অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৯৪.

0
58

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৯৪.

শহুরে সভ্য এলাকা পেরিয়ে জনবহুল এক বস্তি। তার দুর্গন্ধযুক্ত এক ছোট্ট গলিতে প্রবেশ করল তুহিন আর জ্যোতি। গাড়িটা ছেড়ে আসতে হলো গলির বাইরেই। গলিতে প্রবেশমাত্র অজান্তেই নাক কুঁচকে এলো তুহিনের। ভ্রুকুটি করে তাকাল জ্যোতির দিকে। জ্যোতি নির্বিকারভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। পেছনে দুজন অফিসার। একজন পুরুষ, অপরজন মহিলা।
তুহিন সন্দিহান দৃষ্টিতে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল।
‘এখানে?’ তুহিনের কন্ঠে তখন অকপট বিষ্ময়।

ঠোঁটে তির্যক হাসি ফুটিয়ে তুলল জ্যোতি। নিরুত্তর রইল। কথা বাড়াল না তুহিন। হাতে সময় কম। আরও দু’মিনিট হাঁটার পর বেশ পুরোনো, স্যাঁতস্যাঁতে, দুই রুমের একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে গেল জ্যোতি। চোখ থেকে রোদচশমা খুলে ফেলল তুহিন। চোখ বুলিয়ে দেখে নিল আশেপাশের অস্বস্তিকর পরিবেশ। ঘনবসতি, চারপাশে ছড়ানো ছেটানো নোংরা আবর্জনা, গুমোট দুর্গন্ধ আর লোকজনের বিরক্তিকর কোলাহল। সব মিলিয়ে সভ্য ব্যক্তির বসবাসের অনুপযুক্ত জায়গাই বলা চলে এটাকে।

ঘরে প্রবেশ করতেই তুহিনের চোখ গেল কক্ষের একমাত্র জানালাটার দিকে। পুরোনো যং ধরা গ্রিল দুহাতে আকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক রমনী। পড়নে ঘিয়ে রঙা এক শাড়ি। শাড়ির প্রতিটা ভাজ এলোমেলো। খোলা চুলগুলো অযত্নে ছড়িয়ে আছে পিঠজুড়ে। উল্টোদিকে ঘুরে থাকায় মুখ দেখতে পেলোনা তুহিন। কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইল কেবল।
ধ্যান ভাঙল জ্যোতির দীর্ঘশ্বাসের শব্দে। জ্যোতি কাঠের পুরোনো, নরবড়ে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল তুহিনের দিকে। ঘরের কোন থেকে আরও দুটো বেতের মোড়া এগিয়ে এনে লজ্জিত কন্ঠে বলল, ‘আপাতত এগুলোই আছে আপনাদের বসতে দেওয়ার মতো।’

‘ যথেষ্ট।’

বলে বসে পড়ল তুহিন। বাকি দুজন অফিসারও বসল। তুহিন একবার চোখ বুলিয়ে নিল ঘরের চারপাশে। দালানগুলো স্যাঁতস্যাঁতে। সারাঘরে একটাই ছোট জানালা। ফ্লোরটাও ভীষণ ড্যামেজ। তাতে একটা তোষক পাতা আছে। এমন এক পরিবেশে থাকছে এরা!

এরমধ্যেই অপর কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো একটা মেয়ে। আওয়াজ পেয়েই এসেছে হয়তো। জ্যোতিকে দেখামাত্র মেয়েটার ফ্যাকাশে চেহারায় সামান্য উজ্জ্বলতা লক্ষ্য করল তুহিন। দৌড়ে এসে জাপটে ধরল জ্যোতিকে। জ্যোতি কয়েক সেকেন্ড ধরে রেখে ছাড়িয়ে নিল ওকে। দুহাতে গাল ধরে আলতো করে আদর করল। মেয়েটার নিষ্পাপ, শীতল চোখদুটো দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু গড়িয়ে নামল। দুহাতের ইশারায় কী কী সব বলে গেল একনাগারে। কিছুই বুঝল না তুহিন। নিঃশব্দে দেখে গেল কেবল।
মেয়েটা কুহু। বুঝতে অসুবিধা হয়নি তুহিনের। রাশেদ আমেরের অ‍্যালবামে ছবি দেখেছিল ও। ইশারায় কথা বলা দেখে তা নিশ্চিত হয়েছে। পরনে গোলাপি রঙা সাধারণ এক স্যালোয়ার কামিজ। মসৃণ চুলগুলো উঁচু করে ঝুটি বাঁধা। চোখে-মুখে সেই নিষ্পাপ আভা। কিন্তু তীব্র কোন বিষাদ যেন শুষে নিয়েছে চেহারার সেই বাচ্চাসুলভ দর্শন। দীর্ঘশ্বাস চাপল তুহিন।

