অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৯৫. ( দ্বিতীয় অধ্যায়ের সমাপ্তি )

0
53

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৯৫. ( দ্বিতীয় অধ্যায়ের সমাপ্তি )

শ্রাবণের রাত। কিছুক্ষণ আগেই আকাশ ভাঙা বৃষ্টি ছিল। সন্ধ্যা থেকে রাত এগারোটা অবধি চলেছে বর্ষণের টানা প্রকোপ। লম্বা শ্বাস টেনে আকাশের দিকে তাকায় রুদ্র। আকাশ তখন পরিষ্কার। পরিপূর্ণ গোল চাঁদখানা ফাঁকা আকাশে জ্বলজ্বল করছে। বৃষ্টি না থাকলেও ভেজা তীব্র বাতাস খানিক বাদে বাদেই ধাক্কা মারছে শরীরে। সিগারেটে লম্বা এক টান দিয়ে নাক দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ে রুদ্র। আঁধারিতে ঘেরা ছাদে অদ্ভুত ধোঁয়াময় এক পরিবেশ সৃষ্টি করে সেই ধোঁয়া। কখন যেন ওর বাঁ পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল প্রিয়তা। খেয়াল করেনি রুদ্র। যখন খেয়াল হল তখন দেখল, একধ্যানে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। খানিক বাদে নিজের হাত কচলাচ্ছে। রুদ্র সিগারেটে আরেকটা টান দেয়। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, ‘কী হয়েছে?’

প্রিয়তা ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। কমলাটে পাতলা ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে বলে, ‘যাক, খেয়াল করলেন তবে। সিগারেটটা ফেলবেন?’

‘ কেন? ক্রেভিং হচ্ছে?’

‘ ধ্যাত!’

নিজের রসিকতাতেই হাসে রুদ্র। সিগারেটটা নিচে ফেলে পিষে দেয়। প্রিয়তা বলে, ‘একা একা দাঁড়িয়ে ছিলেন যে?’

‘ উচ্ছ্বাস ছিল। কিছুক্ষণ আগেই রুমে গেল।’

‘ নাজিফার বিয়ের পর থেকে ভাইটা কেমন হয়ে গেল তাইনা? বাইরে থেকে বুঝতে দেয়না। কিন্তু ভেতর থেকে একদম শেষ হয়ে যাচ্ছে।’

‘ নিজের সুখ নিজে নষ্ট করলে অন্যকেউ কী করবে?’

‘ এভাবে বলছেন কেন? ওর কাছে আপনাদের জায়গাটা সবার ওপরে। তাইতো এতবড় ত্যাগ করতে পারল।’

‘ সেটা ভালোবাসার আগে ভাবা উচিত ছিল।’

‘ আপনি পেরেছিলেন?’

ভ্রু কুঁচকে তাকায় রুদ্র। কন্ঠে জিজ্ঞাসা ঢেলে বলে, ‘কী?’

‘ভেবেচিন্তে ভালোবাসতে?’

জবাব দেয়না রুদ্র। দু সেকেন্ড স্থির থেকে আস্তে করে তাকায় আকাশের দিকে। সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে আকাশের দিকে তাকায় প্রিয়তাও। বেশ কিছুক্ষণ বাতাসের শো শো শব্দ শোনা যায় কেবল। দীর্ঘ এক শ্বাস নিয়ে প্রিয়তা বলে, ‘ভালোবাসা যদি ভেবেচিন্তে সম্ভব হতো, আমি আপনাকে ভালোবাসতাম না রুদ্র। আপনার প্রেমে পড়া আমার জীবনের সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পতন। এতোটাই অনাকাঙ্ক্ষিত যা আমার সমস্ত পরিকল্পনাকে একনিমিষে এলোমেলো করে দিয়েছে।’

‘ জানি। আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে আর পাঁচটা মেয়েরর মতোই স্বাভাবিক জীবন চেয়েছিলে তুমি। একটা সাজানো ঘর, চমৎকার বর, ফুটফটে বাচ্চা। অথচ আমি এসে সবটা এলোমেলো করে দিলাম তাইনা? প্রেম নামক অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড়ে এলোমেলো করে দিলাম তোমার সাজানো স্বপ্নগুলোকে।’ পাল্টা দীর্ঘশ্বাস বের হয় রুদ্রর ভেতর থেকেও।

রুদ্রর হাতের বাহু আকড়ে ধরে প্রিয়তা। কাঁধে মাথা এলিয়ে বলে, ‘ সত্যি বলেছেন। কিন্তু তারচেয়েও বিশাল সত্যি কী জানেন? আপনাকে ভালোবেসে কখনও আফসোস হয়নি আমার। স্বপ্নভঙ্গতো তুচ্ছ ব্যপার। আপনার বুকে আমি নরকের জ্বালাও সয়ে নিতে পারব।’

‘ এতোটা ভালোবাসো?’

‘ আপনি কল্পণাও করতে পারবেননা ঠিক কতটা ভালোবাসি আপনাকে। আর আপনার ভালোবাসা আমাকে বাঁচিয়ে রাখে রুদ্র। কোনদিন এই ভালোবাসাটুকু কেড়ে নেবেননা। আমি জ্যান্ত লাশ হয়ে যাব। যদি কখনও মনে হয় আমাকে আর ভালোবাসা সম্ভব না, সেদিন নিজের হাতে মৃত্যু দেবেন। সেই মৃত্যু আপনার ভালোবাসা না পাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি সুখের হবে।’ কেঁপে ওঠে প্রিয়তার কন্ঠস্বর।

রুদ্র ঠোঁটে মলিন হাসি ফুটিয়ে বলে, ‘ অপার ভালোবাসা দেওয়ার পর তা তুলে নেওয়া যায়না প্রিয়। আর যদি তা যায়, সেই শূন্য স্থানে এসে ভীড় করে তীব্র ঘৃণা। অতোটা ঘৃণা আমি তোমাকে করতে পারবনা।’

‘ সেই ঘৃণার কারণ যদি আমি নিজেই দেই।’

প্রিয়তার আচমকা প্রশ্নে গম্ভীর হয়ে ওঠে রুদ্রর চোখমুখ। থমথমে গলায় বলে, ‘ নিজের হাতে খু-ন করব তোমাকে।’

চমকে ওঠে প্রিয়তা। মাথা তোলে রুদ্রর কাঁধ থেকে। সর্বাঙ্গ যেন স্থির হয়ে যায়। রুদ্র ঘুরে তাকায় প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তার দুচোখে বিষ্ময়। কোমরে হ্যাঁচকা টানে ওকে নিজের কাছে টানে রুদ্র। চোখে চোখ রেখে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘মাঝরাতে নেশাখোরদের মতো উল্টোপাল্টা বকলে সত্যিই খু-ন করব।’

রুদ্রর বুকে মাথা এলিয়ে গুটিয়ে যায় প্রিয়তা। ফিসফিসে সেই আওয়াজ অনুকরণ করে বলে, ‘আপনার বুকে খু/ন হতে আপত্তি নেই আমার।’

ঝট করে চোখ খুলল রুদ্র। অবোধের মতো চারপাশে চোখ বুলালো। আবছা অন্ধকারে স্যাঁতস্যাঁতে চারটা দেয়াল ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলোনা। দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে ও। চোখটা লেগে এসেছিল। লম্বা শ্বাস ফেলল রুদ্র। ঠান্ডার প্রকোপ এখনো অব্যাহত আছে। অথচ দরদর করে ঘেমে চলেছে ও। হঠাৎ ভীষণ চাপ সৃষ্টি হল বুকে। হাত দিয়ে বুকের বাঁ পাশটা চেপে ধরল রুদ্র। বোধ করল শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। চোখে জ্বালা করছে। আরেকটা হাত আপনাআপনিই চলে গেল জিন্সের পকেটে। বেরিয়ে এলো সেই দুটো লকেট। তারমধ্যে একটা পকেটে রেখে দিল রুদ্র। অপরটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরল। মনে পড়ল সেইদিন রুদ্রর বুকে লেপ্টে থেকে আরও বলেছিল প্রিয়তা। বলেছিল, ‘ফুটফুটে বাচ্চার স্বপ্নটা কিন্তু পূরণ করতেই পারেন আপনি।’

বলতে বলতেই গুটিয়ে গিয়েছিল লজ্জায়। মৃদু হাসল রুদ্র। হঠাৎই মনে পড়ল সেই দিনটা। প্রিয়তার সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়া, সেই র-ক্ত, মিসক্যারেজ। রাজপুত্র নামক সেই স্বপ্নের নিষ্ঠুর সমাপ্তি! শুকনো এক ঢোক গিলল রুদ্র। আপনমনে বলে উঠল, ‘তোমার অপেক্ষার অবসান ঘটবে প্রিয়। আরেকটু ধৈর্য্য ধরো। আমি আসব। খুব তাড়াতাড়ি আসব।’

আপাতত একটা ছোট্ট বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে সে। এই মুহূর্তে এধরণের জায়গার সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। দ্রুত সময়টা দেখে নিল রুদ্র। আটটা বাজতে চলেছে। সেলফোনটা বের করে কাউকে কল করল ও। রিসিভ হতেই বলল, ‘ ওদিকের কী খবর?’

