অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল
৮২.
আমের ভিলায় ফিরতে অনেকটা রাত হল রুদ্রর। বাড়ি ফিরে কোথাও কাউকে দেখতে পেল না। ব্যপারটা স্বাভাবিক। এইসময় সকলেই ঘুমিয়ে পড়ে। উচ্ছ্বাস, জাফরও নিশ্চয়ই নিজেদের ঘরে আছে। ওর নিজেরও ঘুম পেয়েছে। সারাদিন অনেকটা খাটুনি গেছে আজ। আগে সমস্ত কাজ দলের সবাই ভাগেভাগে করলেও, এখন কিছু কাজ রুদ্রকে একা করতে হচ্ছে। যেগুলো খুবই পরিশ্রমের, গোপনীয়। শারীরিক ক্লান্তিতো আছেই। তারওপর কাঁধে অনেক কাজের ভাড়। সেই কাছের একাংশ ভাগ দেওয়ার মতো বিশ্বস্ত কাঁধ নেই রুদ্রর কাছে। আবার একা কাজ করাও সম্ভব না। তাই যেটুকু কাজ অন্যকে দিয়ে করানো যায়। বাকিটা একান্তই নিজস্ব। রুদ্রর জন্যে ব্যপারটা যেন জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই। আর সেই লড়াইয়ে মানসিক শক্তিও প্রয়োজন। তাই এতো কিছুর মাঝে মনকে ক্লান্ত হতে দেয়নি রুদ্র।
নিজের ঘরে ঢুকতেই রুদ্র থমকে গেল। সারা শরীরে অবর্ণণীয় এক অনুভূতি ছেয়ে গেল মুহুর্তেই। ঘরটা আবছা অন্ধকার। কিন্তু ঘরের ভেতরের শীতল হাওয়া, আবহওয়া নিমেষেই শান্ত করে দিল মনকে। প্রশান্তিতে আপনাআপনি চোখ বন্ধ করে ফেলল রুদ্র। হঠাৎই চমকে উঠল। এতো স্বস্তি, এতো ভালোলাগা কেবল তখনই অনুভব করে, যখন প্রিয়তা ওর আশেপাশে থাকে। তারমানে প্রিয়তা এসেছে! হ্যাঁ, কুহুদের যাওয়ার কথা ছিলতো প্রিয়তার কাছে। আজই গেছে! তবেকী প্রিয়তা রাজি হয়েছে আসতে? বুকের মাঝে কেমন করে উঠল রুদ্রর। চোখ দুটো হঠাৎই জ্বলজ্বল করে উঠল। উৎসাহি হয়ে ঘরের চারপাশে চোখ বুলালো। কেউ নেই। বারান্দার দরজা খোলা। সেদিক থেকেই আসছে শীতল হাওয়া। হয়তো সেখানেই আছে রুদ্রর প্রাণবায়ু!
বারান্দায় সত্যিই প্রিয়তাকে দেখতে পেল রুদ্র। রেলিং ধরে তাকিয়ে আছে খোলা আকাশের দিকে। পরনে আকাশি রঙের স্যালোয়ার-কামিজ। খোলা চুলগুলো একপাশে করে সামনে নিয়ে রেখেছে। বাতাসে মৃদু নড়াচড়া করছে তারা। রুদ্রর দম বন্ধ হয়ে এলো। এতোগুলোদিন পরে প্রিয়কে নিজের ঘরে পাওয়ার ব্যপারটা নেহাতই ভ্রম বলে ভয় হলো। কিন্তু ঘটনাটা যে সত্যিই তা বুঝতেও বেশি সময় নিলোনা। আনন্দ, আবেগ মেশানো মৃদু খানিক হাসি ফুটল রুদ্রর ঠোঁটে। জ্বলজ্বল করে উঠল চোখজোড়া। আস্তে করে খানিকটা এগিয়ে গেল। কিন্তু হঠাৎই এতোদিনকার প্রিয়তার দেওয়া বিরহ যন্ত্রণার কথা মনে পড়তেই থমকে গেল রুদ্রর পা। অভিমানে স্থির হয়ে গেল ওর শরীর। গম্ভীর হয়ে বলল, ‘এতোদিনে তবে আমার ওপর দয়া হলো?’
