১.
“আই লাভ ইয়্যু পাশের বাড়ির চ্যাংরা পোলা।”
বান্ধবীদের ট্রুথ এন্ড ডেয়ার নামক ভ’য়ং’ক’র খেলার চক্করে পড়ে অবশেষে ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে এমন একটা পোস্টটা দিয়েই ফেললো আরোহী। কোন কুক্ষণে যে বান্ধবীদের সাথে ট্রুথ এন্ড ডেয়ার নামক খেলাটা খেলতে গিয়েছিল কে জানে! জীবনের চড়ম ভুলটা বোধহয় এটাই করলো সে। তাও খেলেছিল বেশ ভালো কিন্তু ডেয়ার নিতে কে বলেছিল? সত্যি বলার ভয়ে ট্রুথ নেয়নি। এখন ডেয়ার নিয়ে তো ফাঁ’স’লো আরও। ভাগ্যিস আইডিতে পরিবারের কোনো সদস্য বা আত্মীয় স্বজন কাউকে রাখেনি নয়তো আজ যাচ্ছে তাই একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হতো। যদিও তাদের বাড়ির আশেপাশের বাড়িতে তেমন কোনো ছেলে টেলে নেই। ডানপাশের বাড়িটায় দুটো মেয়ে একটা ছেলে। ছেলেটা ছোট, বয়স এই বছর দুই হবে হয়তো। আর বাম পাশের বাড়িটা তালাবদ্ধ। তবে এই বাম পাশে দুটো বাড়ি রেখে যে বাড়িটা রয়েছে তাতে এক ভয়ংকর পুরুষের বসবাস। সম্পর্কে সে পুরুষ আরোহীর মামাতো ভাই। তার বড় মামা তূর্য চৌধুরীর সুপুত্র তূর্ণ চৌধুরী। তূর্ণের থেকে আরোহী প্রায় বছর পাঁচেকের ছোট হলেও শৈশব থেকেই তাদের দা কুমড়ার সম্পর্ক। তূর্ণ বাকি সকলের সাথে সর্বদা বেশ মার্জিত ব্যবহার করে। কাজিন মহলের সকলের সাথে ভালো সম্পর্ক তার। শুধুমাত্র শত্রুতা আরোহীর সাথে। এই মেয়েটার সাথে যেন তার জন্ম জন্মান্তরের শত্রুতা। দেখা হলে এক চোট ঝগড়া না করে, দুটো ধমক না দিয়ে শান্তি পায় না। উঠতে বসতে সর্বদা তার পিছনে লেগেই থাকে ছেলেটা। আরোহীর মনস্তাত্ত্বিক ভাবনা মতে সে এক বদমাইশ, ভয়ংকর, বদ, অভদ্র এবং বাজে পুরুষ। যাকে দেখলেই ভয়ে ঠকঠক করে কেঁপে ওঠে তার হৃদয়। মেয়েটার ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ তাদের বাড়ির কলিং বেলটা বেজে উঠলো। আরোহী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো কক্ষের দেয়ালে ঝুলানো দেয়াল ঘড়ি টার পানে। রাত প্রায় বারোটা বেজেছে। বাবা মা এবং ছোট ভাইটা নিশ্চই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু এত রাতে আবার কে এলো? মেয়েটা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বিছানার পাশে ফেলে রাখা ওড়নাটা তুলে ভালোভাবে জড়ালো শরীরে অতঃপর কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে এলো সদর দরজার পানে। কিন্তু এত রাতে একা একজন মেয়ে মানুষ হয়ে কি তার দরজা খোলাটা ঠিক হবে? যদি কোনো চো’র ডা’কা’ত বা গু’ন্ডা ব’দ’মা’ই”শ হয় তখন কি হবে? আরোহী ভীত হলো। দরজায় লাগানো দূরবীন/লুকিং গ্লাস থেকে তাকালো বাইরে। অমনি চমকে উঠলো মেয়েটা। একি বাইরে তো তূর্ণ দাঁড়িয়ে আছে। এই লোক এত রাতে এখানে কেন? তূর্ণ হাত উঁচিয়ে আবারও কলিং বেল চাপলো। আরোহী আর সময় ব্যয় করলো না। কলিং বেলের আওয়াজ শ্রবণে যদি তার মায়ের ঘুম ভেঙে যায় আর সে এসে দেখে তূর্ণ এসেছে অথচ আরোহী দরজা না খুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে তখন আবার এক চোট বকুনি দিবে। তার মায়ের আদরের ভাইপো কিনা। মেয়েটা হাত উঁচিয়ে দরজাটা খুললো। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,
“তূর্ণ ভাই আপনি…”
পুরো কথাটা শেষ করতে পারলো না আরোহী। তার আগেই তূর্ণের পুরুষালী হাতের বেশ শক্তপোক্ত একটা থাপ্পর এসে পড়লো মেয়েটার নরম গালে। মাথাটা যেন ঘুরে উঠলো সাথে সাথে। গালে হাত চলে গেল অজান্তেই। হতবাক চোখে তাকালো তূর্ণের পানে। অত্যন্ত গম্ভীর ক্রোধিত মুখশ্রী তার। সর্পের ন্যায় কেমন ফোঁস ফোঁস ধ্বনি তুললে কণ্ঠে। চক্ষু দুটোতেও রক্তিম আভা বিরাজমান। ঢোক গিললো আরোহী। আমতা আমতা করে বলল,
“আপনি আমাকে থাপ্পর কেন মা’র’লে’ন তূর্ণ ভাই?”
