অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ১০৪.

0
56

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

১০৪.

নিজস্ব ধারায় কলকল করে বয়ে চলেছে তুরাগ নদী। শীতকাল, তাই নদীর প্রস্থ সংকীর্ণ। বিরুলিয়া ব্রিজের ওপর পা ঝুলিয়ে, নদীর দিকে মুখ করে বসে আছে রুদ্র। উদাস চোখে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। আবছা কুয়াশায় ধূসর দৃশ্যপট। অথচ বেলা হয়েছে অনেকটাই। আপাতত কোন কাজ নেই ওর। চাইলে ফিরে যেতে পারে আমের ভিলায়। কিংবা প্রিয়তাকে যেখানে বন্দি করে রেখেছে, সেখানে। কিন্তু ইচ্ছে করছেনা। রাজা থেকে যেদিন পরিপূর্ণ রুদ্র আমের হয়ে উঠল; সেদিনই নিজেকে নিয়ে ভাবা ছেড়ে দিয়েছিল। একান্ত সময়টাতে হয় বিশ্রাম নিয়েছে, নয়তো দলীয় কাজের চিন্তায় ডুবিয়ে রেখেছে নিজেকে। আর যবে থেকে প্রিয়তা এলো। অবশিষ্ট সেই সময়টুকু মেয়েটাকে ভালোবেসেছে রুদ্র। প্রচণ্ড ভালোবেসেছে। মায়ের পরে অন্যকোন নারীকে এতোটা ভালোবাসতে পারেনি ও। কিন্তু আজ হঠাৎ, বহুবছর কিছুটা সময় নিজেকে দিতে ইচ্ছে করছে ওর। শুধুই নিজেকে।
চাপা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল রুদ্র। জ্যাকেটের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। দক্ষ হাতে ধীরেসুস্থে ধরিয়ে নিল একটা সিগারেট। লম্বা এক টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শীতল, তীক্ষ্ম এক বাতাস এলো উল্টোদিক থেকে। নিকোটিনের ধোঁয়াগুলো এসে আঘাত করল চোখমুখে। চোখটা সামান্য জ্বলে উঠল রুদ্রর। সামনের দৃশ্যপট হয়ে উঠল আরও ধোঁয়াশাময়। চোখের সামনে ভেসে উঠল অপূর্ব সুন্দর একজোড়া চোখ। প্রিয়তা, ওর বিবাহিত স্ত্রী। ঐ মেয়েটা ওর জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যি। সে যেমন সত্যিই হোক। যে ওর হৃদয়ের স্পন্দন হয়ে এসেছিল। রুদ্রর আজও মনে পড়ে সেই জঙ্গলে ঘেরা শীতল, নির্জন রাতটা। যেদিন রুদ্রর প্রবাহমান জীবনে স্থিরতা এসেছিল প্রিয়তা। থমকে গিয়েছিল রুদ্র আমের। প্রথমবার। এরপর? এরপর সবটাই যেন ঘটল স্রোতের বিপরীতে। অমন কট্টর প্রেম বিরোধী হৃদয়ে কীকরে যেন ভালোবাসার জন্ম হল। সেও এমন তীব্র ভালোবাসা যা সব এলোমেলো করে দিল রুদ্রর। যা কোনদিন হওয়ার ছিলোনা তাই হল। বিবাহ নামক বৈধ এক সম্পর্কে জড়ালো। টানা দুটো বছর মেয়েটাকে অসম্ভব যত্নে, ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে রেখেছিল রুদ্র। প্রিয়তাও যেন বিনা শর্তে নিজের সর্বস্ব সমর্পন করে দিয়েছিল রুদ্রর কাছে। অন্তত রুদ্র তাই অনুভব করেছে। প্রত্যেক দিন একটু একটু করে সাজিয়েছিল ওদের ভালোবাসার মহল। রুদ্র-প্রিয়তার সুখমহল। সেই মহলে রাজা ছিল, রাণী ছিল। আকাশের মতো অসীম, সাগরের মতো গভীর ভালোবাসা ছিল। একটা ছোট্ট রাজকন্যা কিংবা রাজকুমার আসার স্বপ্ন ছিল। সেইসব স্বপ্ন নিয়ে দুইবছরে একটু একটু করে সাজিয়েছিল ওরা সেই সুখমহলকে।

