অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল
৯০.
শানের খ-ন্ডবিখ-ন্ডিত মাথাটা দেখে গা গুলিয়ে উঠল তুহিনের। চোখ সরিয়ে নিল সে। আরও একবার ব্যর্থ হওয়ার গ্লানিতে চারপাশটা কেমন অসহনশীল হয়ে উঠল। প্রচন্ড জেদে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল ও।
এরমধ্যেই ফরেন্সিক থেকে লোক চলে এসেছে। শানের ডেডবডিটা দেখে ক্ষণিকের জন্যে থমকে গেল তারাও। মনে হল, এই নির্জন বনে কোন পিশাচের হিংস্র থাবায় পড়েছিল শান মীর্জা। রক্ষা পায়নি সে। কোনভাবেই না। কোনমতে ডেডবডিটা তুলে নিয়ে যায় তারা। সঙ্গে নিয়ে যায় রুদ্র পি-স্ত-ল, সেই রড আর ছো-রাটা।
শওকত মীর্জার জ্ঞান ফেরেনি এখনো। তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সেই দুইটা লাশ আর দুজন অজ্ঞান হামলাকারীকে গাড়িতে করে সঙ্গেই নিয়ে এসেছিল তুহিন। তাদের ও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দুই রুমের টিনের ঐ ঘরটাতে পড়ে রইল কেবল তুহিন আর তমাল।
ফাঁকা ঘরটার চারপাশে আরেকবার চোখ বুলালো তুহিন। চারপাশটা স্তব্ধ, অদ্ভুত ঝিম ধরা পরিবেশ। মাটিতে গড়িয়ে যাওয়া কালচে র-ক্ত দেখে লম্বা শ্বাস ফেলল তুহিন। শীতল আবহাওয়াতেও আশপাশ প্রচন্ড উত্তপ্ত মনে হল। চোয়াল, গাল শক্ত হয়ে উঠল। প্রচন্ড জেদে তীব্র এক লাথি বসাল ঘরের খুটিতে। চমকে উঠল তমাল। তুহিনের চোখমুখ দেখে ভয় পেয়ে গেল ও। আত্মগ্লানিতে দুকান গরম হয়ে উঠল। আজকের ব্যর্থতার সম্পূর্ণ দায়ভার ওর নিজেরই। অপরাধী দৃষ্টিতে তুহিনের গম্ভীর চেহারার দিকে তাকাল তমাল। মনে করল কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া সেই ভয়াবহ ঘটনাক্রম –
–
যেনো কোন কাল্পনিক চরিত্র সাক্ষাৎ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অনেকটা সেরকমই বোধ করে তমাল। দীর্ঘদিন যাবৎ কেবল শুনেই এসেছে রুদ্র নামক চরিত্রকে। দু-একবার ছবি দেখেছে। রাতের পর রাত জেগে কাটিয়েছে এই চরিত্রের জীবনী, কার্যকলাপ নিয়ে ভাবতে ভাবতে। আজ সে ওর সামনে। তাও এমন ভয়ংকর রূপে! এমন ভয়ানক খুনের পর! যার নৃশংসতার গল্প এতোদিন শুনে এসেছে, আজ তা সামনাসামনি দেখে গা শিরশির করে ওঠে ওর। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে আরেকবার শানের দিকে তাকায় তমাল। চোখ ঘোরাতেই চোখে পড়ে জ্ঞানহীন শওকত মীর্জাকে। শরীরের সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে।
ক্ষণিকের জন্যে হতভম্ব হয়ে যায় রুদ্র আমের নিজেও। ও জানতো তুহিন আহমেদ পাগলের মতো খুঁজছে ওকে। অনেক ভেবেচিন্তে এই জায়গাটা বেছেছিল রুদ্র। কিন্তু পুলিশ এতো দ্রুত এই জায়গায় পৌঁছে যাবে কল্পনা করেনি ও। ওর সময় প্রয়োজন ছিল। আরেকটু সময়। সিনিয়র ইনভেস্টিগেটর তুহিন আহমেদকে কিছুটা হলেও মিস আন্ডার্স্টান্ড করে ফেলেছিল ও। সেটা তখন উপলব্ধি করে।
