অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৪৭. ( বর্ধিতাংশ )

0
81

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৪৭. ( বর্ধিতাংশ )

চোখে সবকিছু ঝাপসা দেখতে পাচ্ছে রুদ্র। কাঁধের সঙ্গে সঙ্গে মাথাটাও ভারী হয়ে উঠছে। ঝাপসা চোখেই দেখতে পেল ওর ঠিক মাথা বরাবর পি-স্ত-ল ধরে রেখেছে এক সুগঠিত শরীরের এক যুবক। চিনতে অসুবিধা হলোনা রুদ্রর। কন্ঠস্বরের মতো অবয়ব দেখেও অনায়াসে চিনে ফেলল আগন্তুককে। সম্রাট! ব্লাক হোল নামক রাজ্যের রাজপুত্র।

আস্তে আস্তে সুস্থ থাকা বাকি লোকগুলোও বেরিয়ে এলো। সকলেরই বন্দুকের নল তাকিয়ে আছে রুদ্রর মাথার দিকে। সম্রাট রুদ্রর দিকে পিস্তল তাক করে রেখেই বলল, ‘কী ব্যপার ছোট আমের! বললে না কেমন আছো? কতদিন পর দেখা।’

রুদ্র নিজের কাঁধ চেপে উঠতে নিলেই সম্রাট বলে উঠল, ‘আ.. আ.. চালাকি করোনা রুদ্র। মোটা সাতটা পিস্তলের চোখ তোমার মাথার দিকে। খুন হয়ে যাবে।’

রুদ্র পাত্তা দিলোনা। নিজের মতো উঠে বসে একটা বস্তার সঙ্গে হেলান দিয়ে। একটা হাঁটু গুটিয়ে নিয়ে; বাঁ হাতটা তুলে দিল হাঁটুর ওপর। ডান হাত দিয়ে এখনো চেপে রেখেছে ক্ষতস্থান। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, ‘পেছন থেকে সাক্ষাৎ করার স্বভাবটা তোমার বাবার সম্রাট। তোমাকে সম্মুখসমোরে বিশ্বাসী লোক বলেই জানতাম।’

সম্রাটের 7mm পি-স্ত-লটা এখনো রুদ্রর দিকে তাক করা। আঙুল ট্রিগারে। ও নিজেও সামান্য হেসে বলল, ‘দাবা খেলায় তুমি খুব পারদর্শী তাইনা রুদ্র? ট্র্যাপ বোঝ? ট্র্যাপ?’

বিজ্ঞের মতো মাথা দোলালো রুদ্র, ‘বুঝলাম। এরপর?’

‘মালগুলো দিয়ে দাও রুদ্র। হুসাইনের সঙ্গে কোনরকম চুক্তি হবেনা তোমার।’

‘দ্বিতীয় কোন অপশন নেই?’ সকৌতুকে প্রশ্ন ছুড়লো রুদ্র।

রাগে দাঁতে দাঁত পিষল সম্রাট। কিন্তু ধৈর্য্য হারালো না। পি-স্ত-লটা লোড করে বলল, ‘অবশ্যই আছে। তোমার মরণ।’

চোখেমুখে কৌতুক খেলা করছে রুদ্রর। নিজের অবস্থা নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত নয় সে। ব্যপারটায় চিন্তিত করে তুলল সম্রাটকে। কপালে ভাজ পড়ল। রুদ্রকে চেনে সে। অযথাই এতোটা নির্বিকার থাকবেনা সে। হঠাৎই কিছু একটা ভেবে কুটিল হাসল সম্রাট। বলল, ‘তুমি কী কোনভাবে এটা ভেবে নিশ্চিন্ত হচ্ছোনাতো; যে বাইরে তোমার লোক আছে, তারা তোমাকে এসে বাঁচিয়ে নেবে? যদি সেটা ভেবে থাকো তাহলে বলব তোমার জানা উচিত যে সম্রাট এতো কাঁচা কাজ করেনা। এতো বড় একটা কাজে তুমিযে এখানে একা আসবেনা সেটা আমি জানি। ওরা চারপাশটা ঘিরে ধরতে ধরতে তোমার মাথায় ব-ন্দু-ক ধরা খুব বেশি কঠিন হবেনা আমার জন্যে। আর গোটা সোলার সিস্টেমকে নিরস্ত্র করে; স্যারেন্ডার করাতে এরচেয়ে বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই বোধ হয়। কী বলো?’

রুদ্রর চোখে এখনো একই কৌতুক। অনেকটা আলসেমি ঝেড়ে নিজের ক্ষতস্থানটা হাত দিয়ে আরেকটু চেপে ধরল রুদ্র। ব্যথায় সামান্য বিকৃত হয়ে উঠল মুখটা। সেটা হজম করেই বলল, ‘ক্যালকুলেশান ঠিক ছিল। কিন্তু চালে একটু ভুল হয়ে গেলোযে খোকা।’

ভ্রকুটি করল সম্রাট, ‘ভুল?’

‘দাবার খেলাটা শুধু চারকোনা একটা কোটের মধ্যে হয় চাঁদ। কিন্তু জীবনের খেলাটা আরও বেশি জটিল। এমন হাজারটা চারকোনা কোট ছড়িয়ে আছে আশেপাশে। একটা কোট থেকেও নজর সরে গেলে খেল খতম। সোজা চেকমেট!’

‘গু-লি খেয়ে পাগল হয়ে গেছো নাকি?’ বলল বটে। কিন্তু আগের মতো সেই আত্মবিশ্বাস নেই সম্রাটের কন্ঠে। মনে মনে ঠিকই বুঝতে পারছে সত্যিই চালে কোথাও একটা ভুল হয়ে গেছে। হাওয়ায় কথা বলার লোক রুদ্র আমের নয়। তবে এটা রুদ্রর চালও হতে পারে। ওকে বিভ্রান্ত করার জন্যে। সম্রাট কোনরকমে নিজের কন্ঠে দৃঢ়তা বজায় রেখে বলল, ‘বিভ্রান্ত করতে চাইছো আমাকে?’

