অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৯৮.

0
50

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৯৮.

আমের ভিলার বসার ঘরটাতে সিঙ্গেল সোফায় বসে আছে কুহু। আনমনে তাকিয়ে আছে টিভির দিকে। টিভিতে কী হচ্ছে সেসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই ওর। যেন কোন অলিক চিন্তায় ডুবিয়ে রেখেছে নিজেকে। পাশের বড় সোফাটায় বসে চা খাচ্ছে প্রিয়তা আর জ্যোতি। কিছুক্ষণ আগেই নিচে নেমে এসেছে প্রিয়তা। এসেই চা বানালো নিজের হাতে। সময় কাটানোর জন্যে চা নিয়ে গল্প করতে বসেছে জ্যোতির সঙ্গে। মাঝেমাঝে ফোন স্ক্রোল করছে। আসলে ফোনে ওকে ইনফর্ম করা হচ্ছে ইকবালের অবস্থান। কথায় কথায় জ্যোতি বলল, ‘নার্গিস খালার খবরটা শুনেছো? মহিলা নাকি পাগল হয়ে গেছে! আবলতাবল বকে চলেছে শুধু। ঘরে থাকছেনা।’

চোখেমুখে অবাক ভাব ফুটিয়ে তুলল প্রিয়তা, ‘কী বলছো?’

‘ হ্যাঁ, দুপুরেই খবর পেলাম। আসছেনা কেন খবর নিতে লোক পাঠিয়েছিলাম তখন।’

‘ ইশ! কীভাবে হলো বলোতো?’

‘ কী জানি?’ কাঁধ ঝাকাল জ্যোতি।

ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে প্রিয়তা বলল, ‘ নীরব ভাইয়া এখনো এলোনা যে?’

কপালে ভাজ ফেলে চায়ের কাপে চুমুক দিল জ্যোতি। বলল, ‘ইন্টারভিউ আছেতো আজ। কখন শেষ হবে কে জানে?’

বলে একপলক কুহুর দিকে তাকাল জ্যোতি। দেখাদেখি প্রিয়তাও তাকাল। কেমন উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কোনকিছু নিয়ে কোন আগ্রহ নেই। অথচ ওই একসময় কত প্রাণচ্ছ্বল, হাসিখুশি ছিল। শব্দ না করেও মাতিয়ে রাখতো নিজের চারপাশটা। মেয়েটা কোনদিনও আবার আগের মতো হবে কি-না জানেনা ওরা। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো দুজনের ভেতরে থেকেই।

এরমধ্যেই বসার ঘরে প্রবেশ করল জয়। হাতে একটা শপিং ব্যাগ। এগিয়ে এসে প্রিয়তার দিকে বাড়িয়ে দিল সেটা। মাথা নিচু করে আছে। প্রিয়তা ব্যাগটা নিয়ে বলল, ‘থ্যাংক ইউ। তুমি এসো।’

মাথা নেড়ে চলে গেল জয়। জ্যোতি প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘ কী আনতে দিয়েছিলে?’

‘ প্যাড লাগতো আমার। হঠাৎই দেখি শেষ। উনিতো হুটহাট বের হতে দেবেননা আমাকে। তাই জয়কে দিয়েই আনালাম।’

‘ ওহ্।’

উঠে দাঁড়াল প্রিয়তা। বলল, ‘ যাই, আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি।’

মাথা নাড়ল জ্যোতি। প্রিয়তা দেরী না করে চলে গেল ওপরে। নিজের ঘরে।

*

চারপাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। হাঁড় কাঁপানো ঠান্ডা।সিএনজি ওয়ালাকে বারবার তাড়া দিচ্ছে ইকবাল। সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। মাথার একসাইড দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাচ্ছে বারবার। পাগলের মতো তাড়া করছে একটা গাড়ি। ভেতরে নিশ্চয়ই ডার্ক নাইট কিংবা ব্লাক হোলের লোকজন। কোনভাবেই এদের হাতে পড়া যাবেনা। কোনভাবেই না। রুদ্রকে জানাতে হবে সব সত্যিটা। যে বিষে গোটা সোলার সিস্টেম শেষ হয়ে যাচ্ছে, সে বিষধারণকারী সাপকে ও নিজেই সযত্নে পুষছে; সেটা জানা প্রয়োজন রুদ্রর। শুধু একারণেই নিজের প্রাণবায়ুটুকু ধরে রেখেছিল এতোগুলোদিন। প্রাণের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে বেরিয়ে এসেছে ঐ জাহান্নাম থেকে।

