অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৪৯.

0
72

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৪৯.

সাভার! এলাকাটা ঢাকার অন্যান্য জায়গার তুলনার শান্ত। তবে সেখানকারই মোটামুটি জনবহুল এলাকায় অবস্থান করছে পলিটিশিয়ান শওকত মীর্জার একমাত্র ছেলে, শান মীর্জা। বারাে তলা এক বিল্ডিং এর ছাদে আয়েশ করছে বলা যায়। বেতের আরামদায়ক এক চেয়ারে শরীর ছেড়ে দিয়েছে। এক হাতে বিদেশী মদের গ্লাস, অন্য হাতের দু আঙ্গুলের মাঝে জ্বলন্ত সিগারেট। জীবনের সবচেয়ে অসহ্যকর সময় পাড় করছে সে এখন। কিছুক্ষণ আগেও শওকত মীর্জা ফোন করেছিল। বারবার সতর্ক করে চলেছে; এই ফ্ল্যাট থেকে কোনভাবেই বের হওয়া যাবেনা। দরজা জানালা সব বন্ধ করে রাখতে হবে। সঙ্গে দিয়েছে কাকা পলাশ মীর্জার মৃত্যু সংবাদ। মৃত্যু, নাকি খু-ন!

কাকার মৃত্যু নিয়ে কোন শোক নেই শানের। কোথাকার কে,
তারজন্যে ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে তাকে। এটাই তার
সমস্ত বিরক্তির কারণ। ও শান মীর্জা। ও কেন কারো ভয়ে
লুকিয়ে থাকবে? নিজের অপার সাহস প্রদর্শনের জন্যেই
বাবার আদেশ অমান্য করে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে ছাদে
চলে এসেছে। এটাই প্রমাণ করতে যে সে কারো ধার
ধারেনা। তাকে মারার ক্ষমতা নিয়ে কেউ জন্মায়নি এখনো। তবে বিল্ডিং থেকে বের হয়নি। স্বীকার না করলেও পলাশ মীর্জার খু-ন ওর মনে ভয়ের সূষ্টি করেছে। যখন শুনেছে খু-নি
শওকতকে পলাশের আর্তনাদ শুনিয়েছে। পলাশের প্রতিটা মৃত্যু চিৎকার শুনে বহু ক্রোশ দূরে বসে ছটফট করেছে শওকত মীর্জা। তখন থেকেই ভয়ের মাত্রা বেড়ে গেছে কয়েক ধাপ! চোখের সামনে ভেসে আসছে এক নৃশংস অতীত। এরকম নৃশংসতাতো তারাও করেছিল কারো সাথে। সেই রাতে! শক্তপোক্ত এক লোকের বাঁচার সেই আকুতি আবারও যেন বেজে উঠল ওর কানে। কী বিভৎস সে শব্দ! মাথা ধরে এলো শানের। গলা শুকিয়ে এলো।
এক নিঃস্বাসে গ্লাসে পড়ে থাকা অবশিষ্ট মদটুকু গিলে নিলো শান। তখনই গম্ভীর কন্ঠে কেউ বলে উঠল, ‘জীবন ভীষণ সুখের, তাইনা?

অতি পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে থমকে গেল শান। নড়ার শক্তি
হারিয়ে ফেলল কয়েক সেকেন্ডের জন্যে। কিন্তু শক্ত নার্ভের
কারণে মুহুর্তেই সামলে নিল নিজেকে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। কন্ঠ চিনতে ভুল করেনি শান। অবাক কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো, ‘তুমি!’

আর কিছু বলার আগেই কাচের বোতলের তীব্র আঘাত
পড়ল শানের মাথায়। আকস্মিক আঘাতে হতভম্ব হয়ে
গেল শান। চোখে সর্ষে ফুল দেখল। চারপাশ অন্ধকার
হয়ে এলো।

উত্তরা থেকে সাভারে পৌঁছেই উত্তেজনা বেড় গেল
তুহিনের। গাড়ির জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকাল।
রাত অনেক হয়েছে। রাস্তায় গাড়ি কম। তুহিন রাস্তায় নজর
বুলিয়ে অন্যমনস্ক গলায় ড্রাইভারকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি
চালাও।’