প্রশ্নটা কণ্ঠে ধারণ করতে যতক্ষণ তারপরই আবারও একটা থাপ্পর এসে পড়লো মেয়েটার আরেক গালে। কি ভয়ংকর শক্ত হাতের থাপ্পর রে বাবা! তাও আবার একটা নয় দুটো। ব্যথায় গাল টনটন করে উঠলো তার। আরেকটা হাত অন্য গালে দিয়েই ফুঁপিয়ে উঠলো মেয়েটা। নাক টেনে শুধালো,
“আমি কি করেছি তূর্ণ ভাই? এভাবে হুট করে বিরোধী দলের ন্যায় আচরণ করছেন কেন? দরজা খুলতেই থাপ্রা থাপ্রি লাগিয়ে দিয়েছেন ঐ ইটের মতো শক্ত হাত দিয়ে।”
তূর্ণের ক্রোধ যেন বাড়লো আরও। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল,
“আই লাভ ইউ পাশের বাড়ির চ্যাংরা পোলা! কোন ছেলেকে তুই আই লাভ ইয়্যু বলেছিস বেয়াদব? এত বড় সাহস তোকে কে দিয়েছে?”
দুই গালে দুই হাত রেখেই চমকে উঠলো আরোহী। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল বিস্ময়ে। এ কথা এই লোক জানলো কিভাবে? তার ফেসবুকের ফ্রেন্ড লিস্টে তো এ নেই। প্রোফাইলও লক করা তাহলে এ কিভাবে জানলো? আরোহীর ভাবনার মধ্যেই আবারও মুখ খুললো তূর্ণ। হিসহিসিয়ে বলল,
“একটু খানি পুঁচকে মেয়ে। নাক টিপলে এখনও দুধ বের হয় এর মধ্যে নাগর জোটাতেও নেমে পড়েছে।”
আরোহী চোখ তুলে তাকালো তূর্ণের পানে। ঘোর প্রতিবাদ করে বলল,
“আমার নাক টিপলে কোনো কালেই দুধ বের হয়নি তূর্ণ ভাই বরং সর্দি বের হয়েছে। বিশ্বাস না হলে টিপে দেখুন। আপনার থাপ্পর খেয়ে কান্না করতে গিয়ে নাকে সর্দি জমেছে মাত্রই।”
আরোহী দুই গালে হাত রেখেই মাথাটা এগিয়ে দিল। তূর্য তাকালো মেয়েটার নাকের পানে। নাকের ডগাটা কেমন লাল হয়ে উঠেছে। মেয়েটা তার মায়ের মতো একটু বেশিই ফর্সা। একটু কান্নার বেগ আসলেই নাকটা লাল টমেটোর বর্ণ ধারণ করে। শীতল হলো তূর্ণের দৃষ্টি। তবে পরক্ষণেই আবার সর্দির কথা স্মরণে আসতে নাক মুখ কুঁচকালো। কটমট করে বলল,
“তুই কিন্তু বেশি বার বেড়েছিস আরোহী। আমার কথার উপরে আর একটা কথা বললে তোর নাকটাই কিন্তু আমি কেটে নেব।”
আরোহী ভীত হলো। দ্রুত নিজের নাকটা সরিয়ে নিল তূর্ণের সম্মুখ থেকে। এই পুরুষ যা ভয়ংকর তার নাকটা কেটে নিতেও পারে। তারপরে সে গন্ধ শুঁকবে কি দিয়ে? এই পৃথিবীর এত ভালো ভালো খাবার, সুন্দর সুন্দর ফুল শুধু চোখ দিয়ে দেখবে কিন্তু গন্ধ শুঁকতে পারবে না। কি মারাত্মক ব্যাপার স্যাপার। তার থেকে নিজের নাক নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাওয়া ভালো। আরোহী একটু দূরে সরে গেল। পুরোনো ক্রোধ আবার জেগে উঠলো তূর্ণের ভিতরে। রু’দ্র’মূ’র্তি ধারণ করে বলল,
“তুই যে ইদানীং এসব করে বেড়াচ্ছিস, পাশের বাড়ির ছেলেদের ফেসবুকে পোস্ট করে আই লাভ ইয়্যু বলে বেড়াচ্ছিস এসব তোর ঐ হিটলার বাপ জানে? নাকি এখনও জানাসনি?”
