অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৪৬.

0
67

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৪৬.

সকাল দশটা বেজে বারো। চট্টগ্রাম। নিজের অফিসে বসেই কাজ করছে করিম তাজওয়ার। পাশে দলেরই আরও চারজন লোক। তাদের মধ্যে সাজ্জাদও একজন। ব্যবসায়িক বিষয়ে-ই আলোচনা চলছিল। আলোচনার মধ্যেই ঘরে ঢুকলো সম্রাট। ওকে দেখে আলোচনা থামিয়ে দিল সবাই। সুদর্শন এই যুবকের চোখ-মুখে ঔদ্ধত্যের ছাপ স্পষ্ট। সম্রাট হাতের ইশারা করে বের হতে বলল সবাইকে। সবাই একটু ইতস্তত করে বের চুপচাপ বেরিয়ে গেল। বের হলোনা সাজ্জাদ। সে তাকিয়ে রইল করিম তাজওয়ারের দিকে। সম্রাট খেঁকিয়ে উঠল, ‘আমি বলছি সেটাই যথেষ্ট। গেট আউট!’

অপমানে স্তব্ধ হয়ে গেল সাজ্জাদ। দাঁতে দাঁত পিষল। কিন্তু হজম করে নিতে হল সবটা। অপরাধীর মতো চুপচাপ মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।
ছেলের ঔদ্ধত্যে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল করিম। বেয়াদবির মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেছে ছেলেটার। সম্রাট সেদিকে তোয়াক্কা করল না। একটা চেয়ার টেনে পায়ের ওপর পা তুলে বসল। করিমের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পারভেজের খবর পেয়েছো?’

‘পেয়েছি।’ গম্ভীর গলায় জবাব দিল তাজওয়ার।

‘এক সপ্তাহ লাগেনি কিন্তু।’

‘রুদ্র মারেনি ওকে।’

‘জানি আমি। মা-রতো, যদিনা তার আগেই ও এসে পারভেজকে শু-ট করতো।’

করিম তাজওয়ার ফাইল বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, ‘ভাগ্যিস করেছে। নয়তো সব ভেস্তে যেতো। প্রথমে ভরসা করতে পারিনি ওর ওপর। কিন্তু এখন দেখছি যথেষ্ট কাজের।’

সম্রাট তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ‘ ও কার কাছে, কার শিক্ষায় তৈরী হয়েছে সেটাও দেখতে হবে। তোমার দলের বা কাছের কেউ হলে এতোদিনে..’ গলা কেটে যাওয়ার ইশারা করল সম্রাট। ‘সবাইতো আর আমার মতো এক্সেপশনাল কেইস না। ভাগ্যিস জেনেটিক্যালি তোমার বলদমার্কা গুনগুলো পাইনি। নইলে তোমার বড় ছেলের সঙ্গে সঙ্গে এতোদিনে আমারও এনকাউন্টার হয়ে যেতো।’

করিম তাজওয়ার বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘বেয়াদবির সীমা পাড় করে ফেলছো তুমি সম্রাট। মানছি তোমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা একটা স্টেপ নিয়েছি। যা তোমার পছন্দ হয়নি। কিন্তু রেজাল্ট আল্টিমেটলি ভালোই আসবে।’

সম্রাটের কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টি এবার কঠোর হয়ে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘হোপ সো। যদি তা না হয়, রুদ্রর আগে আমি নিজেই শেষ করে দেব সবকিছু। কথাটা মাথায় রেখো।’

করিম পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল ছেলের দিকে। হাতের তালু ঘেমে উঠছে তার। মন কু ডাকছে বারবার। যা করতে চলেছে তার জন্যে মনে মনে ভীষণ অনুশোচনা হচ্ছে। তারা খু’ন করে, অনেক অবৈধ কাজ করে। নিজস্ব প্রয়োজনে করে। কিন্তু তাই বলে এরকম পৈশাচিক নিষ্ঠুরতা! গাছ গোড়া থেকে উপড়ে ফেলেই অভ্যস্ত তারা। কিন্তু এবারতো একটা একটা করে ডাল ভাঙার পরিকল্পনা করেছে। জীবন মরণ প্রশ্ন না হলে এটা সে করতোনা।

