অন্তর্নিহিত কালকূট তৃতীয় অধ্যায় লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৯৬.

0
56

অন্তর্নিহিত কালকূট
তৃতীয় অধ্যায়
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৯৬.

সময়টা ছিল বর্ষাকাল। তখন সদ্য গোয়েন্দা বিভাগে জয়েন করেছে তুহিন। কেইসেরই কাজে গুলিস্তান গিয়েছিল। গাড়ি ব্যবহার করতে পারেনি সেদিন। তাই ইচ্ছাকৃতভাবেই ফেরার পথে গুলিস্তান থেকে একটা লোকাল বাস ধরল। জানালার পাশে বসে দেখছিল বাইরের কোলাহল। গুলিস্তান এমনিতেই জনবহুল। ঈদের ছুটি শেষে শহরে ফিরছে সবাই। সুতরাং সেদিন ভীড় ছিল ভয়ংকর। হাজার মানুষের ভীড়ে যেন শ্বাস ফেলা দ্বায়। পারলে একজন অপরজনকে মারিয়ে চলে যায়। নিজ দেশের সিস্টেমাইটিক ল্যাকিংস্ দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুহিন।

আকাশ মেঘলা। ছোটছোট মেঘ ডাকছে। তুহিনের পাশের সিটটা ফাঁকা করে নেমে গেল একজন। আর সেই ফাঁকা স্থান পূরণ করে ঝট করে বসে পড়ল এক রমনী। ফর্সা রঙ, মাঝারি লম্বা চুলগুলো বেনুনী করা। পরনে কালো স্যালোয়ার কামিজ। দেখে প্রচন্ড বিরক্ত মনে হল মেয়েটাকে। নিজে নিজেই বিড়বিড় করছে। বাস গতি বাড়িয়ে চলতে শুরু করল আবার। মেয়েটার বিড়বিড়ানি থামছে না বরং বাড়ছে। এবার আর কৌতূহল দমাতে পারল না তুহিন। বলল, ‘এক্সকিউজ মি মিস। এনি প্রবলেম?’

ভ্রু কুঁচকে তুহিনের দিকে তাকাল মেয়েটা, ‘ জেনে কী করবেন? সমাধান করতে পারবেন?’

মৃদূ হেসে তুহিন বলল, ‘ হু নোজ? তবে শেয়ার করতে ক্ষতি কী?’

তুহিনের দিকে একটু ঘুরে বসল মেয়েটি। অভিযোগ ঝাড়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘বাসের রেগুলার ভাড়া আড়াইশ টাকা। ঈদের বাজার বলে চারশ করে নিচ্ছে! যেখানে ফিক্সড করে দেওয়া আছে তিনশ টাকা করে। এতোবার বললাম, এতো কমপ্লেইন করলাম কিন্তু কোন লাভ হলোনা। চারশ টাকাই নিল। না দিলে বাস থামিয়ে নামিয়ে দিচ্ছিল! ভাবুন, কী অসভ্য!’

তুহিন অবাক হয়ে বলল, ‘ কমপ্লেইন করেন নি?’

‘ করিনি আবার! শুধু তাই নাকি। বাসে আসতে আসতে এরিয়া দেখে মোট তিনটে থানায় কল করা শেষ। সকলেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটাই উত্তর। আমার এরিয়া না। কী আশ্চর্য ভাবুন! কারোরই এরিয়া না। মহাশূন্য দিয়ে এলাম কিনা সেটা ভেবেই ডিপ্রেসড হয়ে যাচ্ছি আমি এখন।’

হাসি নিয়ন্ত্রণ করল তুহিন। তবে সমস্যাটা সিরিয়াস। এমন অনৈতিকভাবে অনেক বাস-ই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। বাড়ি ফেরা বা যাওয়ার তাড়ায় যাত্রীরাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে এই অন্যায় আবদার। তুহিন বলল, ‘ কী নাম?’

‘ ইরা।’ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল মেয়েটি।

আরও একবার হাসি নিয়ন্ত্রণ করল তুহিন। বলল, ‘ আপনার না। বাস কম্পানির কী নাম?’

ইরা লজ্জা পেল। কান লাল হল বেচারি। মৃদু আওয়াজে জানাল বাস কম্পানির নাম। কোথাও একটা কল করল তুহিন। কম্পানির নাম বলে, রেট করার কথা বলল। ইরা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল তুহিনের দিকে। ফোন রাখতেই প্রশ্ন করেছিল, ‘ কে আপনি?’

তুহিনের জবাব ছিল, ‘গোয়েন্দা বিভাগের ছোটখাটো এক অফিসার।’

ব্যস্! এরপর প্রায় দু ঘন্টা একসঙ্গে বাসে ছিল দুজন। টুকটাক আলাপ। নাম্বার আদানপ্রদানটা যেন হয়ে গিয়েছিল খুব ক্যাসুয়ালি। এরপর কলে কথা হতে লাগল, যোগাযোগ বাড়তে থাকল। ইরার নামক সেই মেয়েটা কবে তুহিনের এতো প্রিয় হয়ে উঠল নিজেও জানেনা তুহিন।

অতীতের সেই কথা ভেবে আনমনেই হাসল তুহিন। গোধূলির সময়। ঠান্ডা বাতাস বইছে। তিনটে বছর দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল। প্রেম হল, বিচ্ছেদও হল। কিন্তু অনুভূতিগুলো এখনো কত তাজা! ইরারও কী তাই মনে হয়? আচ্ছা, ও কী ঠিক করছে? এভাবে হাল ছেড়ে দেওয়া উচিত হচ্ছে? একবার প্রাণপণ চেষ্টা করে দেখা কী উচিত না? বিবেকের কাছে প্রশ্নটা করে নিজেই থমকে গেল তুহিন।

নিজের বর্তমান কেইসে মনোযোগ দিল ও। এক সিরিয়াল কিলারকে অ‍্যারেস্ট করেছে সে। পরপর দশটা খু*নের অভিযোগ তার কাঁধে। অতীতের রেকর্ড বলে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে ভয়ংকর মাফিয়া সে। রুদ্র আমের! নিয়মমতো ইন্ট্রোগেট করার কথা তুহিনেরই। কিন্তু এই কেইসের নেপথ্যে জড়িয়ে আছে বড়বড় কিছু মাথা। নিজেদের স্বার্থে রুদ্রকে গোয়েন্দা কাস্টাডি থেকে বের করার চেষ্টা করবে তারা। সেটাই আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে ও।

‘ বাবা?’

