অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৭৫.

0
9

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৭৫.

যখন বুঝল ঘটনাটা কোন দুঃস্বপ্ন নয়, কঠিন বাস্তব। নিঃশ্বাস নেওয়া দ্বায় হয়ে উঠল ইকবালের। সমস্ত শরীরে কেমন শিরশিরে অনুভূতি ছেঁয়ে গেল। এও সম্ভব! যে মেয়েটাকে দেখলেই মনে সুখের অনুভূতি ছেঁয়ে যতো। যার আগমনে আমের ভিলা নতুন রঙে সেজে উঠেছিল। যার ছোঁয়ায় জীবন্ত থাকতো আমের ভিলার প্রতিটা কোণ। যার চলনে আমের পরিবারে প্রাণ সঞ্চার হতো। যার হাসিতে হেসে উঠতো ওরা। কঠোর, গন্তীর রাশেদ আমেরও যার প্রতি ছিলেন
নমনীয়। পাথর হৃদয়ের রুদ্র আমেরও যাতে বিলীন হয়েছিল। সীমাহীন ভালাবেসেছিল। অতি যত্নে আগলে রেখেছিল নিজের বক্ষকুটিরে। সেই মেয়েটা! সেই মেয়েটাই কি-না সবকিছুর মূল! যে মেয়েটা এই মুহূর্ত ওর সামনে বসে আছে, সে সত্যিই রাশেদ আমেরের একমাত্র পুত্রবধু। রুদ্র আমেরের প্রাণপ্রিয় স্ত্রী। প্রিয়তা!

যে মেয়েটা আমের পরিবারের সৌভাগ্য হয়ে প্রবেশ করেছিল। সেই কি-না আমের পরিবারের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য! এতোটা অভিনয় সম্ভব? প্রিয়তা ঠোঁটে সেই সামান্য হাসি ধরে রেখেই বলল, ‘চিনতে পেরেছেন, ইকবাল ভাই?’

ইকবাল প্রিয়তার চেহারা জুড়ে কিছু একটু খুঁজতে খুঁজতে বলল, ‘আমিহ, আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা।’

প্রিয়তা ঠোঁটের হাসি আরও একটু প্রসারিত হলো, ‘স্বাভাবিক। ব্যপারটা বিশ্বাসযোগ্য হলে দুটো বছর আমি আমের ভিলার প্রিয় রাণী হয়ে থাকতে পারতাম না আমি।’

‘তােমার পক্ষে এসব করা সম্ভব না।’

‘অসম্ভব বলে পৃথিবীতে কিছু নেই।’

‘তারমানে! তারমানে, সত্যিই তুমিই সব করেছো? তখন ওরা যা যা বলল। কুহুর কিডন্যাপিং, রাশেদ বাবার খুন, সােলার সিস্টেমের ভেতরের সব তথ্য পাচার করা, দলটাকে এভাবে শেষ করে দেওয়া। সব?’

প্রিয়তা আরেকটু ঝুঁকে গেল ইকবালের দিকে। ফিসফিসে কণ্ঠে বলল, ‘সব।’

ইকবাল চকিতে চাইল। কান ঝিঁ ঝিঁ করে উঠল প্রিয়তার অকপট স্বীকারোক্তিতে। প্রিয়তা সোজা হয়ে বসল। চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, ‘শুধু তাইনা। পুরো ব্যপারটা আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে; সােলার সিস্টেমের কাছে আপনাকে মীরজাফর তৈরী করার পরিকল্পনাটাও আমারই ছিল। তারজন্যে ক্ষমা করবেন। আর কোন উপায় ছিলােনা আমার কাছে। বড্ড বেশি জেনে ফেলেছিলেন আপনি। এরচেয়ে বেশি জেনে গেলে, ব্যপারটা আমার জন্যে ভালো হতােনা।’

ইকবাল কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। এতো বড় ষড়যন্ত্র! এতাে বড় বিশ্বাসঘাতকতা! হঠাংই উত্তেজিত হয়ে উঠল ইকবাল। ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করার ব্যর্থ এক চেষ্টা করে বলল, ‘কালনাগিনী! রুদ্র নিজের সঙ্গে কালসাপ এনে তুলেছিল বাড়িতে। আর রাশেদ বাবা দুধকলা দিয়ে সেই কালসাপকে পুষেছে। ছিহ্! এতােটা_’

