অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল
৯৯.
ইকবাল মারা গেছে। পালস্ চেইক করে সেটাই নিশ্চিত হল রুদ্র আমের। স্থির চোখে তাকিয়ে রইল লাশটার দিকে। সেই শক্তপোক্ত শরীরের ইকবাল কেমন শুকিয়ে গেছে। সারা শরীরে ভয়ংকর সব আঘাতের চিহ্ন। মুখ দিয়ে ফ্যানা পড়া বন্ধ হয়েছে। তবে মাথা দিয়ে তখনও র*ক্ত বের হচ্ছে। র*ক্ত আর ফ্যানার মিশ্রনে অদ্ভুত দেখতে লাগছে ফুলে ওঠা ঠোঁটজোড়া। চোখ দুটো বিস্ফোরিত অবস্থায় খোলা। দীর্ঘশ্বাস চাপল রুদ্র। হাত দিয়ে আস্তে করে বন্ধ করে দিল খোলা চোখজোড়া।
উচ্ছ্বাস আর জাফরকে কল করে সবটা জানিয়েছে নীরব। আসছে তারা। কুহু ছুটে এসে নীরবের বুকে মুখ লুকালো। নীরব কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠল শরীরটা। দুহাতে কুহুকে আকড়ে ধরল নীরব। এতো সরলভাবে বেড়ে ওঠা মেয়েটা গত দুমাসে কী ভয়ংকরসব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছে! নীরব বিষণ্ন চোখে তাকিয়ে রইল ইকবালের লাশটার দিকে। ইকবালকে ঠিকভাবে ওর আর কুহুর এনগেইজমেন্টের দিনই দেখেছিল। দেখেছিল, গোটা আমের পরিবারের প্রতি কতটা সমর্পিত ছিল লোকটা।
লাশটা রেখে আস্তে করে উঠে দাঁড়াল রুদ্র। তীক্ষ্ম চোখজোড়া লালচে রঙ ধারণ করেছে। পাশেই স্তম্ভিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল প্রিয়তা। হঠাৎই মাথাটা ঘুরে উঠল ওর। পড়ে যেতে নিলে একহাতে ধরে ফেলল রুদ্র। চোখ নামিয়ে তাকাল প্রিয়তার দিকে।
‘ জ্যোতি।’ প্রিয়তার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থেকেই থমথমে গলায় ডাকল রুদ্র।
জ্যোতিও অদ্ভুত এক ঘোরে ছিল এতক্ষণ। রুদ্রর ডাকে চমকে উঠল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ছলছলে চোখ তাকাল রুদ্রর দিকে। থমথমে আওয়াজেই রুদ্র বলল, ‘ভেতরে নিয়ে যা ওকে।’
মাথা নাড়ল জ্যোতি। এগিয়ে এসে ধরল প্রিয়তার হাত। রুদ্র ছেড়ে দিল। প্রিয়তাও মাথা নিচু করে চুপচাপ ভেতরে চলে গেল জ্যোতির সঙ্গে। দেখে মনে হল সত্যিই অসুস্থ খুব।
জ্যোতি নিজের ঘরেই নিয়ে গেল প্রিয়তাকে। আস্তে করে বিছানায় বসাল। বেডসাইড টেবিল থেকে একগ্লাস পানি এগিয়ে দিল। প্রিয়তা ডান হাত বাড়িয়ে নিল গ্লাসটা। ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসেই ফাঁকা করে ফেলল সেটা। তারপর কম্পমান হাতে ফিরিয়ে দিল জ্যোতির দিকে। গ্লাসটা রেখে প্রিয়তার পাশে এসে বসল জ্যোতি। কাঁধে হাত রেখে বিষণ্ন গলায় বলল, ‘ ঠিক আছো তুমি? শোবে একটু?’
লম্বা একটা শ্বাস ফেলল প্রিয়তা। মাথা নেড়ে না করল। আস্তে করে বলল, ‘ওয়াশরুমে যাব একটু।’
‘ একা যেতে পারবে?’