উত্তর শুনে কপালে ভাঁজ পড়ল রুদ্রর। বলল, ‘ বুলেট লাগবে আমার। আরেকটা পি-স্ত-ল। হুসাইন আলীর ডেরায় চলে যা। আমার গঠন ওদের মুখস্থ। কিন্তু তোরটা না। জায়গামতো মালগুলো আমার হাতে তুলে দিবি।’

ওপাশ থেকে আবারও কিছু বলল। তার উত্তরে রুদ্র বলল, ‘ওদের পাহারায় পুলিশ রেখে গেছে তুহিন আহমেদ। কিচ্ছু হবেনা।’

সন্দিহান কন্ঠে আরও এক প্রশ্ন ছুটে এলো ওপাশ থেকে। উত্তরে রুদ্র বলল, ‘ সেরকম লোক রাখেনি তুহিন আহমেদ। এইটুকু বিশ্বাস আছে ওনার ওপর আমার।’ একটু থামল রুদ্র। ‘আর তাছাড়াও। নির্বাচনের আগে এমন কোন রিস্ক মীর্জা নেবেনা। আমি জানি সেটা। এই ভোটটাই ওর জীবনের একমাত্র সম্বল।’

কথাটা শেষ করেই কল কেটে দিল রুদ্র। লম্বা শ্বাস ফেলে মোবাইলটা চেইক করল আরো একবার। শওকতের কোন মেসেজ আসেনি এখনো। তবে আসবে। শীঘ্রই আসবে। সব যুক্তি, তর্ক, ঠিক, বেঠিক বেমালুম ভুলে আসবে। প্রতিশোধ, আক্রোশ, ভয়, অনিশ্চয়তা, অসুরক্ষার যে গোলকধাঁধায় রুদ্র তাকে ফেলেছে; সব গুলিয়ে একাকার হয়ে যাবে তার। আসতে তাকে হবেই। কথাগুলো চিন্তা করতেই ভয়ংকর মৃদু হাসি ফুটে উঠল রুদ্র আমেরের সরু পুরুষালি ঠোঁটে।

*

হুসাইন আলীর ডেরার কাছেই অপেক্ষা করছে ফারিয়া আর নাঈম। দুজনের কানেই এয়ার বাট। দীর্ঘক্ষণ হল কান পেতে আছে। কিন্তু বিশেষ কিছুই শুনতে পায়নি এখনো। এদিকে সময় ফুরিয়ে আসছে। ঘড়িতে আটটা বাজে। সময় মাত্র সাতঘন্টা। যেকাজ এতোগুলোদিনে হয়নি, সেকাজ আগামী সাত আগামী সাত ঘণ্টায় কীকরে সম্ভব হবে সেই চিন্তাতে মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম ফারিয়ার। চোখের সামনে বারবার তুহিনের সেই বিচলিত চেহারাটা। বুকের মাঝে হুঁ হুঁ করে উঠছে ওর। শুধু সিনিয়র হিসেবে সম্মান করে তাইতো না। লোকটার প্রতি তীব্র এক আকর্ষণ, দুর্বলতা, ভালোবাসা আছে ওর। একতরফা হলেও তা সত্য। যে আদর্শের প্রেমে এতো গভীরভাবে পড়েছিল, সেই আদর্শের ওপর এমন ভয়ানক প্রশ্ন চিহ্ন মেনে নেওয়া যায়!
নাঈমের মধ্যেও উদ্বিগ্নতা। তুহিনের সঙ্গে আহামরি বন্ডিং না থাকলে শ্রদ্ধাবোধ আছে প্রচুর। এই লোকটাকে আদর্শ মেনে চলতো ও। তুহিনযে যে কোন অনৈতিক কাজ করবে না সেবিষয়ে বিশ্বাস আছে তার।

এরমধ্যেই ওখানে এসে উপস্থিত হল তমাল। তমালকে দেখে ফ্রন্ট সিট থেকে নেমে এলো ফারিয়া। দ্রুতগতিতে তমাল গিয়ে বসল সেখানে। ফারিয়া বসল ব্যাকসিটে। কানেক্ট করা এয়ারবাটঠা কানে গুজতে তমাল বলল, ‘ কোন খবর?’

‘ না। সন্দেহজনক কোন কথোপকথন এখনো কারো সঙ্গে হয়নি হুসাইন আলীর।’ বলল নাঈম।

কপালের ভাজটা গভীর হল তমালের। এয়ারবাটটা চেপে ধরে শোনায় মনোযোগ দিল। অফিস থেকে সরাসরি এখানেই চলে এসেছে। এরকম অবস্থায় অযথা এক সেকেন্ডও বসে থাকার জন্যে মন শায় দিলোনা ওর। সময় খুবই কম।

আধঘণ্টা নিঃশব্দে অপেক্ষা করল ওরা। কিন্তু বিশেষ কিছুই শুনতে পেলোনা। যা আওয়াজ এলো সবই স্বাভাবিক আলাপ। নিত্য বেচাকেনার ব্যপার। হতাশা ঘিরে ধরল তিনজনকেই। নাঈম বিরক্ত হয়ে বলল, ‘রুদ্র অস্ত্র নিতে আসবেনা নাকি?’

ফারিয়া বলল, ‘এমনোতো হতে পারে যে ওর প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও আগেই নিয়ে নিয়েছে?’

তমাল অস্থির হয়ে বলল, ‘ হতেই পারে। কিন্তু সময় একদমই নেই আমাদের হাতে। এভাবে হাতপা গুটিয়ে বসে থাকব?’

ফোনটা বেজে উঠল তমালের। তুহিনের ফোন। সঙ্গেসঙ্গে রিসিভ করল তমাল, ‘ হ্যালো স্যার!’

‘কোন খবর?’

তুহিনের কন্ঠস্বর শুনে হতাশ হল তমাল। সন্তোষজনক কোন খবর দিতে পারবেনা বলে মন খারাপ হল। বিষণ্ন গলায় জানাল, ‘ এখনো না স্যার। তেমন কাউকে ঢুকতেও দেখিনি।’

ফোঁস করে শ্বাস ফেলল তুহিন। বলল, ‘ ব্যাপার না। খেয়াল রাখো। তবে একটা বিষয় মাথায় রেখো তমাল, রুদ্র নিজেই যে আসবে তেমন কোন কথা না। অন্যকেউ হতে পারে। কেউ একজন যে আছে রুদ্রর সঙ্গে সেটা নিশ্চিত। তাই যেকোন কিছুর জন্যে রেডি থাকবে। ফোকাস!’

‘ ওকে স্যার।’

‘ আর হ্যাঁ, ফারিয়াকে পাঠিয়ে দাও এখানে। আই নীড হার।’

‘ জি।’

কল কেটে দিয়েছে তুহিন। ফোন নামিয়ে ফারিয়াকে চলে যেতে বলল তমার। এরপর আবার মনোযোগী হল। আত্মবিশ্বাস এখন অনেকটাই বেড়েছে ওর।

*

পৌষের শীতেও কপাল বেয়ে ঘাম নামছে শওকত মীর্জার। পরিকল্পনায় ভাটা পড়েছে। চব্বিশটা ঘণ্টা পাড় করতে চাইছিল সে। বিনা দ্বিধায় পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্যে তুহিনকে কেইসটা থেকে সরাতে হতো। কিন্তু পরিকল্পনা ঘেঁটে দিল রুদ্র আমের।
হ্যাঁ রুদ্র! শওকত ভেবেছিল সে যেমন কাঁটামুক্ত পথে রুদ্রর সম্মুখীন হতে চায়; রুদ্রর চাওয়াটাও তাই। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণিত করে সে মুহূর্তে রুদ্র বলে ওঠে, ‘ চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করার সময় আমার হাতে নেই মীর্জা।’

‘ কিন্তু অপেক্ষাতো করতে হবে রুদ্র। কারণ চব্বিশ ঘণ্টা পূর্ণ হওয়ার আগে তোমার সম্মুখীন হচ্ছিনা আমি।’

‘ ভয় পাচ্ছো আমার সামনে দাঁড়াতে?’