সম্রাট যেন নিজেও একটু ভাবুক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু মুহূর্তেই সমূর্তি ধারণ করে বলল, ‘এনিওয়ে! ওরা আজ আমাকে কল করেছিল। এবার মিটিং এ বসতে হবে। আজ সন্ধ্যায়।’

দুই মাস পরের কথা। ক্যালেন্ডারের দুটো পাতা উল্টে গেছে। ঋতুর সঙ্গে বদলেছে পরিবেশ, আবহাওয়া। মাঝে বিশেষ কিছু না ঘটলেও সম্পর্কের সমীকরণে পরিবর্তন ঘটেছে অনেক।
সন্ধ্যাবেলা কুহুর ঘরে বসে একসঙ্গে টিভি দেখছে প্রিয়তা, কুহু আর জ্যোতি। প্রিয়তা আর জ্যোতি পাশাপাশি নিচে বসে আছে। কুহু আসাম করে বসে আছে বিছানায়।
নতুন একটা সিনেমা এসছে। মুভিটা থ্রিলার, বেশ ইন্টারেস্টিং। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে প্রিয়তা আর জ্যোতি। খানিক বাদে বাদে নিজেদের মধ্যে ব্যপারটা নিয়ে আলোচনাও করছে। কিন্তু কুহুর টিভিতে সেরকম মনোযোগ নেই। নামে মাত্র টিভির দিকে তাকাচ্ছে। টিভিতে কী হচ্ছে সেসবে কোন ধ্যান নেই তার। বারবার ফোন চেইক করছে। কাল নীরবের সঙ্গে রাগ করে চলে এসেছিল ভার্সিটি থেকে। ছোটখাটো মনমালিন্য হয়েছে দুজনের মধ্যে। সেকারণে কাল থেকে নীরবকে কোন মেসেজ করেনি ও, আর না নীরব করেছে। সে ব্যাপারেই মন খারাপ। অভিমানে গাল ফুলে উঠছে। কেঁদে সবকিছু ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। ব্যপারটা সবার আগে প্রিয়তাই খেয়াল করল। বিছানায় উঠে বসে কুহুকে কুনুইয়ের খোঁচা দিয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার কুহুরাণী? আমাদেরতো পাত্তাই দিচ্ছোনা। ফোনে কার টেক্সটের অপেক্ষা করা হচ্ছে শুনি?’

কুহু চকিতে চাইল। খানিকটা হকচকিয়ে গেল প্রিয়তার হঠাৎ করা প্রশ্নে। জ্যোতিও উঠে বসল বিছানায়। অলস ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে বলল, ‘তুমিতো এটা এখন দেখছো। আমিতো সেই কবে থেকে দেখছি। ম্যাডাম কিন্তু আজকাল বেশ রাত জেগে ফোনে কারো সাথে মেসেজিং করে। মিষ্টি করে হাসে। আর যখন আমি জিজ্ঞেস করি কী হয়েছে? তখন মুখস্থ বুলির মতো আওড়ায় “কিছুনা”।’

প্রিয়তা দুষ্টুমির স্বরে বলল, ‘এটা কী সত্যি সত্যি “কিছুনা”? নাকি “অনেক কিছু” টাইপের “কিছুনা”?’

কুহু ভীষণ লজ্জা পেলো। উঠে চল্র যেতে নিলে দুজন মিলে দু হাত ধরে বসিয়ে দিলো ওকে। প্রিয়তা বলল, ‘ এটা কিন্তু ঠিক না কুহুরাণী। আমরাইতো, বলোনা।’

জ্যোতিও প্রিয়তার কথায় সায় দিয়ে বলল, ‘একদমই তাই। আমাদের বলতে কী সমস্যা?’