মাহমুদার ডাকে ঘাড় ফেরাল তুহিন। মুচকি হেসে বলল, ‘এসো।’

‘ কফি খাবে? আনব?’

‘ একটু পরে।’

তুহিনের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মাহমুদা। বলল, ‘ ইরা আম্মুর কথা মনে পড়ছে?’

উত্তর দিলোনা তুহিন। মলিন হাসল কেবল। তুহিনের কাঁধে হাত রাখল মাহমূদা। বলল, ‘ এখানো সব নষ্ট হয়নি বাবা। ঠিক করে নাও। সম্পর্কে মাঝেমাঝে নিচু হতে ক্ষতি নেই।’

তুহিন এবারও নিরুত্তর। মাহমুদা বুঝলেন প্রসঙ্গটা ভালো লাগছেনা তুহিনের। তাই কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘খবর দেখলাম। তোমাকে নিয়ে কত ভালো ভালো কথা বলল। কীযে ভালো লাগছিল আমার।’

তুহিন হেসে ফেলল। বলল, ‘ এভাবে বলোনাতো খালা।’

সন্তুষ্ট হেসে তুহিনের মাথায় হাত বুলিয়ে মাহমুদা বলল, ‘অনেক বড় হও বাবা। তবে একটু সাবধানে। যত বেশি নাম, তত বেশি শত্রু। তোমাকে নিয়ে এমনিতেই অনেক ভয়ে থাকি আমি। আর আমি বুঝতে পারছি। তোমার এবারের শত্রুরা বাকিদের চেয়ে বেশি ভয়ংকর। সাবধান বাবা, খুব সাবধান।’

চোখমুখ গম্ভীর করে লালচে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল তুহিন। জানে, একবিন্দু ভুল বলছেনা মাহমুদা।

*

রাজধানীর হাসপাতালের উন্নত এক কেবিন। বরাদ্দ বেডটাতে হেলান দিয়ে বসে আছে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত নেতা শওকত মীর্জা। হাতে স্যালাইনের ক্যানেলা। মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ। কিছক্ষণ আগেই কেবিনটা মুছে গেছেন এক পরিচ্ছন্ন কর্মী। নাকে বারি খাচ্ছে ফিনাইলের তীক্ষ্ম গন্ধ। অসহ্য লাগছে তার। অস্থিরতায় দমবন্ধ হয়ে আসছে। ছটফট করতে গিয়ে হাতের ব্যথায় মুখ কুঁচকে ফেলল শওকত। মাথায়ও টনটনে ব্যথা। মনে মনে এক অশ্রাব্য গালি দিল রুদ্র আমেরকে।
রুদ্র আমের! সবদিক দিয়ে নিঃস্ব করে দিয়েছে এই পশুটা তাকে। এখন গোয়েন্দা বিভাগের কাস্টাডিতে বন্দি সে। খবর পেয়েছে শওকত। এটাই এখন তার চিন্তার কারণ। যদি সত্যিই রুদ্রর কাছে সেই পেনড্রাইভটা থেকে থাকে তবে ওর গোয়েন্দা কাস্টেডিতে থাকাটা কেবল শ ওকতের জন্যে না; দেশের বড়সর কিছু প্রতাপশালী ব্যক্তিদের জন্যেও হুমকি বৈ-কি। মুখ থুবড়ে পড়বে সব। জনসম্মুখে জ্বলজ্বল করবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে রাজধানীর গভীর সংযোগ। আর তারপর শেষ হয়ে যাবে সে। একদম শেষ! বোকামো হয়ে গেছে তার। সেদিন রুদ্রর ফাঁদে পা দেওয়া উচিত হয়নি। স্পষ্ট বুঝতে পারছে রুদ্র সেদিন মাইন্ড গেইম খেলেছিল ওর সঙ্গে। তার ট্রিগার পয়েন্টে আঘাত করে তার ভেতরকার পুরোনো সেই সাইকোপ্যথ জাগিয়ে তুলেছিল। তাইতো এমন ব্লান্ডার করল সে। আগেপিছে না ভেবে, একা, এভাবে চলে গেল সেখানে।

শওকত মীর্জার গভীর ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে বেজে উঠল সেল ফোন। বিরক্তি নিয়ে স্ক্রিনে তাকাল শওকত। তবে চমকে উঠল নামটা দেখে। হাক ছেড়ে ঘরের বাইরে থাকা দেহরক্ষীদের একজনকে ডাকল সে। দৌড়ে এলো দেহরক্ষী। শওকত ইশারা করতেই ব্লুটুথ কানেক্ট করে কানে গুজে দিয়ে ফিরে গেল নিজের জায়গায়। ওপাশ থেকে গম্ভীর গলায় কেউ বলে উঠল, ‘ ভালো আছেন?’

