অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল
৪৪.
অতীত~
সকাল দশটা বাজে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দিনের প্রথম সিগারেট ধরালো রুদ্র। মনে মনে পরিকল্পনা সাজাচ্ছে। কাল প্রিয়তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হওয়ার কথা থাকলেও বের হতে পারেনি। হঠাৎই রাশেদের জরুরি তলব পড়ে। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল টাকা। পরের প্রজেক্টের ডিলটা কনফার্ম করার জন্যে যত টাকা প্রয়োজন ছিল, তত টাকা এখনো জোগাড় হয়নি। হাতে সময় আছে চারদিন। বেশ কয়েক কোটি টাকার ব্যপার। প্রয়োজনের চেয়ে অনেকটা বেশি টাকা দিয়েই করতে হচ্ছে ডিলটা। একবার মালগুলো হাতে পেলে লাভ প্রচুর। তখন এই বাড়তি খরচটা গায়ে লাগবেনা। কিন্তু এই চারদিনে কীভাবে এতোগুলো টাকা জোগাড় করবে সে বিষয়েই ভাবছে রুদ্র।
নিচে সবকিছু গুছিয়ে রুমে এলো প্রিয়তা। রুমটা ফাঁকা দেখে খানিকটা ঘাবড়ে গেল ও। রুদ্র বেরিয়ে যায়নি তো? ওপরে উঠে আসার সময় তাড়াতাড়ি আসতে বলেছিল প্রিয়তাকে। কিন্তু প্রিয়তা সব গোছাতে গিয়ে দেরী করে ফেলেছে। প্রিয়তা ভেবেছিল পাঁচ মিনিটের বেশি লাগবেনা। কিন্তু এতোটা সময় লেগে যাবে বুঝে উঠতে পারেনি। নিশ্চয়ই রাগ করেছে রুদ্র? বিষণ্ন মন নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল প্রিয়তা। তখনই ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢুকলো রুদ্র। হাতে ফোন। প্রিয়তাকে দেখে বলল, ‘তো এতক্ষণে ম্যাডামের আমার কথা মনে পড়ল?’
প্রিয়তা অপরাধীর ন্যয় মাথা নুইয়ে বলল, ‘স্যরি। আসলে আমি ভেবেছিলাম তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। বুঝতে পারিনি এতোটা লেইট হয়ে যাবে।’
রুদ্র গম্ভীর মুখ করে এগিয়ে এলো। প্রিয়তা ভাবল নিশ্চয়ই এখন ধমক দিয়ে বসবে রুদ্র। কিন্তু ওকে অবাক করে, রুদ্র একহাতে জড়িয়ে ধরল প্রিয়তার কোমর। সামনের ছাটা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠেই বলল, ‘একটা কথা মাথায় রাখবে। এ বাড়িতে কাজ করার জন্যে অনেকে আছে। তুমি হাত না লাগালেও কেউ না কেউ ঠিক করে দেবে। কিন্তু আমার বউ একটাই। বাড়িতে আমি যতক্ষণ থাকব, ততক্ষণ তোমাকে আমার আশেপাশে চাই। বোঝা গেছে?’
প্রিয়তা রুদ্রর দুই কাঁধে দুহাত রেখে বলল, ‘ হ্যাঁ বোঝা গেল। মাস্টারমশাই এমন গম্ভীর রাগী হলে না বুঝে উপায় আছে? ভুল হয়ে গেছে সাহেব। এবার ছাড়ুন। আপনার সেবায় নিয়োজিত হই।’
‘এই! তোমার ভয় কেটে যাচ্ছে!’
‘আপনাকে ভয় পেতে যাব কোন দুঃখে? আপনি বাঘ-ভাল্লুক না-কি?’
রুদ্র প্রিয়তার কোমর টেনে আরেকটু কাছে এনে বলল, ‘সত্যিই ভয় পাও না?’
