অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৮৬.

0
8

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৮৬.

বিষাদে পরিপূর্ণ আমের ভিলার মানুষগুলো আজ অনেকদিন পর সামান্য খুশি ছিল। পরিবারের সবচেয়ে আদরের মেয়েটা! যাকে ছোট থেকেই চিনির পুতুলের মতো করেই বড় করা হয়েছে। আজ তার বিয়ে হল। অসহনীয় উত্তপ্ত পরিবেশে হালকা বাতাসও অমৃতের মতো লাগে। ঠিক তেমনই সব দুঃখ ভুলে আমের ভিলার সকলেই আজ হাসছে। জীবনের এতো অনিশ্চয়তার মাঝেও বর্তমানের এই খুশিটুকুকে আকড়ে ধরে তৃপ্ত হচ্ছে ওদের মন।

নীরবকে যখন কবুল বলতে বলা হয়, ও শেষবারের মতো একবার তাকায় সদর দরজার দিকে। জীবনের সবচেয়ে বিশেষ দিনটাতে বাবা-মাকে পাশে না পাওয়ার আক্ষেপে মনটা ভার হয়ে ওঠে। যখন বোঝে তারা সত্যিই আসবেনা, হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে নীরব। তারপরেই কুহুর দিকে তাকায়। নিষ্পাপ, সুন্দর ঐ মেয়েটাকে ভালো রাখাই এখন ওর প্রধান লক্ষ্য। অতীতে যাই ঘটে থাক, ভবিষ্যতে মেয়েটার গায়ে কোনরকম আচর লাগতে দেবেনা ও। কোনকিছুর বিনিময়েই না। কুহুর চোখে চোখ পড়তেই মিষ্টি করে হাসল নীরব। চোখ নামিয়ে কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই হালকা স্বরে উচ্চারণ করল, ‘কবুল।’

রাত তখন সাড়ে এগারোটা বাজে। হলরুমের সোফায় গা ছেড়ে বসে আছে রুদ্র আমের। চোখজোড়া বন্ধ। কপালের ওপর ডান হাতটা দিয়ে রাখা। নীরব আর কুহুকে কিছুক্ষণ আগেই ঘরে পাঠানো হয়েছে। আমের ভিলার একমাত্র মেয়ে। রুদ্র আর রাশেদের চোখের মণির বিয়ে হয়ে গেল! কখনও ভাবেনি এইদিনটা এভাবে যাবে। এতোটা সাদামাটা, প্রাণহীন। রাশেদ আমেরের অনেক স্বপ্ন ছিল কুহুর বিয়ে নিয়ে। সে মুখে প্রকাশ না করলেও রুদ্র বুঝতে পারতো। যেদিন কুহুর বাগদান হলো; সেই দৃঢ়, গম্ভীর মুখটাতে কতোটা প্রসন্নতার ছোঁয়া ছিল দেখেছে রুদ্র। মেয়েকে অসম্ভব ভালোবাসতেন কি-না। কুহুর জন্মের পরেইতো এই পাপের জগত ছাড়তে চেয়েছিলেন রাশেদ। আর কুহুর সঙ্গে ঘটা সেই দুর্ঘটনার পরেইতো নিস্তেজ হয়ে গেলেন তেজস্বী সেই ব্যক্তি। চিরতরে বিদায় নিলেন এই পৃথিবী থেকে।
নিজের বিয়ের কথা মনে পড়ল রুদ্রর। কী জাকজমক, হৈচৈ, আনন্দ। সকলের মনে কত প্রশান্তি, কত আনন্দ ছিল। আজ যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকতো, রাশেদ আমের বেঁচে থাকতো, তাহলে নিশ্চয়ই দিনটা অন্যরকম হতো। একমাত্র ছোটবোনের মুখের হাসিটা এতোটা মলিন হতোনা। নীরবকেও পরিবার, বাবা-মাকে ছাড়া, বিষণ্ন মনে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনটা কাটাতে হতোনা। খুশির দিনটাও এতোটা বিষাদপূর্ণ হতোনা। কথাগুলো ভেবে দীর্ঘশ্বাস চাপল রুদ্র।

বাইরে থেকে এসে সোজা রুদ্রর পাশে বসল উচ্ছ্বাস। নাজিফা এবং ওর মাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়েছিল ও। গায়ের ভারী জ্যাকেটটা খুলে রাখতে রাখতে বলল, ‘ঘরে যাবিনা?’

‘যাবো। ওদের ঠিকভাবে পৌঁছে দিয়ে এসছিস?’

‘হ্যাঁ।’

রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ থাকল। চোখজোড়া এখনো বন্ধ। হঠাৎ বলে উঠল, ‘তো কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?’

‘কী ব্যপারে?’

