অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৮৯.

0
7

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৮৯.

বিভ্রান্ত বোধ করছে তমাল। গাড়ি থামিয়েছে। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাত্র আটটা বাজতে চলল অথচ চারপাশটা একদম সুনসান। নির্জনতার মাঝে হঠাৎ হঠাৎ আশপাশ থেকে বিচিত্র আওয়াজ ভেসে আসছে। মৃদু শীতল বাতাসে শিউরে উঠছে শরীর। এখন আর দেখতে পাচ্ছেনা শওকতের গাড়িটা। যথেষ্ট দূরত্বে থেকে গাড়ি চালানোতে হারিয়ে ফেলেছে শওকতের গাড়ি। উন্নত রাস্তা ছেড়ে অনেকটা ভেতরে চলে এসছে ওরা। সোডিয়ামের আলো নেই এখানে। হেডলাইটও জ্বালাতে পারছেনা। ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সুতরাং আঁধার রাস্তায় বাড়াতে পাড়ছেনা গাড়ির স্পিডও। চারপাশে এলোমেলো দৃষ্টিতে চোখ বুলাল তমাল। ড্রাইভিং সিটে বসা অফিসারকে বলল, ‘কী মনে হচ্ছে? কোনদিকে গেছে?’

অফিসারও তীক্ষ্ম চোখে দেখে নিলেন আশেপাশটা, ‘বুঝতে পারছিনা কিছু।’

‘ হেডলাইটটা অন করতে হবে মনে হচ্ছে।’

‘ যদি দেখে ফেলে?’ পেছন থেকে বলল একজন।

দ্বিধাগ্রস্ত তমাল আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টি বজায় রেখে বলল, ‘আর কোন অপশনতো দেখতে_’

কথাটা শেষ করতে পারল না তমাল। তার আগেই বুকপকেটে ভাইব্রেট করে উঠল ওর ফোন। তুহিনের কল। সময় ব্যয় না করে সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করল তমাল, ‘জি স্যার?’

‘ অনেকক্ষণ যাবত তোমাদের লোকেশন স্টিক করে আছে। কী সমস্যা?’

‘ গাড়িটা আমরা হারিয়ে ফেলেছি স্যার। অনেক দূর থেকে ফলো করতে হচ্ছিলো আমাদের। হেডলাইটও জ্বালাতে পারিনি তাই_’

দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল তুহিন। লুকিং গ্লাসে দৃষ্টি ফেলে দেখে নিলো ফলো করতে থাকা গাড়িটার অবস্থান। মস্তিষ্ক দ্রুত কাজ করছে। হঠাৎ কিছু একটা মাথায় খেলে যেতেই বলল, ‘হেডলাইট অন কর।’

থতমত খেয়ে গেল তমাল। দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে বলল, ‘আমিও সেটাই ভেবেছিলাম স্যার। কিন্তু _’

তুহিন শক্ত কন্ঠে বলল, ‘যা বলছি তা করো। শওকত মীর্জার গাড়িটা যদি চলমান থেকে থাকে তবে অনেকদূর চলে গেছে। আর তা না হলে আমাদের দুর্ভাগ্য। রিস্ক একটা নিতেই হবে। হেডলাইট অন করো!’

হেডলাইট জ্বালালো তমাল। জানালো, ‘করেছি স্যার।’

‘ রাস্তাটা নিশ্চয়ই নির্জন? আর মাটির রাস্তা রাইট?’

‘ জি স্যার।’

‘ আজ সারাদিন ঘন কুয়াশা ছিল। কিছুক্ষণ আগে ঠান্ডা গুড়িগুড়ি বৃষ্টিও হয়েছে। ঐ এরিয়ার মাটি অনেকটা আলগা আর নরম। শিশিরে আর বৃষ্টির পানিতে ভিজে যাওয়ার কথা। ভালোকরে রাস্তাটা লক্ষ্য করে দেখো। শওকতের গাড়ির চাকার ছাপ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’

‘ ওকে স্যার।’

সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে রাস্তায় তাকাল তমাল। হেডলাইটের আলোতে ভালোভাবে লক্ষ্য করল জায়গাটা। হ্যাঁ, দেখতে পেয়েছে সে। স্পষ্ট না, কিন্তু ভালোভাবে দৃষ্টি ফেললেই বোঝা যায় চাকার দাগ। তমাল ধাতস্থ হয়ে বলল, ‘ ইয়েস স্যার! চাকার দাগ দেখতে পেয়েছি।’

‘ গুড! ফলো করে। যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছাও সেখানে। মাইন্ড ইট, ভুল করেও যেন আজকের টার্গেট মিস না হয়!’

‘ রাইট স্যার। কিন্তু আপনি কতদূর আছেন স্যার?’

‘ কাছাকাছিই। কিন্তু কতক্ষণে পৌঁছতে পারব বুঝতে পারছিনা।’

তুহিনের কথার অর্থ বুঝতে সক্ষম হলোনা তমাল। ভ্রুদ্বয় কিঞ্চিৎ কুঁচকে বলল, ‘ মানে স্যার?’

