অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল
৭৬.
বােতল দুটো চেঞ্জ করে দু’মিনিটের মাথাতেই ফিরে এসেছে প্রিয়তা। নিজের গ্লাসে এবার নিজেই মদ ঢালল। গ্লাসটা প্রায় ভর্তি করে আবার গা এলিয়ে দিল নরম কাউচে। সম্রাট বলল, ‘হঠাংই এতো গম্ভীর হয়ে গেছাে কেন? বহুদিন পর এভাবে দুটো খু-ন করেছোে বলে?’
প্রিয়তা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘খুনদুটো করে বিন্দুমাত্র আফসােস নেই আমার।’
সম্রাট হালকা হেসে সিগারেটে সুখটান দিল। সেটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে রেখে বলল, ‘সে আমি জানি। রুদ্র তােমার পেছনে পাহারাদার লাগালে কী করবে কিছু ভেবেছো?’
‘ভাবা আছে। তবে কতোটা ওয়ার্ক করবে জানিনা। ডিপেন্ডস অন লাক। কোান “প্লান বি” রেডি নেই। সেটা নিয়েই ভাবছি এখন। আর ভোর হলেই ভাড়া করা ফ্ল্যাটটাতে ফিরে যাবো। ঐ স্কুলে কথা বলা আছেতো?’
‘আছে। সব পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়ে আসা হয়েছে। যেই জিজ্ঞেস করবে বলা হবে তুমি ওখানেই চাকরি নিয়ছাে।’
‘গুড! আমিও কাল থেকে জয়েন করব। জ্যোতিকে এতােদিন না বললেও, দুদিন আগে বলে দিয়েছি কোথায় কাজ করছি।’
‘কেন?’
‘কারণ আমি চাইনা রুদ্র আমাকে আন্ধের মতো খুঁজুক। তাতে কেঁচো খুড়তে কেউটে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা বেশি।’
‘সেটাই বেটার। কিন্তু একটা খবর দেওয়ার ছিল তােমাকে। সুযােগ পাইনি বলে বলা হয়নি।’
প্রিয়তা কিছু বলল না। খবর শোনার কোন আগ্রহও দেখা গেলােনা ওর মধ্যে। সম্রাট তবুও বলল, ‘রুদ্রর চ্যালা। কী যেন নাম? হ্যাঁ, রঞ্জু ছিলোনা? সাভারের দিকের গোডাউনটায় এসেছিল ও। কোনভাবে খবর পেয়েছিল আমি, বাবা আর পলাশ আঙ্কেল যাচ্ছি ওখানে। লুকিয়ে খবর জোগাড় করতে গিয়েছিল। ধরা পড়ে যায়। আমার লোকজন কু-পিয়ে মেরে রাস্তার পাশে ঝোপের মধ্যে ফেলে এসেছে।’
প্রিয়তা গ্লাসে চুমুক দিতে নিয়েও থেমে গেল। চুমুক দিলোনা আর। গ্লাসটা আবার নামিয়ে রেখে চুপ থাকল কয়েক সেকেন্ড। থমথমে গলায় বলল, ‘কিছু জানতে পারেনিতাে?’