‘বুঝেও না বোঝার ভান করলে আমি প্রশ্ন করা থামিয়ে দেব না।’

উচ্ছ্বাস কপাল কুঁচকে তাকাল রুদ্রর দিকে। কৃত্রিম বিরক্তি ঝেড়ে বলল, ‘কী সমস্যা কী তোর বলতো? সবেতো বোনের বিয়ে খেলি। এখনই আমার বিয়ে দিতে চাইছিস কোন সুখে? পেট ভরেনি নাকি? না ভরলে বল বাইরে থেকে এক্ষুনি এক প্লেট কাচ্চি খাইয়ে আনছি। তুই চাইলে তিন-চার প্লেটও খাওয়াতে পারি। আরও কিছু লাগবে তাও বল? বিয়ে করে নিজে ফ্যাঁসাদে পড়েছিস। মাঝরাতে বউ পালিয়ে যায়, তাকে আবার ধরে নিয়ে আসতে হয়। বাপের বাড়ি নেইতো কী হয়েছে? নিজেই ঘর ভাড়া করে ফট করে চলে যায়। বিয়ে করা বউ। অথচ কাছে ঘেঁষতে গেলেও মনে হয় গরম তেলে হাত দিচ্ছিস। ভাবা যায়! নিজের লেজ কেটেছে বলেকী আমার লেজটাও কাটতে চাও গুরু?’

রুদ্র চোখ খুলল। ঘাড় ফিরিয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বড় হবিনা এই জন্মে?’

উচ্ছ্বাস দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল, ‘ন্যাহ্!’

রুদ্র হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে আবার চোখ বন্ধ করল। এই ছেলে ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ হয়ে গেলেও সারাদিন হেসে বেড়াবে। সবাইকে হাসাবে। কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পাবেনা ওর ভেতরটা ঝলসে যাচ্ছে। অদ্ভুত ছেলে!
রুদ্র চোখ বন্ধ করার পরেই উচ্ছ্বাসের হাসি মিলিয়ে গেল। তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজেও গা এলিয়ে দিল সোফায়। নাজিফার চোখের ভাষা পড়তে পারে উচ্ছ্বাস। মেয়েটা ইদানিং ওকে কিছু বলতে চায়। আর কী বলতে চায় সেটাও বুঝতে পারে ও। তাইতো এড়িয়ে যায়। যখনই নাজিফা ওকে কিছু বলতে আসে ও কথা কাটিয়ে যায়। যেমন আজ গেছে। ওর ভয় হয় শুনতে। ও যা অনুমান করছে সেটাই যদি বলে নাজিফা? তাহলে কী করবে? মুখের ওপর নাজিফাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাহস নেই উচ্ছ্বাসের। সেদিন আবেগের বশে রাজি হওয়ার কথা বলেছিল ঠিকই। কিন্তু সত্যিই কী নাজিফাকে গ্রহন করার ক্ষমতা আছে ওর? যে পাপের জগতের জালে ও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে, সেখান থেকে মুক্ত হয়ে স্বস্তির শ্বাস নেওয়া সম্ভব? স্বাধীনভাবে বাঁচার চিন্তা করা ওর জন্যে কতটা ঠিক? এরকম হাজারটা প্রশ্ন আর দোটানার জট পাকিয়ে আছে উচ্ছ্বাসের মাথায়। নাজিফা আর ওর সন্তানকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করার লোভ হয়। সুন্দর স্বাভাবিক জীবন কাটাতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু বাস্তবতা মনে পড়তেই বারবার হোঁচট খায় উচ্ছ্বাস। সকলের সামনে হাসিখুশি থাকলেও, ভেতরে ভেতরে অসম্ভব দোটানা আর মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে ছেলেটা।

‘জীবনকে সাহস করে সুযোগ দিতে হবেতো, বাবা। নয়তো চলবে কীকরে?’

কথাটা শুনে উচ্ছ্বাস আর রুদ্র দুজনেই চোখ খুলল। চোখ খুলে দেখল জাফর এসে বসেছে পাশের সিঙ্গেল সোফায়। জাফরকে দেখে ওরা সোজা হয়ে বসল। জাফর বলল, ‘রুদ্রতো টানা দুটো বছর ভালোভাবেই সংসার করেছে তাইনা? নেহাতই পরিস্থিতি এখন এতোটা খারাপ হয়ে গেছে তাই। নইলেতো কোন সমস্যা হতোনা। তাই ভবিষ্যতে কী হবে না হবে এসব ভাবা বাদ দিয়ে জীবনটা নিজের মতো শুরু কর।’

উচ্ছ্বাস হেসে দিয়ে বলে, ‘এইজন্যই বুঝি কাকি আর বোনকে ছেড়ে এখানে এখনো পড়ে আছো কাকা? এমন ভয়ানক খারাপ অবস্থাতেও নিজের সুখের কথা না ভেবে আমাদের কথা ভাবছো?’