তুহিন আরও একবার তাকাল লুকিং গ্লাসে। গম্ভীর স্বরে বলল, ‘কিছু লোক ফলো করছে আমাকে। সম্ভবত অ‍্যা-টা-ক করবে। চেষ্টা করব ঝামেলাটা এড়িয়ে যাওয়ার। যদি তা না পারি তবে ওখানকার পরিস্থিতিকে তোমাকেই সামলাতে হবে। এসব নিয়ে এখন মাথা ঘামিও না। ফলো করো! গন্তব্যে পৌঁছে কল করবে আমাকে। যদি আমি রিসিভ না করি, তোমরা নিজেরাই করবে যা করার। মনে থাকবে?’

মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল তমালের। ভীষণ চিন্তা হল বসের জন্যে। কিন্তু প্রফেশনালিজম বজায় রেখে বলল, ‘জি স্যার।’

তুহিন কল কেটে দিয়েছে। তমাল নিজের কান থেকে ফোন নামল। মনে মনে প্রার্থনা করল তুহিনের জন্যে। লম্বা শ্বাস ফেলে পাশে বসা অফিসারকে বলল, ‘গাড়ি স্টার্ট করো।’

তুহিন লুকিং গ্লাসে গাড়িটাকে দেখে চলেছে। ক্রমাগত দূরত্ব কমে আসছে। স্পিড বাড়িয়ে দিলো তুহিন। কোনরকম ঝামেলা ছাড়াই ব্যপারটা এড়িয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা করে দেখতে চাইল ও। কিন্তু লোকগুলো ঝামেলা করতে উৎসাহি। তাইতো তুহিন স্পিড বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তারাও বাড়িয়ে দিল গাড়ির স্পিড। হতাশ নিশ্বাস ফেলল তুহিন। আরও বাড়িয়ে দিল গাড়ির স্পিড। প্রতিপক্ষও তাই করল। রাস্তাটা খুব বেশি ভালো না। এভাবে গাড়ি চালানোটা রিস্কি হয়ে যাচ্ছে ভীষণ। কিন্তু কিছু করার নেই।

কিছুক্ষণ চলল গতির এই খেলা। প্রতিপক্ষ বোধ হয় বেশিক্ষণ ধৈর্য্য ধরতে পারলেন না। গাড়ির পেছনের গ্লাস চূর্ণবিচূর্ণ করে একটা বু-লে-ট চলে গেল তুহিনের কানের ঠিক দুই ইঞ্চি পাশ দিয়ে। দমবন্ধ করে ফেলল তুহিন। গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখল ভীষণ কষ্টে। গাড়িতে আরও একটা বু-লে-ট লেগেছে বলে টের পেল ও। স্পিড আরও বাড়াল তুহিন। কিন্তু লাভ হলোনা। কারণ এবারের বুলেটটা এসে লাগল সোজা গাড়ির পেছনের টায়ারে।
সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল তুহিনের গাড়িটা। মাথাটা স্টেয়ারিংয়ে লাগতে লাগতে বেঁচে গেল। লুকিং গ্লাসে তাকাল তুহিন। নেমে আসছে লোকগুলো। তুহিন সময় নষ্ট করল না। দরজা খুলে লাফিয়ে নামল গাড়ি থেকে। এক লাফে রাস্তা থেকে নেমে দৌড়ে চলে গেল ঝোপের আড়ালে। এরমধ্যে আরও দুইবার গুলি ছোড়া হলো তুহিনকে লক্ষ্য করে। কিন্তু তুহিনের গতি চলমান থাকায় লক্ষ্য ব্যর্থ হলো।

তুহিন উঁকি দিয়ে দেখল চারজন আছে এরা। চারজনই রাস্তা থেকে লাফিয়ে নিচে নামল। তুহিনের অবস্থান কোথায় বোঝার চেষ্টা করছে। প্রত্যেকের হাতে বন্দুক। বেশি লোক পাঠায়নি তবে। পেছনের হোলস্টার থেকে নিজের বেরেটা বের করে নিল তুহিন। লোড করল।

রুদ্রর বলা ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছলো শওকত মীর্জা। জায়গাটা খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়েছে বেশ! এটাতো আর সেক্টরের গলিতে নাম্বারপ্লেট লাগানো বিল্ডিং নয়। জনবহুল এলাকা থেকে দূরে। নির্জন এক রাস্তা পাশে বিশাল বাগান। সেই বাগানের অপরপাশে তুলে দেওয়া একটা দুই রুমের টিনের ঘর। গাড়িটাও রেখে আসতে হয়েছে কিছুটা দূরে। রুদ্রর দেওয়া বিস্তারিত বিবরণ স্বরণ করে শওকত বুঝল এটাই সেই জায়গা। প্রচণ্ড রাগে দাঁতে দাঁত পিষল শওকত। একমাত্র ছেলের জন্যে হাহাকার করে উঠল বুকের ভেতর। দ্রুত এগিয়ে গেল ঘরটার দিকে। ভেতরে ঢোকার একটাই দরজা। ভেতরে হলুদ বাল্বের লাইট জ্বলছে। শওকত ঘরে ঢুকতেই খুলে গেল দরজাটা। উদভ্রান্তের মতো ঢুকে গেল ভেতরে। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই পা থমকে গেল শওকত মীর্জার। তার ঠিক বরাবর থাকা টিনের বেড়ার মোটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে শানকে। সারা শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। বোঝাই যাচ্ছে অমানুষের মতো নির্যাতন করা হয়েছে শানের ওপর। ঝিমছে। প্রায় অবচেতন। কিন্তু শওকতের উপস্থিতি টের পেতেই কোনমতে মাথা তুলল শান। অসহায় গলায় বহু কষ্টে উচ্চারণ করল, ‘বাবা!’

বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল শওকত মীর্জার। চোখ সিক্ত হল। র-ক্ত যেন টগবগ করে ফুটল। রাগে, ঘৃণায় কুঁচকে উঠল মুখটা। রুদ্র নামক ছেলেটাকে পায়ের তলে পিষে ফেলতে ইচ্ছা করল। জঘন্যভাবে আহত ছেলের কাছে ছুটে যেতে চাইছিল শওকত। হাতে ধরা স্ট্রেচারে ভর দিয়ে এগোতেই যাচ্ছিল। কিন্তু বাঁধা পেল পরিচিত কন্ঠস্বরে।

‘ একপাও এগিও না মীর্জা। তোমার পা ঐ পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই আমার বু-লে-ট তোমার ছেলের মগজ অবধি পৌঁছে যাবে।’

থেমে গেল শওকত মীর্জা। শব্দ অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখল পাশের ঘরে যাওয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র আমের। হাতে এম.টি. 9। শওকত ক্ষীপ্ত চোখে তাকাল রুদ্রর দিকে। দু-কদম এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘শু*রের বাচ্চা! তোকে পুঁতে ফেলব আমি।’

সামান্য হাসল রুদ্র। পাত্তা দিলোনা শওকতের হুমকিকে। দরজা ছেড়ে শওকতের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, ‘আটটায় আসতে বলেছিলাম আপনাকে। আপনিতো আধঘন্টা আগেই চলে এলেন! পাঞ্চুয়ালিটিটা একটু বেশি হয়ে গেলোনা মীর্জা? নাকি রক্তে মিশে থাকা বেঈমানী মনের সঙ্গ দিচ্ছেনা?’

হিংস্র বাঘের মতো গর্জে উঠল শওকত। বলল, ‘এই র-ক্তের বেঈমানীই তোকে কুত্তার মতো মারবে হা-রা-মজাদা!’

থেমে গেল রুদ্রর পা। শুষ্ক, তামাটে ঠোঁটে বেদনাত্মক হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘এইজন্যইতো এই রক্তের বীজসহ উপড়ে ফেলব আজ আমি।’

শওকত অশ্রাব্য এক গালি ছেড়ে বলল, ‘তারজন্যে আগে বেঁচে থাক।’

চোখের পলকে একটা পিস্তল বের করে ফেলল শওকত। তাক করল রুদ্রর কপাল বরাবর। ট্রিগারে আঙুল চাপতেই যাচ্ছিল কিন্তু থামতে হলো তাকে। কারণ তারচেয়েও দ্রুতগতিতে চলেছে রুদ্রর হাত। ওর হাতে থাকা এম.টি.নাইনের মুখটা উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে অর্ধচেতন শানের দিকে। রুদ্র বলল, ‘এমন ভুল করোনা মীর্জা! আমার টার্গেট সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা আছে তোমার।’

থতমত খেয়ে গেল শওকত। দ্রুত নামিয়ে ফেলল নিজের পিস্তল। উদ্ভ্রান্ত গলায় বলল, ‘খবরদার রুদ্র! খবরদার!’

‘ পিস্তল নিচে রাখো!’ থমথমে গলায় আদেশ করল রুদ্র।

‘ রুদ্র_’

‘ নিচে!’

খানিক ইতস্তত করল শওকত। আহত ছেলের দিকে একপলক তাকিয়ে বাধ্য হয়েই নিচে নামিয়ে রাখল নিজের পিস্তল। রুদ্র স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হুকুম করল, ‘পা দিয়ে ছুড়ে দাও এদিকে।’

রুদ্রর দিকে হিংস্র চোখে তাকাল শওকত। লাথি মেরে পিস্তলটা এগিয়ে দিল রুদ্রর দিকে। রুদ্রর পায়ের একহাত দূরে গিয়ে থামল তা। পিস্তলটা তখনই তুলল না রুদ্র। শওকতের দিকে তাকিয়ে থেকেই আদেশ দিল, ‘চুপচাপ তোমার পেছনের পিলারটার সঙ্গে ঘেঁষে বসে পড়ো।’