বাক্যটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে এসে ঢুকল রঞ্জুসহ সোলার সিস্টেমের বেশ কয়েকজন সশস্ত্র লোক। সম্রাট সঙ্গে সঙ্গেনিজের পি-স্ত-ল চেপে ধরল রুদ্রর মাথায়। চেঁচিয়ে বলল, ‘সাবধান রুদ্র! ওদের একটা ভুল কিন্তু তোমার শেষের কারণ হবে।’

রুদ্র তখনও নির্বিকার। রঞ্জু দ্রুত এগিয়ে এসে ব্যস্ত স্রে বলল, ‘ভাই এতো রক্ত ক্যান। গুলি লাগছে আপনার?’

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে একবার পরখ করে নিল নিজের ক্ষতটা। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল, ‘হালকা করে ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে। তেমন কিছুই না। কিন্তু আমাদের ছোটভাই বড্ড অধৈর্য হয়ে উঠছে। আসল ঘটনা বোঝা ওকে।’

সম্রাট চমকালো। তারমানে এতক্ষণ নাটক করছিল রুদ্র! গুলিটা সেভাবে ঘায়েল করেনি তাকে! রাগে দাঁত কিড়মিড় করে উঠল সম্রাট। কিছু বলতে যাচ্ছিল তখনই শুনতে পেল করিম তাজওয়ারের গলার আওয়াজ। যেটা রঞ্জুর ফোন থেকে ভেসে আসছে। রঞ্জু ফোনটা বাড়িয়ে রেখেছে সম্রাটের দিকে। হতভম্ব সম্রাট ফোনটা নিয়ে কন্ঠে অবিশ্বাস ঢেলে বলল, ‘বাবা?’

‘চুপচাপ বেরিয়ে এসো ওখান থেকে।’ অস্থির গলায় আদেশ করলেন করিম।

তেঁতে উঠল সম্রাট, ‘তামাশা করছো? হুসাইনও যদি হাতছাড় হয়ে যায় মালগুলো তোমার মরা বাপের কাছে বেঁচবে? গোডাউনে পঁচবে সব। ডোবা দলটাকে আর কত ডোবাবে?’

‘তুমি চুপচাপ ওখান থেকে চলে না এলে এরা আমাকে মেরে বঙ্গপোসাগরে ডুবিয়ে দেবে।’

‘কী?’

‘সোলার সিস্টেমের কাছে বন্দি আছি আমি এখন। এইযে আমি কথা বলছি সেটাও ওদের ফোন থেকেই। আর আমার মাথায় এ মুহুর্তে পি-স্ত-ল ধরে আসে উচ্ছ্বাস। আঙুলটা ট্রিগারেই আছে। চাপতে সময় লাগবে না।’

উচ্ছ্বাস অপাশ থেকে বলল, ‘ট্র‍্যাপ কাকে বলে এবার বুঝেছো খোকা? ফিডার খাওয়ার বয়সে মাংস চাইতে নেই। চুপচাপ লেজ গুটিয়ে পালিয়ে এসো দেখি বাছা।’

সম্রাট রাগে করমর করে বলল, ‘তোর মরন আমার হাতেই লেখা আছে শু*রের বাচ্চা।’

উচ্ছ্বাস হেসে ফেলল। আরও শক্ত করে পি-স্ত-ল ধরল করিমের মাথায়। করিম বলল, ‘ডায়লগ না ঝেড়ে ওরা যা বলছে করো!’

সম্রাট শান্ত গলায় বলল, ‘তোমাকে পেলো কোথায় ওরা?’

‘ইনকাম ট্যাক্সের লোক সেজে ঢুকেছিল বাড়িতে। রেট ওয়ারেন্টও ছিল। তাই কিছু বুঝতে পারিনি।’

বিশ্রী এক গালি বেরিয়ে এলো সম্রাটের মুখ থেকে। সে গালি শুনে কান লাল হয়ে উঠল করিমের। তা দেখে উচ্ছ্বাস ঠোঁট চেপে হাসল। রঞ্জু পারলে বত্রিশের জায়গায় আটত্রিশটা দাঁত বের করে হাসে। এদিকে রুদ্রও কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখছে বাপ-ব্যটার কান্ড। যেন সার্কাস!
রাগে দিশেহারা বোধ করল সম্রাট। কত কষ্ঠে সাজিয়েছিল সব পরিকল্পনা। রুদ্রকে পাকরাও করা। ওর লোক কীভাবে সামাল দেবে তা। সব ঠিকঠাক চলছিল। মাঝখান থেকে ওর গাধা বাপটা সবটা ভেস্তে দিল। কোনরকমে বলল, ‘বাপ না হলে আমিই কোনদিন যেন ঠুকে দিতাম তোমায়। মাথামোটা একটা!’

থতমত খেয়ে কলটা কাটলেন করিম। কোনরকমে নজর লুকিয়ে ফোনটা বাড়িয়ে দিল উচ্ছ্বাসের দিকে। উচ্ছ্বাস দাঁত বের করে হাসল। ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে বলল, ‘আম গাছে আমই হয় আর কচু গাছে কুচু! সবই কপাল। কিছু করার নেই চাচা।’

চোখ তুলে তাকালেন না করিম। রাগে, লজ্জায় দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলেন নিজের জায়গায়। উচ্ছ্বাস সকৌতুকে বলল, ‘একটু খাবারদাবারের ব্যবস্থা করুন দেখি তাজওয়ার সাহেব। অপেকক্ষণ না খেয়ে আছি।’

কটমটে চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকাল করিম। পারলে এক্ষুনি খু-ন করতো এই ছেলেকে। কোনদিন সুযোগ এলে হাতছাড়া করবেনা সে।

ইতিমধ্যে গোডাউনে এসে উপস্থিত হয়েছে হুসাইন আলি এবং তার লোকজন। সম্রাট ঘুনে ধরা একটা চেয়ারে চোয়াল শক্ত করে স্থির হয়ে বসে আছে। সম্রাটের সব লোকজন নিয়ে বেরিয়ে গেছে রুদ্রর লোক। কাউকেই প্রাণে মারা হবেনা। হাইওয়ে অবধি নিয়ে গাড়িতে করে পাঠিয়ে দেবে চট্টগ্রাম। সম্রাটকে নিয়ে যাবে রঞ্জু। ওরা চট্টগ্রামের গাড়িতে তুলে দেওয়ার পরেই মুক্ত করা হবে করিম তাজওয়ারকে। রুদ্র রঞ্জুকে ইশারা করল সম্রাটকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। অ-স্ত্র অনেক আগেই কেড়ে নেওয়া হয়েছে ওদের কাছ থেকে।