জাফর প্রশ্নের উত্তর দিলোনা। হতাশ এক নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘একটা খারাপ খবর আছে।’

‘এই মুহূর্তে খারাপ খবর আসাটা অস্বাভাবিক কিছু না। বরং না আসাইটাই অস্বাভাবিক। বলে ফেলো।’ গম্ভীর কন্ঠে বলল রুদ্র।

‘দশ কোটি টাকা দেওয়ার কথা ছিল সিদ্দিকের। কিন্তু হঠাৎই তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। কর্পূরের মতো উবে গেছে যেনো।’

উচ্ছ্বাস অবাক হয়ে বলল, ‘টাকা দেওয়ার ভয়ে পালালো না-কি?’

মাথা নাড়ালো রুদ্র। ‘না, পালিয়ে লাভ নেই সেটা সে জানে। গায়েব করা হয়েছে।’

‘কে করল?’ অনেকটা অন্যমনস্ক হয়ে প্রশ্ন করল জাফর।

রুদ্র উত্তর দিলোনা। ও নিজেও গভীর ভাবনায় মগ্ন। উচ্ছ্বাস বলল, ‘তাহলে এখন?’

রুদ্র নির্বিকারভাবে বলল, ‘যা গেছে, গেছে। এখন নতুন পার্টি ধরতে হবে।’

আলোচনা সেখানেই সমাপ্ত হল। জাফর রাতের খাবার আগেই খেয়ে নিয়েছে। তাই চুপচাপ চলে গেল নিজের ঘরে। রুদ্র আর উচ্ছ্বাস আবার গা এলিয়ে দিলো সোফায়।

তখনই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো প্রিয়তা। এতক্ষণ রান্নাঘরে জ্যোতি আর নার্গিসের সঙ্গে সব গোছগাছের কাজ করছিল। দুই ভাইকে এভাবে সোফায় গা এলিয়ে বসে থাকতে দেখে তপ্ত শ্বাস ফেলল প্রিয়তা। কোমরে বাঁধা ওড়নাটা খুলে বুকের ওপর দিতে দিতে বলল, ‘তোমরা এখানে এভাবে বসে আছো কেন? রাতে খাবেনা?’

রুদ্র চোখ খুলল। প্রিয়তার দিকে একপলক তাকিয়ে বলল, ‘ক্ষিদে নেই আমার।’

বলে উঠে পড়ল রুদ্র। পা বাড়াল নিজের ঘরের দিকে। প্রিয়তা সেদিকে আর তাকাল না। উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি?’

‘আমারও ক্ষিদে নেই।’

প্রিয়তা ভ্রুকুটি করে বলল, ‘দুপুরে দুজনের একজনও ঠিক করে খাওনি। আর এখন বলছো ক্ষিদে নেই? খাবার নিয়ে আসছি চুপচাপ খেয়ে ওঠো। আর ওনারটা আমি ঘরে নিয়ে যাচ্ছি। চিন্তা করোনা।’

ঠোঁট উল্টে কাঁধ ঝাঁকালো উচ্ছ্বাস। প্রিয়তা খাবার নিয়ে এসে রাখল টি-টেবিলে। উচ্ছ্বাস আসাম করে বসল সোফায়। প্লেটটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘আমি খেয়ে রেখে দেব প্লেট। তুমি ঘরে যাও। তোমার একটা মাত্র বর, একা আছে।’

‘তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার।’ উচ্ছ্বাসের পাশে বসে বলল প্রিয়তা।

‘হ্যাঁ বলো?’

‘বিয়ে কবে করছো?’

প্রিয়তার আচমকা প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল উচ্ছ্বাস। খাবার মুখে তুলতে গিয়েও থেমে গেল। কিন্তু সঙ্গেসঙ্গেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল। হেসে দিয়ে বলল, ‘পাত্রী ঠিক করে দাও। কালকেই করে ফেলছি।’

প্রিয়তাও মৃদু হেসে বলল, ‘পাত্রিতো ঠিক করাই আছে। ঠিক করতে হবে কেন?’

‘কে সে?’

‘নাজিফা।’

উচ্ছ্বাস ক্ষণিকের জন্যে থমকালেও পরমুহুর্তেই কৌতুক করার চেষ্টা করে বলল, ‘কীসব বলো তুমি..’

কিন্তু উচ্ছ্বাসের কথা শেষ হওয়ার প্রিয়তা শীতল কন্ঠে বলল, ‘ভাই!’ অর্থাৎ, এখন কোনরকম মজা করবে না।

উচ্ছ্বাস গম্ভীর হলো। দু-তিন সেকেন্ডের মতো চুপ থেকে স্বাভাবিক স্বরে বলল, ‘বউমণি আমি..’

এবারেও বাঁধা দিল প্রিয়তা। ‘দেখো, তোমার মনে কী চলছে আমি জানি। এখনই তোমাকে বিয়ে করতে হবে সেটা বলছিনা। সবচেয়ে বড় সমস্যাতো তোমাদের এই অবৈধ কাজকারবার আর সে সম্পর্কিত জটিলতা। তাইনা? কিন্তু রুদ্রতো বলেছে খুব শীঘ্রই ছেড়ে দেবে এসব। আর রুদ্র এসব ছেড়ে দিলে নিশ্চয়ই তুমি এসবের মধ্যে থাকবেনা? তাহলে সমস্যা কোথায় ভাই?’