প্রিয়তা চেহারায় কৃত্রিম বিরক্তিভাব ফুটিয়ে তুলল। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ছাড়ুন তো! এখন দেরী হত না আপনার?’ জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে কাবার্ডের দিকে যেতে যেতে বলল, ‘নিচে সবার সামনেই যেভাবে তাড়া দিচ্ছিলেন। কুহু, ভাই মিটমিটিয়ে হাসছিল। খালারা অবধি সব হেসে কুটিকুটি। কী লজ্জার ব্যাপার! ভাগ্যিস বাবা বা কাকা ছিলেন না। বিয়ের আগেতো আপনাকে এমন হ্যাংলা মনে হয়নি। ঘোল পাল্টে ফেললেন কেন?’
রুদ্র বলল, ‘ মারাত্মক প্রশ্ন। উত্তর পেলে জানিয়ে দেব।’
প্রিয়তা মুচকি হাসল। রুদ্রকে গায়ে শার্টটা জড়িয়ে দিয়ে বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল, ‘কোথায় যাবেন আজ?’
‘ অফিসে। কেনো?’
‘ না, এমনি।’
রুদ্র প্রিয়তার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘চিন্তা করোনা। আপাতত কারো গলা কা-ট-তে যাচ্ছিনা। আর তোমার স্বামীর গলা কা-টা-র মতো সাহস কারো নেই।’
উত্তরে তপ্ত শ্বাস ফেলল প্রিয়তা। বোতাম লাগানো শেষ করল। এরপর রুদ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল। রুদ্র বলল, ‘আজ ডেকে আনতে হয়েছে। পরেরবার যেন এরকম না হয়। আমি বের হওয়ার সময় আমার শার্ট পড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তোমার। আর দায়িত্ব এরিয়ে যাওয়া মানুষদের আমি পছন্দ করিনা। কঠিন শাস্তি দেই।’
প্রিয়তা আবার হাসল। বলল, ‘যো হুকুম, জাহাপনা।’
–
আমের ফাউন্ডেশনে গিয়ে বসার সুযোগ পায়নি রুদ্র। যাওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই আবার বের হতে হলো। আমের মিলস্ এর ফ্যাক্টরিতে যাবে। রাশেদ, রুদ্র আর উচ্ছ্বাসও আছে সঙ্গে। রুদ্র আর উচ্ছ্বাস অফিসের ঢোকার সুযোগটাও পায়নি। তার আগেই রাশেদের নির্দেশ চলে এসেছে। উচ্ছ্বাস ড্রাইভ করছে। রুদ্র সামনের সিটে বসে আছে আর রাশেদ পেছনের সিটে। হঠাৎ এতো তাড়া দেখে রুদ্র প্রশ্ন করল, ‘কিছু কী হয়েছে বাবা?’
রাশেদ তাকালেন না। বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললেন, ‘মালগুলো যাবে আজ। ভুলে গেছো?’
