অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৪৫.

0
71

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৪৫.

রুদ্র বেরিয়ে এলো ঠিক দশ মিনিট পর। শাওয়ার নিয়েছে। ওর চোখমুখ একদম স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয়নি। প্রিয়তা বিছানায় বসে আছে। একদম স্থির পুতুলের মতো। চোখদুটো তখনও সেই র-ক্তা-ক্ত শার্টটাতে স্থির। রুদ্র সেদিকে একপলক তাকাল। কিছু না বলে চলে গেল ড্রেসিং টেবিলের সামনে। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে চুল মুছতে মুছতে বলল, ‘কালো টি-শার্ট টা দাও তো?’

প্রিয়তা ধীরে সুস্থে তাকাল প্রিয়তার দিকে। উঠে গিয়ে টি-শার্ট এনে দিলো রুদ্রকে। রুদ্র টি-শার্টটা পরে ঘুরতেই দেখল প্রিয়তা দাঁড়িয়ে আছে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিঞ্চিৎ হকচকিয়ে গেল রুদ্র। কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। প্রিয়তা রুদ্রর হাত ধরে এনে বসাল বিছানায়। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোয়ালে দিয়ে রুদ্রর চুল মুছতে শুরু করল। রুদ্র কিছু বলছেনা। প্রিয়তাও চুপ। কিছু সময় পর হঠাৎই প্রিয়তা বলে উঠল, ‘আপনার শরীরে কোন আঘাতে চিহ্ন নেই। অথচ শার্টে র-ক্ত। কাউকে মে-রে এসেছেন?’

‘ হ্যাঁ।’ মিথ্যে বলল রুদ্র।

প্রিয়তা পাল্টা কোন প্রশ্ন করল না। কিন্তু রুদ্র খেয়াল করল প্রিয়তার হাত কাঁপছে। বারবার ঢোক গিলছে। রুদ্র তখনই কিছু বলল না। লোক ডেকে র-ক্তা-ক্ত শার্টটা নিয়ে যেতে বলল। অনেক রাত হয়েছে, কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়ল রুদ্র। প্রিয়তাকেও শুয়ে পড়তে বলল।

এরপর আধঘন্টা কেটে গেল। কিন্তু কারো চোখে ঘুম নেই। অদ্ভুত অস্থিরতা গ্রাস করেছে ঘরটাকে। একপর্যায়ে প্রিয়তা এসে মাথা রাখল রুদ্রর বুকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। রুদ্রর এতক্ষণের অস্থিরতা কর্পূরের মতো উবে গেল। মনটাও শান্ত হয়ে গেল। চোখ বন্ধ করেই চুপচাপ শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। এরপর ডান হাতের আঙুলগুলো প্রিয়তার চুলে ডুবিয়ে দিয়ে বলল, ‘ ভয় পেয়েছিলে?’

প্রিয়তা কিছু বলল না। আরও শক্ত করে আকড়ে ধরল রুদ্রকে। রুদ্র বলল, ‘এগুলোর অভ্যাস করে নাও, প্রিয়। আমি আগেও বলছিলাম, আমার সঙ্গে জীবনযাপন করা সহজ হবেনা। এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি তোমাকে বারবার হতে হবে। তবে ভয় পেওনা। আমার কিছু হবেনা।’

প্রিয়তা কিছু বলল না। সেঁটে রইল রুদ্রর সঙ্গে। যেন দূরে গেলেই হারিয়ে যাবে। আর পাবেনা। রুদ্র হাসল। সযত্নে চুমু খেলো প্রিয়তার মাথায়। চোখ বন্ধ করে মনে করল কয়েকঘন্টা আগের ঘটনা-