তমাল ফ্রন্ট সিট থেকে পেছন ঘুরে বলল, ‘স্যার চিন্তা
করবেন না। পুলিশের গাড়ি পৌঁছে গেছে এতক্ষণে।’

‘কিন্তু আমি এখনো পৌঁছতে পারিনি।” রাস্তার দিকে ব্যস্ত
দৃষ্টি রেখে বলল তুহিন।

তমাল নিজেও একবার রাস্তাটা দেখে নিলো। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে ওর। সত্যিই কী আজ খু-নি ধরা পড়বে? পড়লে কীভাবে পড়বে? কে হবে খুনি? রুদ্র? নাকি অন্যকেউ? এতাোগুলো রহস্যময় খুনের কারণ জানা যাবে আজ।
ভেতরে ভেতরে রােমাঞ্চ বোধ করছে তমাল। উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করল, ‘স্যার? আপনার সত্যিই মনে হয় খুনি কে তা আমরা জানতে পারব আজ?

‘জানিনা। তবে আমি এইটুকু মােটামুটি নিশ্চিত যে খু-নি যেই হোক। আজ সেষসাভারের ফ্ল্যাটে যাবেই। শান মীর্জার কাছে। হয়তো এতক্ষণে চলেও গেছে।’

‘মাই গুডনেস! ওসির কলটাও আসছেনা এখনো। আশ্চর্য! আমরা ধরতে পারব তো ওকে?

‘পারা উচিত। না পারলে সেটা আমাদের চরম ব্যর্থতা হবে।
তবে আজ কিছুতো একটা হবে। এইটুকু নিশ্চিত। কিন্ত
আমি ভাবছি অন্য কথা।’
তমাল কৌতূহলী গলায় বলল, ‘কী কথা স্যার?’

‘শান মীর্জাকে আদোও জীবিত পাবোতো?’

তুহিনের কথা শুনে লােম দাঁড়িয়ে গেল তমালের। শিরশির করে উঠল মেরুদন্ড। মাঘের রাত, কনকনে শীত, তারসাথে এরকম রোমাঞ্চকর অনুভূতি। কী হতে চলেছে আজ? শান মীর্জাকে বাঁচাতে পারবে? খুনিকে ধরতে পারবে ওরা? তমালের এসব ভাবনার মাঝেই তুহিনের ফোন বেজে উঠল। ইষৎ চমকে উঠল তমাল। তুহিনও চমকেছে। ফোনটা হাতেই ছিলো; দ্রুত রিসিভ করে বলল, ‘হ্যালো?’

ওপাশ থেকে কেউ কিছু একটা বলল। যা শোনামাত্র ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল তুহিনের। ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘একটা পোকাও যেন বিল্ডিং থেকে বের হতে না পারে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।
কথাটা বলে কল কেটে দিল তুহিন। দাতে দাঁত চেপে
বলল, ‘ড্যাম ইট!

তমাল ঘাবড়ে গেল। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘ কী হয়েছে
স্যার?’

‘তাড়াতাড়ি চলো!’ অদ্ভুত ঠান্ডা কিন্তু কঠোর শোনালো তুহিনের গলা।

শানে মীর্জার ফ্ল্যাটের সেই বিল্ডিং এর নিচে এসে থামল
তুহিনের গাড়ি। তুহিন আর তমাল দ্রুত নামল গাড়ি থেকে। পুলিশের গাড়ি নিচেই দাঁড় করানো আছে। সঙ্গে একটা অ্যাম্বুলেন্স। দেখেই বােঝা যাচ্ছে এইমাত্র এসেছে। গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে ঢুকত যাচ্ছিল ওরা। সেই মুহূর্তে আবার
তুহিনের ফোনটা বেজে ওঠল। ইরা কল করছে তখন
থেকে। কিন্তু তুহিন রিসিভ করেনি। এখন মাথা ঠিক নেই তুহিনের। কথা বললে শুধু ঝগড়াই হবে। এইমুহুর্তে
ঝগড়া করার ইচ্ছা ওর নেই। ফ্রী হয়ে, ঠান্ডা মাথায় কথা
বলে ব্যপারটা ঠিক করতে হবে। তেমনটাই ভেবে রেখেছিল ও। কিন্তু ইরা বিরতিহীনভাবে কল করেই যাচ্ছে। তুহিন তমালকে ভেতরে ঢোকার ইশারা করে একটু সাইডে চলে এলো। ফোনটা রিসিভ করে বলল, ‘আমি ব্যস্ত আছি এখন। আই’ল কল ইউ ব্যাক।’

‘জাস্ট এক মি_’

‘ইরা বললামতো পরে কল করব আমি। প্লিজ!’