বলতে বলতে কেশে উঠল ইকবাল। শরীরের যন্ত্রণাগুলাে আবারও তীব্রভাবে অনুভব করতে পারল। যার কারণে অবিশ্বাস্য এই মানসিক ধাক্কাটাও সামলাতে পারছেনা সে। কিন্তু ওর বলা তিক্ত বাণী শুনে রেগে গেল সম্রাট। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে জামার হাতা গোটালো। তেড়ে আসতে নিল ইকবালকে মারার জন্যে।

‘সম্রাট!’

প্রিয়তার গম্ভীর ডাকে থেমে গেল সম্রাট। বিরক্তি নিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকাল। কিন্তু প্রিয়তার জ্ব-লন্ত চোখ
দেখে দমে গেল নিজের অজান্তেই। চোখের ইশারায় সম্রাটকে সাবধান করে আবার ইকবালের দিকে তাকাল প্রিয়তা। দেখল, কাশতে কাশতে এখনো নিজেকে সামলানাের চেষ্টা করছে ইকবাল। প্রিয়তা হাঁক ছাড়ল, ‘জয়!’

সঙ্গে সঙ্গে দরজায় চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সী এক ছেলে
এসে উপস্থিত হল। ছিপছিপে গরন, শ্যামলা বরণ, ঝাকরা চুল। চরম অনুগত দাসের মতো বলল, ‘জি ম্যাডাম।’

‘এক গ্রাস পানি নিয়ে এসাে।’ ইকবালের দিকে তাকিয়ে
থেকেই বলল প্রিয়তা।

এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে চলে গেল জয়। বিশ সেকেন্ডেরও কম সময়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। প্রিয়তার কাছ থেকে দু হাত দূরে এসে থামল। মাথা নিচু করে এগিয়ে দিল গ্লাসটা। ইকবাল শুধু প্রিয়তাকেই দেখছে অপলকে। আশেপাশে কোন নজর নেই তার। গ্লাসটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল প্রিয়তা। ইকবালের কাছে এগিয়ে গেল। একহাত রাখল ইকবালের পিঠের ওপর। অপরহাত দিয়ে পানির গ্লাসটা ইকবালের মুখের সামনে ধরল, ‘খুব তেষ্টা পেয়েছে নিশ্চয়ই?’

‘দয়া দেখাচ্ছ?’

‘সেটা আমার মধ্যে নেই বলেই জানি।’

‘তােমার হাতে পানি খেতে রুচিতে বাধবে আমার।’

‘অনেক কিছুই করতে মাদের রুচিতে বাধে ইকবাল ভাই। কিন্তু করতে হয়। বেঁচে থাকার ইচ্ছে আছে নিশ্চয়ই?’

প্রিয়তার দিকে নিস্পলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ইকবাল। প্রিয়তা ইকবালের ঠোঁটের কাছে গ্লাসটা ধরে চোখের ইশারায় বলল খেয়ে নিতে। ইকবাল তর্ক না করে খেয়ে নিল পানিটা। বেঁচে থাকা প্রয়োজন। পানি খাইয়ে ফাঁকা গ্লাসটা জয়ের হাতে দিল প্রিয়তা। মাথা নিচু করেই জায়গাটা ছাড়ল জয়।

প্রিয়তা আবার বসল সেই চেয়ারে। সম্রাটও আর দাঁড়িয়ে থাকল না। আরেকটা চেয়ার টেনে বসল। দীর্ঘসময় পর শুষ্ক গলায় পানি পড়াতে শরীর কেমন ছেড়ে দিল ইকবালের। ধীরে ধীরে শ্বাস নিল। তবে বুঝল কিছুটা শক্তি পাচ্ছে।

ইকবালকে সামলে নিতে সময় দেয় প্রিয়তা। তবে বিষয়টা ভালো লাগল না সম্রাটের। মাথাটা প্রিয়তার দিকে এগিয়ে নিচু গলায় বলল, ‘এতা সময় নষ্ট করছোে কেন? দুটা চড়-থাপ্পড় মেরে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেই হয়।’