রুদ্রর কন্ঠে স্পষ্ট বিদ্রুপ টের পায় শওকত। রাগে দাঁতে দাঁত আটকে আসে তার। ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলে, ‘প্রথমে তোমার হাত দুটো শরীর থেকে আলাদা করব। যে হাত দিয়ে আমার ছেলেকে আমার চোখের সামনে খু-ন করেছো তুমি। এরপর তোমার কলিজাটা বের করে তোমার চোখের সামনেই আমার পোষা কুকুরটাকে খাওয়াবো। তোমাকে পিস পিস করে কু-পি-য়ে না মারা অবধি স্বস্তি নেই আমার। আমার সর্বস্ব শেষ করে দিয়েছো তুমি। আমার ছেলে, আমার ভাই, আমার আন্ডারওয়ার্ল্ড, সব। বাকি আছে এই রাজনৈতিক ক্যারিয়ারটাই। এটা নিয়ে বিন্দুমাত্র রিস্ক নেবনা আমি। তুহিন আহমেদের সফলতা আমার শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নেবে। সেটা হতে দেবনা আমি।’

‘ আপনার কেন মনে হচ্ছে তুহিন আহমেদকে ধরা দেওয়ার জন্যে আমি ব্যাকুল হয়ে আছি?’

‘মানে?’ আপনাআপনি কপালে ভ্রুকুটি তৈরী হয় শওকতের।

‘ মাইক্রোফোনটা নিশ্চয়ই আপনার ওপর দয়াশীল হয়ে খুঁজে দেইনি আমি। আপনাকে ট্রেস করার কোন উপায় নেই এখন তার কাছে।’

ব্যপারটা চিন্তা করে শওকত। সত্যিই তাই। যদি সাধারণ ফোনটা রেখে যায়, ওকে ট্রেস করার কোন উপায়ই থাকবেনা তুহিন আহমেদের কাছে। তবুও বলে, ‘বললামতো! কোনরকম রিস্ক নেবনা আমি।’

‘ রিস্কতো নিতে হবে মীর্জা।’

রুদ্রর হেয়ালিতে কপালের ভাজ বৃদ্ধি পায় শওকতের। কোন প্রশ্ন করার আগেই ব্যপারটা পরিষ্কার করে রুদ্র বলে, ‘পেনড্রাইভটা কিন্তু আমার কাছেই আছে।

‘ কীকরে বিশ্বাস করি? ওটা তোমার কাছেই আছে তার প্রমাণ কী?’

হেসে ফেলে রুদ্র, ‘ বিশ্বাস! প্রথমত, বেঈমানী তোমার রক্তে আছে মীর্জা; আমার নয়। দ্বিতীয়ত, বিশ্বাস করা ছাড়া তোমার কাছে অন্যকোন অপশন নেই। খুঁজেছিলোতো সবজায়গায়। আমের ভিলাতেও। পেয়েছো কী?’

চারপাশটা কেমন উত্তপ্ত লাগে শওকতের। অস্থিরতায় হাঁসফাঁস করে। শব্দহীন হয়ে কেমন শা শা করে ওঠে চারপাশ। সত্যিই সবজায়গায় চিরুনী তল্লাশি চালিয়েছে সে। তুহিন আহমেদের কাছে ধরা পড়ায় তার এক লোক প্রাণও দিয়েছে সায়ানাইড গিলে। সেটাও আমের ভিলায়। কিন্তু ওটা রুদ্রর কাছে কীকরে থাকে? কীকরে সম্ভব সেটা। ওটাতো_

‘ প্রয়োজনে সেটা পুলিশের কাছে পাঠাতে আমি দু’বার ভাবব না।’

রুদ্রর কথায় ধ্যান ভাঙে শওকতের। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘তাই? আমাকে নিজের হাতে ওপরে পাঠানোর যে প্রতিজ্ঞা? তার কী হবে?’

‘ সময়টা অদ্ভুত জায়গাতে এসে দাঁড়িয়েছে মীর্জা। আমার প্রতিজ্ঞার চেয়েও তোমার শেষটা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়াও, পেনড্রাইভটা পাওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই তোমাকে জেলে ঢোকাবেনা কেউ। কয়েকদিন ঘাটাঘাটি চলবে। তারমাঝে তুমি যদি গর্ত ছেড়ে নাও বের হও, কাস্টাডিতে যাওয়ার সময় বের হওয়া ছাড়া তোমার হাতে অন্যকোন উপায় থাকবেনা। স্নাইপার হিসেবে আমার দক্ষতা নিয়ে নিশ্চয়ই সন্দেহ নেই তোমার।’

রুদ্রর ইঙ্গিত বুঝতে বিন্দুমাত্র দেরী হয়নি ধূর্ত শওকত মীর্জার। হঠাৎই প্রবল দোটানায় ফেঁসে গেল যেন। উত্তপ্ততা বৃদ্ধি পায়। শা শা সেই শব্দ যেন আর গুমোট, আরও ভয়ানক হয়ে ওঠে। স্ট্রেচারটা শক্ত করে ধরে; আটকে যাওয়া সাপের মতো মুচড়ে ওঠে তার শরীরটা। শওকতের দ্বিধা বোধ হয় টের পায় রুদ্র। তাই ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলে, ‘ জায়গার নামটা আমি মেসেজ করে দিচ্ছি মীর্জা। সময়টা তুমি ঠিক করো। তবে হ্যাঁ, রাত ঠিক দশটার মধ্যে যদি তুমি সময় জানাতে না পারো; তবে আমি জানাবো। পুলিশকে। এই পেনড্রাইভে থাকা তথ্য।’

শওকতের উত্তরের অপেক্ষা করে নি রুদ্র। কল কেটে দিয়েছে। তার ঠিক পাঁচ মিনিট পড়েই মেসেজ এসেছে তার নাম্বারে। ঠিকানা দিয়েছিল রুদ্র। সময়টা তাকে জানাতে হবে। তখন থেকেই অসহ্যকর এই ছটফটানীতে অস্থির হয়ে উঠেছে সে। সবদিক দিয়ে ভেবে দেখেছে সে। রুদ্র আনপ্রেডিক্টেবল। একটা সময় ছিল, যখন রুদ্রকে প্রেডিক্ট করতে পারতো শওকত। কিন্তু সেইদিনের পর সব হিসেব তালগোল পাকিয়ে গেছে তার, যেদিন রুদ্র নিজের হাতে_। অজান্তেই গা শিউরে উঠল শওকতের। রুদ্রর পক্ষে এখন সব সম্ভব। তাই ওর কথাকে উড়িয়ে দেওয়ার ভুলটা দ্বিতীয়বার করতে পারছেনা শওকত মীর্জা। তুহিনের ব্যপারটা ভাবালেও এটাও ঠিক যে এখন আর তাকে ট্রেস করার মতো কিছু নেই তুহিনের হাতে। সুতরাং রুদ্র অবধি পৌঁছতে পারবেনা সে, আর রুদ্রকে না পেলে নিজের পক্ষে কোন প্রমাণ পেশ করতে পারবেনা তুহিন। কারণ সবটা রুদ্রর হাতেই। অর্থাৎ কাল সকালে তুহিনকে কেসটা থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। অতঃপর তদন্ত করবে ডিপার্টমেন্ট। তুহিনের একাউন্ট হ্যাক করা হয়েছিল সেটা হয়তো প্রমাণিত হয়ে যাবে। যদিও না হওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে তারা। যদি প্রমাণিত হয়ও, সময় সুযোগ বুঝে ওটাকেও দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবে। তারপর পথ একদম পরিষ্কার। তার এমপি হওয়া, মন্ত্রীত্ব পাওয়া ঠ্যাকায় কে? কিন্তু তারজন্যে রুদ্রর ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা আজকেই।
কয়েকঘণ্টা নিরন্তর মন্থনের পর অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল সে। তুলে ধরল নিজের সেলফোনটা। সময় লিখে পাঠিয়েও দিল রুদ্র যে নাম্বার থেকে মেসেজ পাঠিয়েছিল, সেই নাম্বারে। তীব্র আক্রোশে দাঁতে দাঁত পিষল শওকত। নিজের কাঠের বাঁ পা’টায় হাত গেল। পলাশ মীর্জার আর্তনাদ কানে ভেসে এলো। শানের মৃতদেহ, সেই চিৎকার, সেই বিভৎস দৃশ্য সবটাই চোখে ভাসল। ঠোঁট কেঁপে কান্না পেল তার। বুকের মধ্যকার তীব্র বিষাদ আক্রোশ হয়ে ছিটকে এলো চেহারায়।
ছেলের মৃত্যুর শোকটা অবধি পালন করতে দিলোনা হা-রা-মজাদাটা ওকে। যা ভেবেছে তাই করবে শওকত। রুদ্রর শরীরের প্রতিটা অঙ্গ শরীর থেকে আলাদা করবে সে। মৃত্যু ভিক্ষা চাইতে বাধ্য করবে সে ঐ জানোয়ারটাকে। যেকোন মূল্যে। তারজন্যে রুদ্রর মুখোমুখি হবে সে আজ।
হঠাৎই ঠোঁটে ভয়ংকর হিংস্র এক হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। স্ট্রেচারে ভর দিয়ে এগিয়ে গেল স্টোররুমটার দিকে। বহুবছর পর আজ আবার নিজের সেই রূপে ফিরতে চলেছে সে। তারজন্যে চাই পুরোনো সেইসব জিনিসপত্র। যা স্টোররুমের কালো ব্যাগে রাখা আছে। একটা সময় ওগুলোইতো তার নেশা মেটানো। র*ক্তের নেশা। রক্ত নিয়ে তার এই খেলাটাকে লোকে সাইকোপ্যাথ বলে। যা হয়তো জেনেটেক্যালি ঢুকে গিয়েছিল তার একমাত্র কন্যার মধ্যেও।

