#প্রেমপরশ
#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৮
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
ঠিক তখনই ভেসে এলো গম্ভীর এক কণ্ঠস্বর,
“ওখানেই দাঁড়িয়ে যাও।”
আরোহী এবং তনয়া চমকালো। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে গেল মুহুর্তেই। মানিক স্যার এগিয়ে এলেন তাদের দুজনের পানে। চশমার ফাঁক থেকে তাকিয়ে শুধালেন,
“একে তো দেরী করে এসেছো। তার উপর আবার লুকিয়ে লুকিয়ে ঢুকছিলে?”
ঢোক গিললো দুজনেই। আরোহী আমতা আমতা করে বলল,
“না কি হয়েছে কি স্যার। রাস্তায়…”
বাকিটুকু আর শেষ করার সুযোগ হলো না মেয়েটার। তার আগেই মানিক স্যার ধমকে বলল,
“ক্লাসের বাইরে গিয়ে দাঁড়াও দুজনেই।”
স্যারের ধমকে চমকে উঠলো দুজনেই। মাথা নিচু করে ফেলল তৎক্ষণাৎ। তনয়া কিছুটা অনুনয়ের সাথে বলল,
“স্যরি স্যার। আর কখনও এমন হবে না।”
মানিক স্যার শুনলেন না কোনো কথা। গম্ভীর কণ্ঠে ফের বললেন,
“ক্লাসের বাইরে গিয়ে দাঁড়াও তাড়াতাড়ি।”
আরোহী এবং তনয়া আরও কিছুক্ষণ অনুনয় করলো। তবে শেষ পর্যন্ত গিয়ে ক্লাসের বাইরেই দাঁড়াতে হলো তাদের। স্যারটাও খবিশ বেশ। কোনো কথা শুনলো না। একটুই তো দেরী করেছে। কি হতো মাফ করে দিয়ে ক্লাসে বসতে দিলে? আরোহীর রাগ লাগলো ভীষণ। মনে মনে কিছু অভিশাপও দিয়ে ফেললো সে স্যার এবং স্যারের বউকে। তবে সবচেয়ে বেশি রাগ লাগলো তূর্ণের উপরে। ঐ লোকটার জন্যই তো সব হয়েছে। তখন যদি ঐ লোকটা তাদের পিছন থেকে না ডাকতো, দাঁড় করিয়ে উদ্ভট সব কথা বলে সময় নষ্ট না করতো তবে ঠিক সময়েই কলেজে পৌঁছাতে পারতো আরোহী আর তনয়া। শুধু শুধু লোকটা তাকে দাঁড় করিয়ে বিভ্রান্তিকর একটি পরিস্থিতিতেও ফেললো আর এখন ক্লাসের বাইরেও দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ক্লাসের সবার সম্মুখে কি এক লজ্জাজনক পরিস্থিতি এটা! সবাই নিশ্চয়ই তাদের নিয়ে মনে মনে হাসছে।
১১.