এরমধ্যেই তমালের বাকি চারজন সহকারী ঢুকে পড়ে ঘরটাতে। সবার আগে তাদের চোখ যায় রুদ্র আমেরের দিকেই। দ্রুতগতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে চারজন। ব-ন্দু-ক তাক করে রুদ্রর দিকে। শানের লাশটা লক্ষ্য করে তারপর। ভেতর থেকে সবকিছু গুলিয়ে উঠলেও স্থির থাকে তারা। ততক্ষণে তমালও সামলে নেয় নিজেকে। শক্ত হাতে নিজের পি-স্ত-ল তাক করে রুদ্রর কপাল বরাবর।
রুদ্রর চেহারার চকিত ভাবটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না। রডটা ফেলে দেয় হাত থেকে। প্যান্টের সামনেই গোজা ছিল ওর এম.টি.নাইন। বিদ্যুৎ বেগে বের করে সেটা। তমালের দিকে তাকা করে ট্রিগার চাপতে গিয়েও থেমে যায় রুদ্র। কিছু একটা বাঁধা দেয় ওকে। তমাল ক্ষেপাটে গলায় বলে, ‘বোকামো করোনা রুদ্র! তোমার দিকে একটা নয়, পাঁচটা ব-ন্দু-ক তাক করা আছে। ওদিক থেকে একটা বুলেট বের হলে এদিক থেকে চারটা বের হবে।’
নির্বিকার দৃষ্টিতে পাঁচজনের অবস্থান দেখে নেয় রুদ্র। মনে মনে হাসে। ওর শুটিং স্কিলকে বড্ড বেশি হালকা করে দেখছে সহকারী ইনভেস্টিগেটর তমাল। তবে ওর ভুলটা ভাঙায়না রুদ্র। নিজের পি-স্ত-ল তাক করেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নিজের জায়গায়।
তমাল বলে, ‘ তুমি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছো যে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে তোমাকে। নিজের পি-স্ত-ল নামিয়ে হাত উঁচু করে দাঁড়াও।’
মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রুদ্র। কিন্তু মস্তিষ্ক দ্রুতবেগে ছোটে। তমাল এসেছে! অর্থাৎ তুহিনের অবস্থান খুব বেশি দূরে নয়। এই পাঁচজনকে সামাল দেওয়া খুব বেশি কঠিন হবেনা জানতো রুদ্র। কিন্তু তুহিন চলে এলে জটিল হয়ে উঠবে ব্যপারটা। এইমুহূর্তে পরিস্থিতি এতোটা জটিল করা যাবেনা। এখনো কাজ বাকি আছে ওর।
‘ পিস্তল নামাও রুদ্র!’ ধমকে ওঠে তমাল।
রুদ্র কথা বাড়ায় না। চুপচাপ মাটিতে নামিয়ে রাখে নিজের এম.টি.নাইন। তমালের আদেশের আগেই নিজের দুহাত উঁচু করল রুদ্র। রুদ্রর দিকে বন্দুক তাক করে রাখা অবস্থাতেই ঘরের চারপাশে চোখ বুলালো তমাল। লোহার রড, একটা ছু-রি ছাড়া আর কোন অস্ত্র দেখতে পেলোনা। রুদ্রর ডানে থাকা অফিসারের দিকে তাকাল তমাল। নির্দেশের ভঙ্গিতে বলল, ‘তুলে নিন ওগুলো।’
সচেতনতা অবলম্বন করে দক্ষ ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল অফিসার। একে একে তুলে নিল পি-স্ত-ল, লোহার রড, আর ছু-রিটা। স্বস্তি পেল তমাল। বর্তমানে আর কোন অস্ত্র নেই রুদ্রর কাছে। রুদ্রর দিকে পি-স্ত-ল তাক করেই এগিয়ে গেল তমাল। রুদ্র তখনও হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তীক্ষ্ম চোখদুটো তমালের ওপর স্থির। রুদ্রর ঠিক সামনাসামনি এসে দাঁড়াল তমাল। পি-স্ত-লটা ঠেকিয়ে ধরল ওর মাথায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘অনেকটা দৌড় করিয়েছো রুদ্র আমের। এবার থামতে হবে।’