সন্ধ্যায় কোন কাজ রাখেনি রুদ্র। কারণ সন্ধ্যাটা ও প্রিয়তাকে দেবে বলেই ঠিক করে রেখেছিল। সদ্য বিয়ে হয়েছে মেয়েটার। বিয়ের পর নতুন সংসার শুরু করার সময় প্রতিটা মেয়ের তার মায়ের কথা মনে পরে। কীভাবে নতুন সংসার গোছাতে হবে, কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হবে মায়েরাই মেয়েকে শিখিয়ে দেয়। সেখানে প্রিয়তার নিজের বলে কেউ নেই। মীরা চলে যাওয়ার পর আরও গুমরে গেছে। নতুন বাড়ি, নতুন লোকজনদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগছে। রুদ্র বুঝতে পারে ব্যপারটা। তাই ভেবেছিল ওকে একটু ঘুরিয়ে আনলে হয়তো ভালো লাগবে।
সন্ধ্যায় যখন রুদ্র এসে প্রিয়তাকে রেডি হতে বলল প্রিয়তা বেশ অবাক হয়েছিল। আর যখন শুনলো রুদ্র ওকে নিয়ে ঘুরতে বের হবে, তখন ওর খুশি ছিল দেখার মতো। প্রিয়তার আনন্দে উদ্ভাসিত মুখটা দেখে তৃপ্তি পায় রুদ্র। এইটুকুই দেখার জন্যেই তো এতোকিছু। নিজের ব্যক্তিত্বের এমন অদ্ভুত পরিবর্তনে রুদ্রর নিজেই অবাক হয়। কয়েকদিন আগেও সে কেবল নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতো। কাউকে খুশি রাখার, কারো মন ভালো করার বিশেষ কোন আগ্রহ ছিলোনা ওর মধ্যে। কিন্তু প্রিয়তা ওর জীবনে আসার পরে সবকিছু বদলে গেছে। এখন মনে হয় প্রিয়তাকে খুশি রাখতে পারলে ওর আর কিচ্ছু চাই না। মেয়েটাকে ভালো রাখার জন্যে সব করতে পারে ও। সব।

রুদ্রর জিপে করে সারা সন্ধ্যা ঘুরে বেরিয়েছে রুদ্র-প্রিয়তা। বিস্তৃত রাস্তা, সোডিয়ামের আলো আর মৃদু হাওয়ায় হারিয়ে গিয়েছিল ওরা। প্রিয়তার বায়না রাখতে রাস্তায় চটপটি খেয়েছে। চা খেয়েছে। হাতে হাত রেখে ফুটপাত দিয়ে হেঁটেছে। এসবে অভ্যস্ত না হলেও প্রিয়তার মন রাখার জন্যে করেছে রুদ্র। একপর্যায়ে গিয়ে নিজেও তা উপভোগ করেছে। এ এক নতুন অনুভূতি ওর জন্যে। রাতের খাবারটাও ওরা বাইরে খেয়েছে। ডিনার করে ইউনাইটেড হসপিটাল পাড় হওয়ার সময় হঠাৎই জীপ থামাতে বলে প্রিয়তা। রুদ্র দ্রুত জীপ থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে? সমস্যা হচ্ছে কোন?’

প্রিয়তা মুখে কিছু না বলে চোখের ইশারায় দেখাল। প্রিয়তার দৃষ্টি অনুসরণ করে রুদ্রও তাকাল সেদিকে। দেখল, রাস্তার অপরপাশে একটা চায়ের দোকানে উচ্ছ্বাস আর নাজিফা বসে আছে। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে, হাসছে। প্রিয়তা বলে, ‘ঐ মেয়েটাকে বিয়েতে দেখেছিলাম। ভাইয়ের সঙ্গে এখানে কী করে? আপনাদের পরিচিত?’

রুদ্র কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, ‘ মেয়েটার নাম নাজিফা। শুনেছি আমাদের অফিসের কর্মচারী ছিল ওর বাবা।’

প্রিয়তা হেসে ফেলে। সিটে হেলান দিয়ে বলে, ‘তারমানে দেবর আমার প্রেম করছে? তাও লুকিয়ে লুকিয়ে!’

রুদ্র বলে, ‘গাধাটারও এতো সাহস হয়ে গেছে! জানতাম না-তো?’