প্রিয়তা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। দেখল রুদ্রকে। ওর চোখজোড়াও যেন স্থির রইল কিছু সময়ের জন্যে। মনে হলো চোখের তৃষ্ণা মেটাল প্রিয়তা নিজেও। একটু পর পুনরায় আকাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, ‘আপনাকে দয়া করার যোগ্যতা আমার নেই। আমি এখানে শুধু কুহু আর নীরবের জন্যে এসেছি।’
‘এতোটা ক্ষোভ?’
‘ক্ষোভ নয়, সংকোচ।’
‘সংকোচ?’
‘নিজের সন্তানের খু-নের জন্যে যে দায়ী, তার আশেপাশে থাকতে সংকোচ হওয়াটা স্বাভাবিক না?’
‘প্রিয়!’
‘ধমকালে সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবেনা।’
রুদ্র এবার রেগে গেল। রাগ, বিরক্তি মিশ্রিত কন্ঠে বলল, ‘তোমার কথাবার্তায় মনে হয় যে আমাদের পুচকু আমার কেউ ছিলোনা। তুমি একাই ওর মা। আমি কেউ নই। ও চলে যাওয়াতে তুমি একাই কষ্ট পেয়েছো? আমি পাইনি?’
প্রিয়তা ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। এ বিষয়ে আর কিছু বলল না। এই নিয়ে অনেক তর্ক, ঝগড়া হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। কোন লাভ হয়নি। তিক্ততা বেড়েছে কেবল। প্রিয়তা বলল, ‘খেয়ে এসেছেন?’
‘হ্যাঁ। জানতাম না আজই তুমি আসবে। অনেক রাত হয়েছিল তাই_’
রুদ্র কথা শেষ করার আগেই প্রিয়তা বলে উঠল, ‘ক্লান্ত নিশ্চয়ই? বিছানা করা আছে। শুয়ে পরুন।’
বলে প্রিয়তা রুমে গেল। কয়েক সেকেন্ড প্রিয়তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দেখল রুদ্র। আনমনেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে।
রুমে এসে দেখল প্রিয়তা নিজের কাপড় গোছাচ্ছে। লাগেজে থেকে একটা কাপড়ও বের করল না। লাগেজ সহই ঘরের এককোণে রেখে দিল। সেটা দেখে রুদ্র বলল, ‘পোশাকগুলো ওভাবেই রেখে দিলে কেন?’
‘চারদিনের জন্যে এসেছি। এইটুকু সময়ের জন্যে জামাকাপড় বের করে কী লাভ?’ বলতে বলতে টি-টেবিলের কাছে চলে গেল প্রিয়তা।
রুদ্র একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, ‘বাহ্! তাহলে এই ঘরে এসেছো যে? আমের ভিলায় ঘরের অভাব পড়েছে বলেতো আমার জানা নেই।’
প্রিয়তা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালল। ভাবলেশহীনভাবে বলল, ‘একবার ভেবেছিলাম। কিন্তু সামনে বাড়িতে বিয়ে। নতুন কোন তামাশা করতে চাইনি, তাই এই ঘরেই এসেছি।’
পানি খেয়ে লম্বা শ্বাস ফেলল প্রিয়তা। পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই হাত ধরে ফেলল রুদ্র। নিজের দিকে টেনে নিল। প্রিয়তার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘পাথর হৃদয়তো আমাকে বলা হয়। তুমি কবে থেকে এতোটা নির্দয় হলে?’
