অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৭২.

0
8

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৭২.

বারান্দার দরজাটা খোলা। ঘরের আনাচে কানাচে গোটা কয়েক সুগন্ধি মোমবাতি। খােলা বারান্দা দিয়ে বয়ে আসা শীতল দমকা হাওয়ায় প্রেতনৃত্য করছে আগুনের শিখা। জানালার পর্দাগুলোও দুলছে গোছালো ছন্দে। বিছানাটাও চমংকার সব ফুল দিয়ে সাজানো। মােমের রঙিন আবছা আলোয় মোহনীয় লাগছে সেই দৃশ্য।

রাত এগারোটার পর ঘরে ঢোকে প্রিয়তা। পরনে চমৎকার সাদা শাড়ি। গলায়, হাতে, কানে সাদা ফুলের গহনা। সম্পূর্ণ শুভ্র সাজে অতি পবিত্র কোন অপ্সরার মতো লাগে ওকে। তবে ঘরে ঢুকেই এমন মোহনীয় পরিবেশ দেখে প্রিয়তা থমকে যায়। বিস্ময়ভরে দেখে সব আয়ােজন। খুবই ধীর কদমে এগোতে থাকে। উপভােগ করে নিজ কক্ষের অপূর্ব সৌন্দর্য। মোম আর ফুলের অপূর্ব সুন্দর ঘ্রাণে চোখ বন্ধ করে ফেলে ও। অজান্তেই ঠোঁটে ফুটে ওঠে মিষ্টি হাসি। এই অসাধারণ আয়োজন কার পক্ষে করা সম্ভব বুঝতে বাকি থাকেনা প্রিয়তার। চোখ খুলে নীরব আকুলতায় খোঁজে প্রিয়তমকে। কিন্তু আবছা আলােয় কোথাও দেখতে পায়না কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে।
আরও কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে প্রিয়তা মৃদু গলায় ডাকে, ‘রুদ্র।’

রুদ্র সাড়া দেয়না। প্রিয়তা ব্যাকুল হয়। আরেকটু এগিয়ে যেতে যেতে বলে, ‘কোথায় আপনি?’

এবারেও কোন উত্তর না পেয়ে মন খারাপ হয় প্রিয়তার। হাসি মিলিয়ে যায়। কোথায় মানুষটা? বিষণ্ন দূষ্টিতে চারপাশে তাকায় প্রিয়তা। হাটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় বারান্দায়।সেখানেও মােমবাতি দিয়ে সাজানো আছে। কিন্তু এবার প্রিয়তা হাসেনা। রুদ্রকে ছাড়া অসম্পূর্ণ লাগে এই সৌন্দর্য। ভিত্তিহীন লাগে সব আনন্দ। কোথায় সে? এমন লুকোচুরি কেন?
তখনই প্রিয়তার হলদে ফর্সা কোমরে শীতল হাতের গভীর স্পর্শ লাগে। কোঁপে ওঠে প্রিয়তা। ঠান্ডা শীতল বাতাসের সঙ্গে, শীতল গভীর স্পর্শে জমে যায় শরীর। নাকে এসে বারি লাগে সুপরিচিত সেই ঘ্রাণ। এই স্পর্শ, ঘ্রাণ অতি পরিচিত ওর। এই স্পর্শ প্রিয়তার শরীরের প্রতিটা লোমকূপ গভীরভাবে চেনে। বারংবার এই স্পর্শে শিহরিত হয়েছে ওর শরীর। পরিপূর্ণ হয়েছে আত্মা। নারী সত্তা। প্রিয়কে স্পর্শ করার সেই দুঃসাহস একজনেরই হতে পারে। রুদ্র আমের।নিজের শরীরের ভর ছেড়ে দেয় প্রিয়তা। নিজেকে সপে দেয় রুদ্রর হাতে। রুদ্র অলস ভঙ্গিতে থুতনি রাখে প্রিয়তার কাধে।
প্রিয়তা চোখ বন্ধ করে অনিয়মিত স্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে
বলে, ‘কোথায় ছিলেন?’

‘ঘরেই ছিলাম।’

‘এতাে ডাকলাম। সাড়া দিলেন না কেন?’

‘চমকে দেব বলে।’

‘আপনাকে দেখতে পাইনি আমি।’

‘অন্ধকারের ছিলাম।’

‘আমাকে এভাবে সাজানোর পরিকল্পনা আপনার বুঝি?’