প্রিয়তা নিঃশব্দে হাসল। ‘ অনেক হয়েছে অন্যের প্রেম দেখা। এবার চলো!’ বলে জিপ স্টার্ট দেয় রুদ্র।

রুদ্র প্রিয়তাকে নিয়ে সোজা বনানী চলে গেল। রুদ্রর সেই ফ্ল্যাটে। সেখানে বিল্ডিংয়ের ছাদে গেল ওরা। ছাদের রেলিং ধরে পাশাপাশি দাঁড়াল দুজন। মুক্ত আকাশ, খোলা হাওয়া। ফুরফুরে মনটা আরও সতেজ হয়ে উঠল। প্রিয়তার হাতের ওপর হাত রেখে রুদ্র বলে ওঠে, ‘মন ভালো হয়েছে?’

প্রিয়তা আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে, ‘আপনাকে কে বলল আমার মন খারাপ ছিল?’

‘আমার মন।’

হাসে প্রিয়তা। ‘আমার মন ভালো করার জন্যেই এতোকিছু?’

‘তোমার তাই মনে হচ্ছে?’

প্রিয়তা রুদ্রর দিকে। চোখেমুখে খানিকটা দুষ্টুমি ঢেলে বলে, ‘আপনাকে বিয়ে করার সময় একটা আফসোস ছিল। ভেবেছিলাম একটা গোমড়ামুখো, আনরোমান্টিক ক্রিমিনালকে বিয়ে করছি। কিন্তু এখন দেখছি গোমড়ামুখো ক্রিমিনাল হলেও…’

রুদ্র প্রিয়তার হাতে মাঝারি গোছের একটা টান দিয়ে নিজের বুকে এনে ফেলে। আলতো করে থুতনি ধরে বলে, ‘গোমড়ামুখো ক্রিমিনাল হলেও?’

প্রিয়তা পায়ে পাতা উঁচু করে রুদ্রর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘রোম্যান্টিক আছেন।’

রুদ্র প্রিয়তার কোমরে হাত রেখে বলে, ‘আমার রিটার্ন গিফট?’

‘ থ্যাংক ইউ!’

ভ্রু কুঁচকে ফেলে রুদ্র। শুধায়, ‘তোমার শুকনো থ্যাংক ইউতে আমার মন ভরবেনা ম্যাডাম! আই নিড সামথিং মোর।’

প্রিয়তার ঠোঁট চেপে হাসে। আলতো করে নিজের ডান হাতটা রাখে রুদ্রর বা গালে। আরেকটু উঁচু হয়ে চুমু খায় রুদ্রর গালে। নিঃশব্দে হাসে রুদ্র। আরও শক্ত কর‍ে ধরে প্রিয়তার কোমর।

‘ভাই!’

কারো গলার আওয়াজ পেয়ে তাকায় রুদ্র। ও তাকাতে তাকাতে ঝট করে পেছনে ঘুরে যায় রঞ্জু। থতমত খেয়ে বলে, ‘স-সরি, সরি ভাই। আসলে অনেক দরকারি কথা আছে তাই_’

রুদ্র তখনো প্রিয়তাকে ছাড়েনি। প্রিয়তা ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ছাড়েনা রুদ্র। বরং গম্ভীর গলায় বলে, ‘কী হয়েছে? এখানে আমি আর তোর ভাবি আছি জানতিনা?’

রঞ্জু ভয়ে ভয়ে বলে, ‘ক্ষমা চাইছি ভাই। কথা দিলাম আগামীকাল একশবার কান ধরে উঠবোস করুম।’

‘ দু’শবার। এবার নাটক ছেড়ে এদিকে ঘোর। আসল কথা বল।’

রঞ্জু ঘোরে। ওদের দেখে চোখ নামিয়ে নেয় আবার। প্রিয়তা বারবার রুদ্রকে চোখ রাঙায় ছাড়ার জন্যে। কিন্তু রুদ্রতো রুদ্রই। রঞ্জু ইতস্তত করে বলে, ‘কলের ঘটনাটা নিয়ে কথা ছিল ভাই। উচ্ছ্বাস ভাইকে জানায়ছিলাম। উনি আপনাকে বলতে বললেন। যদি একটু এদিকে আসতেন।’