‘আমি..’

কিন্তু ইরার কথা শোনার সময় হলোনা তুহিনের। নিজের
কথাটুকু বলেই ফোনটা রেখে দিল। পেছনে ঘুরে দেখল
রাস্তা দিয়ে একটা বাইক চলে গেল। গতিটা বেশিই ছিল। তবে বাইকটা কালো রঙের। বাইকচালকও কালো জ্যাকেট পড়া ছিল। মাথায় কালো হেলমেট। দু সেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে রইল তুহিন। কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হলাে ওর। ভেতর ভেতর শিরশির করে উঠল যেন। চুম্বকের মতো আকর্ষণ করল সেই পথটা ওকে। কিন্তু সেদিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে প্রায় দৌড়ে চলে গেল ভেতরে। গেইটের কাছে দুজন হাবিলদারকে গার্ড দিতে দেখে সন্তষ্ট হলো। কেউ বের হতে পারেনি তাহলে।

শান মীর্জার র-ক্তা-ক্ত শরীরটা স্ট্রেচারে তুলে নিচ নিয়ে
গেছে পুলিশ। ছাদের চারপাশটা ভালোেভাবে লক্ষ্য করল
তুহিন। ইেঁটে ইেঁটে সবটা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে
বুঝল, ছাদ থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোন চান্স নেই।
খুনিকে সিড়ি দিয়েই নামতে হয়েছে এবং বিল্ডিং এর
গেইট দিয়েই বের হতে হয়েছে। তুহিন চারপাশে তাকাতে
তাকাতে ডাকল, ‘ওসি সাহেব!’

দ্রুত তুহিনের কাছে এগিয়ে এলো ওসি। বলল, ‘ইয়েস
স্যার?’

‘এখানে যখন পৌঁছলেন তখন শান এখানে একা
ছিলেন?’

‘জি, স্যার।’

শান মীর্জা জীবিত। তারমানে পুলিশ চলে আসায় খুনির
পক্ষে মা-র্ডা-র করা সম্ভব হয়নি। অর্থাং তখনও খুনি
বিল্ডিং এর ভেতরেই ছিল। তুহিন প্রশ্ন ছুড়ল, ‘গোটা বিল্ডিং
চেক করেছেন?’
‘চেকিং চলছে স্যার। এখনো অবধি পাওয়া যায়নি।’

এরমধ্যেই একজন হাবিলদার এসে হাজির হলো।
হাপাতে হাপাতে বলল, ‘ স্যার, পছনের গেইটের একজন
হাবিলদারকে অজ্ঞান অবস্থায় গাছের পেছনে পাওয়া গেছে।

আঁতকে উঠলেন ওসি। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বললন, ‘ কী
বলছাে? তুমি কী করছিলে?’

‘আমিতোে একটু..’ কনিষ্ঠা আঙল তুলে দেখাল লোকটা। বলল, ‘ফিরে এসে দেখি ও নেই। তারপর একটু খুঁজতেই
অজ্ঞান অবস্থায় পেছনে..’

কথাটা শেষ করতে পারল না হাবিলদার। তার আগেই ধমকে উঠল ওসি, ‘কাজের সময়ই তােমাদের ইয়ে
পায় ননসন্স! এখন এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয় আমার
চেহারা না দেখে ওটার জ্ঞান ফেরাও। পেছনের গেইটে
আরও দুজন পাঠাচ্ছি আমি।’

তুহিন গম্ভীর, শান্ত কণ্ঠে বলল,’তার আর দরকার নেই।
পালিয়ে গেছে ও।’