‘কই? আমিতোে কিছু করিনি।’

‘মিথ্যে বলবেন না।’

রুদ্র হাসে। কুহুকে সাদা শাড়ি আর ফুলের গহনা দিয়ে বলেছিল, প্রিয়তাকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে রুদ্রর ঘরে পাঠাতে। ততক্ষণে নিজহাতে মনের মতো করে সাজিয়েছে প্রেয়সীর শয়নকক্ষ। প্রিয়তা ঘরে আসার উদ্দেশ্যে করিডর পাড় হওয়ার। সময়ই একপ্রকার জোর করে টেনে নিয়ে যায় কুহু আর জ্যোতি। দুজন মিলে সাজায় ওকে। জ্যোতি নিজ হাতে পড়িয়ে দেয় রুদ্রর নিয়ে আসা সাদা ফুলের গহনা। প্রিয়তাকে সাজানোর সময় জ্যোতির হাসিখুশি মুখটা কেমন বিষণ্ন লাগে। হঠাৎই ওর চোখ দিয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। প্রিয়তা মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করে সেটা । কিন্তু কিছু বলেনা। দীর্ঘশ্বাস চাপে কেবল।

রুদ্র আরেকটু গভীর আলিঙ্গন করতেই প্রিয়তা বলে, ‘হঠাৎ এসব কেন?’

রুদ্র প্রিয়তার কানের পিঠে ঠোঁট ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘কাল রাতের কথা ভুলে গেল, প্রিয়?’

রুদ্র নিজের শব্দবাণে যেন লজ্জাবতী লতাকে ছুঁয়ে দিল। সেভাবেই নুইয়ে পড়ল প্রিয়তা। মনে পড়ল, গতরাতে একান্ত, গভীর অন্তরঙ্গ মুহুর্তে প্রিয়তা রুদ্রকে বলেছিল, আমি মা হতে চাই রুদ্র। রুদ্র থেমে গিয়েছিল। মাথা তুলে সরাসরি তাকিয়েছিল প্রিয়তার ঘনপল্লব চোখের গভীরে। হৃদয়গ্রাসী নীরবতা চলে কিছুক্ষণ। মুখে কিছু বলেনি রুদ্র। প্রিয়তার মাথার পেছনে হাত রেখে নিজের উন্মুক্ত বুকে চেপ ধরেছিল কেবল।

প্রিয়তার গুটিয়ে যেত দেখে রুদ্র নিজের দিকে ঘোরালো প্রিয়তাকে। এক হাতে আবদ্ধ করল প্রিয়তার ক্ষীণ কটি। অপর হাতে থুতনি ধরে উচু করল লজ্জামাখা মুখটা। আঁচল ভেঙ্গে নিখুঁত ভাজে পড়ানাো জামদানি শাড়িটা। ছিপছিপে হলদে ফর্সা শরীরে ফুটে উঠেছে একদম। লম্বা চুলগুলাে সাইড সিঁথি করে খোপা করা। খােপায় গোঁজা বেলী ফুল। কী অপূর্ব ঘ্রাণ! শরীরের সাদা ফুলের গহনাগুলোও সেই সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুণ।
রুদ্র মেকআপ পছন্দ করেনা। তাই মুখে কোনরকম মেকআপ নেই প্রিয়তার। শুধু চমৎকার চোখদুটো সেজে উঠেছে গাঢ় কাজলে। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে অর্ধাঙ্গিনীর ঝলসানো রূপ দেখে রুদ্র। কোমল গলায় বলে, ‘তাকাও প্রিয়।’

প্রিয়তা তাকায় না। না বােধক মাথা নাড়ায়। রুদ্র মৃদু হেসে নিজের শুষ্ক তামাটে ঠোঁট এগিয়ে আনে প্রিয়তার কম্পমান ভেজা ঠোঁটের দিকে। তখনই নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় প্রিয়তা। লজ্জায় অস্থির হয়ে পালাতে চায়। কিন্তু নিজেকে মুক্ত করত পারেনা রুদ্রর বাহুবন্ধন থেকে। রুদ্র হেসে বলে, ‘কাল রাতে বাচ্চা চেয়ে, আজ পালাতে চাইলে হবে প্রিয়? আমার বাচ্চাকে জন্ম দিতে হলে আমার কাছে অন্তত সমন্ত লজ্জা ত্যাগ করা উচিৎ তােমার।’
প্রিয়তা তাকায় রুদ্রর দিকে। সাদা রঙের শার্টে শ্যামবর্ণের সুর্দশন পুরুষটিকে আরও আর্কষণীয় লাগে ওর। আগােছালা চুল। কালাে গভীর চোখ। নিষ্ঠুর ঠোঁট। কঠোরতা আর কোমলতার মিশ্রনে তৈরী কা-টা মুখ। রুদ্র আকাশের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, ‘তুমি আমি আর আমাদের সন্তান। তিনজনে একসঙ্গে ধূমকেতু দেখলে কেমন হবে প্রিয়?’

‘তিনজন না, চারজন। আবার পাঁচ ছজনও হতে পারে।’

রুদ্র অবাক হয়, ‘ সেটা কীভাবে?’