রুদ্র সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেয় প্রিয়তাকে। এগিয়ে যায় রঞ্জুর দিকে। ওদের দুজনের কথা শুনতে পাচ্ছিলোনা প্রিয়তা। চিন্তিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে ছিল কেবল। একটু পরে রুদ্র এসে প্রিয়তাকে বলে, ‘প্রিয় আমাদের ফিরতে হবে। চলো।’

প্রিয়তা কথা না বাড়িয়ে মাথা নাড়ে। প্রিয়তাকে আমের ভিলায় পৌঁছে দিয়ে গেইটের কাছে আসে রুদ্র। রঞ্জুকে বলে, ‘বৈঠকঘরে প্রহরী! নামটা যেন কী? হ্যাঁ পারভেজ! বল আমার সঙ্গে একটু বাইরে যেতে হবে।’

রঞ্জু খানিকটা অবাক হয়, ‘এখনই ভাই?’

‘ শুভ কাজে দেরী কীসের?’ অদ্ভুত হিংস্র এক হাসি দেয় রুদ্র।

শহর পার কর রুদ্রর জিপ এক নির্জন রাস্তার দিকে ঢোকে। রুদ্রর পাশের সিটে বসে পারভেজ। পারভেজ প্রথমে ভেবেছিল রুদ্র হয়তো কোন গোডাউন বা ফ্যাক্টরিতে যাবে। এসব জায়গা যাওয়ার আগে মাঝেমাঝেই রুদ্র ওদের প্রহরীদের মধ্যে কাউকে সঙ্গে নিয়ে যায়। ও নিজেও গেছে অনেকবার। তাই বিষয়টা ভাবেনি সেভাবে। কিন্তু এই রাস্তায় আসতেই খানিকটা অবাক হয় সে। বলে, ‘কোথায় যাচ্ছি আমরা, ভাই?’

‘এক কালসাপকে বহুদিন দুধকলা দিয়ে পুষছিলাম। এখন ওটাকে মা-রা-র সময় হয়ে গেছে।’

‘কালসাপ?’

‘শব্দটা পরিচিত মনে হচ্ছে? আপন আপন লাগছে, তাইনা?’

গলাটা শুকিয়ে আসে পারভেজের। দু হাতে তালু দিয়ে মুখের ঘামটুকু মুছে নিয়ে তুতলে বলে, ‘ব-বুঝলাম না ভাই।’

রুদ্র চেহারাটা খানিকটা ভাবুক হয়ে ওঠে। ভাবুক স্বরেই বলে, ‘আমিও। বোঝার জন্য সাহায্য লাগবে তোর।’

পারভেজ অবাক হয়, ‘ আমার সাহায্য?’

‘সোলার সিস্টেম গ্রুপের সবচেয়ে গোপন আলোচনা আমের ভিলার কোথায় করা হয়?’

‘বৈঠক ঘ-ঘরে।’

‘ধর, কেউ যদি কোনভাবে ঐ ঘরের টেবিলের নিচে ছোট্ট একটা মাইক্রোফোন লাগিয়ে দেয়। তাহলে সব গোপন খবর জানা সম্ভব। তাইনা?’

পারভেজ জবাব দেয়না। কিন্তু লক্ষ করে ওর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। রুদ্র বলে চলে, ‘আর মজার ব্যপার এমন কিছুই ঘটেছে। দরজায় পাহারায় তো তুইও থাকিস। তাই জিজ্ঞেস করছিস। কাউকে ঢুকতে বা বের হতে দেখেছিস যে এরকমটা করতে পারে? কিংবা আমাদের মধ্যেই কাউকে লাগাতে দেখেছিলি?’