*

রাগে, বিরক্তিতে কপালের শিরাটা অনবরত কেঁপে চলেছে তুহিন আহমেদের। কিছুক্ষণ আগেই নিজের এক কলিগকে কল করেছিল ও। ওর একাউন্ট থেকে টাকা ট্রান্সফারের ব্যপারটা নিয়ে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে সেটাই জানার ছিল। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, এখনো তেমন কোন ইনফরমেশনই দিতে পারেনি তারা। ব্যপারটা ধরতে সময় লাগেনা তুহিনের। সময় পাড় করছে। ইচ্ছাকৃতভাবে। তীব্র হতাশায় শাফায়াত হোসাইনকে কল করেছিল তুহিন। কিন্তু সে ওকে মনে করিয়ে দিয়েছে ওর হাতে অবশিষ্ট সময়টুকু। এটাও বলেছে এবিষয়ে এমুহূর্তে তার বিশেষ কিছুই করার নেই। লোকটাকে পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায়না। সিস্টেম আর রুলস নামক শেকল বেঁধে দেওয়া হয়েছে তার পায়ে। সত্যিই বেশি কিছু করতে পারবেননা তিনি এখন। যা করতে পারবেন তা সময়সাপেক্ষ ব্যপার। অতোটা সময় নেই তুহিনের হাতে। টেবিলে সজোরে এক ঘুষি বসাল ও। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরল। সবটা জেনেও কিছু করতে না পারার অনুভূতিটা অসহ্য। এখন একমাত্র ভরসা রুদ্র আমের। ধরা তাকে দিতেই হবে। সেটা আজই।

মেসেজের টোন বেজে উঠতেই ভ্রু কুঁচকে গেল তুহিনের। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল ইরার মেসেজ। সন্ধ্যায় যখন আচমকা তীব্র হতাশা আর ক্ষোভ ঘিরে ধরেছিল মনকে; তমালের কাছ থেকে নেওয়া সেই সিগারেটে শেষ টানটাও বিন্দুমাত্র শান্তি, স্বস্তি দিতে পারেনি মনকে; নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি তুহিন। ঘোরের মধ্যেই যেন ইরাকে একটা মেসেজ পাঠিয়ে বসেছিল। লিখেছিল,

‘ আজ তোমার অভাবটা ভীষণভাবে অনুভব করছি ইরাবতী। গত তিনবছরে অনেকবার, অনেকরকম বিপদে পড়েছি। সেই বিপদ থেকে বেরিয়েও এসেছি। কখনও নিজেকে এতোটা হতাশ, অসহায়, অপারগ লাগেনি। তোমার অনুপস্থিতি এতোটা গভীরভাবে অনুভব করিনি আমি। তুমি করতে দাওনি। জানি এখন এসব কথা অনর্থক। জীবনটাকে নতুনভাবে শুরু করতে চলেছো তুমি। তবুও, তোমার শূণ্যতার ভার নিতে পারছিলাম আজ। মনে হল তোমাকে কিছু বলতে পারলে বোধ হয় হালকা লাগবে। অথচ বলার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই আমার কাছে। শুধু বলব, ভীষণ মিস করছি। তোমার সেই ছোট্ট একটা মেসেজকে। যা আমার সব চিন্তা, স্ট্রেস দূর করে দিতো।’

তুহিনের লেখার হাত আহামরি না। তাই সেই অসম্পূর্ণ বার্তাটাই পাঠিয়ে দিয়েছিল ইর নাম্বারে। সেই মেসেজের উত্তরই বোধ হয় এসেছে এখন। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল ওর ধারণাই ঠিক। মেসেজটা ইরার। চোখজোড়া হঠাৎই জ্বলজ্বল করে উঠল তুহিনের। পূর্ণ উৎসাহে তাকালো মোবাইলের স্ক্রিনটাতে। যাতে লেখা আছে,

‘ এমন মুহূর্তেও তোমার আমার কথা মনে পড়েছে জেনে ভালো লাগলো। যাই হোক! হতাশা, পরাজয় শব্দগুলো তোমার জন্যে নয় তুহিন। তুমি অনন্য। সবার থেকে আলাদা। তুহিন আহমেদ তুমি। কোনকিছুই তোমার জন্যে অসম্ভব নয়। ইউ ক্যান ডু এনিথিং। আর সেটা আমি আজও বিশ্বাস করি। তুমি সবকিছু জয় করতে পারবে। পারবেই। আমাদের রাস্তা আলাদা হয়ে গেলেও আমার শুভকামনা সবসময় তোমার সঙ্গেই থাকবে। যা তুমি পারো তা আর কেউ পারেনা। কেউ না। বেস্ট অফ লাক।’

মেসেজটা শেষ হতেই দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলল তুহিন। আনমনেই বলে উঠল, ‘ভালোবাসি ইরাবতী!’

‘ স্যার?’

ফারিয়ার ডাকে ধ্যাত ভাঙল তুহিনের। চমকে তাকাল। ফারিয়াকে দেখে সোজা হয়ে বসল ও। বলল, ‘ এসেছো। ডু ওয়ান থিং। মীর্জার নাম্বারটা তোমাকে সেন্ড করে দিয়েছি আমি। লোকেশন ট্রাক করতে থাকো। ফাস্ট!’

‘ ওকে স্যার!’

সঙ্গে সঙ্গে নিজের সাইড ব্যাগটা টেবিলে রেখে চেয়ারে বসে পড়ল ফারিয়া। ল্যাপটপ বের করে শাট অন করল। শাট অন হওয়ার সময়টাতে আড়চোখে একবার তাকাল তুহিনের দিকে। চেয়ারে হেলান দিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে সে। হাতের কলমটা ঘোরাচ্ছে উদ্দেশ্যহীনভাবে। অন্যসময় অনুমতি ছাড়া কেবিনে প্রবেশের জন্যে হয়তো কড়া কিছু কথা শুনিয়ে দিতো তুহিন ওকে। কিন্তু আজ সেরকম অবস্থাতেই নেই লোকটা। বুকের মাঝে কেমন চিনচিন ব্যথা করে উঠল ফারিয়ার। প্রফেশন, লজ্জা, অধিকার, সম্পর্ক নামক কঠিন বাঁধাগুলো না থাকলে বোধ হয় শক্ত করে জড়িয়ে ধরতো লোকটাকে নিজের সঙ্গে।

*

রাত দশটা। সময় যত এগোচ্ছে পরিবেশটা ততই গুমোট আর স্তব্ধ হচ্ছে। এমনটাই মনে হচ্ছে তমালের। নিঃশব্দে কেবল শুনে যাচ্ছে। নাঈম নজর রাখছে ডেরার দিকে। সন্দেহজনক কাউকে ঢুকতে দেখে কিনা সেলক্ষ্যে। হঠাৎ অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। একদম চুপচাপ হয়ে গেল হুসাইন আলীর কক্ষ। টু শব্দও নেই যেন। ভ্রু কুঁচকে গেল তমালের। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল নাঈমের দিকে। দুজনের দৃষ্টি বিনিময় এই জানান দিল যে দুজনেই সন্দেহজনক কিছু টের পেয়েছে। নাঈম ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ মাত্রই একটা ছেলে ঢুকেছে। কিন্তু রুদ্র আমেরের সঙ্গে ওর শারীরিক মিল থাকা অসম্ভব। তাই তেমন গুরুত্ব দেইনি। এখনতো মনে হচ্ছে…’

‘ তুমি বোঝার চেষ্টা করো ভেতরে কী হচ্ছে। আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলে দেখছি।’

বলতে বলতেই তুহিনকে কল করল তমাল। ফোন বেজে উঠতেই নড়েচড়ে বসল তুহিন। তমালের কল দেখার সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করে বলল, ‘ হ্যাঁ তমাল বলো!’