‘সময়, পরিস্থিতি তৈরি করে দেয়।’
রুদ্র প্রিয়তার দুই বাহু চেপে ধরে ভরাট কিন্তু ব্যথিত কন্ঠে বলল, ‘অথচ তুমি আমার সময় আর পরিস্থিতিটা বুঝতে পারছোনা। আমার প্রিয়তো এমন ছিলোনা! ও আমাকে বুঝতো। আমার সমস্যা, অসুবিধা, কষ্ট সব বুঝতো। কিন্তু আজ তুমি আমাকে বুঝতে পারছোনা প্রিয়। একদম পারছোনা।’
এতক্ষণে নমনীয় হল প্রিয়তার দৃষ্টি। আদ্র দৃষ্টি ফেলল রুদ্রর চোখে। রুদ্রর দৃষ্টিও সরাসরি প্রিয়তার চোখের ওপর নিহিত। ঐ চোখের দিকে তাকিয়ে অনন্ত কাল কাটিয়ে দিতে পারে রুদ্র। কী অদ্ভুত মায়া! এই মায়ার পরেইতো ওর পাথর হৃদয় গলল। সকলের কাছে কঠোর রুদ্র আমের ঐ চোখের মায়াতেই কোমল, দুর্বল।
প্রিয়তা কম্পিত স্বরে বলল, ‘আপনিওতো আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছেন না রুদ্র।’
‘প্রিয়তা পুচকু আমার অংশ ছিল। আমার! ওর জন্যে আমারও কষ্ট হয়।’
‘আমি সেই প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইছিনা আর। আপনি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছেন আপনি কী কথা দিয়েছিলেন।’
‘ভুলিনি।’
প্রিয়তা রুদ্রর হাত নিজের বাহু থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘তবে যেদিন সে কথা রাখতে পারবেন, সেদিন জোর খাটাবেন আমার ওপর। তার আগে নয়।’ চোখের কোণে জমা অশ্রুটুকু মুছে আবার বলল, ‘আশা করি, এই চারদিন একঘরে থাকলেও দূরত্ব বজায় রাখবেন আপনি।’
প্রিয়তা যেতে চাইলে পুনরায় বাধা পেল রুদ্রর শক্ত হাতে। হঠাৎই শক্ত করে প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরল রুদ্র। সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ফেলল প্রিয়তা। ছাড়িয়ে নেবে ভেবেও কী একটা মনে করে থেমে গেল। দীর্ঘদিন পর ভালোবাসার মানুষটাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পেরে মন-মস্তিষ্ক শান্ত হয়ে গেল রুদ্রর। প্রিয়তার স্পর্শে যেন ওর সব মানসিক যন্ত্রণা হালকা হয়ে গেল। প্রিয়তার ঘাড়ে মুখ গুজে রেখে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘এইমুহূর্তে তোমাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন প্রিয়। আমাকে সবচেয়ে ভালো বাবা বুঝতেন। সে নেই। কিন্তু তার পরে আমাকে সবচেয়ে বেশি যে মানুষটা বোঝে সে তুমি। আর তুমি খুব ভালোকরেই জানো এইমুহূর্তে আমার তোমাকে কতোটা প্রয়োজন।’
প্রিয়তা রুদ্রর পিঠে আলতো করে হাত রাখল। বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দু ফোঁটা অশ্রু। ভেজা গলায় বলল, ‘তবে কেন রাখছেন না আমার কথা। আমিও আপনার কাছে, আপনার সঙ্গে থাকতে চাই রুদ্র। কিন্তু এভাবে না। এমন অনিশ্চিত জীবনে না। একসময় আমি ভেবেছিলাম আমি মানিয়ে নেব, মেনে নেব। কিন্তু.. কিন্তু পরপর এতোগুলো মানুষকে হারানোর পর আমার আর সেই সাহস নেই। প্লিজ আমার কথাটা শুনুন। ছেড়ে দিন এসব। চলে যাব আমরা। এসব থেকে অনেক দূরে।’
রুদ্র কিছু বলল না আরও শক্ত করে আকড়ে ধরল প্রিয়তাকে। খোলা বারান্দা দিয়ে এখনো পৌষের ঠান্ডা হাওয়া আসছে। পরস্পরের প্রেমময় আলিঙ্গনে শীতল হচ্ছে যুবক যুবতির হৃদয়ও। এতোদিনের তৃষ্ণা যেন একদিনেই মেটাচ্ছে রুদ্র। যেন নিজের শরীর, আত্মা, সত্তার সঙ্গে মিশিয়ে ফেলবে নিজের প্রিয়কে। প্রিয়তাও কোন বাঁধা দিচ্ছে না। নিজেও আকড়ে ধরে আছে রুদ্রকে। দীর্ঘক্ষণ পর আস্তেধীরে প্রিয়তাকে ছাড়ল রুদ্র। হাত রাখল প্রিয়তার দুই গালে। প্রিয়তা অস্ফুট স্বরে আবার বলল, ‘প্লিজ।’
রুদ্র আলতো করে চুমু খেলো প্রিয়তার কপালে। নরম গলায় বলল, ‘আমিও স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে চাই। এসবে আমি নিজেও হাঁপিয়ে উঠেছি। সত্যিই হাঁপিয়ে উঠেছি।’
খুশিতে উদ্ভাসিত হল প্রিয়তার মুখ। দ্রুত বলল, ‘সত্যি?’