রুদ্র উত্তর দিলোনা। মাল ডেলিভারির কথা ও ভোলেনি। কিন্তু এটাও জানে রাশেদ মনে মনে অস্থির হয়ে আছেন। অস্থির থাকলেই সবকাজ দ্রুত সেরে ফেলতে চান উনি। বহুবছর পর সদাস্থির রাশেদকে আজ অস্থির দেখছে রুদ্র।
উচ্ছ্বাস বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে আমাদের কাজটা কয়েকদিন পেছাতে হবে। এতো দ্রুত এতো টাকার এরেঞ্জমেন্ট কোনভাবেই সম্ভব নয়। সকালে জাফর কাকা আর ইকবাল ভাই একই কথা বলছিল।’
রুদ্র গম্ভীর গলায় বলল, ‘পেছানোর কোন প্রয়োজন নেই। কাজ ঠিক সময়েই শুরু হবে।’
চমকে রুদ্রর দিকে একপলক তাকিয়ে আবার গাড়ি চালানোতে মনোযোগ দিল উচ্ছ্বাস। রাশেদও চমকে উঠেছিলেন, কিন্তু এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের জন্যে। পুনরায় একইভাবে তাকিয়ে রইলেন বাইরের দিকে। ততক্ষণে গাড়ি ফ্যাক্টরির সামনে চলে এসছে। গাড়ি থামিয়ে উচ্ছ্বাস বলল, ‘কিন্তু টাকা…’
রুদ্র জবাব না দিয়ে নেমে গেল গাড়ি থেকে। রাশেদও নামলেন। উচ্ছ্বাস বোকার মতো কয়েক সেকেন্ড বসে থেকে নিজেও নেমে এলো। ওরা ভেতরে ঢুকতেই দৌড়ে এলো রঞ্জু। সালাম দিলো তিনজনকেই। কাজ করে ঘেমে গেছে কালো হাফ হাতা গেঞ্জিটা। জিন্সটা গুটিয়ে ফেলেছে প্রায় হাঁটু অবধি। চেক চিটচিটে চুল বেয়ে ঘাম ঝরছে অনবরত। রুদ্র জিজ্ঞেস করল, ‘আটার প্যাকেটগুলো রেডি?’
‘জি ভাই। নয়শ প্যাকেট আছে।’
‘মাল কয়টার ভেতরে আছে?’
তিন-চার সেকেন্ড চিন্তা করে রঞ্জু বলল, ‘তিনশ।’
রুদ্র গম্ভীর আওয়াজে বলল, ‘এতে হবেনা। আরও দু’শ প্যাকেটে ঢোকা। মোট পাঁচশ প্যাকেট। রাত দুটোয় ট্রাক আসবে। এখান থেকে নয়শ প্যাকেট বের হবে। ওদিকে সিলেটের মিল থেকে চারশ পিওর প্যাকেট আসবে। একেকটা গাড়িতে পঞ্চাশটা প্যাকেট থাকবে। প্রতি স্টেশনে পঞ্চাশটা পিওর আটার প্যাকেটের সঙ্গে মালওয়ালা প্যাকেট এক্সচেঞ্জ করে দিতে হবে। পিওর প্যাকেটগুলো সব এখানে চলে আসবে। আর মালওয়ালাগুলো ক্লাইন্টের কাছে।
উচ্ছ্বাস কিছু বলতে নিয়েও বলল না। তাকাল রাশেদের দিকে। রাশেদ নির্বিকারভাবে চারপাশটা দেখতে দেখতে সিগারেট টানছেন। মনে হচ্ছে এদিকে তার কোন ধ্যান নেই। কিন্তু রুদ্রর প্রতিটা কথাই যে সে মনোযোগ দিয়ে শুনছে তা জানে উচ্ছ্বাস।
রুদ্র আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কাকা আর ইকবাল ভাই কোথায়?’
‘ ছাপাখানায় গেছে। বইয়ের মধ্যে যে মালগুলো যাবে সেগুলো দেখতে।’
রুদ্র হাঁটতে হাঁটতেই ফোন করল জাফরকে। জাফর কল রিসিভ করতেই বলল, ‘ আরও দেড়শটা বই বাড়িয়ে দাও।’
ওপাশ থেকে জাফর ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘কিন্তু এতো কম সময়ের এতোগুলো বই কীকরে কাটবে?’
রুদ্র কঠোর আদেশের ভঙ্গিতে বলল, ‘আজকের জন্যে ব্রেক বন্ধ। একদিন না খেলে মরে যাবেনা ওরা। প্রয়োজনে কাজ শেষে পেট ভর্তি করে বিরিয়ানি খাইয়ে দিও।’
ইকবালের গলার আওয়াজ শোনা গেল। ইকবাল বলল, ‘কিন্তু রিস্ক হয়ে যাবে। চেকপোস্টে ঝামেলা হবে।’
‘ভালো বইগুলো ওপরে রেখে নিও। বাকিটা আমি দেখে নেব।’
কথাটা বলে ফোন কাটল রুদ্র। ফোন রেখে জাফর আর ইকবাল হতভম্ব চোখে তাকাল একে ওপরের দিকে। পাগল হয়ে গেছে না-কি ছেলেটা?