কিন্তু হঠাৎই এক দমকা হাওয়ায় নড়ে উঠল সেই মহল। চমকে উঠল রুদ্র। বাস্তবতা নামক তিক্ত সত্যর ঘ্রাণ আবছা হয়ে নাকে ধাক্কা লাগল। সেইদিন! যেদিন মিসক্যারেজের পর প্রথমবার প্রিয়তাকে ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিল রুদ্র। স্কুলের গেইটের সামনে। প্রিয়তার জেদ আর রুদ্রর ক্রোধের মিশ্রণে তর্ক শুরু হল দুজনের মাঝে। আর সেই তর্কের মাঝেই হঠাৎ প্রিয়তা বলে ওঠে, ‘নিজের বোনকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন? বাবাকে বাঁচাতে পেরেছিলেন? আর আমার রাজপুত্র? ওকে বাঁচাতে পেরেছিলেন? রঞ্জুকেও ম-রতে হলাে। পেরেছেন বাঁচাতে? অথচ এটা ভাবছেন যে আপনি আমাকে বাঁচাতে পারবেন। চমৎকার!’

রুদ্রর মস্তিষ্ক তখন অন্যভাবে চলছিল। সবদিক থেকে বিদ্ধস্ত রুদ্র জানতো ওকে ধোঁকা দেওয়া হয়েছে। আর সেটা দিয়েছে ওর খুব কাছের কেউ। গুপ্ত সেই শত্রুর খোঁজে সদা সজাগ ছিল ওর মস্তিষ্ক। সজাগ সেই মস্তিষ্কে সঙ্গে সঙ্গে ধাক্কা লাগে “রঞ্জুকেও মরতে হল” কথাটা। রুদ্রর স্পষ্ট মনে আছে রঞ্জু মারা গেছে এমন কথা সে কাউকে বলেনি। এমনকি বৈঠকঘরে উচ্ছ্বাস কিংবা জাফরকেও বলেনি। ওর আহত হওয়ার খবরটাও ডাক্তার রতন ছাড়া আর কেউ জানেনা। তাহলে প্রিয়তা কীকরে জানলো? প্রশ্নটা খচ করে বেঁধে রুদ্রর মনে। তর্কে মেজাজ হারিয়ে ফেলা রুদ্র মুহূর্তেই শান্ত হয়ে যায়। ঠান্ডা হয়ে প্রিয়তাকে প্রশ্ন করে সে কী চায়। উত্তরে প্রিয়তাও নিজের ইচ্ছা জানায়। যা সে আগেও বলেছে।
সংশয়ের শুরুটা আসলে সেদিন থেকেই। কিন্তু এটুকুতেই নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীকে সন্দেহ করতে পারছিলনা রুদ্র। ঐসময় রুদ্রর মনে হল, কথার ধারাবাহিকতায় বেরিয়ে গেছে মুখ দিয়ে। কিংবা রুদ্রর কথায় প্রিয়তার মনে হয়েছে রঞ্জু মারা গেছে। কিন্তু অজানা এক কারণেই ব্যপারটা চেপে যায় রুদ্র। প্রশ্ন করেনা। অবচেতন মনে নিজের মৌনতা দিয়েই হয়তো প্রিয়তার জন্যে প্রথম ফাঁদ পেতেছিল রুদ্র সেদিন।