শওকত দাঁতে দাঁত পিষল। অধৈর্য দৃষ্টিতে একবার তাকাল ঘরে ঢোকার দরজাটার দিকে। অতঃপর রুদ্রর কথা মতো পিলার ঘেঁষে বসে পড়ল নিচে। এবার পিস্তলটা তুলে নিল রুদ্র। প্যান্টের পেছনে গুঁজে রাখতে রাখতে এগিয়ে গেল শওকতের দিকে। এক হাঁটু ভেঙে ঠিক শওকতের মুখোমুখি বসল। শকুনের দৃষ্টিতে রুদ্রর তীক্ষ্ম চোখের দিখে তাকাল শওকত। রুদ্রর দৃষ্টি শীতল, কিন্তু ক্রোধে পূর্ণ। আড়চোখে একবার বন্দি শানের দিকে তাকাল রুদ্র। পুনরায় শওকতের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে বলল, ‘অনুভূতিটা খুব বেশি পরিচিত মনে হচ্ছেনা মীর্জা? এইতো মাস তিনেক আগে; এমনই এক রাত সম্পূর্ণ জেগে কাটিয়ে দিয়েছিল এক বাবা। তোমার মতোই চিন্তায়, যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। আর তারপরদিন সকালে তাকে কী দেখতে হয়েছিল মনে পড়ে? ঘটনা, অনুভূতি সব কতটা পরিচিত। আপন আপন লাগছে না?’

কটমটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শওকত মীর্জা। চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝড়ছে। রুদ্র ঠোঁটে তিক্ত এক হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া। ব্যপারটা শুনেছেন নিশ্চয়ই?’

শওকত রুদ্রর চোখে চোখ রেখে বলল, ‘সে হিসেব করতে গেলে তোমার একটা পা’ও কিন্তু কাঠের হওয়া উচিত।’

রুদ্র শব্দ করে হাসল। যেন মারাত্মক কোন কৌতুক করে ফেলেছে শওকত। বলল, ‘ সেটা হলেও তোমাকে ক্ষমা করা সম্ভব হতো মীর্জা। আমার দরবারে সবকিছুর ক্ষমা হয়। ছলনা ছাড়া। একসময় আফসোস হতো, সেদিন ট্রেনে আমার হাতটা ফসকে যাওয়ায়। সত্যি বলছি, আজও আফসোস হয়। সেদিন আফসোস হতো তোমার পা কে-টে গিয়েছিল বলে, আর আজ আফসোস হয় তোমার বাকি শরীরটা বেঁচে গিয়েছিল বলে।’

শওকতের চোখের হিংস্রতা বৃদ্ধি পেল। সে আরও একবার তাকাল দরজার দিকে। ঠোঁটের হাসি প্রসারিত হলো রুদ্রর। সামান্য ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ কারো জন্যে অপেক্ষা করছেন বুঝি?’

শওকত চকিতে চাইল। কৌতুক খেলা করছে রুদ্রর চোখে। কৌতুকপূর্ণ স্বরেই রুদ্রবলল, ‘ সত্যিই বেঈমানী তোমার রক্তে মিশে আছে মীর্জা। একা আসতে বলেছিলাম তোমাকে। কিন্তু এবারেও কথা রাখতে পারলেনা। কিন্তু তোমার দুর্ভাগ্য, যাদের লেজ বানিয়ে নিয়ে এসেছো তারা কেউ বেঁচে নেই! এতক্ষণে বাইরে ওদের লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছে।’

মাথায় ঝিম ধরে উঠল শওকতের। নিজের সঙ্গে নিজের দলের বিশ্বস্ত তিনজনকে নিয়ে এসেছিল সে। বাকিদের বিশ্বাস করার মতো অবস্থা তার ছিলোনা। পরিকল্পনা ছিল ভেতরে যখন সে রুদ্রর সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত থাকবে তখনই ব-ন্দু-ক নিয়ে অতর্কিতে হামলা করবে ওরা তিনজন। রুদ্র একা। সামলাতে পারবেনা। সে সুযোগটাই নেবে শওকত। কিন্তু তার এই পরিকল্পনা কীকরে জানল রুদ্র? আর ওর সঙ্গেই বা কে আছে? কে খু-ন করেছে এই তিনজনকে! সব তালগোল পাকিয়ে গলা শুকিয়ে এলো শওকতের। শুকনো ঢোক গিলে তাকাল রুদ্রর দিকে।

কৌতুক ছাড়েনি রুদ্রর তীক্ষ্ম চোখ। ব্যঙ্গাত্মক কন্ঠে বলল, ‘এই মুহূর্তটাও খুব পরিচিত লাগছে?’

আচমকাই এক ভয়ানক কান্ড ঘটিয়ে বসল শওকত। নিজের কাঠের পায়ের সঙ্গে আটকে এনেছিলেন একটা ছু-রি। দ্রুতহাতে সেটা বের করে বসিয়ে দিতে গেল রুদ্রর গ-লায়। রুদ্রর সজাগ ইন্দ্রিয় যেন বিদ্যুৎ গতিতে কাজ করল। সঙ্গে সঙ্গে একপাশে কাঁত হয়ে গেল সে। ছো-রাটা গিয়ে বসল রুদ্রর বাহুতে। একটানে সেটা বের করল শওকত। রুদ্র নিজেকে সামলে ওঠার আগেই আরও এক কো-প মারল। গড়ান গিয়ে পেছনে সরে গেল রুদ্র। কোপটা পড়ল মাটিতে।
স্ট্রেচারে ভর দিয়ে দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়াল শওকত। ক্রোধে উন্মাদ হয়ে গেছে সে। ভুলে গেছে রুদ্রর হাতে আছে ব-ন্দু-ক। ছো-রা নিয়ে এগিয়ে এসে পাগলের মতো তেড়ে এলো রুদ্রর দিকে। কিন্তু রুদ্র সুযোগ নিল শওকতের দুর্বলতার। শওকত এগিয়ে আসার আগেই সজোরে লাথি বসালো শওকতের কাঠের পায়ে। নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে ব্যর্থ হল শওকত। মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে। একলাফে উঠে দাঁড়াল রুদ্র। ছো-রা ধরে রাখা শওকতের হাতটা নিজের পা দিয়ে পিষে ধরে বলল, ‘আমাকে তুমি এতোটা মিসআন্ডার্স্টান্ড করবে সেটা কল্পনাও করিনি মীর্জা। সোলার সিস্টেম নেই। কিন্তু আজও আমি রুদ্র আমেরই আছি।’