তুহিনকে দেখতেই কেমন ঘাবড়ে গেল কুহু। শক্ত করে চেপে ধরল জ্যোতির হাত। দুচোখে ভয়। পাতলা ঠোঁটজোড়া তিড়তিড় করে কেঁপে চলেছে। কুহুর হাতের ওপর হাত রেখে ওকে আশ্বস্ত করল জ্যোতি। নরম গলায় বলল, ‘ ভয় পাসনা। উনি পুলিশের লোক। ভালো মানুষ। কোন ক্ষতি করবেনা আমাদের।’

কুহু ধাতস্থ হলো ঠিকই, কিন্তু পুরোপুরি আশ্বস্ত হলোনা। বোধ হয় খারাপ দেখতে দেখতে ভালো কিছু ভাবতেও ভয় হয় নিষ্পাপ ঐ মনটার। হয়তো আরও নানান কুচিন্তা জমাট বাঁধছে সেখানে। জ্যোতি বলল, ‘ বাবু কোথায়?’

ইশারায় কিছু একটা বলল কুহু। যা নিশ্চিন্ত করল জ্যোতিকে। সবকিছুই সুক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে তুহিন। এসবের মধ্যে একটা জিনিস খুব চোখে বাঝল তুহিনের। ঘরে এতোকিছু ঘটে যাচ্ছে, অথচ জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার কোন হেলদোলই নেই। যেন এ জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন আছে সে। কী এমন দেখছে জানালা দিয়ে? কৌতূহলবশত একবার উঁকি দিল তুহিন। পঁচা এক ডোবা ব্যতিত আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হলোনা। আশ্চর্য!

তুহিনের মতি যেন বুঝতে পারল জ্যোতি। নিজেও একবার দেখে নিল মেয়েটাকে। অনুরোধের স্বরে বলল, ‘ও নাজিফা স্যার। ওকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থা ওর নেই।’

চেহারার বিস্ময় লুকোতে পারল না তুহিন। অবিশ্বাস নিয়ে পুনরায় তাকাল মেয়েটার দিকে? নাজিফা! সে এখানে কেন? তবে কী উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ওর? কিন্তু সময় সল্পতার কথা মাথায় আসতেই জোরপূর্বক চিন্তাটা মস্তিষ্ক থেকে সরালো তুহিন। তাকাল কুহুর দিকে। মেয়েটা সরল চোখে তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে। তা লক্ষ্য করে মুচকি হাসল তুহিন। নিজ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বোসো এখানে।’

কুহুর বিভ্রান্তি নিয়ে তাকাল জ্যোতির দিকে। জ্যোতি চোখের ইশারায় অভয় দিতেই গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে বসল চেয়ারটায়। জ্যোতিও এসে দাঁড়াল ওর পাশে। পুরুষ অফিসার মোড়া ছেড়ে দিল তুহিনকে। সেটা নিয়ে কুহুর ঠিক মুখোমুখি বসল তুহিন। বলল, ‘ কেমন আছো তুমি?’

জবাব দিলোনা কুহু। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কেবল। তুহিন ঘরের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘তোমার স্বামী, নীরবকে দেখতে পাচ্ছিনা। সে কোথায়?’

কুহু ঢোক গিলল। জ্যোতির দিকে চাইতে জ্যোতিও প্রশ্ন করল, ‘নীরব কোথায়?’

কুহু ইশারায় উত্তর দিল। তা বুঝে নিয়ে জ্যোতি তুহিনকে বলল, ‘ বাজারে গেছে। সবজি আর ঔষধ কিনতে।’

মহিলা অফিসারটার দিকে তাকাল তুহিন। তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ খুলে একটা নোটবুক আর কলম বের করল সে। এগিয়ে দিল কুহুর দিকে। তুহিন বলল, ‘এগুলো নাও কুহু। দু-তিনটে প্রশ্ন করব আমি তোমাকে। উত্তরগুলো লিখে দেবে আমাকে। মিস জ্যোতির কোনরকম ইন্টারাপ্টেশান ছাড়াই।’

শেষ বাক্যটা জ্যোতির দিকে তাকিয়ে কিছুটা শক্ত গলাতেই বলল তুহিন। কুহু দুচোখের বিভ্রম বাড়ল। জ্যোতির দিকে তাকাতে নিলে বাঁধ সাধল তুহিন। নরম গলায় বলল, ‘ আমার ওপর ভরসা রাখো কুহু। আমি যা করছি তোমাদের ভালোর জন্যে করছি। আমার কথা শোন, প্লিজ।’

কয়েক সেকেন্ড অপলক তুহিনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কুহু। অতঃপর কাঁপাকাঁপা হাতে তুলে নিল নোটবুক আর খাতাটা। তুহিনের ঠোঁটের হাসি প্রসারিত হল। প্রসন্ন গলায় বলল, ‘গুড গার্ল।’

নিজ মনে আরেকবার প্রশ্নগুলো আওড়ালো তুহিন। অতঃপর বলল, ‘ এখানে কতদিন যাবত আছো তোমরা?’

