অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ৯৯. ( বর্ধিতাংশ

0
62

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

৯৯. ( বর্ধিতাংশ)

সকাল সকালই শওকত মীর্জার ঢাকার বাড়িটাতে এসেছে প্রিয়তা। এখানে আসার ইচ্ছা ছিলোনা আজ ওর। কিন্তু গতকাল রাতে কল করেছিল শওকত। বলল, সম্রাট আর করিম তাজওয়ারও আসছে। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। প্রথমে অফিসেই বসতে চেয়েছিল শওকত; কিন্তু রাজি হয়নি প্রিয়তা। সবাইকে ওদের বাড়িতেই আসতে বলেছে। আমের ভিলা থেকে স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হলেও জয়কে নিয়ে সোজা চলে এসেছে শওকতের বাড়িতে। সম্রাট বা করিম এখনো এসে পৌঁছয়নি। তাই নিজের রুমটাতে চলে এসেছে প্রিয়তা। স্যালোয়ার স্যুট ছেড়ে কমফর্টেবল টিশার্ট আর একটা টাউজার পড়ে নেয়। শানকে বলে এসেছে সবাই উপস্থিত হলে ওকে ডেকে পাঠাতে। বরাবরের মতোই এদের দেরী করার বাতিকটা খুব বিরক্ত করে প্রিয়তাকে।

গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা কী সেটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেনা প্রিয়তা। এখন অন্যচিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে মস্তিষ্কে। রুদ্র দুবাই চলে গেছে পরশু সকালে। এখনো অবধি রুদ্রর সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই প্রিয়তার। ফোন নট-রিচেবল। সেদিকের কী অবস্থা জানার উপায় নেই প্রিয়তার। যেটা বর্তমানে প্রিয়তার সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ।
ঘুম থেকে উঠে রুদ্রকে পাশে পায়নি প্রিয়তা। প্রথমে ভাবে ওয়াশরুমে, বারান্দায় কিংবা নিচে গেছে। ছোট্ট হাই তুলে পিটপিটে চোখে ফোনের স্ক্রিনটা অন করে। সময় দেখামাত্র চমকে ওঠে ও। সকাল তখন ন’টা বারো। অথচ ফ্লাইট ধরার জন্যে সাতটায় বের হয়ে যাওয়ার কথা ছিল রুদ্রর। দ্রুত উঠে বসে প্রিয়তা। শরীরে পোশাক না থাকায় কম্ফোর্টারটা আকড়ে ধরে নিজের সঙ্গে। বিভ্রান্তের মতো চারপাশে তাকায়। ওয়াশরুমের লাইট অফ। বারান্দার দরজাটাও বন্ধ। রুদ্র কী চলে গেছে? সময় হিসেব করলে চলে যাওয়ারই কথা। কিন্তু…। দ্রুত পোশাক খুঁজে পড়ে নেয় প্রিয়তা। কোনমতে ফ্রেশ হয়ে প্রায় দৌড়ে নিচে যায়। নিচে গিয়ে জানতে পারে রুদ্র সাতটার দিকেই বেরিয়ে গেছে। কাউকেই নাকি সেভাবে বলে যায়নি। শুধু বের হওয়ার সময় ড্রয়িংরুমে দেখা হয়ে যায় জ্যোতির সঙ্গে। একটু দাঁড়িয়ে কেবল বলেছে, ‘যাচ্ছি। বাড়ির সবার খেয়াল রাখিস।’
জ্যোতি মাথা নাড়ে। এরপর নাকি আর দাঁড়ায়নি রুদ্র। সোজা বেরিয়ে গেছে। ব্যপারটায় মন খারাপ হয় প্রিয়তার। কাউকে বলে না গেলেও ওকেও বলে যায়নি ব্যপারটায় বড্ড বেশি অভিমান হয় ওর।

দরজা খোলার শব্দে প্রিয়তার ধ্যান ভাঙল। তাকিয়ে দেখল সম্রাট এসেছে। দরজা লক করছে সে। আজ বাদামি রঙের একটা ফুলহাতা গেঞ্জির সঙ্গে কালো জিন্স পরনে। সেদিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল প্রিয়তা। চুপচাপ ফোন স্ক্রোলিং করতে শুরু করল। এগিয়ে এসে প্রিয়তার বিছানায় বসল সম্রাট। প্রিয়তা ঠিক মাঝখানে হেডরেস্টে হেলান দিয়ে বসে ছিল। সম্রাটও হেলান দিল হেডরেস্টে। মুচকি হেসে বলল, ‘ভালো আছো সুইটহার্ট?’

চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল প্রিয়তার। তবে কন্ঠস্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, ‘ ভালো। তোমার কী খবর?’

‘ বেশ ভালো।’

‘ ভালো থাকাই ভালো। কিন্তু আদবকায়দা ভুলে যাওয়া না। প্রথমত, কারো বেডরুম ঢোকা আগে নক করতে হয়। দ্বিতীয়ত, আমার অনুমতি ছাড়াই বিছানায় উঠে বসাটা উচিৎ হয়নি তোমার।’

ঠোঁটের হাসিটা মিলিয়ে গেল সম্রাটের। অপমানে থমথমে হয়ে গেল মুখটা। ভেতরে ভেতরে একধরনের চাপা ক্রোধ অনুভব করল ও। বলতে ইচ্ছে করল, একটা সময় একে অপরের রুমে আসতে, বিছানায় বসতে এমনকি শুতেও অনুমতির দরকার হয়নি আমাদের। অথচ এটা বললেই সেই পরিচিত উত্তর আসবে, জানে সম্রাট। গম্ভীর গলায় রাণী বলবে, আগের পরিস্থিতি এখন আর নেই। কিন্তু রাণীর এই হুটহাট পরিস্থিতি বদলের সঙ্গে মানিয়ে চলতে বাকি সবাই বাধ্য নয়, সেটা বলে এইমুহূর্তে ঝগড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছেনা সম্রাট। সবাই মিলে যখন আলোচনায় বসবে তখন এমনিতেই ঝগড়া সৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। তাই চুপ এ বিষয়ে থাকাটাকেই উপযুক্ত মনে করল। কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘ ব্রেকফাস্ট করেছো?’

‘ হ্যাঁ। তুমি?’

‘ করেছি।’

প্রিয়তা ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থেকেই বলল, ‘তাজওয়ার সাহেব এসেছে?’

হবু শ্বশুরকে নাম ধরে ডাকছে! সম্রাট মনে মনে কথাটা ভাবলেও মুখে বলল, ‘আসছে। উনি আসলেই লোক আসবে আমাদের ডাকতে। বাকি সবাই চলে এসেছে অলরেডি।’

প্রিয়তা ভ্রু উঁচু করে তাকাল সম্রাটের দিকে, ‘ “টাইম ম্যানেজমেন্ট ” শব্দদুটো আছে তোমাদের ডিকশনারীতে? নাকি ঘাসের সঙ্গে গিলে খেয়েছো?’

ক্রোধটা এবার চেপে রাখা দায় হল সম্রাটের। ঠান্ডা গলায় বলল, ‘ডোন্ট ইউ থিংক ইউ আর বিয়িং ডিজরেস্পেক্টফুল ডে বাই ডে?’

উত্তর দিলোনা প্রিয়তা। সম্রাট বলল, ‘ডেলিভারি হবে সামনে অনেক সেটআপ তৈরী বাকি। সেগুলি ঠিকঠাক করতে গিয়েছিলাম। ফিরতে ফিরতে দেরী হয়ে গেছে আমার। কাজেই গিয়েছিলাম।’

ঠোঁটে মৃদু তাচ্ছিল্যের হাসি মিশিয়ে প্রিয়তা বলল, ‘সঙ্গে হোটেলরুমে মেয়েদের নিয়ে ফুর্তিও করেছো।’

সারা শরীর গরম হয়ে উঠল সম্রাটের। কিন্তু ব্যপারটা ঘাটালোনা ও। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করল। নিজে একটা নিয়ে আরেকটা বারিয়ে দিল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা নিল সেটা। পরপর দুবার গ্যাসলাইট জ্বলার আওয়াজ হল। কেটে গেল দুটো মিনিট। প্রিয়তাকে আজ দু’টানের বেশি দিতে দেখে অবাকই হল সম্রাট। বিস্ময় চেপে রাখতে না পেরে বলল, ‘ আবার রেগুলার শুরু করেছো?’