বলে অপর পা দিয়ে সজোরে এক লাথি বসাল শওকতের পেটে। ব্যথায় চোখমুখে অন্ধকার দেখল শওকত। সবকিছু ঝাপসা লাগল। ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখল জ্ঞানে ফিরেছে শানের। মুক্ত হওয়ার জন্যে ছটফট করছে।

নিজের টিম নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এলো তমাল। শওকতের গাড়িটা এসে থেমেছে এখানে। চাকার দাগ অনুসরণ করে করে এ অবধি এসে পৌঁছেছে ওরা। কিন্তু এখন কোনদিক যাবে? আসেপাশে চোখ বুলিয়েও বিশেষ কিছু দেখতে পাচ্ছেনা ওরা। এদিকে নষ্ট করার মতো সময় নেই। যেকোন কিছুর মূল্যে ধরতে হবে আজ রুদ্রকে। একজন অফিসার বলল, ‘কী করব এখন?’

দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল তমাল। চিন্তা করল কিছুক্ষণ। তুহিনের দেওয়ার বুদ্ধিটাকেই অন্যভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করল তমাল। নিজের সঙ্গিদের বলল, ‘মিস্টার মীর্জার গাড়ি থেকে জুতোর ছাপ মাটিতে পড়েছে কিনা দেখুন।’

তমালের নির্দেশমতো সকলেই নিজেদের টর্চ বের করল। গাড়ির কাছ থেকে জুতোর ছাপ সনাক্তকরণের চেষ্টা করল খুব মনোযোগ দিয়ে। পেলোও, তবে খুবই আবছা। অনেকটা সময় নিয়ে নিয়ে এগোতে হবে ওদের। কিছু করার। ছাপ অনুসরণ করে এগোতে গিয়ে খানিকটা আবাকই হল তমাল। কারণ জুতোর ছাপ এক নয় একাধিক। অর্থাৎ গাড়িতে আরও লোক ছিল! সঙ্গে আরও লোক নিয়ে গেছে শওকত! দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছনোর তাগিদ অনুভব করল তমাল। কাজের গতি বাড়াল। এগোতে এগোতেই কল করল তুহিনের নাম্বারে। কিন্তু কল তুলল না তুহিন। রিং হয়ে যাচ্ছে। দুঃশ্চিন্তা বাড়ল তমালের। কিঞ্চিৎ ভয় বাসা বাঁধল মনে। শীতের সঙ্গে রমাঞ্চেও শিরশির করে উঠল শরীর। তুহিন ঠিক আছেতো!

পকেটে ভাইব্রেট হচ্ছে তুহিনের ফোন। টের পাচ্ছে তুহিন। কিন্তু কল ধরার অবস্থায় নেই এখন ও। ব-ন্দু-ক হাতে খুঁজে চলেছে ওকে চারটা লোক। ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থেকে তাদের দিকেই নজর রাখছে ও। কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে অপেক্ষা করা যাবেনা। বের হতে হবে ওকে। পকেটে ফোনকল টের পেয়ে সেই প্রয়োজন আরও বেশিকরে অনুভব করতে পারল তুহিন। গাড়িটা ইতিমধ্যে নস্ট করে ফেলেছে ওরা। পায়ে হেঁটে বাকিটা যাওয়া সম্ভব হবে কি-না জানেনা। শুধু এইটুকুই জানে যেকোন মূল্যে পৌঁছতে হবে ওকে।