এরপর কুহু-নীরবের বিয়ে ঠিক হয়। রুদ্র তখন চাইছিল প্রিয়তা ফিরে আসুক আমের ভিলায়। তবে সেটা শুধুমাত্র ওর নিরাপত্তা বা কাছে রাখার জন্যে না। সেদিন খচ করে বেঁধা প্রশ্নটার অস্থিরতা যাচ্ছিলনা রুদ্রর ভেতর থেকে। সচেতন মস্তিষ্ক বারবার বলছিল কিছু একটা ঘটছে ওর অগোচরে। সেই অস্থিরতা ঘোঁচানোর জন্যে নিজে একবার প্রিয়তাকে বাজিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয় ও। সেকারণেই রুদ্র কুহুকে বলে, প্রিয়তাকে গিয়ে নিয়ে আসতে। কারণ রুদ্র জানতো একমাত্র কুহুই পারে প্রিয়তাকে নিয়ে আসতে। আর ওর ধারণাই সঠিক ছিল। সফল হয় কুহু। কুহুর বিয়ে উপলক্ষ্যে হলেও ফিরে আসে প্রিয়তা।
প্রিয়তা ফিরে আসার পর বাজিয়ে দেখার কাজটা করতে সময় নেয়না রুদ্র। ঐদিন রাতে ফিরে প্রিয়তাকে দেখেই ভেবে নেয় সচেতন মনে প্রথম চালটা ঠিক কীভাবে দেবে। তবে রুদ্র মনে-প্রাণে চাইছিল সংশয়ের সেই বিজটা সেখানেই মুষড়ে পড়ুক। সেটা চারায় পরিণত না হোক। সেই আশা নিয়েই হুট করে কথার মাঝে রুদ্র বলে বলে বসে, রাশেদ আমেরকে বি*ষ দিয়ে খুন করা হয়েছে। কথাটা বলে খুব সুক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করে প্রিয়তার প্রতিক্রিয়া। কারণ রাশেদের মৃত্যুটাযে স্বাভাবিক না সেটাও একমাত্র রঞ্জু জানতো। সে ছাড়া আর একজনের পক্ষেই জানা সম্ভব ছিল এই কথা, স্বয়ং রাশেদের খুনি। কিন্তু প্রিয়তার মধ্যে চমকে ওঠার কোন লক্ষণ দেখতে না পেয়ে ভেতরে ভেতরে ভয়ংকরভাবে চমকে ওঠে রুদ্র। প্রিয়তাকে বুঝতে না দিলেও মনের মধ্যে ঝড় বইতে থাকে ওর। প্রকাশিত সূর্যের মতোই পরিষ্কার হয়ে যায় প্রিয়তা এমন আরও অনেককিছু জানে। এবং সেটা মোটেও কোন ভালো উদ্দেশ্যে না। কারণ ভালো উদ্দেশ্যে আর যাই হোক রুদ্রর কাছ থেকে এভাবে কিছু লুকিয়ে যাওয়ার মানে নেই। তাও এরকম এক বিষয়ে। ভয়ংকর হলেও সত্যিটা বুঝে ফেলল রুদ্র। তবে মনকে মানাতে পারল না কিছুতেই।

কুয়াশার ধূসরতায় আরও খানিকটা নিকোটিনের ধোয়া উড়িয়ে দিয়ে দিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিল রুদ্র। নিজের প্রতি এমন তাচ্ছিল্য আগে কখনও আসেনি ওর। এ ঘটনার পরেও রুদ্র পুরোপুরি অবিশ্বাস করতে পারেনি প্রিয়তাকে। সন্দেহের বিজ তখন চারায় রূপ নিয়েছে। তাতে মাঝেমাঝে নিজেকে অপরাধী ভাবতো ও। নিজের প্রিয়কে সন্দেহ করতে বিবেক বাঁধা দিতো। মস্তিষ্ক সংকেত দিলেও মন মানতে চাইছিল না। বরং মন মস্তিষ্ককে বোঝাতো, হয়তো প্রিয়তা কথাটা সেভাবে খেয়াল করেনি। উত্তেজিত ছিল তখন, হতেই পারে! এই দ্বিধাদন্দেই একেকটা দিন পাড় হচ্ছিলো রুদ্রর। কিছুতেই কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছিলনা। মানসিক অশান্তিতে বেশিরভাগ সময়ই মেজাজ খারাপ থাকতো ওর। যার কারণে প্রিয়তার সঙ্গে স্বাভাবিক থাকার আহামরি কোন চেষ্টা ও করেনি।

