অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ১০৬.

0
57

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

১০৬.

শওকত মীর্জার কথাটা পছন্দ হলোনা সম্রাটের। রাণীর কথাগুলো রাত থেকেই অস্থির করে তুলছে ওকে। কোনভাবেই মাথা থেকে বের হচ্ছেনা। বারবার বিভিন্ন উল্টাপাল্টা চিন্তা আসছে মাথায়। ঐ একটা মেয়ের জন্যে অনেক কিছু করেছে ও, অনিচ্ছা সত্ত্বেও সহ্য করেছে অনেককিছু। সবকিছু মানতে পারলেও রাণী মীর্জা ওর হাত ছাড়া হয়ে যাবে; তা মানতে পারবনা ও। কিন্তু সেটাই হচ্ছে বলে ওর মনে হচ্ছে বারবার। এসব চিন্তায় কালকের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ ডিলিংয়ের সময়ও যথেষ্ট বেখেয়ালি ছিল ও। যার মূল্য দিতে হয়েছে চরমভাবে। তারওপর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হাতের যন্ত্রণা। যতবার হাতের দিকে তাকাচ্ছে মাথায় র*ক্ত উঠে যাচ্ছে সম্রাটের। উচ্ছ্বাসের চেহারা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। পেটে মারা সেই লাথির দৃশ্যটা মানসপটে দৃশ্যমান হতেই কান দিয়ে গরম ভাপ বের হচ্ছে। রাগে, অপমানে কিড়মিড় করছ গোটা শরীর। অঙ্গারের মতো সেই রাগ ভেতরে পুষে রেখেই সম্রাট বলল, ‘ আপনার ঐ সিংহের খু*লি আরেকটু হলেই উড়িয়ে দিচ্ছিলাম আমি। মাঝখান থেকে ঐ বেজ*ন্মাটা এসে সব বানচাল করে দিল।’

‘ উচ্ছ্বাস?’ ভ্রুকুটি করে জানতে চাইল পলাশ। ছোট্ট করে “হু” বলে সম্মতি জানাল সম্রাট। করিম আরও তেঁতে উঠে বলল, ‘এতোগুলো মানুষের ব*ন্দু*কের মাথায় থেকেও তুমি গু*লি চালানোর সাহস করো কীকরে? তোমার কী মনে হচ্ছিল ওরা হা করে তামাশা দেখবে?’

নিজের সাফাই গেয়ে সম্রাট বলল, ‘ ঐ সিচুয়েশনে..’

ফোনের ওপাশ থেকেও করিম তাজওয়ার ধমকে উঠলেন, ‘একদম সিচুয়েশন বোঝাছে আসবেনা আমায়। হাড়ে হাড়ে চিনি তোমাকে আমি।’

কিন্তু করিমের আওয়াজকেও ছাপিয়ে গেল শওকতের আচমকা ধমক, ‘ তোমাদের বাপব্যাটার সার্কাস দেখার ধৈর্য্য নেই আমার এখন। কত টাকার ক্ষতি হয়ে গেল অনুমান আছে কারো? আর পরশু অস্ত্রগুলো সাপ্লাই দেওয়ার কথা। ক্লাইন্টরা সময়মতো অস্ত্র না পেলে কী হবে ধারণা আছে। কনট্রাক্টের কথাটা মাথার রেখো!’

চুপ হয়ে গেল সবাই। ব্যপারটা সত্যিই চিন্তার। করিম হালকা গলা ঝেড়ে বলল, ‘কথা বলে সময়টা একটু বাড়িয়ে নেওয়া যায়না?’

‘ সোলার সিস্টেমের সঙ্গে ঘটা ঘটনার পরও কেউ আর এসব ভঙচঙ শুনতে চাইবে? আর যদি শোনেও, যদি সময় দেয়ও? সেই সময়ের মধ্যে মাল কোথায় পাবো? পেলেও কতগুলো টাকা এক্সট্রা দিতে হবে ধারণা আছে? সামনে আরও দুটো ডেলিভারি আছে। এটা সামলাবো না-কি বাকি দুটো? তারওপর এখন যদি ঐদলকে রুদ্র মালগুলো অফার করে। তারা চাইবে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করতে? এটা আন্ডারওয়ার্ল্ড। দোস্তি-ইয়ারি ততক্ষণ চলে যতক্ষণ লাভ আছে।’

‘ তাহলে?’ হতাশা আর উদ্বিগ্নতা স্পষ্ট ফুটে উঠল পলাশের কন্ঠে।

পুনরায় দমবন্ধকর স্তব্ধতা নেমে এলো ঘরটাতে। প্রত্যেকেই হতাশ, অস্থির। অস্থির চিন্তায় হাঁসফাঁস লাগছে ওদের। এক রাতেই যেনো খেলাটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে ফেলেছে রুদ্র আমের। কিন্তু একরাতে যে আসলে কিছুই হয়নি তা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে অভিজ্ঞ এই দলঅধিপতিরা। অনেকদিন আগে থেকেই নিজের খেলার ছক সাজিয়েছে রুদ্র। কিন্তু কীকরে? শান শান্ত স্বরে বলল, ‘ পরের ডেলিভারিটা খুব সতর্ক হয়ে ঠান্ডা মাথায় করতে হবে আমাদের।’

করিম বলল, ‘ কিন্তু তারজন্যে আগে এটা জানতে হবেযে রুদ্র কীভাবে করেছে কাজটা। হঠাৎ এতো লোক, অ*স্ত্র কীকরে পেলো? ফাইনানশিয়ালিও দুর্বল করে দেওয়া হয়েছিল ওদের। কোন বিজনেসম্যান চাঁদা দেওয়ার আগেই তাদের খু*ন করা হচ্ছিলো। তারওপর প্রিয়তার সত্যিটা সামনে আসায় ভয়ংকর ধাক্কা খাওয়ার কথা ছিল ওর। অথচ উল্টে আমাদেরকেই এমন অবিশ্বাস্য ধাক্কা দিয়ে দিল। এগুলো সব কাটিয়ে এগিয়ে গেল কীকরে?’