মনে মনে গালি ছাড়ল শওকত। মুখে বলল, ‘একদম! হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে পিকনিক করছি।’

‘রেগে যাচ্ছেন কেন? অসুস্থ অবস্থায় মশকরা করা ভালো। মন ভালো থাকে।’

‘আমার ভাই মরেছে। ছেলে মরেছে। আমার সাজানোগোছানো সব পরিকল্পনা মাটি হয়ে যাচ্ছে; আর আপনি রসিকতা করছেন? ঐ পেনড্রাইভটা গোয়েন্দা বিভাগের হাতে পড়লে রসিকতা আমি না, পাবলিক করবে আমাদের নিয়ে। আমিতো এ লাইনে নতুন। কিন্তু আপনার জা*ই*ঙ্গা খুলে জুতাপেটা করলেও আমি অবাক হবনা।’

চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল ওপাশের ব্যক্তির। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘ভাষা ঠিক করুন। পজিশনে আমি আপনার অনেক ওপরে। আপনার নমিনেশন পাওয়া না পাওয়ার অনেকটাই কিন্তু নির্ভর করছে আমার ওপরেই।’

শওকত ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলল, ‘ সেটা কাগজে কলমে। কিন্তু আপনার ঐ পজিশনের পেছনে থাকা আমার কন্ট্রিবিউশানটা ভুলে যাবেন না। আর রইল নমিনেশান; সেটার ব্যবস্থাও আপনি করবেন। নিজের স্বার্থে।’

‘ আপনাকে কন্ট্রিবিউশানটাও নিজের স্বার্থেই ছিল।’

‘ সেটাই। যে যা করছি নিজের স্বার্থেই করছি। আমার ছেলের মরার শোক পালনের সময়টা পাইনি আমি। তাই পরবর্তী পরিকল্পনা করুন। সন্ধ্যা হতেই ঐ কুত্তা সাংবাদিকরা চেপে ধরবে এসে। জবাব চাইবে। কী বলব?’

ধূর্ত হাসি হাসল ওপাশের ব্যক্তি। বলল, ‘ভাই মরেছে আপনার, ছেলেও মরেছে আপনার। খেলাটাতো আপনার দিকেই। এতো ভাবছেন কেন?’

‘ মানে?’ ভ্রু কোঁচকালো শওকত।

‘ বাঙালি বড্ড আবেগি জাতি মীর্জা সাহেব। একটুখানি ইমোশন গুলিয়ে যদি ওদের বি*ষও গেলান, ওরা ঢকঢক করে গিলে নেবে।’

শওকত মীর্জার ধূর্ত মস্তিষ্ক ধরতে পারল বিষয়টা। বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘আপনি চাইছেন আমি…’

হো হো করে ঘর কাঁপানো হাসি হাসল ওপাশের ব্যক্তি। নেশা জাতীয় কিছু গিলল বোধহয়। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল শওকত। কাজটা বড্ড বেশি নরপৈশাচিক। কিন্তু নিজের স্বার্থে এইটুকু করাই যায়। গম্ভীর গলায় শওকত বলল, ‘ আর ঐ পেনড্রাইভ? রুদ্র গোয়েন্দা বিভাগের আন্ডারে থাকে কীকরে এখনো? কী করছেন আপনি? ওকে পুলিশ কাস্টাডিতে আনার ব্যবস্থা হচ্ছেনা কেন? ওখানে থাকলে কোনভাবে শেষ করে দেওয়া যাবে ওকে। আপনার লোক আছে। আমারও চেনাজানা আছে কিছু। কিন্তু গোয়েন্দা কাস্টাডিতে থাকলে ওকে ছুঁতেও পারবেনা কেউ।’

গম্ভীর হয়ে উঠল এপাশের গলাও, ‘চেষ্টা শুরু করেছি আমি। কিন্তু সবকিছু এতো সহজ না। ঐ গোয়েন্দা ছোকরা, কী যেন নাম_ হ্যাঁ তুহিন। ব্যাটা আপিল করেছে। সে চায় ইন্ট্রোগেশনটা গোয়েন্দা বিভাগ থেকেই হোক। তার মর্জিমতো গোয়েন্দা বিভাগের ঐ প্রধান আবার সোজা ওপরমহলে এপিল করে দিয়েছে। সেখানে কী লেখা আছে জানার ক্ষমতা আমারও নেই। সচিব জরিয়ে গেছে এখানে। বেশি নাক গলাতে গেলেই বিপদে পড়ব।’

আরও এক আশ্রাব্য গালি বেরিয়ে এলো শওকতের মুখ দিয়ে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘ঐ বা***দ গোয়েন্দা গলার কাটা হয়ে আটকে আছে। শালাকে না পারছি গিলতে, আর না পারছি ওগলাতে। পাগল কুত্তার মতো পরে আছে পেছনে। রুদ্রকে ধরেতো এখন সাপের পাঁচ পা দেখেছে বাস্টা*টা।’

‘ তোমার কী মনে হয়? যদি রুদ্রর কাছে পেনড্রাইভ থাকেও, সে দেবে তুহিনকে? ইন্ট্রোগেট করে রুদ্রর পেট থেকে কথা বলানো সম্ভব? তুহিনের এতো ক্ষমতা আছে?’

‘ কথাটা কিছুদিন আগে বললেও জবাব দিতে পারতাম আমি। কিন্তু এখন, জানিনা। কিচ্ছু জানিনা। কদিন যাবত যা যা করে চলেছে তাতে ওর পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, কারো পক্ষে অনুমান করা সম্ভব না।’

‘ তার মানে পেনড্রাইভটা তুহিনকে রুদ্র দিতেই পারে?’

‘ সম্ভব!’