‘বাহ রে! ততদিনে আমাদের সন্তানেরও বিয়ে হয়ে যাবেনা? আমাদের নাতিপুতিও হয় যেতে পারে।’

রুদ্র হালকা আওয়াজ করেই হাসে। প্রিয়তা ঠোঁট চেপে হেসে মাথা নিচু করে ফেলে। রুদ্র দেখে কিছুক্ষণ। তারপর প্রয়সীর কপালের মাঝে গভীর চুম্বন করে। চুলে নাক ঠেকিয়ে বেলী ফুলের ঘ্রাণ নেয় দীর্ঘক্ষণ। আস্তে করে খুলে দেয় চুলের খোপা। প্রিয়তা মুখ গোঁজে রুদ্রর প্রশস্ত বুকে।

বারান্দার দরজাটা সশব্দে বন্ধ হতেই ঘুম ভেঙে গেল রুদ্রর। দ্রুত উঠে বসল। শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে বুঝল, বারান্দার দরজা খুলে রেখে ঘুমিয়েছিল সে। দমকা বাতাসে আটকে গিয়েই এই শব্দ। লস্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করল রুদ্র। পাশে তাকিয়ে বিছানার বা পাশটা ফাকা দেখে দীর্ঘশ্বাস চাপল। দমবন্ধকর এক ভার অনুভব করল বুকের মাঝে। এক সপ্তাহ হল জায়গাটা ফাঁকাই পড়ে আছে। প্রিয়তা নেই। অজস্র অভিমান আর অভিযােগ নিয়ে চলে গেছে রুদ্রকে ছেড়ে। এখন রুদ্রর সঙ্গে কেবল স্মৃতিগুলো আছে। গত দুবছর তার প্রিয়র সঙ্গে কাটানো মিষ্টি মধুর স্মৃতি। যা একটা রাতও শান্তিতে ঘুমাতে দেয়না রুদ্রকে। যেমন আজ দিলোনা।


প্রিয়তাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসার পরে তিনটে দিন কেটে যায়। রুদ্রর সঙ্গে কোনরকম কোন কথা বলেনি প্রিয়তা। রুদ্র নিজের কাজ কিছুদিনের জন্যে উচ্ছ্বাস আর জাফরকে বুঝিয়ে দিয়ে বাডিতেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তাতেও বিশেষ কোন লাভ হয়না।
বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বললেও, রুদ্রর কোন কিছুতেই কোন প্রতিক্রিয়া দেখাতো না প্রিয়তা। দিনের বেলা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো জানালা দিয়ে। আর রাতের বেলা চুপচাপ শুয়ে পড়তাে উল্টো ঘুরে। রুদ্র কথা বলার চেষ্টা করতো। ছোঁয়ার চেষ্টা করতা। কিন্তু প্রিয়তার কাছ থেকে কোনরকম কোন প্রতিত্রিয়া পাওয়া যেতো না। যখন প্রিয়তা একটু ঠিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারল। তখন থেকে বেশিরভাগ সময় জ্যোতির ঘরেই থাকতো। রুদ্র ডাকলেও আসতো না রাত হওয়ার আগে। হাসপাতাল থেকে সপ্তাহখানেক এভাবেই কেটে যায়।

একদিন রাতে রুদ্র ঘরে ঢুকে প্রিয়তাকে পায়না। অথচ জ্যোতির ঘরেও নেই সে। ওকে খুঁজতে খুঁজতে বারান্দায় গিয়ে দেখে রেলিং ধরে একদৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। রুদ্র ধীরগতিতে গিয়ে দাঁড়ায় প্রিয়তার পাশে। নিজেও তাকিয়ে থাকে বিশাল আকাশের দিকে। রুদ্র উপস্থিতি টের পেয়েও নড়ে না প্রিয়তা। কিছুক্ষণের নীরবতার পর অবশেষে রুদ্র বলে, ‘এভাবে কতদিন চলবে প্রিয়?’

বরাবরের মতো কোন জবাব আসেনা প্রয়তার কাছে থেকে। প্রিয়তাকে চুপ থাকতে দেখে রুদ্র আবার বলে, ‘পুচকু সােনা কিন্তু আমারও সন্তান ছিল প্রিয়তা।’

এতক্ষণে রুদ্রর দিকে তাকাল প্রিয়তা। প্রিয়তার শীতল দৃষ্টি দেখে মন কেঁপৈ ওঠে রুদ্রর। প্রিয়তা ঠোঁট বাঁকিয়ে কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলে, ‘আপনার সন্তান?’

দীর্ঘদিন পর রুদ্রর সঙ্গে সরাসরি কথা বলে প্রিয়তা। ‘পুচকু সােনা আপনার কেউ নয় রুদ্র। কেউ নয়। ও শুধু আমার সন্তান ছিল। শুধু আমার। তাইতাে ওর ব্যাপারে শুধুমাত্র আমিই ভেবেছিলাম। যদি ও সত্যিই আপনার সন্তান হতা, ওর ব্যপারে ভাবতেন আপনি। আপনার জেদের বলি হতে হতোনা ওকে। নিজের মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থাতেই চলে যেতে হতোনা। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে আপনিই আমার পুচকুর খুনি। নিজের সন্তানের খুনি আপনি।’

‘প্রিয়!’