কুহু ধীরস্থিরভাবে কলমের নিপ খুলল। কম্পমান হাতে নোটবুকের খালি পৃষ্ঠা খুলে রাখল নিজের কোলের ওপর। উদাস চোখে একপলক তুহিনকে দেখে নিয়ে লিখল, ‘গুনিনি। বিশ দিনের আশেপাশে হবে হয়তো।’

লেখাটা দেখল তুহিন। নোটবুকটা এগিয়ে দিতে দিতে দ্বিতীয় প্রশ্ন ছুড়ল, ‘আমের ভিলা ছেড়ে হঠাৎ এখানে কেন এলে?’

কুহু চেহারায় মলিনতা ধাপে ধাপে বেড়ে চলেছে। সামান্য দ্বিধা নিয়ে খসখসে শব্দে উত্তর লিখল ও। তুহিন পড়ে দেখল, তাতে লেখা আছে, ‘ সঠিক কারণটা বলেনি আমাকে কেউ। ভাইয়া বলেছিল কয়েকটা দিন আমাদের এখানে কাটাতে হবে। আমরা কাটাচ্ছি।’

‘ তোমার ভাইয়ার সঙ্গে শেষ কবে দেখা হয়েছিল তোমার?’

‘ যেদিন আমাদের এখানে রেখে গেল, সেদিন।’

‘ এর মাঝে আর কথা হয়নি?’

কুহু এবার মাথা নাড়িয়ে উত্তর না বোধক জবাব দিল।

‘ ফোন কলেও না?’

একই জবাব দিল কুহু। তুহিন ভ্রু কুঁচকে ফেলল। কিছু বলতে নিলেই ঘরে প্রবেশ করল এক যুবক। ধবধবে ফরসা, লং লেন্থে কাটা ডার্ক ব্রাউন চুল, বাদামি চোখ। সুদর্শন, দেখতে অনেকটা বিদেশিদের মতো। হাতে বাজারের ব্যাগ।
তুহিনকে দেখে শুরুতে থমকে গেল ছেলেটা। অতঃপর দেখতে পেল জ্যোতিকে। তাতে তার দুচোখের বিস্ময় ধীরে ধীরে কাটল। তুহিন গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করল, ‘ আপনি?’

‘ নীরব।’ ছেলেটির কন্ঠে স্পষ্ট বিভ্রম।

তুহিন পূর্ণ দৃষ্টি মেলে আরও একবার দেখে নিল নীরবকে। তারপর কুহুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ সত্যি কথা বলো কুহু। রুদ্র কোনরকম যোগাযোগ করছেনা তোমাদের সঙ্গে? মিথ্যে বলে লাভ নেই। আমি কিন্তু সত্যিটা বের করতে পারব।’

দ্বিধাগ্রস্ত মনে হল কুহুকে। শক্ত করে ধরল কলমটা। কিছুক্ষণ নিদারুণ দোটানায় ভুগল যেন। সরল চোখে চাইল নীরবের দিকে। ঘরে ঢুকে তুহিনকে দেখে আশ্চর্যিত হলেও; জ্যোতিকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ব্যপারটা পরিষ্কার হয় নীরবের কাছে। বুঝতে পেরেছে, এ আইনের লোক। চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করল কুহুকে। ভরসা পেল কুহু। লিখল, ‘ আমার সঙ্গে কথা হয়নি। বাকিদের সঙ্গে হয় কি-না আমি জানিনা।’

মাথাটা সামান্য দুলিয়ে উঠে দাঁড়াল তুহিন। ওর দৃষ্টি এবার নীরবের ওপর স্থির। নীরব ততক্ষণে সোজা হয়েছে দাঁড়িয়ে। জানে, প্রশ্নবাণ এখন ওর দিকেই আসবে। প্রস্তুত ও। তুহিন স্পষ্ট, গম্ভীর গলায় বলল, ‘ খুবই আশানুরূপ একটা প্রশ্ন করব। সঙ্গে উত্তরটাও আমি সত্যিই আশা করব। আপনার সম্পর্কে যতটুকু শুনেছি, আপনি খুব ভালো ছেলে নীরব। কথা বার করার কোনরকম বাঁকা পদ্ধতি আপনার ওপর প্রয়োগ করতে চাইনা আমি।’

নীরব চুপ থাকল। দৃষ্টি নিঃসংকোচ। এমন পরিস্থিতি আসবে তা রুদ্র জানতো। নীরবকে সেভাবেই তৈরী রেখেছে সে। তুহিন প্রশ্ন ছুড়ল, ‘রুদ্রর সঙ্গে কথা হয় আপনার?’

‘হয়।’

‘নাম্বার?’

‘এ পর্যন্ত যতগুলো নাম্বার দিয়ে কল করেছে, সব যদি আপনাকে দিতে শুরু করি তবে আপনাকে একটা ছোট্ট নোটবুক নিয়ে বসতে হবে __ অফিসার? ইফ আ’ম নট রং!’