প্রিয়তা একবার তাকাল হাতে ধরা সিগারেটটার দিকে। রাণী থেকে প্রিয়তা হওয়ার পর ছেড়েই দিয়েছিল সম্পূর্ণভাবে। সেই আড়াই বছরে সর্বোচ্চ চারটা কী পাঁচটা টেনেছে। কিন্তু দুদিন হল ক্রেভিংসটা বাড়ছে ওর। মনের অস্থিরতার জন্যে কি-না জানেনা। নিকোটিন পোড়া এই ধোঁয়াটুকু ফুসফুস ছুলেই কেমন শান্তি লাগছে ওর। ধ্বংসাত্বক শান্তি। প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে প্রিয়তা বলল, ‘ হঠাৎ এই মিটিংটার কী দরকার ছিল?’

সম্রাট নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, ‘দরকার ছিলো বলেই ডাকা হয়েছে। রুদ্র থাকলে এখানে হুটহাট আসতে পারতেনা তুমি। রুদ্র দেশে নেই। আলোচনার জন্যে এটাকেই উপযুক্ত সময় মনে হয়েছে আমাদের।’

চোখ ছোট করে সিগারেটে টান দিল প্রিয়তা। বলল, ‘রুদ্র না থাকলেও উচ্ছ্বাস আছে। ওকে খাটো করে দেখার ভুল করোনা। আমি ইশ্যুটা জানতে চেয়েছি।’

মেজাজ খারাপ হল সম্রাটের। দুবছর আগের সেই ঘটনার পর উচ্ছ্বাস নামটা শুনলেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে ও। ইচ্ছে হয় নিজ হাতে কু*পি*য়ে মারতে। নিজেকে সামলে নিল সম্রাট। প্রিয়তার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল, ‘এখন আমরা সেসব কথা না বলি? কতগুলোদিন পর এভাবে আলাদা বসার সুযোগ পেয়েছি বলোতো?’

বলতে বলতেই প্রিয়তার হাতে চুমু খেতে গেল সম্রাট। কিন্তু বিদ্যুৎ গতিতে হাতটা সরিয়ে নিল প্রিয়তা। রেগে গিয়ে বলল, ‘আমি নিষেধ করেছি সম্রাট।’

চোখেমুখে বিরক্তি নিয়ে প্রিয়তার মুখের দিকে তাকাল সম্রাট। বিতৃষ্ণা নিয়ে সিগারেট টান দিয়ে বলল, ‘ফাইন!’

অতঃপর নীরবতায় কাটল আরও কিছুক্ষণ। সেই নীরবতায় ছেট ঘটিয়ে সম্রাট নিজেই বলল, ‘ ঐ বাড়িতে কতদিন থাকবে? আই মিন তোমার আর রুদ্রর এই বর-বউ খেলাটা কবে শেষ করবে?’

‘ যতদিন দরকার পড়বে।’ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল প্রিয়তা।

‘ কিন্তু আমারতো মনে হয়না ওখানে তোমার আর কোন দরকার আছে। যা করার, যতটুকু করার করে ফেলেছো তুমি। অযথাই পড়ে আছো ওখানে। রুদ্র আসার আগেই এবার ফিরে এসো। এসে বউ খুঁজবে নাকি দল সামলাবে সেটা ডিসাইডস করতেই হিমশিম খাবে বেচারা।’

‘ কী করতে হবে সেটা আমার ওপরই ছেড়ে দাও। কখন কী করতে হবে, সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি।’

‘ তোমার করণীয় নিয়ে কিছু বলছিনা আমি। জাস্ট থাকার কারণটা জানতে চাইছি।’

‘ বলার প্রয়োজন মনে করছিনা আমি?’

‘ প্রয়োজন মনে করছোনা? কিন্তু আমি যদি বলি তোমার ফিয়োন্সি হিসেবে এইটুকু জানার অধিকার আছে আমার। তবে?’