ধমকে ওঠে রুদ্র। প্রিয়তা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদে। রুদ্র লম্বা শ্বাস ফেলে শান্ত করে নিজেকে। আলতো হাতে প্রিয়তাকে বুকে জড়াতে চায়। কিন্তু প্রিয়তা সরে যায় দূরে। হিঁচকি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমার কথা কেন শুনলেন না রুদ্র? কেন শুনলেন না? তাহলেতো আজ আমার রাজপুত্র, আমার পুচকু সোনা বেঁচে থাকতো। কেন করলে এমন?’

রুদ্র উত্তর দিতে পারেনা। অসহায় চোখে দেখে প্রিয়তার ছটফটানি। সন্তান হারানোর গভীর ক্ষত যেন আরও প্রবল আঘা-তে র-ক্তা-ক্ত হয়। রুদ্রকে চুপ থাকত দেখে প্রিয়তা রেগে যায়। চোখ মুছে বলে, ‘আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম আপনি রাশেদ আমেরের সন্তান। যে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে নিজের ছেলেকে সযত্নে একটা ক্রিমিনাল তৈরী করতে পারে। তার ছেলে নিজের কাজ, নিজের জেদ বজায় রাখতে নিজের সন্তানের বিসর্জন দিতেই পারে। শত হলেও রক্ততো কথা বলে।’

‘ প্রিয়তা!’ এবার সত্যি সত্যি গর্জে উঠল রুদ্র। ‘বাবাকে নিয়ে একটা কথাও না।’

কিন্তু প্রিয়তা থামেনা। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা হয়তো গ্রাস করে ওর বোধবুদ্ধি। ও দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলে, ‘ভুল কিচ্ছু বলিনি আমি। আপনার বাবা আপনার জীবনটা নষ্ট করে দিয়ে গেছেন। আর আপনিতো আমার সন্তানকে পৃথিবীর আলােটাও দেখতে দেননি। স্বার্থপর! আপনারা দুজনেই স্বার্থপর।’

কোন কিছু না ভেবেই প্রিয়তার গালে ঠাটিয়ে এক চড় মারে রুদ্র। প্রিয়তা থমকে যায়। গালে হাত দিয়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকায় রুদ্রর দিকে। রুদ্র নিজেও হতবাক হয়। বিয়ের পর প্রথম প্রিয়তার গায়ে হাত তুলেছে ও। কী করতাে? নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। প্রিয়তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। ওকে কিছু বলতে যাচ্ছিল রুদ্র। কিন্তু বলতে পারল না। বলার সাহস জুগিয়ে ওঠার আগেই ধীরপায়ে হেঁটে রুমে চলে গেল প্রিয়তা। রুদ্র ঠায় দাঁড়িয়ে রইল বারান্দায়। কী করবে, কী করা উচিত, কিছু বােঝে না। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে স্থির করার চেষ্টা করে। কার ওপর জানা নেই। তবে প্রচন্ড রাগ হয় ওর। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সজোরে আঘাত করে রেলিংয়ে।

পরেরদিন সকালবেলা আমের ভিলার সকলেই চা খাচ্ছিল বসার ঘরে বসে। রুদ্র, উচ্ছাস, জাফর, নীরব, কুহু জ্যোতি সকলেই ছিল। কুহুকে সেদিন অনেকটা জোর করেই নিচে নামায় নীরব। নয়তো মেয়েটা সহজে বের হতেই চায়না। সিড়ি বেয়ে প্রিয়তাকে নামতে দেখে থমকে যায় উপস্থিত সকলেই। প্রিয়তাকে দেখে নয়, থমকায় ওর হাতর বড় লাগেজ দেখে। কেউ আর বসে থাকতে পারেনা। রুদ্র বিস্ময়ে কথাও বলতে পারেনা। সবার আগে কথা বলে জাফর, ‘এ কী প্রিয়তা মা? এই শরীরে, এমন সময় ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছাে তুমি?’

প্রিয়তা জাফরের প্রশ্নের কোন উত্তর দেয়না। দাঁড়িয়ে যায় কেবল। উচ্ছ্বাস বলে, ‘কোথাও যাচ্ছো বউমণি? তাও এই অবস্থায়…’

উচ্ছ্বাস কথা শেষ করার আগেই প্রিয়তা বলে, ‘আমি আমের ভিলায় আর থাকতে পারব না ভাই। তাই একটা ঘর ভাড়া নিয়েছি। এখন থেকে সেখানেই থাকব।’

জ্যোতি এগিয়ে এসে প্রিয়তার হাত ধরে বলে, ‘কী বলছো এসব? চলে যাচ্ছো মানে কী? দেখো প্রিয়তা, আমি জানি তােমার মনের অবস্থা ভালো নেই। রুদ্রর ওপর রেগে আছাে তুমি। তাই বলে_’

জাফর বলে, ‘তাছাড়াও ওখানে একা থাকবে কীকরে তুমি? খরচ চালাবে কীকরে?’