শান সম্রাটের দিকে একপলক তাকিয়ে বলল, ‘ দুবাই গিয়ে কিছু করেছে সম্ভবত। ফিনানশিয়াল সাপোর্টটা হয়তো ওখানেই_’

শানের কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোনের ওপাশ থেকে শওকত বলল, ‘আর ইনফরমেশন? লোকেশন, সময়, ওয়ে এগুলো কীকরে জানলো? আমরাও জেনেছিলাম। কিন্তু সেটা আড়াইবছর কাঠখড় পোড়ানোর পর। কিন্তু ওর তিনমাসও লাগেনি। এবং এটা ও একা করেছে। কারণ বৈঠকঘরে এসব নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি। হলে সেটা অবশ্যই জানতাম আমরা। তাছাড়া রাণীর কাছেও রেগুলার মাইক্রোফোনের রেকর্ডিং আসতো।’

সম্রাট বলে উঠল, ‘ রাণীকে সন্দেহ করাটা বোকামি হবে কারণ_’

‘ কারণ ও সেটা করবেনা। নিজের স্বার্থেই করবেনা। তোমার প্রেমিকা হতে পারে কিন্তু আমার মেয়ে ও। জন্ম দিয়েছি ওকে। ওর প্রতিটা শিরা-উপশিরা চিনি।’ কথাটা মুখে বললেও মনেমনে পুরোপুরি বিশ্বাস করেনা শওকত। সত্যিই মেয়েকে চেনেতো! তবুও কন্ঠে দৃঢ়তা বজায় রেখে বলল, ‘ কিন্তু কথা হলো আরেকটা সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে আমার মনে।’

কেউ প্রশ্ন করার আগে শওকত নিজেই বলল, ‘ কিন্তু সেটা পরে দেখা যাবে। আগে এই হয়ে যাওয়া ক্ষতিটা পুশিয়ে কীকরে পরবর্তী ডিলগুলো করা যায় সেটা ভাবতে হবে। মাথা গরম করে খু*নোখু*নির পরিকল্পনা করলে এখন ক্ষতি ছাড়া লাভ হবেনা।’

করিম বলল, ‘ হুসাইন আলীর কাছে মাল ধার চাওয়াই যায়। ওনার কাছ থেকে মাল নিয়ে আমরা ক্লাইন্টকে দিলাম। এবং সেখান থেকে আসা এমাউন্ট দিয়ে হুসাইন আলীর টাকা শোধ করে দেব। এতে কোন লাভ হবেনা জানি। কিন্তু ক্ষতিটা আপাতত পুশিয়ে নেওয়া যাবে। ওনার সাথে কনট্রাক্টতো আছেই আমাদের।’

শান বলল, ‘তারজন্যে রাণীকে দরকার হবে আমাদের। হুসাইন আলীকে সবচেয়ে ভালো হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা যদি কারো থাকে সেটা রাণীর আছে। কিন্তু ওকে বের করার জন্যে কোন ব্যবস্থা কেন নিচ্ছিনা আমরা?’

সম্রাট গম্ভীর স্বরে চাপা রাগ নিয়ে বলল, ‘ কারণ তোমার বোন নিজেই চায়না কেউ ওকে সাহায্য করুক। ফোন করেছিল আমাকে। বলেছে সময় বুঝে নিজেই বের হবে।’

শওকত মাথা নেড়ে বলল, ‘শুধু হুসাইন আলীকে ম্যানেজ করলেই হবেনা। আরও টাকা লাগবে। তাই ওনাকে কল করতে হবে। এখন যদি কেউ ক্যাশ দিতে পারে উনিই পারবে।’

‘ এতোগুলো ক্যাশ দেবন উনি?’ স্পষ্ট সন্দেহ প্রকাশ পেল করিমের গলায়।

শওকত বলল, ‘ দেবে। ইলেকশনের সময় ওর জন্যে ভোট কাটার কাজটা আমার লোকই করেছে একসময়। ক্যারিয়ারের গোড়া থেকে কম সাহায্য নেয়নি ডার্ক নাইটের কাছ থেকে। ডার্ক নাইটের বিপদে য‍দি কাজেই না লাগে তাহলে হবে কীকরে? তাছাড়া ঐ পেনড্রাইভটাতে ওনার কীর্তিও আছে। তাই সাহায্যতো করতেই হবে। আজ আবার রাতে ফ্লাইট আছে ওর। তার আগেই কথা বলতে হবে। এসব ছাড়ো। এখন রাণীর বের হওয়ার জন্যেই অপেক্ষা করো তবে। জয় কল করেছিল আমায়। ও নিজেই পালাতে পেরেছে। জঙ্গলে জঙ্গলে পালাচ্ছিল এতোদিন। আজ রাতে দেখা করতে আসবে আমার সঙ্গে। দেখি কী বলে। আপাতত ফোন রাখো। বিশ্রাম নিয়ে ঢাকা ফিরে এসো। বাকি কথা সামনাসামনি হবে।’

লাইনটা কেটে দিল শওকত। মুখে কথাটা বললেও কপালের চিন্তার রেখাদ্বয় গভীর হল তার। কারণ সে তার মেয়েকে চেনে, কিন্তু অনেকক্ষেত্রে চেনেনা। সেটাই সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর। রুদ্রর প্রতি প্রিয়তার মারাত্মক দুর্বলতার কথা এখানে আর কেউ না জানলেও সে খুব ভালোভাবে জানে। আর করিম তাজওয়ারের মতো শুরু থেকে শওকতেরও একটাই ভয়; রুদ্রর প্রতি প্রিয়তার এই দুর্বলতাই তাদের সমূলে ধ্বংস করে দেবে।

*

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে ছুটে চলেছে রুদ্রর গাড়ি। অ*স্ত্রগুলো সব নিরাপদ এবং সুরক্ষিত স্থানে পৌঁছে তবেই বিরতি নিয়েছে। এতো বিশাল একটা কাজ করেও রুদ্রর মধ্যে কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখতে পাচ্ছেনা উচ্ছ্বাস। বরাবরের মতোই নির্বিকার সে। তবে আজ ব্যতিক্রম কিছু লক্ষ্য করছে উচ্ছ্বাস। রুদ্রর চেহারায়, প্রতিক্রিয়ায় কোথাও যেন একটা শূণ্যতা আছে। যা অনুভব করতে পারলেও ঠিকভাবে ধরতে পারছেনা উচ্ছ্বাস। মাঝরাতে হওয়া এই হঠাৎ অপারেশনটা নিয়েও যথেষ্ট প্রশ্ন আছে ওর মনে, যার উত্তর এখনো রুদ্র দেয়নি ওকে। রুদ্রর চোখমুখ দেখে দীর্ঘসময় চুপ থাকলেও আর পারল না উচ্ছ্বাস। গলা ঝেড়ে বলল, ‘ দুবাই কী এজন্যই গেছিলি?’