নিজের গভীর তীক্ষ্ণ চোখজোড়া সম্রাটের চোখে রাখল প্রিয়তা। ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে বলল, ‘ষোল বছর বয়সের পর থেকে আমার জন্মদাতা বাবাও আমার কাছ থেকে কৈফিয়ত চাওয়ার সাহস করেনি সম্রাট। কথাটা আগেও বহুবার বলেছি তোমাকে। আজ আবার মনে করিয়ে দিলাম।’

আধ খাওয়া সিগারেটটা অ‍্যাশট্রেতে ফেলে দিল প্রিয়তা। হাত ভাজ করে বন্ধ করে ফেলল নিজের চোখজোড়া। অর্ধেকেরও বেশি শেষ হওয়া সিগারেটে টান দিতে দিতে প্রিয়তাকে দেখল সম্রাট। ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠল চাপা এক ক্রোধে। এই একটা মেয়ের সামনে কেমন একটা হয়ে যায় ও। হ্যাবলা টাইপ। যেখানে মশার মতো মানুষ খু*ন করতে পারে, সেখানে এই মেয়েটার সামনে ঠিকভাবে গুছিয়ে কথাও বলতে পারেনা সম্রাট। গুলিয়ে যায় সবকিছু। এটা রাণী মীর্জার প্রতি ওর চরম দুর্বলতারই পরিচয়। সেটা স্বয়ং রাণীও জানে। তবে সেটাযে কেবল একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্তই প্রযোজ্য তা জানেনা রাণী। যেদিন সেই সীমা অতিক্রান্ত হবে, সেদিন সম্রাটের হিংস্রতাও দেখবে। আপাতত আসন্ন আলোচনার বিষয়ে ভাবাটাই ভালো।

‘ ইকবালেরকে খু*ন করার কী দরকার ছিল?’

গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্নটা করল শওকত মীর্জা। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। উপস্থিত আছে করিম, পলাশ, শান এবং সম্রাট। প্রিয়তা বাদে সবার হাতেই আড্ডা জমার খোরাক, সিগারেট। সোফায় পায়ে পা তুলে বসে ফোন স্ক্রোল করছে প্রিয়তা । দৃষ্টি ফোনের স্ক্রিনে রেখেই বলল, ‘ যদি একটা শব্দও ঠিকভাবে উচ্চারণ করার সুযোগ পেতো তবে আজ তোমরা এখানে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারতেনা।’

‘ কিন্তু ওকে মাঝরাস্তা থেকে তুলে নেওয়ার সুযোগ ছিল আমাদের। তুমি বারণ করেছো তনুজাকে দিয়ে। কেন?’ প্রশ্নটা করল পলাশ।

ফোনের স্ক্রিন থেকে এবারও চোখ তুলল না প্রিয়তা। অদম্য সেই নির্বিকারত্ব বজায় রেখেই বলল, ‘ আটকে রেখেই বা কী অসাধ্য সাধনটা করেছো তোমরা। ছিলোতো এতোগুলো মাস। বার করতে পেরেছো পেট থেকে কিছু?’

এবার ফিচেল কন্ঠে আওয়াজ করে উঠল করিম, ‘ তাতে তোমার কৃপাতো কিছু কম নেই মা। গায়ে একটা ফুলের টোকাও দেওয়া যাবেনা। তিনবেলা গরম গরম গেলাতে হবে। তাহল মুখটা খুলবে কেন সে?’

রেগে গেল প্রিয়তা। ফোন থেকে চোখ সরিয়ে শক্ত চাহনী দিল করিমের দিকে। রাগী গলায় বলল, ‘সেটা বলেছি কটা দিনই হয়েছে। কিন্তু তার আগেতো নাক গলাইনি আমি। তখন কোন বা* ছিড়েছেন আপনারা? এতোদিনে কিছু ছিড়তে পারেনি, কটা দিনে কয়লা থেকে হিরে খুলে আনতেন চাঁদু।’

অপমানে কান লাল হয়ে উঠল করিমের। এই মেয়ের সঙ্গে মুখ লাগাতে যাওয়ার অপরাধে নিজেকেই অকথ্য এক গালি ছাড়লেন মনে মনে। থমথমে একটা পরিবেশ নেমে এলো ঘরটাতে। কেউ হাসি নিয়ন্ত্রণ করল, কেউ রাগ।
কিন্তু ইকবালের মৃত্যু নিয়ে হেলদোল নেই সম্রাটের। ও বুঝে গিয়েছিল ব্যাটা এমনিতেও মুখ খুলবেনা। রাণী না মারলে কবে যেন নিজেই মেরে ফেলতো ওকে।