প্রিয়তা দীর্ঘশ্বাস চেপে বলে, ‘চাকরী খুঁজছি। সার্টিফিকেট আছে, যোগ্যতা আছে। হয়ে যাবে। আর আমার কাছে যা সেভিংস আছে তাতে আপাতত চলে যাবে আমার।’

এবার নীরব কিছু বলতে গেলে তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রিয়তা বলে, ‘আমাকে আটকানোর চেষ্টা করোনা কেউ। লাভ নেই। আমি অনেক ভেবে চিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি এখানে আর একটা দিনও থাকছি না।’

জাফর বলে, ‘তুমি বুঝতে পারছোনা মা। বাইরে কতধরণের বিপদ। ওরা সবার আগে আমাদের দুর্বল জায়গাগুলোতেই আঘা-ত করছে। তোমার এভাবে বাইরে থাকাটা নিরাপদ না। তোমার ক্ষতি করে দেবে ওরা।’

প্রিয়তা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, ‘নিজের সন্তানের মৃত্যুর চেয়ে বড় ক্ষতি একজন মায়ের আর কী হতে পারে কাকা? জীবন, মৃত্যু দুটোই এখন আমার কাছে সমান।’

ওরা সবাই মিলে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই কোন লাভ হয়না। রুদ্র নিষ্পলক চোখে দেখে প্রিয়তাকে। সকলে ব্যর্থ হতেই ধীরপায়ে প্রিয়তার দিকে এগিয়ে যায় রুদ্র। এক হাত ধরে ঘোরায় নিজের দিকে। থমথমে গলায় বলে, ‘তােমার কী মনে হয়? তুমি যেতে
চাইলেই আমি যেতে দেব?’

প্রিয়তা রুদ্রর চোখে চোখ রেখে বলে, ‘যদি আপনি
আমাকে আটকানোর চেষ্টাও করেন। তবে আমের ভিলার পরবর্তী মূ-ত্যু আমার হবে রুদ্র।’

রুদ্রর হাত আলগা হয়ে আসে। বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা হাত ছাড়িয়ে নেয়। রুদ্রর গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয়না। এরকম ধাক্কা হয়তো জীবনে প্রথম পেয়েছে ও। যেতে নিয়েও থেমে যায় প্রিয়তা। রুদ্রর দিকে ঘুরে বলে, ‘আরেকটা কথা। লােক দিয়ে আমাকে পাহারা দেওয়ার দয়াটা দেখাতে যাবেন না। যে হাত আমার সন্তানকে রক্ষা করতে পারেনি। সেই হাতে নিজের রক্ষা চাইনা আমি। যদি আমি কোনভাবে টের পাই আপনি এমন কিছু করেছেন। তবে বাইরের কেউ আমার কোন ক্ষতি কী করবে? আমি নিজেই নিজেকে শেষ করে দেব। আপনার অর্ধাঙ্গিনী আমি রুদ্র। আমার জেদ আপনার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। যা বলি, সেটা কাজেও করে দেখাতে পারি।’

রুদ্র শুধু তাকিয়ে দেখে প্রিয়তাকে। কুহু প্রায় দৌড়ে আসে প্রিয়তার কাছে। জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। ছেড়ে দিয়ে হাতের ইশারায় অনুরোধ করে বলে থেকে যাওয়ার জন্যে। প্রিয়তা কুহুর চোখ মুছে দেয়। মলিন হেসে বলে, ‘মিষ্টি বােন আমার। কাঁদেনা। আমি আসবতো মাঝেমাঝে তােমার সঙ্গে দেখা করতে।’ তারপর নীরবের দিকে ইশারা করে বলে, ‘এই ছেলেটা নিজের সবকিছু ছেড়ে তােমার কাছে এসে পড়ে আছে কুহু। ওকে আর কষ্ট দিওনা।’

কেউ কোনভাবেই আটকে রাখতে পারেনা প্রিয়তাকে। বিশাল প্রস্তরখণ্ডকেও হয়তো গুড়িয়ে ফেলা যায়। কিন্তু এক সন্তানহারা মায়ের সংকল্প ভাঙা যে অসম্ভব। তাই বােধ হয় প্রিয়তার সিদ্ধান্তকেও কেউ টলাতে পারেনা। চলে যায় সে।
রুদ্র পাথর বনে যায়। প্রেয়সীর এমন কঠোর রূপ ভেতর থেকে ভেঙ্গে দেয় ওকে। প্রিয়তা বলেছিল, নিজের জেদের কারণে একদিন প্রিয়তাকেও হারিয় ফেলবে সে। হয়তাে সেটাই ঐ দিন ছিল।