আরেকজনকে ইশারা করল তমাল। হ্যান্ডকাফ নিয়ে আসার জন্যে। লম্বা করে শ্বাস ফেলল রুদ্র। সময় নেই। যা করার এখনই করতে হবে ওকে। তীক্ষ্ম চোখজোড়া ঘুরিয়ে আরও একবার পাঁচজনের দিকে তাকায় রুদ্র। হঠাৎই দরজার দিকে তাকায় রুদ্র। এমনভাবে তাকায়, যে কেউ বিশ্বাস করতে বাধ্য যে কেউ একজন এসেছে। ফলে যা ঘটার তাই ঘটে। দু সেকেন্ডের জন্যে পাঁচজনেরই দৃষ্টি রুদ্রকে ছেড়ে দরজার দিকে চলে যায়। ব্যস! এইটুকুই সময়েরই প্রয়োজন ছিল রুদ্রর। সঙ্গে সঙ্গে নিজের পেছনে গোজা শওকতের পি-স্ত-লটা বের করে রুদ্র। একই সময় তীব্র বেগে লাথি মারে তমালের হাতে। ক্ষনিকের অসাবধানতায় পি-স্ত-ল খসে পড়ে তমালের হাত থেকে। ওর হাত ধরে ঘুরিয়ে গলায় হাত দিয়ে আটকায় রুদ্র। অপর হাত দিয়ে ব-ন্দু-ক চেপে ধরে তমালের মাথায়। আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব হয়ে যায় তমালসহ বাকি চারজন। রুদ্র গম্ভীর, শান্ত গলায় বলে, ‘ভদ্র বাচ্চার মতো পি-স্ত-লগুলো নামিয়ে পা দিয়ে ঠেলে দাও এদিকে। একপাশে গিয়ে দাঁড়াও। নয়তো ট্রিগার চাপতে দ্বিধা করব না আমি।’
তমাল তখনও হতভম্ব। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছেনা ওর। বাকি চার অফিসারের মধ্যে দ্বিধা স্পষ্ট। সময় নেই রুদ্রর হাতে। আরও শক্ত করে তমালের গলা চেপে ধরল রুদ্র। পি-স্ত-লের চাপ বাড়াল। ধমকের সুরে বলল, ‘কুইক!’
তুহিনের অর্ডার ছিল। জীবিত চাই রুদ্র আমেরকে। যার ফলে আচমকা শু-ট করার কথা ভাবতে পারল না কেউ। তারচেয়েও বড় কথা। ওদের কেউ শু-ট করতে করতে তমালকে শুট করে ফেলবে রুদ্র। কোন সন্দেহের অবকাশ নেই তাকে। সুতরাং রুদ্রর কথা মানতেই বাধ্য হলো তাদের। চারজনই নামিয়ে রাখল পি-স্ত-ল। ঠেলে দিল রুদ্রর দিকে। এরপর ধীরপায়ে এগিয়ে গেল ঘরের অপর পাশে। তমালের হুশ এল ততক্ষণে। দাঁতে দাঁত পিষে অকথ্য এক গালি দিয়ে বলল, ‘তোকে পুতে ফেলব আমি শয়তান!’
রুদ্রর ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ শশ্! শয়তানকে চটাতে নেই। বিপদ বাড়ে।’
ঠিক তখনই পায়ের আওয়াজ এলো রুদ্রর কানে। কান খাড়া করল রুদ্র। মৃদু পায়ের আওয়াজ। বাকিরা টের পায়নি এখনো। সঙ্গে সঙ্গে তমালকে নিয়ে এক ঝটকায় দরজার বেড়াটার সাইডে চলে গেল রুদ্র।
পি-স্ত-ল হাতে ঘরে ঢুকল তুহিন আহমেদ। চারজানকে একজায়গায় ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। ঘরের আশেপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে বলল, ‘এভাবে দাঁড়িয়ে আছো_’
থেমে গেল তুহিনের গলার স্বর। রুদ্রকে চিনতে একমুহূর্তও দেরী হলোনা। তারচেয়েও বেশি অবাক হল রুদ্রর কাছে তমালকে বন্দি দেখে।
‘ স্যার!’