আকাশটা মেঘে ঢাকা। সূর্যের দেখা নেই আজ। গতকাল রাত থেকে যে এ বৃষ্টি শুরু হয়েছে তা কমেনি এখনও। টুপটাপ ধ্বনি তুলে অঝোর ধারায় ঝড়ছে ভূমিতে। আরোহী আজ কলেজে যায়নি। এই ভেজা বর্ষায় সে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার কক্ষের সাথে লাগোয়া বারান্দায়, হাতে এক কাপ ধোঁয়া ওড়ানো চা। বাহিরে বৃষ্টি, হাতে গরম চা। কি অদ্ভুত এক প্রশান্তি! আরোহী চায়ের কাপে চুমুক দিল। আবেশে বন্ধ করে নিল চোখ দুটো। পর মুহুর্তেই আবার চোখ দুটো খুলে ফের চুমুক বসালো চায়ের কাপে। বারান্দার মেঝেতে ছোট ছোট পায়ে হাঁটতে হাঁটতে এক হাত বাড়িয়ে দিল বাহিরের পানে। মুহুর্তেই ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিরা এসে ভিজিয়ে দিল তার কোমল হাতকে। শিরশির করে উঠলো শরীর খানা। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো মৃদু প্রশান্তির হাসি। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হঠাৎ করেই আরোহীর স্মরণে এলো বেলী ফুলের কথা। এই ভেজা বর্ষায় এক গুচ্ছ শুভ্র রঙা বেলীদের দেখা পেলে মন্দ হয় না। সেদিন তূর্ণের ঘরের বারান্দায় যখন কিছু বেলী ফুলের চাড়া লাগাতে গিয়েছিল আরোহী তখন খেয়াল করেছিল বারান্দায় থাকা অন্যান্য বেলী গাছে বেশ সুন্দর ছোট ছোট কিছু কলি নিয়েছে। আজ তা ফুটে যাওয়ার কথা। আরোহী আর সময় নষ্ট করলো না। দ্রুত পায়ে এলো কক্ষের ভিতরে। চায়ের কাপটা টেবিলে উপরে রেখে একটা ছাতা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো গৃহের বাইরে।
১২.
রাস্তাঘাটে ইতমধ্যে পানি জমে গেছে। ঢাকার এই একটা সমস্যা। একটু বৃষ্টি হলেই পথে ঘাটে পানি জমে যায়। ড্রেনগুলোও অপরিষ্কার, ময়লা আবর্জনায় ভরে রয়েছে। পানি নিষ্কাশনের ভালো কোনো উপায় নেই। আরোহী এক হাতে মাথায় ছাতা ধরে আর অন্য হাতে পাজামাটা একটু উপরে তুলে এক প্রকার লাফিয়ে লাফিয়েই পৌঁছালো তূর্ণদের বাড়ির দরজার সম্মুখে। বিশাল এক যুদ্ধ জয় করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন মেয়েটা। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে সে হাতের ছাতাটা বন্ধ করলো। অতঃপর দরজা ঠেলে ভিতরের দিকে পা দিতেই ধপাস করে মেঝেতে। আকস্মিক ঘটনায় হকচকিয়ে উঠলো আরোহী। চেঁচিয়ে বলল,
“আল্লাহ গো!”
রান্নাঘরে কাজ করছিল পৃথা, ইসরাত এবং অনন্যা। আরোহীর চিৎকার শুনে তার পানে ছুটে এলো তারা। মেয়েটাকে মাটিতে বসে থাকতে দেখে তাদের আর বুঝতে বাকি রইলো না এখানে কি হয়েছে। বাহির থেকে ভেজা পা নিয়ে এসে টাইলসের উপরে পাড়া দিতেই নির্ঘাত পিছলে পড়েছে। পৃথা, ইসরাত এবং অনন্যা আর সময় ব্যয় করলো না। দ্রুত এসে মেঝে থেকে টেনে উঠালো মেয়েটাকে। অস্থির হয়ে পৃথা শুধালো,
“ঠিক আছিস মা? কি হয়েছে?”