সন্দেহের সেই চারাটা ডালপালা মেলল কুহুর হলুদের দিন রাতে। সেদিন রাতে যখন আগ বাড়িয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে প্রিয়তা বেরিয়ে গেল, এবং ওকে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে রাস্তায় দেখল। রুদ্র সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলল কোন পরিকল্পনা ছিল সেদিন প্রিয়তার। নয়তো আর যাই হোক ঝগড়ার নাম করে মাঝরাতে বাড়ি থেকে বের হতোনা সে। কিন্তু চুপ ছিল তখনও। ওদের নিয়ে বাড়ি ফিরে যখন গ্লাসে ঢেলে রাখা পানি খেল, পানির সামান্য উট্কো স্বাধ স্পষ্টই টের পেয়েছে রুদ্র। তবুও থামেনি। ইচ্ছে করেই শেষ করেছে পুরোটা। তবে শুয়ে পড়ার আগে করেছে একটা ছোট্ট কাজ। নিজের ফোনের ক্যামেরায় ভিডিও রেকর্ডার অন করে বালিশের সঙ্গে এমনভাবে রেখেছে যাতে দরজার দিকটা স্পষ্ট রেকর্ড হয়ে যায়। হয়েছেও তাই। পরেরদিন সারাদিন কুহুকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ভিডিওটা চেইক করা হয়না রুদ্রর। চেক করে একেবারে রাতে। সব কাজ সেড়ে যখন রুমে যায়, তখন। আর সেই রেকর্ডিং ওকে জানায়, ওর ধারণাই ঠিক ছিল। মাঝরাতে বেরিয়েছে প্রিয়তা। আর এটাও বুঝে ফেলল ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে ওকে। ভেতর থেকে সেদিনই কেমন মুষড়ে পড়ে রুদ্র। একের পর এক প্রকাশিত সত্য মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে ওকে। ওর প্রিয় ওকে ঠকাচ্ছে। খুব বাজেভাবে ঠকাচ্ছে। এই নিদারুণ সত্যটা এতোদিন নানা অযুহাতে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও সেদিন আর পারেনা। সত্য মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা ওর কাছে। ফোনটা হাতে নিয়ে স্থির হয়ে বসে থাকে আধঘন্টা। মনে হয় কেউ মুচড়ে ধরে রেখেছে হৃদপিণ্ডটা। চোখ ভয়ংকরভাবে জ্বলতে থাকে একফোঁটা অশ্রুর আশায়। রুদ্রর সেই সুখমহলকে নিতান্তই তাসের ঘর ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না। ওর মনে হয় ওর সুখমহল ভেঙে গুড়িয়ে গেল। ওর চোখের সামনে। কিছুই করতে পারল না ও। কিছুই না।
নিজের সর্বোচ্চ মানসিক শক্তি নিয়ে যখন রুদ্র নিজেকে সামলাচ্ছে। ভেতরের তীব্র যন্ত্রণাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। সেমুহূর্তে ওর জন্যে খাবার নিয়ে আসে প্রিয়তা। রুদ্রর ইচ্ছে করছিল তখনই চেপে ধরতে মেয়েটাকে। এমন ভয়ংকর ছলনা আর বিশ্বাসঘাতকতার জবাব চাইতে। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রুদ্র। কারণ তখনও ওর আরও অনেককিছু পরিষ্কার হওয়া বাকি। প্রিয়তা ওকে ঠকাচ্ছে সেটা পরিষ্কার হলেও ঠিক কী নিয়ে ঠকাচ্ছে, কেন ঠকাচ্ছে আর কতখানি ঠকাচ্ছে, তা তখনও জানা বাকি ছিল। প্রিয়তা যখন ওকে খাইয়ে দিচ্ছিল তখন পলকহীন চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল রুদ্র। মন বারবার প্রশ্ন করছিল সবটাই অভিনয়? সবটাই ছলনা? এই দুটো বছরের সংসার, ভালোবাসা সবকিছুতে শুধুমাত্র ওই ছিল। প্রিয়তা কোথাও ছিলোনা? কোথাও না? ভেতরে ভেতরে সবকিছু গুড়িয়ে যাচ্ছিল রুদ্রর। কিন্তু রাশেদ আমেরের সেই শিক্ষাটাই যেন জাদুর মতো কাজ করল সেদিন। ছোট রাজার চোখের সামনে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ, তার মায়ের শেষ স্মৃতি নষ্ট করেও তাকে কাঁদতে না দিয়ে যে ভয়ংকর রুদ্র আমেরেকে তৈরী করেছিল। সেই রুদ্র আমের এমন বিভৎস ধাক্কার পরেও শক্ত থাকল। ভেতরে ভেতরে চূর্ণবিচূর্ণ হয়েও অটল পাহাড়ের মতো দৃঢ় রাখল নিজেকে। কিন্তু প্রিয়তা যখন ওর বুকে মাথা রেখে আবেগি কথা বলছিল। অসম্ভব যন্ত্রণায় ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছিল ওর। চাপা রাগ, দুঃখ, যন্ত্রণাকে দমিয়ে রাখতে না পেরে সেদিন প্রিয়তাকে ছুঁয়েই করে ফেলল এক ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা। বলল, সেই বিশ্বাসঘাতক যেই হোক, তার বিনাশ রুদ্রর হাতেই লেখা আছে।