‘ পারব। তুমি নিচে যাও। ওদিকটা দেখো। আমি একটু স্টেবল হয়ে আসছি।’
মাথা নাড়ল জ্যোতি। প্রিয়তা আস্তে করে উঠে চলে গেল ওয়াশরুমে। সেদিকে তাকিয়ে চাপা শ্বাস ফেলল জ্যোতি। দেরী না করে নিচে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল।
ওয়াশরুমে ঢুকে সোজা কমোডের সামনে গেল প্রিয়তা। আঙ্গুলের ফাঁক থেকে সুচটা ছেড়ে দিল কমোডে। অতঃপর ফ্ল্যাশ করে দিল। এরপর বেসিনের সামনে গিয়ে অন করে দিল পানির ট্যাপ। প্রথমে পানি দিয়ে হাত ধুলো। এরপর হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে। পরপর তিনবার। বি*ষ কোনভাবে হাতে লাগলেও এখন আর ভয় নেই। কিন্তু অস্বস্তি কাটলনা প্রিয়তার। দুহাতে পানি দিয়ে বারবার বারবার ঝাপটা দিতে থাকল নিজের মুখে। বিরতিহীন কিছুক্ষণ এমনটা করর পর থামল ও। ধীরচোখে তাকাল আয়নায়; নিজের প্রতিবিম্বের দিকে। চোখদুটো লাল হয়ে আছে। মনে পড়ল ইকবালের বলা সেই কথাটা, “এমন করােনা প্রিয়তা। রুদ্র প্রচণ্ড ভালাবাসে তোমাকে। এই সত্যি যদি ও কোনভাবে জানতে পারে, ভেতর থেকে একদম গুড়িয়ে যাবে। ছােটবেলা থেকেই প্রচুর কষ্ট পেয়েছে ও। ওর নিজের বলতে এখন কেবল তুমিই আছাে। তােমাকে ওর খুব প্রয়াজন। এখনো সময় আছে। সব ছেড়ে রুদ্রর কাছে ফিরে যাও। ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখাে ওকে। ছেলেটাক এভাবে শেষ করে দিও না বােন। যেভাবেই হোক, একসময় ভাই বলে ডেকেছো তুমি আমাকে। ছোট বোন হিসেবে অনুরোধ করছি। ফিরে যাও।”
নিজের ভেজা হাতজোড়া চোখের সামনে মেলে ধরল প্রিয়তা। প্রিয়তার মনে পড়ে গেল সেই দিনের কথা। এই ষোল বছর বয়স। জীবনে করা প্রথম খু*ন। সারা শরীরে র*ক্ত। স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে যখন সেই রক্ত ধুচ্ছিল। বাথরুমের সাথা টাইলস লাল হয়ে গিয়েছিল। কত র*ক্ত! আরও কয়েকবার পানির ঝাপটা দিল প্রিয়তা। মুখে, গলায়, হাতে। আয়নায় প্রতিবিম্বে তাকাল আরও একবার। চোখ দিয়ে পানি বের হল কি-না, কাঁদল কিনা বোঝা গেলনা! সারা মুখেযে পানির ছেটা। প্রিয়তার মনে হয় সেদিন সেই র*ক্ত ধুয়ে যায়নি। আজও লেপ্টে আছে ওর সারা শরীরে। মনে, হৃদয়ে, আত্মায়। মৃত্যুর আগ অবধি সেই র*ক্ত ওর পিছু ছাড়বেনা। ও প্রাণপণে চাইলেও না!
–
ইন্সপেক্টর আজিজ এসেছেন আমের ভিলায়, সঙ্গে সাব-ইন্সপেক্টর ফারুক। আমের ভিলা থেকে কাউকে খবর দিতে হয়নি। ওনারাই খবর পেয়েছেন। সেই গোডাউন থেকে বেরিয়ে যখন ইকবাল একটা গাড়ির জন্যে আকুতিমিনতি করছিল রাস্তায়। সেই দৃশ্যের ভিডিও করেছে অনেকে। ছেড়ে দিয়েছে সোস্যাল মিডিয়ায়। যার মধ্যে বেশ কয়েকটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে ইতিমধ্যে। ইকবালকে খুব ভালোভাবেই চেনেন ইন্সপেক্টর আজিজ। ভিডিও দেখামাত্র চিনতে পেরে যায়। তাই বিন্দুমাত্র দেরী না করে চলে আসে আমের ভিলায়। ব্যপারটা খতিয়ে দেখার জন্যে। এসে দেখে ইতিমধ্যেই ইকবাল এসে পৌঁছে গেছে আমের ভিলায়। তবে এখন সে মৃত।
আধঘন্টার মধ্যে উচ্ছ্বাস, জাফর দুজনেই প্রায় হন্তদন্ত হয়ে ফিরেছিল আমের ভিলায়। ফ্লোরে তখনও শুইয়ে রাখা হয়েছে ইকবালের লাশ। দুজনের হতবাক হয়ে যায়। কিছুক্ষণের জন্যে বিশ্বাস করতে পারেনা, সত্যিই এখানে এসে, এভাবে মারা গেছে ইকবাল। জীবনের দীর্ঘ কয়েকবছর একসঙ্গে কাটিয়েছে বলেই বোধ হয় চোখ দিয়ে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে জাফরের। ইকবালের লাশের পাশে বসে হাতের মুঠোয় তুলে নেয় ওর নিথর একটা হাত। দু ফোঁটা জল গড়িয়ে নামে তার চোখ থেকে।
উচ্ছ্বাসের চোখ দিয়ে জল আসেনা। কিন্তু চাপা এক যন্ত্রণায় ভাড় হয়ে থাকে বুকটা। ওর আমের ভিলায় প্রবেশের চাবিটুকুই ছিল ইকবাল ভাই। স্পষ্ট মনে পড়ে, দশ বছরের উচ্ছ্বাস খিদের জ্বালায় ছটফট করছিল সেদিন। সুযোগ খুঁজছিল কারো পকেট মারার। রেললাইনের ধারে একটা দোকানে চা খেতে দাঁড়িয়েছিল ইকবাল। সিগারেট কেনার পর টাকা দেয় দোকানিকে। ফেরত পাওয়া খুচরোটা খোলাভাবেই রেখে দেয় প্যান্টের পকেটে। সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করে উচ্ছ্বাস। কৌশলে পকেট মারার চেষ্টা করে। কিন্তু ধরা পড়ে যায়। খপ করে হাতটা ধরে ফেলে ইকবাল। তবে জনসম্মুখে কিছু বলেনা। আড়ালে নিয়ে কানটা মুলে ধরে দিয়ে বলে, ‘ চুরি করছিল কেন?’