থামলো তূর্ণ। পরপর আবার বলল,
“দাঁড়া ডাকছি তোর হিটলার বাপকে। মেয়েকে আদরে আদরে এতটাই বাদর বানিয়েছে যে সে এখন পাশের বাড়ির ছেলেদের ধরে ধরে লাভ ইয়্যু বলে।”
আঁতকে উঠলো আরোহী। এতক্ষণ রুক্ষ কণ্ঠে কথা বলা, থাপ্পর মা’রা যাই একটু মানা যায় কিন্তু বাবাকে বলা! ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠলো আরোহীর ছোট্ট দেহটা। বাবা মায়ের কানে কোনোভাবে এ কথা গেলে কেটে কুঁচি কুঁচি করে ফেলবে নির্ঘাত। মেয়েটা দিশেহারা হলো। তাড়াহুড়ো করে বলল,
“মা বাবাকে কিছু বলবেন না তূর্ণ ভাই। বান্ধবীদের সাথে ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলতে গিয়ে ঐ পোস্টটা করেছিলাম ভাইয়া। নয়তো করতাম না।”
তূর্ণ তবুও দমলো না। ওষ্ঠদ্বার ফাঁকা করে উদ্যত হলো আরুশ শেখ এবং ইরাকে ডাকতে। আরোহী ভীত হলো আরও। কি করবে না করবে ভেবে পেল না। শেষে আর উপায় না পেয়ে হুট করেই সে বসে পড়লো তূর্ণের পায়ের কাছে। দুই হাতে তার পা জড়িয়ে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,
“আব্বু আম্মুকে ডাকবেন না তূর্ণ ভাই। আমি সত্যিই বান্ধবীদের ট্রুথ এন্ড ডেয়ারের পাল্লায় পড়ে ঐ পোস্ট করেছিলাম। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন আমাদের বাড়ির আশেপাশে কোনো চ্যাংরা পোলা নেই। দুই বাড়ি পরে আপনাদের বাড়ি। কিন্তু সে বাড়ির সব পুরুষরা তো ভীষণ ভদ্র, সভ্য, সুশীল এবং মার্জিত যেমন আপনি।”
তূর্ণ চোখ ছোট ছোট করে তাকালো আরোহীর পানে। এই মেয়ের কণ্ঠে নিজের এত প্রশংসা তো জন্মে যুগে শোনেনি। আজ একদম প্রশংসার ফোয়ারা বইছে। এসব যে নিজেকে বাঁচানোর জন্য তা বেশ ভালোই জানে তূর্ণ। ছেলেটা হাত বাড়িয়ে আরোহীর বাহু ধরলো। টেনে দাঁড় করিয়ে বলল,
“কোনো চ্যাংরা পোলা থাকুক বা না থাকুক। আর বান্ধবীদের ট্রুথ এন্ড ডেয়ারের পাল্লায় পড়ে হোক বা এমনি তুই আই লাভ ইয়্যু লিখেছিস তো। এর শাস্তি তোকে পেতেই হবে।”
আরোহী ডাগর ডাগর নয়নে তাকালো তূর্ণের পানে। কাঁচুমাচু করে প্রশ্ন করলো,
“কি শাস্তি?”