‘শুধু এইটুকুই শুনেছিল যে ইকবাল আমাদের হাতে বন্দি। আর কিছু করেনি ও। আর আমি তখন মজা করে বলেছিলাম, “রুদ্র বেচারা এবার তার বউকে হারাবে।” ও
হয়তাে ভেবে বসেছিল তােমাকে খু-নটুন করার কথা ভাবছি।’
বলে শব্দ করে হাসল সম্রাট। কিন্তু প্রিয়তা কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অ্যাশট্রেতে পড়ে থাকা ছাইগুলোর দিকে।
সম্রাট তীক্ষ দৃষ্টিতে দেখছে প্রিয়তাকে। মাঝে মাঝে মৃদু চুমুক দিচ্ছ গ্লাসে। বোঝার চেষ্টা করছে আসলে কী চলছে এর মনে।
সেই থেকে দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। পরপর দুটো গ্লাস শেষ করার পর প্রিয়তা সম্পূর্ণ শরীর ছেড়ে দিয়েছে কাউচে। চোখ বন্ধ করে একটা হাতটা রেখেছে কপালের ওপর। এখনাে ওভাবেই আছে। সম্রাট লক্ষ্য করল, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে বুকের স্বাভাবিক ওঠানামা ছাড়া আর কোন নড়াচড়ার লক্ষন অবধি দেখা যাচ্ছেনা প্রিয়তার শরীরে। অথচ প্রিয়তা ঘুমায়নি, পূর্ণ জ্ঞানে সে। সেটা জানা সম্রাটের।
মেয়েটা কতটা অস্বাভাবিক আর অদ্ভুত! কল্পনা করেও গা শিরশির করে উঠলো সম্রাটের। এই দুইঘন্টায় কোন এক অদৃশ্য আকর্ষণে একবারের জন্যেও চোখ সরাতে পারেনি প্রিয়তার থেকে। তবে আরো একবার ব্যপারটা চিন্তা করে ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে ওর। এমনটাইতো হওয়া উচিত। যার নামই রাণী, তার ব্যাক্তিত্ব সাধারণ হলে চলবে কেন? প্রিয়তার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই সম্র্রাট বলল, ‘যদি আমার জন্যেই এখানে বসে থাকো তাহলে বলব তুমি একাও রুমে যেতে পারো রানি। আমি জানি তুমি টায়ার্ড।’
প্রিয়তা কপালে হাত রেখেই কপালটা কুঁচকে ফেলল, ‘তােমার মনে হচ্ছেনা, তুমি আজকাল বাঁচাল হয়ে যাচ্ছ?এককথা বারবার বলা তােমার রােগে পরিণত হচ্ছে?’
কথাটা গায়ে লাগল সম্রটের। ঠোঁটের মৃদু হাসিটা মিলিয়ে গেল। মেয়েটার কথা বলার ধরন আগেও এমন ছিল। তবে আগে প্রিয়তার এসব উগ্র কথায় সম্রাট কেবল নির্লিপ্ততা দেখতে পেতা। কিন্তু আজকাল নির্লিপ্ততার সাথে সাথে অবহেলাও দেখত পায়। বিরক্তি দেখতে পায়। তবুও কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব নমনীয় রেখে বলল, ‘একদম চুপচাপ শুয়ে আছাে তাই বললাম। মনে হল রেস্ট দরকার। কিন্তু আমার জন্য নিতে পারছাে না। তাই বারবার বলছি। এতে বাঁচালপনার কিছু নেই।’
প্রিয়তা লম্বা শ্বাস ফেলল। নিজেকে সামলে নিয়ে গলার স্বরটা নামিয়ে বলল, ‘তেমন কিছুনা। আ’ম ফাইন। তােমার প্রয়ােজন হলে তুমি রুমে যেতে পারো।’
‘আমি তােমার জন্যে বলছিলাম।’
‘থ্যাংকস ফর দ্য ফেভার।’
‘বড্ড বেশি পর করে দিচ্ছোনা আজকাল? এতগুলোদিন পর আমরা একসঙ্গে সময় কাটাচ্ছি রাণী। কিন্তু তােমার মধ্যে কোনরকম আনন্দ বা ভালাোলাগা দেখতে পাচ্ছিনা আমি। যেটা আগে দেখতে পেতাম।’
‘সম্রাট, প্লিজ। ইমোশনাল ফুলের মতো কথা বলোনা। কথা বলতে ভালোে লাগছেনা আমার। তাই চুপ করে আছি।’
‘কিছু খাবে? আনাবো?’
‘না। আপাতত একটু চুপ থাকতে চাই।’
‘কী হয়েছে বলোতো?’