আরোহী কোনো মতে উঠে দাঁড়ালো। বোকা বোকা হেসে সে তাকালো সবার পানে। এই মুহূর্তে ভীষণ লজ্জা লাগছে তার। সারা পথে পানির মধ্যেও পড়লো না অথচ বাড়ির দরজায় এসেই ধপাস করে পড়লো! কি এক লজ্জাজনক ঘটনা! ভাগ্যিস আর কেউ আসেনি। নয়তো মান ইজ্জত বলে আর কিছু থাকতো না। মেয়েটা ব্যথা তো পেয়েছে বেশ। কোমড় এবং এক পা বোধহয় ব্যথায় অবশ হয়ে গেছে ইতমধ্যে। তবুও লজ্জায় ব্যথা লুকালো সে। আমতা আমতা করে জবাব দিল,
“কোথাও ব্যথা পাইনি। কোথাও না।”
পরপর মেয়েটা ব্যস্ত হয়ে পা বাড়ালো উপরের দিকে। যেতে যেতে বলল,
“তনায়ার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। ওর কাছে যাই আগে।”
পৃথা, ইসরাত এবং অনন্যা কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো আরোহীর চলে যাওয়ার পানে। অতঃপর যে যার নিজের কাজের উদ্দেশ্যে চলে গেল।
*****
আরোহী মুখে তনয়ার সাথে দেখা করার কথা বললেও সে তো মূলত এসেছিল তূর্ণের বারান্দা থেকে বেলী ফুল নিতে। পায়ে ব্যথা পেয়েছে বা কোমড়ে ব্যথা পেয়েছে তাতে কি হয়েছে? তাই বলে কি সে বেলী ফুল নিবে না? অবশ্যই নিবে। কিন্তু এখন সমস্যা হলো তূর্য ঘরে আছে কিনা তা নিয়ে। ঐ বদ লোক ঘরে থাকলে বেলী ফুল নেওয়া তো দূরে থাক তাকে বেলী গাছের ধারে কাছেই ঘেঁষতে দিবে না। তখন নিচে বসে যে কাউকে তূর্যের কথা জিজ্ঞেস করবে তাও পারেনি। আছাড় খেয়ে লজ্জায় উপরে ছুটে এসেছে।
আরোহী আস্তে ধীরে উঁকি মা’র’লো তূর্ণের কক্ষের পানে। কক্ষের দরজাটা চাপানো তবে ভিতরে জনমানবের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না কোনো। হয়তো ঘরে নেই। এই বৃষ্টিতেও বেড়িয়েছে। যাক ভালোই হলো। আরোহী পা টিপে টিপে নিঃশব্দে ঢুকলো তূর্ণের কক্ষে। এদিক ওদিক তাকিয়ে চারপাশটা আরেকবার পর্যবেক্ষণ করে সোজা ছুটে গেল বারান্দায়। সত্যিই আজ অনেকগুলো বেলী ধরেছে গাছে। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে নিজের সুশ্রী শুভ্র রঙা রূপ নিয়ে সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা, মোহিত সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে চারপাশে। আরোহী চোখ বন্ধ করে নাক টেনে অনুভব করলো সে সুগন্ধ। হাত ছুঁইয়ে দিল ফুলের গায়ে। তবে এ পুষ্প বিলাসে আর খুব বেশি সময় নষ্ট করলো না সে। বলা তো যায় না কখন আবার তূর্ণ ফিরে আসে। তারপর তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে এ কক্ষ থেকে। আরোহী একটু ঝুঁকে দ্রুত হাত চালিয়ে বেলীগুলো ছিঁড়ে নিতে শুরু করলো এক এক করে। ঠিক তখনই পিছন থেকে নিঃশব্দে একটা মাথা এগিয়ে এলো তার ঘাড়ের নিকট। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“কি করছিস এখানে?”
আরোহী চমকে উঠলো। কেঁপে উঠলো তার ছোট্ট দেহখানা। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল তীব্র ভয়ে। হাতের বেলী ফুলগুলোও ইতমধ্যে ছিটকে পড়েছে মেঝেতে। এ আবার কে এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে? এভাবে কথা বলছে কেন? মেয়েটা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ধীরে ধীরে তাকালো পাশ ফিরে। অমনি চোখের সম্মুখে ভেসে উঠলো তূর্ণের মুখ খানা। মেয়েটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল তবে রাগও হলো ভীষণ। এভাবে কেউ ভুতের মতো আসে নাকি? আর একটু হলেই প্রাণটা বেড়িয়ে যেতো। আরোহী বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“এভাবে কেউ আসে? আবার কিভাবে কথা বলছিলেন। আর একটু হলেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতো।”
তূর্ণে আরোহীর নিকট থেকে একটু সরে দাঁড়ালো। মেয়েটার কথাগুলোকে তেমন একটা পাত্তা না দিয়ে কপাল কুঁচকে বলল,
“আমার গাছের ফুল চু’রি করছিলি কেন তুই?”