‘আর কয়েকটা দিন। জাস্ট আর কয়েকটা দিন ধৈর্য্য ধরো। কিছু অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে। তারপরেই তোমার সব ইচ্ছা পূরণ করব আমি।’
প্রিয়তার উজ্জ্বল মুখটাতে আঁধার নেমে এলো। মনে মনে ভীষণ রাগ হল ওর। ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হল সবকিছু। ভেতরের রাণী মীর্জা যেন মাথা চাড়া দিয়ে জেগে উঠতে চাইল। কিন্তু রুদ্রর সামনেতো রাণী নয়, প্রিয়তা আছে। রুদ্রর প্রিয় আছে। তাই নিজের ক্রোধ সংবরণ করল প্রিয়তা। অস্থির গলায় বলল, ‘কী দরকার রুদ্র? বাদ দিন এসব প্রতিশোধের খেলা। আপনাদের সব পক্ষেরই একে অপরে দ্বারা অনেক ক্ষতি হয়েছে। সেসবের প্রতিশোধ নিতে গেলে এই প্রতিশোধের খেলা চলতেই থাকবে। চক্রের মতো। কিন্তু কিচ্ছু শেষ হবেনা। শুধু নিষ্পাপ প্রাণগুলো যাবে। বাদ দিন না এসব। প্লিজ?’
রুদ্রর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। দৃঢ় কন্ঠে বলল, ‘আজ অবধি আমরা যা যা করেছি সব সামনাসামনি করেছি। আমাদের আঘা-ত-প্রতিঘা-ত সবটাই ছিল খোলা বইয়ের মতো। কিন্তু ওরা ছলনার আশ্রয় নিয়েছে। কুহুর মতো নিষ্পাপ একটা মেয়ের সঙ্গে অমন ঘৃণ্য কাজ করেছে। বাবাকেও কাপুরুষের মতো বি-ষ দিয়ে মে-রেছে। আমার নিষ্পাপ সন্তান, যে কিনা পৃথিবীতেও আসেনি তাকে হ-ত্যা করেছে প্রিয়। আর তুমি বলছো ওদের ছেড়ে দিতে?’
‘হ্যাঁ বলছি। দেখুন ওদের অনেকে হয়তো ইতিমধ্যে শাস্তি পেয়ে গেছে। আর যদি কেউ থেকে থাকে সেও শাস্তি পাবে। পাপ করে কেউ বাঁচতে পারেনা। আপনাকে আর কিছু করতে হবেনা। শুনুন আমার কথাটা।’
‘তোমার কথাগুলো বাচ্চা বাচ্চা প্রিয়। শোনার মতো না। এমনিতেও কুহুর দুজন অপরাধীকে নিজে শাস্তি দিতে না পারার আফসোস আছে আমার। সেই গ্লানি আমি আর বাড়াতে পারব না।’
প্রিয়তা শক্ত দৃষ্টিতে তাকাল রুদ্রর দিকে। অপূর্ব সুন্দর চোখদুটো হিংস্র হতে গিয়েও হলোনা। সামলালো নিজেকে। গাল থেকে রুদ্রর হাত নামিয়ে যান্ত্রিক কন্ঠে বলল, ‘শুয়ে পরুন।’
রুদ্র বলল, ‘কয়েকটা দিন প্রিয়তা। সব ঠিক হয়ে যাবে তারপর।’
প্রিয়তা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, ‘তার আগে যদি ওরা আমারও কোন ক্ষতি করে দেয়? ক্ষমা করতে পারবেন নিজেকে?’