আকস্মিক এক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল সম্রাট। নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না নিজের ভেতরে চেপে রাখা রাগকে। খালি হাতেই আক্রমণ করে বসল রুদ্রকে। ঘুষি মারল রুদ্রর চোয়ালে। রঞ্জু ব-ন্দু-ক নিয়ে এগোতে যাচ্ছিল। রুদ্র বাঁধা দিল। খালি হাতেই লড়বে সে। আরেকটা ঘুষি আসতেই হাত দিয়ে বাঁধা দিল রুদ্র। কাঁধের ব্যথাটা টনটন করে উঠল। কিন্তু পাত্তা পেলোনা রুদ্রর কাছে। হাঁটু দিয়ে কষিয়ে এক লাথি মারল সম্রাটের তলপেটে। কয়েক পা পিছিয়ে গেল কিন্তু দমল না সম্রাট। আবাল তেড়ে এলো রুদ্রর দিকে দুজনেই হাতের তালু দিয়ে ঠেলে ধরল দুজনকে।
সাহায্য করতে চাইছিল হুসাইনের লোক। কিন্তু বাঁধা দিল হুসাইন আলী। বরং চেয়ারে বসে আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরালো। যেন কোনো মজাদার ক্রিয়া চলছে।

বাহুবলে কাউকে পিছিয়ে রাখা যাচ্ছেনা। রুদ্র সম্রাট সমানতালে আঘাত করছে একে অপরকে। তবে রুদ্রর গু-লিতে ক্ষতিগ্রস্ত কাঁধটা সম্রাটের জন্যে অ‍্যাডভান্টেজ বটে। সুযোগটা ভালোভাবেই নিল ও। সুযোগ বুঝে রুদ্রর বাঁ হাত পিঠের কাছে নিয়ে মুচড়ে ধরল। ব্যথায় কয়েসেকেন্ড চারপাশ অন্ধকার দেখছিল রুদ্র। কিন্তু সামলে নিল। ডান হাতে কুনুই দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করল সম্রাটের উড়ুতে। ছেড়ে দিতে বাধ্য হল সম্রাট। ব্যথায় নিজেও চোখে শর্ষেফুল দেখছে ও। সময় ব্যয় করল না রুদ্র। ঘুরে সম্রাটের দু কাঁধ চেপে ধরে সজোরে হাঁটু মারল তলপেটে। বিকৃত আওয়াজ করে ঝুঁকে পড়ল সম্রাট। অতঃপর ডানহাতটা চা-পা-তির মতো ধরল সবলে নামিয়ে দিল সম্রাটের ঘাড়ের বিশেষ এক জায়গায়। আর কিছু করার ক্ষমতা রইল না সম্রাটের। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল।
সানন্দে সিগারেটে লম্বা টান দিলেন হুসাইন আলী। মাটিতে সেটা ফেলে দিয়ে পা দিয়ে পিষতে পিষতে দুবার হাত তালি দিয়ে বললেন, ‘চমৎকার!’

রঞ্জু প্রায় দৌড়ে এলো রুদ্রর কাছে বলল, ‘ভাই অনেক হইছে। এইবার জলদি হাতটা বাইন্ধা লন। অনেক র-ক্ত পইড়া গেছে।’

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে একবার দেখল ক্ষতটা। সামান্য ক্ষত হলেও র-ক্তক্ষরণ হচ্ছে প্রচুর। শরীর ঝিম ধরে আসছে সেকারণেই। রুদ্র বলল, ‘করিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু এটাকে হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে আয়।’

‘জীবিত ছাড়াডা কী ঠিক হইতো ভাই?’ সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন করল রঞ্জু।

‘না, হচ্ছেনা। কিন্তু বাবার আদেশ, দলের প্রয়োজন ছাড়া খু-ন করা নিষেধ।’

রঞ্জু কিছু বলতে গিয়েও বলল না। সম্রাটকে জী-বিত ছাড়ার পক্ষে নয় ও। কিন্তু রুদ্রর মুখের ওপর কথাও বলতে পারছেনা। রুদ্র বলল, ‘সময় নষ্ট না করে যা। জ্ঞান ফিরে এলে আরেক ঝামেলা।’

হঠাৎই ঘোল পাল্টে ফেলল রঞ্জু। ভীত সত্তা থেকে বেরিয়ে এসে প্রবল অধিকারবোধ নিয়ে বলল, ‘আপনি কান্দ বান্দনের আগে আমি যাইমুনা কিন্তু।’

দশ বছরের বাচ্চাদের আবদারের মতোই শোনালো রঞ্জুর আবদার। হেসে ফেলল রুদ্র।

হুসাইনের তত্ত্বাবধায়নেই হল রুদ্রর চিকিৎসা। রুদ্র ব্যান্ডেজ বাঁধার পড়েই সম্রাটের অজ্ঞান শরীর নিয়ে বিদায় নিল রঞ্জু।
অতঃপর কাজের কথায় এলো রুদ্র আমের এবং হুসাইন আলী। অন্ধকার ঘরটাতে কয়েকটা মশাল বাঁধা হয়েছে। ওখানে পড়ে থাকা পুরনো এক টেবিলে বসেছে ওদের বৈঠক। চারপাশে হুসাইন আলীর লোকবলই দাঁড়িয়ে। অ-স্ত্র হাতে। আলোচনার আগে একে অপরকে ভালোভাবে দেখে নিল রুদ্র এবং হুসাইন। পঞ্চাশ পেরিয়েছে হুসাইন আলীর বয়স। কাঁচাপাকা চুলদাড়ি। পরন সাদা পাঞ্জাবী। চোখে গাঢ় সুরমা ল্যাপা। ধূসর চোখদুটো অদ্ভুত লাগছে দেখতে। সেই চোখদুটোর দিকেই তাকিয়ে আছে রুদ্র। হুসাইন আলীর দৃষ্টিও রুদ্রর তীক্ষ্ম চোখে। নীরবতা ভেঙ্গে সে বলল, ‘লোকে সত্যিই বলে। ক্রি-মি-নাল জগতের সর্বকালের সুন্দর, সুদর্শন, অতুলনীয় ক্রি-মি-নাল তুমি।’

রুদ্র হাসল। কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, ‘আপনারতো আরও আগে আসার কথা ছিল। দেরী করলেন যে?’