থতমত খেয়ে গেল আরোহী। ভয়ের চোটে তো সে তার কর্মই ভুলে বসেছিল। ঢোক গিললো মেয়েটা। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বলল,
“না মানে আসলে হয়েছে কি….”
আরোহী নিজের কথা শেষ করার আগেই মুখ খুললো তূর্ণ। নাক মুখ কুঁচকে বলল,
“ছিঃ ছিঃ আরোহী তোর এত অধঃপতন হয়েছে। শেষে কিনা তুই আমার বারান্দায় ফুল চু’রি করতে এসেছিস? চু’রি করবি তো করবি ভালো কিছু করতি। যা বিক্রি করেও সারাজীবন বসে খেয়ে যেতে পারবি।”
আরোহী ভীষণ অপমানিত বোধ করলো। একটু ফুলই তো নিতে এসেছিল তাই বলে এই লোক তাকে চো’র উপাধি দিবে? মেয়েটার মুখশ্রী থমথমে আকার ধারণ করলো। তূর্ণের বক্তব্যের ঘোর প্রতিবাদ করে সে বলল,
“মোটেই না তূর্ণ ভাই। আমি কোনো চু’রি করিনি। আপনার বারান্দার এ গাছগুলো আপনি আনলেও লাগিয়েছে আমি। সুতরাং এ গাছের ফুলের উপরে আমারও অধিকার আছে। সেই অধিকার থেকেই ফুল ছিড়ছিলাম আমি।”
তূর্ণের ওষ্ঠে হাসি ফুটে ফুটে উঠলো। তবে তা আরোহীর নজরে পড়ার আগেই গিলে ফেললো। থমথমে কণ্ঠে বলল,
“তারমানে তুই বলতে চাইছিস গাছ এক হলেও এ গাছের মালিক আমরা দুইজন?”
আরোহী উপর নিচ মাথা ঝাঁকালো। কণ্ঠে জোর দিয়ে বলল,
“হ্যা তাই।”
“ভেবে বলছিস তো!”
“একদম।”
আরোহীর তৎক্ষণাৎ জবাব। ওষ্ঠ প্রসারিত করলো তূর্ণ। আরোহীর পানে একটু ঝুঁকে বলল,
“ভেবে বলছিস তো? ভবিষ্যতে এই গাছের সাথে সাথে আমি যখন অন্য কিছুর মালিকানা দিতে চাইবো তখন কিন্তু পিছপা হতে পারবি না। আমার গাছের মালিকানা নিতে হলে আর যা কিছুর মালিকানা দিতে চাইবো সব নিতে হবে।”
আরোহী অত কিছু ভাবলো না। আপাতত তার নিকট বেলী গাছ এবং তার ফুলই মূখ্য। ভবিষ্যতে যা হবে তা ভবিষ্যতেই দেখা যাবে। মেয়েটা দৃঢ়তার সাথেই বলল,
“ঠিক আছে।”
“এই ভেজা বর্ষায় এক গুচ্ছ বেলীর উপস্থিততে তুই কিন্তু আমায় কথা দিলি। আমার নিকট দায়বদ্ধ হয়ে পড়লি।”
“আচ্ছা।”
তূর্ণের ওষ্ঠ প্রসারিত হলো আগের তুলনায়। নিজে থেকেই সে বেলী গাছগুলো থেকে ফুলগুলো তুললো এক এক করে। সে ফুলগুলো সে বাড়িয়ে দিল আরোহীর পানে। হাসিমুখে বলল,
“তোর অধিকার।”
চলবে…..
ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি লিংক –
https://www.facebook.com/profile.php?id=100090661336698&mibextid=rS40aB7S9Ucbxw6v
গ্রুপ লিংক –
https://facebook.com/groups/233071369558690/