পেছন থেকেই চেঁচিয়ে উঠল একজন। একসেকেন্ডও দেরী করেনি রুদ্র। তমালকে নিয়ে চলে গেল দরজার কাছে। বেরিয়ে গেল টিনের ঘরটার বাইরে। সজোরে তমালের মাথায় এক আঘা-ত করে ঠেলে দিল ঠিক তুহিনের ওপর। ডিফল্ট মুডের মতোই দুহাত তমালকে ধরে ফেলল তুহিন। সেই সুযোগে রুদ্র বের করল নিজের পেছনেই লুকিয়ে রাখা গ্রে-নে-ড। ছুট লাগাল। ছুটতে ছুটতে আনপিন করল সেটা। ছুড়ে দিল ঘরটার দিকে। ব্যপারটা এতো দ্রুত ঘটল যে কিছু করার সুযোগ পেলোনা তুহিন। খুবই কাছে ঘটা বি-স্ফো-রণে চোখ বুঝে ফেলল ছ’জনই। টাল হারিয়ে বসে পড়ল মাটিতে। নিজেকে সামলে দ্রুত উঠে দাঁড়াল তুহিন। উড়ন্ত ধুলো আর ধোঁয়ায় কিচ্ছু দেখতে পেলোনা। কোনমতে সেসব কাটিয়ে বের হল। হতবাক হয়ে তাকাল চারপাশে। দেখতে পেলো অনেকটা দূরে চলে যাচ্ছে একটা বাইক। বড় করে দম নিল তুহিন। দ্রুত দৌড়ে নিজের গাড়িটার কাছে গেল। গাড়িটা আসলে ওর ওপর হামলাকারীদের। ওর গাড়ির টায়ার বু-লে-টের আঘাতে ফুটো হয়ে গিয়েছিল তখনই। কিন্তু এবারেও হতাশ হতে হয় তুহিনকে। যাওয়ার আগে নিজের আরও এক তীক্ষ্ম বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে গেছে রুদ্র। শওকত মীর্জা, তমাল আর তুহিনের; ওখানে পার্ক করে রাখা তিনটে গাড়িরই দুটো করে চাকা ফুটো করে দিয়ে গেছে সে।
দাঁতে দাঁত পিষল তুহিন। প্রথমবারের মতো দুচোখে আগুন দেখা গেল ওর। তীব্র আক্রোশে লাথি বসালো গাড়িতে। জেদ, রাগ, আফসোসে পরিপূর্ণ গলায় হিশহিশিয়ে বলল, ‘রুদ্র আমের!’
–
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে তমাল। তুহিন এখনো কিছু বলেনি। কিন্তু তমালের ওপর রেগে আছে সে। সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। রুদ্র আমেরের সক্রিয়তা সম্পর্কে খুব ভালোভাবে অবগত ছিল তমাল। সেক্ষেত্রে ওর কাছে কেবল একটাই অস্ত্র থাকবে ভাবাটাই ছিল সবচেয়ে বড় বোকামি। যে ভুলের মাশুল বোধ এবার তুহিনকেই দিতে হবে। দু-বছর হলো কাজ করছে তুহিনের সঙ্গে। অনেকরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে ওরা। কিন্তু তুহিনের চোখেমুখে এতো আক্রোশ আর ক্রোধ এর আগে দেখেনি তমাল।
‘ কপাল কেটে রক্ত বেড় হচ্ছে তোমার। চলো! ফার্স্ট এইড নিতে হবে।’
তুহিন হঠাৎ কথা বলে ওঠায় চমকে উঠল তমাল। অপরাধী দৃষ্টিতে তাকাল। ইতস্তত করে বলল, ‘ স্যরি স্যার! আমার আরেকটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।’
লম্বা শ্বাস ফেলল তুহিন। ঘরে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘চলো!’
‘স্যার স্যরি_’
‘ চলো তমাল!’