এরপরেই প্রিয়তার বাইরে বের হওয়া বন্ধ করে রুদ্র। কোন কারণে বের হলেও পাহাড়ায় রাখে রাজুকে। কিন্তু প্রিয়তার আসল উদ্দেশ্য তখনও ধরতে পারেনা। মাঝখানে ডেলিভারি আর ডিলের টাকা জোগাড়ের ঝামেলায় সবদিকে পরিপূর্ণ নজর দেওয়া সম্ভব হয়না কোনভাবেই। কিন্তু ঝামেলাটা হয় তখন, যখন পুনরায় লিক হতে থাকে বৈঠকঘরের ভেতরকার খবর। উধাও হতে থাকে একের পর এক ডোনাররা। বিষয়টা নিয়ে একদিন বৈঠকঘরে বসে চিন্তা করতে থাকে রুদ্র। একা। ঘরে জ্বলছিল শুধুমাত্র একটা টেবিল ল্যাম্প। কেউ কীকরে সবটা জানছে? সে যদি প্রিয়তাও হয় সেই বা জানবে কীকরে? বৈঠকঘরে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। পাহারাও থাকে সবসময়। তাহলে কীকরে? সারা বৈঠকঘরে যে কোন ডিভাইস নেই তা তন্নতন্ন করে খুঁজে নিশ্চিত হয়েছে রুদ্র। জাফর, এমনকি উচ্ছ্বাসের সঙ্গেও সবসময় একটা করে মাইক্রোফোন আছে। ওরা সেটা প্রকাশ করলেও জেনে যাবে রুদ্র। তবে? বাকি কে থাকে। ও নিজে!
ব্যপারটা সঙ্গেসঙ্গে ধাক্কা দেয় রুদ্রর মগজে। ও নিজে! অর্থাৎ ওর সঙ্গেই এমনকিছু আছে যা দিয়ে ভেতরের সব পরিকল্পনা বাইরে যাচ্ছে! নিজের দিকে একবার তাকায় রুদ্র। এমনকিছু যা সবসময় ওর সঙ্গে থাকে। উত্তরটা জ্বলজ্বল করতে থাকে ওর বাঁ হাতে। প্রিয়তার দেওয়া সেই ব্রেসলেট। যা ও সবসময় পড়ে। স্নান আর রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময়টা বাদে। জিনিসের সঙ্গে নামের সংযোগটাও পরিষ্কার! সময় নষ্ট না করে সঙ্গে সঙ্গে ব্রেসলেটটা খোলে রুদ্র। চারদিকে খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করেও কোন ডিভাইস পায়না। কিন্তু কিছুতো অবশ্যই আছে। হঠাৎই রুদ্রর চোখ পড়ে মাঝের পাথরটার দিকে। জিনিসটা অনেকটা লকেট সিস্টেমের মতো। একটু কষ্ট করলে খোলা যায়, তবে ভেঙে যাওয়ার ভয় থাকে। সেকারণেই অতীতে কখনও খোলার চেষ্টা করেনি রুদ্র। কিন্তু আজ আর বসে থাকল না। খুলে ফেলল ওপরের পাথরটা। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে দৃশ্যমান হল খুবই ছোট একটা মাইক্রোফোন। সেটাকে বৃদ্ধা আর তর্জনী আঙুল দিয়ে হাতে তুলল রুদ্র। চোখের সামনে তুলে ধরল ছোট্ট সেই ডিভাইসটা। সেই সঙ্গে পুরোপুরি গুড়িয়ে গেল রুদ্রর সেই সুখমহল।
তিক্ত এক হাসি ফুটে উঠল রুদ্রর। সেই হাসিতে ছিল জঘন্যভাবে ঠকে যাওয়ার অসীম যন্ত্রণা। অপলক চোখে ও কেবল দেখেই গেল ডিভাইসটা। যে হৃদয়ে ঐ মেয়েটার জন্যে আকাশসম ভালোবাসা পুষে রেখেছিল। সে হৃদয়টা কোন প্রশিক্ষণের ধার ধারল না আর। টপ করে এক ফোটা জল গড়িয়ে নামল চোখ দিয়ে। সেদিন রুদ্র স্পষ্ট বুঝল, প্রিয়তা কেন এসেছে আমের ভিলায়। কেন বিয়ে করেছে ওকে। শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্যেই রুদ্রর কাছে নিজেকে সমর্পন করেছিল প্রিয়তা। গোটা ব্যপারটায় কোথাও ভালোবাসা ছিলোনা। কোথাও না। যে মেয়েটাকে গভীর প্রনয়ে ও বুকে আগলে রেখেছিল। সে মেয়েটাই খুব দক্ষভাবে আঘাত করেছে ওর হৃদপিণ্ডে। বুকে মাথা রেখে পিঠে ছু*রি বসিয়েছে সে। আর রুদ্র! রুদ্রও অন্ধের মতো শুধু ভালোবেসে গেছে। বিশ্বাস করে গেছে। হাজারটা আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েও মেয়েটাকে দুহাতে আগলে রেখেছে। সবকিছু হারিয়েও যেই অবলম্বনটুকু আগলে রুদ্র স্বাভাবিক জীবনে ফেরার স্বপ্ন দেখছিল; সে এসেছিলই ওকে ধ্বংস করতে। এই ভয়াবহ, নিদারুণ সত্য হজম সহজ ছিল রুদ্রর কাছে? কখনই না। সারারাত সেদিন বৈঠক ঘরেই কাটিয়ে দেয় রুদ্র। পাগলের মতো ছটফট করে। যাকে ভালোবেসে ও সব করেছে সে তাকে কখনই ভালোবাসেনি। ব্যবহার করেছে, ভালোবাসার নাটক করেছে। জঘন্য অভিনয় দিয়ে প্রতিনিয়ত ওকে ঠকিয়েছে। নিজের অনাগত সন্তানকে হারানোর পর আবার সেদিন কেঁদেছিল রুদ্র। আবছা অন্ধকারে ঘেরা বৈঠক ঘর ওর নীরব হারাকারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