‘সে সুযোগ আমি ওদের আর দেবনা।’
‘একই কথা আপনি আমার পুচকুর সময়ও বলেছিলেন। কিন্তু কী লাভ হলো? চলে গেল আমার রাজপুত্র।’
রুদ্র জবাব দিতে পারল না। কথোপকথন ঘুরেফিরে আবার সেদিকেই যাচ্ছে। এখন কথা চালিয়ে গেল কেবল তিক্ত কথাই বের হবে। সেটা এখন চাইছেনা রুদ্র। তাই চুপচাপ শোয়ার জন্যে এগোলো। তখনই প্রিয়তা বলে উঠল, ‘আপনার এই জেদের কারণে কবে যেন আমের ভিলার আরও একটা প্রাণ চলে যায়। আপনার উদ্দেশ্য পূরণ হবে ঠিকই। কিন্তু ততদিনে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে।’
রুদ্র থমকে গেল। কানে যেন ঝংকার তুলে দিল প্রিয়তার কথাগুলো।
–
পরেরদিন সকালে আমের ভিলার সকলেই একটু দেরী করে উঠল। আলসেমির চাদরে যেন মুড়িয়ে আছে বসার ঘরটা। নার্গিস নাস্তা বানাচ্ছে। বসার ঘরে বসে আলোচনা করছে রুদ্র, উচ্ছ্বাস আর জাফর। নীরব আর কুহুর বিয়ে নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। নীরব এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। ওরই বিয়ে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তাই ওখানে থাকতে সংকোচবোধ করছে। যেতেও পারছেনা। কারণ রুদ্রর কড়া হুকুম। সবটা ওকে শুনতে হবে এবং নিজের মতামতও জানাতে হবে। বেচারা মাঝখান ফেঁসে গেছে। বারবার অসহায় দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে উচ্ছ্বাসের দিকে। উচ্ছ্বাস দাঁত কেলাতো হাসি দিয়ে বোঝাচ্ছে, দন্ডায়মান থাকো হে বৎস।
জ্যোতিও সবাইকে কফি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। যেহুতু বিয়েটা একেবারেই ঘরোয়াভাবে হচ্ছে তাই আলোচনাও খুব দীর্ঘ নয়।
এরমধ্যেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো প্রিয়তা। কথা ছেড়ে সবাই তাকাল ওর দিকে। দেখে মনে হচ্ছে বাইরে যাবে। ব্যাগও আছে। রুদ্র কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই প্রিয়তা বলল, ‘জ্যোতি আপু, আমি একটু স্কুলে যাচ্ছি। ছুটি নিতে হবে তিনদিনের।’
জ্যোতি রুদ্রর দিকে একপলক তাকাল। ইতস্তত করে কিছু বলতে নিলেই রুদ্র থমথমে গলায় বলে উঠল, ‘কোথাও যাবেনা তুমি।’
‘যেতে হবে তোমাকে।’
‘আমি যখন বলেছি না, তখন না।’
প্রিয়তা ভ্রুকুটি করল। রুদ্রর দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বলল, ‘আশ্চর্য! ছুটি ছাড়া স্কুলে গেলে, ক্লাস না করালে আমার চাকরি থাকবে? ছোট্ট একটা প্রাইভেট স্কুল ওটা।’
রুদ্র নির্বিকারভাবে বলল, ‘তোমারতো চাকরি করার কোন প্রয়োজন নেই। এখন সমস্যার মধ্যে থাকলেও তোমাকে খাওয়ানোর ক্ষমতা আমার আছে। আর তাছাড়াও তোমার কাছে ফোন আছে। স্কুলে কল করে দাও। তাহলেই হয়।’
‘আমি গিয়েই ছুটি চাইব।’
জেদ ধরে কথাটা বলে চলে যেতে নিলেই খপ করে ওর হাতটা ধরে ফেলল রুদ্র। স্বাভাবিক কিন্তু দৃঢ় কন্ঠে বলল, ‘তোমার কোথাও যাওয়া হচ্ছেনা। গেইটের বাইরে পা দিতে পারবেনা তুমি। সে ব্যবস্থা করাই আছে।’
মস্তিষ্কের ভেতরটা যেন জ্বলে উঠল প্রিয়তার। রাগ চেপে রাখা কতটা কষ্টের সেটা ইদানিং বুঝতে পারে ও। আক্রোশ ঢেকে নিজের চোখমুখ অসহায় রাখার চেষ্টা করে জ্যোতিকে বলল, ‘আপু! তুমি কিন্তু কথা দিয়েছিলে উনি আমার ওপর কোনরকম জোর খাটাবেনা। সেই শর্তেই আমি এসেছিলাম।’
জ্যোতি থতমত খেয়ে গেল। কী বলবে বুঝতে পারল না। ওরা জানতো এমনটা হবে। তবুও মিনমিনে কন্ঠে বলল, ‘রুদ্র, আমি বলি..’