‘ কাইন্ড অফ।’ দুই শব্দের ছোট্ট জবাব দিল রুদ্র।

‘ কাইন্ড অফ?’

‘ হুম।’

‘ কিন্তু টাকা কোথায় পেলি? আর দুবাই থেকে আনলে এতো তাড়াতাড়ি অ*স্ত্র আর লোক জোগাড় করাতো সম্ভব হতোনা। গতকালইতো ফিরেছিস না-কি? আর কোথায় ডেলিভারি হচ্ছে সেটা কীকরে জানলি? অ‍্যাই! এক্সাক্টলি কী ঘটেছে বলতো?’

‘ অনেক লম্বা কাহিনী। বলার ইচ্ছা, ধৈর্য্য, এনার্জি কোনটাই নেই এখন।’

রুদ্রর দায়সারা উত্তরে ফোঁস করে শ্বাস ফেলল উচ্ছ্বাস। বুঝল বাছাধনকে এখন কিছুই বলবেনা। তাই আর বৃথা প্রশ্নে সময় নষ্ট করল না ও। বিড়বিড় করে বলল, ‘ শালা তুই আর তোর সাসপেন্স থ্রিলার মুভি!’

উচ্ছ্বাসের হঠাৎই মনে পড়ল প্রিয়তার কথা। আসার সময় প্রিয়তার কথা রুদ্রকে বলবে ভেবেছিল ও। কিন্তু সাহসে কুলোয়নি। তারওপর প্রিয়তা বলেছিল আজকে কোন এক বাচ্চার জন্মদিন আছে। তাই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল বেচারা। কিন্তু এখন আমের ভিলায় পৌঁছলেইতো রুদ্র জেনে যাবে সবটা। তখন কী হবে সেটা ভেবেই গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ওর।

আমের ভিলার পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর হলো ওদের। বসার ঘরে ঢুকেই দেখল কুহু আর নীরব একসঙ্গে নামছে সিঁড়ি বেয়ে। হয়তো লাঞ্চের জন্যে। রুদ্রকে দেখেই থমকে যায় ওরা দুজন। এতোদিন পর ভাইকে দেখতে পাওয়ার আনন্দের চেয়ে প্রিয়তার অনুপস্থিতির ভয়টাই বেশি গ্রাস করে।
রান্নাঘর থেকেই রুদ্রর উপস্থিতির আভাস পায় জ্যোতি। সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস বন্ধ করে প্রায় ছুটে আসে বসার ঘরে। রুদ্রকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে পা থমকে যায় জ্যোতিরও। টলমলে চোখে অপলকভাবে তাকিয়ে থাকে প্রিয় মানুষটার দিকে। সাদার মধ্যে আকাশি চেকের গেঞ্জি, হাতে ঝুলিয়ে রাখা কালো জ্যাকেট। চুলগুলো বড্ড উস্কখুস্কো, তীক্ষ্ম চোখজোড়া কেমন নিষ্প্রাণ। শ্যামসুন্দর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। কিছুক্ষণের দর্শনেই জ্যোতি বুঝে ফেলল মানুষটা ঠিক নেই। প্রিয়তার অনুপস্থিতির কথা মাথা আসতেই ছ্যাঁত করে উঠল জ্যোতির বুক। শরীর ঠান্ডা হয়ে এলো।
রুদ্র সকলের প্রতিক্রিয়াই দেখছিল এতক্ষণ। ততক্ষণে ওপর থেকে নেমে এলো জাফর আমেরও। এসে সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরল রুদ্রকে। উচ্ছ্বাসের মুখে সবটা শুনেছে সে ফোনে। জাফর সগর্বে রুদ্রর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, ‘আমি জানতাম তুই সোলার সিস্টেমকে ডুবতে দিবিনা। কিছু না কিছু ব্যবস্থা তুই করবিই। এইনা হলে আমের বংশের সন্তান।’

কথা বলে উচ্ছ্বাসের বাহুতেও দুখানা গর্বিত চাপড় বসিয়ে দিল সে। রুদ্র কিছু বলল না। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘ আমি ক্লান্ত, রুমে যাচ্ছি। লাঞ্চটা রুমে পাঠিয়ে দিও কেউ। খেয়ে ঘুমোবো।’

বলে রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই জ্যোতির ডাকে থামতে হলো ওকে। রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো জ্যোতির দিকে। জ্যোতি কীকরে কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। হাঁসফাঁস করতে লাগল অযথা। এদিকে রুদ্রও কোনরকভ তাড়া দিচ্ছেনা। কেবল চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে জ্যোতির দিকে। অবশেষে অনেকটা ইতস্তত করে জ্যোতি বলতে শুরু করল, ‘প্রিয়তা_’

কিন্তু জ্যোতিকে কথা শেষ করতে দিলোনা রুদ্র। নামটা উচ্চারণ করার সঙ্গেসঙ্গেই বলল, ‘ও চট্টগ্রাম আছে সেটা জানি আমি। আশ্রমে আছে, কাল ফিরবে। কথা হয়েছিল আমার সঙ্গে। তাছাড়া রাজু আছে সবসময় ওর সঙ্গে। চিন্তার কোন কারণ নেই।’

ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতোই অবস্থা হল জ্যোতির। সঙ্গে ঘরে উপস্থিত বাকি সবারও। এই একটা চিন্তাতেই নাওয়া-খাওয়া হারাম হয়ে যাচ্ছিল ওদের সবার। যদিও রুদ্রর ব্যপারটা এতো সহজভাবে নেওয়াটা অবাক করেছে ওদের। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর ব্যপার তারা নিজেরাই বুঝে নেবে ভেবে তেমন গুরুত্ব দিলোনা ওরা। সিঁড়িতে পা রাখতেই কুহু দ্রুতপায়ে নেমে এসে জড়িয়ে ধরল রুদ্রকে। বোনের মাথায় কেবল একবার হাত রাখল রুদ্র। কিন্তু কিছুই বলল না। নীরবের সঙ্গে সেকেন্ডের দৃষ্টি বিনিময় করে দৃঢ় পায়ে চলে গেল নিজের কক্ষের দিকে।

সেদিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল উচ্ছ্বাস। জ্যোতির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ লাঞ্চ রেডি কর তাহলে। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।’

রুমে ঢুকে সবার আগে শাওয়ার নিয়ে নিল রুদ্র। দীর্ঘক্ষণ ঠান্ডা পানির নিচে দাঁড়িয়ে থাকায় ঠান্ডা হয়ে গেছে শরীরটা। কিন্তু মন? মনের দহন যেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়াচ্ছে তার প্রবলতা। ট্রাউজার আর স্যান্ডো গেঞ্জি পড়া অবস্থাতেই রুমে থাকা সিঙ্গেল কাউচটাতে গা এলিয়ে দিল রুদ্র। চোখ বন্ধ করে গা ছেড়ে দিল সেখানে। শরীরের চাপ কমিয়ে একটু হলেও মস্তিষ্কের চাপ কমানোর চেষ্টা করল ও। সেইসঙ্গে আরেকটাবার শুরু থেকে পর্যালোচনা করে দেখল নিজের পরিকল্পনা।

সেদিন বৈঠকঘরে যখন প্রিয়তার সত্যিটা পুরোপুরি সামনে এলো। ঐ একটা রাত অন্যকিছু নিয়ে চিন্তা করার মতো অবস্থা ওর ছিলোনা। স্তব্ধ, বিদ্ধস্ত, সবদিক থেকে নিঃস্ব রুদ্র আমেরের মনে কেবল একটাই প্রশ্ন ছিল, কেন? এমন নিষ্ঠুর ছলনা ওর সঙ্গেই কেন করল প্রিয়তা? দুটো বছর একটা মানুষের অনুভূতি নিয়ে এতো নির্মমভাবে কীকরে কেউ খেলতে পারে! কুহুর সেই যন্ত্রণা-হাহাকার, রাশেদ আমেরের নিষ্প্রাণ মুখ, নিজের অনাগত সন্তানের মৃত্যু! সবকিছু ভেতর থেকে ঝাঁজরা করে দিচ্ছিল এই লৌহমানবটিকেও। নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে যাকে ও সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছিল, সেই মেয়েটাই কতটা নিষ্ঠুরভাবে ওকে ঠকিয়ে গেছে। তীব্র আঘাতে নিষ্প্রাণ করে দিয়েছে ওকে।
কিন্তু সূর্যদয়ের সঙ্গেসঙ্গেই নিজেকে আরও একবার শক্ত করেছে রুদ্র। চূর্ণবিচূর্ণ সেই সত্ত্বাকে নিজের নিষ্ঠুর, নির্মম সত্ত্বা দিয়ে আড়াল করেছে। মাইক্রোফোনের ব্যপারটা সামনে আসার পরপরই ও জানতো প্রিয়তা ওর সব কথা শোনে। সেকারণেই শরীরে সেই ব্রেসলেটটা থাকা অবস্থায় নিজের কোন পরিকল্পনা সমুখে উচ্চারণ করেনি রুদ্র। এমনকি বৈঠকঘরেও নিজের কোন পরিকল্পনা প্রকাশ করেনি। বরং উল্টোটাই বলেছে। যেসব ব্যবসায়ীদের তালিকা বৈঠকঘর কিংবা আমের ফাউন্ডেশনে করা হতো তাদের নাম প্রকাশের আগেই তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে ফেলেছিল রুদ্র। কারণ ও জানতো এই লিস্ট প্রকাল হওয়ার পরপরি শত্রুদলের হাতে চলে যাবে। এবং বেশিরভাগ ব্যবসায়ীদেরই ওরা সরিয়ে ফেলবে। হয়েছিলোও তাই। সেকারণেই লিস্টটা মিটিংয়ে নিজের কার্যসিদ্ধির পরে প্রকাশ করেছিল রুদ্র। সেই পরিকল্পনা সম্পর্কে হাতের ঐ ব্রেসলেটতো দূর, উচ্ছ্বাস আর জাফরও জানতো না। কারণ পরিপূর্ণ বিশ্বস্ততার তালিকায় ও জাফর বা উচ্ছ্বাসকেও রাখতে পারছিল না। ওর চাঁদা আদায়ের টিম ছিল একেবারেই ভিন্ন। যা কেউ টেরও পায়নি। সেকারণেই, রাণী মীর্জার পরিকল্পনায় ব্যবসায়ীদের সরিয়ে দেওয়া হলেও তা আসলে রুদ্রর কোন ক্ষতিই করতে পারেনি। কারণ তার আগেই নিজের সেই টাকা আদায় করে ফেলেছিল রুদ্র। সেকারণেই পরবর্তী পরিকল্পনা সাজাতে ফিনানশিয়ালি কোন অসুবিধাই হয়নি ওর।

সেলফোন বেজে ওঠার আওয়াজে ধ্যানভঙ্গ হল রুদ্রর। হাত বাড়িয়ে বেডসাইড টেবিল থেকে ফোনটা তুলে নিল ও। স্ক্রিনে তাকাতেই ঠোঁটে সামান্য ব্যঙ্গাত্মক হাসি ফুটল ওর। রিসিভ করে বলল, ‘ মাল পেয়েছেন?’

‘ পেয়েছি। কিন্তু আমাকে না পাঠিয়ে এগুলো দিয়ে ওদের ক্লাইন্টকে দিয়ে, ওদের বিরুদ্ধে উস্কে দিলে তোমার জন্যে বেশি লাভজনক হতোনা?’