কুহু একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। ওর বোঝা হয়ে গেছে, আজ এই দুজন ওকে ছাড়বেনা। মুখের ভেতর চুম্বক ধরে সব কথা বের করে নিয়ে আসবে। তাই হোয়াটস অ‍্যাপে নীরব আর ওর চ্যাট ওপেন করে এগিয়ে দিল প্রিয়তা আর জ্যোতির দিকে। দুজনেই একসঙ্গে লুফে নিল ফোনটা। অধীর আগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করল। কুহু চোরের মতো গুটিয়ে বসে রইল এককোণে। যেন মস্ত বড় কোন অপরাধ ফাঁস হয়ে যাচ্ছে।

অনেকটা সময় পর প্রিয়তা আর জ্যোতি একসঙ্গে অবাক হয়ে তাকাল কুহুর দিকে। কুহু ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল। ধরা পরে যাওয়ার ভঙ্গিতে মাথা তুলে তাকাল ওদের দিকে। প্রিয়তা দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বসল কুহুর পাশে। উত্তেজিত গলায় বলল, ‘দু মাস আগে প্রপোজ করেছে তোমাকে?’

এদিকে জ্যোতি বলল, ‘ আর তুই এখনো উত্তর দিসনি বেচারাকে? ডিপিতে দেওয়া ছবিটা ওর?’

কুহু মাথা ঝাঁকালো। প্রিয়তা কুহুকে একহাতে আলতো করে জড়িয়ে নিলো। মৃদু গলায় বলল, ‘ভালোবাসো?’

নিমেষেই কুহুর গাল, কান লাল হয়ে উঠল। চুপসে গেল একদম। তা দেখে জ্যোতি কৌতুক করে বলল, ‘বাবাহ্! আমাদের কুহুসোনা বড় হয়ে গেছে।’

প্রিয়তা বলল, ‘ ভালো যখন বাসো তখন বলছোনা কেন ওনাকে? মনের কথা মনে চেপে রাখতে নেই। বলে দিতে হয়।’

কুহুর হাস্যজ্জ্বল মুখটা হঠাৎ মলিন হয়ে উঠল। অসহায় মুখ করে মাথা নিচু করে ফেলল। প্রিয়তা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল কুহুর দিকে। কুহুর থুতনি ধরে মাথাটা উঁচু করে বলল, ‘আমি জানি তুমি কী ভাবছো। কুহু নিজেকে এতো ছোট করে দেখোনা। আর নীরবের কথাবার্তা দেখে আমার মনে হয়নি তোমার এই কথা বলতে না পারার মতো ছোট বিষয়টা ওনার কাছে মেটার করে। আর যদি পারিবারিক ব্যপার নিয়ে ভেবে থাকো, তাহলে আপাতত এসব মাথায় এনোনা। আগে নীরবকে ‘হ্যাঁ’ বলেতো দেখো। আমার মনে হয় ও ওর পরিবারকে বোঝাতে পারবে। আর তোমার ভাইয়াকে আমি বুঝিয়ে বলব। আর তোমার ভাইয়া বাবাকে বলবে। দেখবে, সব ঠিক হবে। আমি বলছি।’

কুহু মিষ্টি এক হাসি দিয়ে জড়িয়ে ধরল প্রিয়তাকে। জ্যোতিও মলিন হেসে বলল, ‘তুই খুব ভাগ্যবতী কুহু। যাকে তুই ভালোবাসিস সেও তোকেই ভালোবাসে। তাই বলছি, সময় থাকতে বলে দে ওকে।’