“বাইরে আয় তারপর বলছি।”
আরোহী দ্বিরুক্তি করলো। তূর্ণের প্রস্তাবকে নাকোচ করে বলল,
“আমি কোথাও যেতে পারবো না। যা শাস্তি দেওয়ার এখানেই দিন।”
“তাহলে আমি তোর বাবা মাকেই ডাকছি। কোন ছেলেকে ফেসবুকে প্রেম নিবেদন করেছিস সে উত্তর না হয় তাদের সম্মুখে দিস।”
আরোহী আতঙ্কিত হলো। তাড়াহুড়ো করে পা বাড়ালো বাইরের দিকে। মেকি হেসে বলল,
“কে বলেছে আমি যেতে পারবো না। এই যে যাচ্ছি, এখনই যাচ্ছি।”
তূর্ণ ওষ্ঠ বাঁকিয়ে হাসলো অতঃপর নিজেও বেরিয়ে এলো আরোহীর পিছু পিছু। মেয়েটা সম্পূর্ণভাবে বাইরে বেরুতেই তূর্ণ আদেশ দিয়ে বলল,
“কান ধর।”
আরোহী চমকালো। এখন কিনা তাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কান ধরতে হবে? হতে পারে এটা রাত আশেপাশে কেউ নেই কিংবা কেউ তাকে কান ধরে থাকতে দেখবে না। তবুও আত্মসম্মানের একটা ব্যাপার আছে। মেয়েটা এবার ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে, কিছুদিন পর এইচএসসি দিবে। যথেষ্ট বড় মেয়ে সে। সে কিছুতেই এই পুরুষের সম্মুখে কান ধরবে না। আরোহী তূর্ণের এ শাস্তি নিতে অস্বীকার করলো। নিচু কণ্ঠে বলল,
“অন্য শাস্তি দিন তূর্ণ ভাই। আমি কান ধরতে পারবো না।”
তূর্ণ চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে কিছু খুঁজলো। অতঃপর রাস্তার পাশ থেকে একটা মোটা লাঠি তুলে এনে বলল,
“কান ধরবি নাকি এই লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তোর পাশের বাড়ির চ্যাংরা পোলা বের করবো? আর তোর বাবা মাকে তো অবশ্যই পুরো ঘটনা বলে যাব।”
লাঠির পানে তাকিয়েই ঢোক গিললো আরোহী। এই লাঠির একটা বারি খেলে হাসপাতালের বিছানা ধরা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলে যে সে জীবনের কত বড় ভুল করেছে তা সে বেশ ভালোই বুঝতে পারছে। মেয়েটা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো,
“এই জীবনে আর যাই হোক না কেন সে আর কোনোদিন ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলবে না। এই খেলার মতো ভয়ংকর এবং আতঙ্কের খেলা বোধহয় পৃথিবীতে আর দুটো নেই।”
আরোহীর ভাবনার মধ্যেই তাকে ধমকে উঠলো তূর্ণ। হাতের লাঠিটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,
“কান ধরবি নাকি এটা দিয়ে লাগিয়ে দেব দুই ঘা।”
কেঁপে উঠলো বেচারী। দ্রুত কানে হাত দিল। তুতলিয়ে জবাব দিল,
-“এএএই তো ধরেছি কান।”
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
#প্রেমপরশ ( রোমান্টিক কমেডি )
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_১ ( সূচনা পর্ব )
( আপনারা তূর্যের ছেলে এবং আরুশের মেয়েকে নিয়ে গল্প চেয়েছিলেন। আজ একটু ফ্রী ছিলাম তাই মাথায় যা এসেছিল লিখে ফেলেছি। আমি এর আগে কাজিন রিলেটেড গল্প তেমন লিখিনি। কেমন হয়েছে তাও জানি না। সবাই সাড়া দিবেন। আপনাদের সাড়া পেলে গল্পটা নিজের ফ্রী সময়ে লিখবো। আর তেমন সন্তোষজনক সাড়া না পেলে এই পর্বটাও ডিলেট করে অন্য গল্পে মনোনিবেশ করবো যা আপনাদের ভালো লাগবে। আর হ্যা এই গল্পের কোনো অংশ যদি অন্য কারো গল্পের সাথে মিলে যায় বা কপি মনে হয় তাহলে আমাকে জানাবেন। আমি যথাযথ ব্যবস্থা নেব। )
Edit : তূর্য আর আরুশের গল্পের নাম ছিল #অবাধ্য_পিছুটান। লিংক :
https://www.facebook.com/share/p/jhhac6BL3DEXQfkT/?mibextid=oFDknk