উচ্ছ্বাস তখনই কিছু বলল না। চুপ থাকল। প্রিয়তাও সময় দিল উচ্ছ্বাসকে। প্রায় দু’মিনিট চুপ থাকার পর উচ্ছ্বাস বলল, ‘নতুন করে স্বপ্ন দেখতে ভয় লাগে বউমণি। ওকে আবার স্বপ্ন দেখাতেও ভয় লাগে। যদি আবার একই ঘটনা ঘটে? সব স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়? বারবার একই ধাক্কা নেওয়ার মতো মানসিক শক্তি আমার থাকলেও নাজিফার নেই। ইতিমধ্যে অনেক কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। নিজের ভালোবাসার মানুষটা মাঝপথে ওর হাত ছেড়ে দিল। গর্ভাবস্থায় অকালে বিধবা হল। নিজের বাবাকে হারালো। আমার জন্যে যদি ও আবার কষ্ট পায়, নিজেকে ক্ষমা করব কীকরে বলোতো? তারচেয়েও বড় কথা, মেয়েটাকে পাগল হয়ে যাবে।’

প্রিয়তা লম্বা শ্বাস ফেলল। উচ্ছ্বাসের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘স্বপ্ন ভাঙার ভয়ে যদি সবাই স্বপ্ন দেখাই ছেড়ে দেয়, পৃথিবীটাতো অন্ধকারে তলিয়ে যাবে ভাই। আর সবসময় নেগেটিভ কেন ভাবো? এমনোতো হতে পারে, তোমরা একে অপরের ভাগ্যে আছো। সেকারণেই নিয়তি আরও একবার তোমাদের এক হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। দ্বিতীয় সুযোগ সবসময় সবার ভাগ্যে আসেনা ভাই। আর আসলে সেটাকে হেলায় হারাতে নেই।’

প্রিয়তার দিকে একপলক তাকাল উচ্ছ্বাস। মুহূর্তেই করুণ হয়ে উঠল ওর দৃষ্টি। দুচোখে স্পষ্ট দোটানা। প্রিয়তা নরম কন্ঠে বলল, ‘ভালোবাসার জন্যে সব করা যায় ভাই। কথায় আছে, প্রেম আর যুদ্ধে সব জায়েজ। নিজের ভালোবাসার স্বার্থে, ভালোবাসাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মানুষ কতকিছু করে। পাপ, পূণ্য, ভালো, মন্দ। ভালো কিংবা খারাপের সব সীমা পাড় করে ফেলে। সেখানেতো তোমরা দুজন দুজনকে এতো করে চাও। তাই এসব সাময়িক দ্বিধা-দ্বন্দের জ্বালে আটকে নিজেদের কষ্ট দিওনা।’

‘তাহলে তুমি কেন রুদ্রকে কষ্ট দিচ্ছো?’

‘ভবিষ্যতের জন্যে।’

‘মানে?’

‘আমি এরকম না করলে উনি কখনই স্বাভাবিক জীবনে ফেরার কথা ভাবতেন না ভাই। আমি ওনার থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলাম বলেই এখন এই জগত ছাড়ার এতো তাড়া ওনার।’

‘কিন্তু আমি যতদূর ওকে চিনি, ওর উদ্দেশ্য পূরণ হওয়ার আগে কোনভাবেই ও পিছু হঁটবেনা বউমণি।’

প্রিয়তা মলিন হেসে বলল, ‘সে আমি জানি ভাই।’

উচ্ছ্বাস অনুনয়ের স্বরে বলল, ‘আর যেওনা বউমণি। ছেলেটা বড্ড বেশি ভালোবাসে তোমাকে। তোমার অনুপস্থিতিতে একটা রাতও ঠিকভাবে ঘুমায়না ও। বাইরে দিয়ে পাথরের মতো শক্ত থাকলেও ভেতরে ভেতরে গুমরে যায়। আর এই মুহূর্তে তোমাকেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ওর।’

প্রিয়তা কোন উত্তর দিলোনা। উচ্ছ্বাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খেতে শুরু করল। কিন্তু ওর মনে ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারটা চিন্তা। সত্যিই ভবিষ্যতের চিন্তা করে বর্তমানে এসে ধরা দেওয়া সুখটাকে পায়ে ঠেলে দিচ্ছে ও। সেটা নিশ্চয়ই ঠিক হচ্ছেনা। খেতে খেতে ব্যপারটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবল উচ্ছ্বাস। অবশেষে নিয়ে ফেলল নিজের সিদ্ধান্ত।
খাওয়া শেষে প্লেট নিয়ে চলে যাচ্ছিল প্রিয়তা। যাওয়ার সময় পেছন থেকে ডেকে উঠল উচ্ছ্বাস। প্রিয়তা পেছন ঘুরতেই উচ্ছ্বাস কৃতজ্ঞতাপূর্ণ চাহনী দিয়ে বলল, ‘থ্যাংকস বউমণি।’
প্রিয়তা ঠোঁট প্রসারিত করে মৃদু হাসল কেবল।