সেসব দিনের কথা চিন্তা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুদ্র। আজ রাতে চোখে আর ঘুম ধরা দেবেনা। বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় যায়। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে তাকিয়ে থেকে সিগারেট জ্বালায় একটা। বিষাক্ত ধোঁয়া উড়িয়ে নিজের জীবনের অসংখ্য সমীকরণ মেলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুই মেলেনা। কোন উত্তর পায়না। প্রিয়তার খোঁজ নেওয়ার সাহস করে উঠতে পারেনি রুদ্র। যদি সত্যি সত্যিই মেয়েটা নিজের কোন ক্ষতি করে দেয়? আর কাউকে হারানোর সাহস হয়তো নেই রুদ্রর মধ্যে। তাই মেনে নিয়েছে এই বিরহ দহন। কেমন আছে মেয়েটা? জাফর, উচ্ছ্বাসের কাছে শুনেছে সকলের সঙ্গে কৌশলে নাকি রুদ্রর খবরও নেয় সে। আর মেয়েটার কী ইচ্ছে করেনা একবার রুদ্রকে দেখতে। রুদ্রর গলার আওয়াজ শুনতে। রুদ্রর তো করে। ভীষণ ইচ্ছে কর। সারাটাদিন ব্যস্ততায় কেটে গেলেও রাতগুলো অসহ্য যন্ত্রণায় কাটে ওর। বুকের ভেতর ভীষণ শূণ্য লাগে।।

ঘুমের মধ্যও প্রিয়তার স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায় ওকে। জীবনধারণ যে এতোটাও যন্ত্রণার হতে পারে এর আগে বােঝেনি রুদ্র। হঠাৎই রাশেদের কথা মনে পড়ে। মূত্যুর আগে সেই বজ্র গম্ভীর কন্ঠে বলেছিল, ‘আমার বংশধরকে সুস্থভাবে পৃথিবীর আলো দেখানোর দায়িত্ব তােমার। ওর অযত্ন যাতে না হয়।’

রুদ্রর চোখ জ্বালা করে ওঠে। আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাস কন্ঠে বলে, ‘আমি আমার কথা রাখতে পারিনি বাবা। তােমার বংশধরকে যত্নে রাখতে পারিনি আমি। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই সে চিরকালের মতো চলে গেছে আমাদের ছেড়ে। তোমার মতো।’

সন্ধ্যাবেলা আমের ফাউন্ডেশনে গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে বসে রুদ্র, উচ্ছাস আর জাফর। তিনজনই বসেছে। এইমুহূর্তে বাইরের একটা পোকাকেও বিশ্বাস করতে পারছেনা ওরা কেউ। রাশেদ আমেরের মৃত্যুর পর দলের দুরাবস্থা দেখে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন দল ছেড়ে পালিয়েছে। হাল ছেড়েছে আরও কয়েকজন। তারা কেবল নামেই দলের সদস্য। হাতে গোণা কয়েকজনই এখনো শক্ত করে ধরে রেখেছে সোলার সিস্টেমের হাল। তারাও যেকোন মুহুর্তে তা ছেড়ে দিতে আরে। যার ফলসরূপ শান্ত হয়ে গেছে অশান্ত গুলশান। সোলার সিস্টেমের সেই সূর্যসরূপ তেজ আর নেই। বর্তমান পরিস্থিতি খুবই ভয়ানক।

জাফর কলম ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ‘দেশে আমাদের অনুগত যতগুলো দলই ছিল তারা কোনভাবে টের পেয়ে গেছে সােলার সিস্টেমের ভেতরকার কথা। রাশেদ আমেরের মৃত্যুতে এমনিতেই ধাক্কা খেয়েছ ওরা। আর এই অবস্থার কথা জানার পর তারা কী করবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।’