প্রিয়তা ইকবালের দিকে তাকিয়ে থেকেই দাঁতে দাঁত পিষে
বলল, ‘তােমাদের কাজের ধারা নিয়ে কোন প্রশ্ন করিনি আমি। যা করেছো, নিজেদের মতো করেছ। সো, আমি যা করব, নিজের মতো, নিজের সিস্টেমে করব। এন্ড আই হােপ, তােমরা তাতে ইন্টারাপ্ট করবেনা। পেনড্রাইভটা পাওয়া অবধি ওর জীবিত থাকা প্রয়াোজন সেটা ভুলে যেওনা।’

সম্রাট বলার মতো কিছু পেলনা। ভুল বলেনি মেয়েটা। প্রিয়তা প্রায় দু মিনিট পর মুখ খুলল, ‘পেনড্রাইভটা.কোথায় ইকবাল ভাই?’

ইকবাল ক্লান্ত, দুর্বল হাসি হেসে বলল, ‘তােমার সত্যিই মনে হচ্ছে আমি বলব?’

‘হচ্ছেনা। তবে কী বলোতাে, একটু ফর্মালিটি করতে হয়। সেটুকুই করলাম। তবে বলে দেওয়াটা তােমার জন্যেই মঙ্গল।’

‘তুমি! সন্বােধনটা বদলে গেল দেখছি। যাই হোক, এমনিতেও কোন মঙ্গলের আশা আমি আর করিনা প্রিয়তা।’

‘স্বার্থহীন হয়ে এ জগতে কোন লাভ হয়না ইকবাল ভাই। আমার কথা শোন। বলে দাও পনড্রাইভটা কোথায় আছে। ব্লাক হোল বা ডার্ক নাইট কোনটাই জয়েন করতে হবেনা তোমাকে। শুধুমাত্র আমাদের কাজটা হয়ে যাওয়ার আগ অবধি তােমাকে আটকে রাখব আমরা। তবে ওরা তােমার ওপর কোনরকম টর্চার করবেনা। খাবার, শোবার জায়গা সবটাই পাবে। আরামে থাকবে। সময়মতো মুক্তিও পাবে। শুধুশুধু এতাে কষ্ট সহ্য করে কী লাভ?’

‘সেটা বোঝার ক্ষমতা তোমার মতাে বিশ্বাসঘাতিনীর নেই। একটুও অনুশোচনা নেই তাোমার মধ্যে!’

প্রিয়তা ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। বলল, ‘আনুশােচনা! এথিকস! ক্রিমিনালদের মুখে এথিকসের গল্প মানায় ইকবাল ভাই? আমরা দুটো দলই অপরাধী। অপরাধ জগতে কাজ করি। এখানে সবাই পাপে পূর্ণ। বিশ্বাসঘাতকতা করে পাপের ডিগ্রীটা একটুখানি বাড়িয়েছি এই আরকি। কথায় আছেনা, এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড অয়ার।’

ইকবাল অবাক হয়ে দেখল প্রিয়তার নির্লিপ্ততা। কিছু একটা চিত্তা করে বলল, ‘অনেক হিসেব আমার এখনো মিলছেনা প্রিয়তা। যদি ধরেও নেই তুমিই সবকিছুর পেছনে আছো। তবে এতোদিনেও রুদ্র বা রাশেদ বাবার কাছে ধরা পরলেনা কীকরে? এটাও সম্ভব? নিজেরই ঘরে একজন এতােকিছু করছে। অথচ তারা টেরটি পা্ছেনা! প্রথমত, তােমার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার আগে রাশেদ বাবা নিজে গিয়েছিলেন সেই অনাথ আশ্রমে। তােমার সমস্ত ব্যাকগ্রাউন্ড তার নখদর্পনে ছিল। যা আমিও দেখেছি। আর সেই রেকর্ড, ইনফরমেশন অনুযায়ী কোনভাবেই কোন দলের সঙ্গে যুক্ত থাকা সম্ভব নয় তােমার পক্ষে। দ্বিতীয়ত, আমের বাড়ির বউ তুমি। তােমার সুরক্ষার জন্যে কোনভাবেবই তোমাকে একা ছাড়া হতােনা। ভার্সিটি বা মল যেখানেই বের হতে তােমার সঙ্গে গার্ড যেতো। আর দেখা সাক্ষাৎ এতো প্লানিং, প্লটিং কারাে পক্ষ করা সম্ভব না। তুমি সেসব কীকরে করতে। কী দেখা করতে দলের লোকেদের সঙ্গে? কীকরে যােগাযােগ করতে?’