রান্নাঘরে গিয়ে জ্যোতিকে দেখতে পেলোনা প্রিয়তা। চারপাশটা অন্ধকার। সিঙ্কের পাশে মিটমিটে আলোর একটা হলদে বাতি জ্বলছে। সেখানে দাঁড়িয়ে বাসন মাজছে নার্গিস। প্রিয়তা এঁটো প্লেটটা সিঙ্কে রাখতে রাখতে নার্গিসকে বলল, ‘জ্যোতি আপু ঘরে চলে গেছে?’

নার্গিস মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, তার নাকি মাথা ধরছে।’

প্রিয়তা কোন জবাব দিলোনা। ফিরে আসতে নিয়েও দাঁড়িয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো নার্গিসের দিকে। সকালবেলা একটু দেরীতেই ঘুম থেকে ওঠে প্রিয়তা। রুদ্রকে পাশে দেখতে না পেয়ে অবাক হয়। ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েও ওর আগে ঘুম ভেঙ্গে গেছে রুদ্রর! কিন্তু সময়ের হিসেব করে প্রিয়তা স্বস্তি পায়। ও শেষরাতের দিকে এসে ঘুমিয়েছে। সেখানে রুদ্রতো মাঝরাতে ঘুমিয়েছিল। ঔষধের পরিমাণও অল্প ছিল। তাই হয়তো দ্রুত জেগে গেছে রুদ্র।
বাইরে বেরিয়েই নার্গিসের মুখোমুখি হয় প্রিয়তা। করিডর পরিষ্কার করছিল সে। প্রিয়তাকে দেখে অদ্ভুতভাবে তাকায় সে। জহুরির মতো দৃষ্টি দিয়ে পরখ করতে থাকে ওকে। প্রিয়তা গুরুত্ব না দিয়ে চলে যাবে ভেবেও যায়না। আশেপাশে একপলক চোখ বুলিয়ে নার্গিসের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘আরও একবার বলছি খালা। কাল রাতে যা দেখেছেন ভুলে যান। নয়তো নিজেই বিপদে পড়বেন।’

নার্গিস নিজের স্বভাবসুলভ মুখ বাঁকিয়ে বলে, ‘এতো ভয় কীসের বাপু? সত্যিই বাইরে গিয়ে কেচ্ছা ঘটাচ্ছো নাকি? অমন রাজপুত্তুরের মতো ছোটবাবা আমাদের। তাকে দিয়ে মন ভরেনা?’

প্রিয়তা সে প্রশ্নের উত্তর দেয়না। শুধু বলে আসে, ‘নিজের বিপদ নিজেই বাড়াচ্ছেন।’

প্রিয়তার সকালের সেই হুমকিতেও লাভ হয়নি। থামেনি মহিলা। আরও এক নতুন কাণ্ড ঘটিয়েছে। প্রিয়তা এগিয়ে গিয়ে নার্গিসকে বলল, ‘সন্ধ্যায় রাজুর সঙ্গে আমার ছবি তুলে ঠিক করেননি আপনি খালা। ভালোয় ভালোয় ছবিটা ডিলিট করে দেবেন।’

নার্গিস চমকে উঠল। সন্ধ্যায় জয়ের সঙ্গে আড়ালে প্রিয়তাকে কথা বলতে দেখেছে সে। প্রিয়তার ওপর বিশেষ নজর রাখছে কি-না। দেখে সঙ্গে সঙ্গে ছবি তুলতেও ভোলেনি ফোনে। কিন্তু সেটাও যে এই মেয়ে টের পেয়ে গেছে তা বুঝতে পারেনি। নার্গিস নিজের ভীতভাব লুকিয়ে জীভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, ‘দুনিয়াতে ফাও কিছু পাওয়া যায়না। না করলে কী করবা? মারবা নাকি? যদি আমারে কিছু দিয়ে খুশি করতে পারো। তাইলে কিছু করতে পারি। নাইলে না।’

প্রিয়তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত দেখালো না। আরেকটু এগিয়ে নার্গিসের পেছনে দাঁড়াল। একদম ঘাড়ের কাছে ঝুঁকে বলল, ‘শেষবার। শেষবার সাবধান করলাম খালা। নিজের পায়ে কু-ড়াল মারবেন না। এরপর এটা বলবেন না যে আমি সাবধান করিনি।’