চারজন চারদিক দিয়ে খুঁজছে তুহিনকে। হাতের টর্চগুলোকে সার্চলাইটের মতো ব্যবহার করছে। চারজনই কালো টিশার্ট পড়ে আছে। তবে শারীরিক গঠনে পার্থক্য আছে বটে। একজন বেশ কালো আর বেঁটে। মাঝারি সাইজের দুইজন শ্যামলা, তবে গোঁফ আছে একটা। লম্বাটা সম্পূর্ণ চাকমাদের মতো দেখতে। তুহিন ভাবল কোনভাবে চোখে পড়ে গেলে একসঙ্গে চারজন গু-লি করে বসবে। একা চারদিক সামাল দিতে পারবেনা তুহিন। অন্যকিছু ভাবতে হবে। ঠোঁট চেপে এদিক ওদিক চোখ বুলালো তুহিন। কিন্তু কোন উপযুক্ত উপায়ই চোখে পড়ছেনা। যেকোন মুহূর্তে তুহিনের অবস্থানরত ঝোপের কাছে খুঁজতে চলে আসবে তারা। তার আগেই যা করার করতে হবে।
হঠাৎ তুহিন দেখল ওর ডান পাশের কিছুটা দূরের ঝোপ অবধি পৌঁছে গেছে বেঁটে লোকটা। সতর্ক ভঙ্গিতে সেদিকে খুঁজছে ওকে। লম্বা দম নিল তুহিন। এই ব্যাটাকে দিয়েই শুরু করতে হবে। বাকি তিনজনের দিকে তাকাল ও। তাদের নজর অন্যদিকে। ধীর পায়ে ঝোপ ছেড়ে বের হল তুহিন। পরপর তিনটা গাছের পেছনে পেছনে নিজেকে আড়াল করে অবশেষে গিয়ে পৌঁছলো সেই ঝোপের কাছে। উল্টো ঘুরে আশেপাশে উঁকিঝুঁকি মারছো লোকটা। তুহিন সঠিক পজিশনে ধরল পিস্তলটা। বেড়ালের মতো নিঃশব্দে এগিয়ে গেল সেদিকে। হঠাৎই নিজের ঠিক পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেলো বেঁটে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। পিস্তলের বাঁট দিয়ে সজোরে মাথায় আঘা-ত করেছে তুহিন। বেশি কিছু করার সুযোগ পায়নি। ঘোৎ করে একটা আওয়াজ করেছে কেবল। অতঃপর জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছে নিচে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল তুহিন।
এবার ঐ ঝোপটাকেই আশ্রয় হিসেবে বেছে নিল। দেখল বাকি চারজনের গতিবিধি। হঠাৎই সোজা এই ঝোপটার দিকে তাকাল গোফ ওয়ালাটা। একজন সঙ্গী ওদিকে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে সেই আগে অনুভব করল। তবে সে বীরপুরুষ। বাকি দুজনকে না জানিয়ে নিজেই এগিয়ে এলো। মনে মনে হাসল তুহিন। লোকটা এসে ঝোপের পেছনে উঁকি দিয়ে টর্চ ফেলতেই পিস্তল দিয়ে আঘাত করল তুহিন। কিন্তু লক্ষ্যচুত হল। কিন্তু লোকটা আওয়াজ কিংবা শু-ট করার আগেই লোকটার গলায় গু-লি করল তুহিন। মৃদু ‘থু’ মতোন আওয়াজ হল কেবল। সাইলেন্সার লাগানো ছিল। গোফওয়ালার লাশটা সাবধানে নিচে শুইয়ে রাখল তুহিন। এখন বাকি আছে দুজন। দুটোকে সামলাতে খুব বেশি বেশ পেতে হবেনা তুহিনকে।
ঐ ঝোপটা থেকে বের হল তুহিন। দুজনেই উল্টোদিকে ফিরে খুঁজছে। এবার আর বেড়ালের মতো এগোলো না। যেকোন সময় ঘুরবে ওরা। দৌড়েই চলে গেল চাকমাটার কাছে। অতর্কিতে হাত দিয়ে পেছন থেকে গলা আটকে ধরল শক্ত করে। সঙ্গে সঙ্গে টের পেল শ্যামলাটা। ঘুরে তাকিয়ে কিছু বুঝে ওঠার সময় দিলোনা তুহিন। ঠিক কপালের মাঝ বরাবর শ্যু-ট করল। এক লাথিতে চাকমাটার হাত থেকে পিস্তল ফেলে দিল তুহিন। ঘাড়ের বিশেষ এক পয়েন্টে তীব্র আঘা-ত করে। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারায় চাকমা।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল তুহিন। মৃত লাশদুটোকে একপাশে, আর অজ্ঞান দুজনকে আরেকপাশে টেনে এনে রেখেছে। শীতের মধ্যেও ঘেমে গেছে ও। হাঁপাচ্ছে। হাত দিয়ে মুছে নিল কপালের ঘামটা। দুটো খু-ন করতে চায়নি ও। কিন্তু করতে হল। উপায় ছিলোনা। যথেষ্ট চেষ্টা করেছে কিন্তু লাভ হয়নি। মানুষ খু-নের পক্ষে কোনদিনও ছিলোনা ও। কিন্তু জান বাঁচানো ফরজ!
এখন অজ্ঞান দুটোর ব্যবস্থা করতে হবে। পকেট থেকে ফোন বের করল তুহিন। তমাল কল করছিল তখন। কল ব্যাক করতেই সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করল তমাল। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, ‘স্যার! ঠিক আছেন আপনি?’

তুহিন মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, ‘আছি! ওদিকের কী খবর?’

এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হল তমাল। সন্তুষ্ট স্বরে বলল, ‘ স্যার, মীর্জাদের পায়ের ছাপ রাস্তার একটা বাগানের কাছে থেমেছে। বাগানের ওপাশে দূর থেকে একটা ঘর দেখা যাচ্ছে স্যার। হলুদ বাল্ব জ্বলছে। সম্ভবত ওখানেই।’

তমাল বলল, ‘সম্ভবত না তমাল! ওখানেই আছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছাও গিয়ে। অনেকটা সময় পাড় হয়ে গেছে। ব্লান্ডারটা বোধ হয় এবারও আটকাতে পারলাম না। গোও!’

‘ ওকে স্যার!’

কল কেটে বাকিদের ইশারা করল তমাল। পি-স্ত-ল হাতে সতর্ক পায়ে এগোলো ওরা পাঁচজন। লক্ষ্য ঐ টিনের ঘরটা!

আরেকটা পিলারের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে ফেলা হয়েছে শওকত মীর্জাকে। সে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে। কারণ সে জানে রুদ্র এখন কী করবে। নিজের দেওয়া কথা রাখতে চলেছে রুদ্র। শওকতের সামনেই খু-ন করবে তার ছেলেকে। শওকত শানের দিকে তাকাল। এখন পুরোপুরি জ্ঞান ফিরেছে তার। কিন্তু শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। শওকত আতঙ্কিত গলায় বলল, ‘ খবরদার রুদ্র! আমার ছেলের গায়ে হাতও দেবেনা। তোমাকে জ্যান্ত অবস্থায় টুকরো টুকরো করে কা-টব কিন্তু আমি রুদ্র!’

রুদ্রর হাত আর ঘাড় বেয়ে রক্ত নামছে। তবুও ঠোঁটের ব্যাঙ্গাত্ম হাসিটুকু সরল না। ভয় বাড়ল শওকতের। বাঁধন শক্ত ছাড়াতে পারার সম্ভাবনা নেই। শওকত এবার খানিকটা অনুনয় করে বলল, ‘রুদ্র! তোমার একটা নীতিবোধ আছে তাইনা? একজন আহত, নিরস্ত্র মানুষকে মারতে পারোনা তুমি।’

রুদ্র আরও একবার ঝুঁকে বসল শওকতের সামনে। তীক্ষ্ম চোখজোড়া কৌতুক হারিয়েছে। চোয়াল শক্ত। শওকতের কাঁচাপাকা চুলের মুঠি ধরে ও দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘নীতিবোধ আমি সেদিন থেকেই ত্যাগ করেছি মীর্জা যেদিন আমার বোনের ধ-র্ষি-ত শরীর দেখেছি, আমার বাবার মৃত শরীর দেখেছি, আমার অনাগত বাচ্চার মৃত্যু দেখেছি। আর_’

থামল রুদ্র। ঝাড়া দিয়ে ছাড়ল শওকতকে। উঠে দাঁড়িয়ে তুলে নিল নিচে পড়ে থাকা সেই ছুরিটা। এগিয়ে গেল শানের দিকে। শওকতের কলিজা মোচড় দিয়ে উঠল। তার পুত্রস্নেহযে প্রবল তা সেই মুহূর্তে উপলব্ধি করতে পারল। ঝাঁকি দিয়ে উন্মুক্ত করার চেষ্টা করল নিজেকে কিন্তু ব্যর্থ হল। চিৎকার করে বলল, ‘ রুদ্র! খবরদার রুদ্র!’

শানের সামনে গিয়ে হাঁটু ভেঙ্গে বসল রুদ্র। শান আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে ওকে। নির্বিকারহাতে শানের বাঁধন খুলে দিল রুদ্র। শান্ত-শীতল গলায় বলল, ‘যদি ক্ষমতা থাকে। বাঁচার একটা শেষ চেষ্টা কর।’

শানের সারাশরীর আঘা-তে র-ক্তা-ক্ত। শরীর ভর্তি ব্যথা। আতঙ্কভর্তি চোখে দুকদম পিছিয়ে গেল শান। শুকনো গলায় দুটো ঢোক গিলল। টিনের বেড়ার সঙ্গেই একটা লোহার রড রাখা ছিল। হঠাৎ সেটা হাতে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রুদ্রর মাথা বরাবর মা-রতে যাচ্ছিল শান। বিদ্যুৎ বেগে মাথা নুইয়ে ফেলল রুদ্র। আরও দুটো আঘাত এলো পরপর। তারমধ্যে একটা লাগল রুদ্রর আহত বাহুতে। তীব্র ব্যথায় মৃদু গুঙিয়ে উঠল। শাল বিড়বিড় করে বলল, ‘ শালা, হা-রামি! আমাকে মারবি!’