হুসাইন আলী ডালা পান তুলে নিল একটা। মুখে পুড়ে নিয়ে ডালাটা এগিয়ে দিল রুদ্রর দিকে। রুদ্র তাকিয়ে দেখল ডালাটা। কিন্তু পানে হাত দিলোনা। ডালায় রাখা সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিল হাতে। হুসাইন আলী পান চিবুতে চিবুতে বলল, ‘এবার যেই চুক্তি তুমি করতে চাইছো সেটাযে এতো সহজে কেউ হতে দিতে চাইবেনা সে আমার জানা কথা। বেশ কয়েকটা দল আটকাতে চাইছিল তোমাদের। পথেই আটকেছে সব। কিন্তু এ ছোকরা চলে এসছে কোনভাবে। আর আমি যারতার সাথেতো চুক্তি করবোনা বাপ। তাই অপেক্ষা করছিলাম। তোমাদের এই ডিসুম ডিসুম খেলা শেষ হওয়ার অপেক্ষা। যে জিতবে তার সঙ্গেই চুক্তি ফাইনাল।’

‘মাল না দেখেই?’ সিগারেটে আগুন জ্বা-লি-য়ে বলল রুদ্র।

হাসল হুসাইন আলী, ‘মাল নিয়ে আত্মবিশ্বাসী না হলে এতোবড় চুক্তি করতেনা তুমি। তবুও! দেখাও তোমার মাল।’

মালের ব্রিফকেসটা রেখেই গিয়েছিল রঞ্জু। টেবিলের ওপর সেটা তুলে খুলল রুদ্র। চকচকে অস্ত্রগুলো দেখে চোখ চকচক করে উঠল হুসাইন আলীরও। দ্রুত একটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘ও-য়ে-বলি স্কট! আর ওটা! ওটাতো ফা-য়া-র আ-র্মস।’

মাথা দোলালো রুদ্র। ‘দেখতে অরকমই। কিন্তু আরও উন্নত এবং শক্তিশালী। বিশেষকিছু এক্সট্রা পার্টস এবং আফ্রিকান ম্যাটালস্ দিয়ে তৈরী। আফ্রিকার ক্যাগেলস্ গ্রুপের তৈরী। অস্ত্র নিয়ে প্রচুর সফল এক্সপেরিমেন্ট আছে তাদের।’

ব্রিফকেস থেকে একটা প্যাকেট বের করল রুদ্র। ওটা খুলে টেবিলে উল্টো করে ঢালতেই ঝনঝন শব্দে টেবিলে ছড়িয়ে পড়ল ধারাল কিছু বুলেট। চোখ বড় বড় হয়ে গেল হুসাইনের। নিজের এতো বছরের ব্যবসা জীবনে এমন বুলেট সে দেখেনি।

হুসাইন আলীর লোভে চকচক করা চোখদুটো দেখে হাসল রুদ্র। বলল, ‘এটাও ওদেরই আরেক এক্সপেরিমেন্ট। ওদের প্রতিটা সফল এক্সপেরিমেন্ট আমাদের হাতে আসবে। আর আমাদের হাতে আসা মানেই আপনার হাতে আসা। যদি আপনি আমাদের সঙ্গে চুক্তি করতে রাজি থাকেন তো।’

শব্দ করে হাসল হুসাইন আলী। সানন্দে আরেকটা পান পুড়ে নিল মুখে। রুদ্র বলল, ‘আপনার এই হাসিকে আমি হ্যাঁ ধরব নাকি না।’

পান চিবুতে চিবুতে হুসাইন বলল, ‘সেদিকে লাভ সেদিকেই আমি বাছা। আর এখানেতো আমি কোন ক্ষতি দেখছি না।’

বলেই হো হো করে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল হুসাইন আলী। হাসল রুদ্রও।

*

চারদিন হল রুদ্র নেই আমের ভিলায়। প্রিয়তার কাছে মোটেও সহজ ছিলোনা চারটা দিন। একটা রাতও শান্তিতে ঘুমোতে পারেনি সে। রুদ্র এখনো ফেরেনি। প্রথম দুদিন ফোনে কথা হলেও এরপর থেকে ফোন বন্ধ। রাশেদ, জাফর, উচ্ছ্বাস কারো কাছেই কোন খবর নেই। যদিও ওরা বলেছে, এরকম মাঝেমাঝেই হয়। চিন্তা না করতে। কিন্তু তাতেও প্রিয়তার অস্থিরতা একফোঁটাও কমেনি।
রাতের খাবারের সময় হয়ে গেছে। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শসা কা-টছে প্রিয়তা। কা-টতে কা-টতে গভীরভাবে ভাবছে কিছু একটা। অসাবধানতাবশত লেগে গেল হাতে। মৃদু আর্তনাদ করে উঠল প্রিয়তা। পাশেই জ্যোতি মাংসের তারকারি রাখছিল। প্রিয়তা আওয়াজ শুনে চমকে তাকাল। দেখল ওর তর্জনী আঙুল কেটে রক্ত বের হচ্ছে। জ্যোতি দ্রুত ওর হাত ধরে বলল, ‘তোমাকে বললাম আজ এসব রাখো। ঘরে অনেকে আছে করে দেবে। অন্যমনস্ক থেকে এসব করা যায়?’

বলে একটা টুল টেনে এনে প্রিয়তাকে বসিয়ে দিলো। এরপর ড্রয়ার খুলে ফার্স্ট এইড বক্সটা বের করল। নিজেও একটা টুল টেনে বসল প্রিয়তার পাশে। আঙুলে ঔষধ লাগিয়ে দিতে দিতে কঠোর গলায় বলল, ‘এখন আর কিছু করতে হবেনা। সোফায় গিয়ে বসবে চুপচাপ। বাড়ির বউ তুমি মানলাম। তাই বলে সবসময় পাকামো করতে হবে কেন?’

