “অসম্পর্ক?ʼʼ
-“আমার-আপনারটা।ʼʼ
-“এর দায় কী?ʼʼ
অন্তূ দম ফেলল গভীর করে। চূড়ান্ত একটা প্রস্তুতি নিলো চূড়ান্ত কিছু বয়ান করার। জয়ের মুখোমুখি বসল বেশ কাছে। ধীর-স্থির আওয়াজে বলতে শুরু করল,
-“জয় আমির! জীবন আপনাকে অনেক ব্যথা-যন্ত্রণার সমাহার দিয়েছে। আর সেটাকে পুঁজি করে আপনি পাপের মহাসমুদ্রে ডুব দিয়েছেন। আপনার দ্রোহীতা মাত্রা ছাড়িয়ে রক্তপিপাসায় পরিণত হয়েছে। যা আপনাকে ভুক্তভোগী থেকে বের করে এনে এক রাক্ষস ও হুমকিতে পরিণত করেছে।
এখন আপনি বলবেন, আমি তো ভিক্টিম প্রমাণিত হতে চাইনি। চেয়েছেন, জয় আমির। আপনি চেয়েছেন। কিন্তু ততদিন, যতদিন আপনি বিচার পাননি। আর তারপর একসময় আপনি নিজেই বিচারক হয়ে গেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আপনার তাণ্ডব শুধু আপনার আসামীদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকেনি। কারণ ঝড় নির্দিষ্ট একটি খুপরিকে উপড়ে ফেলে থামে না, ঝড়ের সেই সীমারেখা-নীতি নেই, সে গোটা অঞ্চলকে বিধ্বস্ত করে।
মানুষকে আপনি ঘেন্না করেন। তাই মানুষ আপনার কাছে একটুও ছাড় পাবার যোগ্য নয়, যে ছাড় ও দরদ একটা পশুপাখিও পায় আপনার কাছে। এতে বড়জোর আপনি মানুষের কাছে নেতিবাচক একটি প্রতিচ্ছবি তৈরি করতে পেরেছেন। এর বেশি কী পেয়েছেন? কী আছে আপনার, বলুন!ʼʼ
জয় চোখদুটো ডানে ফিরিয়ে কেমন করে যেন হাসল, দুনিয়ায় জন্মালে পেতে হবে, এমন কথা আছে? কে দিয়েছে এই কথা? নারী-পুরুষ মিললে তাদের অনুরূপ আরেকটা প্রাণী জন্মায়। এটা একটা জৈবিক ব্যাপার। এখন সেই প্রাণী কিছু পেল না পেল সেটার দায় কারও নয়। আমি পেতে তো আসিনি।
অন্তূ দীর্ঘশ্বাস টানে। জয়ের মানসিক চিন্তাধারা অস্বাভাবিক রকমের অ-ভরসা ও মেকানিক পর্যায়ে চলে গেছে। সে তকদীর, ভালো, আইন, ভরসা, প্রাপ্তি, জীবন, প্রেম, স্নেহ কিছুই মানে না। অন্তূ জয়ের এই কথায় জলন্ত এক ঘা দেখে, যে ঘা শুকিয়ে ক্ষতস্থানটি অনুভূতির ঊর্ধ্বে চলে গেছে। আর না সেখানে ব্যথা লাগে, আর না আরাম পাবার প্রয়াস জাগে! জয় এই বিশ্বাসটুকু অবধি হারিয়েছে, জীবনে আদতেও পাবার মতোন কিছু আছে!