আসলে শান ততটাও দুর্বল ছিলোনা যতটা দেখাচ্ছিল। ক্লান্ত, আহত হলেও এখনো কিছুটা শক্তি আছে তার শরীরে। কিন্তু চতুর্থ আঘাতটা করে কায়দা করতে পারল না শান। হাত দিয়ে ধরে রুদ্র। তিন সেকেন্ডের কসরতে ছিনিয়েও নিল রডটা। ওটা দিয়েই তীব্র বেগে আঘাত করল শানের কাঁধে। ‘বাবাগো!’ বলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল শান। চিৎকার করে উঠল শওকত। রুদ্র হাঁপাতে হাঁপাতে মাথা নেড়ে বলল, ‘ সত্যিই বলেছিলাম মীর্জা! ছলনা আসলে তোমার র-ক্তেই আছে।’

বলে তীব্রবেগে আরও কয়েকটা বাড়ি মারল শানের শরীরে। অসহ্য ব্যথায় চোখেমুখে অন্ধকার দেখল শান। ‘বাবাগো!’ ‘মাগো!’ বলে চিৎকার করল। এখন বাস্তবেই নড়ার শক্তি নেই ওর মধ্যে। দম বন্ধ হয়ে এলো শওকতের। চোখ ফেটে ছল গড়িয়ে নামল। চিৎকার করে রুদ্রকে হুমকি দিল থামার জন্যে। হাঁটু ভেঙ্গে বসল রুদ্র। শানের হাত ধরল। সজোরে মোচড় দিয়ে ভেঙে ফেলল সেটা। শানের চিৎকারে কেঁপে উঠল চারপাশ। শওকতের হৃদয় যেন ভেঙ্গেচুড়ে চুরমার হয়ে গেল। হুমকি, ধমকির সুর নেমে এলো অনুরোধে, ‘রুদ্র! যা করার আমি করেছি। মাফ চাইছি আমি। আমি মাফ চাইছি! সবকিছুর জন্যে মাফ চাইছি। রুদ্র। ছাড়ো ওকে ছাড়ো! ছাড় ওকে স্ক্রাউন্ডেল!’

লাভ হলোনা ততক্ষণে শানের দ্বিতীয় হাতটাও ভেঙে ফেলল রুদ্র। প্রচন্ড যন্ত্রণায় আর্তনাদ করার ক্ষমতাও হারালো শান। কেবল বিকৃত আওয়াজ বেরিয়ে এলো ওর মুখ দিয়ে। উঠে দাঁড়াল রুদ্র। সেই লোহার রডটা দিয়ে সবেগে আঘাত করল শানের মাথায়। শওকত পাগলের মতো ছটফট করে উঠল। প্রচন্ড জোরে চেঁচিয়ে বলল, ‘রুদ্র না! না রুদ্র না!’

শওকতের একটা কথাও কানে প্রবেশ করছেনা রুদ্রর। ও আবার আঘা-ত করল। একবার, দুবার, বারবার। করেই যাচ্ছে। মাথা ফেটে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল শানের। চারপাশে ছি-ট-কে রক্ত বেরিয়ে এলো। তবুও থামল না রুদ্র। উন্মাদের মতো মে-রেই যাচ্ছে শানের মাথায়। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল সিঁড়ির নিচে পড়ে থাকা প্রিয়তার আহত শরীর। সাদা স্যালোয়ার গড়িয়ে পড়া সেই রক্ত। কানে বেজে উঠল “আমার বাচ্চা! আমার বাচ্চা!” বলে প্রিয়তার করা সেই করুণ চিৎকার। ডাক্তারের বলা সেই কথা, “সরি মিস্টার রুদ্র। বাচ্চাটার মিসক্যারেজ হয়ে গেছে।” সেই দৃশ্য, সেই আওয়াজ বারবার মস্তিষ্কে যেন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিল। হিংস্র গর্জন করে শেষ আঘাতটা করল রুদ্র।

এবার আর চিৎকার বের হলোনা শওকতের মুখ দিয়ে। স্তব্ধ, বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল শানকে। বিষ্ফোরিত, নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে শান। মাথাটা চারপাশ দিয়ে ফেটে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। ঘন কালচে র-ক্ত ভয়ংকর লাগছে দেখতে। মাথা থেকে বইতে থাকা কালচে সেই র-ক্ত গড়িয়ে গেছে বহুদূর। শরীরটা শান্ত, স্থির। অর্থাৎ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে শান মীর্জা।

হাঁপাতে হাঁপাতে হিংস্র দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকাল রুদ্র। বুকের ভেতর তীব্র চাপ অনুভব করল শওকত। নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা সে। গা গুলিয়ে বমি পাচ্ছে। মাথাটায় কেমন ঝিম ধরছে। নিদারুণ যন্ত্রণায় বুক ফাটতে চাইল শওকতের। নিজের সন্তানকে চোখের সামনে, নিজের সন্তানকে মরতে দেখার যন্ত্রণা বুঝি এতো তীব্র, এতো করুণ হয়! শওকতের মনে হল সে মারা যাবে। এক্ষুনি মারা যাবে। একমাত্র ছেলের বিভ‍ৎস লাশের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল শওকত।

ঠিক সে মুহুর্তেই দরজা দিয়ে প্রফেশনাল ভঙ্গিতে পি-স্ত-ল তাক করে ঘরে ঢুকল তমাল। সবার আগে চোখ পড়ল শানের লাশটার দিকে। আঁতকে উঠল ও। অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘মাই গুডনেস!’

চকিতে দরজার দিকে তাকাল রুদ্র। তখনও হাঁপাচ্ছে সে!

#চলবে…

[ রি-চেইক করিনি। নেটওয়ার্কের সমস্যার জন্যে লগইন হচ্ছিল না। দেরী হওয়ার জন্যে দুঃখিত !]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here