জ্যোতি কথা শেষ করার আগেই রুদ্র কঠোর গলায় বলে উঠল, ‘শর্ত ওদের দিয়েছো, আমাকে না। কথা ওরা দিয়েছে, আমি এমন কোন কথা তোমাকে দেইনি। সুতরাং তুমি কোথাও যাচ্ছোনা।’
প্রিয়তা এবার নীরবের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনিও কী কিছু বলবেন না ভাইয়া? সবচেয়ে বেশি অনুরোধ কিন্তু আপনিই করেছিলেন। এখন কিছু বলুন?’
নীরব চোরের মতো দৃষ্টি লুকালো। মনে মনে ভাবল, পাগল নাকি! যেচেপরে সিংহের সামনে গিয়ে হরিণীনৃত্য করব!
জাফর বলল, ‘প্রিয়তা মা, তুমি ফোনেই ছুটি চেয়ে নাও। বুঝতেই পারছো রুদ্র যেতে দেবেনা তোমাকে। বাইরের অবস্থাটাও খুব বেশি ভালো না। সকলের জন্যেই অনিরাপদ।ঘরে যাও মা।’
উচ্ছ্বাস সকৌতুকে বলল, ‘বউমণি, কীসব সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি করছো বলোতো? রুদ্র আমেরের বউকে অতো ছোট পোস্টে মানায়? উহু! তারচেয়ে বরং আমি নিজেই তোমার জন্যে একটা স্কুল খুলে দেব। ওখানে তুমি হবে হেডমাস্টার।’
নীরব ফিক করে হাসতে গিয়েও থেমে গেল। জ্যোতি আর জাফর ঠোঁট চেপে হাসল। রুদ্রও নাক চুলকে নিয়ন্ত্রণ করল নিজের হাসি। প্রিয়তা বুঝল এরা কিছু বলবে না। আর না রুদ্র ওকে বের হতে দেবে। ক্রোধে ভরা দৃষ্টিতে রুদ্রর দিকে একপলক তাকাল প্রিয়তা। রাগে গজগজ করে চলে গেল নিজের ঘরে দিকে।
–
ঘরে এসে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল প্রিয়তা। রুদ্র এখন আসবেনা রুমে। সোজা বেরিয়ে যাবে। রাগে ব্যাগটা একপাশে ছুড়ে মারল প্রিয়তা। ধপ করে বিছানায় বসে সামনের চুলগুলো দুহাতে খামচে ধরল। হিংস্র হয়ে উঠল অপূর্ব সুন্দর চোখজোড়া। প্রিয়তা রানী মীর্জা হয়ে উঠেছে। রাগে মৃদু চিৎকার করে উঠল ও। ফুঁসতে শুরু করল। ফোনটা দিয়ে ফোন কল করল তনুজাকে। সঙ্গেসঙ্গেই রিসিভ করল তনুজা। ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘আপনি আসছেন ম্যাম?’
‘না, আটকে গেছি। তবে আসব। যখনই পারি আসব। ততক্ষণ ওদিকটা সামলাও। কোন গন্ডগোল দেখলে সঙ্গেসঙ্গে মেসেজ করবে আমাকে। যদি আমি রেসপন্স না করি, তখন সম্রাটকে জানাবে। আর যদি দেখো আউট অফ কন্ট্রোল কিছু করেছে তো শেষ করে দেবে। মনে থাকবে?’