জয় বলল, “মানুষ? ঘরওয়ালি তুমিও সমাজের প্রাণীদের মানুষ বলো? আজও? যারা তোমার অসম্মানে একবারও তোমার কাছে তোমার সত্যতা যাচাই করতে চায় নাই, চোখ বুজে তোমার অনিশ্চিত অপরাধ নিশ্চিত করে শাস্তি দিয়েছে। তাদেরকে তুমিও মানুষ বলো!ʼʼ
-“এক্সাক্টলি! দ্যাটস দ্য পয়েন্ট, জয়। সমাজের অধিকাংশই মানুষের মতো দেখতে অমানুষ। কিন্তু সেই অমানুষদের মাঝে আপনিও যদি একটা হোন, আপনার অমানুষিকতার তোপে আমিও যদি প্রতিশোধপরায়ন হয়ে আরেকটা অমানুষে পরিণত হয়, আমার তোপে আরেকটা কেউ অমানুষে পরিণত হয়—বাকি মানুষেরা অমানুষ হতে খুব বেশি দেরি লাগবে কি?ʼʼ
-“কী বোঝাতে চাচ্ছ?ʼʼ
-“আপনি তা বুঝতে চান?ʼʼ
জয় সিগারটা আঙুলের ভাজ থেকে ছুঁড়ে মারল কোথাও, “শুনতে চাই আপাতত।ʼʼ
অন্তূ চোখের মণি এতক্ষণ চিকচিক করছিল, এবার পানি জমে। দুজনের নজর এক বিন্দুতে মিলিত হয়। অন্তূ সজল চোখে নিজের দু’হাতের তালুতে চোখ রাখে। হাতদুটো থরথর করে কাঁপছে। অন্তূ তা দেখিয়ে জয়কে বলে,
“এই দেখুন, আপনি দেখছেন আমার হাতদুটো? আপনি দেখতে পাচ্ছেন আমার রক্তাক্ত হাতের তালুদুটো? আজ আমার এই দুই হাত আগ্নেয়াস্ত্র চালানো দুটো হাত। আমার হাত চার-চারজন মানুষের রক্তে লাল। আপনি বলুন তো এটা কি হবার ছিল? এটা কি আমার আব্বুর আদর্শ ছিল, জয় আমির?ʼʼ
জয় কেমন ছটফট করে ওঠে যেন। চেপে ধরে অন্তূর কম্পমান হাতদুটো। সে অন্তূর কান্না দেখে অভ্যস্ত, দেখতেও চায় না। অথচ আজ সে চোখ ফেরাতে পারে না। সে দেখে অন্তূ কান্নায় সে কী নিদারুণ হাহাকার!
অন্তূর থুতনি কাঁপে, অন্তূ বলে, “ছোটবেলা থেকে আমার মুখের ভাষা ক্ষেত্রবেশেষ কর্কশ। কিন্তু হাতদুটো ছিল নরম। আজ তা মানুষের রক্তে রাঙা। আব্বু আমাকে প্রতিবাদ শিখিয়েছিল। কিন্তু কখনও আঘাত করতে শেখায়নি, জানেন! আমার প্রতিবাদ ছিল হিংস্রতা, অমানুষিকতার বিরুদ্ধে, আজ আমি নিজেই হিংস্র, মুখোশধারী, অমানুষিক জয় আমির। আজ আমি মাহেজাবিণ আরমিণ অন্তূ সেই সকল রক্তপিপাসু অমানুষদেরই একজন, যাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার জের ধরে আজ আমি এই অবধি।
আমি উকিল হতে চাই। কীসের উকিল? অন্যায়কারীকে আইনত শাস্তি দিয়ে নিরপরাধকে মুক্তি দেবার উকিল! তা-ই যদি হয়, তাহলে আমার জীবনের প্রথম কেইস আমাকে আমার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। আমাকে আমার নিজের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনে দাঁড়াতে হবে আমার অপরাধের শাস্তি কার্যকর করতে। নিজেকে দুটো খুন ও দুটো মানুষকে আহত করবার দায়ে ফাঁসিতে ঝুলানোর রায় চেয়ে বিচারকের কাছে আরজি জানাতে হবে।