প্রিয়তাকে কাছে না টানার প্রক্রিয়া সেদিন থেকেই শুরু হল। মনকে শক্ত করে রুদ্র শুধু এটা জানার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল কেন এই ফাঁদ? কী এমন কারণ যার জন্যে সোলার সিস্টেমকে ধ্বংস করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল প্রিয়তা! নিজের সর্বোস্ব বিসর্জন দিয়ে দিল! কীসের এতো ক্ষোভ? কীসের রাগ? সেই সত্য উদ্ঘাটনেই ঠান্ডা মাথায় আরও এক ফাঁদ পাতে রুদ্র। সেই ফাঁদে খুব চমৎকারভাবে পা দিয়ে ফেলে প্রিয়তা। দিতেই হতো। কারণ এবার চালটা চেলেছিল রুদ্র আমের! প্রিয়তার আসল পরিচয়টা সেদিনই আসে রুদ্রর সামনে। শওকত মীর্জার মেয়ে রাণী মীর্জা নামক রমনীর সঙ্গে সেদিন প্রথম পরিচয় হয় ওর। কিন্তু সেদিন কষ্ট নয় ভয়ংকর রাগ হয় রুদ্রর। বিশ্বাসঘাতকাকে তীব্র ঘৃণা করে আসা ওর সঙ্গে এমন নোংরা প্রতারণা হয়েছে জেনে নিজের ওপরেই রাগ হয় ওর। সেই রাগে পৃথিবী ওলটপালট করে দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু রুদ্র আমের নামক পুরুষ যেনো আলাদাই কোন এক ধাতুতে তৈরী। সেকারণেই স্থির থেকে অপেক্ষা করে ও। সঠিক সময়ের অপেক্ষা!