‘ লাভের আশায় কিছু করছিনা আমি এখন। ওদের সবদিক দিয়ে পিষে দেওয়াটাই এখন আমার প্রধান লক্ষ্য।’

‘ সোলার সিস্টেমকে নতুন করে শুরু করা না?’

‘ কিছু জিনিস এতোটাই নির্মমভাবে নষ্ট হয় যে আর কখনও নতুনকরে শুরু করা যায়না। সমূলে ধ্বংস করে ফেলতে হয়। সেটা দল হোক কিংবা সম্পর্ক।’

ফোনের ওপাশ থেকে খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে উঠল হুসাইন আলী। মুখে পান পুড়ে নিয়ে বলল, ‘ তা বেশ বলেছো। তা পরবর্তী পরিকল্পনা কী তোমার?’

রুদ্র ঠান্ডা গলায় বলল, ‘মালগুলো বুঝে নিন। ওরা আবার যাবে আপনার কাছে। হয়তো আমার বউ-ই যাবে। কী করতে হবে সেটা আপনি জানেন। সেটাই করবেন, যেটা আগেরবার করেছেন।’

মাথা নাড়ল হুসাইন আলী, ‘ বুঝলাম। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর দাও দেখি, সেদিন যে তোমার বউযে আমার কাছে এসেছিল। আর কী কথা বলেছিল। তা তুমি কীভাবে জানলে? আমিতো বলিনি।’

‘ প্রশ্নটা আপনি আগেও করেছেন।’

‘ উত্তরটা পাইনি।’

‘ তারমানে আপনার জানার প্রয়োজন নেই।’

কাঁধ ঝাঁকাল হুসাইন আলী, ‘ ঠিক আছে। তুমি যেমন বলবে। আমার লাভ দিয়ে কাজ। তোমার বউয়ের প্রস্তাবের চেয়ে তোমার প্রস্তাব আমার কাছে বেশি ভরসার লেগেছে তাই তোমারই দলে ভিড়েছি। আগেই বলেছি। লাভ যেখানে, আমি সেখানে।’

বলেই সেই বিকৃত ভঙ্গিতে ‘হা হা’ করে হাসতে থাকল হুসাইন আলী। যা শোনার ধৈর্য্য হলোনা রুদ্রর। কেটে দিল ফোনটা। ফোনটা আবার টি-টেবিলে রাখতেই দরজায় নকের শব্দ হল। রুদ্র তাকিয়ে দেখল জ্যোতি এসেছে। হাতে খাবারের ট্রে। রুদ্র ছোট্ট করে বলল, ‘আয়।’

জ্যোতি ভেতরে এসে বেড-সাইড টেবিলেই রাখল খাবারের প্লেটটা। হালকা ইতস্তত করে তাকাল রুদ্রর দিকে। শাওয়ারের পরে রুদ্রকে যতবার দেখেছে মুগ্ধ হয়েছে জ্যোতি। নিজেকে একটাই প্রশ্ন করেছে, পুরুষ এতো অসম্ভব সুন্দর হয় কীকরে? কিন্তু আজ ভেতরটা কেমন খাঁ খাঁ করে উঠল ওর। এই মানুষটার বিন্দুমাত্র কষ্ট ওর সহ্য হয়না। অস্থির গলায় বলল, ‘ তুমি ঠিক আছো?’

রুদ্র তাকাল না জ্যোতির দিকে। গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমার আবার কী হবে?’

‘ আমার মনে হচ্ছে অস্থির হয়ে আছো তুমি। তোমার কোথাও কষ্ট হচ্ছে।’

‘ ভুল মনে হচ্ছে। দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে চলে যা। কথা বলতে ভালো লাগছেনা আমার।’

তপ্ত এক শ্বাস ফেলল জ্যোতি। উদাস চোখে একবার রুদ্রকে পর্যবেক্ষণ করে প্রস্থান করল রুদ্রর কথামতো। ভিড়িয়ে দেওয়া দরজাটার দিকে তাকাল রুদ্র। নিজ চোখের উদাসীনতা লুকোতে পারল না। নিজের মধ্যই এক দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে বলল, ‘ ক্ষমা করে দিস আমায়। তোকে ভালোবাসাতে পারিনি বলে নয়। তোর বদলে ওকে ভালোবেসেছি বলেও নয়। কারণ ও আমার জীবনে না এলেও তোকে ভালোবাসতে পারতামনা আমি। যেকারণেই হোক, ঐ অনুভূতিটা ঐ একজনের জন্যেই তোলা ছিল। আমার জন্যে তুই যে কষ্ট পেয়েছিস তারজন্যে ক্ষমা চাইছি। এতোদিন না জানলেও আজ জানি। ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে ভালোবাসা না পেলে কতটা যন্ত্রণা হয়।’

কথাটা বলে দেয়ালে টানানো রুদ্র-প্রিয়তার বড় ওয়েডিং ফটোটার দিকে তাকাল রুদ্র। ফিসফিসে আওয়াজে বলল, ‘ওকে আমি একসিন্ধু পরিমাণ ভালোবেসেছিলাম, অথচ ও আমায় একবিন্দুও ভালোবাসতে পারেনি।’

*

রুদ্র প্রিয়তাকে অন্যকোথাও না, হুসাইন আলীরই এক পরিত্যক্ত বাড়িতে রেখেছে। ঢাকার পাশ ঘেঁষেই ছোট্ট একটা জঙ্গলে তৈরী বাড়িটা। হঠাৎ রেট কিংবা অন্যকোন বিপদে এখানে এসে গা ঢাকা দেয় সে। প্রিয়তা রুদ্রকে নিয়ে রিসার্চ করেছে, হুসাইন আলীকে নিয়ে না। সেকারণেই নিজস্ব জায়গায় রাখার মতো রিস্কটা নেয়নি রুদ্র। রাণী মীর্জা নামক ধূর্ত প্রাণীটিকে এখন খুব ভালোভাবেই রপ্ত করেছে রুদ্র আমের।