ব্যপারটা বুঝতে পারল তুহিন। নাম্বার চাওয়াটা বোকামি হবে। মস্তিষ্ক দ্রুত ছুটছে ওর। এক সেকেন্ডও অযথা ব্যয় করবেনা ও এখন। তাই দ্রুত পরের প্রশ্ন গেল, ‘ রুদ্রর সঙ্গে কোথায় গিয়ে কোন ফোনে কথা বলেন আপনি? এটা বলবেন না, এখানে, আপনার রেগুলার ফোনে। এমন ভুল রুদ্র করবেনা। সেটি একদিনে আমি খুব ভালোভাবে বুঝে গেছি।’

কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই গরগর করে ঠিকানা বলে দিল নীরব। মনে মনে অবাক হল তুহিন। নীরবের নিশ্চিত মুখখানা যেন মনে খচখচ কর বিঁধছে। কিন্তু চেহারায় সেই অস্বস্তি প্রকাশ করল না তুহিন। বলল, ‘ কোড কী?’

‘ কোড?’

‘ যেটার মাধ্যমে রুদ্র বুঝতে পারে যে আপনি সেচ্ছায় কথা বলছেন?’

‘ এমন কোন কোড নেই।’

‘ মিথ্যে বলছেন আপনি।’

নির্বিকারভাবটা অকপটভাবে খসে পড়ল নীরবের মুখশ্রী থেকে। তার বদলে দেখা গেল দ্বিধা। প্রথমবার। রুদ্রর শিখিয়ে দেওয়া বুলি আওড়ে যাচ্ছিল এতক্ষণ। কিন্তু এবার?
মনে মনে হাসল তুহিন। কোডের কথাটা অন্ধকারে তীর ছোড়ার মতোই আন্দাজে বলেছিল ও। বুঝল, তী-র নিশানা ভেদ করেছে।

‘ কোডটা কী নীরব?’ তুহিনের কন্ঠ এখন রুক্ষ।

নীরব যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বলল, ‘এমন কোন কোড নেই।’

নীরব মিথ্যে বলছে। না বোঝার কারণ নেই। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল তুহিন। চোখ ঘুরিয়ে একবার দেখে নিল কুহু আর জ্যোতিকে। হঠাৎই বলে বসল, ‘ উচ্ছ্বাসের ব্যপারে কথা বলতে চাইছিলাম আমি।’

তুহিন বাক্যটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল নাজিফা। হিংস্র বাঘিনীর মতো ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। তেড়ে এলো তুহিনের দিকে। প্রচণ্ড রাগে হিশহিশিয়ে বলল, ‘কে? কে ওর নাম নিল? কে নিল?’

বলেই তুহিনের ওপর প্রায় ঝাপিয়ে পড়ল নাজিফা। শার্ট খামচে ধরে বলল, ‘ আপনি? আপনি নিয়েছেন তাইনা? মে-রে ফেলব। খু-ন করে ফেলব।’

জ্যোতি দ্রুত এসে টেনে সরালো নাজিফাকে। কিন্তু নাজিফা নাছোড়বান্দা। ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে ফেলল নিজেকে। আবার তেড়ে যেতে চাইল। কিন্তু এবার নীরব এসে আটকাল। নীরব আর জ্যোতি মিলে জোরপূর্বক ধরে আটকে রাখল নাজিফাকে। অথচ নাজিফা যেন ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে ওদের বন্ধন থেকে। কুহু দুহাতে মুখ চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নিষ্পাপ চোখদুটো জলে টাইটুম্বুর। নাজিফা গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘নেবেননা। ঐ বিশ্বাসঘাতকের নাম একদম মুখে নেবেন না। ঠক! প্রতারক!’

তুহিন হতবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দেখল সবটা। সঙ্গে আসা বাকি দুজন অফিসারও বিস্ময়ে বিমূঢ়। হঠাৎই পাশের ঘরটা থেকে ছোট বাচ্চার ক্রন্ধন ধ্বনি ভেসে এলো। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেল কুহু। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বেরিয়ে এলো একটা ছোট্ট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে। বাচ্চাদের বয়স মাসখানেক হবে বোধ হয়। বাচ্চার কান্নার শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড় হল। ওদিকে নাজিফাও নিজের মতো চেঁচিয়ে যাচ্ছে। “ঠক, প্রতারক, নেবন না ওর নাম!” দুটো শব্দ মিলিয়ে অদ্ভুত এক পরিবেশ হল বস্তির স্যাঁতস্যাঁতে ঘরটাতে। নাজিফাকে নীরবের হাতে ছেড়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল জ্যোতি। কান্না থামানোর ব্যর্থ প্রয়াশ করতে করতে বলল, ‘নাজিফা! শান্ত হও। দেখ বাচ্চাটা কাঁদছে। ভয় পাচ্ছে ও। এমন করেনা। এদিকে তাকাও বোন! তাকাও।’

নাজিফার কানে যেন এক শব্দও পৌঁছলোনা। ও বারবার একএ বাক্য আওড়ে চলেছে। “ঠক, প্রতারক, নেবন না ওর নাম! একদম নেবেনা।” জ্যোতি এবার ধমকে উঠল, ‘নাজিফা!’