জ্যোতির বকা শুনে প্রিয়তা মুখ কালো করে বসে রইল। প্রিয়তার কালো মুখটা দেখে জ্যোতি গলা ঝেড়ে বলল, ‘এতো চিন্তা করার কিছু নেই। দেখবে হুট করে এসে হাজির হবে।’

প্রিয়তা অবাক হয়ে বলল, ‘তোমরা সবাই এতো নিশ্চিন্ত কীকরে? দুদিন যাবত কল ধরছেনা। তোমাদের চিন্তা হচ্ছে না?’

জ্যোতি হাসল। ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমাদের জন্যে এটা নতুন কিছু না। এরকম প্রায়ই হয়। তোমাকে তো তাও দুদিন কল করেছে, ধরেছে। ও তো কখনও আমার কলই ধরতোনা। আমি অনেক বেশি দিলে বাধ্য হয়ে মাঝেমাঝে ধরে হাই-হ্যালো বলে রেখে দিতো। আর ফিরে আসতো হাতে-পায়ে ছোট-বড় ইঞ্জুরি নিয়ে। এসবে এখন আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি।’

প্রিয়তা এতক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল জ্যোতির কথা। জ্যোতি কথা থামাতেই প্রিয়তা বলে উঠল, ‘ খুব ভালোবাসো ওনাকে?’

জ্যোতি চমকে তাকাল প্রিয়তার দিকে। দু চোখে বিস্ময়। প্রিয়তা মলিন হাসি দিল। নিচের দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘ আমিও একজন মেয়ে আপু। অন্য একটা মেয়ের অনুভূতি বুঝব না? আর সেই অনুভূতিটা যখন আমার স্বামীর জন্যে হয়।’

জ্যোতি হাঁসফাঁস করল কয়েকসেকেন্ড। কী বলবে, কী প্রতিক্রিয়া দেবে বুঝতে পারল না। জ্যোতির উত্তর না পেয়ে প্রিয়তা আবার বলল, ‘আমার ওপর রাগ হয় জ্যোতি আপু? এরকম মনে হয়, আমি তোমার সঙ্গে অন্যায় করেছি?’

জ্যোতি কোন উত্তর দিলোনা। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিল। টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়ে বলল, ‘দেরী হয়ে যাচ্ছে প্রিয়তা। একটু পরে রাশেদ বাবা চলে আসবে। খাবার দিতে হবে তাকে। তুমি গিয়ে বসো। আমি আসছি।’

প্রিয়তা আর কথা বাড়াল না। চুপচাপ উঠে চলে গেল হল রুমের দিকে।

গভীর রাত। ঘুমের মধ্যে প্রিয়তার মনে হলো কিছু একটা পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে ওকে। নড়তে পারছেনা। কিন্তু সেই উষ্ণ আলিঙ্গনে উপভোগ করতে মন চাইল ওর। বেশ আরামবোধ করল। আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে চাইছিল। হঠাৎ টনক নড়ল প্রিয়তার। ওতো ঘরে একা শুয়ে ছিল। রুদ্রর কথা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাহলে ঘরে কে? ঝট করে চোখ খুলে তাকাল প্রিয়তা। নাকে এসে বাড়ি খেল খুব পরিচিত ঘ্রাণ। চোখ তুলে তাকাল প্রিয়তা। ঘরটা আবছা অন্ধকার। ও দেখলো, ওকে দুহাতে বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছে এক সুঠামদেহী পুরুষ। রুদ্র আমের। বিস্ময়ে কয়েক সেকেন্ড নড়তে পারল না প্রিয়তা। এরপর ঝট করেই উঠে বসল। হঠাৎই উঠে বসায় রুদ্রও চমকে উঠল। এখনো ঘুমোয়নি ও। ফ্রেশ হয়ে, প্রিয়তাকে জড়িয়ে চোখ বুজে ছিল কেবল। প্রিয়তাকে অবাক হতে দেখে হাসল রুদ্র। হাত বাড়িয়ে টেনে প্রিয়তাকে নিজের বুকে এনে ফেলল। আয়েশ করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তো মিসেস, কেমন কাটলো চারটা দিন?’

প্রিয়তা উত্তর দিলোনা। কিছুক্ষণ পর রুদ্র অনুভব করল রুদ্রর বুক ভিজে যাচ্ছে। কাঁদছে প্রিয়তা। রুদ্র গম্ভীর হয়ে উঠল। গম্ভীর গলায় বলল, ‘কান্না থামাও প্রিয়। আমি চলে এসেছিতো।’

প্রিয়তা কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘তাই বলে দুটো দিন কোন যোগাযোগ করবেন না? জানেন কত টেনশন করছিলাম আমি।’

‘আসলে ফোন ধরা বা করার মতো অবস্থায় ছিলাম না আমি। বিশ্বাস করো। আর এরকমটাতো প্রায়ই হয়। কেউ বলেনি তোমাকে?’

‘বলেছে। কিন্তু আমারতো চিন্তা হয়। আর আগে যা হতো এখনও সেটাই হবে না-কি? ভুলে যাবেন না এখন আপনি বিবাহিত। এখন আগের মতো সব হবেনা। পরবর্তীতে এমন করলে আমি ঘরে ঢুকতে দেবোনা বলে দিলাম।’

নাক টানতে টানতে শাসনের ভঙ্গিতে কথাগুলো বলছিল প্রিয়তা। রুদ্র হাসল। মজার ছলে বলল, ‘ঘরে ঢুকতে না দিলে আর কী করব? অন্য কোথাও গিয়ে অন্যকারো সাথে_’

কথা সম্পূর্ণ করতে পারল না রুদ্র। বুকের ওপর দারুণ এক কিল পড়ল। প্রিয়তা জেদ করে বলল, ‘খবরদার বলছি। বিয়ের আগে যা করেছেন আমি ভুলে গেছি। কারণ সেটা অতীত ছিল। এখন সেসব কিছু চিন্তা করলে খু-ন করে ফেলব আপনাকে আমি।’

‘মজা করছিলাম, প্রিয়। আমি লুকিয়ে কিছু করিনা। তোমার কাছে বরাবরই আমি খোলা বইয়ের মতো। শুধু একটা সিক্রেট অধ্যায় আছে। সেটা তোমার না জানাই ভালো। তোমার পরে অন্যকোন নারীকে ছোঁয়ার দুঃসাহস হবেনা আমার। এইটুকু বিশ্বাস রাখতে পারো।’

প্রিয়তা মুচকি হাসল। হাত দিয়ে আলতো করে স্পর্শ করল রুদ্রর গাল, ঠোঁট, গলা। মুখে বলল, ‘খেয়েছেন রাতে? নাকি আনবো?