‘ না ভাই। আমিতো দেখিনি অন্যকাউকে।’

উত্তরে কিছুই বলে না রুদ্র। হঠাৎই শিস বাজাতে শুরু করে। শিসের শব্দটা পারভেজের শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে শীতল স্রোত বইয়ে নিয়ে যায়। রুদ্র থমথমে গলায় বলে, ‘অন্যকাউকে দেখার কথাও না। কারণ কাজটা তুই করেছিস।’

আর কোন সন্দেহ-ই নেই পারভেজের মনে। মৃত্যু নিকটে। কোনকিছু না ভেবেই জিপ থেকে লাফিয়ে নেমে যায় পারভেজ। রুদ্র জিপ থামায়। নেমে দেখে পারভেজ কেটে-ছিলে যাওয়া হাত-পা নিয়ে দৌড়ে পালাতে চাইছে। রুদ্রর চেহারা নির্বিকার। অলস ভঙ্গিতে হোলস্টার থেকে পি-স্ত-লটা বের করে সোজা গু-লি করে পারভেজের পায়ে। পারভেজ হুমড়ি খেয়ে পড়ে রাস্তায়। রুদ্র স্বাভাবিক পায়ে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু ভেঙ্গে বসে রুদ্রর সামনে। পারভেজ ডান পা চেপে ধরে ছটফট করছে। সে রুদ্রর দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলে, ‘ভাই, দয়াকরে একবারে মেরে ফেলুন। দোহাই লাগে। একবারে মারুন।’

ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হাসে রুদ্র। হাতের পিস্তলটা নাড়াতে নাড়াতে বলে, ‘যন্ত্রণা সহ্য করার সাহস যখন নেই তখন এতোবড় আবা*গিরি করলি কীকরে? রুদ্র আমেরের পিঠে ছু-রি মারার সাহস করতে গেলে যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতাও থাকা উচিত ছিল।’

কথাটা বলে পারভেজের পায়ের হাঁটুতে গু-লি করে রুদ্র। গগনবিদারী চিৎকার করে ওঠে পারভেজ। রুদ্রর ঠোঁটে নিষ্ঠুর হাসি প্রসারিত হয়। মৃদু গলায় বলে, ‘হুশ! চিৎকার না। সবাই জানে চেঁচামেচি পছন্দ করিনা আমি।’

বলেই পিস্তলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে পারভেজের মুখে। ব্যথায় চিৎকার করতেও ভুলে যায় পারভেজ। রুদ্র জিজ্ঞেস করে, ‘ব্লাক হোল?’

বিদ্যুৎ গতিতে মাথা ঝাঁকায় পারভেজ। যন্ত্রণায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার। রুদ্র বলে, ‘ স্বপন, তপু, খোকন আর.. হ্যাঁ সবুজ! এদের দিয়ে বানানো মাস্টারপ্ল্যান ফ্লপ হওয়ার পরেও তোকে দিয়ে এমন ইউজলেস প্লান এক্সিকিউট করল কোন দুঃখে সেটাই বুঝলাম না। তাজওয়াররা আজকাল গাঁ’জা বেশি ফুঁকছে না-কি?’

চমকে ওঠে পারভেজ। ওর আগেও লোক কিনে নিয়েছিল ব্লাকহোল? তাদের রুদ্র মে-রে ফেলেছে! নিজেকেই তখন জন্মগত গাধা মনে হয় পারভেজের। এতো বড় ভুল কীকরে করল সে? যন্ত্রণার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। মুখ বিকৃত হয়ে যায় তীব্র ব্যথায়। রুদ্র পি-স্ত-লে-র বাঁট দিয়ে আরেকটা আঘাত করে পারভেজের ক্ষতে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘মাইক্রোফোনের কথা বুঝলাম। কিন্তু আমার বিয়ের দিন বেচারী মেইডটাকে কেন মারলি? ওকে মারা উদ্দেশ্য তোর ছিলোনা। সেটা আমার জানা। উদ্দেশ্যটা কী ছিল?’