থমকালো নাজিফা। ফ্যালফ্যালে চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল জ্যোতির দিকে। অতঃপর সেই দৃষ্টি গিয়ে স্থির হল বাচ্চাটার ওপর। বার কয়েক কেঁপে উঠল নাজিফার ঠোঁট। বাচ্চাদের মতো ভেঙ্গে এলো তা। দুবার ফুপিয়ে উঠল যেন। অতঃপর শরীর ছেড়ে একপাশে ঢলে পড়ল মেয়েটা। দ্রুত ধরে ফেলল নীরব। জ্ঞান হারিয়েছে নাজিফা।

বিস্মিত চোখে সবটাই দেখল তুহিন। এতক্ষণ যেন ভিন্ন জগতে ছিল নাজিফা। ঘরে প্রলয় বয়ে গেলেও যেন কিছু যাচ্ছিলোনা তার। কিন্তু “উচ্ছ্বাস” নামটা নেওয়া মাত্রই এভাবে উত্তেজিত হয়ে গেল! ঘরের বাকি সদস্যদের দিকে তাকাল তুহিন। কুহু এক কোণে গুটিয়ে আছে। নিষ্পাপ চোখদুটো থেকে মুক্তর দানার মতো ঝড়ে পড়ছে অশ্রুকণা। বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে জ্যোতি। নীরবের মুখেও তীব্র বেদনার ছাপ। বিষণ্ন চিত্তে নাজিফাকে ফ্লোরে পাতা তোষকটাতে শুইয়ে দিল ও।
বক্ষগহীনে অকারণ এক ভার অনুভব করল তুহিন। বাতাসটা ভারি ঠেকল। আজিজ, জ্যোতির মুখে শুনেছে প্রাসাদসম আমের ভিলায় কত চমৎকার হেসেখেলে বেড়াতো এরা। কত আনন্দ, কত সুখ। অথচ আজ কী নিদারুণ পরিণতিতে ভুগছে এরা! জ্যোতির সেই কথার মাহাত্ম্য আজ কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারল তুহিন। “বিষে নীল হয়ে গেল সবকিছু!”

*

নিজ কক্ষের আরামদায়ক কাউচটাতে বসে হাসফাঁস করছে শওকত। দুঃখ, অস্বস্তি, রাগ, ভয় চারটি অনুভূতির মিলিয়ে অদ্ভুত ঠেকছে তার। সদ্য ছেলে হারিয়ে বিষাদসিন্ধুতে হাবুডুবু খাচ্ছে লোকটা। অস্বস্তি আর রাগের কারণ তুহিনের অনাকাঙ্ক্ষিত আগমন। ছোকরা এমনি এমনি আসেনি। ঘাপলা একটা করে গেছে। সেটা নিয়ে সন্দেহ নেই শওকত মীর্জার। কিন্তু করেছেটা কী সেটাই বুঝে উঠতে পারছেনা। সবতো খুঁজে দেখলো। কিন্তু পাওয়া যায়নি কিছুই। এমনিতেই রুদ্রর জ্বালায় শ্বাস নেওয়া দ্বায়, এদিকে আবার ঐ অফিটারটাও আদাজল খেয়ে নেমেছে তাকে ডোবানোর জন্যে। বহুল প্রচলিত বাক্য মনে পড়ে গেল শওকতের। “একে রামে রক্ষে নেই, সুগ্রীব তার দোষর!”

আর ভয়টা রুদ্রকে নিয়ে। এতোদিন তীব্র এক আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ছিল হৃদয়। কিন্তু পলাশের মৃত্যুতে সে ভয়ে গ্রহণ লাগল। আর শানের মৃত্যুর পর সেই গ্রহণ এখন বিকট রূপ ধারণ করেছে। কাউকে ছাড়েনি রুদ্র। কাউকেই না! একেকটা মৃত্যুর কথা স্মরণ করলেও এখন শিরশির করে কেঁপে ওঠে মেরুদণ্ড। সেখানে সেতো ছিল এইসব কেচ্ছার মাথা! তার পরিণতি কী ভেবে রেখেছে রুদ্র? কতটা ভয়ংকর? শওকতের মনে পড়ল কক্সবাজারে আচমকাই সবদিক দিয়ে অসহায় রুদ্র তীব্র আক্রোশ নিয়ে বলা সেই বাক্য, ” তোদের সবগুলোকে কুত্তার মতো দৌড় করিয়ে মারব শু*রের বাচ্চা।”
কথা রেখেছে রুদ্র! তাই করেছে যা বলেছিল। বাকি কেবল সে। কিন্তু পরমুহুর্তেই প্রতিহিংসায় জ্বলে উঠল চোখজোড়া। শানের খু*নের সেই নৃশংস, ভয়াবহ দৃশ্যটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। তীব্র ব্যথা আর আফসোসে ভরে উঠল বুকটা। প্রতিশোধ চাই তার! প্রতিশোধ! যেকোন মূল্যে প্রতিশোধ। তারজন্যে রুদ্রর জীবনের অবশিষ্ট কাছের মানুষগুলোকে চাই তার। কিন্তু হারামিগুলো কোথায় যেন ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। কিছুতেই পাচ্ছেনা!