এদিকে ওখানেই রাখা হাতল ছাড়া চেয়ারগুলোতে বসল ওরা। রঞ্জু দাঁড়িয়ে রইল একপাশে। উচ্ছ্বাস বলল, ‘ইকবাল ভাই কিন্তু ভুল কিছু বলেনি। একটু বেশিই রিস্ক হয়ে যাচ্ছেনা?’
‘চারদিনের মধ্যে আমার টাকা লাগবে। এটাই মূল কথা। ডিলটা নিতে দেরী করে ফেললে অন্যকোন গ্রুপ যেকোন মুহূর্তে হাতিয়ে নিতে পারে। আর সেটা হলে কী হবে তা কারো অজানা না। উই হ্যাভ টু টেইক দিস চান্স। যেখানে প্রতিটা শ্বাস রিস্কের ওপর বসে নিচ্ছি সেখানে এইটুকু কিছুই না।’
রাশেদ এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার মুখ খুললেন। বললেন, ‘কিন্তু এক্সট্রা মাল ডেলিভারিতে যা আসবে তা পুরোপুরি যথেষ্ট নয়। বড় একটা এমাউন্ট তবুও বাকি থেকে যায়।’
রুদ্র মৃদু হেসে রাশেদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমাদের ব্যবসায়ী বন্ধুরা আছে কী করতে?’
তারপর উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রিপন চৌধুরীকে একটা কল লাগাতো। বল এবার দু কোটিতে আমার পেট ভরবেনা। পাঁচ কোটি চাই। আমাদের আমের ফাউন্ডেশনের নামে যাতে চারদিনের মধ্যে ডোনেট করে দেয়।’
উচ্ছ্বাস ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে কল করল। রুদ্রর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘শালা এবার শিওর হার্ট ফেইল করবে। যেই বাঁশ খাইছে। এরপর আর কোনদিন মেয়েছেলে নিয়ে হোটেলে উঠবে বলে মনে হয়না।’
কাছে থাকায় শুনতে পেল রঞ্জু। ফিক করে হেসে বলল, ‘আমারতো মনে হয় ব্যাটা হোটেলের নাম শুনলেই এখন প্যান্ট ধইরা দৌড় মারে।’
অতঃপর বাকিদের উপস্থিতি বুঝে থতমত খেয়ে গেল। রুদ্র চোখ পাকিয়ে তাকাল রঞ্জুর দিকে। রঞ্জুর মুখটা তখন অবোধ, অসহায়। ঠোঁট চেপে হাসি নিয়ন্ত্রণ করছে উচ্ছ্বাস। রুদ্র সোজা হয়ে বসে রাশেদকে বলল, ‘আমার চেনা-জানা এমনই কয়েকজন বিজনেসম্যান আছে বাবা। চারদিনের মধ্যে ফাউন্ডেশনে টাকা জমা করে দেবে। মানি লন্ডারিং এর মাত্রা আরেকটু বাড়িয়ে দিলে আর ঝামেলা হবেনা। কাজ সময়মতোই শুরু হবে।’
রাশেদ এ বিষয়ে কিছুই বললেন না। যেন রুদ্রর বাক্সই ব্রহ্মবাক্য। প্রসঙ্গ পাল্টালেন। থমথমে গলায় বললেন, ‘ইন্সপেক্টর আজিজ এসছিলেন সকালে। সার্ভেন্ট ছাড়া অন্যকারো হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি ছু-রিতে। হয় খুনি গ্লাভস্ পড়ে ছিল, নয়তো সার্ভেন্টদের মধ্যেই কেউ।’
রুদ্র নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘ গ্লাভস্ জাতিয় কিছুই পরে ছিল। এখনো দিব্বি ঘুরে বেরাচ্ছে। উঠতে বসতে দু বেলা সালাম ঠুকছে আমাদের। তবে পড়েরবারের সালামটাই ওর শেষ সালাম হবে। পুলিশের হাতে ও পড়বেনা। চিন্তা করবেন না।’