ওসি তাকিয়ে রইলেন তুহিনের দিকে। কিন্তু কিছু
বললেন না। তুহিনের মেজাজ ভয়ানক খারাপ হচ্ছে।
পরপর নজনকে খু-ন করেছে লোকটা। এরকম একজন
সিরিয়াল কি-লারকে আটকাতে এরকম দুর্বল পাহারাব্যবস্থা! মজা করছে এরা সবাই ওর সাথে? কিন্তু মুখে
কিছু বলল না। তমালকে বলল, ‘কালো বাইকে করে
কালাে জ্যাকেট পড়া একজনকে রাস্তা দিয়ে যেতে
দেখেছি আমি। আই থিংক পেছনের গেইট দিয়ে বেরিয়ে,
বাইক নিয়ে সামনের রোড দিয়ে চলে গেছে। বুঝতেই
পারিনি এই বিল্ডিং থেকে বেরিয়েছে। ‘

একটুর জন্যে! জাস্ট একটুর জন্যে খু-নি হাতছাড়া হয়ে
গেল ভেবে নিজেরই মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে হলাে
তুহিনের। তুহিনের কথা শুনে তমাল কিছু একটা ভাবল।
ভেবে চমকে গিয়ে বলল, ‘স্যার, আমি সিঁড়ি দিয়ে ওঠার
সময় কালো পোশাক পড়া একজনকে নামতে
দেখেছিলাম।’

চমকে উঠল তুহিন। তমালের দিকে ঘুরে বলল, ‘কাকে?’

‘আনফরছুনেটলি আমি চেহারাটা দেখতে পাইনি। তার
আগেই নেমে গেছে।’

‘থামাও নি কেন?’ ধমকে উঠল তুহিন।

‘আমি ভেবেছিলাম নিচের ফ্লোরের কেউ। আর বাইরে
গার্ডও দেখে এসছিলাম। ভেবেছিলাম বাইরে নিশ্চয়ই
যাচ্ছেনা। ছাদে আসাটা বেশি ইম্পর্টেন্ট মনে হয়েছিল।
তাই..’

তুহিন চোখ-মুখ খিচে দাঁড়িয়ে রইল। ভীষণ কষ্টে নিজেকে বিরত রাখল কড়া কয়েকটা কথা শুনিয়ে দেওয়া থেকে।
জাস্ট একুর জন্যে কেইসটা সলভ হতে গিয়েও হলোনা।
তখন যদি ইরার সঙ্গে কথা বলতে না যেতাে, তাহলে
হয়তাে এতো বড় ব্লান্ডারটা হতো না। ও নিজেই দেখতে
পেতাে খু-নিকে। তুহিন ওসিকে জিজ্ঞেস করল, ‘শওকত
মীর্জাকে খবর দেওয়া হয়েছে?’

ওসি জানালো, ‘ইয়েস স্যার। উনি বলে দিয়েছেন তার ছেলের চিকিৎসার যাতে কোন ক্রটি না হয়। উনি সব টাকা পাঠাবেন। আর শীঘ্রই বাংলাদেশ আসার চেষ্টা করবেন।’

ওখানকার সব কাজ সেরে নিয়ে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে
এলাে তুহিন। এতক্ষণ একটু একটু লুকিয়ে রাখা ক্লান্তি
যেন একঝাঁকে তীব্রবেগে হানা দিল শরীরে। গাড়ির
ব্যাকসিটে বসে গা ছেড় দিল একদম। ঠিক সেই মুহূর্তে
আবার বেজে উঠল ওর ফোনটা। যন্ত্রণায় মাথা যেন ধরে
এলাে এবার। রিংটোনটা যেনো গা জ্বালিয়ে দিল
একেবারে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে সাজা
হয়ে বসল তুহিন। ফোনটা বের করে দেখল স্ক্রিনে
ইরাবতী নামটা জ্বলজ্বল করছে।
কিন্তু আজ নিজের ইরাবতীর নামটা দেখে খুশি হতে পারল না তুহিন। বরং মেজাজ খারাপ হলো ওর। ফোনটা রিসিভ করে ইরা কিছু বলার আগেই ধমকে বলে উঠল, ‘বলেছিলাম না আমি কল ব্যাক করব? ব্যস্ত আছি? বলেছিলাম? এইটুকু অপেক্ষা সহ্য হয়না তোমার ? কী চাইছোটা কী তুমি? আমার জব, প্রফেশন ফেলে আমি ঘরে বসে থাকি? এরপর তােমাকে ঘরে ডেকে এনে হা করে বসে বসে তােমার ফাল্তু বকবকানি শুনি, হ্যাঁ?’