শেষের আঘাতে চোখে শর্ষে ফুল দেখছিল পারভেজ। রুদ্রর কথা শুনে বহু কষ্টে কিছু বলতে যাচ্ছিল সে। তখনই ‘থু’ টাইপের একটা আওয়াজ হয়। ঝাঁকি খেয়ে ওঠে পারভেজের শরীর। একপাশে কাঁত হয়ে পড়তে নিলে নিজের অজান্তেই ধরে ফেলে রুদ্র। ঘটনার আকস্মিকতায় কয়েক সেকেন্ডের জন্যে হলেও হতভম্ব গিয়েছিল রুদ্র। ব্যপারটা বুঝেই চারপাশে তাকায়। অনেকটা দূরে কেউ একজন বাইক নিয়ে নিমেষেই চলে যায় চোখের আড়ালে। পিছু নিয়ে লাভ নেই। এরই মাঝে আরেকবার ঝাঁকি খেয়ে স্থির হয়ে গেছে পারভেজ। রুদ্র খেয়াল করে দেখে মাথার ডান পাশ দিয়ে ঢুকে বাঁ পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে বু-লে-ট। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। শার্টটাও নষ্ট হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। লা-শটা রাস্তায় নামিয়ে রেখে রুদ্র কোথাও একটা ফোন করে বলে, ‘রোড-৫৩ দিয়ে একটা বাইক গেছে। কালো জ্যাকেট পড়া কেউ ছিল। পেলে উঠিয়ে নে।’

কী কী করতে বুঝিয়ে দিয়ে কল কাটে রুদ্র। এরপর কল করে ইকবালকে। কিন্তু ইকবা রিসিভ করে না কলটা। দু’বার কল করার পরেও যখন ধরল না তখন উচ্ছ্বাসকে কল করে রুদ্র। উচ্ছ্বাস প্রথমবারেই ফোন তুলল। সংক্ষেপে পুরো ব্যপারটা ব্যাখ্যা করে ওকে লোকজন নিয়ে আসতে বলে রুদ্র। লা’শ সরিয়ে, সব ঠিকঠাক করে ফিরতেই এতোটা দেরী। –

তপ্ত এক শ্বাস ফেলে অতীত থেকে ফিরে এলো রুদ্র। সোলার সিস্টেমের একটা নিয়ম আছে। প্রতিদিন সকালে হোলস্টার আর পি-স্ত-ল জমা দিতে হয়। ওগুলো চেক করে তারপর আবার ফিরিয়ে দেওয়া হয় সবাইকে। বিয়ের দিনের ঘটনার পর, প্রত্যেকের হোলস্টারে মাইক্রোফোন রাখার ব্যবস্থা করেছিল রুদ্র। সবার অজান্তেই। আর সেটার মাধ্যমেই পারভেজের পর্দা ফাঁস করা সম্ভব হয়। সেদিন করিম তাজওয়ারের সঙ্গে হওয়া ফোনের কথোপকথন শুনেছে ও।

বুকের ওপর শুয়ে থাকা প্রিয়তার দিকে তাকাল রুদ্র। ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ অনুতাপে দগ্ধ হতে শুরু করলো ওর মন। আজ একটু এদিক-সেদিক হলে বু-লে-ট-টা ওর মাথা এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে যেতে পারতো। কেন বিয়ে করল প্রিয়তাকে ও? মেয়েটার ভবিষ্যৎ কী হবে?

আমের ভিলায় আজ একসঙ্গে সকালের খাবার খেতে বসেছে সবাই। প্রিয়তা আর জ্যোতি মিলে সার্ভ করছে। সবাই শুরু করে দিলেও রুদ্র এখনো খাওয়া শুরু করেনি। ব্যপারটা প্রিয়তা, জ্যোতি দুজনেই খেয়াল করছে। প্রিয়তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই প্রিয়তা চোখের ইশারায় জানতে চাইল, কী হয়েছে? রুদ্র গলা ঝেড়ে তাকাল রাশেদের দিকে। মাথা নিচু করে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘বাবা, আপনার কী আর কিছু প্রয়োজন হবে?’