রুদ্র গম্ভীর। ও জানে তারা কী করবে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের জগৎটা যেমন সাধারণত মানুষর অদেখা অন্ধকার। তারচেয়েও বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন তার অভ্যন্তরীণ রীতিনীতি। এখানে কেবল স্বার্থ দেখা হয়। কেবল স্বার্থ। এখানে প্রয়ােজন মাথায় তুলতেও সময় লাগেনা। ঠিক তেমনই প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে আছড়ে নিচ ফেলতেও দু’বার ভাবেনা কেউ। ঐসব দল এতোদিন সোলার সিস্টেমের অনুগত ছিল কারণ সােলার সিস্টেমের কাছ থেকে যথেষ্ট প্রফিট পেতো ওরা। কিন্তু সেই প্রফিটের রাস্তা যখন বন্ধ হয়ে গেছে। এখন অবশ্যই তারা সেখানেই যাবে যেখানে তাদের লাভ। আর সেই জায়গাটা অবশ্যই ওদের শক্রদল। আর তারা সবাই মিলে একজোট হয়ে যদি সােলার সিস্টেমের পেছনে লাগে। রুদ্র কিচ্ছু করতে পারবেনা। এখন অতোটা ক্ষমতা নেই সোলার সিস্টেমের। রাশেদের একটা সই সেই ক্ষমতা অনেক আগেই কেড়ে নিয়েছে। আর রুদ্রর ধারণা তারা সে পথেই এগোচ্ছে। ওদের সবচেয়ে বেশি ইন্ধন আর আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে কয়েকজন নামকরা ব্যবসায়ী। তারমধ্যে রিপন চৌধুরী একজন। রিপন চৌধুরীর কথা মনে পড়ল রুদ্রর। যার কাছ থেকে ব্লাকমেইল করে চাঁদা আদায় করতো। এমন আরও অনেকেই আছে। উচ্ছ্বাস একটা লিস্ট বের করে বলল, ‘এখানে সেসব ব্যবসায়ীর লিস্ট আছে। তবে এসবে কোন লাভ হবে বলে মনে হচ্ছেনা। আমাদের লোকবল, অর্থবল দুটোই এই মুমুর্তে যথেষ্ট দুর্বল।’

জাফর মাথা দুলিয়ে বলে, ‘চারদিক থেকে আটকে গেছি
আমরা রুদ্র। মুক্তির কোন পথ দেখছি না আমি।’

এতক্ষণ মনোযোগী শ্রোতার মত সবটা শােনার পর রুদ্র বলল, ‘একটাই পথ খোলা আছে। আর সে অনুযায়ী কাজ শুরু করে দিয়েছি আমি।’

ভ্রু কুঁচকে গেল উচ্ছ্বাসের। সাগ্রহে জানতে চাইল, ‘সেটা কী?’

‘সেইসব অ-স্ত্রগুলো। বাবার সাইন করার পর ডিলটা ব্লাক হােল আর ডার্ক নাইট জয়েন্টলি নিয়েছে। অর্থাং রেগুলারলি মাল ডেলিভারী হচ্ছে। ওরা কৌশলে আমাদের মালগুলো বদলে দিতো। কিন্তু আমরা ছিনিয়ে নেব। ওদের মতাে কাপুরুষ নই কি-না। আর সময়মতোে ক্লাইন্টদের হাতে যখন মাল পৌঁছবে না। তখন ওদের অবস্থাটাও আমাদের মতোই হবে।’

উচ্ছাস বলল, ‘কিন্তু আমাদের লোকজন কম।ছিনিয়ে নেওয়াটা সহজ হবেনা।’

রুদ্র শক্ত কন্ঠে বলল, ‘কোনকিছুই এখন সহজ নয়। তাই বলে চুড়ি পড়ে বসে থাকতে পারব না আমরা।’

জাফর চিন্তিত হয়ে বলল, ‘কিন্তু তার আগেতো আমাদের জানতে হবে মালগুলো কোথায় কোথায় ডেলিভারী হচ্ছে।’

‘রঞ্জু গেছে। আমার বিশ্বাস কোন একটা ইনফরমেশন না নিয়ে ও ফিরবেনা।’

এইটুকুতে আলোচনা শেষ হওয়ার পরেই রুদ্র উচ্ছ্বাসকে প্রশ্ন করল, ‘প্রিয়তাকে সেদিন হসপিটালে যে ধাক্কা দিয়েছিল। তাকে পাওয়া গেছে?’

‘সিসিটিভিতে চেহারাতো দেখেছি আমরা। পেয়ে যাবো
শীঘ্রই।’

‘সেন্টু বা বু-লে-টকে?’

উচ্ছ্বাস চুপ হয়ে গেল। খানিকটা ইতস্তত করে বলল, ‘খু-ন হয়েছে ওরা। আর খুবই খুব নৃশংসভাবে মা-রা হয়েছে। পুরুষা-ঙ্গ থেতলে দেওয়া হয়েছে। চোখ পর্যন্ত উপড়ে ফেলেছে। এভাবে কাজটা কে করল জানতে পারিনি এখনো।’

মধ্যরাত। শহুরে কোলাহল থেকে মুক্ত রাস্তা এটি। রাস্তার দুপাশে সারিসারি গাছ। আশেপাশে মানুষের চিহ্নও দেখা যাচ্ছেনা। ঠিক সেখানেই জিপ থামাল রুদ্র। জিপ থেক নামতেই ঠান্ডা দমকা হাওয়া এসে লাগল গায়ে। শােনা গেল পেঁচার ডাক। আশেপাশে চোখ বুলালো রুদ্র। দৃষ্টিসীমার শেষপ্রান্তে দেখা যাচ্ছে জমাট কুয়াশা। কিন্তু আশেপাশে কোথাও রঞ্জুকে দেখতে না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে গেল ওর। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত একটা পনেরো বাজে। অথচ ঠিক একটায় এখানে থাকার কথা ওর। আর রঞ্জু কখনও দেরী করেনা। সময়টা যখন রুদ্র বেঁধে দেয়, তখনতো একদমই না।