জ্যোতির কথা শুনে প্রিয়তা স্থির চোখে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। জ্যোতির দৃষ্টিও প্রিয়তার দিকেই। চোখে-চোখেই যেন অদ্ভুত কিন্তু গভীর কিছু কথোপকথন হলো দুজনের মধ্যে। কুহু দুজনের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেলল। প্রথম প্রথম ও নিজেও খুব করে চাইতো জ্যোতিই ওর ভাবি হোক। রুদ্র জ্যোতিকে ভালোবাসুক। কিন্ত যখন জানলো রুদ্র প্রিয়তাকে ভালোবাসে তখন জ্যোতির জন্যে দুঃখ হল। তবে মনেপ্রাণে চেয়েছিল রুদ্র তার ভালোবাসাকেই পাক। কারণ ওর অনিভিজ্ঞ মনও জানতো একপাক্ষিক ভালোবাসায় মানুষ কষ্ট পায়। কিন্তু তার চেয়েও কয়েকগুন বেশি কষ্ট তখন পায়, যখন পরস্পরকে ভালোবেসেও তাদের একসঙ্গে থাকা হয়ে ওঠেনা। আর এখন প্রিয়তার সঙ্গে যত সময় কাটাচ্ছে, যত চিনছে। ততই কুহুর মনে হচ্ছে প্রিয়তার চেয়ে ভালো ওর ভাইয়ের জন্যে আর কেউ হতেই পারতো না। এমনি এমনিতো আর রুদ্র আমেরের কঠোর হৃদয়ে এই রমনী জায়গা করে নেয়নি। কিছুতো বিশেষ আছে তার মধ্যে।
জ্যোতি যে কষ্ট পেয়েছে তার জন্যে রুদ্র বা প্রিয়তা কেউই দায়ী নয়। দায়ী তার ভাগ্য। কিন্তু ও মন থেকে সবসময় চায়, ওর ভাইয়া-ভাবিকে যেন সেই তীব্র কষ্ট সহ্য করতে না হয়। নিয়তি যেন তাদের সঙ্গে কোন নিষ্ঠুর কোন খেলা না খেলে।

আষাঢ় মাসের প্রথম দিন। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। ইউনিভার্সিটিতে আজ নীরবদের শেষ দিন। অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠান হচ্ছে। অনুষ্ঠান শেষ হতেই রিতুকে বিদায় দিয়ে বারান্দাতে এসে দাঁড়াল কুহু। এদিকটা একদম ফাঁকা। কুহু একদৃষ্টিয়ে তাকিয়ে আছে মেঘলা আকাশের দিকে। ধূসর মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে আছে গোটা আকাশ। কুহুর মনে হল, আকাশেরও বুঝি আজ মন খারাপ। কুহুরই মতো। আকাশের মতো কুহুরও আজ ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ভারি বর্ষণে মনে জমা ঘন মেঘকে দূর করে দিতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ পাশে এসে কেউ দাঁড়িয়েছে বুঝতে পেরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল কুহু। তাকিয়ে দেখে নীরব দাঁড়িয়ে আছে। নীরবকে দেখে কুহুর মন আল্লাদি হয়ে উঠল। কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু কুহু কাঁদল না। আবার তাকাল মুক্ত আকাশের দিকে। পাতলা ঠোঁটজোড়া কেঁপে উঠল দুবার। নীরব আলতো করে হাত রাখল কুহুর হাতে। মৃদু, নরম গলায় বলল, ‘স্যরি।’

কুহু অভিমানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল নীরবের দিকে। নীরব নিজের দুই কানে হাত দিয়ে বলল, ‘সত্যিই সরি।’

কুহু চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। তা দেখে হতভম্ব হলো নীরব। দ্রুত কুহুকে ঘরালো নিজের দিকে। ব্যস্ত হাতে চোখদুটো মুছে দিয়ে বলল, ‘এভাবে কাঁদছো কেন? স্যরি বললাম তো। আচ্ছা কান ধরে উঠবোস করব? তবুও কেঁদোনা প্লিজ। আমার ভালো লাগছেনা। স্যরি তো।’

কিন্তু কুহুর কান্না থামল না। মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলেই যাচ্ছে মেয়েটা। নীরব বিপাকে পড়ল এবার। আলতো করে কুহুর মু্খটা উঁচু করে ধরে বলল, ‘কুহু? কী হয়েছে বলো আমায়?’