কোন উপায় না পেয়ে ইকবালের পায়ে পড়ে গিয়েছিল সেদিন উচ্ছ্বাস। কান্নাকাটি করে নিজের খিদে পাওয়ার কথা বলেছিল। অন্যদের মতো কটা টাকা দিয়ে বিদায় দেয়নি ইকবাল ওকে। বরং কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিল আমের ভিলায়। বাকি সবতো ছিল স্বপ্ন।
বুকের মাঝে চাপটা যেন কয়েকগুন বেড়ে যায় উচ্ছ্বাসের। কান্না আসতে গিয়েও আটকে যায় ভেতরে কোথাও একটা। সোফার হাতলটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে কেবল। জ্যোতি এসে হাত রাখে উচ্ছ্বাসের কাঁধে। হালকা চাপ দেওয়ার সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সবকিছুর সান্ত্বনা এ জগতে নেই।
ডিপার্টমেন্টে খবর পাঠিয়েছিলেন আজিজ। আজিজের প্রাথমিক পরীক্ষার শেষ। ইকবালের লাশটা নিয়ে যাবে তারা। নীরব কুহুকে নিয়ে ভেতরে চলে গেছে। এখানে মেয়েটার না থাকাই ভালো। ততক্ষণে নিচে নেমে আসে প্রিয়তাও। আজিজ প্রশ্ন করে, ‘ উনি আসার আগে কোনভাবেই কোন খবর দেয়নি ইকবাল আপনাদের?’
জ্যোতি উত্তর দেয়, ‘ না, হুট করেই চলে আসেন উনি। অবস্থা এতোটাই খারাপ ছিলোযে দাঁড়াতে অবধি পারছিলনা লোকটা।’
‘ এসে কিছুই বলেনি?’ প্রশ্নটা করল ফারুক।
প্রিয়তা বলল, ‘বলার সুযোগ পায়নি। কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু বুঝতে পারিনি আমরা কেউ। ওনার অবস্থা এতোটাই খারাপ ছিলোযে গলা দিয়ে আওয়াজই বের হচ্ছিলো না।তারপরেই তো_’
ইন্সপেক্টর আজিজ বললেন, ‘ কে কে ছিলেন তখন?’
উত্তর দিল উচ্ছ্বাস, ‘ জ্যোতি, নীরব, কুহু আর বউমণি_ আইমিন প্রিয়তা ছিল।’
মাথা ঝাঁকিয়ে ইকবালের লাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন আজিজ। আপনমনেই বলে, ‘দেখেতো মনে হচ্ছে মৃত্যুর কারণ বি*ষক্রিয়া। কিন্তু শরীরে আরও সব আঘাতের চিহ্নও আছে। দেখা যাক পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কী বলে।’
কথাটা বলে তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্র তখনও গম্ভীর, স্তব্ধ। স্থির চোখে দেখে যাচ্ছে ইকবালের লাশটা। আজিজ রুদ্রর কাছে গিয়ে আস্তে বলল, ‘ ভেবেছিলাম ইকবালকে তুমি আরও আগেই টপকে দিয়েছো। কিন্তু এখনতো দেখছি ঘটনা ভিন্ন। ভেতরে কী জটলা পাকছে বলোতো?’
রুদ্র গম্ভীর গলায় বলল, ‘এজন্যই নিজের সব থিওরিতে বিশ্বাস করতে নেই।’
‘ সে না হয় করলাম না। কিন্তু প্রথমে রাশেদ বাবা এখন ইকবাল। পঞ্চ পান্ডবের মধ্যে দুজনেরই বধ হয়ে গেল। সোলার সিস্টেম আর বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব নয় রুদ্র। বুঝতে পারছো সেটা?’