মৃদু গলা ঝেড়ে শান বলল, ‘ আচ্ছা, আমার মনে হয় ইকবালেে এখন এতো মাথা না ঘামানোই ভালো। এমনিতেও বলছিলনা কিছু। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। আপদ বিদেয় হয়েছে একটা। খুঁজেতো দেখেছিলাম আমরা ওর গোটা ঘর। পাইনি কিছু। মনে হয়না অন্যকেউ পাবে।’

মাথা নাড়লেন শওকত, ‘ ব্যাপারটা এতো সহজ নয়। ঐ পেনড্রাইভটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ বোঝার ক্ষমতা নেই তোমাদের। এক হাতে পড়লে_’

শওকতের কথায় বাঁধা দিল সম্রাট, ‘এখন এটা নিয়ে না ভেবে আমার মনে হয় রুদ্রকে নিয়ে ভাবা উচিত। পরশু দুবাই গেছে ও। কেন? এই মুহূর্তে ওর এই মুভটা সবচেয়ে বেশি আনএক্সপেক্টেড।’

সিগারেট ছোট্ট একটা টান দিয়ে শওকত বলল, ‘ ওর মুভ সব বরাবরই আনএক্সপেক্টেড হয়।’ অতঃপর প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমাকে কিছু বলে গেছে?’

প্রিয়তা ভাবলেশহীনভাবে বলল, ‘ দুটো দলের লীডারের সঙ্গে না-কি মিটিং আছে। মাইক্রোফোনের রেকর্ডে ওদের বৈঠকঘরের আওয়াজ শুনে জেনেছি দলদুটো বিধারাত আর ক্রুইট।’

ভ্রু কুঁচকে গেল উপস্থিত বাকি সবারই। সম্রাট চিন্তিত গলায় বলল, ‘ ক্রুইট দুবাই আসছে?’

‘ মাইক্রোফোনের মাধ্যমে জানতে পারছোনা কিছু? ওখানে কী ঘটছে?’

প্রিয়তা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল নিজের কাকার দিকে। দাঁতে দাঁতে চেপে বলল, ‘ মাইক্রোফোন ওটা। ডোরেমনের গ্যাজেট না।’

শওকত মীর্জা ধমকে পলাশকে থামিয়ে বলল, ‘ওসব টেকনিক্যাল ব্যপার। তুই বুঝবি না। এখন ভাবার বিষয় হচ্ছে আমাদের করণীয় কী।’

করিম তাজওয়ার অসন্তুষ্ট গলায় বলল, ‘করারতো অনেককিছুই ছিল। কিন্তু অনেকের অনেক রেস্ট্রিকশন আছে কি-না।’

কথাটা বলে আড়চোখে তাকাল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা সেদিকে পাত্তাও দিলোনা। শান বলল, ‘ আমার মনে হয় আমাদের ডেলিভারীর কাজটাতে এখন মন দেওয়া উচিত। রুদ্রর ব্যপারে কী করব সেটা রুদ্র ফিরে আসার পর-ই ভাবা সম্ভব। ওর পরবর্তী পদক্ষেপ দেখার পর।’

মৌন থাকল উপস্থিত সবাই। অর্থাৎ এটাই আপাতত সবচেয়ে কার্যকারি সিদ্ধান্ত। চুপচাপ সিগারেট টানায় মনোযোগ দিল সবাই। সেই মৌনতা থাকল টানা তিনমিনিট। তিনমিনিট পর হঠাৎই প্রিয়তা বলে উঠল, ‘তাজওয়ার সাহেব? আপনাদের দলে একটা ছেলে ছিলোনা? কী যেন নাম?’ মনে করার ভান করল প্রিয়তা, ‘ হ্যাঁ, রাতুল। কোথায় সে?’

পিনপতন নীরবতা নেমে এলো ঘরটাতে। থম মেরে তাকিয়ে রইল করিম তাজওয়ার। চমকে উঠলেন শওকত মীর্জাও। এদিকে সম্রাটের হৃদপিণ্ডে যেন হাতুরির বাড়ি পড়েছে। করিম কোনরকমে বলল, ‘ক-কেনো? হঠাৎ ওর খোঁজ করছো যে?’