গম্ভীর গলায় কথাটা বলে বেরিয়ে গেল তুহিন। খানিকটা অসহায় দৃষ্টিতে তুহিনের যাওয়ার দিকে। আত্মগ্লানি আরও তীব্রভাবে কো-প বসাল শরীরে। তারসঙ্গে তীব্র আক্রোশ জন্মালো রুদ্র আমের নামক ঐ স-ন্ত্রা-সীর প্রতি। এতোদিন তেমনভাবে অনুভব না করলেও আজ তীব্র ঘৃণা অনুভব করল। আক্রোশটা চলে গেল অনেকটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে।
–
মধ্যরাত। সন্ধ্যায় বৃষ্টি হওয়ায় গায়ে কাটা দেওয়া ঠান্ডা বাতাস বয়ে আসছে। তুহিনের ফ্ল্যাটটা লেকের ঠিক পাশেই। ব্যালকনি দিয়ে ভালোভাবেই দেখা যায় লেকটা। যার ফলে ওর বারান্দায় হাওয়ার পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। কিন্তু সেসবে ভ্রুক্ষেপ নেই তুহিনের। একটা ট্রাউজার আর পাতলা টিশার্ট পড়ে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। এলোমেলো চুলগুলো হালকা দুলছে বাতাসে। মন ভালো নেই ওর। সব ঝামেলা মিটিয়ে অনেক রাতে ফিরেছে বাড়িতে। খাবার গলা দিয়ে নামেনি ওর। মাহমুদা জোর করেও দু লোকমার বেশি ভাত খাওয়াতে পারেনি। শুধু এক কাপ কড়া কফি খেয়েছে। ভীষণ অস্থির আগছে আজ ওর। এক সন্ধ্যায় কতকিছু ঘটে গেল আজ। শান মীর্জার মৃ-ত্যু! সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও ব্যপারটা আটকাতে পারেনি ও। ওর ক্যারিয়ারের সরচেয়ে বড় ব্যর্থতা এটাই ছিল। সবচেয়ে বড় দাগ! রুদ্র আমেরকে দেখেছে ও। প্রথমবার। তাও কয়েক সেকেন্ডের জন্যে। কিন্তু এই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই যেন ঝড় তুলে দিয়ে গেল ছেলেটা! রুদ্র সম্পর্কে এতোদিন যা যা শুনেছে তা বেশি নয়, বরং কম। তা আজ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে তুহিন! জ্যোতি ঠিকই বলেছিল, রুদ্রকে মিসআন্ডার্স্টান্ড করার চেয়ে বড় বোকামি হয়না। সত্যিই হয়না।
মনের অস্থিরতা বাড়ল তুহিনের। এরকম পরিস্থিতিতে একমাত্র ইরাবতীই পাড়তো ওর মনকে শান্ত করতে। এই নিয়ে আরও তিনবার কল করেছে ইরাকে। কিন্তু কল রিসিভ করেনি সে। কিন্তু আজ আর থামল না তুহিন। নিজের সমস্ত অহমকে একপাশে সরিয়ে রেখে আবার কল করল ইরার নাম্বারে। কিন্তু এবার রিসিভড হল কলটা। তুহিন সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘ হ্যালো! হ্যালো ইরা!’
অপাশ থেকে থমথমে গলায় জবাব এলো, ‘ কী হয়েছে? এতোবার কল করছো কেন?’
খানিকটা দমে গেল তুহিন। আজকের এই দুই লাইনে কোথাও নিজের পুরোনো ইরাবতীকে খুঁজে পেলোনা তুহিন। পেলো এক শক্ত কঠোর ইরাকে। যে তুহিনকে ছাড়াই বাঁচতে জানে। শুকনো ঢোক গিলল তুহিন। নরম গলায় বলল, ‘কেমন আছো?’
‘ শুধু এইটুকু জানতেই এতোবার কল দিচ্ছিলে নাকি?’
‘ এভাবে কথা বলছো কেন?’