রাশেদ চোখ তুলে তাকালেন। দু সেকেন্ডের মতো রুদ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর গম্ভীর গলায় বললেন, ‘প্রিয়তা। তুমি বসে পড়ো। জ্যোতি তুইও বস।’

প্রিয়তা লজ্জা পেল। রুদ্রর ওপর রাগও হলো। সকলের সামনে কী দরকার ছিল এভাবে বলার? কিন্তু রুদ্র ভাবলেশহীন। তার মতে সে ঠিকই করেছে। প্রিয়তা বসতেই খাওয়া শুরু করল রুদ্র।
সেদিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল জ্যোতি। আগে ও নিজেও তো সার্ভ করতো। ওর জন্যেতো রুদ্র কখনও অপেক্ষা করেনি। পাশে বসিয়ে খাওয়ানোর জন্যে টালবাহানা করেনি। এমন একটা মুহূর্তের জন্যে কত অপেক্ষা করেছিল ও। আজ সেই মুহূর্তগুলোই ওর চোখের সামনে তৈরী হচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা ও নয়। অন্যকেউ। ঘনঘন শ্বাস ফেলে কান্না রোধ করল মেয়েটা। ইদানীং প্রায়ই বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে জ্যোতি। দম বন্ধ হয়ে আসে। চোখ-মুখ খিঁচে পাড় করে যাচ্ছে প্রতিটা দিন। কিন্তু সকলের সামনে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করতে হচ্ছে নিরন্তর। এই যন্ত্রণার গভীরতা কাউকে বোঝানো সম্ভব না। কাউকে না।

রাশেদ কুহুকে উদ্দেশ্য করে থমথমে গলায় বলল, ‘কাল এতো রাত করেছিলে কেন, কুহু মা?’

চমকে উঠল কুহু। বাবাকে কীকরে বলবে, নীরব এসে পৌঁছতে দেরী করেছিল বলেই ওর দেরী হয়েছে? তবুও কোনরকম হাসার চেষ্টা করল। চামচটা রেখে হাতের ইশারায় বলল, ‘আসলে প্রোগ্রাম অনেক রাতে শেষ হয়েছিল। তাই দেরী হয়ে গেছে।’

রাশেদ গাম্ভীর্য ত্যাগ করলেন। মোলায়েম কন্ঠে মেয়েকে বললেন, ‘এরপর আর এরকম করোনা। প্রোগ্রাম যখনই শেষ হোক, ন’টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসবে। আমি ঐ দুজনকে বলে রেখেছি। ন’টার পর ওরা আর থাকতে দেবেনা তোমাকে।’

কুহু মাথা নাড়ল। মনটা খারাপ হয়ে গেছে। ক্লাস থাকায় তাড়াতাড়ি খেয়ে সবাইকে বিদায় দিয়ে চলে গেল ভার্সিটিতে। কুহু চলে যেতেই রাশেদ বলল, ‘ কালকের ঘটনায় কী বুঝলে?’

রুদ্র বলল, ‘ পারভেজকে ব্যবহারের পেছনে ওদের যে অন্য উদ্দেশ্য ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।’

উচ্ছ্বাস প্রশ্ন করল, ‘অন্য উদ্দেশ্য?’

‘ হ্যাঁ! আমাদের ঘরে নিয়মিত মাইক্রোফোন লাগানো হলে যে আমরা সহজেই জানতে পারব, সেটা না বোঝার মতো বোকা ব্লাক হোল বা ডার্ক নাইট কেউই নয়। ওরা জানতো পারভেজ ধরা পড়বে। জেনে শুনেই পাঠিয়েছে। বলির পা-ঠা বানিয়ে। ওদের_’

রুদ্রর কথা শেষ হওয়ার আগেই রাশেদ বলল, ‘ওদের উদ্দেশ্যর কথা যাতে আমর জানতে না পারি তাই পারভেজকে মে-রে ফেলল। রুদ্র ওকে মে-রে ফেলার আগেই।’

জাফর বলল, ‘আর আমাদের লোকও তো ঐ কালো বাইকটা বা লোকটাকে পায়নি। ওদের উদ্দেশ্যটা কী?’