‘ না, অনেকদিন হল দেখছিনা। তাই জিজ্ঞেস করলাম।’

‘ দলের পাতি সদস্যদের নিয়ে হঠাৎ এতো ভাবছো যে?’ থমথমে গলায় প্রশ্নটা করলেও ভেতরে ভেতরে ভয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে সম্রাট।

সোফায় হেলান দিল প্রিয়তা। ঠোঁটে রহস্যময় এক বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘ বেশ পছন্দ হয়েছে ওকে আমার। অ‍্যাসিস্টেন্ট করতে চাই ওকে। আমার সঙ্গে একটু দেখা করতে বলবেতো।’

কারো মুখে কথা জোগালো না। উঠে দাঁড়াল প্রিয়তা। সকলের উদ্দেশ্যে বলল, ‘ রুদ্রর আসতে এখনো কয়েকদিন বাকি। এরমধ্যেই যোগাযোগ করতে বলবেন রাতুলকে আমার সঙ্গে। নয়তো আমি করব। আর আমি করলে ব্যপারটা আরও জঘন্য হবে।’

শেষ বাক্যটা বলার সময় সম্রাটের দিকে অদ্ভুত এক আক্রোশ নিয়ে তাকাল প্রিয়তা। অতঃপর পা বাড়ালো নিজের রুমের দিকে। চেঞ্জ করে আমের ভিলায় ফিরবে ও।
সাদা কাগজের মতো ফ্যাকাশে মুখটাতে রঙ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল করিম। শওকতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ মেয়েকে থামান কিন্তু মীর্জা। ঐ দুটোর মতো রাতুলকেও যদি আবার..’

হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল শওকত, ‘ কিছু করার নেই। রাতুলকেও খরচের খাতায় ফেলে দাও।’

*

গাড়ি ড্রাইভ করে আমের ভিলার উদ্দেশ্যে যাচ্ছে জয়। পেছনের সিটে বসে আছে প্রিয়তা। দুপুর হয়ে গেলেও কুয়াশায় ঢেকে আছে সূর্য। চারপাশটা একদম সাদাকালো সিনেমার মতো। গাড়ির জানালা দিয়ে হঠাৎ তীব্র ঠান্ডা বাতাস এলো। চোখ বন্ধ করে ফেলল প্রিয়তা।


কক্সবাজারে ঘুরতে যাওয়ার সেই সময়ের কথা। যাওয়ার উদ্দেশ্য ভিন্ন থাকায় রুদ্র সময় দিতে পারছিলনা প্রিয়তাকে। ফলসরূপ একদিন রাতে যখন রুদ্র ফেরে, ডিনারের পর হোটেলের ছাদে যাওয়ার বায়না করে প্রিয়তা। সারাদিন সময় দিতে পারেনা মেয়েটাকে, তাই একবাক্যে রাজি হয়ে যায় রুদ্র। সেদিন রাতে খুব সুন্দর সময় কাটিয়েছিল ওরা।
বাবলস্ লিকুইড দিয়ে অসংখ্য বাবলস্ তৈরী করে উদ্দেশ্যহীনভাবে আকাশে ছুড়ে দিচ্ছিল প্রিয়তা। খিলখিল করে হাসছিল। হাত ভাজ করে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেই দৃশ্য দেখছিল রুদ্র। রুদ্রর দৃষ্টি দেখে দুষ্টুমি দেখে দুষ্টুমি খেলে যায় প্রিয়তার মাথায়। একগাদা বাবলস্ ফু দিয়ে ছুড়ে মারে রুদ্রর মুখে। চমকে ওঠে রুদ্র। অতঃপর হেসে পেলে প্রিয়তার কান্ডে। প্রিয়তাকে তাড়া করে ও। প্রিয়তাও নিজেকে বাঁচাতে ছোটে ছাদের এদিক সেদিক। শাস্তিসরূপ সুরসুরি দিয়ে অস্থির করে তোলে ওকে। অতঃপর একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দেখে আকাশের গোল মশ্রিন চাঁদ।
সুইমিংপুলের পানিতে পা ভিজিয়ে বসে দুজন। প্রিয়তার রুদ্রর কাঁধে মাথা রেখে তাকাতে থাকে আকাশের দিকে। তখনও প্রিয়তা সন্দেহ করছিল ও প্রেগনেন্ট। তাই হুট করেই রুদ্রকে বলে, ‘ আচ্ছা রুদ্র। আমরা আমাদের বাচ্চা, নাতি-নাতনিসহ ধুমকেতু দেখব বলেছিলাম। মনে আছে আপনার?’