‘ স্বাভাবিকভাবে কথা বলছি।’
ইরার কঠোরতা কোনভাবেই হজম করে উঠতে পারছেনা তুহিন। কেমন দমবন্ধ লাগছে ওর। অস্থিরতা বাড়ছে। ও কোনমতে বলল, ‘জিজ্ঞেস করলেনা আমি কেমন আছি?’
ইরা কঠোরভাবে জবাব দিল, ‘ খারাপ থাকারতো কথা নয় তুহিন। তোমার জীবনে আর কোন ডিস্টার্বেন্স নেই বলেই জানি আমি। সমস্যা কোথায়?’
‘ আমরা কী আরেকটাবার ভাবতে পারি ইরা?’ স্পষ্ট আহ্বান তুহিনের।
কিন্তু তুহিনের এই আহ্বান কাঁটার মতো ফুটল ইরার গায়ে। ক্লিষ্ট হেসে বলল, ‘এসব কথা এখন ভিত্তিহীন তুহিন। সামনের শুক্রবার আমার এনগেইজমেন্ট। অনেকটা দেরী হয়ে গেছে।’
থমকে গেল তুহিন। চারপাশটা কেমন ঝি ঝি করে উঠল। গুলিয়ে গেল সবকিছু। ইরার কথাটা হজম করতে বেশ অনেকটা সময় প্রয়োজন হলো ওর। যখন সামলাতে পারল তখন কোনমতে বলল, ‘ মজা করছো?’
চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠল ইরার। কঠোর আওয়াজে বলল, ‘মজা করার সম্পর্কটা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে তুহিন। আমার বয়স জানোনা তুমি? এতোদিন শুধুমাত্র তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। বাবার দেওয়া প্রেশার, একের পর এক ভালো ভালো প্রস্তাব, আত্মীয় সজনের খোটা সবকিছু একা হাতে সামলেছি। তবুও কখনও তোমাকে প্রেশার দেইনি। তোমার পরিস্থিতি বুঝেছি, সময় দিয়েছি। কিন্তু বিনিময়ে কী পেয়েছি বলোতো? কখনও জানতে চেয়েছো আমার কী পরিস্থিতি? আমি কীকরে এসব সামলাচ্ছি? আমি কেমন আছি? আমার অনুভূতি, আমার এক্সপেক্টেশান এগুলো নিয়ে কোনদিনও কোন মাথাব্যথা ছিল তোমার? তবুও মানিয়ে নিচ্ছিলাম আমি। কিন্তু আমার আত্মসম্মান আমার কাছে সবার আগে তুহিন। কারো জীবনের অপশন হয়ে থাকা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। তাই এবার আর বাবাকে বারণ করার কারণ পাইনি আমি। আর তাছাড়াও, এখন এসব কথার কোন মানে নেই। এখন আর কিছু বাকি নেই।’
‘ সত্যিই কিছু বাকি নেই?’
‘ না!’
মৃদু হাসল তুহিন। লম্বা শ্বাস ফেলল। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ ভালো থেকো ইরাবতী।’
বলার সঙ্গে সঙ্গেই কলটা কেটে দিল তুহিন। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আকাশের বিস্তৃত অন্ধকারে। বুকের ভেতরটা হঠাৎ প্রচণ্ড খালি লাগল। অনুভূতিগুলো কেমন ভোঁতা মনে হল। কষ্ট হচ্ছে কি-না জানেনা তুহিন। শুধু জানে, শীতল বাতাসটাও প্রচণ্ড গরম লাগছে। তাপে ঝলসে যাচ্ছে সর্বাঙ্গ। দমবন্ধ হয়ে আসছে, অসহ্য লাগছে। যেন কোন ছোট্ট কফিনে জোরপূর্বক বন্দি করে রাখা হয়েছে ওকে। একা, জ্যান্ত!
–
বর্তমানে ডক্টর মহিউদ্দিনের ল্যাবে আছে তুহিন। সকালে উঠে সবার আগে ফরেসিকেই এসেছে ও। শানের লাশটা নিয়েই আপাদমস্তক গবেষণা করে চলেছে মহিউদ্দিন শেখ।
পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুহিন। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখে চলেছে মহিউদ্দিনের একেকটা গতিবিধি। মহিউদ্দিন লাশের কাছ থেকে সরে আসতেই ও বলল, ‘কী বুঝলেন শেখ?’