ওপাশ থেকে ইরা বলল, ‘এভাবে কথা বলছো কেন?’

‘ভুল কিছু বলিনি। আমি জানি আমি তোমাকে সময়
দিতে পারিনা। তাই বলে তুমি যখন-তখন ফোন করবে?তুমিতো আমার প্রফেশন সম্পর্কে জেনেই আমার
সঙ্গে রিলেশনে জড়িয়েছিলে রাইট? তাহলে এখন এতো
অভিযােগ কেন? কীসের? সময় আসময়ে কল করে
খেয়েছি কি-না, ঘুমিয়েছি কি-না, বেঁচে আছি কিনা। বাচ্চা
আমি? তোমার কোন ধারণা আছে এসবে কতােটা
ডিস্টার্ব হয় আমার? বিরক্ত লাগছে এখন আমার। জাস্ট
বিরক্ত। একটু শান্তি দাও এবার। প্লিজ?’

কয়েক সেকেন্ড কোন কথা বলল না ইরা। যখন বলল তখন কেমন কেঁপে উঠল ওর গলা। কাঁপাকাপা গলায় শুধু বলল, ‘সরি। তামাকে ডিসটার্ব করার জন্যে। শান্তি উপডােগ করাে।’

বলেই ইরা কল কেটে দিল। তুহিন একপ্রকার ছুড়েই
ফোনটা ফেলে রাখল একপাশে। এরপর আবার গা
এলিয়ে দিলাে গাড়ির সিটে। কী বলল, কেন বলল,
কাকে বলল জানেনা ও। জানতে চায়ও না। সবকিছুই
বিরক্ত লাগছে। একমিনিটের মধ্যে তমালও চলে এলো।
তুহিনকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে বলল, স্যার? ঠিক আছেন?’

তুহিন চোখ খুলল না। ক্লান্ত গলায় বলল, ‘গাড়ি চালাতে
বলাে।’

সকাল সাড়ে দশটার দিকে অফিসে পৌঁছলো তুহিন। রাত
থেকেই মন-মেজাজ ভালো নেই ওর। সাথে ভালো নেই আবহাওয়াটাও। অর্ধেক দিন পাড় হতে চলল। কুয়াশা
কাটার নামগন্ধ নেই। যেন সেটে বসেছে আজ। বাসা বের হতে একদমই ইচ্ছে করছিল না আজ ওর। কিন্তু কাজতো করতেই হবে। তাই ইচ্ছে না থাকলেও জোর করে শরীরটাকে টেনে নিয়ে গেছে অফিসে। অফিসে পৌঁছতেই তমাল ওকে সেই জাল আইডেন্টিটি কার্ডস তৈরী কারী তিনজনের কাছে নিয়ে গেল। ধরে নিয়ে আসা হয়েছে ওদের। তিনজনকেই ভালভাবে লক্ষ্য করল তুহিন। তারপর বলল, ‘কতদিন ধরে চলছে এই ধান্দা?

একজন বলল ছয় মাস, বাকি দুজন বলল দেড় বছর।
ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল। এতোদিন ধরে
জালিয়াতি করে চলেছে অথচ কেউ ধরতেই পারেনি! এদের
সাহায্যে জাল পরিচয়পত্র বানিয়ে না জানি কোথায়, আরও কতরকম ক্রাইম করেছে; করে চলেছে কতলোক।
নীতি নৈতিকতার কথা ছেড়ে কাজের কথা পাড়ল তুহিন। ফেনীর সেই হোটেলে পাওয়া জ্বাল ইনফরমেশনের ডিটেইলস বের করে তিনজনকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা তোমাদের মধ্যে কে বানিয়েছে? একদম মিথ্যা বলবেনা। সত্যি বের করার অনেক সুন্দর সুন্দর উপায় জানা আছে আমাদের। আমরা চাইনা সেটা ব্যবহার করতে।’

ডান পাশে বসে থাকা লোকটা শুকনো ঢোক গিলল। কোনরকম তুতলে বলল, ‘ আ-আমি বানিয়েছি।’

তুহিন পকেট থেকে রুদ্রর ছবি বের করে ধরল লোকটার
সামনে। প্রশ্ন করল, ‘এই লোকটাই বানাতে বলেছিলো
তাইনা?’