‘রাস্তায় খেয়ে নিয়েছি। আর হ্যাঁ, এরপর আর কখনও সবজি কাটতে যাবেনা তুমি। কতখানি কে-টে ফেলেছো আঙুলটা।’ চোখ বুজে প্রিয়তার ছোঁয়াকে উপভোগ করে বলল রুদ্র।

রুদ্রর কাঁধে হাত যেতেই প্রিয়তা থেমে গেল। খসখসে কাপড় জাতীয় কিছু একটা অনুভব করল কাঁধে। একটু ভালোভাবে ছুঁয়েই বুঝে ফেলল এটা ব্যান্ডেজ। নিশ্চিত হতে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখল। সেটা দেখে প্রিয়তা ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘ব্যান্ডেজ কেন? কী হয়েছে?’

রুদ্র প্রিয়তাকে শান্ত করে বলল, ‘কিছুই না। একটু চোট লেগেছে।’

প্রিয়তার বুঝতে বাকি রইল না কিছু। ব্যান্ডেজটা অনেকটা জায়গা নিয়ে করা। নিশ্চয়ই কেউ আঘাত করেছে। আবার সেই খু-ন-খারাবি, অ-স্ত্র, র-ক্ত। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল প্রিয়তা। বেদনাত্মক স্বরে বলল, ‘এগুলো ছেড়ে দেওয়া যায়না? আপনাদেরতো ব্যবসা আছেই। কী দরকার এসবে থাকার। ফিরে আসুন না।’

রুদ্র এই বিষয়ে ভালো-মন্দ কিছুই বলল না। শুধু বলল, ‘অনেক রাত হয়েছে। আমিও ক্লান্ত। ঘুমিয়ে পড়ো। কাল কথা হবে।’

প্রিয়তা পেয়ে গেল নিজের উত্তর। অস্থির লাগছে এখন ওর। রুদ্র ঠিক বলেছিল, যতটা সহজ প্রিয়তা ভেবেছিল ততটা সহজ হবেনা সবকিছু। হচ্ছেনা। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে প্রতি মুহূর্তে মৃ’ত্যুর দিকে এগোতে দেখা যন্ত্রণার। ভয়ানক যন্ত্রণার। প্রিয়তার অস্থিরতা টের পেল রুদ্র। মেয়েটাকে স্হির করতে হবে। নয়তো সারারাত ঘুমোবেনা। বুকের ওপর থেকে সরিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল রুদ্র ওকে। ভেজা চোখদুটো আলতো হাতে মুছে দিল। ড্রিম লাইটের আলোয় সম্মোহনী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রিয়তার চোখে।

*

পরেরদিনটা ছিল কুহুর জন্যে অবাক হওয়ার দিন। আমের ভিলার সকলে সবে সকালের খাবার খেয়েছে। তখনই রাশেদ আমের ঘোষণা দিলেন, আজ কারো বের হওয়ার প্রয়োজন নেই। সবাই বাড়িতেই থাকবে। রাশেদের হঠাৎ এমন ঘোষণায় সকলে অবাক হলেও কিছু বললেন না।

বৈঠকঘরে না ডেকে রুদ্র, উচ্ছ্বাস আর জাফরকে নিজের ঘরে ডেকে নিলেন রাশেদ। রাশেদ নিজের ইজি চেয়ারটাতে গা এলিয়ে দিয়ে অভ্যাসবশত সিগারেট ধরালেন। দু-তিনটে টান দিয়ে গুছিয়ে নিলেন নিজের কথাগুলো। তারপর রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘কাজ শেষ হয়েছে?’

‘ জ্বি বাবা। হুসাইন আলীর সঙ্গে ডিল হয়ে গেছে আমাদের।’

‘বাঁধা দিতে আসেনি কেউ?’

‘ব্লাকহোল এসেছিল।’

‘ দলের প্রধান কেউ ছিল? না-কি সব চ্যালা?’

‘ সম্রাট ছিলো।’

জাফর চমকাল। রাশেদ নির্বিকারভাবে বললেন, ‘বেঁচে আছে?’

‘আছে। কিন্তু ঘায়েল। আপনি বলেছিলেন বলে প্রাণে মারিনি।’

রাশেদ কোন উত্তর দিলেন না। চোখ বন্ধ করে মনে পরপর কয়েকটা টান দিলেন সিগারেটে। মনে পড়ে গেল করিম তাজওয়ারের বলা সেই কথা, ‘ভবিষ্যতে এমন আদেশ রুদ্রকে আর দেবেন না। কারণ আবার কোনদিন যদি শত্রুকে প্রাণ ভিক্ষা দেওয়ার ভুলটা ও করে। সেটাই ওর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হবে। যার মাশুল গোটা সোলার সিস্টেমকে দিতে হবে। আফসোস করার সময়টুকুও পাবেনা কেউ। সব শেষ হয়ে যাবে।’ কিন্তু প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘নাঈমুর রহমানের কথা মনে আছে?’

‘ বিজনেস পার্টনার?’