নিরব থাকল ওপাশের ব্যক্তি। শওকত মীর্জা বলল, ‘আগামীকালের আগে নিশ্চয়ই ইন্ট্রোগেশন শুরু হবেনা?’

একটু নিরবতা। অতঃপর জবাব এলো,’ না।’

‘ তাহলে যা করার কালকের মধ্যেই করুন। আমার পক্ষে এখন সম্ভব না। লোক নেই আমার। যেকজন আছে পুরোপুরি বিশ্বস্ত নয় কেউ। নমিনেশান পাওয়ার আগ অবধি সাবধান থাকতে হবে আমাকে। করুন যা করার।’

‘ বাধ্যবাধকতা আমারও আছে মীর্জা। তবুও দেখছি কী করা যায়। ঐ ছোকরাকে বাঁচিয়ে রাখা আসলেই বিপদজনক। তবে প্লাসপয়েন্ট এটাইযে ওর পাস্ট রেকর্ড ভালো না। অতীতের কেইসগুলোর কারণে অনেক নামিদামি মানুষের সঙ্গে শত্রুতা আছে তুহিন আহমেদের। মে*রে নদীতে ভাসিয়ে দিলেও ডিপার্টমেন্ট খুব বেশি অবাক হবেনা। নিউজপেপারে লেখালেখি হবে। খবর হবে। বড়জোর পাবলিক কদিন জাস্টিস চেয়ে শোরগোল করবে। এরপর? এরপর আবার নাকে শরিষা তেল দিয়ে ঘুমোবে। পরে প্রতিবছর ওর মৃত্যুবার্ষিকিতে সবার নীতিবোধ জেগে উঠবে। পরেরদিন ঘুমিয়েও পড়বে। এমন কেচ্ছা এদেশে বহু দেখেছি। চাপ নিওনা।’

বলতে বলতেই হো হো করে হেসে উঠল ওপাশের ব্যক্তি। দুঃখ যন্ত্রণার মাঝেও মৃদু হাসল শওকত। কথা সত্য। লম্বা শ্বাস টেনে বলল, ‘তাই করুন। তবে এবার সাবধানে। গতবার আপনার পাঠানো চারজনের দুজনকেই টপকে দিয়েছে। দুজন কাস্টাডিতে। যদিও ওদের কাছে আপনার খবর নেই বলে এযাত্রায় চিন্তামুক্ত। কিন্তু পরেরবার সাবধান হতে হবে।’

‘ এবার অন্যভাবে খেলছি গেইমটা। রাখছি তবে। আর প্রেইস কীভাবে সামলাতে হবে বুঝেছেনইতো।’

‘ বুঝেছি।’

কলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলল শওকত। দাঁতে দাঁত পিষল। চাপ অনুভব করল বুকে। একবার রুদ্র পুলিশ কাস্টাডিতে আসুক। শোধ সে তুলবেই। রইল বাকি তুহিন আহমেদ। ওটার মরার ব্যবস্থাতো হচ্ছেই। তুহিনের ওপরও ভীষণ ক্ষোভ শওকতের। সামনাসামনি পেয়েও রুদ্রর বুকে গু*লি চালায়নি বেজ*টা! চালালে আজ জীবিত থাকতো তার ছেলে। তুহিনকেও জীবিত রাখবেনা সে। কোনভাবেই না।

*

‘ সমস্ত সমালোচনা এবং ক্ষোভ মিটিয়ে অবশেষে পুলিশের আওতায় দশটি খুনের আসামি রুদ্র আমের। নেপথ্যের নায়ক গোয়েন্দা বিভাগের তরুণ অফিসার তুহিন আহমেদ।’

হেডলাইনটা আরও একবার জোরে জোরে পড়ল তমাল। চোখেমুখে সন্তুষ্টি, গর্ব। ফ্রন্ট পেইজে ছেপেছে খবরটা। তুহিন, গোয়েন্দা বিভাগ এবং কেইসটার ব্যপারে বিস্তারিত লেখা আছে ভেতরে। তুহিনের কেবিনেই বসে আছে তমাল, ফারিয়া এবং নাঈম। তিনজনই ভীষণ উত্তেজিত। বর্তমান কেইসটা সলভ করতে প্রতিটা মুহুর্তে সাথে ছিল ওরা তিনজন। আজ যখন কেইসটা সলভ হয়েছে; একসঙ্গে বসে ছোট একটা কফির আড্ডা দেওয়াই যায়। তুহিন আসলে আবদার রাখবে ওরা। ততক্ষণ কাগজে তুহিনকে নিয়ে লেখাটাই পড়ছিল ওরা।

তমাল থামতেই নাঈম বলল, ‘ স্যারতো পুরো হিরো হয়ে গেল, তাইনা?’

‘ স্যার হিরোই ছিলেন। এর আগেও এমন অনেক নিউজ ছাপা হয়েছে ওনাকে নিয়ে। কিন্তু এসব পছন্দ করেন না স্যার। বিরক্ত হন।’ কাগজটা ভাজ করে রাখতে রাখতে বলল তমাল।

ফারিয়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ কিন্তু স্যার এখনো এলেন না যে!’

বলতে বলতেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করল তুহিন আহমেদ। পরনে কফি কালার একটা শার্ট। কালো প্যান্ট। হাতে ব্রাউন ব্লেজার। ভেতরে ঢুকতেই তিনজন দাঁড়িয়ে গেল। একসঙ্গে বলে উঠল, ‘গুড মর্নিং স্যার।’

‘মর্নিং। সবাই একসঙ্গে যে?’ ব্লেজারটা নিজের চেয়ারে ঝুলিয়ে রাখল তুহিন।

তমাল খানিকটা ইতস্তত করে বলল, ‘ আসলে স্যার.. আজ আমরা একসঙ্গে কফি খেতে চাইছিলাম।’

নিজের চেয়ারে বসতে বসতে তুহিন বলল, ‘ কেন?’