কথাটা বলে একপলক রঞ্জুর দিকে তাকাল রুদ্র। রাশেদ কিছু বললেন না। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে চলে গেলেন। উনি জানেন এ ব্যপারে ওনার কোন বারণ রুদ্র শুনবে না।
এদিকে রুদ্র ভাবছে অন্যকথা। টাকার ব্যপারটা সমাধান করে দেওয়ার পরেও রাশেদের কপাল থেকে চিন্তার রেখা সরেনি। তারমানে তার চিন্তার কারণটা ভিন্ন। রাশেদ দূরদর্শী মানুষ। হয়তো সে এমন কিছু ঘটার আভাস পাচ্ছে যা অন্যকেউ দেখতে বা বুঝতে পারছেনা। সাংঘাতিক কিছু হতে চলেছে। আর সেটাই ভাবাচ্ছে রুদ্রকে।
–
ভার্সিটির কালচারাল ক্লাবের ফাংশন হচ্ছে। এতক্ষণ নাচ-গান হৈ হুল্লোড় দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে উঠেছে কুহু। তাই কিছুক্ষণ ব্রেক নেওয়ার জন্যে রীতিকে নিয়ে বেরিয়ে আসে অডিটোরিয়াম থেকে। গিয়ে বসেছে ক্যাম্পাসের সেই পুকুরপাড়ে। গালে হাত দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পুকুরের পানির দিকে। রীতি ওর পাশে বসেই ফোনে চ্যাটিং করছে কারো সঙ্গে। ফোনে ব্যস্ত থেকেই বলল, ‘কীরে? এমন চুপ করে বসে আছিস কেন? ভেতরে সবাই কত মজা করছে। আমাকেও এখানে নিয়ে এলি। কতক্ষণ থাকবি?’
কুহু কোন রেসপন্স করল না। এখনো তাকিয়ে আছে পুকুরে। তখনই ওখানে এসে উপস্থিত হলো নীরব। কুহুর পাশে বসে বলল, ‘হেই গার্লস। হোয়াটস্ আপ? ভেতরের নাচ-গান ছেড়ে তোমরা এখানে কী করো?’
কুহু এবারও কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। রীতি ফোন থেকে চোখ তুলে তপ্ত শ্বাস ফেলল। নীরবের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমারতো সব ঠিকই আছে ভাইয়া। কিন্তু ম্যাডামের মুড অফ। সকাল থেকে নো রেসপন্স। এবার আপনিই দেখুন। ‘ও’ আবার অপেক্ষা করছে আমার জন্যে।’
নীরবকে কুহুর কাছে রেখে রীতি চলে গেল। নীরব এবার ভালোভাবে তাকাল কুহুর দিকে। মৃদু হেসে বলল, ‘কী হয়েছে কুহুরাণীর? মন খারাপ কেন?’
কুহু জবাব দিলোনা। প্রতিদিনকার মতো ঝটপট ফোনটাও বের করল না। নীরব কিছুটা অবাক হলো। কুহুর হাতটা ধরে নিজের হাতের মুঠোয় এনে বলল, ‘কী হয়েছে? রেগে আছো আমার ওপর?’
কুহু এবার সরাসরি তাকাল নীরবের দিকে। বাদামি রঙের পাঞ্জাবীতে বেশ মানিয়েছে। লাল দোপাট্টাও লং লেন্থে কাটা চুলের সঙ্গে বেশ মানানসই। কুহু অলস ভঙ্গিতে হাত ছাড়িয়ে নিল। তারপর ফোন বের করল পার্স থেকে। লিখল, ‘আপনার ওপর রাগ করব কেন? মন ভালো নেই আমার।’
মেসেজটা পড়ে ভ্র কুঁচকে ফেলল নীরব। বলল, ‘মন ভালো নেই কেনো?’