এদিকের অবস্থাটা বর্ণণা করল তমাল তুহিনকে। শোনার সঙ্গে সঙ্গে তুহিন বলল, ‘ রুদ্র নিজে আসেনি তমাল। পাঠিয়েছে কাউকে। আমার সঙ্গে লাইনেই থাকো তুমি। ওখানে কী হচ্ছে ইনফর্ম করতে থাকো আমাকে।’

‘ওকে স্যার।’

নিজের ব্লুটুথটা কানেক্ট করে নিল তুহিন। কানে গুজতে গুজতে ফারিয়াকে বলল, ‘ শওকত মীর্জা বাড়ি থেকে বের হলেই জানাবে আমাকে। ওকে?’

‘ ওকে স্যার। কিন্তু… যদি সে ফোনটা ঘরেই রেখে যায়?’

গম্ভীর হয়ে উঠল তুহিনের চোখমুখ। রুদ্র নাম্বারের ব্যপারটা জানে কি-না নিশ্চিত নয় ও। শুধু বলল, ‘দ্যাট উইল বি আওয়ার ব্যাড লাক।’

কিছু সময় কেটে গেল নিস্তব্ধতার মধ্য দিয়েই। এরপরেই ডেরা থেকে বেরিয়ে এলো সেই যুবক। অন্ধকারে বোঝা না গেলেও গরন বেশ ছিপছিপে। হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ। সঙ্গে সঙ্গে তমাল বলল, ‘ বেরিয়েছে স্যার!’

‘ হাতে কিছু আছে?’

‘ হ্যাঁ স্যার। ছোট একটা ব্যাগ।’

‘ ঢোকার সময় ছিল সেটা।’

তুহিনের কন্ঠেও তখন উত্তেজনা। নাঈমের দিকে তাকাল তমাল। মাথা নেড়ে না বোঝাল নাঈম। তমাল বলল, ‘ না স্যার।’

টেবিলে চাপড় বসাল তুহিন। চোখ তুলে তাকাল ফারিয়াও। তুহিন বলল, ‘ওকে রুদ্রই পাঠিয়েছে। ফলো করো। দ্রুত।’

‘ বাট স্যার যদি আমাদের ধারণা ভুল হয় তো?’

‘ হবেনা। তাছাড়াও, এইটুকু রিস্ক এখন নিতেই হবে। যাও!’

‘ রাইট স্যার।’

একটা মোটরবাইক নিয়ে এসেছিল ছেলেটা। সেটাই বসেই নিজ গন্তব্যে এগোচ্ছে সে। কিছুটা সামনে চলে যাওয়ার পর গাড়ি স্টার্ট দিল নাইম। দূর থেকেই ফলো করতে হবে।

বেশ অসহ্য কিছুক্ষণ সময় পাড় হল এরপর। ঘরময় পায়চারী করল তুহিন। ফারিয়ার চোখ ল্যাপটপে আটকে আছে। মাঝেমাঝে একপলক করে দেখছে তুহিনকে। কেবিনটা থমথমে, স্তব্ধ। উত্তেজনায় চারপাশটা যেন কেঁপে উঠবে যেকোন মুহূর্তে।

ছেলেটাকে ফলো করতে করতে একটা বস্তির কাছে পৌঁছলো তমাল আর নাঈম। দেখল, একটা জিপের কাছে থেমেছে সেটা। গাড়ি থামাল ওরা। বেশ অনেকটা দূরে আছে দুজন। স্পষ্ট করে দেখা মুশকিল। তবে দেখল জিপের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে লম্বা, সুঠামদেহী এক যুবক। তার সঙ্গেই কথা বলছে ছেলেটা। তমাল সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘বাইকটা থেমেছে স্যার।’

‘ কোথায়?’

হঠাৎই খানিকটা উত্তেজিত হয়ে উঠল তমাল। বলল, ‘ একটা বস্তির পাশে। জিপের সামনে থামিয়েছে স্যার। ওখানে লম্বা, চওড়া করে কেউ একজন আছে। স্যার আমার মনে হচ্ছে ওটাই রুদ্র। আমি ওকে দেখেছি স্যার। মিলে যাচ্ছে!’

থমকে দাঁড়াল তুহিন। নাকের নিচের ঘামটা মুছতে মুছতে বলল, ‘কী করছে এখন ওরা?’

তমাল তাকিয়ে রইল সেদিকে। হুবহু বর্ণনা করল যা দেখছে, তাই। বলল, ‘ স্যার লোকটার হাতে ব্যাগটা দিয়ে বাইকটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে স্যার। আর ঐ লোকটাও জিপে উঠছে। কী করব স্যার?’ হঠাৎ আতকে উঠল তমাল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। দূর থেকেও এখন রুদ্রকে চিনতে ভুল হলোনা ওর। কোনমতে বলল, ‘ ওটা রুদ্রই স্যার। চিনতে পেরেছি আমি।’

‘ জীপটাকে ফলো করো। আর নিজের লোকেশন অন করো।’ কঠিন গলায় বলল তুহিন।

‘ কিন্তু স্যার বাইকটা_’

‘বাইকের পেছনে ছুটে কোন লাভ নেই। ডু হোয়াট আই সেইড।’

বলতে বলতে গাড়ির চাবিটা টেবিল থেকে তুলে নিল তুহিন। ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ ওঠো! যেতে হবে আমাদের। ল্যাপটপটা নিয়ে চলো। গাড়িতে বসে শওকতের নয়, তমালের লোকেশন জানাবে আমাকে। গেট ইট?’

ফারিয়া দ্রুত মাথা নাড়ল। সেটাই করল যেটা অর্ডার করেছে তুহিন আহমেদ। দ্রুতগতিতে ল্যাপটপটা বগলদাবা করেই ছুটলো তুহিনের পেছন পেছন।

অনেকক্ষণ হলো রুদ্রর জীপটাকে ফলো করছে তমাল আর নাঈম। ওদের লোকেশন ট্রাক করে যতটা সম্ভব শর্টকাটে এগিয়ে আসছে তুহিন আর ফারিয়া। বিরুলিয়ার একটা ফিলিং স্টেশনে জীপ পার্ক করতে দেখা গেল রুদ্রকে। বেশ অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে গাড়ি থামাল নাঈমও। আবার সেই আবছা দর্শন। সেই আবছা দর্শনেই দেখা গেল, রিফিল করতে দিয়ে জিপ থেকে নেমেছে রুদ্র। একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটছে এদিক ওদিক। তমাল তুহিনকে বলল, ‘ রিফিল করতে নেমেছে স্যার। গিয়ে ধরব?’

তুহিন সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিল, ‘একদম না! ও রুদ্র আমের। এভাবে ধরা যাবেনা ওকে। সতর্ক হয়ে গেল হিতে বিপরীত হবে। সময় নেই আমার হাতে তমাল। ফলো করে যাও।’

সামনে তাকিয়ে চারপাঁচ সেকেন্ড হঠাৎ রুদ্রকে দেখতে পেলোনা ওরা দুজন। চমকে উঠল তমাল। উত্তেজিত হয়ে কথাটা তুহিনকে জানাতেই যাচ্ছিল তখনই দেখল ফিরে এসেছে ও। জীপে উঠে বসেছে আবার। স্বস্তির শ্বাস ফেলল তমাল। জীপটা খানিকটা এগোতে ওরাও গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফলো করা শুরু করল।

আধঘন্টারও অনেকটা বেশি সময় পাড় হল। মীরপুরে এসে ঢুকেছে ওদের গাড়িটা। এরমধ্যে কোথাও থামার নাম নিলোনা রুদ্রর জীপ। ওদিকে কাছাকাছি চলে এসেছে তুহিনের গাড়িও। শীতের প্রহার তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। শুনশান হয়ে উঠছে রাস্তাঘাত। কুয়াশা বাড়ছে। এভাবে বেশিক্ষণ ফলো করা যাবেনা। ব্যপারটা কেমন অদ্ভুত লাগছে তমাল, নাঈমের কাছে। যাচ্ছেটা কোথায় রুদ্র! খচখচ করছে তুহিনের মনেও। কিছু একটা গন্ডগোল হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে ওর। গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল তুহিন। রাস্তা পুরোপুরি ফাঁকা হলে রুদ্র এমনিতেও বুঝে ফেলবে কেউ ফলো করছে ওকে। কিংবা বুঝে ফেলেছে!

তমালের লোকেশনের খুব কাছে পৌঁছে গেছে তুহিনের গাড়ি। ল্যাপটপে চোখ রেখেই ফারিয়ার বলল, ‘উই আর ক্লোজ স্যার!’

ব্লুটুথটা চেপে ধরে তুহিন, ‘জীপটা তোমাদের ঠিক কতটা দূরে তমাল?’