‘ ছো-ছোট্ট একটা সেলিব্রেশন স্যার।’

‘ কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি তমাল।’

‘জানি স্যার, এখনো কাজ বাকি। হাতে সময় কম। তাই এই কেবিনেই যদি_’

চেয়ারে হেলান দিয়ে ভ্রু কোঁচকালো তুহিন, ‘ আজকেই কেন?’

খানিকটা এগিয়ে এলো নাঈম। মুখে অমায়িক হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘ সময়ের কাজ সময়ে করে রাখা ভালো না স্যার? পরে কী হয় কে জানে? তবে শুধু কফিতে ছাড়ছিনা আপনাকে। এইসব ঝামেলা মিটে যাওয়ার পর একটা ট্রিট চাই কিন্তু।’

তুহিন তাকাতেই গলা শুকিয়ে গেল নাঈমের। কোনমতে বলল, ‘ প্লিজ স্যার।’

হেসে ফেলল তুহিন। বলল, ‘ বেশ।’

বলার সঙ্গে সঙ্গেই পিয়নকে ডাকল তমাল। চার মগ কফি আনতে বলল। তুহিনের নির্দেশে তিনজনেই পুনরায় বসল একেকটা চেয়ার টেনে। নাঈম বলল, ‘ স্যার বেশ জব্বর নিউজ হয়েছে কিন্তু। জনগণতো হিরো মেনে নিয়েছে আপনাকে।’

‘ আর রুদ্র আমেরকে ভিলেইন।’ মৃদু হেসে কথাটা বলল ফারিয়া।

তেমন উত্তেজনা দেখা গেলোনা তুহিনের মাঝে। টেবিল থেকে একটা ফাইল খুলে বসল। বলল, ‘ প্রত্যেকেই তার নিজের গল্পে হিরো ফারিয়া। গল্প প্রকাশের দৃষ্টিভঙ্গিই নায়ক এবং খলনায়ক নির্ধারণ করে।’

তমাল বলল, ‘ নিউজ চ্যানেলেও খবরটা নিয়ে কিছু বলেছে নিশ্চয়ই? কফি আসতে আসথে দেখি চলো!’

বলতে বলতে নিজের ল্যাপটপটা অন করল তমাল। নিউজ চালাল। কাগজের কথাগুলোই আরেকটু মশলা মাখিয়ে পাঠ করলেন সংবাদ পাঠিকা। এরমধ্যেই শওকত মীর্জার সাক্ষাৎকার ভেসে এলো স্ক্রিনে। নড়েচড়ে বসল ওরা। এবার ফাইল থেকে চোখ তুলে তাকাল তুহিনও। হসপিটাল থেকে রিলিজ হওয়ার পরপরই সাংবাদিকরা চেপে ধরেছে তাকে। ছুড়ে যাচ্ছে একের পর এক প্রশ্ন। সবপ্রশ্নের উত্তরই ধৈর্য্য নিয়ে দিচ্ছে শওকত। একজন প্রশ্ন করল, ‘সামনের নির্বাচনের এমপি পদপ্রার্থী হতে চলেছেন আপনি। এই মুহূর্তেই আপনার ভাই আর ছেলেকে এতো নৃ*শং*সভাবে হ*ত্যা করল একজন কথিত মাফিয়া। এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?’

শওকত নিজের চেহারায় বিষাদ ঢেলে বললেন, ‘ এই সময়ে আমাকে দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আমার দুটো হাত ছিল আমার ছেলে এবং ভাই। সেই দুটো হাতই ছিড়ে ফেলেছে ওরা।’

বলতে বলতে যেন জল চলে এলো শওকতের। সেটাই মোছার চেষ্টা করে বলল, ‘ এতে কাদের লাভ হতে পারে সেটা নিশ্চয়ই খুলে বলার কিছু নেই।’

‘ কিন্তু খু*নতো আরও আটটা হয়েছে।’

‘ ভালো করে খবর নিয়ে দেখবেন! ওরা সব আমাদের পার্টিরই লোক। হ্যাঁ হয়তো আমার এরিয়ার না। কিন্তু পার্টি একটাই? মাফিয়া ভাড়া করে করাচ্ছে এসব। ঐ রুদ্র আমের না কী নাম, সে ধরা পড়ার পরেও আজ ভোরে আমার পার্টিরই দুজন খু*ন হল। এ বিষয়ে কী বলবেন?’

আরেকজন প্রশ্ন করল, ‘ গুজব আছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে সংযোগ আছে আপনার। বিশাল বড় এক দল সামলাম আপনি।’

শওকত এবারেও সংশয়হীন হয়ে জবাব দিলেন, ‘প্রমাণ আছে আপনার কাছে?’

চুপ থাকল রিপোর্টার। নেই। শওকত ক্যামেরায় তাকিয়ে বলল, ‘ সেসব সত্যি হলে আমার ভাই, ছেলেকে ছোঁয়ার সাহস পেতোনা কেউ। ষড়যন্ত্র বুঝতে শিখুন। ক্ষমতায় থাকার জন্যে যারা এতো নিচে নামছে। পেয়ে গেলে রসাতলে যাবে আমার দেশ।’

বিরক্ত হয়ে নিউজ বন্ধ করে তমাল। বলল, ‘ পার্টির দুজনকে শালারা নিজেরাই মেরেছে। আমি ড্যাম শিওর।’