সম্রাট প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে হাসল। প্রিয়তা কৌতুকপূর্ণভাবে বলল, ‘ম্যাজিক!’

সম্রাট শায় দিয়ে বলল, ‘ঠিক রাশেদ আমেরের মৃত্যর মতাে।’

গা-পিত্তি জ্বলে উঠল ইকবালের। যখন মনে পড়ল সামনে বসে থাকা এই মেয়েটা রাশেদ আমেরের খু-নি। সবকিছু জ্বা-লিয়ে দিতে ইচ্ছে করল। রেগে গিয়ে বলল, ‘সত্যিই তুমি কালনাগিনী! কীকরে পারলে রাশেদ বাবাকে খু-ন করতে! আরে ঐ মানুষটা নিজের মেয়ের মতোে আগলে রেখেছিল তােমাকে। ভালোবাসা দিয়েছিল। বিশ্বাস করে আমের ভিলার অন্দরমহল তুলে দিয়েছিল তোমার হাতে। “প্রিয়তা মা” বলে ডাকতো তােমাকে। একবারও হাত কাঁপলােনা তােমার। সর্বনাশিনী!’

সম্রাট আর চুপ থাকলােনা এবার। বিশ্রী এক গালি দিয়ে বলল, ‘তোর রাশেদ বাবাও জীবনে অনেককে খু-ন করেছিল। তার হাত কেঁপেছে, কু-ত্তারবাচ্চা!’

সম্রাটের গালিকে পাত্তা দিলোনা ইকবাল। প্রিয়তার দিকে ঘৃণাভর্তি চোখে তাকিয়ে বলল, ‘তখন ওরা বলছিল তুমি না-কি গর্ভবতী ছিলে? রুদ্রর সন্তান ছিল তােমার গর্ভে। নিজের স্বার্থে নিজের সন্তানকেও শেষ করলে? রাক্ষুসী নাকি তুমি!’

প্রিয়তা অনুভূতিহীন চোখে তাকিয়ে রইল ইকবালের দিকে। প্রায় একমিনিটের নীরবতার পর বলল, ‘পেনড্রাইভাটা কোথায় আছে বলে দিন ইকবাল ভাই। শেষবারের মতো ভালােভাবে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে আপনাকে।’

প্রিয়তার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ইকবাল। এতোটা অনুভূতিহীন এই মেয়ে! ওর দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে হর্টলেস মানুষ হল রুদ্র আমের। এই মেয়েটা কী তার চেয়েও বেশি? অনেককিছু খুঁটিয়ে ভাবার পর হঠাৎই কেঁদে ফেলল ইকবাল। অনুরোধের স্বরে বলল, ‘এমন করােনা প্রিয়তা। রুদ্র প্রচণ্ড ভালাবাসে তোেমাকে। এই সত্যি যদি কোনভাবে ও জানতে পারে, ভেতর থেকে একদম গুড়িয়ে যাবে। ছােটবেলা থেকেই প্রচুর কষ্ট পেয়েছে ওপ্রিয়তা। ওর নিজের বলতে এখন কেবল তুমিই আছাে। তােমাকে ওর খুব প্রয়াজন। এখনো সময় আছে। তুমি সব ছেড়ে রুদ্রর কাছে ফিরে যাও। ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখাে ওকে। ছেলেটাক এভাবে শেষ করে দিও না বােন। যেভাবেই হোক, একসময় ভাই বলে ডেকেছো তুমি আমাকে। ছোট বোন হিসেবে অনুরোধ করছি। ফিরে যাও।’

প্রিয়তা নিস্পলক কিছুক্ষণ দেখল ইকবালকে। অতঃপর কাঠকাঠ গলায় বলল, ‘এজগতে সব সম্ভব হলেও “ফিরে আসা” ব্যপারটা সম্ভব না। সেটা আপনার চেয়ে ভালো কে জানে ইকবাল ভাই?’