‘স্ট্রেস লাগছে।’ এবার আর রেগে গেলনা। নরম, ক্লান্ত গলাতেই বলল প্রিয়তা। এখনা চোাখ খােলেনি সে।
সম্রাট আর কিছু বলল না। আরও এক গ্লাস মদ ঢালল। চুমুক দিতে দিতে দ্বিতীয়বার তাকাল প্রিয়তার দিকে। খানিক বাদে হঠাৎই অন্যকিছু খেলে গেলা ওর মস্তিষ্কে। গভীরভাবে লক্ষ্য করল প্রিয়তার শরীর। হেলান দেওয়ার ফলে দুদিকে সামান্য সরে গেছে জ্যাকেটটা। কালো রঙের গেঞ্জিটার চারপাশে উন্মুক্ত হলদে ফর্সা শরীরের অংশগুলো যেন চকচক করছে। লম্বাটে মসূন গলা, সুউন্নত বুকের ওঠানামা, বক্ষভাজ, লম্বা সুগঠিত পা। সবকিছুই লক্ষ্য করল গভীরভাবে। মদের নেশার সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়তার নেশাটাও চড়াও হল মাথায়।
প্রিয়তার সেদিকে খেয়াল নেই। ও এখনো চোখ বন্ধ করে বসে আছে। সম্রাট প্রিয়তার শরীর থেকে চোখ না সরিয়েই গ্লাসের অবশিষ্ট মদ একেবারে পেটে চালান করে দিল। ডান হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছল। চোখে মাদক দৃষ্টি নিয়ে আরেকটু এগিয়ে বসল প্রিয়তার দিকে। এখন ওদের মধ্যে খুব সামান্য দূরত্ব অবশিষ্ট আছে। সম্রাট প্রিয়তার দিকে খানিকটা ঝুকে বলল, ‘স্ট্রেস ফিল করছোে সেটা আগে বলবে তো। তুমিতো জানাে স্ট্রেস রিলিজ করতে আমি এক্সপার্ট।’
বলে আরা একবার দেখে নিল প্রিয়তাকে। আরেকটু এগিয়ে গেল নিজের অজান্তেই। একদম নিচু গলায় ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আই ক্যান রিলিজ অল ইউর স্ট্রেস।’
কথাটা বলে প্রিয়তাকে আদর করার জন্য হাত বাড়াচ্ছিল। কিন্তু সম্রাটের হাত প্রিয়তার গাল ছোঁয়ায় আগেই ঝট করে চোখ মেলল প্রিয়তা। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালাে সম্রাটের দিকে। ভেতর থেকে কেঁঁপে উঠলো সম্রাট। হাত ওখানেই স্থির হয়ে গেল। সেই চোখে চোখ রাখতে পারল না। পরাজিত সৈনিকেকর ন্যায় চোখ সরিয়ে নিল। মনে হল চোখের ঐ দৃষ্টিতেই সম্রাটকে ভস্ম করার ক্ষমতা রাখে প্রিয়তা। প্রিয়তা ক্রোধভর্তি চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। দাঁতে দাঁত পিষে বলল, ‘কী করছিলে?’
সম্রাট উত্তর দিলোনা। অস্থিরভাবে চোখজোড়া ঘুরে এলাে রুম জুড়ে। প্রয়তা সোজা হয়ে বসল। রাগে গজগজ করে বলল, ‘নিজের হাত আর চোখের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে শেখো সম্রাট। এমন অনেক হাত আর চোখ উপড়ে ফেলার অভ্যেস আছে আমার। সেটা ভুলে যেওনা।’
এতক্ষন সহ্য করলেও এবার বিরক্ত হল সম্রাট। ধের্য্য হারালাে। ভালোবেসে সবকিছু সহ্য করে বলে সীমা পার করে ফেলবে নাকি এই মেয়ে? যা খুশি বলবে? এই মেয়ে যদি রাণী হয়, ও নিজেও সম্রাট। সেটা রানির বাোঝা উচিত।বিরক্তিমাখা কণ্ঠে সম্রাট বলল, ‘অতিরিক্ত.করছাে না? এমন বিহেভ করছো যেন আমি এই প্রথম তােমাকে স্পর্শ করছি।’
‘স্পর্শ বলতে কী বোঝাতে চাইছো তুমি?’
‘ যতটা ভাবছাে ততটা বোঝাচ্ছিনা। কিন্তু ততটা না হলেও কিছুটাতাে ছিল। আর তাছাড়াও, ততদূর এগোনোর মতাে সম্পর্ক কিন্তু আমাদের আছে রাণী। ভুলে যেওনাআমাদের সম্পর্কটা কী।’
‘ আমি ভুলিনি।’
‘ তাই? তাহলে হাতের রিংটা কোথায়?’
‘ আছে। শাওয়ার নেওয়ার সময় খুলে রেখেছিলাম।’
‘ হাহ! এক্সকিউজ রেডি থাকে সবসময়। আচ্ছা ভোলোইনি যখন তখন এভাবে রিঅ্যাক্ট করার কারণটা বলবে?’