‘মাথায় আঘাতের কারণেই মরেছে। সন্দেহ নেই তাতে।’
‘সেটা আমিও দেখতে পাচ্ছি। আনইউজয়াল কিছু থাকলে বলুন।’
ফোঁস করে শ্বাস ফেলল মহিউদ্দিন। তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ আজইউজয়াল কিছুই নেই। দুদিন নির্মম ট-র্চা-র করা হয়েছিল শানের ওপর। আর মাথার আঘাতটা খুবই ডেঞ্জারাস ছিল। যেন কোন বদ্ধ উন্মাদের আঘাত! বিশেষকরে শেষের আঘাতগুলো। এইটুকু নিশ্চিত আঘা-ত করার সময় নিজের মধ্যে ছিলোনা রুদ্র আমের। এমনভাবে মা-রছিল যেন বহু জন্মের ক্ষোভ মিটিয়েছে ওর একেকটা আঘা-তে। ইন ওয়াজ হরেবল!’
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল তুহিন। খানিকটা চিন্তা করে বলল, ‘আর কিছু? আই মিন সে দুজন আমার ওপর হামলা করতে গিয়ে মরেছে সে দুজন?’
‘ ক্রিমিনাল রেকর্ডে কোন ডিটেইলসতো নেই ভাই। নতুন মাল মনে হয়।’
‘ লোহার ঐ রড বা ছো-রাতেও কিছু পাওয়া যায়নি?’
‘ সেটা ওকে জিজ্ঞেস করো।’ ফারিয়ার দিকে উদ্দেশ্য করে বলল ডক্টর মহিউদ্দিন।
তুহিন ঘুরে তাকাল। তমালকে নিজের ডেক্সটপে কিছু দেখাচ্ছিল ফারিয়া। তুহিন তাকাতেই উঠে দাঁড়াল ও। এগিয়ে এসে বলল, ‘ স্যার, লোহার রডটাতে যে ব্লা-ড পাওয়া গেছে সেগুলো শানেরই। কিন্তু ছু-রিটাতে যে ব্লাড পাওয়া গেছে সেটার ডিনএনএ টেষ্ট করিয়েছিলাম আমরা। যেটা রাশেদ আমেরের সঙ্গে মিলে গেছে। কিন্তু লক্ষ্মীবাজারে পাওয়া ব্লা-ডের ডিএনএর সঙ্গে মেলেনি।’
তমাল বলল, ‘ রুদ্র শরীরে রক্ত ছিল স্যার। সম্ভবত ছু-রি-র এই আঘা-তই।’
কপালে ভাজ পড়ল তুহিনের। একটা সম্ভাবনা মাথায় খেলছিল ওর। রাশেদ রুদ্রর বায়োলজিক্যাল ফাদার নয়। কিন্তু এখন ও নিশ্চিত রুদ্র রাশেদেরই সন্তান। বরং লক্ষ্মীবাজারে ঘটা ঐ খু-নে এমন কেউ ছিল যে রাশেদের র-ক্তের কেউনা। কে সে? রুদ্রর সেই সঙ্গী? গতরাতে বাইকটাতে একা ছিলোনা রুদ্র। কেউ ছিল তার সঙ্গে।
‘ রুদ্রর কাছ থেকে পাওয়া পি-স্ত-লটাতে বিশেষ একটা জিনিস পাওয়া গেছে স্যার।’
ফারিয়ার কথায় ধ্যান ভাঙে তুহিনের। নিজেকে সামলে বলে, ‘সেটা কী?’
‘ পি-স্ত-লটার কোন লিগ্যাল লাইসেন্স নেই।’
তমাল বিরক্তি ঝেড়ে বলল, ‘বাহ্! খুবই বিশেষ তথ্য!’
কটমটে দৃষ্টিতে তমালের দিকে তাকাল ফারিয়া। তমাল কিছু বলতে যাচ্ছিল। তুহিন চোখ রাঙাতেই থেমে গেল। তুহিন বলল, ‘ সেটা অবভিয়াস ফারিয়া!’