‘একটা ছেলেকে অনবরত ঠকিয়ে যাচ্ছো। যে তােমার স্বামী। বিন্দুমাত্র কষ্ট হচ্ছেনা তােমার!’

‘ঐযে বললাম, এত্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড অয়ার।’

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল ইকবাল। বলল, ‘লাভ! তোমার কী মনে হয়? তােমার এই সত্যিটা জানার পর রুদ্রর মনে বিন্দুমাত্র ভালোবাসা থাকবে তামার জন্যে? তােমার চেহারা দেখতেও ঘৃণা হবে ওর। ঘৃণা করবে তােমাকে। শুধুই ঘৃণা।’

আচমকাই মুখভঙ্গি বদলে গেল প্রিয়তার। এতক্ষণের সেই শান্ত ভাব খসে পড়ল চেহারা থেকে। জ্ব-লে উঠল সম্মােহনী চোথদুটো। কিছুক্ষণ আগেও সম্রাটকে মারতে বারণ করেছিল। সেই প্রিয়তাই চেপে ধরল ইকবালের ক্ষতবিক্ষত হাতটা। যন্ত্রণায় গুঙ্গিয়ে উঠল ইকবাল। থুতনিতে হাত রেখে হাসল সম্রাট। এতক্ষণে ব্যপারটা উপভােগ করছে
সে।
প্রিয়তা আরও শক্ত করে ইকবালের হাতটা চেপে ধরে ঝুঁকলাে। হাতের পি-স্তলটা ঠেসে ধরল ইকবালের কপালে। ঘনঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে অস্থির কণ্ঠে বলল, ‘এসব বলেনা ইকবাল ভাই! সব সহ্য হলেও এই কথাগুলা একদম সহ্য হয়না আমার। একদম না।’

অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে প্রিয়তার দিকে তাকাল ইকবাল। অদ্ভুত হিংস্রতায় জ্বলজ্বল করছে প্রিয়তার চোখজোড়া। মুখজুড়ে অদ্ভুত উন্মাদনা। এই সেই প্রিয়তা যার চোখ জুড়ে কেবল মায়া ছিল? যার সুন্দর মুখটা দেখলে প্রশান্তিতে বুক ভরে যতো? এই মুহুর্তে সাক্ষাৎ উন্মাদ, বিনাশিনী মনে হচ্ছ ওকে। যে কেবল ধবংস করতে জানে। কেবল ধ্বংস! দুলতে থাকা বাল্বের আলোয় আরও ভয়ানক লাগছ সে দৃশ্য। দাতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করছে ইকবাল। না চাইতেও গুঙ্গিয়ে উঠছে সে।
হঠাৎ আস্তে করে হাত সরিয়ে নিল প্রিয়তা। পি-স্তল নামাল। লস্বা শ্বাস ফেলে সামলে নিল নিজেকে। থমথমে গলায় বলল, ‘তাহলে তুমি বলবেনা পেনড্রাইভ কোথায়?’

‘মরে গেলেও না।’

জেদ চেপে গেছে ইকবালের মাথায়। প্রিয়তা উঠে দাঁড়াল। আফসোসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘বেশ। যেমন তোমার ইচ্ছা। আমি তামার কষ্টটা কমাতে এসেছিলাম। কিন্ত তােমার যখন সে ইচ্ছে নেই। আমিও আর সেই চেষ্টা করলাম না। আমিও দেখি, ইকবাল ভাই আর কতটা কষ্ট সহ্য করতে পারে।’

সম্রাটও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তােমাকেতো আগেই বলেছিলাম ভালো কথায় শোনার লোক এ নয়। একে দিনরাত চাপকে সোজা করতে হবে। তুমিই শুনছিলে না আমার কথা।’