দীর্ঘক্ষণ পর ইকবালের লাশ থেকে চোখ সরায় রুদ্র। নিজের লালচে চোখজোড়া আজিজের চোখে রেখে বলল, ‘আপনার দেরী হচ্ছে বোধহয়।’
মাথা ঝাঁকায় আজিজ। কথা বাড়ায় না। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোক চলে আসে স্ট্রেচার নিয়ে। ইকবালের লাশটা নিয়ে বেরিয়ে যায়। আমের ভিলার উপস্থিত সদস্যদের ওপর একপলক চোখ বুলায় ইকবাল। নিজের বেরিয়ে আসে।
ইকবালের লাশটা নিয়ে বেরিয়ে যেতেই কেমন থমথমে এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে ওখানে। কারো মুখে কোন শব্দ নেই। কিছু বলার নেই, কিছু করার নেই। আছে কেবল দীর্ঘশ্বাসের শব্দ আর একরাশ শূন্যতা।
*
ঐদিন রাতেই বৈঠক ঘরে আলোচনায় বসে রুদ্র, উচ্ছ্বাস এবং জাফর। বরাবরের মতোই রাশেদ আমেরের চেয়ারটা ফাঁকা। তবে রুদ্রকে বেশ নীরব মনে হচ্ছে। সন্ধ্যা থেকে এতোকিছু হয়ে গেল। ইকবাল মারা গেল। তার লাশ নিয়ে যাওয়া হল। রেখে গেল কয়েকটা অমীমাংসিত জটিল প্রশ্ন। অথচ রুদ্র গতি খুবই মন্থর। এতোটা লম্বা সময়ে মাত্র কয়েকটা শব্দই বের হয়েছে ওর মুখ দিয়ে। এখনো কেমন থম মেরে বসে আছে চেয়ারে। হাতের সিগারেটটায় ছাই জমে যাচ্ছে। টান দেওয়ার নাম নেই।
‘ ঠিক আছিস তুই?’ হালকা গলায় প্রশ্ন করল উচ্ছ্বাস।
রুদ্র নড়ল। অ্যাশট্রেতে সিগারেটের ছাই ঝেড়ে ধীরে সুস্থে একটা টান দিয়ে বলল, ‘শুনছি। বল।’
উচ্ছ্বাস একটু অবাক হল। কিন্তু পরিস্থিতি বুঝে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘ আমরাতো ভেবেছিলাম ইকবাল ভাইকে হয় ওরা মেরে ফেলেছে, নয়তো পালিয়ে গেছে সে। কিন্তু আজ যা হলো তাতেতো পুরো ইকুয়েশনটাই বদলে গেল। যদি সত্যিই ইকবাল ভাই তথ্য পাচার করে থাকতেন তবে এতোদিন কোথায় ছিলেন? বেঁচে ছিলেন তারমানে মারেনি ওরা ওনাকে। আর যদি ধরে নেই পালিয়ে গিয়েছিলেন তবে ফিরে এলেন কেন? এরকম গুরুত্বর খারাপ অবস্থাইবা কীকরে হলো ওনার?’
জাফর বলল, ‘শরীর দেখে মনে হচ্ছিল অনেকদিন যাবত টর্চার করা হচ্ছিল।’
‘ এক্সাক্টলি। কিন্তু কেন? মেরে ফেলতো পারতো! এভাবে বাঁচিয়ে রাখার কারণ কী ছিল?’
রুদ্র সোজা হয়ে বসল। অ্যাশট্রেতে ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ‘ ধরে নেওয়া যাক, ওনার কাছে এমন কিছু ছিল যেটা ডার্ক নাইট বা ব্লাক হোলরও দরকার ছিল। আমাকে কল করেছিলেন ইকবাল ভাই। সিএনজি ওয়ালার ফোন থেকে। কিন্তু আমি হুসাইন আলীর সঙ্গে মিটিংয়ে ছিলাম। যার ফলে বন্ধ ছিল আমার ফোন।’
‘ আমাকেও। কিন্তু আজ নাজিফাদের বাড়িতেই ভুল করে রেখে এসেছিলাম ফোনটা। নয়তো ধরতে পারতাম ওনাকে বাঁচাতে না পারলেও কোন তথ্য অন্তত জানা যেতো।’ উচ্ছ্বাসের কন্ঠে স্পষ্ট আফসোস।
জাফর বলল, ‘ কিন্তু মারা গেল কীকরে সেটাই বড় প্রশ্ন। রিপোর্ট না আসা অবধি কিছু বলাও যাচ্ছেনা।’
পাশ থেকে একটা ডায়েরি খুলল রুদ্র। পাতা উল্টাতৈ উল্টাতে বলল, ‘ এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই এখন। উচ্ছ্বাস, ভাইরাল হওয়া ভিডিওটা চেক কর। লোকেশনটা বের করে লোক নিয়ে কাল একবার রেট দিয়ে আয় জায়গাটা।’
উচ্ছ্বাস বলল, ‘লোকেশন দেখেছি। খবরে শুনলাম ওখানকার এক গোডাউনে নাকি কাল ঐসময়ই আগুন লেগেছে।’
‘ হতে পারে ওখানেই আটকে রেখেছিল ওরা ওনাকে। তুই যা একবার কাল। আর হ্যাঁ। কাল একজনের টাকা দেওয়ার কথা আছে। আমি এড্রেস দিয়ে দিচ্ছি। কাল আসার সময় কালেক্ট করে নিবি।’
হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই উচ্ছ্বাস বলল, ‘ হুসাইন আলীর সঙ্গে মিটিংয়ের কী হলো?’