‘ আমার পারমিশন ছাড়া আমার শরীরে কেউ হাত দিক
সেটা আমি পছন্দ করিনা। তখন পারমিশন পেয়েছিলে,
এই মুহুর্তে পাচ্ছাোনা। সিম্পল।’
রেগে গিয়ে উঠে দাঁড়াল সম্রাট। কাউচে একটা লাথি বসিয়ে বলল, ‘সিম্পল! সব তােমার ইচ্ছেতে হবে? অথচ প্রায় দুটো বছর রুদ্রর সঙ্গে এক বিছানায় থেকেছাে। রুদ্রর শরীরে লেপ্টে প্রতিটা রাত কেটেছে তােমার। তােমার শরীরের প্রতিটা অঙ্গে নিশ্চয়ই রুদ্রর ছোঁয়া লেগে আছে। ওর বাচ্চাওতোে ছিল তোমার গর্ভে। সেগুলােও সব তােমার ইচ্ছেতে হয়েছিল? খুব ভালো লাগতো যখন ঐ বা-স্টা-র্ডটা তোমার সারা শরীর স্পর্শ করতো। আদর করতো। খুব এনজয় করেছিলে সেই রাতগুলো? সেটাই ধরে নেব আমি?’
হিংস্র বাঘিনীর মতো সম্রাটের দিক তাকাল প্রিয়তা। উঠে দাঁড়িয় সজোরে লাথি মারল টি-টেবিলে। টেবিলটা উল্টে পরল। ঝনঝন শব্দে ভেঙ্গ গেল ওপরের কাঁচ। মদের বােতল, গ্লাসও পরে ভেঙ্গে গেল। সম্রাট হতবাক হয়ে দেখল এই দৃশ্য। প্রিয়তা এগিয়ে একদম মুখোমুখী দাঁড়াল সম্রাটের। তর্জনী আঙুলটা তুলে ধরল ওর মুখের সামনে। রাগে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। যখন গলা দিয়ে আওয়াজ বের হল তখন হিসহিসিয়ে বলল, ‘ভেবে চিন্তে কথা বলো সম্রাট। নয়তো আমি ভুলে যাবো তুমি কে। আমি কী করেছি, কেন করেছি সবটাই খুব ভালাে করে জানা তুমি। তাই সেইসব কথা তুলে আমায় অপমান করার চেষ্টাও করোনা। তােমার বেড়রুমে নিয়মিত মেয়েদের আসা-যাওয়া যে এখনো বন্ধ হয়নি, সেটা কিন্তু আমার জানা।’
সম্রাট চকিতে তাকাল প্রিয়তার দিকে। ব্যপারটা প্রিয়তা কীকরে জানল বুঝতে পারল না। প্রিয়তা শক্ত কন্ঠে বলল, ‘আমি কিন্তু সেসব নিয়ে এখন আর কিছু বলিনা
তােমাকে। আশা করব তুমিও বলবেনা। সময়ের সাথে অনেককিছু বদলে গেছে এখন।’
কাউচের ওপর থেকে নিজের ফোন তুলল প্রিয়তা। জয়কে কল করে বলল, ‘গাড়ি বর করো। ফ্র্যাটে যাবো আমি। ওপাশ থেকে কিছু বলার পর আরও রেগে গিয়ে বলল, হ্যা ভাড়া করা ঐ ফ্ল্যাটেই। ডাফার!’
কথাটা বলে সম্রাটের দিকে একপলক তাকাল প্রিয়তা। তারপর হনহনে পায়ে বেরিয়ে গেল পাবের রুমটা থেকে। সম্রাট শক্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল প্রিয়তার যাওয়ার দিকে। মেয়েটা দিন দিন হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে না? এই সেই প্রিয়তা যে ওর প্রেমে পাগল ছিল! নাকি অন্য এক প্রিয়তা, শাওয়ারের পর যার এনগেইজমেন্ট রিং পরতে মনে থাকেনা অথচ গলায় লকেট পরতে ঠিকই মনে থাকে। না, এমন হলেতো চলবে না। মেয়েটাকে বাগে আনতে হবে। সােজাভাবে না হলে বাঁকাভাবে।
–
সেই ভােররাতে বাড়ি ফিরেই সবার আগে জ্যোতির কাছে গেল রুদ্র। দরজায় দুবার কড়া নাড়তেই জ্যোতি দরজা খুলল। রুদ্রকে এইসময় ওর রমে দেখে বেশ অবাক হল
জ্যোতি। আবাক হয়েই বলে, ‘তুমি? কিছু লাগবে?’