রাত এগারোটা বাজে বাড়িটার সামনে এসে পৌঁছলো রুদ্র। গেইটে তালা আর হুসাইন আলীর নিয়োগকৃত দুজন পাহারাদারকে সুরক্ষিত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনে মনে স্বস্তি পেলো ও। ভেতরে আজ শুধু রঞ্জুই আছে। জয়কে শওকত মীর্জার কাছে পাঠিয়েছে ও। পরবর্তী পরিকল্পনার অংশও সেটাই। তাই ভয় ছিল তার বউ নামক ভয়ংকর প্রাণিটি না আবার কোন তাণ্ডব বাঁধিয়ে রাখে বিগত দু’বারের মতো। গতরাতে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে রেখে গিয়েছিল ওকে রুদ্র। যেন মিশনটাতে কোনভাবেই কোনরকম ঝামেলা করতে না পারে। সেই ক্ষোভতো নিশ্চয়ই আছে। কথাগুলো চিন্তা করতে করতে ভেতরে চলে গেল রুদ্র। সোজা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল। প্রিয়তাকে রাখা ঘরটার দরজাটা খোলা দেখে বুঝল রঞ্জু আছে ভেতরে। এজন্যই নিচে কোথাও দেখা যায়নি। কিন্তু ঘরে প্রবেশ করতেই চমকে উঠল রুদ্র। সারাঘরে প্রিয়তা কোথাও নেই। ওয়াশরুমের দরজার সামনে পড়ে আছে রঞ্জু। ব্যথায় ছটফট করছে ছেলেটা। রুদ্র বুঝতে বিন্দুমাত্র বাকি থাকেনা কী হয়েছে। ও দ্রুতপায়ে গিয়ে বসে রঞ্জুর সামনে। রঞ্জুও যেন সময়নষ্টের পক্ষপাতি না। তাই রুদ্র কিছু বলার আগেই বহুকষ্টে বলল, ‘ভাই ভাবি, ভাবিহ্ আজকে পুরা সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমাইছে। একবারও ওডে নাই এরমধ্যে। খাবার দিতে আইছিলাম আমি। খাওয়ার পর হে আমারে জিগাইল যে আইজ কয় তারিখ। পরে জিগাইল কয়টা বাজে। আমি বলছিলাম। এরপর হে ওয়াশরুমে যাইতে চাইছিল। আমি খুইলা দিছিলাম। হেয় ভালো মাইনসের মতো গেলোও। বিশ্বাস করেন ভাই আমি পি*স্ত*ল ধইরাই রাখছিলাম। কিন্তু দরজা খোলার লগলগেই ঐডা দিয়া হাতে জোরে বারি মারছে।’

রুদ্র তাকিয়ে দেখল ওয়াশরুমে কাপড় টানানোর হ্যাঙার। ওয়াশরুমের ভেতরের ফ্লোরে স্ক্রু ড্রাইভারও পড়ে আছে। রঞ্জু বলল, ‘আমি আটকাইতে চাইছিলাম কিন্তু তার আগেই মাতায়_ ‘

রাগে দাঁতে দাঁত পিষল রুদ্র। অসুস্থ একটা ছেলেকে মারতেও হাত কাঁপলোনা মেয়েটার! রঞ্জু ওঠার চেষ্টা করে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘কিন্তু এক্ষনি গেছে ভাইজান। আপনের সামনেহ্ পড়ার কতা। এইমাত_’

রঞ্জুকে থামিয়ে উঠে দাঁড়াল রুদ্র। যা বোঝার বুঝে গেছে ও। এইমাত্র সামনের গেইট গিয়ে এসেছে ও। সামনের গেইট ছাড়া বের হওয়ার আর একটাই রাস্তা আছে!
এক মিনিটও দেরী না করে ছুটতে শুরু করল রুদ্র। ছুটতে ছুটতে মেইন গেইটের ওখানে গিয়ে বলল, ‘ভেতরে যা একজন। রঞ্জুর আঘাত লেগেছে, ফার্স্ট এইড দিতে হবে।’

বলতে বলতে আর দাঁড়ালনা রুদ্র। দৌড়ে চলে গেল পেছনের দিকে দ্বিতীয় এক্সিট গেইটটার দিকে। ওখানে পৌঁছতেই থমকে দাঁড়াল রুদ্র। ওর ধারণাই ঠিক ছিল। প্রিয়তা বাউন্ডারি ওয়াল ক্রস করছে। এক্সিট ডোর খুঁজে এই পর্যন্ত আসতে সময় লেগেছে কিছুটা। শার্ট আর ট্রাউজার পড়ে থাকায় সুবিধাই হচ্ছে ওর। প্রিয়তা দেয়াল থেকে লাফিয়ে নামতে নিলেই চিৎকার করে ওঠে রুদ্র, ‘ প্রিয়তা!’

চমকে ওঠল প্রিয়তা। রুদ্রকে কোনভাবেই এখন এখানে আশা করেনি ও। তাল সামলাতে না পারায়র লাফটা দিতে হল বেকায়দায়। ফলে পায়ে সামান্য ব্যথাও পেল। কিন্তু হাল ছাড়লোনা। সোজা দৌড়াতে শুরু করে উল্টোদিকে। রুদ্রও দৌড়তে শুরু করল ওর পেছনে। দুজনেই ছুটতে শুরু করল অন্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। বনের নিস্তব্ধতায় দুজনের ছোটার শব্দ অদ্ভুতভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এরমধ্যেও প্রিয়তার ছোটার ক্ষীপ্রতা চমকে দিল রুদ্রকে। চট্টগ্রামের ঘন জঙ্গলের ভীত, ঠিকভাবে হাঁটতে না পাড়া সেই মেয়েটাযে কতটা অবাস্তব, মিথ্যা, ভ্রম ছিল আরও ভালোভাবে টের পেল। মেজাজ ভয়ংকর খারাপ হলো রুদ্রর। ছোটার গতি বেড়ে গেল। প্রিয়তা টের পেল ওর কাছাকাছি চলে এসেছে রুদ্র। এক্ষুনি ধরে ফেলবে ওকে। ছুটতে ছুটতে সামনে একপাশে একটা মোটা শুকনো মোটা ডাল দেখতে পেল ও। পায়ের গতি বাড়িয়ে সেটাই হাতে ছুড়ে মারে রুদ্রর পায়ের দিকে। হঠাৎ আক্রমণে তাল সামলাতে পারেনা রুদ্র। হোঁচট খেল মাটিতে।