হতবাক ফারিয়া বলল, ‘ নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে নিজের ছেলের মৃত্যুটাকে কাজে লাগাল! আবার নিজেরই দলের লোক মেরে ফেলল! কতবড় নরপিশাচ এরা!’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল নাঈম। তিনজনই তুহিনের দিকে তাকিয়ে দেখল বসে আছে চুপচাপ। বিরক্তিতে কুঁচকে আছে ভ্রুজোড়া। বুঝল ভেতরে ভেতরে ভয়ংকর রাগে ফুঁসছে তুহিন। জেদ চেপে আছে। পরিস্থিতি সামলাতে প্রসঙ্গ বদলাল তমাল। বলল, ‘ স্যার! আমাদের নাঈম বোধ হয় এবার বিয়ে-টিয়ের পরিকল্পনা করে ফেলছে বুঝলেন? এখনই ভবিষ্যতের চিন্তা করছে।’

চোখ রাঙিয়ে তমালের দিকে তাকাল নাঈম। তুহিনের দিকে চোখ পড়তেই কান লাল হয়ে উঠল বেচারার। নাক চুলকে হাসি নিয়ন্ত্রণ করল তুহিন। ফারিয়া বলল, ‘ ঠিকই আছে। বিয়ে করলে বউকে সময় দেবেনা! সেটা হয় আদোও! সবাই কী আর লেজ ছাড়া বাদর নাকি। সারাদিন খালি এগাছ থেকে ওগাছ লাফাবে?’

তমাল কটমটে চোখে ফারিয়ার দিকে তাকাল, ‘ লেজ ছাড়া বাদর কী আমায় বললে?’

‘ পড়ল কথা সবার মাঝে। যার কথা তার_’ বাক্যটা সম্পন্ন করল না ফারিয়া। ঠোঁটে চেপে হাসল কেবল।

হাসি পেলেও চেহারায় গাম্ভীর্য বজায় রাখল তুহিন। একটা ফাইল দেখতে দেখতে বলল, ‘ সত্যি সত্যিই বিয়ে-টিয়ে করে ফেলছো নাকি নাঈম?’

নাইমের লাল হওয়া কান আরও লাল হয়ে উঠল। অনেকটা ইতস্তত করে বলল, ‘ না মানে স্যার। বাড়ি থেকেই মেয়ে দেখেছে। টুকটাক কথাবার্তা হয়। এখনো ডেইট ফিক্সড হয়নি। তবে হবে শীঘ্রই।’

হেসে উঠল তমাল, ফারিয়া। কফি চলে এলো। কফি খেতে খেতে আরও কিছুক্ষণ চলল ওদের আড্ডা। তমাল, ফারিয়ার ঝগড়া, নাঈমকে খোঁচা দিয়ে কথা বলা, নাঈমের পাল্টা খোঁচা। তুহিন বেশিরভাগ সময়ই চুপ ছিল। কফি প্রায় শেষের দিকে। তখন তুহিন বলল, ‘ হয়েছে সেলিব্রেশন? এবার কাজের কথায় আসি।’

তিনজনই ঠিকঠাক হয়ে বসল। তুহিন বলল, ‘ সম্ভবত আজকেই রুদ্র আমেরের ইন্ট্রোগেশন শুরু করব আমি। আমার সঙ্গে তমাল থাকবে। ফর নোটিং ডাউন।’

মাথা নাড়ল তমাল। তুহিন বলে চলল, ‘ ফারিয়া, গোটা কেইসের এখনো পর্যন্ত ফরেনসিক রিপোর্ট তৈরী করে ফেলো। আজকের মধ্যে। শেখের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য এবং তুমি আমাদের সঙ্গে ফিল্ড ভিজিটে যা যা দেখেছো, জেনেছো সে অনুযায়ী রিপোর্ট রেডি করবে। গট ইট?’

‘ ইয়েস স্যার।’ যান্ত্রিক কন্ঠে বলল ফারিয়া।

নাঈমের দিকে তাকাল তুহিন, ‘ সাইবার ডিপার্টমেন্টের ল্যাবে গিয়ে ঘুরে এসো। আমার একাউন্টের গরবরের রিপোর্ট রেডি হয়ে যাওয়ার কথা এতক্ষণ। ওটা কালেক্ট করো। ভালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করো ওদের। কীভাবে ব্যপারটা ঘটল আই অন্না নো অল ডিটেইলস্।’

‘ রাইট স্যার।’

‘ এক্ষুনি বেরিয়ে পরো। সময় নষ্ট করা যাবেনা।’

‘ ওকে স্যার।’

কফি শেষ করেই উঠে দাঁড়াল ফারিয়া এবং নাঈম। বিদায় নিল তুহিনের কাছ থেকে। নাঈমকে শুধুমাত্র একটা পাতলা শার্টেই বেরিয়ে যেতে দেখে ভ্রু কোঁচকাল তুহিন। ডেকে বলল, ‘ কী ব্যপার নাঈম? গরম কাপড় আনোনি।’

নাঈম নিজের দিকে তাকিয়ে, ‘এনেছিলাম স্যার। এসে চা খেয়েছিলাম তখন হাত ফসকে পরে গেছে। তাই_’

মাথা নাড়াল তুহিন। চেয়ারে ঝোলানো নিজের ব্লেজারটা দেখল একবার। নাইমও কোইন্সিডেন্টলি কফি কালার শার্টই পড়েছে। তুহিন নিজের ব্লেজার এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা পড়ে বের বের হও। আমি এখন আর বাইরে যাবনা। তাই লাগছেনা আমার।’

‘ কিন্তু স্যার_’

‘ কুয়াশা না থাকলেও বাইরে ভীষণ ঠান্ডা নাঈম। দরকার হবে। টেইক ইট।’