‘ইয়েস ম্যাম।’
‘কোথায় বা-স্টা-র্ডটা?’
‘কাজ করছে মিলে। দেখে বোঝার উপায় নেই ওকে স্যার পাঠিয়েছে। চালাক মাল।’
রাগে মাঝেও মৃদু হাসল প্রিয়তা। ঠান্ডা গলায় বলল, ‘চালাক বলেই তোমার স্যার ওকে পাঠিয়েছে।’
বলে কল কাটল প্রিয়তা। ফোনটা উচ্ছিষ্ঠের মতো রেখে দিল একপাশে। থুতনির নিচে দু হাত রেখে ভাবতে বসল। কাল রাতে পুনরায় রুদ্রর ব্রেসলেটে স্পাই মাইক্রোফোন লাগিয়েছে প্রিয়তা। মাঝের এতোদিন রুদ্রর ব্রেসলেটে মাইক্রোফোন থাকলেও সেটা কাজ করতো না। কারণ চার্জ ছিলোনা। একবার চার্জ দিলে চব্বিশ ঘন্টা টানা কাজ করতো। প্রতিদিন রাতে রুদ্র ব্রেসলেটটা খুলে ড্রেসিং টেবিলে রাখতো। রুদ্র ঘুমানোর পর প্রিয়তা উঠে বের করে নিতো মাইক্রোফোনটা। চার্জ করে রুদ্র ওঠার আগেই আবার রেখে দিতো ব্রেসলেটের ভেতরে। এভাবেই চলছিল টানা দুটো বছর। আঠারোশ ফ্রিকোয়েন্সির, কয়েক মিলিমিটারের এই ছোট্ট স্পাই মাইক্রোফোনটাই সোলার সিস্টেমের ধ্বংসের মূল কারণ। আজ সকালে সাব্বিরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল রুদ্র। আর এই মাইক্রোফোনের বদৌলতেই সকালবেলা প্রিয়তা শুনে ফেলে সাব্বিরকে বলা রুদ্রর কথা। জানতে পারে যে, ডার্কনাইটের নতুন কর্মচারী হয়ে ডুকেছে সাব্বির। চমকে ওঠে ও। তবে অবাকও হয় রুদ্রর বুদ্ধিমত্তা দেখে। মাইক্রোফোনটা না থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যেই খেলাটা ঘুরিয়ে দিতো রুদ্র।
কিন্তু জেনেও প্রিয়তা এখনো কিছু করতে পারেনি। সম্রাটকে কল করবে ভেবেও করেনি। শওকতকেও জানানোর ইচ্ছা নেই ওর। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল ওখানেই একটা গোপন ঘরে ইকবাল আছে। সাব্বির কোনভাবে ইকবালের কাছে পৌঁছে গেলে সবটা বিগড়ে যাবে। সেটা কোনভাবেই হতে দেওয়া যাবেনা। এতো পরিশ্রম করে এই অবধি এসে সব ভেস্তে যেতে পারেনা।
চিন্তার ভাঁজ পড়ল প্রিয়তার কপালে। ভাবছে লাগল, কী করবে? কীভাবে বের হবে আমের ভিলা থেকে। রুদ্র যেভাবে জেদ ধরে বসে আছে এমনি এমনি কিছুতেই বের হতে দেবেনা প্রিয়তাকে। পরিবার প্রত্যেক সদস্যর ওপরেই ভয়ানক স্পর্শকাতর হয়ে আছে ও। কোনভাবেই কোন রিস্ক নেবে বলে মনে হচ্ছেনা। কিন্তু প্রিয়তাকেতো বের হতেই হবে। সাব্বির ইকবালের কাছে পৌঁছনোর আগে ওকে পৌঁছতে হবে সাব্বিরের কাছে।
উত্তেজিত হলোনা প্রিয়তা। রাগ কমিয়ে নিজেকে শান্ত করল। চোখ বন্ধ করে কপালে চেপে ধর ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা আঙ্গুল। কিছুক্ষণ ভাবার পর হঠাৎ কিছু একটা চিন্তা করে ঠোঁটে হাসি ফুটল প্রিয়তার। উপায় সে পেয়েছে!
#চলবে…