আচমকাই কুহু জড়িয়ে ধরল নীরবকে। শক্ত করে। নীরব হকচকিয়ে গেল। হতভম্ব হয়ে কুহুর পিঠে হাত রেখে বলল, ‘কুহু? কী হয়েছে? বলবেনা আমাকে?’

কুহু না বোধক মাথা নাড়াল। নীরব হাসল। কুহুকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ওর দুটো হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘মিস করবে আমাকে, তাইনা?’

কুহু প্রথমে না বোধক মাথা নাড়ল। এরপর কী একটা ভেবে হঠাৎ দ্রুত গতিতে ওপর নিচ মাথা ঝাঁকাল। নীরব বলল, ‘আজকের পর আবার কবে দেখা হবে জানিনা। তাই আজ আর কোন মান অভিমান রাখতে চাই না। কাল রাতে তুমি একটা ভিডিও রেকর্ডিং পাঠিয়েছিলে; তাইনা? তুমি জানো কতক্ষণ লেগছিল আমার মানেটা বুঝতে? তুমি জানোনা কুহু, কাল সারারাত ঘুমোতে পারিনি আমি। গত দুই মাস যাবত অপেক্ষা করছিলাম তোমার উত্তরের জন্যে। কাল সেই উত্তর পেয়ে আমার মনে হচ্ছে আমার আর কিচ্ছু চাইনা। সামনের মাসে আমি ইন্ডিয়া যাচ্ছি। প্রায় বছর দুয়েকের জন্যে।’

কুহুর কান্না থেমে গেল। চুপচাপ তাকিয়ে রইল নীরবের দিকে। নীরব কুহুর দুই বাহুতে হাত রেখে বলল, ‘ কুহু, তোমার কোন খামতি, কোন অপূর্ণতা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমি এসব কিছু নিয়েও ভাবিও না। ভাবতে চাইনা। আমরা কেউ পূর্ণ নই। অপূর্ণতা আমাদের সবার মধ্যেই আছে। নিজের অপূর্ণতাকে হারিয়ে দিয়ে, জগতে টিকে থাকাকেই তো জীবন বলে। দ্যাট ইজ লাইফ। আর আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি তোমার কোন অপূর্ণতা কোনদিন আমাদের সম্পর্কে দেয়াল হয়ে দাঁড়াবেনা। আমি তোমার পূর্ণতা দেখে তোমাকে ভালোবাসিনি। আমার নিজের পূরিপূরক হিসেবে ভালোবেসেছি। আমার অপূর্ণতাকে একমাত্র তুমিই পূর্ণ করতে পারো, তাই তোমাকে ভালোবেসেছি। আমার কোলাহলপূর্ণ জীবনের একমাত্র নীরবতাকে ভালোবেসেছি। তোমাকে ছাড়া এখন আমি অসম্পূর্ণ কুহু। আমি জানিনা আমাদের আবার কবে দেখা হবে। শুধু এইটুকু জেনে রাখো, আই লাভ ইউ।’

শেষের দিকে গলা কেঁপে উঠল নীরবের। কুহু ঠোঁট ফুলিয়ে বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলল। কিছু না ভেবেই ঝাঁপিয়ে পড়ল নীরবের বুকে। নীরব কষ্ঠের মাঝেও হেসে ফেলল। মেয়েটা শুধু দেখতে বাচ্চা না। মনটাও একদম বাচ্চাদের মতো। নরম, অবুঝ। হবেনাই বা কেন? রুদ্রকে রাশেদ যতটা শক্ত করে তৈরী করেছেন। কুহুকে ততটাই কোমলভাবে বড় করেছেন। বাইরের জগতের তিক্ত জটিলতার ছায়াটাও পড়তে দেয়নি ওর গায়ে।