রুদ্র বলল, ‘খুব সহজ। আমাদের কাজে বাঁধা দেওয়া। কিন্তু সেটা কীকরে, এটাই আসল প্রশ্ন। পারভেজের কাজ এইটুকুই ছিল। কিন্তু আরো কাজ বাকি আছে ওদের। সেই বাকি কাজটা কী? আর কে করবে সেটাই আসল প্রশ্ন।’

প্রিয়তা আর জ্যোতি চুপচাপ খেয়ে চলেছে। যেন কেউই এসবে মনোযোগ দিচ্ছেনা। দিলেও বুঝবেনা। বোঝার কথাও না। ওরা বুঝে যাওয়ার মতো কোন আলোচনা এখানে করা হবেনা। সেটাও বোধ হয় জানে ওরা। কিন্তু রাশেদ, রুদ্র, উচ্ছ্বাস, জাফর সকলের মুখেই চিন্তার ছাপ। কারণ শুধু ওরাই জানে ভবিষ্যৎ কতোটা ভয়ংকর হতে চলেছে। কয়েকটা আন্ডারওয়ার্ল্ডের দলের কফিনে শেষ পেরেগ মারতে চলেছে ওরা। মারণ ছোবল তারা দেবেই। করো, নয়তো মরোর মতো অবস্থা এখন তাদের। বাঁচার জন্যে মানুষ ভয়ংকরতম হতে পারে। আর এবার বাঁচার জন্যে যে নিষ্ঠুর পরিকল্পনা তারা করেছে, তার পঞ্চাশ শতাংশও জানা থাকলে কেবল চিন্তা করতোনা সোলার সিস্টেম। রীতিমতো ভয় পেতো! ভয়!

ইউনাইটেড হসপিটালের সেই চায়ের দোকানে পাশাপাশি বসে আছে উচ্ছ্বাস-নাজিফা। দুজনেই চুপচাপ। মাঝেমাঝে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে চায়ের কাপে। দীর্ঘ সময়ের নীরবতা ভেঙ্গে উচ্ছ্বাস প্রশ্ন করল, ‘কিছু বলছো না যে?’

‘কী বলবো?’

‘কিছু বলার না থাকলে শুধুশুধুই বারবার ডাকো কেন নাজিফা?’

নাজিফা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি যখন হসপিটালের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে ডেইলি দুইবেলা আমার চেহারা গেল। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকো। তখন আমি কোন প্রশ্ন করি?’

উচ্ছ্বাস খানিকটা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আমি সিরিয়াস।’

‘ভালো লাগে, তাই ডাকি।’ স্পষ্ট জবাব নাজিফার।

‘আর ডেকোনা।’

নাজিফা অবাক হলো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো, মানে? উচ্ছ্বাস কঠিন স্বরে বলল, ‘ আর ডেকোনা। ডাকলেও আমি আসবোনা। আমি চাইনা আমাদের মধ্যে আর কোনরকম কোন যোগাযোগ হোক। আমরা এখন থেকে আবার আগের মতোই থাকব। তুমি তোমার রাস্তায়। আমি আমার রাস্তায়। এইটুকুই বলতে এসেছিলাম। ভালো থেকো।’

নাজিফাকে কিছু বলার সুযোগটুকুও না দিয়েউঠৈ এলো উচ্ছ্বাস। নাজিফা হতভম্ব হয়ে বসে রইল সেখানেই।
উচ্ছ্বাস মোড়ে এসে দেখল রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে জিপ নিয়ে। এই মুহুর্তে রুদ্রকে এখানে আশা করেনি ও। রুদ্র চোখের ইশারায় বসতে বলল জিপে। উচ্ছ্বাস কথা না বাড়িয়ে বসে পড়ল। রুদ্র জিপে চাবি দিয়ে বলল, ‘আমায় যেটা করতে বারণ করেছিলি, নিজেও এখন সেটাই করলি। নিজেকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ? বাবা সবটা মেনে নেবেন।’

‘আমি জানি।’

‘তাহলে?’

উচ্ছ্বাস শব্দ করে হেসে ফেলল। কৌতুকের স্বরে বলল, ‘তোর অবস্থা দেখে বিয়ের সাধ মিটে গেছে আমার। বউ জিনিসটা বড্ড ভয়ংকর। আমার এতো প্যারা পোষাবে না বস। চল তো!’

রুদ্র কিছু বলল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিপ স্টার্ট দিল।

#চলবে…

[ কাল প্রথম অধ্যায় শেষ করে দেব। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here