‘ হ্যাঁ। তার ছেলে, নীরব। কুহুর ভার্সিটিতেই ছিল। এবছর মাস্টার্স পাশ করেছে। কুহুর সঙ্গে ওনার ছেলের বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিল। আমি এখনো কিছু বলিনি। তোমার আসার অপেক্ষা করছিলাম। উচ্ছ্বাস আর জাফর জানে সবটা। ওদের কোন সমস্যা নেই।’

রুদ্র চুপচাপ সব কথা শুনলো। এরপর বলল, ‘আসলে বাবা আমিও আপনার সঙ্গে এ বিষয়েই কথা বলতাম। কুহু এ ব্যাপারে প্রিয়তার সঙ্গে কথা বলেছিল। ও আমাকে বলেছে ব্যপারটা। নীরব আর কুহু একে অপরকে পছন্দ করে। আমি ওর সম্পর্কে যতটা জানি, ছেলে ভালো। ভেবেছিলাম এসে রিল্যাক্সে আপনার সঙ্গে আলোচনা করব।’

উচ্ছ্বাস বলল, ‘ আর আমি খোঁজ নিয়েছি। সত্যিই ছেলেটা ভালো।’

রাশেদ বললেন, ‘বছর দুয়েকের জন্যে ইন্ডিয়া যাচ্ছে ও। নাঈমুর চাইছে ও যাওয়ার আগে বাগদান হয়ে থাক।’

জাফর প্রসন্ন গলায় বলল, ‘ছেলে-মেয়ে দুজনেই যখন একে অপরকে পছন্দ করেছে তখন আর সমস্যা কোথায়?’

রাশেদ আরেকটু ভাবলেন। অ‍্যাশট্রেতে সিগারেট ফেলে দিয়ে বললেন, ‘কালকে ফ্লাইট আছে নীরবের। তাই বাগদানটা আজ বিকেলের মধ্যেই হয়ে যাওয়া ভালো। রুদ্র, তুমি প্রিয়তাকে বলো কুহুর সঙ্গে আরও একবার কথা বলে নিতে।’

রুদ্র মাথা নাড়ল। রাশেদ জাফরকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘সিঙ্গাপুর কর করে জানিয়ে দিস। রুদ্রর বিয়েতো ওরা এলোনা।’

জাফর খানিকটা ইতস্তত করল। লজ্জিত গলায় বলল, ‘আপনিতো জানেনই ভাইজান ওরা এ বাড়িতে আসতে পছন্দ করেনা। আমাদের কাজটাকেই পছন্দ করেনা। তাই_’

রাশেদ জাফরকে আর কিছু বলল না। রুদ্রকে বলল, ‘কাঁধের ইঞ্জুরিটা দেখেশুনে রেখো। ইনফেকশন যাতে না হয়। অনেক কাজ আছে।

রুদ্র উত্তর দিলোনা। মৃদু হাসল কেবল।

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় পারিবারিকভাবে, খুব ছোট করে নীরব আর কুহুর বাগদান হয়ে গেল। কুহুর সে কী লজ্জা। প্রিয়তা যখন কুহুকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিল, কুহু একদম আকাশ থেকে পড়েছিল। এতো তাড়াতাড়ি এসব হয়ে যাবে কল্পনাও করতে পারেনি ও। নীরবকে বারবার মেসেজ করছিল। শেষে নীরবের শুধু একটাই রিপ্লে ছিল, ‘ কামিং সুইটহার্ট।’ মেসেজটা দেখে হেসে ফেলেছিল কুহু। লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল চোখ-মুখ।

বাগদান শেষে করিডরের বারান্দায় ওদের দুজনকে আলাদাভাবে কথা বলার জন্যে পাঠানো হলো। করিডরে পৌঁছেই কুহু পরপর তিন-চারটা কিল বসালো নীরবের বুকে। নীরব ওর দু হাত ধরে আটকে দিয়ে বলল, ‘এগুলো কী হ্যাঁ? হবু বরকে মারতে হয়?’

কুহু মুখ ফুলিয়ে, হাত ভাঁজ করে, উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে রইল। নীরব কুহুকে নিজের দিকে ঘোরালো। কাছে টেনে বলল, ‘বলেছিলাম না সারপ্রাইজ আছে। জানো কতকিছু করতে হয়েছে এর জন্যে আমাকে? প্রথমে আমার বাবাকে মানাতে হয়েছে। এরপর আমার বাবাকে দিয়ে তোমার বাবাকে মানাতে হয়েছে। তোমার বাবার আবার তোমার ভাইকে মানাতে হয়েছে। বিয়েতো না যেনো যুদ্ধ!’

কুহু হেসে না বোধক মাথা নাড়াল। নীরব ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কী না?

কুহু ফোন বের করে মেসেজ লিখল, ‘আমার আবার ভাবিকে মানাতে হয়েছে। ভাবি মানিয়েছে ভাইয়াকে।’

সেন্ট করে হেসে ফেলল কুহু। মেসেজ দেখে নীরবও শব্দ করে হেসে ফেলল। হঠাৎ কিছু একটা চিন্তা করে কুহুর হাসি থেমে গেল। ফোনে কিছু লিখতে গেলে নীরব হাত ধরে ফেলল। বলল, ‘আমি জানি তুমি কী ভাবছো। বাড়ির সবাই রাজি হলো কীকরে? তাইতো?’ একটু থেমে, ‘সত্যিটি বলবো?’

কুহু মাথা ঝাঁকালো। নীরব সযত্নে কুহুর চুল ঠিক করে দিতে দিতে বলল, ‘আমার খুশিটাই আমার বাবা মায়ের কাছে সব। যদিও মা প্রথমে একটু হিঁচকিচ করছিল। কিন্তু বাবার কোন আপত্তি ছিলোনা। বাবাই মা-কে মানিয়ে নিয়েছে। এন্ড ইউ নো হোয়াট? তোমাকে দেখে মায়ের মনের হিঁচকিচও দূর হয়ে গেছে। সত্যি বলছি।’

কুহু মাথা নিচু করে হাসল। নীরব বলল, ‘আর দ্বিতীয় প্রশ্ন। আমি এতো তাড়াহুড়ো করে এনগেইজমেন্ট কেন করলাম? এটাই বলবে তো?’

কুহু তাকাল নীরবের দিকে। নীরব কুহুর দু গালে হাত রেখে বলল, ‘ আমি দুবছরের জন্যে বাইরে চলে যাচ্ছি। রিস্ক নিতে পারব না। এতোদিনে যদি অন্যকেউ তোমাকে বুক করে নেয় তো? আমার কী হবে?’

কুহু আবার হেসে ফেলল। নীরব কুহুর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘খুব মিস করব তোমাকে। আমার নীরবতাকে।’

.