আজ বিকেলটা আমের ভিলায় বিশেষ মনে হচ্ছে। কারণ বহুদিন পর আজ আমের ভিলার সকলেই বাড়িতে উপস্থিত। একসঙ্গে। রাতে ঘুমোনোর সময় ছাড়া এরকমটা সচারচর হয়না। রুদ্র আর উচ্ছ্বাস বসে আছে সোফায়। রুদ্র খবর দেখছে। উচ্ছ্বাস মোবাইলে কিছু একটা করছে। ব্রেক আসতেই রুদ্র আড়চোখে তাকাল উচ্ছ্বাসের দিকে। ফোনের স্ক্রিনে নাজিফার একটা ছবি। সেটা দেখে ফোঁস করে শ্বাস ফেলল রুদ্র। আবার টিভির স্ক্রিনে তাকিয়ে বলল, ‘দেখ আমি এখনও বলছি। নিজেকে শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছিস।’

রুদ্রর কথায় উচ্ছ্বাস কপাল কুঁচকে ফেলল। ফোন রেখে চোখ তুলে তাকিয়ে বলল, ‘ কী ব্যপারে?’

‘নাজিফা।’

শব্দ করে হাসল উচ্ছ্বাস। যেন রুদ্র মারাত্মক কৌতুক করেছে। রুদ্র বিরক্ত হয়ে তাকার। হাসি থামিয়ে উচ্ছ্বাস বলল, ‘তুই এখানো ওখানেই পড়ে আছি। কাম অন। ওটা কয়েকদিনের অ‍্যাট্রাকশন ছিল। এখন ওকে আমার আর ভালো লাগেনা।’

রুদ্র নিরস গলায় বলল, ‘সেইজন্যই ফাঁক পেলেই ফোনে ওর ছবি দেখিস। আজও লুকিয়ে ইউনাইটেড হসপিটালের গেইটের দিকে তাকিয়ে থাকিস। চুপি চুপি ওকে দেখিস। আড়ালে ওকে সাহায্য করিস। জাস্ট অ‍্যাট্রাকশন বলে? ওকে আর ভালো লাগেনা বলে?’

উচ্ছ্বাস জবাব দিলোনা। টিভির দিকে তাকিয়ে রইল শক্ত চোখে। ওদের কথোপকথনের মাঝেই কুহু নিচে নেমে এলো। বসল সিঙ্গেল সোফায়। কুহুর মলিন মুখ খেয়াল করল রুদ্র। ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় প্রশ্ন ছুড়লো, কী হয়েছে? কুহু কৃত্রিম হাসি হেসে মাথা নাড়ল। রুদ্র হাত বাড়িয়ে ওকে ডাকল নিজের কাছে। কুহু এগিয়ে এসে বসল রুদ্রর পাশে। রুদ্র একহাতে বোনকে জড়িয়ে ধরে টিভির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ইউনিভার্সিতে কিছু হয়েছে?’

কুহু মাথা নেড়ে না বলল। উচ্ছ্বাস কৌতুক করে বলল, ‘আরে ওতো গাছে ফুল একটা কম ফুটলেও মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। ফিলিং হার্ট!’

কুহু ভেংচি কাটল। উচ্ছ্বাস হেসেই গেল। এরমাঝেই রুদ্র ঘাড় বাঁকিয়ে একবার উঁকি ‍দিল রান্নাঘরে। প্রিয়তা আর জ্যোতি চা-নাস্তা বানাচ্ছে। প্রিয়তা আর জ্যোতির চা-নাস্তা বানানো হতে হতে বসার ঘরে উপস্থিত হলেন রাশেদ আর জাফর। সোফায় বসে নিজেদের মধ্যকার আলাপ শুরু করলেন। তার ঠিক দশ মিনিট পর চা-নাস্তা নিয়ে হাজির হলো প্রিয়তা আর জ্যোতি। দ্রুত হাতে সার্ভ করে দিল সবাইকে। জ্যোতিও নিজের চা নিয়ে বসে পড়ল। প্রিয়তা তখনও দাঁড়িয়ে। বসার প্রস্তুতি নেবে তখনই রাশেদ নিজের বজ্র কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘প্রিয়তা মা?’