কিন্তু রুদ্রের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায় সেই সন্ধ্যায়! যেদিন ইকবালকে খু*ন করে প্রিয়তা। সময়টা ছিল গোধূলি। গুরুত্বপূর্ণ এক কাজ সেড়ে রুদ্র নিজের জিপে উঠে বসে। আমের ভিলায় ফিরবে। ফোনটা তখনও বন্ধ ছিল ওর। অন করার সাথেসাথেই হোয়াটস্অ‍্যাপে একটা ভয়েসমেইল পায় রুদ্র। আননোন নাম্বার। আরও আগেই পাঠিয়েছে কেউ। কিন্তু ফোন বন্ধ ছিল বিধায় দেখতে পায়নি। ভয়েসমেইলটা শোনার সঙ্গেসঙ্গেই থম মেরে যায় রুদ্র। সেখানে ইকবাল তার যন্ত্রণামাখা অস্পষ্ট গলায় প্রিয়তার সব অপকর্ম সংক্ষেপে বলে যাচ্ছে। সেই জঙ্গলের প্রথম দেখা থেকে শুরু করে নিজের অনাগত সন্তানের হত্যা। সাব্বিরের খু*ন সবটাই বলেছে। যা সে জানতো। ইকবালের গলায় একেকটা বর্ণনা মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত নামিয়ে দেয় রুদ্রর। ঘাড়ের পেছনের চুলগুলো দাঁড়িয়ে যায় ভয়ংকর শিহরণে। চারপাশটা কেমন ঝিম ধরে রুদ্রর। শক্ত হয়ে জমে যায় গোটা শরীর। মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্যে।
যে প্রিয়তাকে ও ভালোবেসেছে। যে প্রিয়তার সত্তাকে ও ভালোবেসে। সে সত্তাটুকুই পুরোপুরি মিথ্যা! একবিন্দুও সত্য ছিলোনা সেখানে। রাণী মীর্জাই হল বাস্তব। প্রিয়তা কেবল রুদ্রকে ধ্বংস করার একটা অস্ত্র ছিল। চারপাশে বিভ্রান্তের মতো তাকায় রুদ্র। গোটা জগতটাকেই মিথ্যা, ভ্রম, ছলনা মনে হয় ওর। অদ্ভুত এক যন্ত্রণাময় ঘোরে চলে যায় রুদ্র।

সেই ঘোর কতক্ষণ ছিল জানা নেই রুদ্রর। তবে ইকবালের কথা মনে পড়তেই নিজেকে সামলে নেয় ও। দ্রুত কল করে সেই নাম্বারে। রিসিভ করে সেই সিএনজি ড্রাইভার। ইকবালের বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই সে জানায়, কোথায় ছেড়ে এসেছে তাকে। ইকবালের ভয়ংকর শারীরিক অবস্থার কথাও জানায় সেই ড্রাইভার। সেই মুহূর্তেই উন্মাদের মতো গাড়ি চালিয়ে আমের ভিলায় পৌঁছেছিল রুদ্র। কিন্তু দেরী হয়ে যায়! ততক্ষণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে ইকবাল। লাশটা দেখামাত্র রুদ্র বুঝে যায় খু*ন করা হয়েছে ইকালকে। আর সেটাযে প্রিয়তাই করেছে তা বোঝার বাকি থাকেনা ওর। সেইসময় ভেতরে কী তীব্র ক্রোধ পুষে দাঁড়িয়ে ছিল তা কেবল রুদ্র জানে। ইকবাল নামক মানুষটাকে ও ভালোবাসতো। গোপনে বড় ভাই মেনে শ্রদ্ধা করতো। সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, বিষয়টা ভেতরে ভেতরে আঘাত করেছিল রুদ্রকে। সেদিন আঘাত করে মানুষটাকে ভুল বোঝার গ্লানি! ঐ মুহূর্তে রাগ এতোটাই মাত্রা ছাড়িয়েছিল ঐ মুহূর্তেই প্রিয়তার গলা চেপে ধরতে ইচ্ছা করছিল রুদ্রর। অথচ সে মুহূর্তেও অসম্ভব ধৈর্য্যের পরিচয় দেয় ও।
এরপরেই রুদ্র ঠিক করে আর নয়! থামাতে হবে প্রিয়তাকে। তবে সেটা প্রিয়তা রূপে নয়। রাণী মীর্জা রূপে। এবার স্বয়ং রাণী মীর্জার মুখোমুখি হবে ও। দুবাই যাওয়ার বন্দবস্ত আগেই করেছিল রুদ্র। সেদিন দিনটা এগিয়ে আনে। আর সেই প্রস্থান ঘীরেই সাজায় নিজের শেষ চাল।