মৃদু হেসে ব্লেজারটা নিল নাঈম। অতঃপর বেরিয়ে গেল নাঈম আর ফারিয়া। সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল তুহিন। বয়সে ওদের খুব বেশি বড় নয়। তবুও ওদের কী চমৎকার সম্মানবোধ ওর প্রতি। শুধু সিনিয়র বলে নয়, হৃদয় থেকেই আসে এই সম্মান। সেটা জানে তুহিন। এই কেইসটাকে এদকম নিজের মনে করে একদম প্রাণপণে লড়েছে এই তিনজন। তুহিনকে নির্দোষ প্রমাণ করতে বিলিয়ে দিয়েছিল নিজেদের সবটা।

খানিক বাদে উঠে দাঁড়াল তুহিন। তমালও দাঁড়াল। তুহিন বলল, ‘ তুমি সবকিছু রেডি করো। আমি স্যারের কেবিন হয়ে আসছি। সম্ভবত আজই রুদ্রকে ইন্ট্রোগেট করার সুযোগ পাব আমি।’

*

কফির মগে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজ পড়ছেন শাফায়াত হোসেইন। নিজের ডিপার্টমেন্টের তরুণ অফিসারদের কৃতিত্বের কথা বিস্তরে লেখা দেখে মনে মনে ভীষণ গর্বিত অনুভব করলেন উনি। স্বস্তির শ্বাস ফেলে গা ছেড়ে বসলেন। ঠান্ডা সতেজ সকালটা আরও বেশি সতেজ মনে হল তার। দরজায় নক পড়ল, ‘আসব স্যার?’

তুহিনকে দেখে প্রসন্ন হাসি হাসলেন শাফায়াত। বললেন, ‘এসো এসো।’

ভেতরে এলো তুহিন। শাফায়াত অনুমতি দিতেই চেয়ার টেনে বসল ও। শাফায়াত বলল, ‘ তোমার প্রতি আস্থার জায়গাটা দিন দিন আমার বেড়েই চলেছে তুহিন। প্রতিবার অদ্ভুতভাবে মুগ্ধ করো তুমি আমায়। শুধু আমি না; গোটা ডিপার্টমেন্ট গর্ব করে তোমাকে নিয়ে।’

সৌজন্যমূলক হাসি দিল তুহিন। ‘ধন্যবাদ স্যার।’ অতঃপর খানিকটা ইতস্তত করে বলল, ‘স্যার, আমার আপিলটা…’

‘ হ্যাঁ! সেটা নিয়ে বলতেই ডেকেছি তোমাকে। তোমার কথা অনুযায়ী ওপর মহলে আপিল করেছিলাম আমি। কারণ হিসেবে সেটাই লিখতে বলেছি; যা তুমি বলেছো। ট্রিকটা কাজে দিয়েছে। রুদ্রকে ইন্ট্রোগেট তুমিই করবে।’

তুহিনের তীক্ষ্ম চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠল। সন্তুষ্ট হেসে বলল, ‘থ্যাংকস্ আ লট স্যার। আর আমার ওপর হওয়া অ‍্যাটাক আর একাউন্ট হ্যাকিং এর ব্যপারটাও আমি নিজেই দেখতে চাই।’

উত্তরে হাসি দিতে পারলেন না শাফায়াত। খানিকটা গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘ তবে সাবধান। তুমি যা সন্দেহ করেছো তা যদি সত্যি হয়। এবার কিন্তু বেপরোয়া হয়ে উঠবে ওরা। আর তুমি যাদের লেজ ধরে টান দিয়েছো তাদের হাত অনেক লম্বা, থাবা অনেক হিংস্র। সুতরাং প্রতিটা পা খুবই সতর্কতার সঙ্গে ফেলতে হবে।’

চোখেমুখে বিন্দুমাত্র ভীতি নেই তুহিনের। দৃঢ় সংকল্প নিয়ে বলল, ‘ আমি তৈরী স্যার।’

‘গুড! কবে শুরু করতে চাইছো তুমি তোমার ইন্ট্রোগেশন?’

‘আজ স্যার, এবং এখনই।’

*

ইন্টারোগেশন রুমটা মাঝারি আকারের। তিনটে নিশ্ছিদ্র দেয়াল। চতুর্থ দেয়ালটায় ঢোকার দরজা। বাইরে কড়া পাহাড়া। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা টেবিল। টেবিল বরাবর সিলিংয়ে নগ্ন একটা বাল্ব ঝুলছে। তার আলোয় উত্তপ্ত হয়ে আছে টেবিলসহ আশপাশটা। নিচে বসা লোক সহজেই অস্থির হয়ে উঠবে।
টেবিলের দুপাশে দুটো চেয়ার। তারমধ্যে একটা চেয়ারে বসে আছে রুদ্র আমের। হ্যান্ডকাফ পড়ানো হাতটা টেবিলের ওপর রাখা। পরনে নেভী ব্লু রঙের একটা শার্ট। গালে অযত্নে গজিয়ে ওঠা খোঁচাখোঁচা দাঁড়ি। লালচে চোখ। সারামুখ জুড়ে অসম্ভব নির্বিকারত্ব। নির্বিকারভাবেই তাকিয়ে আছে হাতের হ্যান্ডকাফটার দিকে। দু মিনিট আগে অপর চেয়ারটায় এসে বসেছে তুহিন আহমেদ। দু মিনিট যাবত তীক্ষ্ম নজরে রুদ্রকে পর্যবেক্ষণ করে নিল রুদ্র আমেরকে। ঠিক পাশেই বসে আছে তুহিন আহমেদ। হাতে নোটবুক। টেবিলে রেকর্ডার রাখা। অধৈর্য হচ্ছে তমাল। জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হচ্ছেন কেন? বাকি সত্য জানার জন্যে ছটফট করছে ওর।

হেলদোলহীন রুদ্রকে দেখে অবাকই হল তুহিন। রুদ্রর স্বভাব সম্পর্কে অনেকটাই ধারণা হয়েছে ওর। তাই বলে এমন মুহূর্তেও এতোটা নিষ্ক্রিয়! সামান্য গলা ঝাড়ল তুহিন। নিরবতায় ছেদ ঘটিয়ে বলল, ‘ চিরকুটে ঠিকই বলেছিলে তুমি। সময় কম। নয়তো সত্যিই আমাদের চোর-পুলিশ খেলাটা জমে উঠতো। প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে আমারও ভীষণ পছন্দ হয়েছিল তোমাকে। কিন্তু কী করার! বেটার লাক_ নেক্সট টাইম বলব নাকি নেক্সট লাইফ?’