চোখমুখ গম্ভীর হয়ে উঠল রুদ্রর। থমথমে গলায় বলল, ‘ সে কোনরকম সময় দিতে রাজি হয়নি। হয় সময়মতো তার কাছে মাল পৌঁছে দিতে হবে নয়তো টাকা। আর না হলে_’
সাদা কাগজের মতো ফ্যাকাশে হয়ে উঠল উচ্ছ্বাস আর জাফরের মুখ। তা না হলে কী সেটা বুঝতে বাকি থাকেনা ওদের। জাফর অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘আর ফ্যাক্টরি বেঁচে দেওয়ার সিদ্ধান্ত?’
সিগারেট ঠোঁটে লাগাতে গিয়েও থেমে গেল রুদ্র। শূণ্য দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ ব্রানথুইস আপাতত কোন তাড়া দিচ্ছেনা আমাদের। বাকি থাকে “বিধারাত” আর “ক্রইট” দল। ওদের ডেডলাইনটা কাছে হলেও একটা মিটিং করব আমি। বিধারাতের লীডার দুবাইতেই আছেন। বাকি রইল ক্রুইট। সেও আসছেন দুবাই। বিজনেস কাছে। দুবাই যাচ্ছি আমি। ওনাদের সঙ্গে একটা মিটিংয়ে বসতে হবে। মিটিংটা সেড়ে এসে দেখছি কী করা যায়।’
চমকে উঠল উচ্ছ্বাস, জাফর দুজনেই। বিস্ময় চাপতে না পেরে জাফর বলল, ‘ দুবাই যাচ্ছিস তুই? বলিসনিতো?’
তেমন গুরুত্ব দিলোনা রুদ্র। নির্বিকারভাবে বলল, ‘শিওর ছিলাম না তখনও। আজ শিওর হয়েছি। তাছাড়া ভিসাও রেডি ছিলোনা। এখন অল ওকে।’
‘ কবে যাচ্ছিস।’ কপালে গভীর রেখা ফেলে জানতে চাইলেন জাফর।
‘ কালকেই ফ্লাইট।’
আরেকদফা চমকে উঠল ওরা। পিনপতন নীরবতা নেমে এলো ঘরটাতে। ফ্লাইট কালকেই তারমানে পরিকল্পনা আগে থেকেই করা ছিল। তবে এই মুহূর্তে বিষয়টা নিয়ে ঘাঁটলনা। কিছুক্ষণের নীরবতার পর আনমনেই উচ্ছ্বাস বলল, ‘ হুসাইন আলীর ব্যপারটা কী করবি?’
ঠোঁট থেকে সিগারেটের শেষ অংশটুকু নামিয়ে অ্যাশট্রেতে গুঁজে রাখল রুদ্র। আলোচনায় ইতি টেনে বলল, ‘ দেখছি সবটাই। আমি দুবাই থেকে ফিরে আসার পর।’
*
রুদ্রর লাগেজ গোছাচ্ছে প্রিয়তা। চেহারায় নির্লিপ্ততা থাকলেও মনে মনে অস্থির হয়ে উঠছে ও। সন্ধ্যায় ঘটা আকস্মিক ঘটনার রেশ এখনো কাটেনি আমের ভিলায়। সকলের মধ্যেই গুমোট একটা ভাব। থমকে গেছে সবাই। জ্যোতির সঙ্গে সবকিছু সামলে রাত প্রায় বারোটায় ঘরে আসে প্রিয়তা। ও ঘরে আসার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বৈঠকঘর থেকে ফিরে আসে রুদ্র। প্রিয়তাকে বলে ব্যাগ গোছাতে। প্রিয়তা কারণ জানতে চাইলে ওকে অবাক করে দিয়ে রুদ্র বলে, দুবাই যাচ্ছে সে। সেটাও কালকেই।
রুদ্রর হঠাৎ দুবাই যাওয়ার পরিকল্পনা ভাবাচ্ছে প্রিয়তাকে। এমনিতেই কম বিপদ নেই চারপাশে। তারওপর আজ হঠাৎ ইকবালের মৃত্যু। এরকম পরিস্থিতিতে হঠাৎ বিদেশ কেন যেতে চাইছে রুদ্র? হুসাইন আলীর সঙ্গে মিটিংয়ের পরতো রুদ্রর অন্যকিছু ভাবার কথা ছিল। কিন্তু ঘটছে ভিন্ন কিছু। কী চলছে রুদ্রর মনে? কী পরিকল্পনা? এমনিতেও ইদানিং ঠিকঠাকভাবে কাজ করেনা মাইক্রোফোনটা। দুদিন চার্জ দিতে পারেনি। ঘুমই ভাঙেনি ওর। আর রুদ্র দুবাই চলে গেলেতো চার্জ দিতেই পারবেনা। জানতেই পারবেনা ওখানে আসলে কী করছে রুদ্র। সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে এটাও সত্য যে চিন্তা হচ্ছে ওর রুদ্রর জন্যে। যদি ভয়ংকর কোন বিপদে জড়িয়ে যায় সেখানে?