ফোন বের করে রঞ্জুর নাম্বারে কল করল রুদ্র। রিংটোনের আওয়াজে চমকে উঠল ও। আশেপাশে কোন একটা জায়গা থেকেই ভেসে আসছে শব্দটা। শব্দ অনুসরণ করে এগোতে শুরু করে রুদ্র। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর রাস্তার পাশে ঝোপঝাড়ে এসে পৌঁছোয়। ওখানেই একপাশে পড়ে বাজতে দেখল রঞ্জুর ফোনটাকে। ভেতরে ভেতরে কম্পন ধরল রুদ্রর। শুকনো এক ঢোক গিলে ডাকল, ‘রঞ্জু?’

সাড়া না পেয়ে ফোনের টর্চ জ্বা-লালো রুদ্র। ধীরপায়ে ঝোঁপের দিক দিয়ে নেমে আসল। রঞ্জুকে ডাকতে ডাকতে কয়েক কদম এগুতেই পায়ে আটকালো কিছু একটা। নিচে তাকাতেই থমকে গেল রুদ্র। উপুড় হয়ে পড়ে আছে কেউ একটা। রুদ্র আস্তে আস্তে টর্চটা সেদিকে মারতেই চমকে ওঠে র-ক্তাক্ত রঞ্জুকে দেখে। উপুড় হয়ে পরে আছে রঞ্জু। র-ক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীর। পিঠে কয়েকটা ছো-রাঘা-তের গভীর চিহ্ন।
রুদ্র স্তব্ধ হয়ে গেল। হতবাক চোখে কিছুক্ষণ দেখল শরীরটাকে। আস্তে করে রঞ্জুর পাশে বসতেই শুনতে পেল অসহ্য যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে ছেলেটা। হুঁশ এলো রুদ্র। রঞ্জুকে ধরে ঘুরিয়ে নিজের কোলে নিল। এক হাত ওর র-ক্তা-ক্ত গালে রেখে ডাকল, ‘রঞ্জু? রঞ্জু ওঠ, রঞ্জু?’

রঞ্জু আরেকটু জোরে গুঙিয়ে উঠল। রুদ্রর গলা পেয়ে যেন ঝংকার দিয়ে উঠল ওর আহত শরীর। পিটপিট করে তাকাল বহু কষ্টে। রুদ্র বলল, ‘চোখ খোলা রাখ। বন্ধ করবিনা। আমি আছিতো। একদম ভয় পাবিনা। কিচ্ছু হবেনা তোর।’

রঞ্জুর চোখে জল চলে আসে কঠোর রুদ্র ভাইয়ের অমন কোমল স্বর শুনে। আবেগে পরিপূর্ণ গলায় বলল, ‘রু-রুদ্র ভাই।’

‘চুপ কর। এখন কোন কথা না। হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে তােকে।’

রুদ্র ওকে ওঠাতে গেলে শক্ত করে রুদ্রর হাত খামচে ধরে রঞ্জু। অস্ফুট স্বরে বলে, ‘আমি ব-বোধ হয় অ-আর বাঁচমু না রুদ্র ভ-ভাই। আপনার দুঃসময়ে চাইয়াও আর সাথে থাক-থাকতে পারলাম না। ক্ষমা করবেন আমায়।’

‘এক চড় মারব। বললাম না হসপিটালে যেতে হবে। ওঠ!’

রুদ্রর ধমকে আজ থামল না রঞ্জু। জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলে, ‘ইক-ইকবাল ভাই কিছু করেনাই ভাই। ওরা ফ-ফাঁসাইছে ওনারে। ভাবিহ্ ভাবির অনেক ব-বিপদ ভাই। ওনারে বাঁচা_’

এইটুকু বলে থেমে গেল রঞ্জু। খামচে ধরা হাতটা ধীর গতিতে খসে পড়ল নিচে। চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। রুদ্র পাথুরে দৃষ্টিতে দেখল সেই দৃশ্য। চোয়াল শক্ত হল। হাত মুষ্টিবদ্ধ হল।চোখদুটো জ্বলে উঠল ভয়ানকভাবে। কানে ভেসে এলো রাশেদ আমেরের বলা শেষ সেই কথা, ‘সব নিয়ম ভুলে যাও। ভুলে যাও সব কৌশল। শুধু তিনটে শব্দ মনে রাখো। সংহার, সংহার এবং সংহার।’

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here