হঠাৎই ফোনে রিংটোনে চমকে উঠল শওকত মীর্জা। কেমন ঘোরে ডুবে যাচ্ছে বারবার। তার ইউজয়াল নাম্বারেই কল এসেছে। আননোন নাম্বার। কোনমতে নিজেকে সামলে কলটা রিসিভ করল শওকত। কানে ধরে রাখার ধৈর্য্য নেই তার। তাই কলটা লাউডে দিয়ে টি-টেবিলে রাখল। সে কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘হঠাৎ যোগীন্দ্রনাথের একটা কবিতা মনে পড়ে গেল। সেটাকে একটু নিজের মতো করে শোনাতে ইচ্ছে করছে আপনাকে। শোনাই?’

গম্ভীর, ধীর কন্ঠটা রুদ্রর। শক্ত হয়ে উঠল শওকতের চোখমুখ। অনুমতির তোয়াক্কা করলোনা রুদ্র। বলল,
‘হারাধনের দশটি ছেলে
ধরতে গেল ভেক,
ন’টি মরল সাপের বিষে
রইল বাকি এক।’

দাঁতে দাঁত পিষল শওকত। সোজা হয়ে বসে হাতে নিল ফোনটা। জঘন্য এক গালি ছেড়ে বলল, ‘হরাধনের এই শেষ ছেলে কিন্তু বাকি নটার মতো নয়। সে জাত সাপুরে। সাপের বিষ আর বিষদাঁত দুটোই ধ্বংস করা তার স্বভাব। কথাটা মাথায় রাখিস রাস্কেল!’

‘জানিতো। আপনার রক্তেই বিষ।’

‘ সেই বিষ তোকে শেষ করেই থামবে শু*র। শানের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোর কাছে সুযোগ ছিল। আমার হাতে পেনড্রাইভটা তুলে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার। ছেড়ে দিতাম তোকে। আর না পুলিশ তোর নাগাল পেতো। কিন্তু আমার ছেলেকে খু-ন করে তুই নিজের মৃরণ নিশ্চিত করে ফেলেছিস। আমার চোখের সামনে আমার ছেলের মাথা খ*ণ্ডখ*ণ্ড করেছিস। তোর হাজারটা টুকরো করে তবেই আমার শান্তি। আমার একটা পায়ের বদলা নিতে তোকে সর্বহারা করেছিলাম আমি। সেখানে এবারতো তুই আমার জলজ্যান্ত ছেলেটাকে শেষ করেছিস। নিজের পরিণতি নিয়ে ভাব। মৃত্যু নিয়ে ভাব।’

শব্দ করে হাসল রুদ্র ‘ লাশের মৃত্যু হয়না মীর্জা। আমার কাছে সুযোগ থাকলেও, তোমার কাছে অন্যকোন সুযোগ নেই; আমার হাতে মরা ছাড়া। ভুলে যেওনা, ওর বুকে গু*লি চালানোর আগেও হাত বিন্দুমাত্র কাঁপেনি আমার। সেখানে তোমাদের একটা কীটকেও জীবিত ছেড়ে মরব? ভাবলে কীকরে? বলেছিলাম না, কুত্তার মতো দৌড় করিয়ে মারব।’

ক্রোধে শরীর গরম হয়ে উঠল শওকতের। শরীরের কাঁপুনি ধরে গেল। হিশহিশিয়ে বলল, ‘ সেটা সময় বলবে।’

‘ সে সময় নির্ধারণের জন্যেই কলটা করা।’

‘ মানে?’

‘ মানে একটা অন্তিম সুযোগ আপনার জন্যে। আমাকে খু*ন করার। যেখানে বলবেন, চলে আসব। সেচ্ছায়। দেখা যাক কার মনবাসনা পূরণ হয়। আপনার, নাকি আমার।’

হিংস্র এক হাসি খেলে গেল শওকতের চোখেমুখে। বলল, ‘ডিলটা ভালো। কিন্তু আজকের জন্যে প্রযোজ্য নয়।’

রুদ্র খানিক তাচ্ছিল্য করে বলল, ‘ সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইছেন?’

‘ উহু! সময়টাকে পাড় করতে চাইছি।’

খানিকক্ষণ চুপ থাকল রুদ্র। হঠাৎ বলে উঠল, ‘তুহিন আহমেদ এসেছিল?’