এটা ছিল আমার লক্ষ্য? এই লক্ষ্যে আমজাদ আলী প্রামাণিক আমাকে ছোট থেকে আদর্শ ও সত্যের পথে অবিচল করতে সচেষ্ট ছিলেন?ʼʼ
অন্তূ গলা কাঁপে, থুতনিও। চোখ বেয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ে। জয় চোখদুটো পাথরে খোদাইকৃত মূর্তির চোখের মতো স্থির রইল অন্তূর মুখে। তার কাছে জবাব নেই। অন্তূ কী বোঝাচ্ছে? অন্তূ কেন রাবেয়ার মতো কথাবার্তা বলছে? অন্তূ কেন জয়ের মতোন প্রতিশোধের পক্ষপাতিত্ব করছে না? জয় অস্থির হয়।
অন্তূ নাক টেনে সোজা হয়ে বসে। সে নিজের অজান্তেই বোধহয় এবার নখ দিয়ে আঁকড়ে ধরে জয়ের হাত। বলে,
“আজ আমি প্রতিশোধের নেশায় তা-ই হয়ে গেছি, যা-র বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ-যাত্রা আমার। আপনি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে মনুষত্ব হারিয়ে পাপকে জায়েজ করে তুলেছিলেন। সেই মতো আমার সাথে যা করেছেন, তার শিকার হয়ে আমিও এক জয় আমিরে পরিণত হয়েছি। যার লক্ষ্য কেবল ধ্বংস, রক্ত, অন্ধকার! কিন্তু এটা তো আমার পথ নয়! এটা বুঝতে আমার কিছুটা সময় লেগেছে। আমাকে এই বাড়ির সেই রাতে আসতে হয়েছে। আপনার গল্পে যেদিন আমি আমির বাড়িতে নিজেকে রেখেছি, তারপর টের পেয়েছি আপনার ভেতরটায় কোনো জানোয়ারেরা একটা জানোয়ারের চাষ করেছে। আপনি সেই জানোয়ার ঘটনাক্রমে আমার ভেতরে সেই একই জানোয়ারের চাষ করতে সফল হবার পথে।
আপনি বলেন, আপনি জলতরঙ্গ। আপনার গতিপথ রুখার উপায় নেই। সেই ঢলে নিজেকেই ভেসে যেতে হয়। আমি ভেসে গেছি, ভেসে গেছে আমার আদর্শ, আমার গন্তব্যের পথ, আমার চিন্তা-ধারা ও নিজস্বতা। আপনি কখনোই মিথ্যা বলেন না জয় আমির। কেন? এক-দু’বার মিথ্যা বললেও পারেন!ʼʼ
জয় আস্তে কোরে বলে, “আমার অভিজ্ঞতা বেশি…ʼʼ
অন্তূ ভেজা চোখে হেসে দিলো, “আপনার সেই অভিজ্ঞতাকে টেক্কা দিতে গিয়ে আমি আজ আপনার পথে পরিচালিত। এই অধঃপতনের দায় আমার। আপনি পাপ করলেনই বা, তার শিকার হয়ে আমিও কেন? আপনি অমানুষ হলেন বা, আমি মানুষ হতে পারতাম…
কয়লার সংস্পর্শে গিয়ে আমি নিজেকে কালি থেকে বাঁচাতে পারিনি। জলন্ত কয়লা আমাকে যেমন পুড়িয়েছে, আমার চরিত্রকে ঠিক সমানভাবে কলঙ্কিত করেছে। আপনি যে বিমুখতার শিকার হয়েছিলেন আমি তার একটুও ব্যতিক্রমে যাইনি। আপনি যেদিন আমায় শত মানুষের সামনে ইজ্জতহীনা প্রমাণ করলেন, তারপর আমি সত্যিই নিজের ইজ্জত বিকিয়ে দিয়েছি। আপনার মতোই সেই রবের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে নিজে নিজের বিচাকর হয়ে গেছি। আমি আমার পর্দা, মানসিকতা, শিক্ষা সব লুটিয়ে দিয়েছি।