আজ দুপুরে খাবার দিতে আসেনা কেউ ইকবালকে। কোন এক ঝামেলায় আটকে যায় গোডাউনের সবাই। অন্যান্য দিনের তুলনায় লোক খুবই কম। তখনই মুক্তির এক উপায় মাথায় খেলে যায় ইকবালের। অনেকদিন যাবতই উপায়টা খেলছিল তার মাথায়। যেকোন কিছুর বিনিময়েই হোক বের হতেই হবে ওকে। সমস্ত মনোবল একত্রিত করে ইকবাল। দাঁত দিয়ে চেপে ধরে কে*টে ফেলে জিভের অনেকটা অংশ, ঠোঁটের ভেতরের অংশ। যতটা সম্ভব গভীর ক্ষত করার চেষ্টা করে। নার্ভের সঙ্গে একপ্রকার যুদ্ধ করে কান্ডটা ঘটায় সে। আশানুরূপ ফল পায়। র*ক্ত বের হতে থাকে। তবে সেই র*ক্তের একফোঁটাও মুখের বাইরে বেরিয়ে আসতে দেয়না ইকবাল। বরং জমিয়ে রাখে নিজের মুখে।
সন্ধ্যার আগ দিয়ে খাবার আসে ইকবালের। নিয়মমতো ব*ন্দু*কের মুখে রেখে একটা হাত খুলে দেওয়া হয় তার। বিন্দুমাত্র এদিকওদিক হলে সঙ্গেসঙ্গে গু*লি করা হবে। তখনই নিজের কৌশল প্রয়োগ করা শুরু করে ইকবাল। মুখের ভেতর জমিয়ে রাখা র*ক্ত গলগল করে ছেড়ে দেয়। হতবাক হয়ে যায় উপস্থিত দুজন। নিজের অসুস্থতা বহিঃপ্রকাশ আরও পরিষ্কারভাবে করতে কাশতে শুরু করে ইকবাল। কিছুক্ষণ কেঁশে চোখ বুঝে গা ছেড়ে দেয়। ভান করে অচেতন হওয়ার। এমনিতেই শারীরিক অবস্থা ভালো না ইকবালের। সেকথা জানা উপস্থিত দুজনের। ভয় পেয়ে যায় ওরা। কড়া নির্দেশ আছে, জীবিত রাখতে হবে একে। মুহূর্তেই সতর্কতার ব্যপারটা ভুলে ছুটে যায় ইকবালের কাছে। তাছাড়াও ঐ অবস্থায় ইকবাল কিছু করতে পারবে সেই কল্পনাও আসেনা ওদের মনে। একজন অস্থির হয়ে বলে, ‘হাত খুলে পেছনমোড়া করে বাঁধ। ফ্লোরে শোওয়াতে হবে। টপকে গেলে বিপদ। ডাক্তার ডাকতে হবে বোধহয়।’

মাথা ঝাকায় অপরজন। দ্রুত ইকবালের অপর হাতের বাঁধনটাও খোলে। যখনই ওকে ধরে ওঠাতে যাবে পি*স্ত*ল হাতে রাখা লোকটার হাত থেকে একঝটকায় পি*স্ত*ল ছিনিয়ে নিয়ে দূরে ধাক্কা মারে ইকবাল। পরে যায় সে। অপরজন নিজের পি*স্ত*ল বের করতেই যাচ্ছিল, তার আগেই পি*স্ত*লের বাঁট দিয়ে সজোরে আঘাত করে মাথায়। জ্ঞান হারিয়ে ওখানেই লুটিয়ে পড়ে বেচারা। পরে যাওয়া লোকটা ততক্ষণে সামলে উঠে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দেরী হয়ে গেছে। ওর মগজ বরাবর ব*ন্দু*ক তাক করে ফেলেছে ইকবাল। ব্যপারটা এতো দ্রুত ঘটল যে কিছু বুঝে উঠতে পারল না ও। ইকবাল কোনমতে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলল, ‘একটু আওয়াজ করলে সোজা ওপরে পাঠিয়ে দেব। হাত উঁচু করে এদিকে আয়!’

থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল লোকটা। নড়চড় করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে যেন। ধমকে উঠল ইকবাল, ‘এদিকে আয়।’

কথামতো এগুলো ছেলেটি। ইকবাল ওকে বসিয়ে রাখা সেই চেয়ারটা ইঙ্গিত করে বলল, ‘বস!’

বসতে নিলেই বাঁটের আঘাত করল ইকবাল। কিন্তু এবার অজ্ঞান হলোনা ও। তবে যেটুকু ঘায়েল হয়েছে যথেষ্ট। সামলে নেওয়ার আগে ঐ দড়ি দিয়েই বেঁধে ফেলল ইকবাল ওকে। মুখের মধ্যে গুঁজে দিল নোংরা একটা কাপড়।

এরপর এক মুহূর্ত ও নষ্ট করেনি ইকবাল। পি*স্ত*লটা শার্টের নিচে গুঁজে নেয়। এতোদিন থেকে সবকিছুই অবজার্ভ করেছে। সেদিন প্রিয়তা বলেছিল খাবার গরম করে আনতে। আর রাজু খুব অল্প সময়েই সেটা করেছিল। অর্থাৎ আশেপাশেই আছে গ্যাস সিলিন্ডার। ভাগ্যক্রমে বের হতে না হতেই দেখতে পায় কিচেনরুম। মানে গ্যাস সিলিন্ডারের সঙ্গে একচুলো একমুখওয়ালা একটা স্টোভ। ওদিকটায় কেউ নেই তখন। কিন্তু একটু দূরেই আছে। আরেকটু এগোলেই ওকে দেখে ফেলবে। জানে ইকবাল। তাই দৌড়ে সিলিন্ডারের কাছেই যায় ইকবাল। দ্রুত হাতে লিক করে দেয় সেটা। ওখান থেকে তুলে নেয় একটা গ্যাস লাইটার। দৌড়ে দূরে সরতে থাকে। তখনই পেছন থেকে সজোরে ওর মাথায় আঘাত করে কেউ একজন। চোখে অন্ধকার দেখে ইকবাল। পেছন ঘুরে দেখে দলেরই কেউ একজন হাতে কাঁধের খুঁটি জাতীয় কিছু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরেকটা আঘাত করতে আসলে অনেকটা মনের জোরেই সরে যায় ইকবাল। শার্টের আড়াল থেকে ব*ন্দু*কটা বের করে সোজা লোকটার মাথায় গুলি করে। আর সময় নষ্ট করলে চলবে না। গ্যাস অনেকটাই ছড়িয়েছে এখন। গ্যাস লাইটারটা জ্বালিয়ে ছুড়ে দেয় সিলিন্ডারের দিকে। দৌড়ে আরও বেশি সরে গিয়ে লুকিয়ে পরে কাঠের একটা কপাটের আড়ালে। বিকট এক শব্দ করে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। প্রথমে গু*লির আওয়াজ, পরে এটা। এদিকেই ছুটে আসে সব। ততক্ষণে ভয়ংকর আগুন লেগে গেছে। সকলের মধ্যে হৈচৈ। সেই সুযোগ নিয়েই ওখান থেকে বেরিয়ে আসে ইকবাল।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিভ্রান্তের মতো আশেপাশে তাকায় ও। মুখের ভেতরটা অবস অবস হয়ে আছে। জ্বালা করছে। গলগল করে র*ক্ত বের হচ্ছে মাথা দিয়ে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি সঞ্চারেই বেগ পেতে হচ্ছে ইকবালকে। কিন্তু মনের জোর খাটিয়ে এগিয়ে যায়। কোন গাড়ি খুঁজে পায়না। যা পায় তা যেতে চায়না ওর গন্তব্যে। ইকবাল অনুরোধ করে, আকুতি করে। কিন্তু এগিয়ে আসেনা কেউ। এমন গুরুত্বর আহত একটা মানুষকে কেউ নিতে চাচ্ছেনা গাড়িতে! সাহায্য পর্যন্ত করছেনা! বরং