রুদ্রর আচমকা প্রশ্নে চমকে উঠল শওকত। খানিকটা ইতস্তত করে বলল, ‘এসেছিল। চব্বিশ ঘন্টা আছে ওর কাছে। তোমাকে ধরার জন্যে। আমি চাই ও ব্যর্থ হোক। তাতে আমার দুটো লাভ। তোমাকে নিজের হাতে খু*ন করার পথে আর কোন বাঁধা থাকবেনা। দুই, অযথাই আমাদের কিছু নেতাদের পেছনে পড়েছে ও। সে আপদও দূর হবে। ওর সাসপেনশনের পর।’

‘ আপনার সঙ্গে শোক পালন করতে আসেনি সে। যাওয়ার সময় কোন ডিভাইস বা ট্রাকার নিশ্চয়ই রেখে গেছে।’

‘ রাখেনি। শুরুতে আমারও তাই মনে হয়েছিল। সব জায়গা তন্নতন্ন করে খুঁজেছি, পাইনি।’

‘ নিজেকে খুঁজেছেন?’

রুদ্রর প্রশ্নে ধাক্কা খেল শওকত। তাইতো! বসার ঘরটাতে চিরুনী তল্লাশি চালিয়ে ফেললেও, নিজেকে চেক করে দেখেনি সে। দ্রুত নিজের সর্বাঙ্গ পরীক্ষা করল শওকত। খুব ভালোভাবে খুঁজতেই পাঞ্জাবীর পকেটে মাইক্রোফোনটা উদ্ধার করল।

‘ কিছু পেলেন?’

রুদ্রর প্রশ্নে টিটকারি স্পষ্ট অনুভব করতে পারল শওকত। দুই আঙ্গুলের চাপে ছোট্ট মাইক্রোফোনটা প্রথমে ভেঙে ফেলল। অতঃপর পায়ের নিচে ফেলে পিষল আচ্ছামতন। তুহিনকে উদ্দেশ্য কর বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘ বেজ*ন্মা!’

‘ নিজের নাম এভাবে বলতে নেই মীর্জা।’

আক্রোশে ফেটে পড়ে এবং রুদ্রকে অশ্রাব্য এক গালি ছাড়ল শওকত। ওপাশ থেকে যেন চারপাশটা কাঁপিয়ে হেসে উঠল রুদ্র। ভয়ংকর হাসি। একটু মনোযোগ দিয়ে শুনলে হাড় হিম করে দেওয়ার মতো হাসি।

আফসোসের শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেলল তুহিন। এতক্ষণ মাইক্রোফোনটার মাধ্যমে ওদের কথোপকথন শুনেছিল ও কিন্তু রুদ্রর “কিছু পেলেন” এর পর বিকট এক শব্দ ছাড়া আর কিছু শুনতে পেলোনা। অর্থাৎ শওকত নষ্ট করে ফেলেছে যন্ত্রটা। এরপর কী কথা হচ্ছে ওদের মধ্যে?টেবিলে সজোরে এক ঘুষি বসিয়ে দিলো তুহিন। এক উপায় গেল। এদিকে বসে নেই ঘড়ির কাটা। টিকটিক করে নিজ গতিতে এগিয়ে চলেছে সে। কিন্তু ওর কাজ এগোচ্ছে কই?

বস্তুির সেই ঘরটা থেকে জ্যোতিসহ বাকি সবাইকে স্পেশাল গার্ডসহ পাহাড়ায় রেখে এসেছে তুহিন। ওর ধারণা শওকতও খুঁজছে ওদের। যদিও জ্যোতিকে নিয়ে সেখানে যাওয়ায় ব্যপারটা গোপন ছিল। তবুও, সাবধানের মার নেই।

*

দিন ফুরিয়ে এলো। সূর্য ডুব দিল পশ্চিম দিগন্তে। চারপাশে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে অনেক্ষণ হলো। নিজের কেবিনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে উদাস দৃষ্টিতে তা দেখছে তুহিন। কিছুক্ষণ আগেই ঘুরে এসেচে শাফায়াতের রুম থেকে। চেনা সেই স্যারকেও আজ অচেনা লাগল তুহিনের। তার ভাষা ছিল কর্কশ, ব্যাঙ্গাত্মক। ভালো, মন্দ অনেক কথাই শোনালো আজ তাকে। শেষে গিয়ে বলল, ‘ তোমাদের ইয়াং স্টারদের এই এক সমস্যা তুহিন। সাফল্য ধরা দিলেই মাথা নষ্ট হয়ে যায় তোমাদের। নিজেদের ওপরওয়ালা ভাবতে শুরু করো। সবকিছুযে চাইলেই হয়না সেটা বুঝতে পারোনা। যাই হোক, তোমার সঙ্গে জার্নিটা মন্দ ছিলোনা।’

তুহিন কেবল শান্ত স্বরে জবাব দিয়েছিল, ‘চব্বিশ ঘন্টা এখনো শেষ হয়নি স্যার।’

জবাবে পেয়েছিল এক তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি। কেবিনে আসার সময় এক কলিগতো বলেই বসল, ‘ ডিনারটা আমাদের সঙ্গেই করেন তুহিন ভাই। আজতো অফিসে আপনার শেষ দিন।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুহিন। তখনই তমাল এসে দাঁড়াল ওর পাশে। তুহিন আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল, ‘কোন খবর?’