প্রিয়তা আর পেছনে তাকালোনা। নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে দৌড়তে থাকে ও। গাছপালা, ঝোপঝাড় পার করে এগোতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করল কেউ আসছেনা ওর পেছনে। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল প্রিয়তা। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেল, চারপাশে স্তব্ধ নিস্তব্ধতা আর ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাড়া কিছুই নেই। ছুড়ে দেওয়া ডালটায় রুদ্রর বেশি ক্ষতি হয়নিতো! কথাটা চিন্তা করতেই বুঁক কেঁপে ওঠল প্রিয়তার। আবার রুদ্রর কাছে যাওয়ার জন্যে এগোতে নিলো। কিন্তু সময় স্বরণে আসতেই থেমে গেল। সামলে ফেলল নিজেকে। যেতে হবে ওকে। আবার দৌড়নোর জন্যে উল্টো ঘুরতেই চমকে দাঁড়াল প্রিয়তা। ওর দিকে এমটি নাইন তাক করে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। তীক্ষ্ম চোখজোড়াতে যেন আগুন জ্বলছে। কন্ঠেও সেই অসীম রাগের বহিঃপ্রকাশ করে রুদ্র বলল, ‘ তোমার চেয়ে খুব ভালোভাবে চিনি আমি এই জঙ্গলটাকে। ইফ ইউ রিমেম্বার, তোমাকে এখানে আমিই এনেছি।’

কিন্তু প্রিয়তা ভয় পেলোনা আজ। চোখে জল টলমল করছে ওর। কেমন অদ্ভুত জেদে শক্ত হয়ে গেল ওর শরীর। কিছুক্ষণ আগেও রুদ্রর প্রতি জন্মানো মায়াটা যেন ক্রোধের অন্ধকার গিলে ফেলল। কোনমতে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলল, ‘ আমাকে যেতে দিন রুদ্র। আমি আপনাকে আঘা*ত করতে চাইনা।’

সত্যিই হাসি পেল রুদ্রর। ব্যঙ্গ করে বলল, ‘ যার হৃদয়টাকে ক্ষ*তবিক্ষ*ত, র*ক্তা*ক্ত করে দিয়েছো। তার শরীরে আঘা*ত করতে চাওনা? ইন্টারেস্টিং!’

শরীর আরও শক্ত হয়ে উঠল প্রিয়তার। জেদে কাঁপতে শুরু করল। হালকা মাথা দুলিয়ে বলল, ‘ আ’ম নট জোকিং।’

‘ মি নেইদার।’

বলতে বলতে এগিয়ে আসছিল রুদ্র। কিন্তু প্রিয়তা ক্যারাটে স্টাইলে নিজের পা তুলে সজোরে লাথি বসালো রুদ্রর হাতে। ব*ন্দু*কটা হাত ফসকাতেই রুদ্রর বুক ঠেলে সোজা একটা গাছের সঙ্গে আটকে ধরল প্রিয়তা। বিদ্যুৎ বেগে একহাতে বের করে আনল একটা ছু*রি। এই ছু*রিটাই কাল প্রিয়তার গলায় ধরেছিল রুদ্র। ঐ রুমেই ফেলে গিয়েছিল! প্রিয়তা ছু*রিটা রুদ্রর গলায় চেপে ধরে বলল, ‘ লেট মি গোও। নয়তো আমার হাতের সেকেন্ড লাস্ট মা*র্ডা*রটা আপনি হবেন।’

বিন্দুমাত্র বিচলিত দেখালোনা রুদ্রকে। শক্ত চোখে তাকিয়ে রইল প্রিয়তার মুখের দিকে। নির্বিকারভাবে প্রিয়তার ছু*রি ধরা হাতটা ধরল। শরীরের শক্তি খাটিয়ে হাতটা একটু সরাতেই প্রচন্ড জোরে ধাক্কা মারল প্রিয়তা রুদ্রকে। খানিকটা দূরে সরতে হল রুদ্রকে। দ্রুত পিছিয়ে মাটিতে পড়া রুদ্রর পি*স্ত*লটা তুলে নিল প্রিয়তা। দুহাতে ধরে রুদ্রর দিকে তাক করল। প্রচন্ড জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলল, ‘আমি শেষবারের মতো বলছি আপনাকে। যেতে দিন আমাকে। না হলে_’

রুদ্র এগিয়ে আসছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ফা*য়ার করল প্রিয়তা। একটুর জন্যে রুদ্রর শরীর ভেদ করলনা বু*লে*টটা। এইবার অবাক হল রুদ্র। চোখে অবিশ্বাস নিয়ে তাকাল প্রিয়তার দিকে। কোথাও যেন একটা আশা ছিল প্রিয়তা ওর দিকে গু*লি ছু*রতে পারবেনা। কোনভাবেই না। কিন্তু আরও একবার খুবই নিষ্ঠুরভাবে রুদ্রর বিশ্বাস, অনুভূতিকে গুড়িয়ে দিল প্রিয়তা। বু*লে*টটা শরীর ভেদ না করলেও রুদ্রর হৃদয়কে এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেল।
কিন্তু প্রিয়তার মধ্যে বেপরোয়া ক্রোধ ছাড়া অন্যকিছুর অস্তিত্ব দেখা গেলোনা। আক্ষরিক অর্থেই যেন পিশাচিনী হয়ে উঠল ও। প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে বলল, ‘যেতে দাও আমাকে! যেতে দাও!’

বলতে বলতে চারপাশ কাঁপিয়ে আরও একটা গু*লির শব্দ হল। বিদ্যুৎ বেগে সরে গেল রুদ্র। কিন্তু শেষ রক্ষা হলোনা। গু*লিটা বা হাতের বাহুঁর খানিকটা মাংস ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল। এবার চোখে অবিশ্বাস নয় জেদ নিয়ে তাকাল রুদ্র। হাত আর মনের যন্ত্রণাকে চাঁপা দিয়ে বেপরোয়াভাবে এগিয়ে গেল। কিন্তু থামতে হল প্রিয়তার হুংকারে, ‘এগোবে না একদম!’