কয়েকজনকে দেখল ফোন বের করে ভিডিও করছে। অবাক হতে গিয়েও হয়না ইকবাল। এদেশের মানুষের এই রূপটা ওর জানা। “কাকে নিয়ে কে ফাঁসবে? আপনি বাঁচলে বাপের নাম”। বর্তমানে এই আদর্শ মেনেই বাঁচে দেশের অধিকাংশ মানুষ। তাইতো রাস্তায় মৃ*ত্যুসজ্জায় পড়ে থাকা কাউকে সাহায্য করতে সহজে কেউ এগিয়ে আসেনা, বিপদে পড়লে সহজে কেউ হাত বাড়ায়না। তবে স্মার্টফোনটা বের করে একটা ভিডিও অবশ্যই করে। ফেসবুক নামক আধুনিক এক সংগ্রামস্থলের উৎপত্তি হয়েছে না আজকাল! সেখানে পোস্ট করে সংগ্রাম করে। ক্যাপশনে থাকে, “মানুষ হয়েছি কিন্তু মানবিকতা শিখিনি” টাইপের কোন একটা লাইন। ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকে একটা দুর্দান্ত ইমোশনাল মিউজিক। ভিউজ আর শেয়ার কে আটকায়? মানুষের এই স্বভাবকে নিজেদের স্বার্থেও বহু কাজে লাগিয়েছে অতীতে। তাই ধারণা আছে ইকবালের।
অবশেষে প্রকৃত অর্থে এক মানুষ নিজের সিএনজিতে জায়গা দেয় ইকবালকে। পানি খেতে দেয়। শরীরে সামান্য জোর পেলেও অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে বুঝতে পারে ইকবাল। রুদ্র কোথায় জানেনা ও। তাই আমের ভিলাতেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। রুদ্রকে বলতে না পারুক, ঐ বাড়ির কাউকে একটা বলতে পারলেই হল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই খেয়াল করে ক্ষিপ্র হয়ে ওদের পিছু নিয়েছে একটা গাড়ি। সিএনজি ড্রাইভারকে বুঝতে দেয়না ও। ঘাবড়ে যাবে।
কোথাও থামলেই এখন বিপদ। কিন্তু থামা প্রয়োজন। যদি আমের ভিলায় যাওয়ার আগেই ধরে ফেলে? একটা ফোন করতে পারলে ভালো হয়। কিন্তু নামলেই ধরে নেবে ওরা। জনসম্মুখে ওকে তুলে নিয়ে গেলেও একটা প্রাণীও সাহস করে বাঁচাতে আসবেনা, জানে ইকবাল। বরং সেই ভিডিও কান্ডেরই পুনরাবৃত্তি হবে। বদলে যাবে ক্যাপশন, “দেখুন মাঝরাস্তা থেকে কীভাবে একটা লোককে তুলে নিয়ে গেল দুর্বৃত্তরা।” যন্ত্রণার মাঝেও হাসি পেয়ে গেল ইকবালের। নিজেরাইতো মাঝরাস্তা থেকে কত মানুষ তুলে নিয়েছে। জনসম্মুখে খু*ন করেছে। কিন্তু বাঁধা দেওয়ার বা মুখ খোলার সাহস করেনি কেউ। করবে কীকররে? জান বাঁচানোই নাকি ফরজ। তাতে শত শত মানুষের সামনে মাত্র পাঁচজন এসে কাউকে কু*পি*য়ে রেখে যাক। কার কী? আজ যখন নিজে সেই পরিস্থিতির সম্মুখীন হল। বুঝতে পারল বর্তমান সমাজকাঠামো ঠিক কতটা বিভৎস করে তুলেছে তারা, কিংবা তাদের ঘাড়ে ভর দিয়ে চলা তথাকথিত সমাজসেবকরা।

শরীরের শক্তি ফুরিয়ে আসছে ইকবালের। যন্ত্রণায় অন্ধকার দেখছে। তা দেখে সিএনজি ড্রায়ভার বলে, ‘ভাইজান? আপনার মনে হয় হাসপাতালে যাওন উচিত। শুরুর থিকাই কতবার কইতাছি।’