প্রিয়তা শীতল কন্ঠস্বর এতোটাই ভয়ানক ছিলোযে গা শিরশির করে উঠল নার্গিসের। সেটা দেখে বাঁকা হাসল প্রিয়তা। আস্তে করে বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে।
নার্গিস ভয় পেয়েছে। কিন্তু তার ধারণা হল প্রিয়তা তাকে থামানোর জন্যেই এভাবে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। আরেকটু চেপে ধরলে ঠিক সুরসুর করে টাকা বের করবে। জানল না, লোভ ভয়ানক খারাপ জিনিস। যা মানুষকে মৃত্যু অবধি ঠেলে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

হঠাৎই শীতের প্রকোপ বেড়েছে। ঠান্ডা শীতল হওয়া গায়ে লাগতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে একপ্রকার। যদিও ডিসেম্বরে এমন শীত পড়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। তবে এই তীব্র শীতের মাঝেও পাতলা গেঞ্জি গায়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে নীরব। মনটা অস্থির হয়ে আছে। মিশ্র অনুভূতির অত্যাচারে অতিষ্ঠ ও। বিয়ে নিয়ে সকলেরই অনেক স্বপ্ন থাকে। যেদিন থেকে কুহুকে ভালোবেসেছে, সেদিন থেকেই ওদের বিয়ে নিয়ে হাজারটা স্বপ্ন দেখেছে । কিন্তু সময়, পরিস্থিতি, কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সব এলোমেলো করে দিয়েছে। আজ ওদের এক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তার মাঝেও অসংখ্য অপূর্ণতার ছড়াছড়ি। বাবা-মার ওপর ভীষণ অভিমান হলো নীরবের। এতোটা কঠোর কীকরে হলেন তারা? নিজের একমাত্র সন্তানের থেকে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিলেন? একবারও নীরবের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করলেন না! নিজেদের জেদ আর অহংকার নিয়েই বসে রইলেন! ভেতরটা ভাড় হয়ে এলো নীরবের। চোখের কোণে সামান্য জল জমা হলো।

ঘরের ভেতরে আওয়াজ পেয়ে নিজেকে সামলালো নীরব। নিশ্চয়ই ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসেছে কুহু। আকাশের দিকে তাকিয়ে লম্বা শ্বাস ফেলল, দু হাতে মুখটা একবার ঘষে নিয়ে চলে গেল রুমে।
কুহুকে দেখে থমকে গেল ও। গোলাপি রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। কালো ব্লাউজ। চুলগুলো ছাড়া। সকল পবিত্রতা আর সিগ্ধতা যেন ভর করেছে মেয়েটার মধ্যে। সেই বাচ্চা দেখতে মেয়েটাকে আজ সত্যি সত্যি বউ বউ লাগছে। কিন্তু এতো সিগ্ধতার মাঝেও চোখমুখ ভীষণ নিষ্প্রাণ। চোখ তুলে একবার নীরবের দিকে তাকিয়ে সঙ্গেসঙ্গে চোখ নামিয়ে ফেলল কুহু। নীরব আস্তেধীরে এগিয়ে গেল কুহুর দিকে। ওর দুবাহুতে হাত রেখে কোমল স্বরে বলল, ‘মন খারাপ?’

কুহু কিছু বলল না। চোখদুটো ছলছল করছে ওর। নীরব কুহুর দুগালে আলতো করে হাত রাখল। কান্নারত মুখটা তুলে ধরে বলল, ‘বাবার কথা মনে পড়ছে?’

কুহু সামান্য মাথা দোলালো। কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল চোখে জমা জলটুকু। নীরব বলল, ‘সবসময় সব ইচ্ছে পূরণ হয়না কুহু। দেখ, আমার বাবা-মা থেকেও আমার কাছে নেই। তারজন্যে আমারও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সেসব কষ্টের কথা ভেবে সুখের মুহূর্তটা নষ্ট করা কী ঠিক?’

কুহু ইশারায় বলল, ‘আমার জন্যেই আপনাকে নিজের বাবা-মার কাছ থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে। ওনাদের কষ্ট দিতে হচ্ছে। আমি সত্যিই অপয়া।’

নীরব কুহুর হাত ধরে ওকে থামিয়ে বলল, ‘দূর পাগলী! তোমার চেয়ে বড় সৌভাগ্য আমার জীবনে আর কিছু হতেই পারেনা। আর যদি দুর্ভাগ্যের কথা বলো, তোমাকে ভালোবেসে আমি হাজারটা দুর্ভাগ্য হাসি মুখে মেনে নিতে পারি নীরবতা।’