ফারিয়া জানাল, ‘ ইয়েস স্যার। কিন্তু এধরণের পি-স্ত-ল খুবই রেয়ার। এম.টি.নাইন হলেও এরমধ্যে বিশেষ কিছু কারিগরি করা হয়েছে। যা মোটেও সাধারণ নয়। অ-স্ত্র সম্পর্কে উচ্চ মাত্রার জ্ঞান না থাকলে এটা সম্ভব না। অর্থাৎ রুদ্র এমন কারো কাছ থেকে অ-স্ত্রের সাহায্য নিচ্ছে যে এসব বিষয়ে খুবই দক্ষ!’
‘ হুসাইন আলী!’ আনমনেই শব্দটা বেরিয়ে এলো তুহিনের মুখ দিয়ে।
মহিউদ্দিন আর ফারিয়া নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠল। একটা চেয়ার টেনে বসল তুহিন। মিনিট খানেক গভীরভাবে চিন্তা করল কিছু একটা। হঠাৎ বলল, ‘ তমাল?’
দ্রুত এগিয়ে এলো তমাল। ব্যস্ত স্বরে বলল, ‘ ইয়ের স্যার?’
‘ হুসাইন আলীর খোঁজ শুরু করো। দ্রুত। তার বর্তমান অবস্থান জানতে হবে আমাকে। এখনই কাজে লেগে পড়ো। লাঞ্চের পর আমাকে একটু অফিস যেতে হবে। ডিজি স্যার ডেকেছেন।’
–
শাফায়াত হোসেনর দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুহিন। আজ আবহওয়া ভিন্ন। শাফায়াতের মুখভঙ্গি দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সুখকর কোন কারণে ডাকেনি ওকে সে আজ। প্রতিদিনকার মতো আজ আর ল্যাপটপে ব্যস্ত ছিলেননা উনি। অপেক্ষা করছিলেন তুহিনের আসার। তুহিন এসে বসেছে আধ মিনিট হলো। এখনো কিছু বলেনি সে। শুধু দেখে চলেছে ওকে। তুহিনও চুপ করে আছে। কিছু বলার নেই ওর। নীরবতা কাটিয়ে শাফায়াত বলল, ‘শান মীর্জার মৃ-ত্যুটা তুমি তোমার ক্যারিয়ারের জন্যে কেমন করে দেখছো তুহিন?’
সরাসরি এমন এক প্রশ্ন আশা করেনি তুহিন। খানিকটা অপ্রস্তুত হল ও। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল, ‘ব্যর্থতাটা আমার; সেটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই স্যার। কিন্তু আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম। রাস্তায় আমাকে অ্যাটাক করা হয়েছিল সেটা আপনি জানেন। সেকারণেই ঠিকসময় পৌঁছতে পারিনি আমি। দুজনকে মারতে বাধ্য হয়েছি আমি আর বাকি দুজনতো এখন কাষ্টাডিতে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। শীঘ্রই জানা যাবে কারা অ্যাটাক করেছিল আমার ওপর। শুধু মুখ খোলার অপেক্ষা।’
‘ ওরা মুখ খুলেছে তুহিন।’
চমকালো তুহিন। শাফায়াত স্থির গলায় বললেন, ‘ টাকা দিয়ে হায়ার করা হয়েছিল ওদের। কে হায়ার করেছিল জানেনা ওরা। কিন্তু যে একাউন্ট থেকে টাকা ট্রান্সফার করা হয়েছিল তার ট্রান্সজেশান ডকুমেন্ট আছে ওদের কাছে। এন্ড ইউ নো, টাকাগুলো কার একাউন্ট থেকে গেছে?’
তুহিন ভ্রুকুটি করে বলল, ‘কার স্যার?’
মুখে বলল না শাফায়াত। একটা কাগজ বাড়িয়ে দিল তুহিনের দিকে। কাগজটা হাতে নিল তুহিন। ট্রান্সজেশান আইডিটা চোখ পড়তেই থমকে গেল ও। মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল শীতল এক স্রোত। একাউন্টটা তুহিনের!
#চলবে…