‘ না স্যার, ফারিয়া আর নাঈম হুসাইন আলীর ডেড়ার কাছেই আছে। মাইক্রোফোন কাজ করছে এখনো। কিন্তু রুদ্র আসেনি। আর ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছেনা রুদ্র আজ আর আসবে ওখানে। আর শওকতের ঐ নাম্বারটা ট্রাকের ওপর রাখা হচ্ছে স্যার। কিন্তু সে এখনো বের হয়নি কোথাও।’

শেষ বাক্যটা তীব্র হতাশা নিয়ে বলল তমাল। কিছু বলল না তুহিন। তুহিনকে চুপ থাকতে দেখে তমাল খানিকটা সংকোচ করে বলল, ‘আপনার শওকতকে চব্বিশ ঘন্টার কথা বলাটা বোধ হয় উচিত হয়নি স্যার।’

‘ আমার বলার অপেক্ষায় সে বসে নেই তমাল। তোমার কী মনে হয়? আমার সাসপেনশনটা ডিপার্টমেন্টের মৌলিক সিদ্ধান্ত? তবে উচিত হয়েছে কী হয়নি তাতো সময় বলবে।’

কী বলবে বুঝতে পারল না তমাল। তাই চুপ থাকল। বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে তুহিনের। এমুহূর্তে ইরার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলে বোধ হয় স্বস্তি পেতো। কিন্তু সেতো আর ওর ইরাবতী নেই। কদিন পর অন্যকারো ঘরোনী হতে চলেছে সে।

‘ একটা সিগারেট হবে তমাল?’

চমকে উঠল তমাল। অবিশ্বাস নিয়ে তাকাল তুহিনের দিকে। হতভম্ব গলায় বলল, ‘ স্যার?’

‘ আমি জানি তুমি সিগারেট খাও। একটা হবে?’

‘ কিন্তু স্যার আপনিতো…’

‘ দাও!’

বিস্ময়ে শব্দ বের হলোনা তমালের মুখ দিয়ে। হাত বাড়িয়ে দিল তুহিন। প্রচুর সংশয় নিয়ে একটা সিগারেট দিল তুহিনের হাতে। লাইনটারটাও চেয়ে নিল তুহিন। সিগারেট ধরিয়ে ধীর গতিতে টানতে শুরু করল তুহিন। অভ্যেস নেই। তাই ক্ষণে ক্ষণে কেশে উঠছে।

সব ভুলে আবার গভীর চিন্তায় মগ্ন হল তুহিন। রিংটোনে বুঝেছে শওকতের কলটা এসেছে আইফোনে। অর্থাৎ সেই পার্সোনাল নাম্বার, যেটা অ‍্যান্ড্রয়েডে ব্যবহার করছে শওকত সেটায় কল করেনি রুদ্র। তারমানে কী এ বিষয়টাও ধরে ফেলেছে রুদ্র? আর হুসাইনের কাছেও রুদ্রর আসার কোন নামগন্ধ নেই। তারমানে বাকি সবার মতো রুদ্রও অপেক্ষা করছে তুহিনের সাসপেনশানের! পথ পরিষ্কার করে তবেই পরবর্তী শিকার ধরতে চাইছে সে?
সকালে বস্তির ঘরটায় ঘটা ঘটনাগুলো মনে পড়ল তুহিনের। উচ্ছ্বাস নামটা শোনামাত্র এমন উত্তেজিত হল কেন নাজিফা। উচ্ছ্বাস প্রতারক! বিশ্বাসঘাতক! হতেই পারে। তথ্য বলছে প্রিয়তার আগমনের আগেও ভেতরকার খুব গোপন তথ্য ফাঁস হয়েছিল খানিকটা। সেটা কে করতো? উচ্ছ্বাস!
রুদ্র তখন ফোনে বলেছিল, “ওর বুকে গুলি চালানোর সময়ও হাত কাঁপেনি আমার।” এই “ও” কে? প্রিয়তা? নাকি উচ্ছ্বাস। ইন্সপেক্টর আজিজের বলা কথাটাও মনে পড়ল ওর, দুটো খুন! “ঐ দুটো খুন রুদ্রর পক্ষে করা সম্ভব না। কোনভাবেই না।” দুইয়ে দুইয়ে কেমন চারের সংকেত পেল তুহিন। সব মিলে যাচ্ছে!
হঠাৎই সময়ের দিকে চোখ গেল তুহিনের। সাড়ে ছ’টা বাজে। আর মাত্র আট ঘণ্টা!

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here