‘ আছে। কেন?’

‘ আপনি মেয়ে চান নাকি ছেলে?’

ভ্রু কোঁচকায় রুদ্র, ‘ হঠাৎ এসব প্রশ্ন কেন প্রিয়তা?’

‘ বলুন না?’ কন্ঠে বিরক্তি ঢেলে বলে প্রিয়তা।

‘ আমার মেয়ে চাই। তোমার মতো। মিষ্টি একটা রাজকন্যা।’

রুদ্রর উত্তর ভালো লাগেনা প্রিয়তার। অস্থিরতা আর অসন্তোষ নিয়ে বলে, ‘না মেয়ে না। আমার মতোতো একদমই না। আমি চাইনা আমার মেয়ে হোক। আমার মতো হোক। আমাদের ছেলে হবে। ঠিক আপনার মতো। আমার রাজপুত্র।’

অন্যমনস্ক থাকায় প্রিয়তার অস্থির ভাবটা খেয়াল করেনা রুদ্র। ওর মাথায় চুমু খেয়ে বলে, ‘বেশ, সময় এলেই দেখা যাবে সেটা।’

লম্বা করে শ্বাস ফেলল প্রিয়তা। রাতুল! ঐ ছেলেটাক চাই ওর। রুদ্র আসার আগেই চাই। রুদ্রর রাতুলকে খুঁজে পেতে সময় লাগলেও প্রিয়তার লাগবেনা। কারণ রাতুল ওদেরই দলের লোক। তাই পালাতে হল বা গা ঢাকা দিতে হলে ওদের দলেরই কারো না কারো সাহায্য নিতে হবে। আর জয় এবং তনুজা দলের প্রত্যেককে হাতের তালুর মতো চেনে। সুতরাং খুঁজে পেতে বেগ পেতে হবেনা ওকে। ও শুধু অপেক্ষা করছিল রুদ্রর দূরে কোথাও যাওয়ার। নিশ্চিন্তে কাজ করার একটা সুযোগের।

আস্তে করে চোখ খুলে তাকাল ও। জয়ের দিকে তাকিয়ে বলর, ‘ রাতুলের খোঁজটা যত দ্রুত সম্ভব চাই আমি। তনুজাকেও বলে দিও সেটা’

‘ জি ম্যাম।’

‘ আর সেটাও তোমার স্যার ফেরার আগে।’

‘ জি।’

গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দেয় জয়। মিররে একবার দেখে প্রিয়তার মুখের দিকে। সেখানে ঘায়েল কোন সিংহিনীর আক্রোশ দেখতে পাচ্ছে ও।

*

রাত বারোটা। থমথমে এক পরিবেশ। লালচে ডিম লাইটের আলো ছড়িয়ে আছে রুমজুড়ে। স্তব্ধ রুমটাতে কিছুক্ষণ আগেই ঘন নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ চলছিল। অশ্লীল শব্দ আর উন্মাদনায় মেতে ছিল যুবক-যুবতি। যুবকটি আর কেউ নয়, সম্রাট তাজওয়ার।

উঠে বসে হেডরেস্টে হেলান দিল সম্রাট। হাত বাড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করল। ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরল ঠিকই কিন্তু লাইটার দিয়ে জ্বালানোর আগেই হারিয়ে গেল গভীর ভাবনায়। শরীরের তৃপ্তি মিটলেও মন অশান্ত ওর। আজকে রাণীর বলা কথাগুলো অস্থির করে তুলেছে একপ্রকার। রাতুলকে যদি কোনভাবে রাণী পেয়ে যায়? যদি জানতে পারে সম্রাট-ই রাতুলকে দিয়ে সেদিন, সেই হস্পিটালের সিঁড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলিয়েছিল ওকে? নষ্ট করিয়েছিল ওর বাচ্চাটা? কী হবে তখন? কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবে রাণী? কতটা রিঅ্যাক্ট করবে? রাণীর প্রতিক্রিয়া পুরোপুরিভাবে অনুমান করতে না পারাটাই বেশি অস্থির করছে ওকে।