হাজারটা চিন্তায় ডুবে থেকেই লাগেজটা বন্ধ করল প্রিয়তা। চেইন লাগাতে লাগাতে একবার উঁকি দিল বারান্দায়। সেই কখন প্রিয়তাকে ব্যাগ গুছিয়ে রাখতে বলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে লোকটা। এখনো আসার নাম নেই। অথচ বাইরে হাঁড় কাঁপানো ঠান্ডা। লাগেজটা রুমে একসাইডে চাপিয়ে রাখল প্রিয়তা। বিছানাটা ঝেড়ে গুছিয়ে নিল ঠিকঠাকভাবে। অতঃপর পা বাড়ালো বারান্দায় দিকে। এই আবহাওয়ায় বাইরে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে রুদ্র। তারসাথে কৌশলে কিছু জেনে নেওয়ার একটা চেষ্টা করতে হবে।
বারান্দায় গিয়ে প্রিয়তা দেখল, নতুন একটা সিগারেট জ্বালিয়েছে রুদ্র। দৃষ্টি আকাশের দিকে স্থির। বাইরে থেকে হিমশীতল হাওয়া আসছে। যা কাঁটার মতো বিঁধছে গায়ে। এই ঠান্ডাতেও গায়ে একটা পাতলা গেঞ্জি মাত্র। ভ্রু কুঁচকে গেল প্রিয়তার। এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘ এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ঠান্ডা লাগবেতো!’
রুদ্র তাকালোনা প্রিয়তার দিকে। আকাশের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই বলল, ‘গোছানো শেষ?’
‘ হ্যাঁ। বিছানাটাও গুছিয়ে দিয়েছি। ভেতরে এসে শুয়ে পরুন। অনেক রাত হয়েছে, ঠান্ডা বাড়ছে। শরীর খারাপ হবে পরে।সকাল সকাল বের হবেনতো আপনি।’
জবাব দিলোনা রুদ্র। আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখেই টান দিল সিগারেটে। অন্ধকার আকাশে উড়িয়ে দিল নিকোটিনের সাদা বিষাক্ত ধোঁয়া। প্রিয়তা অপলক চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল সেদিকে। তারপর এগিয়ে গিয়ে হাত রাখল রুদ্রর কাঁধে। নরম গলায় বলল, ‘ কী হয়েছে রুদ্র? ঠিক আছেন আপনি?’
‘ আছি।’
‘ ইকবাল ভাইয়ের মৃত্যুটা নিয়ে ভাবছেন?’
‘ বিষয়টাতো ভাববার মতোই।’
চুপ করে গেল প্রিয়তা। কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। একটু চুপ থেকে বলল, ‘হঠাৎ দুবাই যাচ্ছেন। কোন বিপদ হয়েছে?’
‘ মিটিং আছে দুটো দলের লীডারের সঙ্গে। বলেছিলাম না ফিনানশিয়ার ক্রাইসিস? অনেক পুরোনো পার্টনারশিপ। দেখি কথা বলে কিছুটা বেনিফিট নেওয়া যায় কিনা। কয়েক পয়েন্ট আর আমার ফিউচার প্ল্যানটা ভালোভাবে বুঝিয়ে বললে কিছু হতে পারে।’
ভেতরকার অস্থিরতা বাড়ল প্রিয়তার। আস্তে করে হাত সরিয়ে আনল রুদ্রর কাঁধ থেকে। নির্লিপ্ত থাকাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠল। ফিউচার প্ল্যানটা কী? জিজ্ঞেস করে ফেলার ঝোঁকটাকে একপ্রকার গলা টিপে মারল। কিন্তু কিছু হতে পারে মানে কী! কিছু হলেতো হবে না। কিছু না হলেইতো দ্রুত সব ছাড়বে রুদ্র। পরিবারকে নিয়ে চলে যাবে অনেক দূরে। আড়ালে! কিন্তু সেটাই যদি না হয় তাহলে? কী করবে প্রিয়তা? সবদিক সামাল দেবে কীকরে?
‘ ভয় পেলে?’
রুদ্র প্রশ্নে চমকে উঠল প্রিয়তা। আপনাআপনি মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘হুঁ?’
দীর্ঘক্ষণ পর আকাশ থেকে চোখ সরালো রুদ্র। ঘুরে তাকাল প্রিয়তার দিকে। রুদ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে ভেতরটা কেমন করে উঠল প্রিয়তার। এখনো সামান্য লালচে ভাব আছে তীক্ষ্ম ঐ চোখজোড়াতে। ঠান্ডায়, চিন্তায়, নাকি অন্যকোন কারণে বোঝা দ্বায়। রুদ্র আবার বলল, ‘ এতো ঠান্ডার মধ্যেও ঘামছো তুমি। তাই জিজ্ঞেস করলাম। ভয় পেয়েছো?’
নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল প্রিয়তা। ঘাড়ে মুখে হাত দিয়ে বুঝল উত্তেজনায় সত্যিই ঘেমে গেছে ও। কোনমতে বলল, ‘ভয় পাওয়াটা কী স্বাভাবিক নয় রুদ্র? বিগত দুমাস যাবত যা যা হচ্ছে এরপর_ এরপর আপনি চোখের আড়াল হলেও কলিজা শুকিয়ে যায় আমার। যতক্ষণ বাইরে থাকেন পাগলের মতো ছটফট করি। সেখানে দুবাই_’ বাক্যটা শেষ করতে পারলনা প্রিয়তা। অস্থির হয়ে থেমে গেল। দুকদম এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘না গেলে হয়না?’
মৃদু হেসে সিগারেটে পরপর কয়েকটা দিল রুদ্র। অবশিষ্ট অংশটা অ্যাশট্রেতে গুজে রেখে পুরোপুরিভাবে ঘুরল প্রিয়তার দিকে, ‘এতো ভয় পাওয়ারতো কিছু নেই। শুধু মিটিংয়ে যাচ্ছি। এর আগে অনেকবার অনেকরকম ভয়ংকর মিশনে গেছি আমি। ব্যপারটাতো নতুন কিছু নয়।’
ছলছলে চোখ নিয়ে না বোধক মাথা নাড়ল প্রিয়তা, ‘ আপনি বুঝবেন না আমার অবস্থাটা। বুঝলে অনেক আগেই শুনতেন আমার কথা। আগের ব্যপার আর এখনকার ব্যপার এক নয়। সেটা জানেন আপনি।’
রুদ্রর একটা হাত নিজের দুহাতের মুঠোয় নিয়ে নিল প্রিয়তা। আলতো করে চুমু খেলো। এক ফোঁটা উষ্ণ জল গড়িয়ে পড়ল রুদ্রর হাতে। অজান্তেই মৃদু কেঁপে উঠল রুদ্র। প্রিয়তা বলল, ‘যদি সম্ভব হতো আপনার সঙ্গে যেতাম আমি। কোনকিছু, কোনভাবেই আটকে রাখতে পারতোনা আমাকে। আপনিও না। কিন্তু আমি জানি, সেটা সম্ভব না। তাই একটা কথা চাইছি। ওয়াদা করুন, ফিরে আসবেন।’
ক্লিষ্ট হাসল রুদ্র। অপলকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল প্রিয়তার মুখের দিকে। ধীরকন্ঠে বলল, ‘এতোটা ডেস্পারেশন?’
রুদ্রর হাতটা আরও শক্ত করে ধরল প্রিয়তা। ফিসফিসে আওয়াজে বলল, ‘ ডেস্পারেশন কি-না জানিনা। কিন্তু আপনাকে ধরে রাখার জন্যে আমি সব সীমা অতিক্রম করতে পারি রুদ্র।’
রুদ্র আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। অতঃপর আলতো করে হাত রাখল ওর অশ্রুসিক্ত গালে। প্রিয়তার মতোই ফিসফিসে আওয়াজে বলল, ‘কথা দিচ্ছি, ফিরে আসব।’
ঝরঝর করে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল প্রিয়তার সেই অপূর্ব, ঘনপল্লব ঘেরা চোখ থেকে। রুদ্র তাকাল সেই চোখে। এই চোখজোড়াইতো রুদ্রর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। এই চোখের দিকে তাকালেই সব গুলিয়ে যায় রুদ্রর। সব ভুলে যায়। সমস্ত জগতকে তুচ্ছ করে একাকার হয়ে যায় নিজের প্রিয়র সঙ্গে।
রুদ্র কাছে টেনে নিল প্রিয়তাকে। গভীরভাবে চুম্বন করল কপালের মাঝখানে। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল প্রিয়তা। সারা শরীর হালকা হয়ে গেল। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী নারী মনে হলো ওর। হঠাৎই মস্তিষ্কে ঝংকার দিয়ে উঠল ইকবালের বলা ওকে বলা সেই শেষ কথাটা, “ওপরওয়ালা তােমাকে ক্ষমা করবে কি-না জানিনা। কিন্তু রুদ্র আমের কোনকিছুর বিনিময়েই তোমাকে ক্ষমা করবেনা সেটা তুমিও জানো। রুদ্রর ঘৃণাই তোমাকে মূৃত্যু দেবে। আর এটা হবে। হবেই। রাশেদ বাবার মৃ-ত দেহের ভাড়, কুহুর চিৎকার-যন্ত্রণার ধ্বনি, আমের পরিবারের প্রতিটা সদস্যের দীর্ঘশ্বাস থেকে তুমি বাঁচতে পারবেনা রাণী মীর্জা। এগুলো তােমাকে শান্তিতে মরতেও দেবেনা, বাঁচতেও দেবেনা। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করবে তুমি। এতোটা ছটফট করবে যে জল্লাদেরও তোমাকে দেখে করুণা হবে।”
সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল প্রিয়তার। দমবন্ধ হয়ে এলো। ঝিম ধরে গেল যেন মস্তিষ্কে। কোনরকম পূর্বসংকেত ছাড়াই রুদ্রকে জাপটে ধরল প্রিয়তা। ফুঁপিয়ে উঠল নিজের অজান্তেই। রুদ্র দুহাতে আকড়ে ধরল ওকে। ইচ্ছে করেই চুপ থাকল। বলল না কিছু। সময়ের হিসেব ছাড়াই একে অপরের সঙ্গে মিশে রইল দীর্ঘসময়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ঠান্ডা। গরম কাপড় ছাড়া এখানে থাকা দ্বায় হয়ে দাঁড়িয়েছে একপ্রকার। প্রিয়তাকে ছাড়াতে চাইল রুদ্র। কিন্তু ছাড়তে চাইল না প্রিয়তা। শক্ত করে ধরে রাখল নিজের সঙ্গে। উপায় না পেয়ে কোলে তুলে নিল রুদ্র প্রিয়তাকে। পা দিয়ে বন্ধ করে দিল বারান্দার দরজাটা। আলতো করে বিছানায় শুইয়ে দিলে প্রিয়তাকে। কম্ফোর্টারটা গায়ে দিয়ে দিয়ে উঠে যেতে নিলেই দুহাতে আকড়ে ধরল প্রিয়তা ওকে।
দ্বিতীয়বার রুদ্রর চোখ পড়ল প্রিয়তার চোখ। আরও একবার গুলিয়ে গেল সবকিছু। এই মেয়েটা আজ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে টানছে ওকে। স্তব্ধ, নীরব ঘরটায় দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ প্রবল হচ্ছে। নিজের স্নায়ুর ওপর বেশি চাপ প্রয়োগ করল না রুদ্র। মরুর তৃষ্ণার্ত কোন পথিকের মতোই নিজের শুষ্ক তামাটে ঠোঁটজোড়া এগিয়ে নিল প্রিয়তার ভেজা কমলাটে ঠোঁটে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা যত বাড়ল। ততই নিঃশ্বাস বন্ধ হতে থাকল প্রিয়তার। নিদারুণ কষ্টে সর্বাঙ্গ জ্বলতে লাগল। রুদ্রর প্রতিটা স্পর্শ হাহাকার তৈরী করল ওর বুকে। রুদ্র যত কাছে আসল, প্রিয়তার সেই যন্ত্রণা ততই বাড়তে থাকল। মনের গহীনে কেউ চিৎকার করে বলল, এই স্পর্শ ও আর কোনদিন পাবেনা। এতোটা ভালোবেসে ওর শ্যামপুরুষ আর কোনদিন ছোঁবেনা ওকে। দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামল প্রিয়তার। ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল।
থেমে গেল রুদ্র। প্রিয়তার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘কাঁদছো কেন?’
প্রিয়তা আকুল নয়নে তাকাল রুদ্রর চোখে। কাতর কন্ঠে বলল, ‘আপনি আমাকে ভালোবাসেন রুদ্র?’
হাসল রুদ্র। প্রিয়তার কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বলল, ‘ভালোবাসি প্রিয়। ঠিক যতটা ভালোবাসলে নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়া যায়; ততটাই ভালোবাসি।’
রুদ্রর দুগালে হাত রেখে আরও একবার ফুঁপিয়ে উঠল প্রিয়তা। ভেতরের হাহাকার আরও বাড়ল। ওর মনে হল, এই শেষ। আর কোনদিন রুদ্রর মুখ থেকে ‘ভালোবাসি’ শব্দটা শুনতে পাবেনা প্রিয়তা। “ভালোবাসি প্রিয়” শব্দদুটি আর শোনা হবেনা ওর। কোনদিন না।’
#চলবে…
[ এই পর্বের খানিকটা অংশ বাকি আছে। লেখার সময় পাইনি। তাই সেটা বর্ধিতাংশ হিসেবে কাল দেব।
আর নিয়মিত দেওয়ার চেষ্টা করছি। তাই সবার গঠনমূলক মন্তব্য এবং রেসপন্সটুকু আশা করতেই পারি। ]