কুহু চোখ বন্ধ করে কেঁদে ফেলল। মাথা এলিয়ে দিলো নীরবের বুকে। জন্মের কয়েকদিন পরই মাকে হারিয়েছে। বাবাও চলে গেল। ধ-র্ষি-তা নামক ভয়ানক খেতাবও লেগেছে ওর গায়ে। জীবনের এতো দুর্ভাগ্যের মধ্যেও নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে হচ্ছে আজ ওর। জীবনে এমন একজনকে পেয়েছে যে কোনকিছুর বিনিময়ে ওকে ছেড়ে যায়নি। কোন বাঁধা, কোন কলঙ্ক, কোন বাস্তবতা পারেননি নীরবকে কুহুর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে। কতটা ভালোবাসলে এভাবে পাশে থাকা যায়! কল্পনা করেও বুক ফেঁটে কান্না পায় কুহুর।
নীরব আস্তে করে সোজাভাবে দাঁড় করায় কুহুকে। আলতো হাতে চোখ মুছে দিতে দিতে বলে, ‘আজকে আমাদের বিয়ের প্রথম রাত। আজকের দিনটা এভাবে কেঁদে নষ্ট করোনা কুহু। অ‍্যাই! তোমার মনে আছে ভার্সিটির সেই দিনগুলোর কথা? ক্লাস বাঙ্ক দিয়ে সেই পুকুরপাড়ে বসে আমরা কতটা সময় পাড় করে দিতাম? আমি একাই ঘন্টার পর ঘন্টা বকবক করে যেতাম আর তুমি গালে হাত দিয়ে শুনতে। সহজে চোখের পলকও ফেলতে না। এতোটা ধৈর্য কীকরে পেতে বলোতো? অন্যকেউ হলেতো ততক্ষণে গোটা দশেক হাই তুলে ফেলতো।’

কুহু হেসে ফেলল। নীরবও হাসল। কুহুকে নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে বলল, ‘এইযে মিস.. স্যরি মিসেস নীরবতা! আজকে রাতটাও আমি বকবক করে তোমার মাথা খাবো। আর তুমি মুগ্ধ হয়ে আমাকে শুনবে। ঠিক ভার্সিটির দিনগুলোর মতো। ডান?’

কুহু হাসিমুখেই হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল। নীরব হাসল। প্রাণোচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত, নিষ্পাপ হাসি। নিজের বাহুবন্ধনে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল তার নীরবতাকে।

খাবারের প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকল প্রিয়তা। দেখল জামা ছেড়ে শুয়ে পড়েছে রুদ্র। সোজা হয়ে শুয়ে কপালের ওপর হাত দিয়ে রেখেছে। বরাবরের মতোই স্যান্ডো গেঞ্জি আর ট্রাউজার পড়ে শুয়েছে। এই শীতের মধ্যেও অভ্যাস বদলাতে পারেনি লোকটা। প্রিয়তা খাবার টি-টেবিলে রেখে রুদ্রর পাশে বসল। আলতো করে ডেকে বলল, ‘খেয়ে তারপর ঘুমান।’

‘খিদে নেই বললাম তো।’

‘আমিও না খেয়ে আছি।’

রুদ্র বুঝে গেল পরবর্তী কয়েকটা বাক্য কী হবে। ওর জন্যেও প্রিয়তা বসে ছিল। ও না খেলে প্রিয়তাও খাবেনা ইত্যাদি। তাই আর কথা বাড়ালোনা। চুপচাপ উঠে বসল। অলস ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দিল প্লেট নেওয়ার জন্যে। কিন্তু প্রিয়তা রুদ্রকে প্লেট দিলোনা। বরং নিজে লোকমা তুলে এগিয়ে দিল রুদ্রর দিকে। রুদ্র অবাক হলো। এমনটা আগেও করতো প্রিয়তা। রুদ্র যখন ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতো। তখন প্রিয়তা নিজের হাতে সময় নিয়ে খাইয়ে দিতো ওকে। তবে রুদ্র মুখে তোলার আগে এক লোকমা প্রিয়তাকে খেতে হতো। সেটা ছিলো রুদ্রর বানানো অলিখিত নিয়ম। বহুদিন হলো সেসব হয়না। রুদ্রকে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রিয়তা বলল, ‘কী ব্যপার? এভাবে দেখছেন যেন আজ প্রথম খাইয়ে দিচ্ছি আমি?’

‘কিছু ভুলে যাচ্ছো তুমি।’ গম্ভীর কন্ঠে বলল রুদ্র।

কপালে ভাঁজ ফেলল প্রিয়তা। কী ভুলে যাচ্ছে তৎক্ষণাৎ ধরতে পারল না। তবে দ্রুতই মনে পড়ল। মনে পড়তেই নিজে এক লোকমা মুখে তুলে তারপর রুদ্রর দিকে এগিয়ে দিল। রুদ্রর সঙ্গে সঙ্গে নিজেও খেয়ে নিল।
খাওয়া শেষে সবকিছু গুছিয়ে এসে দেখল রুদ্র বিছানায় হেলান দিয়ে হাত ভাঁজ করে বসে আছে। প্রিয়তা কিছু না বলে অপরপাশে গিয়ে বসল। শুয়ে পড়তে নিলেই ডেকে উঠল রুদ্র, ‘প্রিয়!’

‘বলুন?’