ইকবাল হেলান দিয়ে চোখ বুঝল। কীকরে বোঝাবে একে এই সিএনজি থেকে নামলেই ভয়ংকর সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই বলল, ‘ আমার কাছে টাকা নেই ভাই। এজন্যই আগে বাড়ি যাব। ওরাই নিয়ে যাবে আমাকে হাসপাতালে। এখনো ঠিক আছি আমি। আপনি শুধু একটু তাড়াতাড়ি চলেন।’

‘ জ্বে।’

সিএনজির গতি আরও বাড়ল। ইকবাল কিছু একটা চিন্তা করে সিএনজি ড্রায়ভারকে বলে, ‘ আপনার ফোনটা দেওয়া যাবে ভাই? কল করতাম।’

মাথা নাড়িয়ে নিজের ফোনটা দেয় ড্রাইভার। দ্রুত ফোনটা নিয়ে প্রথমেই রাশেদের নাম্বারটা ডায়াল করে। কিন্তু তখনই মনে পড়ে সে আর নেই। খু*ন করে ফেলেছে ওরা ওনাকে। চোখ জল চিকচিক করে উঠল ইকবালের। শরীরের সঙ্গে বুকের মধ্যেও কী তীব্র ব্যথা! রুদ্রর নাম্বারটা কোনমতে মনে করে ডায়াল করল ইকবাল, কিন্তু রিচেবল নয়। আর কারো নাম্বার মনে পড়ছেনা ইকবালের। উচ্ছ্বাসেরটা মনে ছিল। কিন্তু ভুলে গেছে এখন। অনেক কষ্ঠে মনে করল নাম্বারটা। কিন্তু রিং হলেও ধরলোনা কেউ। অস্থির হল ইকবাল। সারা শরীর ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। মাথা থেকে এখনো রক্ত বেরোচ্ছে। ফোনটা ফিরিয়ে দিল ইকবাল। কোনমতে বলল, ‘কেউ কল কর‍লে_ করলে একটু দ-দেবেন।’

‘ কী হইছে কনতো ভাই? অ‍্যাকশিডেন্ট করছেন?’

‘ ত-তাড়াতাড়ি।’

ড্রাইভার কথা বাড়ালোনা আর। শরীর ছেড়ে দিচ্ছে ইকবালের। কথা বলার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ওদিকে বিরতিহীনভাবে পিছু নিচ্ছে সেই গাড়িটাও।

*

নীরব বেশ ক্লান্ত হয়েই ফিরল আজ। আসামাত্রই সোফায় গা ছেড়ে দেয়। জ্যোতি পানি এগিয়ে দেয় ওকে। কুহুর দিকে একপলক তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরব। পানি খাওয়া শেষ হতেই জ্যোতি বলে, ‘ইন্টারভিউ কেমন হলো?’

নীরব মৃদু হেসে বলে, ‘ ভালোই। দেখা যাক কী হয়?’

‘ আচ্ছা।

‘ সন্ধ্যায় কিছু খেয়েছে কুহু?’

‘ হ্যাঁ, নুডুলস আর চা খেয়েছে।’

নীরব কুহুর উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় বিকট এক আওয়াজ হয় সদর দরজায়। তিনজনই চমকে ওঠে। সদর দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে দরজা কোনমতে আকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে ইকবাল। যেকোন মুহূর্তে হাত ফসকে পড়বে। হতবাক হয়ে দাঁড়ায় ওরা তিনজন। এতোটাই বেশি অবাক হয় যে জায়গা থেকে নড়তে পারেনা। চিৎকার করে কিছু বলতে চায় ইকবাল, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হতে চায়না। রক্তক্ষরণ হতে হতে শরীরে শক্তি অবশিষ্ট নেই তার। মুখের ভেতরের ক্ষতগুলো ফুলে জঘন্য অবস্থা হয়েছে।

তখনই ওপর থেকে দৌড়ে নেমে আসে প্রিয়তা। প্রিয়তাকে দেখেই চোখ বড় হয়ে যায় ইকবালের। কিছু বলতে নিলেই দরজা থেকে হাত ফসকে যায়। প্রিয়তা সবার আগেই দৌড়ে গিয়ে দুহাতে আকড়ে ধরে ইকবালকে। জ্যোতি, নীরব আর কুহুও ছুটে যায়। ইকবাল ছটফট করে। কোনমতে উচ্চারণ করে, ‘ও_’