‘ অনেকটাই স্যার। কিন্তু সোজা রাস্তা দিয়েই যাচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি কোন টার্ন নেই সামনে।’

গাড়ির স্পিড আরও বাড়ালো তুহিন। ফারিয়ার কোলে থাকা ল্যাপটপটার দিকে তাকাল একবার। অতঃপর অপেক্ষাকৃত সরু এক গোলিতে ঢুকিয়ে ফেলল গাড়িটা। তমালকে নির্দেশ দিল, ‘তোমাদের গাড়ির স্পিডও বাড়িয়ে দাও। কোন লুকোচুরির দরকার নেই আর।’

ফারিয়া বুঝতে পারল কী করতে চাইছে তুহিন। তাই অবাক হলোনা। বরং আরও মনোযোগী হয়ে ওকে লোকেশনের ইনসট্রাকশন দিতে শুরু করল।

ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় চলন্ত জীপটার ঠিক মুখোমুখি এসে নিজের গাড়িটা দাঁড় করালো তুহিন। সামনে থেকে রোড ব্লক করায় থামতে হল জীপটাকে। হোলস্টার থেকে নিজের পি-স্ত-লটা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে নেমে এলো তুহিন। ফারিয়াও একই কাজ করল। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে পি-স্ত-ল তাক করল জীপটার দিকে।
অপরদিকে জীপটার পেছনে এসে থামল তমালদের গাড়িটা। একপ্রকার ঝড়ের গতিতেই গাড়ি থেকে নামল দুজন। একই ভঙ্গিতে গান পয়েন্টে রাখল রুদ্রর জীপটাকে। পালিয়ে যাওয়ার কোন রাস্তা অবশিষ্ট নেই আর।

তুহিন শক্ত দৃঢ় কন্ঠে বলল, ‘ অনেক হয়েছে। এবার বেরিয়ে এসো রুদ্র আমের। পালানোর আর কোন রাস্তা নেই তোমাদের হাতে।’

জীপের দরজা খুলছে টের পেয়েই আরও সতর্ক হল ওরা চারজন। প্রস্তুত করল নিজেকে। কিন্তু ওদের অবাক করে দিয়ে জীপ থেকে নেমে এলো অন্য এক যুবক। শারীরিক গঠন অনেকাংশে রুদ্রর সঙ্গে মিলে গেলেও এটা রুদ্র নয়।
হতভম্ব দৃষ্টিতে যুবকটির দিকে তাকিয়ে রইল তুহিন। ফারিয়া, তমাল, নাঈমের অবস্থাও ভিন্ন নয়। সবচেয়ে বেশি অবাঈ হল তমাল। কারণ ও নিজে দেখেছিল রুদ্রকে। বোকা দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর নিজেকে সামলে ফেলল তুহিন। কোনমতে বলল, ‘ আপনি?’

লোকটার চোখেমুখেও বিষ্ময়, ভয়। সেও অবাক কন্ঠে কোনরকমে বলল, ‘কারা আপনারা? পথ আটকেছেন কেন আমার?’

তুহিন চোখ দিয়ে ইশারা করতেই জীপটা আপাদমস্তক চেইক করে ফেলল ফারিয়া আর নাঈম। কিন্তু কিছুই পেলোনা।

‘ এই জীপটা আপনার?’ সময় নষ্ট না করে সোজা প্রশ্ন করল তুহিন।

দ্বিধায় জর্জরিত যুবকটি বলল, ‘ হ্যাঁ আমারইতো।’

সঙ্গেসঙ্গে প্রতিবাদ জানিয়ে এগিয়ে এলো তমাল। বিচলিত গলায় বলল, ‘এ মিথ্যে কথা বলছে স্যার। আমি নিজে দেখেছিলাম রুদ্রকে এই জীপে। ধরে কয়েকটা_’

তমালকে ইশারায় থামিয়ে দিল তুহিন। লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কাউকে দিয়েছিলেন জীপটা?’

‘ হ্যাঁ। একদিনের জন্যে দিয়েছিলামতো। বিরুলিয়ার ঐসাইডে যে ফিলিং স্টেশানটা আছে। ওটার মালিক নিয়েছিল আমার কাছ থেকে। বলেছিল এগারোটার পর এসে নিয়ে যেতে।’

হাত দিয়ে নাকের নিচের ঘামটা মুছলো তুহিন। শান্ত করার চেষ্টা করল নিজেকে। তমালের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্পষ্টভাবে রুদ্রকে কখন দেখেছিলে তুমি?’

তমাল তখনও হতভম্ব। একপ্রকার ঘোরের মধ্যেই বলল, ‘বাইকারের থেকে ব্যাগটা নিয়ে জীপে উঠছিল তখন।’

‘ এরপর? ফিলিং স্টেশনে জীপ থেকে নেমেছিল ও?’

‘ নেমেছিল স্যার। আর হ্যাঁ, চারপাঁচ সেকেন্ডের জন্যে চোখের আড়ালও হয়েছিল আমাদের। তারপর ফিরেও এসেছিল। যদিও দূর থেকে কেবল অবয়বই দেখতে পাচ্ছিলাম আমরা।’

প্রচন্ড জেদে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল তুহিন। তারমানে এই জীপটা রুদ্রর ছিলোইনা। ও বুঝেছিল ওকে ফলো করা হতে পারে। সেকারণেই এই চালাকি! সজোরে লাথি মারল নিজের গাড়িটায়। চমকে উঠল বাকিরা। তুহিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘ আরও একবার বোকা বানিয়েছে ও আমাদের। রুদ্র আমের!’

জীপে থাকা অচেনা যুবকটিকে ছেড়ে দেওয়া হল। হঠাৎ কিছু মাথায় আসতেই চমকে উঠল তুহিন। ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ গাড়িতে ওঠো ফারিয়া! শওকত মীর্জার লোকেশন ট্রাক করতে হবে।’
তমাল আর নাঈমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমরা ফলো করো আমাদের।’

দ্রুতগতিতে নিজেদের গাড়িতে উঠে বসল ওরা। সেই নাম্বারটা ব্যবহার করে শওকত মীর্জার বর্তমান অবস্থান দেখল ফারিয়া। তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ স্যার, শওকত সাহেব বাড়িতে নেই! এইমুহূর্তে আশুলিয়া আর কাশিমপুরের মাঝামাঝি কোথাও একটা দেখাচ্ছে ওনার লোকেশন।’

আফসোসের ভঙ্গিতে চোখ বন্ধ করে ফেলল তুহিন। আনমনেই বিড়বিড় করে উঠল, ‘শীট!’

*

শহুরে অঞ্চল ছাড়াও মাঝেমাঝে নির্জনে বাস করার একটা ঝোঁক ছিল রাশেদ আমেরের। তাই শহরের বাইরে এই নিরিবিলি পরিবেশে একটা বাড়ি বানানোর পরিকল্পনা করেছিল। তবে বাড়িটা অর্ধেকও তৈরী হওয়া অবস্থাতেই মারা গিয়েছিলেন তার স্ত্রী। তারপর থেকে এভাবে অর্ধনির্মিত অবস্থাতেই পরে আছে। রাশেদও আর কখনও পা রাখেনি এই জমিতে। স্ত্রীকে মারাত্মক ভালোবাসতেন কি-না। ব্যপারটা জানা আছে শওকতের। রুদ্র যখন তাকে ঠিকানা জানিয়েছে তখনই বুঝেছিল সে।
জায়গামতো পৌঁছে চারপাশে চোখ বুলালো শওকত মীর্জা। অনেকাংশে ভুতুড়ে বাড়িই বলা যায় এটাকে। ষাট শতাংশের মতোই কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অর্ধসম্পূর্ণ বাড়িটা চোখে বুলিয়ে দেখে নিল মীর্জা। ঠোঁটে এক ভয়ানক হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘তোমার কেনা জমিতেই তোমার ছেলের সমাধি হবে রাশেদ আমের।’

নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে বেশ অনেকটা দেরীতে গন্তব্যে এসে পৌঁছেছে রুদ্র আমের। ফিলিং স্টেশনের পেছনের গেইট দিয়ে বেরিয়ে ওর নিজস্ব জীপ অবধি পৌঁছতে হয়েছে ওকে। এরপর সেটা নিয়ে বেরিয়ে তবেই ছুটতে হয়েছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। এসবের মধ্যেই আধঘন্টা নষ্ট করে ফেলেছে ও। যেটা উচিত হয়নি বলে মনে হচ্ছে ওর। বাড়িটার দিকে তাকাতেই অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠল রুদ্রর বুক। বাবা-মা দুজনের কথাই মনে পড়ল। রাশেদ আমের! ঐ মানুষটাকে যেন আরও গভীরভাবে অনুভব করল ও। মনে পড় তার সেই নিথর মৃত শরীর। সেইসঙ্গে বাড়ল ভেতরকার আক্রোশ। নিজের গায়ে হাত বুলিয়ে একবার দেখে নিল রুদ্র। সব ঠিক আছে। লম্বা শ্বাস টেনে এবার ভেতরে প্রবেশ করল ও।