কুহু লিখল, ‘ কিছুনা। সামনে এক্সাম সেই টেনশনে হয়তো।’
‘বোকা পেয়েছো আমাকে? আমি দেরী করে এসেছি বলে রাগ করেছো, তাইনা?’
কুহু কিছু লিখল না। মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল। নীরব সিঁড়ির এক স্টেপ নিচে নেমে বসল কুহুর সামনে। তারপর দুই কান ধরে বলল, ‘স্যরি। একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই দেরী হয়ে গেছে। সো স্যরি।’
কুহু কোন উত্তর দিলোনা। যেন শুনতেই পায়নি কিছু। নীরব খানিকটা অসহায় গলায় বলল, ‘স্যরি বলছিতো। এরকম করছো কেন?’
কুহু একবার তাকাল নীরবের দিকে। দু সেকেন্ড পর আবার চোখ সরিয়ে নিল। নীরব পকেট থেকে দুটো চকলেটের প্যাকেট বের করে কুহুর কোলের ওপর রাখল। ফিসফিসিয়ে আবার বলল, ‘স্যরি।’
কুহু তাকিয়ে দেখল চকলেট দুটো। ওগুলো নিজের হাতে নিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে রাখল। হেসে ফেলল নীরব। কুহুও হাসল। ঠোঁট চেপে। নীরব এবার আরেকটা লাল গোলাপ বের করে কুহুর দিকে বাড়িয়ে দিল। আবার একই আওয়াজে বলল, ‘স্যরিইই।’
কুহু এবার ঠিকভাবে তাকাল নীরবের চোখের দিকে। নীরব বলল, ‘বাই দ্যা ওয়ে, পিঙ্ক লেহেঙ্গাটায় তোমাকে খুব কিউট লাগছে। হেয়ার স্টাইলটা জাস্ট ওয়াও! কে সাজিয়ে দিয়েছে প্রিয়তা ভাবি?’
দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। এরপর দুজনেই একসঙ্গে হেসে ফেলল। কুহু হাত বাড়িয়ে নিল ফুলটা। নীরব এক লাফে আবার কুহুর পাশে বসে পড়ল। তারপর বলল, ‘একদিন এতো লেইট করে এসেছি বলেই ম্যাডামের এতো অভিমান? ফাইনাল এক্সামটার পরেই তো আমি চলে যাচ্ছি ভার্সিটি ছেড়ে। তখন কী করবে?’
কুহুর মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল। অন্ধকারে ছেয়ে গেল মুখটা। সেটা দেখে নিরব ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘আরে মন খারাপ করছো কেন? আমিতো এমনিই বললাম।’
কুহু ফোনটা তুলে মেসেজ লিখল, ‘এরপর আর আমাদের নিয়মিত দেখা হবেনা। তাইনা?’