কুয়াশা ভেদ করে মৃদু রোদের আলো চোখে লাগতেই অতীত থেকে বেরিয়ে আসে রুদ্র। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও কীকারণে যেন চেপে যায়। দুবাই যাওয়ার আগের দিন রাতে মনে রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ নিয়েও প্রিয়তাকে কাছে টেনেছিল রুদ্র। কারণ ও জানতো সেটাই শেষবার। এরপর আর কোনদিন প্রিয়তাকে কাছে টানবেনা ও। কারণ এরপর ওর সামনে আর কোনদিন প্রিয়তা আসবেই না। আসবে রাণী মীর্জা। প্রিয়তাকে অসম্ভব ভালোবাসলেও রাণী মীর্জাকে ঘৃণা করে রুদ্র। তাকে আর যাই হোক, ভালোবেসে ছোঁয়া যায়না। সেইসঙ্গে নিজের প্রতিটা স্পর্শে ও প্রিয়তাকে এটাও অনুভব করিয়েছে এই শেষ! আর কোনদিনও এমন মুহূর্ত আসবেনা। রুদ্রর বিশ্বাস, প্রিয়তা অনুভব করেছে সেটা।
হাতের সিগারেটটার দিকে তাকিয়ে দেখল পুড়ছে সেটা। কিন্তু তারচেয়েও ভয়ংকরভাবে পুড়ছে রুদ্রর হৃদয়। জীবনে দুজন নারীকে ভয়ংকর ভালোবেসেছিল রুদ্র। অথচ দুজনেই ওকে ভয়ংকরভাবে ঠকিয়েছে। একজন অকালে চলে গিয়ে ওর ‘রাজা’ নামক সত্তাকে কেড়ে নিয়েছে। আরেকজন ছলনা করে ওর সমস্ত অস্তিত্বকেই বিষাক্ত করে দিয়েছে। ভালোবাসা নামক শব্দটাই কেড়ে নিয়েছে। ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে ওকে।

রুদ্র নদীর জলে ছুড়ে মারল সিগারেটটা। নিশ্চয়ই এখন আগুন নিভে গেছে। শীতল জলে ঠান্ডা হয়ে গেছে সেটা। কিন্তু রুদ্রর বুকের দহনযে চিরস্থায়ী। মৃত্যু ছাড়া জগতের কোন শীতলতা সেই দহনকে নেভাতে পারবেনা। কোনভাবেই না।

*

বদ্ধ ঘরটার পিনপতন নীরবতায় আরও বেশি আবদ্ধ মনে হচ্ছে পরিবেশ। প্রিয়তা স্থির হয়ে বসে আছে। রুদ্র এখন সব জানে! সব! বিষয়টা জেনেও মানতে চাইছেনা ওর মন। কিন্তু দিনটাতো আসারই ছিল! তবে আর কটাদিন দেরীতে এলে বোধহয় ভালো হতো। চাপা এক যন্ত্রণায় ভাড় হয়ে আছে ভেতরটা।

‘ আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছেনা ম্যাডাম?’

জয়ের প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পেল প্রিয়তা। নিজেকে সামলে বলল, ‘ এসব তোমাকে রুদ্র বলেছে?’

‘ হ্যাঁ।’

‘ কখন?’

‘ যখন আমার কাছ থেকে সে অবশিষ্ট সত্য জানছিল, তখন।’

প্রিয়তা বিরক্ত হল, ‘ কথা না ঘুরিয়ে সরাসরি বল। কী হয়েছিল?’

প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে মুচকি একটু হাসল জয়, ‘বেশ। বলছি।’

#চলবে…

[ এই পর্বের অবশিষ্ট অংশ আগামীকাল পোস্ট হবে। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here