শুনশান অর্ধনির্মিত বাড়ির ভেতর দিয়ে হাঁটছে রুদ্র। চাঁদের আলো পরিপূর্ণভাবে পড়েছে ঘরটাতে। যা লম্বাটে এক ছায়া সৃষ্টি করেছে ওর।হজুতোর ঠকঠক আওয়াজের প্রতিধ্বনি ভেসে আসছে চারপাশে দেয়াল থেকে। মধ্যম গতিতে এগোচ্ছে রুদ্র। কোন তাড়া, উত্তেজনা কোনকিছুর লক্ষণ নেই তার মধ্যে।

নিস্তব্ধ সেই পরিবেশে হঠাৎই চারপাশ কাঁপিয়ে একটা আওয়াজ হল। তীব্র গতিতে একটা বুলেট এসে আঘাত করল রুদ্রর পেটে। ছিটকে পড়ল রুদ্র। পেট চেপে ধরে মৃদু গুঙ্গিয়ে উঠল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ব্যথাটা সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু হলোনা বোধ হয়। ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ল ওর শরীর। পিটপিটে চোখে তাকিয়ে কোনমতে শ্বাস নিয়ে গেল কেবল।

সেমুহূর্তেই আড়াল থেকে ক্রাচে ভর দিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো শওকত মীর্জা। চাঁদের সেই আলোয় বিকট এক ছায়া পড়েছে তার। ধীরে ধীরে সেই ছায়া আরও বিকট হচ্ছে। কমছে রুদ্রর সঙ্গে তার দূরত্বও। এগিয়ে রুদ্রর ঠিক পাশে এসে বসল শওকত মীর্জা। পিটপিটে চোখে তাকিয়ে দেখল রুদ্র। অদ্ভুত এক হিংস্রতা খেলা করছে আজ শওকতের চোখেমুখে। হাতে একটা ইনজেকশন সিরিঞ্জ। শরীরটা নাড়িয়ে পরপর দুবার ওঠার চেষ্টা করল রুদ্র। কিন্তু ব্যর্থ হল। ঠিকভাবে নড়তে অবধি পাল না। শওকত তখনও সেভাবেই তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে। কিন্তু এবার ঠোঁটে আছে পৈশাচিক এক হাসি। সে হাসি ধরে রেখেই শওকত বলল, ‘ কী ভেবেছিলি তুই। এই জগতে এতোদিন শুধু কপালের জোরে টিকে আছি? শু*য়ের বাচ্চা আমি একাই তোকে পরকালে পাঠানোর জন্যে যথেষ্ট। এখনতো শুধু উঠতে পারছিস না। এই ইনজেকশনটা পুশ করার পর নড়তেও পারবিনা।’

রুদ্র তখনও তাকিয়ে আছে শওকতের দিকে। বুজে আসছে চোখজোড়া। হিংস্রতায় খিচ মেরে গেল শওকতের চোখমুখ, ‘বলেছিলাম না তোকে জ্যা*ন্ত অবস্থায় পিসপিস করে পি*সপি*স করে কাটব? নিজের চোখে দেখবি সেটা তুই।’

কথাটা শেষ করার সঙ্গেই ইনজেকশন সিরিঞ্জটা রুদ্র ঘাড়ের বরাবর সজোরে নামিয়ে আনল শওকত। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে হাতটা খপ করে ফেলল রুদ্র আমের। বিস্ফোরিত চোখে অবিশ্বাস নিয়ে নিজের হাতের দিকে তাকাল শওকত। চাঁদের আলোয় কিছুটা দেখা যাচ্ছে রুদ্রর চেহারা। রুদ্র ঠোঁটে ফোঁটা বাঁকা হাসিটা স্পষ্ট দেখতে পেল শওকত। তাকে আরও চমকে দিয়ে রুদ্র বলল, ‘ প্লানটা যথেষ্ট ভালো ছিলো মীর্জা। কিন্তু যার ওপর এক্সিকিউট করছো সে তোমার রক্তে মিশে থাকা বেঈমানিকে খুব ভালোভাবে জানে। তোমার স্বভাব এতোভালোভাবে জানার পরেও আমি এমনিই চলে আসব? ভাবলে কীকরে?’

শেষ দুটো শব্দ বলতে বলতে শওকতের হাতটা মুচড়ে দিয়েছে রুদ্র। ব্যথায় চেচিয়ে উঠল সে। দাঁতে দাঁত চেপে রুদ্র বলল, ‘দ্বিতীয় ভুলটা কী ছিল জানো? অন্ধকারে এটা খেয়ার করোনি যে আমার র-ক্ত বের হয়নি।’

প্রচন্ড ব্যথায় নীল চেহারা নিয়েই শওকত বলল, ‘তারমানে তুমি_’

‘ নাটক করছিলাম। বুলেট প্রুফ পড়ে আছি। অভিনয়টা খুব দারুণভাবে শিখে গেছি। তাইনা মীর্জা?’

এসব কথার মধ্যেই নিজের মুক্ত হাতটা দিয়ে নিজের পি-স্ত-লটা বের করে রুদ্রকে গু-লি করতে যাচ্ছিল শওকত। কিন্তু সে হাতটাও চেপে ধরে দিশা বদলে ফেলল রুদ্র। বুলেট লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। ব্যঙ্গাত্মক হাসি হেসে রুদ্র বলল, ‘আসলে কার কাছে শিখেছি দেখতে হবেতো!’

বলতে বলতে শওকতকে এক ঝটকায় উল্টো ঘুরিয়ে। দুটো হাতই সবেগে মুচড়ে ধরল রুদ্র। চারপাশ কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল শওকত। শওকতের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘যন্ত্রণা হচ্ছে? যেটা অন্যকারো সঙ্গে করার নির্দেশ দেওয়া যায়, সেটা নিজে সহ্য করতে ভয়ংকর কষ্ট হয় তাইনা মীর্জা।’

যন্ত্রণায় চোখে জল চলে এসছে শওকতের। মুখ দিয়ে লালা বেরিয়ে আসার উপক্রম। বুঝতে পারছে বড্ড বেশি কাঁচা খেলে ফেলেছে সে। নিজের ব্যক্তিগত আক্রোশ, রাগ আর ক্ষোভে অন্ধ হয়ে হটকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে এবার। যার মূল্য এবার তাকে প্রাণ দিয়ে চোকাতে হবে। তবুও নিজের ভালো পা’টা দিয়ে রুদ্রকে প্রতিরোধ করার ব্যর্থ এক প্রচেষ্টা করল শওকত। কিন্তু লাভ হলোনা। একহাতে শওকতের চুলের মুঠি ধরল রুদ্র। সজোরে ঠেসে দিল দেয়ালের সঙ্গে। চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলো শওকতের। তীব্র যন্ত্রণা মুখের ভেতরটাও ভীষণ তেঁতো হয়ে গেল। আরও দুবার একই কাজ করল রুদ্র। মাথা ফেঁ-টে গলগল করে র-ক্ত বেরিয়ে এলো। মুখ দিয়ে লা লা ছুটল। একঝকটায় শওকতকে চিৎ করে মাটিতে ফেলল রুদ্র। সর্বশক্তি দিয়ে তার গলায় পা নামাতেই যাচ্ছিল তখনই পেছন থেকে কেউ বলে উঠল, ‘ দাঁড়াও রুদ্র!’