‘লাস্ট কবে কল করেছিল প্রিয়? সােজা কথায় আসল রুদ্র।
জ্যোতি মনে মনে হাসল। রুদ্র অপ্রয়োজনে ওর কাছে আসবে সেটা ভাবাও বোকামি। বাধ্য না হলে জ্যোতির আশেপাশেও আসেনা রুদ্র আমের। মুখে বলল, ‘গত পরশু।’
‘নাম্বারটা দে।’
জ্যোতি চমকে তাকাল। এতােদিনে একবারও নিজে থেকে প্রিয়তার খোঁজ নেয়নি রুদ্র। আজ কেন? কিছু কী হয়েছে?
‘কী হয়েছে রুদ্র? কোন বিপদ?’
‘নাম্বার চেয়েছি আমি।’
‘কিন্তু প্রিয়তাতাে বলেছিল তুমি ওর সঙ্গ যোগাযোগের কোন চেষ্টা করলে ও নিজেকে_’
‘মাই ফুট!’ ধমকে উঠল রুদ্র। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘ঐ মেয়ের জেদ অনেক সহ্য করেছি আমি। অনেক প্রশ্রয় দিয়েছি। একটা ট্রমায় ছিল ও। এখানে থাকলে সেটা আরও বাড়তো। তাই ওকে নিজের মতো কিছুদিন থাকতে দিয়েছি। আর না। আমিও দেখি ও কীকরে নিজের ক্ষতি করে। হাত-পা বেঁধ ঘরে ফেল রাখব। নাম্বার দে।’
“কল করে কথা বলে কোন লাভ হবে বলে মনে হয়না।’
‘লােকেশন ট্রাক করব।’
‘ও কোথায় চাকরি করে আমি জানি।’
রুদ্র চমকে তাকাল। বিস্মিত কন্ঠে বলল, ‘কী?’
জ্যোতি তগপ্ত শ্বাস ফেল বলল, ‘হ্যা। লাস্ট যখন কথা হলাে কথায় কথায় বলে ফেলেছে। একটা প্রাইভেট স্কুলে জয়েন করেছে আপাতত। যদিও রিকোয়েস্ট করেছে তােমাকে যাতে না বলি।’
রুদ্র থমথমে গলায় বলে, ‘কোন স্কুলে?’
জ্যোতির কাছ থেকে স্কুলের নামটা শুনে আর দাঁড়ায়না.রুদ্র। চলে যায় নিজের রুমে। জ্যোতি রুদ্রর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস চাপল। আজ রাতেও নিশ্চয়ই ঘুমায়নি রুদ্র। ভালোবাসার মানুষটা কতটা যন্ত্রণার দিন পার করছে ভেবে বুকে চিনচিনে ব্যাথা করে ওঠে ওর। ওর কী কিছুই করার নেই? যাতে করে মানুষটার কষ্ট কিছুটা লঘু হয়। রুদ্রকে ভালো রাখার জন্যে যদি প্রাণও দিতে হয়, যদি তা নির্দ্বিধায় দিতে পারবে।
এদিকে রুদ্র ভাবছে, কালকেই প্রিয়তার সঙ্গে কথা বলতে হবে ওকে। যেভাবেই হোক সঙ্গ করে নিয়ে আসতে হবে আমের ভিলায়। বাইরে মেয়েটার জন্যে কেমন বিপদ অপেক্ষা করছে রুদ্র জানেনা। আর যাই হাক, প্রিয়তার আর কোন বিপদ হতে দেবেনা ও। একমাত্র প্রিয়তাই আছে। ওর ভরসা, ওর শক্তি, ভালোবাসা। নিজের বাবাকে হারিয়েছে, সন্তান হারিয়েছে, একমাত্র বােনের করুণ পরিণতি দেখেছে। এখন প্রিয়তার কোন ক্ষতি সহ্য হবেনা ওর। কোনভাবেই না।
বর্তমান ~
‘আসব স্যার?’