প্রিয়তা দাঁড়িয়ে গেল। হঠাৎ ডাকে লাফিয়ে উঠেছিল হৃদপিণ্ড। ভয়ে ভয়ে বলল, ‘জি বাবা?’

‘তুমি পড়াশোনা কতদূর করেছো?’ জেনেও প্রশ্ন করলেন রাশেদ।

‘ইকোনমিকস এ অনার্স কম্প্লিট করেছি বাবা।’

‘রুদ্র বলেছে তোমার মাস্টার্স করার ইচ্ছে ছিল। কুহুদের ভার্সিটিতে সামনের মাসেই এডমিশন শুরু হচ্ছে। আমি রুদ্রকে বলে দিয়েছি। ভর্তির সব ব্যবস্থা করে দেবে ও। ভর্তি হয়ে যাবে।’

প্রিয়তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হতবাক চোখে তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্রও মুচকি হাসল। প্রিয়তা রাশেদকে উদ্দেশ্য করে খুশি মনে বলল, ‘ ঠিক আছে, বাবা।’

রাশেদ চায়ের কাপে দীর্ঘ এক চুমুক দিয়ে বললেন, ‘ আমায় এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমার মেয়েদের কাছে আমি বরাবরই কোমল।’

প্রিয়তা মুচকি হেসে বলল, ‘ জি বাবা।’

এরমধ্যেই এসে উপস্থিত হলো ইকবাল। রাশেদকে সালাম দিয়ে সোফায় বসল। প্রিয়তা তার জন্যেও কাপে চা ঢেলে এগিয়ে দিল। রাশেদ থমথমে গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘কোথায় ছিলি?’

ইকবাল চায়ের কাপটা নিতে নিতেই হেসে বলল, ‘চৌধুরী টাকা পাঠিয়েছ। সেটাই জমা করছিলাম ফান্ডে।’

রাশেদ কিছু বললেন না। চুপচাপ চায়ে চুমুক দিলেন নির্বিকারভাবে। কিন্তু ভেতরের অস্থিরতা রুদ্র স্পষ্ট টের পেল।

রাতে খাবার খাওয়ার পর রুদ্রকে নিজের ঘরে ডাকলেন রাশেদ। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবেন বলে। রুদ্র সে ঘরে উপস্থিত হয়ে রাশেদকে তার ইজি চেয়ারে বসা দেখল। একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘ কিছু বলবেন, বাবা?’

রাশেদ সোজা হয়ে বসলেন। ধীরেসুস্থে একটা সিগারেট ধরালেন। প্রথম টান দিয়ে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, ‘ব্লাক হোল আর ডার্ক নাইট একসঙ্গে কাজ করছে এবার। মানেটা বুঝতে পারছো?’

রুদ্র সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘পারছি।’

‘বর্তমানে ডার্ক নাইটের লীডার কে জানো?’

রুদ্র জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল রাশেদের দিকে। রাশেদ স্থির কন্ঠে বলল, ‘ শওকত মীর্জা।’

মনে মনে চমকে উঠল রুদ্র। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কিন্তু বাইরে দিয়ে নিজেকে শক্ত রেখে বলল, ‘পলিটিশিয়ান?’

‘মনে পড়েছে?’

রুদ্র উত্তর দিলোনা। ওর মনে পড়েছে। আসলে ভোলেই নি কখনও। ঐ লোকটাকে ভোলা যায় না। রাশেদের চিন্তার কারণ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে রুদ্রর কাছে।

ঠান্ডা ফুরফুরে হাওয়া বইছে। ভেজা বাতাস। কাছে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে হয়তো। রাতের শেষ সিগারেট টেনে বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকলো রুদ্র। ও ঘরে ঢুকতেই প্রায় দৌড়ে এসে জাপটে ধরল প্রিয়তা। দুকদম পিছিয়ে গেল রুদ্র। প্রথমে খানিকটা হকচকিয়ে গেলেও পরে হেসে ফেলল। বলল, ‘কী হয়েছে?’