থমকে গেল রুদ্র। অন্ধকার ঘরটা মৃদু আলোয় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এই মুহূর্তে তৃতীয় কারো উপস্থিতি আশা করেনি ও। ঝট করে পেছন ফিরল। দেখল ওর দিকে ব-ন্ধু-ক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে ইনভেস্টিগেটর তুহিন আহমেদ। দুজনেরই চোখাচোখি হল খুব অদ্ভুতভাবে। সেই সুযোগে নাঈম এসে দ্রুত শওকত মীর্জা অর্ধচেতন শরীরটাকে কভার দিয়ে দাঁড়াল। যাতে রুদ্র তাকে অ‍্যাটাক করতে না পারে। তাতেই ধাতস্থ হল রুদ্র। চোখে আগুন নিয়ে তাকাল নাঈমের দিকে। সেই দৃষ্টিতে যেন নাঈমের ভেতরটাও কেঁপে উঠল। কিন্তু তবুও তাক করে রাখল নিজের পি-স্ত-ল। তমাল আর ফারিয়াও রুদ্রর দুপাশে ছড়িয়ে গিয়ে ব*ন্দু*ক তাক করল। ওদের প্রত্যেকের মাথাতেই টর্চ ক্যাপ। যা ঘরটাকে আলোকিত করে ফেলেছে। রুদ্র নিজের হোলস্টারে হাত দিতে গেলেই তুহিন বলল, ‘ভুলটা করোনা রুদ্র। আজকে আমাদের চারজনের মধ্যে কারো একজনের প্রাণের বিনিময়ে হলেও তোমাকে অ‍্যারেস্ট করা হবে। তোমার ব-ন্দু-ক থেকে গু-লি চললে আমাদের ব-ন্দু-ক থেকেও চলবে। তোমাকে জীবিত চাই আমার, অক্ষত না। হাত উঁচু করো।’

তুহিনের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেই হাত উঁচু করল তুহিন। আস্তে আস্তে রুদ্র সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটা অস্ত্র বের করে নিল রুদ্রর হোলস্টার থেকে। পিঠের দিকে হাত দিয়ে গেলে তুহিনের পি-স্ত-ল ধরা হাতটা মুচড়ে ধরতে যাচ্ছিল রুদ্র। কিন্তু এক অবিশ্বাস্য কাজ করে বসল তুহিন। বিদ্যুৎ গতিতে গু*লি চালিয়ে দিল রুদ্রর বুকে। ছিটকে নিচে পড়ে গেল রুদ্র। সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এলো নাঈম আর তমাল। পেছন মোড়া করে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে দিল রুদ্রর হাতে। হাঁটুর ওপর ভর করিয়ে বসানো হলো ওকে। প্রথমত আগে থেকেই বাহুতে গু*লির আঘাত, তারওপর বুকে লাগা প্রচণ্ড ধাক্কায় কিছুক্ষণের জন্যে শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা হারিয়েছে রুদ্র। সেই সুযোগটাই নিয়েছে ওরা।

মুচকি হাসল তুহিন। হাঁটু ভেঙ্গে বসল রুদ্রর সামনে। বলল, ‘মানুষ যত ধূর্তই হোক কোন না কোন লূপ হোল ছেড়েই রাখে। তোমার জ্যাকেটের ওপরের ফুটোটাই বলে দিচ্ছে তোমার পেটে গু*লি করেছিলেন শওকত মীর্জা। কিন্তু তুমি একদম ঠিক আছো। তখনই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম বুলেট প্রুফ পড়ে আছো তুমি। তাই গু*লি করার সাহসটা করলাম। জানতাম মরবেনা, কিন্তু কিছুক্ষণের জন্যে হলেও চোখে শর্ষেফুল অবশ্যই দেখবে।’

চোখ তুলে তাকাল রুদ্র। কোনরকম প্রতিক্রিয়া নেই ওর মধ্যে। রুদ্রর চোখে চোখ রেখেই তুহিন বলল, ‘ খেলাটা এনজয় করছিলাম রুদ্র। কিন্তু দুর্ভাগ্য, খেলার স্থায়িত্ব এই অবধিই ছিল। ব্যাড লাক!’

*

সকাল দশটা। অনেকদিন পরে সকাল সকালই জ্বলজ্বলে রোদ ছড়িয়ে গেছে গোটা ঘরটাতে। সেই আলোয় চমৎকারভাবে আলোকিত হয়ে উঠেছে শাফায়াত হোসাইনের কেবিন। সন্তুষ্ট চিত্তে ফাইলটা বন্ধ করল শাফায়াত। চমৎকার এক হাসি দিয়ে তাকাল সামনে বসে থাকা তুহিন আহমেদের দিকে। বলল, ‘ মুখে যাই বলি। কোথাও গিয়ে মনে হচ্ছিলো একটা অসাধ্য সাধন করবে তুমি। সি, তুমি তা করে দেখিয়েছো।’

মুচকি হাসল তুহিন, ‘ থ্যাংকিউ স্যার। আই হ্যাভ ডান মাই ডিউটি।’

‘ আই নো। তোমার ব্যাংক একাউন্ট নিয়েও কাজ চলছে। ওটাযে হ্যাক করা হয়েছিল সেটাও প্রমাণ হবে। আর কারা তোমাকে মারতে বা ফাঁসাতে চাইছিশ সেটাও আশাকরি জানা যাবে। শীঘ্রই।’

‘ আমি জানি স্যার।’

‘ শওকত মীর্জার কী খবর?’

‘ হসপিটালাইজড আছে। গুরুত্বর কিছু না। বেঁচে যাবে এযাত্রায়।’

ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেললেন শাফায়াত। চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ‘ অনেকটা শান্তি লাগছে। তোমাকে হারাতে হবেনা জেনে। একটা রত্ন হারিয়ে ফেলতো ডিপার্টমেন্ট। যাই হোক, রুদ্র এখন আমাদের কাস্টাডিতে। পুলিশ কাস্টাডিতে পাঠানো হবে ওকে। এরপর শীঘ্রই ওকে ইন্ট্রোগেশন রুমে নেওয়া হবে। দরকারে থার্ড ডিগ্রী দিয়ে জবানবন্দি নেওয়া হবে ওর।’

গম্ভীর হয়ে উঠল তুহিনের চোখমুখ। শিরদাঁড়া সোজা করে বলল, ‘ একটা কথা বলার ছিল স্যার।’

‘ হ্যাঁ বলো।’

‘ রুদ্রকে আমি ইন্ট্রোগেট করতে চাই। আমাদের কাস্টাডিতে।’

অবাক হল শওকত মীর্জা। পুনরায় সোজা হয়ে বলল, ‘কেনো?’

লম্বা শ্বাস নিল তুহিন। বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে এটা আমারই করা উচিত। ইন্ট্রোগেশন রুমে ওকে হ্যান্ডেল করা সহজ হবেনা স্যার। তাছাড়াও আমরা সকলেই জানি ওর কাছে এমন কিছু একটা আছে যা ভয়ংকরভাবে বিপদে ফেলে দেবে অনেক প্রভাবশালী মানুষদের। ওরা চাইবে রুদ্রকে রাস্তা থেকে সরাতে। তাই এখনই ওকে আমাদের কাস্টাডি থেকে ছেড়ে দিয়ে পুলিশ কাস্টাডিতে দেওয়া ঠিক হবেনা।’

‘ কিন্তু _’

‘ প্লিজ স্যার। আমার ইন্ট্রোগেট করার ক্ষমতা নিয়ে নিশ্চয়ই সন্দেহ নেই আপনার। আপনি খুব ভালো করেই জানেন, যদি প্রয়োজন পড়ে যায়, থার্ড ডিগ্রিকে হার মানানো স্টেপ আমি নিতে পারি। ইউ ক্যান ট্রাস্ট মি।’

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে একটু ভাবলেন শাফায়াত। বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি ব্যবস্থা করছি।’

স্বস্তি পেল তুহিন। সকৃতজ্ঞ কন্ঠে বলল, ‘ থ্যাংকিউ স্যার।’

শাফায়াতের কেবিন থেকে বাইরে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সকলে শুভেচ্ছা জানালো তুহিনকে। চব্বিশ ঘন্টা আগেও যে চোখগুলোতে সহানুভূতি আর তিরস্কার ছিল সে চোখগুলোতে এখন প্রশংসা আর হিংসা। সবাইকে কোনমতে ধন্যবাদ দিয়ে কেবিনে ঢুকল তুহিন। উজ্জ্বল চোখমুখ নিয়ে এগিয়ে এলো তমাল। বলল, ‘ অবশেষে স্যার। বিষাক্ত এক অধ্যায়ের সমাপ্তি। এবার শান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারবেন আপনি।’

জবাব দিলোনা তুহিন। ধীরপায়ে হেঁটে জানালার কাছে গেল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল স্বচ্ছ নীল আকাশটার দিকে। অধ্যায়ের সমাপ্তি! নাকি বিষাক্ত এই উপন্যাসের বিভৎসতম অধ্যায়ে পদার্পনের পূর্ব সংকেত?

( তৃতীয় অধ্যায়ে সমাপ্য। )

[ বিঃদ্রঃ তৃতীয় অধ্যায়টা অনেক ছোট হবে। তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ওখানে কেবল প্রত্যেকটা চরিত্রের পরিণতি থাকবে। এবং ওটাই অন্তর্নিহিত কালকূটের সবচেয়ে বিভৎস অধ্যায় হবে।

আর তৃতীয় অধ্যায় ইনশা’আল্লাহ শীঘ্রই আসবে। দিনক্ষণ অবশ্যই আগে থেকে পেইজে ইনফর্ম করে দেব। হ্যাপি রিডিং। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here