হঠাৎই টুট্ টুট্ আওয়াজ করে উঠল রুদ্রর হাতঘড়িটা। প্রিয়তা তাকাল সেদিকে। হাত আলগা হয়ে গেল ওর। হঠাৎই অন্যমনস্ক হয়ে গেল কেমন যেন। সুযোগটা কাজে লাগালো রুদ্র। দ্রুত এগিয়ে পি*স্ত*ল ধরা হাতটা মুচড়ে ধরল প্রিয়তার। ও ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো সেটা। পায়ের সাহায্যে পি*স্ত*লটা ওপড়ে ছুড়ে হাতে নিয়ে নিল রুদ্র। এবার রুদ্র প্রিয়তাকে ঠেলে ধরল অন্য আরেকটা গাছের সঙ্গে। গলার নিচে চেপে ধরল ব*ন্দু*কের নলটা। রুদ্রর চোখ গিয়ে পড়ল প্রিয়তার চোখদুটোতে।
হঠাৎই রুদ্রর মানসপটে ভেসে উঠল ওদের দুজনের প্রথম দেখা হওয়ার সেই রাতটা। ঘন, অন্ধকার, পূর্ণিমার সেই জঙ্গল ঘেরা রাতে এভাবেই পালাক্রমে একে অপরকে গাছের সঙ্গে চেপে ধরেছিল ওরা। অথচ পরিস্থিতি, অনুভূতি, কারণ কতটা আলাদা! সেদিন সবটাই সাজানো গোছানো একটা নাটক ছিল। এক অবাস্তব পরিস্থিতি। কিন্তু আজ? এরচেয়ে নিষ্ঠুর বাস্তব যেন আর কিছু নেই।

রাতটা অদ্ভুত নিস্তব্ধ। পূর্ণিমা না থাকলেও অর্ধচাঁদ আছে আকাশে। পোকামাকড় আর নিশাচরের ছন্দময় আওয়াজ ভেসে আসছে বিরতিহীনভাবে। রুদ্র তাকিয়ে আছে প্রিয়তার চোখের দিকে। কিছু বলতে চেয়েও পারছেনা যেন। কিছুটা সময় এভাবেই কেটে গেল। কিছুক্ষণ পর রুদ্র বলল, ‘তোমাকে আটকে রাখার আপাতত আর কোন প্রয়োজন নেই আমার। তোমার বাপ কিংবা প্রেমিকের কাছে ফিরে যেতে পারো তুমি এখন। ওদের লাশের পাশে বসে চোখের জল ফেলার মতো একটা মেয়েমানুষ থাকা উচিত। তাই তোমাকে আটকে রাখতে নয় ছেড়ে দিতেই আসছিলাম আজ। কিন্তু রঞ্জুকে আঘা*ত করে ঠিক করোনি তুমি। এতো কিছুর পরেও ছেলেটা সম্মান করে তোমায়। আর তুমি!সেই রাগ থেকেই পিছু নিয়েছি। অথচ দেখ, আমাকে আঘা*ত করতেও তোমার হাত কাঁপেনি । যেখানে আমি তোমার স্বামী, যে তোমাকে উন্মাদের মতো ভালোবেসেছিল। অথচ তুমি তাকে ভালোবাসতে পারোনি।’

প্রিয়তাও তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। হঠাৎই আবার শান্ত হয়ে গেছে মেয়েটা। নিস্তব্ধতা যেন গলা চেপে ধরল দুজনের। তা কাটিয়ে খুব আস্তে করে প্রিয়তা বলে উঠল, ‘যদি বলি পেরেছিলাম। ভীষণভাবে পেরেছিলাম। তাহলে কী আরেকটাবার শুরু করা যায় রুদ্র?’

প্রিয়তার এই ছোট্ট প্রশ্নটা ভেতরসহ নাড়িয়ে দিল রুদ্রর। ঝাঁঝরা করে দিল ভেতরটা। রাগ, দুঃখ, আফসোস, হাহাকারে সর্বাঙ্গ উত্তপ্ত হয়ে উঠল। তীব্র অনিয়ন্ত্রিত সেই অনুভূতিতে পি*স্ত*লের নলটা আরও শক্তভাবে চেপে বসল প্রিয়তার গলায়। চাপা গলায় বলল, ‘ তোমার ভালোবাসতে পারার আর কোন গুরুত্ব নেই রাণী। তোমার ভালোবাসা আমার বাবাকে ফিরিয়ে আনতে পারবেনা। আমার কুহুকে আবার স্বাভাবিক করতে পারবেনা। তোমার ভালোবাসা না আমার বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে, না ইকবাল ভাইকে। তোমার এই সো কল্ড ভালোবাসা আমায় শুধু একটা জিনিসই দিতে পারে। যন্ত্রণা! দ্যাটস্ ইট!’

থমকে গেল প্রিয়তা। রুদ্রর শব্দগুলো যেন একেকটা তী*র হয়ে ভেদ করে চলে গেল ওকে। ছেড়ে দিল শরীরটা। একটা শব্দও করতে পারল না। রুদ্র ক্লিষ্ট হেসে বলল, ‘সময় খুব ভয়ংকর জিনিস রাণী মীর্জা। একবার পেরিয়ে গেলে পরিস্থিতি আর আমাদের অনুকূলে থাকেনা। তোমার আর আমার ক্ষেত্রে ব্যপারটা এখন তাই। তুমি পরিস্থিতিটাই এমন করে ফেলেছো, যে শুরু বলে কোন শব্দ আমাদের জীবনে আর আসবেনা। এখন শুধু শেষের অপেক্ষা। আর এইমুহূর্তে সবচেয়ে নিষ্ঠুর সত্যি কী জানো? এই পৃথিবীতে তোমার আর আমার একসঙ্গে বেঁচে থাকা আর সম্ভব না। হয় তোমাকে, নয় আমাকে; কিংবা দুজনেই মরতে হবে। কিন্তু একসঙ্গে বেঁচে থাকার আর কোন সুযোগ নেই। আর এটাই সত্যি।’

#চলবে…

[ রি-চেইক করার সুযোগ হয়নি। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here