তীক্ষ্ম লালচে চোখজোড়া তুলে তাকাল রুদ্র। ঠোঁট বাঁকিয়ে সামান্য হেসে বলল, ‘এজ লং এজ আই ব্রিথ।’

হাসল তুহিন। মনে মনে যেন স্বস্তির শ্বাস ফেলল। এতক্ষণ যেন এই রুদ্রকেই চাইছিল ও। প্রতিপক্ষ সমকক্ষ না হলে কীসের লড়াই। বলল, ‘ গুড! তবে দশটা খু*ন করে সরাসরি গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়ার পর খুব বেশিদিন শ্বাস নিতে পারবেনা তুমি। সেটা নিশ্চয়ই জানো?’

‘ লক্ষ্য পূরণের জন্যে একটা সেকেন্ডই যথেষ্ট অফিসার।’

‘ কিন্তু সেই সেকেন্ড আমি তোমাকে দেবনা রুদ্র। কোনভাবেই না।’

একই ভঙ্গিতে হাসল রুদ্র। সোজা হয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, ‘বেটার লাক।’

রুদ্রর এমন চটাস চটাস কথায় মেজাজ খারাপ হল তমালের। ঠাটিয়ে একটা লাগিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে নিয়েই তাকাল রুদ্রর দিকে। কিন্তু ঐ চেহারা, চাহনী দেখে কেমন যেন নিভেও গেল। তুহিনের মধ্যে ক্ষেপে যাওয়ার কোন লক্ষণ নেই। বরং ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে রেখেই বলল, ‘শেষ মুহুর্তে এসে তুমি সেচ্ছায় ধরা দিয়েছো রুদ্র। সফল হতে কি-না পরের কথা। কিন্তু চেষ্টাটাও করোনি তুমি। কেন? তারচেয়েও বড় কথা ঐ চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই মীর্জাকে অ‍্যাটাক করার এতো কীসের তাড়া ছিল তোমার? পরেও করতে পারতে। বরং তখন তোমার জন্যে কাজটা সহজ হতো। অনন্ত সময় ছিল তোমার হাতে। সবটা জেনেও এতো ভয়ংকর রিস্ক কেন নিলে রুদ্র? এতো অধৈর্য হল কেন?’

রুদ্র ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই বলল, ‘ আপনার কেইসের কোথাও কাজে লাগবেনা সেই তথ্য।’

তুহিনর চোখমুখ কৌতুক হারাল। গম্ভীর গলায় বলল, ‘ সেটা আমি নির্ধারণ করব।’

হ্যান্ডকাফ পড়ানো হাতটা পুনরায় টেবিলে রাখল রুদ্র আমের। মৃদু ঝুঁকে বলল, ‘ কী যায় আসে অফিসার? আমার হাতে অনন্ত সময় থাকলেও আপনার হাতে কেবল চব্বিশ ঘন্টাই ছিল। আমি অধৈর্য হওয়াতে আপনার লাভ বৈ ক্ষতি হয়নি।’

কারণটা যেন মনে বেজে উঠল তুহিনের। পেয়ে গেল উত্তর। কিন্তু মানতে পারল না। এও সম্ভব! মুখে বলল, ‘ আমি কারণ জানতে চেয়েছি।’

রুদ্র রহস্যময় দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, ‘ সবকিছুর কারণ থাকেনা অফিসার। সুযোগ পেয়েও আমার বুকে গু*লি চালান নি আপনি।’

‘ কারণ তোমাকে জীবিত দরকার ছিল আমার।’

‘ অক্ষত না।’

চোয়াল শক্ত করল তুহিন। টেবিলে হাত রেখে ঝুঁকল রুদ্রর দিকে। বলল, ‘ কারণ বাধ্য হইনি। অকারণে খু*ন করিনা আমি। আর বাধ্য না হলে তোমার বুকে গু*লি চালাবোনা আমি।’

প্রসারিত হল রুদ্রর বক্র হাসি, ‘ মানুষকে বাধ্য করতে ভীষণ ভালোবাসি আমি।’

তমাল দেখল, দু জোড়া তীক্ষ্ম চোখ তাকিয়ে আছে একে আপরের দিকে। দৃষ্টিতে একই তীক্ষ্মতা, একই জেদ, একই দূঢ়তা। ভিন্ন যদি কিছু থাকে, তা কেবল উদ্দেশ্য!

#চলবে…

[ পেইজের রিচ কম। তাই গল্প যাদের কাছে পৌঁছবে সবাই রেসপন্স করার চেষ্টা করবেন। অন্তত রিঅ্যাক্ট করে যাবেন। আর কমেন্টগুলো অনুগ্রহ করে গঠনমূলক করবেন। ‘অপেক্ষা শেষ হয়েছে’ ‘নাইস, নেক্সট’ ইত্যাদি অফটিপক মন্তব্য খুব বেশি না করার অনুরোধ। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here