নীরব বলল, ‘কীকরে হবে? তোমার ঐ বাপ কী তোমাকে কখনও একা ছাড়বে? সঙ্গে সবসময় ঐ কালো হাতিদুটোকে রাখবেই।’
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো কুহুর ভেতর থেকে। মাথা নিচু করে বসে রইল চুপচাপ। নীরবও কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল পুকুরের পানির দিকে। রাতের অন্ধকার আর বাইরের কৃত্রিম আলোর প্রতিফলনে চমৎকার লাগছে দেখতে। দুই-তিন মিনিটের নীরবতার পর নীরব বলল, ‘সম্পর্ক জিনিসটা কত অদ্ভুত তাইনা কুহু? মাস তিনেক আগে আমরা একে অপরকে চিনতামও না। অথচ এখন সামান্য দূরত্বও সহ্য হয়না।’
কুহু তাকিয়ে আছে পানির দিকে। কিন্তু শুনছে নীরবের কথা। নীরব আবার বলল, ‘জানো, তোমাকে শুরু থেকে আমার এতোটা পছন্দ কেন? তোমার এই নীরবতার কারণে। আমার একজন বাবা বিজনেসম্যান আর মা ডক্টর। বুঝতেই পারছো তাদের ব্যস্ততা। তাই ছোটবেলা থেকেই আমায় খুব একটা সময় দিতে পারতো না ওনারা। বড়লোকের ছেলে। তাই কোনদিন কোনকিছুর অভাব হয়নি আমার। শুধু একটা জিনিসের ভীষণ অভাব ছিল। কথা শোনার মানুষের। বাবা-মার অঢেল টাকা আমার এই অভাবটা পূরণ করতে পারেনি। পূরণ হলো, যেদিন তুমি এলে আমার জীবনে। আমার বিরতিহীন কথাগুলো নীরবে শুনে গেলে। আমার কথা এভাবে কেউ কোনদিন শোনেনি, যেভাবে তুমি শোন। তাইতো তোমার প্রতি এতো টান তৈরী হয়েছে আমার। আমার জীবনের অন্যতম অভাবের জায়গাটা পূরণ করে দিয়েছো তুমি। আমাকে পূর্ণ করেছো। আমার কলহলপূর্ণ জীবনের একমাত্র নীরবতা তুমি। আমার স্বস্তির জায়গা। আর আমার পছন্দের মানুষটা থেকে কবে যে ভালোবাসার মানুষ হয়ে গেলে আমি বুঝতেই পারিনি।’
কুহু চখিতে তাকাল নীরবের দিকে। নীরব কুহুর দুটো হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘ আমার মনে হলো আজকেই সঠিক সময় তোমাকে বলে দেওয়ার। নয়তো কখনও বলতে পারব না। আই লাভ ইউ। সত্যি বলছি, ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে আমি।’
কুহু হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে নীরবের দিকে। নীরব কুহুর চোখে চোখ রাখল। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বলল, ‘আমার নীরবতা হবে কুহু?’
–
রাত বারোটা বাজে। রুদ্রর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে চোখ লেগে এসছিল প্রিয়তার। হঠাৎ দরজা লাগানোর শব্দে চমকে উঠল। ঝটপট উঠে দাঁড়িয়ে রুদ্রকে দেখতে পেয়ে স্বস্তি পেল প্রিয়তা। সন্ধ্যায় ওকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিল রুদ্র। হঠাৎ রঞ্জু এসে উপস্থিত হলো। এরপর ওকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে কোথাও বেরিয়ে গিয়েছিল। সেই যাওয়ায় ফিরল এখন। মনে মনে ভীষণ চিন্তায় ছিল প্রিয়তা। অস্থির লাগছিল ভীষণ।
‘ এসেছেন? আমি এদিকে_’
হাসি মুখে এগোতে নিয়েও রুদ্রর গায়ে র-ক্ত দেখে থমকে গেল প্রিয়তা। ভীত ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘ কী হয়েছে আপনার? এতো র-ক্ত কেনো?’
প্রিয়তা রুদ্রকে ধরতে গেলেই হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিলো রুদ্র। গম্ভীর গলায় বলল, ‘এখন আমাকে স্পর্শ করোনা, প্রিয়। আসছি এক্ষুনি।’
প্রিয়তা কিছু বুঝে ওঠার আগেই র-ক্তাক্ত শার্টটা খুলে রেখে ওয়াশরুমে চলে গেল রুদ্র। আর প্রিয়তা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল নিজের জায়গায়। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল র-ক্তা-ক্ত শার্টটার দিকে।
#চলবে…
#অন্তর্নিহিত_কালকূট
[ রি-চেইক করিনি। ]