আব্বুর মৃত্যুর সাথে সাথে আমি তার সকল চিহ্ন মিটিয়ে দিয়েছি নিজের ভেতর থেকে। অথচ আমি ভাবছিলাম আব্বু আমাকে দূর করছে, যেখানে দূর আমি তাকে করেছি।
আমি প্রথম প্রথম তাঁর অস্তিত্ব টের পেতাম। ধীরে ধীরে তাঁর অস্তিত্ব তার নিজস্বতা হারালো। আমি বুঝতে পারলাম, আব্বুর জবান থেকে আজাকাল আমার ভেতরে নতুন জন্মানো সংকীর্ণ চিন্তাধারামূলক কথা বের হয়। এরপর ধীরে ধীরে আব্বুর উপস্থিতি বিলীন হয়ে গেল আমার ভেতর থেকে। আব্বু আর আসেনি। আসলে তার অস্বিত্ব ছিল তার আমাকে দেয়া শিক্ষাগুলো। সেগুলোকে দাফন করে ফেলেছিলাম আমি নিজের ভেতর থেকে। তার অস্তিত্ব টের পাবার প্রশ্ন ওঠে না। মানুষ তার কর্ম ও শিক্ষার মাধ্যমে তার পরিবর্তি আত্মীয়র মাঝে বেঁচে থাকে। আমি তাকে আমার ভেতরে ঠাঁই না দিয়ে ঠাঁই দিলাম আপনাকে, হামজাকে, পলাশকে। কুকুরের কামড় খেয়ে হয়ে গেলাম কুকুর। কামড়াতে গেলাম কুকুরের পায়ে। এ কি মানুষে শোভা পায়?
জয়নাল কাকা আপনাকে কী শিখিয়েছেন, জানি না। কিন্তু আমার আব্বু আমাকে তা শেখায়নি, তা বানাতে চায়নি, আজ আমি যা। আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ আমি, আপনারা উনাকে মেরে না ফেললে উনি উনার অন্তূকে আজ এই পথে দেখে সহ্য করতে পারতেন না। উনি অন্তূকে অন্তূ থাকা অবস্থায় রেখে ছুটিতে গেছেন। এই কৃতজ্ঞতা জানবেন আপনারা আমার পক্ষ থেকে।ʼʼ
অন্তূ ঝরঝর করে কাঁদে, অথচ তার ঠোঁট নিজের ওপর তাচ্ছিল্যে হাসছে। সেই হাসি মিলিয়ে যায়। অন্তূ চোখ মুছল, মুখে হাত বুলিয়ে নিজেকে শান্ত করে। জয়ের হাতদুটো ছেড়ে দেয়। জয় বোবা হয়ে বসে আছে। তার ভেতরে কেমন কেমন যেন লাগছে! এটা হেরে যাবার অনুভূতির মতোন! জয় বকে উঠল নিজেকে। আবার দিশেহারার মতোন অন্তূর কান্নায় লাল হওয়া স্নিগ্ধ মুখখানায় কিছু খোঁজে।
অন্তূ নিজেকে সামলে এক টুকরো মুচকি হাসল, “আমার আব্বুকে মারা হয়েছে, আমার পরিবারকে ধ্বংস করা হয়েছে,আমার কাছ থেকে আমার ইজ্জত ও আমাকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। আমার ভাইকে মারা হয়েছে। এছাড়া যেখানে যা হয়েছে…..এই সবের দায় আজ আমি আপনাদের ওপর থেকে তুলে নিলাম। আমি সজ্ঞানে, সেচ্ছায় আজ ক্ষমা করে দিলাম আপনাকে, জয় আমির।ʼʼ
জয় একটা ঝাঁকুনি খেলো, তা তার অনিয়ন্ত্রিত। শরীরের পশমগুলো কেঁপে উঠল। থরথর করে শিউরে উঠল জয়ের দেহখানা।
অন্তূ বলল, “আপনি যখন অনাচারের শিকার হয়েছেন, তা হয়ত ছিল রাজনৈতিক, হয়তবা পারিবারিক অথবা পশুদের জঙলি উল্লাস। তা আপনার ভেতরের মানুষটাকে জাগ্রত থাকতে দেয়নি, তাকে ঘুম পাড়িয়ে এই জয় আমিরের উদ্ভব ঘটিয়েছে। আপনি নিজেকে নিজের পালনকর্তা ও বিচারকর্তা মেনে নিয়েছেন। কারণ আপনার বিশ্বাস অনুযায়ী কোনো মালিক নেই।