‘তুমি আবার স্বাভাবিক ব্যবহার করছো। গতকাল আমার কথায় কষ্ট পেয়েছো?’

‘না, তবে আপনি ঠিকই বলেছেন। সবকিছু জেনেশুনেইতো এসেছিলাম আপনার জীবনে। এখন এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা ভিত্তিহীন। আর তাছাড়াও কিছু করেতো কোন লাভ নেই। তাই যতক্ষণ আপনার সঙ্গে আছি আপনার অর্ধাঙ্গিনী হয়েই না হয় থাকি।’

রুদ্র ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা এগিয়ে এসে রুদ্রর কাঁধ আকড়ে ধরল। মাথা এলিয়ে দিল রুদ্রর কাঁধে। রুদ্র অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে প্রিয়তার মাথায় আলতো করে চুমু খেল। অন্যচিন্তায় ব্যস্ত সে। সাব্বিরকে মেরে ফেলা হয়েছে সে নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু অনেক হিসেব এখনো মিলছেনা রুদ্রর। সেসব হিসেব মেলাতেই ব্যস্ত সে। সেই চিন্তায় বিভোর থেকেই রুদ্র বলল, ‘তোমাকে কষ্ট দেওয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই প্রিয়। কিন্তু কী জানোতো, শুরু থেকেই একটা জিনিস মারাত্মক ঘৃণা করি আমি। বিশ্বাসঘাতকতা। বিশ্বাসঘাতকদের কিছুতেই ক্ষমা করতে পারিনা আমি। আমি তোমাকে আগেও বলেছি। আমার খুব কাছের, বিশ্বস্ত মানুষই আমার পিঠে ছু-রি মেরেছে এবং মারছে। আর সেকারণেই আজ এই অবস্থা। যার বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি, আমার বাচ্চাকে হারিয়েছি, আমার বোনের মুখ থেকে হাসি হারিয়ে গেছে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না প্রিয়। কোনকিছুর বিনিময়েই না।’

প্রিয়তা রুদ্রর কাঁধ থেকে মাথা তুলে বলল, ‘বিশ্বাসঘাতকতা সেই করতে পারে যাকে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করা হয়। তারমানে নিশ্চয়ই সে আপনার খুব আপনজন। খুব কাছের কেউ। তাকে শাস্তি দিতে কষ্ট হবেনা আপনার?’

চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল রুদ্রর। অদ্ভুত শীতল কন্ঠে বলল, ‘বিশ্বাসঘাতকতদের প্রতি কোনদিনও দয়া হয়নি আমার প্রিয়। আর না হবে। তোমাকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি, যার জন্যে নিজের বাবা, সন্তান, সুখ সবকিছু হারিয়েছি, সে যেই হোক, তার শেষ আমার হাতেই লেখা আছে।’

প্রিয়তা দীর্ঘশ্বাস চাপল। ঘনঘন কয়েকটা ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করল। চোখ বন্ধ করে আটকে ফেলল নিজের অশ্রু। আস্তে করে রুদ্রর বুকে মাথা রেখে কাঁপাকাঁপা গলায় বলল, ‘আমি আর আপনাকে বাঁধা দেবনা রুদ্র। ভাগ্যেকে মেনে নিচ্ছি আমি। আপনার যা ইচ্ছা হয় আপনি করুন। শুধু একটা প্রতিশ্রুতি চাই আপনার কাছে।’

‘প্রতিশ্রুতি?’

‘হ্যাঁ। যাই হয়ে যাক না কেন, কখনও আমাকে ছেড়ে যাবেন না। নিজের থেকে কোনদিনও আমাকে আলাদা করবেন না। জীবনের শেষ মুহূর্তটাও আমি এভাবে আপনার গায়ে লেপটে থেকেই পাড় করতে চাই। সে অধিকার থেকে কোনদিনও আমাকে বঞ্চিত করবেন না।’

মৃদু হাসল রুদ্র। প্রিয়তার চুলে আঙুল বুলিয়ে বলল, ‘সে প্রতিশ্রুতিতো আমি তোমাকে আগেও দিয়েছি প্রিয়। তোমাকে দূরে সরানোর কথা আমি ভাবতেও পারিনা। মৃত্যু ছাড়া আর কোন শক্তি, কোন সত্যি তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবেনা। একমাত্র মৃত্যুই পারবে প্রিয়কে তার রুদ্রর কাছ থেকে আলাদা করতে। কথা দিচ্ছি।’

প্রিয়তার মাথায় দীর্ঘ সময় নিয়ে চুমু খেলো রুদ্র। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল নিজের প্রশস্ত বুকে। প্রিয়তার বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে নামল। রুদ্রর দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে নিশ্চিন্ত হয়েছে ও। রুদ্র প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেনা। সে কথা জানে প্রিয়তা। কিন্তু ভুলে গেল বোধ হয়, কিছুক্ষণ আগে রুদ্র আরও এক প্রতিজ্ঞা করেছে!

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here