সেন্টু আর বুলেটের কথা মনে পড়তেই গলা শুকিয়ে এলো সম্রাটের। ওর চোখের সামনে কী ভয়ংকরভাবে খু*ন করেছিল রাণী ওদের। ওদের অপরাধ ছিল, দলের অর্ডার মাথায় না রেখে রে*প করেছিল ওরা রাশেদ আমেরের ঐ মেয়েকে। যাতে ওদের খুব বেশি ক্ষতি না লাভই হয়েছিল। কিন্তু রাণী কী করল? কী নৃ*শংসভাবে মারল ওদের। এমনিতে মারধোরতো চলছিলই। প্রথমে জিহ্বা কে*টে ফেলল দুজনের। চোখের পলকে। ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে। এরপর হাতের কবজি! অ*ন্ডকোষ থেতলে দিল কী নির্মমভাবে। ওদের সজ্ঞানে রেখেই কে*টে ফেলল দুজনের পু*রু*ষাঙ্গ। এককটা আঘাতে রক্ত ছিটকে ছিটকে সারা শরীরে মেখে যাচ্ছিল প্রিয়তার। কী বিভৎস দৃশ্য! এরপর গিয়ে গরম শিক দিয়ে দুজনের চোখদুটোই গেলে দিল। সেন্টু আর বুলেটের আকাশ কাঁপানো চিৎকার এখনো কানে বাজে সম্রাটের। শেষমেশ মৃত্যু আঘাতটা করেছিল ঠিক কলিজায়। উফফ! ভাবলেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সেখানে রাতুল? রাতুলতো ওর বাচ্চাকে মেরেছে! কী অবস্থা হবে ওর? ফোনটাও বন্ধ পাঠার। ওকেও দোষ দেওয়া যায়না। সম্রাট নিজেই বলেছিল সবকিছু বন্ধ করে গা ঢাকা দিতে। কিন্তু রাণী মীর্জা ওকে পেয়ে গেলে কী হবে?

গ্যাসলাইট জ্বলার আওয়াজে ভ্রুজোড়া কুঁচকে উঠল সম্রাটের। পাশের মেয়েটা জ্বালিয়ে দিয়েছে ওর ঠোঁটে গোজা সিগারেটটা। কিছু বলল না সম্রাট। চোখ ছোট ছোট করে টান দিল কেবল একটা। একটা গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে সম্রাটের হাতে ধরিয়ে দিল মেয়েটা। কাঁধ জড়িয়ে ধরে গলায় নাক ঘষল। কোনরকম কোন প্রতিক্রিয়া দেখালনা সম্রাট। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে চুমুক দিল গ্লাসে। ভ্রুকুটি করে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে ভাবল, শান সেদিন ঐ দুটোর কাছে আমেরের মেয়েকে রেখে গিয়েছিল। ভুল করে। তাতেই এখনো শানের সঙ্গে ঠিক করে কথা বলেনা প্রিয়তা। সেখানে ওতো সরাসরি বাচ্চাটাকে শেষ করার অর্ডার দিয়েছিল। ওর প্রতিইবা কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে সে? তাছাড়া সম্রাটের অপরাধতো একটা না…

মীরা! শওকত মীর্জার কর্মচারীর মেয়ে। প্রিয়তার বোর্ডিংয়ের সেই বান্ধবী। প্রিয়তা জানে ওকে খু*ন করেছে সম্রাট। লা*শটা ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়ে সকলের চোখে বানিয়েছে সু*ই*সাইড। ব্যপারটায় কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেও বেশি ঝামেলা করেনি প্রিয়তা। কারণ মীরা ছিল প্রিয়তার সত্যি জানা সবচেয়ে সহজ-সরল সাক্ষী। যে পুরো সত্যিটা জানতোনা। তাই ওর বেঁচে থাকাটা সত্যিই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।
কিন্তু প্রিয়তা এটা জানেনা, মীরাকে গলা টিপে খু*ন করার আগে ধ*র্ষ*ণও করেছিল সম্রাট। পরপর দু’বার!

#চলবে…

[ রি-চেইক করিনি। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here