কিন্তু তখনই ঘাড়ে খচ করে কিছু একটা বেঁধে ইকবালের। তবুও গরগর করে কিছু বলে যায় সে। কিন্তু অস্পষ্ট। সেই কথাকে আরও অস্পষ্ট করে দিয়ে প্রিয়তা বলে ওঠে, ‘জ্যোতি আপু পানি নিয়ে এসো। দ্রুত।’

বিন্দুমাত্র না থেমে নীরবকে বলে, ‘ তোমাদের ভাইয়াকে ফোন করো তাড়াতাড়ি।’

জ্যোতি দৌড়ে যায় পানি আনতে। নীরব ফোন করায় ব্যস্ত হয়। কুহু হতভম্ব হয়ে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ইকবালের ছটফটানি বাড়ে। গলার আওয়াজ আরও বেশি অস্পষ্ট হয়। প্রিয়তা দুহাতে ইকবালকে আকড়ে ধরে বলে, ‘কিচ্ছু হবেনা ইকবাল ভাই। আগে পানি খান, তারপর বলবেন। রুদ্র আসছে এক্ষুনি।’

বলতে একদম ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে যায়। খুব আস্তে করে বলে, ‘ আপনাকে মা*রতে চাইনি আমি ইকবাল ভাই। কিন্তু আপনি বাঁচতে চাইলেন না। আর কয়েকটা দিন ধৈর্য্য ধরা উচিত ছিল আপনার। সব ঠিক হয়ে যেতো। কিন্তু আপনার আয়ু বোধহয় এইটুকুই ছিল। ভালো থাকবেন। পরকাল বলে কিছু যদি থাকে, দেখা হবে সেখানে।’

চোখদুটো বিস্ফোরিত হয়ে উঠল ইকবালের। সারা শরীর অসার হয়ে এলো। নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা সে। গলাটা যেন কেউ চেপে ধরেছে শক্ত করে। সামান্য ঠোঁট বাকিয়ে হাসল প্রিয়তা। আড়চোখে তাকাল বাঁ হাতের আঙ্গুলের মাঝখানে রাখা ছোট্ট সুচটার দিকে। যার মাথায় ছিল খুব মারাত্মক এই বিষ। জয়কে দিয়ে এই বিশটাই আনিয়েছিল আসলে ও। ব্রিটেন থেকে নিয়ে আসা বিভিন্ন বিষ আর ঔষধের মধ্যে অন্যতম। রক্তে মেশার কিছুক্ষণের মধ্যেই _। ইকবালের আসার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জয়কে মেসেজ করে প্রিয়তা। আনতে বলে এটা। ছোট্ট সুচের মাথায় বিষটা লাগিয়ে আঙ্গুলের মাঝে খুব দক্ষভাবে এঁটে নেয় প্রিয়তা। কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পাবেনা এমনভাবে। সিঁড়ির মাথায় পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। ইকবাল আসতেই নেমে যায় ও। ধরে সামলানোর নাম করে ঘাড়ের রগে বসিয়ে দেয় বিষাক্ত এই সুচ।

জ্যোতি পানি নিয়ে আসতেই মুখভঙ্গি পরিবর্তন করে প্রিয়তা। নীরব এগিয়ে এসে বলে ফোন কেটে দিয়েছে রুদ্র। প্রিয়তার হাত ফসকে নিচে পরে যায় ইকবাল। হাত-পা দাপিয়ে ছটফট করতে থাকে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে সাদা ফ্যানা। ঠিক সে মুহূর্তেই দ্রুত পায়ে সদর দরজায় এসে দাঁড়ায় রুদ্র। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। আরও খানিকটা ছটফট করে স্থির হয়ে গেছে ইকবালের দেহ।

#চলবে…

[ রি-চেইক করিনি। ভুলত্রুটি হলে একটু মানিয়ে নেবেন। আর সবার গঠনমূক মন্তব্যের প্রত্যাশা রাখছি।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here