কিন্তু আমি? আমি আট বছর বয়স থেকে আমার রবকে সেজদা করে আসছি। তাতে বিশ্বাস, ভরসা ও ভক্তির তো কমতি ছিল না! আমার পালনকর্তা মহাবিচারক, মহান শাস্তিদাতা, মহাপরাক্রমশালী। আমি তো তার প্রতি বিমুখ নই। তাহলে আমি কেন আমার সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচার নিজে করব? আমি বরং তা ছেড়ে দেব আমার একমাত্র পালনকর্তার ওপর। আমি দেখতে চাই, আমার পালনকর্তার বিচার কেমন। তিনি সকলের প্রাপ্য ন্যায্য হাতে বুঝে দিতে অদ্বিতীয়। আমার পাপের ফল আমি পাব, আপনারটা আপনি। আমি তো বিচারকর্তা নই। আমি গোলাম। আমি সেই মালিকের গোলাম, যার হিসাবে ভুল হয় না, যা বিচারে না-ইনসাফি হয় না।
আর আপনি তো আমায় মেরে ফেলেননি। আপনি আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, সব রকম দৈহিক আঘাত থেকে বাঁচিয়ে আপনি আমার রুহুটাকে তড়পে তড়পে মেরেছেন। আমি আপনাকে মারব কেন? যেখানে মৃত্যু আপনার প্রেমিকা, আপনার একমাত্র গন্তব, আপনার প্রত্যাশা। যে প্রেম আপনি প্রায় দুই যুগ ধরে নিজের ভেতরে লালন করছেন, তা আপনাকে ধরিয়ে দেবার রাস্তার সহযোগী আমি হব না। মৃত্যু আপনার শাস্তি হতে পারে না।
আপনাকে আমি আজ মাফ করে দিলাম, সবকিছু থেকে। তুলে নিলাম আমার সকল অভিযোগ। আপনি মুক্ত আজ থেকে। আজ আমার সমস্ত অভিযোগ ও অনাচারের দায় থেকে মুক্ত করে দিলাম। ক্ষমা করে দিলাম আপনাকে….
কথা ফুরোয় না অন্তূর। থাবা দিয়ে অন্তূর গলা চেপে ধরল জয়, “এই শুয়োরের বাচ্চা, তুই আমাকে ক্ষমা করার কে? তোর কাছে ক্ষমা চেয়েছি আমি? আমি চেয়েছি ক্ষমা? ক্ষমা করলে মানুষ তাকে ভুলে যায় রে! তুই আমাকে আজ ক্ষমা করে ভুলে যাবি? মহান হয়ে যাবি তুই? তা হবে না! আমি তোর কাছে ক্ষমা তো চাইনি! ক্ষমা করবি কেন? কীসের ভিত্তিতে তোর এই মহানুভবতা?…ʼʼ
ফোন বাজল জয়ের। ঘেমে উঠেছে তার শরীর। শার্টের ফাঁক দিয়ে লোমাবৃত বুকটা দেখা যায়, তান্ডব উঠেছে সেখানে। উঠানামা করছে বিক্ষিপ্ত শ্বাসের দমকায়। অন্তূ শুনতে পায় জয়ের হৃদযন্ত্রের কপাটিকার লাফালাফি!
সে হাসে। আলতো করে হাসে। জিতে যাওয়ার হাসি। যে জিতটা জয় জিততে চেয়েছিল বোধহয়! জয় ছেড়ে দেয় তার গলা।
কল রিসিভ করে। কলটা রাজধানী থেকে এসেছে। কেউ জানায়, রাজধানী থেকে দিনাজপুর ফিরবার পথে দুপুর তিনটায় হামজার গাড়িখানা একটি বাইকের সাথে ক্র্যাশ হয়েছে…
চলবে…
[সন্ধ্যা বারোটায় গল্প দিলাম। বড় বড় মন্তব্য করবেন। বাকি রাতটা মন্তব্য পড়ে কাটাবো। খুবই বিশ্রী একটা পর্ব যদিও, ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]