তমালের ডাক শুনে থেমে যায় জ্যাতি। গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল তুহিন। ওর মনোযোগেও ছেদ ঘটে। তুহিন ভ্র কুঁচকে তাকায় দরজার দিকে। তমাল ইতস্তত করে.বলে, ‘ডিসটার্ব করার জন্যে স্যরি স্যার। একটা গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন ছিল তাই।’
তুহিন গম্ভীর গলায় বলে, ‘এসো।’
তমাল দ্রুত ভেতরে ঢুকে বলে, ‘ঐ দুজন ফেক নার্সের
মধ্যে একজনের ইনরমেশন মিস ফারিয়া আমাদের ক্রিমিনাল রেকর্ডে পেয়েছে স্যার। আশা করছি ওর সব ইনফরমেশনও পাওয়া যাবে। ফারিয়া আসছেন।’
‘তুমি ফারিয়াকে নিয়ে একবারেই আসতে পারতে তমাল।
মাঝখানে এসে ডিসটার্ব করার কান কারণ ছিলোনা।’
তুহিনের থমথমে গলায় ঢোক গিলল তমাল। নিচু গলায়
বলল, ‘স্যরি স্যার।’
‘ফারিয়া আসার আগ অবধি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো এখানে। কোন কথা বলবে না।’
‘জি স্যার।’
তুহিন আবার তাকাল জ্যোতির দিকে। জ্যোতি অন্যমনস্ক হয়ে কিছু একটা ভেবে চলেছে। দৃষ্টি শূন্য। ঠোঁট কেঁপেই চলেছে অনবরত। তুহিনে গলা ঝেড়ে বলল, ‘মিস জ্যোতি?’
জ্যোতি চমকালো। বোকার মতাে তাকাল তুহিনের দিকে। তুহিন বলল, ‘প্রিয়তা কী আর ফিরেছিলেন আমের ভিলায়?’
‘ফিরেছিল।’
‘রুদ্রই ফিরিয়ে এনেছিল তাকে?’
‘না।’
‘তবে?’
‘আমার খুব খারাপ লাগছে। দুটো মিনিট বিশ্রাম নিতে পারব স্যার?’
তুহিন দেখল সত্যিই বিধ্বস্ত লাগছে জ্যোতিকে। ঘেমে গেছে। তুহিন মহিলা কন্সটেবলকে বলল, ‘টিস্যু নিয়ে আসুন।’
কন্সটেবল টিস্যু এনে দিতেই টিস্যবক্সটা জ্যোতির দিকে বাড়িয়ে দিল তুহিন। কিছু বলল না। জ্যোতি নিজেই ওখান থেকে টিস্যু নিয়ে নিজের ঘাম মুছতে শুরু করল। তুহিন ভাবছে প্রিয়তা হঠাৎ চলে গেল কেন আমের ভিলা ছেড়ে? সন্তান হারানোর জন্যে রুদ্রকে দায়ি করা অবধি ঠিক ছিল। কিন্তু তাই বলে একেবারে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে গেল মেয়েটা! ব্যপারটা কী এতােই সহজ?
রাশেদ আমের নিজে যাচাই করে, অনাথ আশ্রমে খোঁজ নিয়ে, সবটা জেনে তবেই প্রিয়তাকে বউ করে এনেছিলেন ঘরে। তাই তুহিন তেমনভাবে কখনও সন্দেহ করেনি প্রিয়তাকে। কিন্তু আজ হঠাংই মনের মধ্যে খচ করে উঠল ‘প্রিয়তা’ নামটা। সবকিছুর মূলে তবে এই মেয়েটা নয়তো!কিন্তু আমের ভিলার অফিশিয়াল তথ্যগুলোতো প্রিয়তার জানার কথা না। সেগুলো কীকরে জানতো সে? নাকি
তুহিন অযথাই সন্দেহ করছে?
কিছু একটা ভেবে তুহিন জ্যোতিকে বলল, ‘আচ্ছা প্রিয়তার কোন ছবি আছে আপনার ফোনে? আমি একবার ভালোভাবে দেখতে চাই তাকে।
জ্যোতি অবাক হয়ে বলল, ‘আছে। কিন্তু ওর ছবি দেখে আপনার কী লাভ?’