ছবিটা দেখে সঙ্গে সঙ্গে চিনে ফেলল লোকটা। মাথা ঝাকিয়ে বলল, ‘জ্বি স্যার। রুদ্র ভাই।’

তুহিন তমালের দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই তমাল
দুজনকে বলল ওদের নিয়ে যেতে। ওরা চলে যেতেই
তুহিন রুদ্র ছবিটা তুলে ধরল নিজের চোখের সামনে।
ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল, ‘শুনেছিলাম যতাে বড়
ক্রিমিনালেই হাোক না কেন একদিন না একদিন তাকে
পেছলাতেই হয়। তোমার ক্ষেত্রেও সেটাই হলো রুদ্র আমের।
প্রমাণ, সাক্ষী সব আমার হাতেই আছে। আর কিছুক্ষণের
অপেক্ষা। এরপর তােমাকে অ্যারেস্ট করার অফিশিয়াল
ওয়ারেন্ট আমার হাতে থাকবে।’

এরপর তমালকে বলল, ‘ শান মীর্জার কী খবর?’

‘আউট অফ ডেঞ্জার, স্যার। তবে জ্ঞান ফেরেনি এখনো।’

‘মিসেস শায়লাকে খুঁজে পেয়েছো?’

‘চাদপুর আছে স্যার। খোঁজ নেওয়া হয়েছে। লোক
গেছে। কালকের মধ্যে ধরে নিয়ে আসবে।’

‘আমের ভিলা, নীরব, মীরার কারো কোন খবর?’

তমাল চুপ হয়ে গেল। তুহিন ক্র কুঁচকে তাকতেই বলল,
‘আমের ভিলার কারো খোঁজ নেই স্যার। না নীরবের।
জাফর আামেরের বউ বাচ্চা সিঙ্গাপুর থাকতাে। ওখানে
খোঁজ করছি স্যার। রিপোর্ট চলে আসবে। কিন্তু…’

তমাল আরও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘মীরা বেঁচে নেই
স্যার। বছরখানেক আগেই মারা গেছে। সু-ই-সাইড করেছিল নাকি। ডিটেইলস চলে আসবে শীঘ্রই।’

তুহিন থম মেরে তাকিয়ে রইল তমালের দিকে। অর্থাৎ
আমের ভিলার সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন সবার সঙ্গেই খারাপ
কিছু না কিছু হয়েছে। কেউ রেহাই পায়নি। কেউ না!

সন্ধ্যার পর জ্ঞান ফিরল শানের। বেশ গুরুতর কয়েকটা
আঘাত পয়েছিল। কিন্তু কোন আঘাতেই ইন্টারনাল
কোন ক্ষতি হয়নি। তাই এখন মোটামুটি সুস্থ সে। তবে
দুদিন হসপিটালের বেডে শুয়ে বিশ্রাম নেওয়ারই পরামর্শ
দিয়েছেন ডক্টর। খবর পাওয়া মাত্রই হাসপাতালে পৌঁছলো
তুহিন। কাল এতো প্রশারে ক্যাচ করতে না পারলেও
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরেই বুঝতে পেরেছে ব্যপারটা।
শান যেহেতু বেঁচে আছে। নিশ্চয়ই ওর ওপর
হা-ম-লাকারীকে দেখেছে। আর শানের কাছ থেকেই
হয়তাে খু-নির খোঁজ পাবে। কিন্তু ওর মনে হচ্ছে শান
সত্যি বলবেনা। নিজেকে বাঁচানোর জন্যে হলেও না।
শানের কেবিনে গিয়ে বসল একটা টুল টেনে। শান বেডে
হেলান দিয়ে বসে আছে। চোখজোড়া বন্ধ। মাথায় আর হাতে ব্যান্ডেজ। শানের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তুহিন। চেহারা দেখে কেমন চেনা চেনা লাগল তুহিনের।
আগেও কোথাও একটা দেখেছে বলে মনে হলো। সেসব
ভাবনা ঝেড়ে ফেলল আপাতত। মুচকি হেসে বলল, ‘এখন কেমন আছেন শান?’

শান চোখ খুলল। গম্ভীর জবাব দিল, ‘ভালো।’

‘কিছু প্রশ্ন করব। আর ইউ কম্পফরটেবল টু টক?’