উত্তর দিলােনা প্রিয়তা। ইকবালের দিকে একপলক তাকিয়ে বেরিয়ে গেল ঘরটা থেকে। সম্রাটও প্রিয়তার পেছন পছন বের হল।
হতভম্ব হয়ে ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল ইকবাল। জুতোর শব্দ মিলিয়ে যেতেই মনে হল ভয়ানক কোন দুঃস্বপ্ন দেখে উঠেছে ও। খুব ভয়ানক। এটা সত্যিই প্রিয়তা ছিল? প্রিয়তা! সেই কোমল, সুন্দর, ফুলের মতো মেয়েটার আসল রূপ কি-না এতাে হিংস্, ভয়ানক! এতো নিখুত অভিনয়! যেখানে ওর নিজের এই নিষ্ঠুর সত্যিটা মানতে কষ্ট হচ্ছে। সেখানে রুদ্র কীকরে সহ্য করবে? কীকরে মানবে, তার ভালােবাসার মানুষটাই তার বিনাশের কারণ? কী ঘটবে, যখন প্রিয়তার আসল রূপ রুদ্রর সামনে আসবে?

ভাজ করা কাগজটা খুলে কিছুই পেলোনা রুদ্র। ব্যপারটা হজম হলােনা ওর। কিছ্ছু নেই! এতো পরিশ্রম করে, বালিশ কেটে, ভেতরে একটা ফাকা কাগজ কেন রাখবে ইকবাল? নিশ্চয়ই এর পেছনে কিছু আছে। কোন সংকেত, কোন ক্লু। কিন্তু কিছুই তো নেই এখানে। কাগজটা আরও একবার নেড়ে দেখেও কিছু পেলনা। রাগ হল রুদ্রর। ধৈর্য্য হারালো। একটানে ছিড়ে ফেলল বালিশটা। তুলােগুলা এলােমেলা করে ছড়িয়ে ফেলল চারপাশে। একদফা তান্ডব করে চাদরহীন তোষকের ওপর থম মেরে বসে রইল ও।
মানসিকভাবে ক্লান্ত বোধ করছে এই মুহুর্তে রুদ্র। একা আর কত লড়বে ও? এমন কেউ নেই যাকে ও ওর মনের কথা বলতে পারে। নিয়তি ওকে এমন পরিস্থিতিত এনে দাঁড় করিয়েছে যে আশেপাশের বাতাসকেও বিশ্বাস করে উঠতে পারছেনা ও। রাশেদ আমেরের কথা মনে পড়ছে ভীষণ। ঐ লোকটা বেঁচে থাকলে কতটা হালকা বোধ করতো রুদ্র আজ। ঐ মানুষটা ওর কতবড় ভরসার জায়গা ছিল সেটা এখন
উপলব্ধি করতে পারে রুদ্র। লােকটা চিরকালের মতো চলে যাওয়ার পর।

হাতের দিকে চোখ যেতেই ব্রেসলেটটা দেখল। প্রিয়তা উপহার দিয়েছিল এই ব্রেসলেটটা ওকে। প্রিয়তার কথা মনে পড়তেই বুকের মধ্যে খাঁ খাঁ করে উঠল রুদ্রর। ঐ মেয়েটা কাছে থাকলেও আজ এতো ভার লাগতোনা ওর। নির্দ্বিধায় মনের সব অশান্তির কথা বলতে পারতো নিজের প্রিয়কে। একমাত্র প্রিয়তাইতো আছে, যাকে কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই সব বলতে পারে। ওর একমাত্র ভয়সার জায়গা। দু হাতে মুখ চেপে ধরে উঁবু হল রুদ্র। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কোথায় আছো প্রিয়? আই নিড ইউ। আই ইউ ব্যাডলি!’

পাবটা সম্রাটের নিজস্ব। করিম তাজওয়ার নিজের এই পাবটা লিখে দিয়েছিলেন সম্রাটের নামে। সেই পাবেরই আলাদা প্রাইভেট রুমে, নরম, দামি কাউচে বসে আছে প্রিয়তা। বসে আছে বলতে, গা ছেড়ে হেলান দিয়ে আছে বলা যায়। ফোন স্ক্রোল করে চলেছে নিরুংসুকভাবে। পাশের রুমে তীব্র শব্দে গান বাজছে, নাচ হচ্ছে। ডিস্ক লাইটের আলােয় জাকজমক পরিবেশ।

হুইস্কির দুটো বোতল নিয়ে এলো সম্রাট। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। বােতলদুটো রাখল টি-টেবিলে। প্রিয়তার পাশে বসে আরেকবার তাকাল ওর দিকে। কিন্তু প্রিয়তার সম্পূর্ণ মনোযোগ তার মােবাইলে। সম্রাট দুটো গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে বলল, ‘রুম বুক করব একটা?’