‘থ্যাংক ইউ সো মাচ।’ আল্লাদি গলায় বলল প্রিয়তা।

‘কেনো?’

‘আমার ইচ্ছেটাকে মনে রাখার জন্যে। গুরত্ব দেওয়ার জন্যে।’

‘ আমি আগেও বলেছি, শুকনো থ্যাংকসে আমার মন ভরেনা।’

প্রিয়তা হাসল। আগের মতো একই ভঙ্গিতে চুমু খেল রুদ্রর গালে। কানের কাছে আস্তে করে বলল, ‘লাভ ইউ।’

প্রিয়তা সরে আসতে গিয়ে আটকে গেল। রুদ্র সরতে দিলোনা ওকে। ওভাবেই নিজের সঙ্গে জড়িয়ে রাখল। ফিসফিসে গলায় বলল, ‘আমার চেয়ে বেশি না।’

‘ জানি।’

‘ জানো?’

‘ হুম।’

কয়েকসেকেন্ড চুপ ছিল দুজনেই। হঠাৎ রুদ্র বলল, ‘প্রিয়?’

‘ হুম?’

‘ কিছু বলার ছিলো।’

‘ বলুন।’

রুদ্র খানিকটা ইতস্তত করে বলল, ‘আমায় তিন-চারদিনের জন্যে কোথাও যেতে হবে। কোথায় সেটা জিজ্ঞেস করোনা। কিন্তু ফিরতে তিন-চারদিন লাগবে।’

প্রিয়তা চোখ তুলে তাকাল রুদ্রর চোখের দিকে। রুদ্র প্রিয়তার গালে হাত রেখে বলল, ‘কাল সকালেই বের হব। নিজের খেয়াল রেখো।’

প্রিয়তা মাথা নিচু করে ফেলল। চেহারায় ভেসে ওঠা কান্নাভাবটা প্রায় জোড়পূর্বক গিলে ফেলল। রুদ্র প্রিয়তাকে নিজের আরও কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘মন খারাপ করবেনা। আমার সবচেয়ে অপছন্দের জিনিস এটা। তোমার মলিন মুখ।’

প্রিয়তা কান্নামাখা গলায় বলল, ‘ আমার ভয় লাগে। আপনি যখন বাইরে যান, প্রতিটা মুহূর্ত ছটফট করি আমি। আপনি ফিরে আসার আগ পর্যন্ত দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। ভয়ে, আশঙ্কায় মরে যেতে ইচ্ছে করে।’

‘ আমিতো আগেই বলেছিলাম, প্রিয়। কিন্তু এতো ভয় পাচ্ছো কেন? মৃত্যুতো অবধারিত। আজ না হয় কাল। সবাইকেই মরতে হবে। পৃথিবী থেকে কেউ প্রাণ নিয়ে পালাতে পারেনা। তাইতো পৃথিবীকে মৃত্যুলোকও বলে। আমাকেও একদিন মর_’

আর কিছু বলার আগেই একহাতে রুদ্রর মুখ চেপে ধরল প্রিয়তা। ব্যথিত কন্ঠে বলল, ‘ আজ থেকে খোদার কাছ একটাই প্রার্থনা করব, আপনার আগে যেনো আমার মৃত্যু হয়।’

রুদ্র কোঁচকানো ভ্রু নিয়ে তাকিয়ে দেখল প্রিয়তাকে। আর একটা কথা বলারও সুযোগ দিলোনা ওকে রুদ্র। মেয়েটার এসব উল্টোপাল্টা কথা ওর কখনই ভালো লাগেনা।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here