নীরব রা একেবারে রাতের খাবার খেয়ে গেল। প্রিয়তা দুটো প্লেট নিয়ে রান্নাঘরে আসছিল। এসে শুনতে পেল এঁটো বাসন গোছাতে গোছাতে কথা বলছে নার্গিস আর আরেকজন মহিলা। নার্গিস বলছে, ‘এ বিয়ে টিকবে বলে মনে হয়? আজ আছে কাল নেই। অমন বোবা মেয়েকে কদিন ঘরে রাখে দেখো। এখন আল্লাদ করে নিচ্ছে। দুদিন পর লাথি দিয়ে বের করে দেবে। কত দেখলাম।’

অপর মহিলা রেগে গিয়ে বলল, ‘ কীসব বলছো? মুখ ভালো হলোনা তোমার। কুহু মার মতো মেয়ে কটা হয়? আমার ঘরে এমন মেয়ে এলেতো আমি মাথায় তুলে রাখতাম।’

প্রিয়তা শব্দ করে পা ফেলে ভেতরে ঢুকল। ওকে দেখে থেমে গেল দুজন। প্রিয়তা প্লেট দুটো নার্গিসের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ সবাই মনে আবর্জনা নিয়ে ঘোরেনা খালা। চাঁদে কালো দাগ থাকে, গোলাপেও কাঁটা থাকে। যাদের আত্মায় সিগ্ধতা আর সৌন্দর্য থাকে তারা চাঁদে সিগ্ধ আলো আর গোলাপে সৌন্দর্য দেখতে পায়। কিন্তু আত্মা দূষিত হলে, দাগ আর কাঁটা ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনা।’

কথাটা বলে প্রিয়তা আর দাঁড়াল না। হনহনে পায়ে বেরিয়ে গেল। নার্গিস মুখ কালো করে কাজে হাত লাগালো। অপর মহিলাটি নার্গিসের এমন হেনস্তা দেখে মনে মনে ভীষণ আনন্দ পেলো। ভাবল, একদম উচিত কথা শুনিয়ে দিয়েছে নতুন বউ।

রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। রুদ্র ওয়াশরুমে ফ্রেশ হয়ে দেখল প্রিয়তা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শরীরে লোশন লাগাচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ক্লান্ত ও। প্রিয়তা গলায় লোশন লাগাচ্ছিল এমন সময় পেছন থেকে ওর পেট জড়িয়ে ধরল রুদ্র। প্রিয়তা বলল, ‘লোশন লাগাচ্ছি দেখছেন না? ছাড়ুন। এখন কাঁধের ব্যথা চলে গেছে আপনার?’

‘ প্রিয়র স্পর্শে রুদ্র সব ব্যথা ভুলে যায়।’

প্রিয়তা মুচকি হাসল। তবুও কৃত্রিম বিরক্তি দেখিয়ে বলল, ‘হয়েছে, ছাড়ুন এবার।’

রুদ্র প্রিয়তাকে ছেড়ে গিয়ে শুয়ে পড়ল। প্রিয়তা লোশন লাগিয়ে, লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল। দুই মিনিট পর এগিয়ে গিয়ে মাথা রাখল রুদ্রর বুকে। রুদ্র প্রিয়তার চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে দিল। প্রিয়তা বলল, ‘একটা কথা ভাবছিলাম।’

‘ কী কথা?’

‘ নীরবের সঙ্গে কুহুর বিয়েটা এখন হয়ে গেলেই ভালো হতো।’

‘ এমন কেন মনে হলো?’

‘ দুটো বছর তো অনেকটা সময় তাইনা? তাই বললাম।’

‘ এখনতো আর সম্ভব না। নীরবের ফ্লাইট কাল।’

‘ হুম।’

রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘ আজ ওকে এতোটা খুশি দেখে নিজেকে হালকা লাগছে জানো? আমার আর বাবা- ওকে নিয়েই যত চিন্তা ছিল। খুব যত্নে বড় করেছি ওকে আমরা। অন্ধকার জগতের বাসিন্দা হয়েও ওর গায়ে কোন কালো ছায়া পড়তে দেইনি।’

প্রিয়তা তপ্ত এক শ্বাস ফেলে বলল, ‘সেটা আমি বুঝেছি এই কদিনে। আজ আমারও ভালো লাগছে। খুব খুশি ছিল মেয়েটা।’

পরিবেশটা কেমন ভারী হয়ে উঠল। তাই প্রসঙ্গ বদলাতে রুদ্র হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা প্রিয়, ধরো যদি হঠাৎ আমার কিছু হয়ে যায়। তখন তুমি কী করবে? বাবা কিন্তু বলেছিল তোমার আবার বিয়ে দেবে। সত্যিই আবার বিয়ে করবে নাকি? পারবে এভাবে অন্যকারো বুকে মাথা রাখতে?’

প্রিয়তা রুদ্রর বুকে আঘাত করে বলল, ‘ধ্যাত!’

রুদ্র শব্দ করে হেসে ফেলল। প্রিয়তা বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘এটা মজা করার বিষয়?’

রুদ্র প্রিয়তার গাল টেনে দিয়ে বলল, ‘যেসব কথা শুনলে মন খারাপ হয়, সেগুলো খানিকটা কৌতুক করেই বলা উচিত। আর তুমি সবসময় এতো ভয় পাও কেন? আমাকে মারা এতো সহজ হবেনা। এতো ক্ষমতা আন্ডারওয়ার্ল্ডের কারো এখনো হয়নি। আমাকে মারতে হলে বুদ্ধিতে আমার মতোই তুখোড়, আর ব্যক্তিত্বে আমার বিপরীত হতে হবে।’

প্রিয়তা কিছু বলল না। রুদ্রকে জড়িয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করল। রুদ্র অন্য চিন্তায় মগ্ন হলো। শওকত মীর্জার ব্যপারটা ভাবাচ্ছে ওকে। সামনে থেকে আঘাত করা শত্রুকে প্রতিহত করা যায়। কিন্তু পেছন থেকে হামলাকারী শত্রুর মোকাবেলা সহজ হবেনা। সামনের দিনগুলো কঠিন হতে চলেছে। খুব কঠিন।

#চলবে…

[ রি-চেইক করিনি। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here