‘যা বলছি তা করুন।’
‘ফোনটা দিন।’
তুহিন দ্রুত জ্যাতির ফোনটা এগিয়ে দেয় জ্যোতির দিকে জ্যোতি ফোনটা কিছুক্ষণ ঘেঁটে একটা ছবি বের করে দেয় তুহিনের সামনে। তুহিন খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে ছবিটা। চেনার চেষ্টা করে। কিন্তু পরিচিত মনে হয়না কোনভাবেই। মেয়েটা সুন্দরী। বিশেষ করে চোখদুটো। সত্যিই যে কাউকে সম্মোহনীত করার ক্ষমতা রাখে ঐ চোখ। এই চোখেই বোধ হয় নিজের সর্বনাশ দেখেছিল রুদ্র আমের!
এছাড়া আর বিশেষ কিছুই পায়না তুহিন। তুহিনের ভাবনার সুতোে ছেড়ে ফারিয়ার আগমনে। ফারিয়া এসে প্রথমে সালাম দেয় তুহিনকে। তারপর কিছু ডকুমেন্ট টেবিলে রেখে বলে, ‘ঐ মহিলা কোন নার্স নন স্যার। একটা বাটপারীর র্যাকেটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন একসময়। আমাদের ইনফরমেশন তাই বলছে। এখানে ঐ মহিলার সব ডিটেইলেস আছে। ঠিকানাও আছে। তবে এখনাে সেই ঠিকানায় সে আছে কি-না তা জানিনা।’
তুহিন জ্যোতির মোবাইলটা টেবিলে রেখে কাগজগুলো দেখতে দেখতে বলল, ‘গুড জব ফারিয়া।’
কিন্তু তুহিনের এপ্রিসিয়েশন কানে গেলোনা ফারিয়ার। ও অবাক হয়ে দেখছে জ্যোতির ফোনের স্ক্রিনে ভেসে থাকা প্রিয়তার ছবিটা। ফারিয়া হঠাৎ বলে উঠল, ‘রাণী!’
ক্র কুঁচকে তাকালো তুহিন। বুঝতে না পেরে বলল, ‘কে রাণী?’
‘এই ছবিটা রাণীর স্যার। আমরা ইন্টার কলেজে একসঙ্গেই পড়েছি। ওর ছবি এখানে! ও কী কোনভাবে এই কেসের সঙ্গে যুক্ত স্যার?’
তুহিন চমকালাে। তমালের মুখ দু’ইঞ্চি হা হয়ে গেছে। তুহিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আর ইউ শিওর ওর নাম রাণী?’
ফোনটা তুলে নিল ফারিয়া। ভালোভাবে জুম করে দেখে নিয়ে বলল, ‘হান্ড্রেট পার্সেন্ট স্যার। ওর নাম রাণীই। ও কলেজে থাকতে কবিতা লিখতো স্যার। কলেজ ম্যাগাজিনে বের হওয়া ওর লেখা একটা কবিতার ছবি এখনো আছে আমার কাছে। আমার খুব ভালো লেগেছিল বলে রেখে দিয়েছিলাম কবিতাটা এতোটাই সুন্দর যে সেটা এখনো আছে আমার কাছে। দেখাচ্ছি।’
দ্রুত নিজের ফোনটা বের করল ফারিয়া। কিছু সময় ওটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করার পর একটা ছবি বের করল। ফোনটা এগিয়ে দিল তুহিনের দিকে। তুহিন ভালোভাবে দেখল। হ্যাঁ, কবিতার ওপরে ছাপা ছবিটা প্রিয়তারই। কিন্তু নামটার ওপর চোখ যেতেই হতভম্ব হল তুহিন। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল ফোনের স্ক্রিনে।
তুহিনের প্রতিক্রিয়া দেখে তমাল এগিয়ে এসে বলল, ‘কী দেখলেন স্যার?’
তুহিন কিছু বলল না। কেবল ফোনটা এগিয়ে দিল তমালের দিকে। নামটা দেখে তমালও চমকালো। চমকে গিয়ে বলল, ‘ওর নামতা সত্যিই রাণী স্যার।’
‘শুধু নামটা দেখলে? পদবীটা দেখোনি?’
তুহিনের কথায় ভ্রু কুঁচকে পদবীর দিকে তাকালো তমাল। আর যা দেখল তাতে এতােটাই অবাক হল যে আপনাআপনি মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলাে, ‘অবিশ্বাস্য!’
#চলবে…