লস্বা একটা হাই তুলল প্রিয়তা। অলস ভঙ্গিতে ফোনটা নামিয়ে রাখল। ড্রিংকের গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলল, ‘দরকার নেই। বাকি রাতটা এখানেই থাকবো।’

‘তােমাকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। আই থিংক ঘুম দরকার ছিল
তােমার। রুম বুক করে দিতে পারি তোমাকে।’

‘শরীরটা আমার সম্রাট। আমি জানি আমার কী দরকার।’

‘তুমি কী আপসেট কোনকারণে?’

নিজের গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলল সম্র্রাট। বিরক্ত হয়ে সম্রাটের দিকে তাকাল প্রিয়তা, ‘বেশি কথা বলছোনা?’

সম্রাট আর ঘাটালা না প্রিয়তাকে। গ্লাসে একটা চুমুক.দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট খুলল। দূটো সিগারেট বের.করে একটা এগিয়ে দিল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা দক্ষ হাতে ডান হাতের দু আঙ্গুলের মাঝে নিল সিগারেটেটা। বাঁ হাতে.চুমুক দিল হুইস্কিতে। লাইটার দিয়ে নিজের আর প্রিয়তার সিগারেট জ্বা-লিয়ে দিল সম্রাট। বলল, ‘তুমি আজ সেভাবে জিজ্ঞেস করলেনা ইকবালকে।’

‘কোনভাবে জিজ্ঞেস করা বাদ রেখেছো কী? বলেনিতো। আর আমার মনে হয়না বলবে।’

‘না বললে পরিণতি কী হবে তোমার অজানা নয়। তবুও এতাে নির্বিকার কীকরে?

‘অযথা চিন্তা করে মাথা নষ্ট করতে চাইছিনা। এমনিতেও মাথা নষ্ট করার অনেক কারণ আছে। যেকোন সময় রুদ্র আমাকে খোঁজা শুরু করে দেবে। নিরাপত্তার জন্যে পেছনে লোক লাগাবে। সেটা কীকরে সামলাব আপাতত সেটা ভাবতে দাও।’

বলে সিগারেটে টান দিল প্রিয়তা। চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল। সম্রাট বলল, ‘তার আগেই ওকে সরিয়ে ফেলছিনা কেন আমরা?’

প্রিয়তা কিছু বলল না। আরও দুটো টান দিয়ে সিগারেটটা গুজে রাখল অ্যাশট্রেতে। পানসে গলায় বলল, ‘সিগারেটের ব্র্যান্ডটা চেঞ্জ করবে। খুব বাজে। রুদ্রর সিগারেটের ব্র্যান্ডটা চমৎকার। ট্রায় করতে পারো।’

চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল সম্রাটের। কিন্তু সামলে নিল নিজেকে। জোরপূর্বক একটু হেসে বলল, ‘তােমাকে সত্যিই ক্লান্ত মনে হচ্ছে। আমরা একটা রুম বুক করি।’

প্রিয়তা একঢোকে ফাঁকা করল গ্লাসটা। উঠে দাঁড়াল। কপাল কুঁচকে বলল, ‘ড্রিংকের ব্রান্ডটাও ঠিকঠাক আনতে পারোনি। বাজে টেস্ট। আমি চেঞ্জ করে নিয়ে আসছি।’

বলে বােতল দুটো নিয়ে চলে গেল প্রিয়তা। প্রিয়তার যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সম্রাট। নিজের গ্লাসটাও ফাঁকা করল এক নিঃশ্বাসে। শব্দ করে গ্লাসটা টি-টেবিলে রেখে দাঁতে দাঁতে পিষল। আনমনে বলল, ‘তােমার পছন্দের ব্র্যান্ডগুলো বঙ্ড বেশি পরিবর্তনশীল রাণী!’

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here