‘ইয়েস।’

‘গুড!’ একটু থামল তুহিন। ‘আপনার ওপর কে হামলা করেছিল? আর কেন?’

‘আমার মনে হয় সেটা খুঁজে বের করা আপনার কাজ।’

শানের কঠোর, ত্যাড়া জবাবে ক্রু কুঁচকে গেল তুহিনের।
তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলল, ‘আমি জানি আমার
কাজ কী। আর আমার কাজটাই আমি করছি মিস্টার
মীর্জা। প্লিজ কোঅপারেট।

‘বলুন।’ শানের কণ্ঠে বিরক্তি স্পষ্ট।

তুহিন শানের দিকে হালকা ঝুকল। মৃদু গলায় বলল, ‘রুদ্রই
আপনাকে খু-ন করতে এসেছিল। তাইনা?’

চমকে উঠল শান। কিন্তু নিজেকে সামলে নিতে সেকেন্ডের বেশি সময় নিলোনা। অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘কে রুদ্র?’

তুহিন হাসল। শানের ঐ সেকেন্ডর চমকে ওঠা ওর নজর
এরায় নি। আঙ্গুল দিয়ে নাক চুলকে বলল, ‘খুব
অপরিচিত নাম। জীবনেও শোনেন নি। তাইনা?’

‘না, শুনেছি। কিন্তু এই নামের কাউকে পার্সোনালি
চিনিনা।’

তুহিন হাসি চেপে বলল ‘আচ্ছা। মেনে নিচ্ছি। কিন্তু যে আপনার ওপর হামলা করেছে তার চেহারার একটা ডেসক্রিপশনতোে দিতেই পারেন। তাইনা?’

শান তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ না পারিনা। কারণ
ওর মুখ দেখিনি আমি। মাস্ক পড়া ছিল। পরনে একটা
কালাে জ্যাকেট ছিল। এইটুকু ছাড়া ওর সম্পর্কে আর
কিছুই জানানোর নেই আমার।’

‘আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?’

‘আপাততে না। মনে হলে জানাতাম। এখন একটু রেস্ট করতে
দিন আমাকে। আপনি আসতে পারেন।’

তুহিন ঠোঁটে মুচকি হাসিটা ধরে রেখেই বলল, ‘ যাবতো
নিশ্চিয়ই। তবে মিথ্যা বলে আপনার বিশেষ কোন লাভ
হচ্ছেনা মিস্টার মীর্জা। বরং নিজের বিপদ বাড়াচ্ছেন।
সত্যি অবধিতো আমি পৌঁছেই ছাড়ব। কিন্তু ততদিন
আপনি জীবিত থাকবেন কি-না সেটা ভাববার বিষয়। যদিও
এখন থেক কড়া পাহাড়ায় থাকবেন আপনি। তুবুও,
নিজের খয়াল রাখবেন।’

কথাটা বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল তুহিন। শানের
চুপ থাকার কারণটা বুঝে গেছে ও। এ কয়েকদিনের
রিসার্চে আনেক অজানা তথ্য ওর জানা হয়ে গেছে।
অনেক সত্যি সম্পর্কে ও অবগত হয়েছে। তাই অনেক
কিছুই পরিষ্কার তুহিনের কাছে।

কোনমতে ঐ দিনটা কেটে গেল। তুহিন কেইসের কাজটা
নিয়েই যথেষ্ট ব্যস্ত ছিল। ল্যাপটপ আর ফাইলে ডুবে থেকে একা একাই কীসব করছিল যা সম্পর্কে তমালের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিলোনা। তবে এইটুকু বুঝতে পারছিল যে তুহিন আলাদাভাবে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে।
অবসর সময়টা হঠাৎ হঠাৎ ইরার কথা মনে পড়েছে তুহিনের। ভীষণ ইচ্ছা হয়েছে একটা কল করতে। কিন্তু ইগো নামক বস্তুটা বারবার বাঁধা দিচ্ছিল মাঝপথে এসে। মনে মনে আশা করেছিল ইরা নিজেই হয়তাে একটা কল করবে। যেমনটা প্রতিবার করে। কিন্তু এবার ইরাও ওকে কোন ফোন
করেনি।

চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আাছে শায়লা। ওর সামনেই বসে আছে ইনভেস্টিগেটর তুহিন আহমেদ। শায়লাকে ঘামতে দেখে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল তুহিন। শায়লা কাঁপাকাঁপ হাতে গ্লাসটা নিল। তিন ঢোকে শেষ করে ফেলল পানিটা। তুহিন এবার ধীরেসুস্হে প্রশ্ন করল, ‘ আপনাকে বারবার বলেছিলাম ঢাকা ছাড়বেন না। আমাদের আাপনাকে দরকার হবে। কিন্তু আপনিতো হঠাৎই গায়েব হয়ে গেলেন। আচ্ছা
সেসব ছাড়ুন। আমাকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই।
আমি জানি আপনি কিছুই করেননি। আপনি এসবের
মধ্যেও নেই। কিন্তু একটা সত্যি আপনি আমাদের কাছ থেকে
লুকিয়েছেন। খু-নির পরিচয়। এইটুকু আমার জানা। কিন্তু
আমার প্রশ্ন হলো কারণটা কী? কেন আড়াল করতে
চাইছিলেন খুনিকে?’

শায়লা কেঁদে ফেলল। অস্ফুট স্বরে বলল, ‘আমার
বাচ্চা।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুহিন। বলল, ‘ গেইস করেছিলাম।
কিন্তু এটাই কী একমাত্র কারণ?’

কিছুক্ষণ চুপ থাকল শায়লা। অতঃপর অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ‘না। আরেকটা কারণ আছে।’

‘কী সেটা?’ কৌতূহলী হয়ে উঠছে তুহিন।

‘ঐ লোকটা আমাকে মুক্তি দিয়েছিল স্যার। ঐ
নরপিশাচটা নরক বানিয়ে রেখেছিল আমার
জীবনটাক। জোর করে তুলে এনে বিয়ে করেছিল। তাও
তিন নম্বর বউ করে। ওর শুধু আমাকে রাতেই প্রয়ােজন
পড়তাে স্যার। এতোগুলো বছর খুবলে খেয়েছে আমাকে। ওর অত্যাচারের কথা কী বলব স্যার! শেষ হয়ে
যাচ্ছিলাম আমি। বেঁচে ছিলাম শুধু বাচ্চাটার মুখের দিকে চেয়ে।’

বলতে বলতে হুঁ হুঁ করে কেঁদে ফেলল তুহিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘আপনার এই চুপ থাকার কারণে আরও দুটো মানুষের মৃ্ত্যু হয়েছে। আরেকজন ম-র-তে বসেছিল। আপনার বাচ্চার কিচ্ছু হবেনা সে গ্যারান্টি আমি আপনাকে দিচ্ছি। কিন্তু আপনাকে সত্যিটা বলতে হবে। আর না বললে আপনার বাচ্চার ক্ষতি কেউ আটকাতে পারবেনা। কারণ খু-নি এতক্ষণে জেনে গেছে আপনি আমাদের এখানে এসেছেন। আর আপনি কিছু না বললেও ওর মনে হবে আপনি বলে দিয়েছেন। সুতরাং আপনার এখন আমাদের সুরক্ষা প্রয়াজন।’

মাথা নাড়ল শায়লা। অর্থাৎ সে রাজি। তুহিন টেবিলে রাখা রুদ্রর ছবিটার দিকে ইশারা করে বলল, ‘এটাই সেই লোক?’

শায়লা মনোযোগ দিয়ে দেখল ছবিটাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে উঠল, হ্যাঁ স্যার। এই ছিল। কিন্তু চুল আর দাড়িগুলো হালকা একটু বড় আর অগোছালো ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল টানা কয়েকদিন শেভ করেনি।’

চোখদুটো চকচক করে উঠল তুহিনের। যেন মরুভূমির পথহারা পথিক জলের সন্ধ্যান পেয়েছে। প্রয়ােজনীয় তথ্যটুকু আদায় করে শায়লাকে বিদায় দিল তুহিন। রুদ্রর ছবিটা দেখে ঠোঁটে অর্থপূর্ণ হাসি ফুটল ওর। আনমনে বলল, ‘খেলা শষ, রুদ্র আমের।’

#চলবে…

[ পরবর্তী পর্বে প্রথম অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটবে। ]

#অন্তর্নিহিত_কালকূট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here