অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ১০০.

0
55

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

১০০.

বেলা বারোটা বাজে। ঘন কুয়াশা ভেদ করে এখনো প্রবেশ করতে পারেনি সূর্যের কিরণ। চারদিকে সাদাকালো মতোন দৃশ্যপট। গুমোট, থম ধরে যাওয়া এক পরিবেশ। দুদিন যাবতই আবহওয়া এমন গুম মেরে আছে। তবে সূর্য উঁকি দেওয়ার সম্ভাবনা আছে আগামীকাল থেকে। সব অন্ধকার আর গুমোটভাব কেটে গিয়ে ঝলমলে আলো ছড়াবে চারদিকে। তবে এরপরই নাকি চাপ দেবে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। এমনটাই জানিয়েছে আবহওয়া অধিদপ্তর।
গায়ে ভারী একটা জ্যাকেট জড়িয়ে নাজিফাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছে উচ্ছ্বাস। আজ চারদিন হল দুবাই গেছে রুদ্র। যোগাযোগ নেই কারো সঙ্গে। সোলার সিস্টেমের বেশিরভাগ কাজের দায় এখন ওর কাঁধে। দুদিন কাজের এতোবেশি চাপ ছিল যে আসতে পারেনি মেয়েটার কাছে। খবর নেওয়া হয়নি ঠিকভাবে। উচ্ছ্বাসকে দেখেই চোখমুখ প্রসন্নতায় ছেয়ে যায় নাজমা বেগমের। উচ্ছ্বাসের সবিনয় বারণকে উপেক্ষা করে রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পরে। দুপুরে না খাইয়ে ছাড়বেনা তিনি ওকে।

নাজিফাদের বাড়ির ছাদের সেই কাঠের আসনে বসে আছে উচ্ছ্বাস আর নাজিফা। নাজিফার একটা হাত নিজের দু-হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছে উচ্ছ্বাস। ওর দৃষ্টি এখন নাজিফার ফুলে ওঠা সাড়ে আটমাসের পেটের দিকে। উচ্ছ্বাসকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নাজিফা বলল, ‘কী দেখছো?’

উচ্ছ্বাস অনেকটা ভাবুক হয়ে বলল, ‘দেখছি না, ভাবছি।’

‘ কী ভাবছো?’ জিগ্যেস করল নাজিফা।

উচ্ছ্বাস ভাবুক থেকেই বলল, ‘ ওর নাম কী রাখা যায়।’

হেসে ফেলল নাজিফা। নাজিফাকে হাসতে দেখে ভ্রুকুটি করল উচ্ছ্বাস, ‘হাসছো যে?’

‘ আগে ওকে আসতেতো দাও।’

‘ তবুও! আগে থেকে ভেবে রাখা ভালো না। পরে দেখা যাবে মাথায় কোন নামই এলোনা। শেষে যে কেউ যা ইচ্ছা বলে ডাকতে শুরু করে দেবে। যেমন ধরো চিন্টু, মিন্টু, পিন্টু। ইশ! ভাবতে পারো! আমার অতো সুন্দর বাচ্চাটাকে কি-না ডাকবে চিন্টু! অসম্ভব!’

সশব্দে হেসে ফেলল নাজিফা। উচ্ছ্বাস চোখমুখ গম্ভীর করে বলল, ‘ ব্যপারটা কিন্তু সিরিয়াস। মানছি আমার নাম টোকাই ছিল। তাই বলে আমার বাচ্চা জন্মের কয়েকবছর পরই বুঝে যাবে যে ওর বাপের এমন উদ্ভট নাম ছিল, সেটাতো হতে দেওয়া যায়না। মান-সম্মান বলে একটা ব্যপার আছেতো না-কি?’

নাজিফার হাসির শব্দ বাড়ল। ওর খিলখিল হাসিতে মুখোরিত হয়ে উঠল গোটা ছাদ। উচ্ছ্বাস অপলক তাকিয়ে দেখল সেই হাসি। কতগুলো দিন পর এভাবে প্রাণখুলে হাসছে নাজিফা। উচ্ছ্বাসের মনে পড়ল, এভাবেই হাসতো মেয়েটা একসময়। যখন পার্কে পাশাপাশি বসে থাকতো ওরা। উচ্ছ্বাসের এধরণের উদ্ভট কথায় কখনও রেগে যেতো, কখনও হেসে ফেলতো। উচ্ছ্বাসের মাথাটা নিজের কোলে রেখে গরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিতো। সেসব এখন কেবলই ফ্যাকাশে স্মৃতি। ওদের বিচ্ছেদ থেকে শুরু করে একের পর এক শারীরিক, মানসিক আঘাতে নিঃশ্বেষ হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। মুখ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল এই প্রাণচ্ছল হাসিটা। উচ্ছ্বাসকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসি আপনাআপনি থেমে গেল নাজিফার। দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছু মুহূর্ত। আচমকা চোখ সরিয়ে নিল নাজিফা; খানিক ইতস্তত করল। উচ্ছ্বাসের মুঠো থেকে আলতো করে ছাড়িয়ে নিল নিজের হাত। মৃদু গলায় বলল, ‘ মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিলে ব্যপারটা নিয়ে?’

বিস্তৃত কুয়াশার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল উচ্ছ্বাস, ‘না, কী বলব? এখনতো চাইলেও বিয়ে করতে পারব না আমরা। তোমার ডেলিভারির আগেতো সম্ভব না। আর তাছাড়াও, আমের ভিলার বর্তমান সমস্যা না মেটা অবধি…’

উচ্ছ্বাসকে থামিয়ে দিয়ে নাজিফা বলল, ‘আমি জানি সেকথা। বলেছো তুমি আমাকে। কিন্তু মা ভীষণ চিন্তায় থাকেন। তুমি সেদিন কোন উত্তর দাওনি। সে ভেবেই নিয়েছে, তোমার উত্তর না। অন্তত আমাদের সিদ্ধান্তটাতো মাকে জানানো উচিত। তুমি বলবে কি-না?’

দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল উচ্ছ্বাস। নাজিফার দিকে তাকিয়ে একটা ভ্রু উঁচু করে বলল, ‘ সে না হয় জানালাম। কিন্তু কী ব্যপার বলোতো? সত্যিই তোমার মা কাউকে পছন্দ-টছন্দ করে বসে আছে নাকি? আই মিন তোমাকে বিয়ে দিয়ে, পরে নিজেও…’

বাহুতে সজোরে কিল পড়াতে থেমে গেল উচ্ছ্বাস। হেসে ফেলল। উচ্ছ্বাসের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিল নাজিফা। বলল, ‘ঐদিনের পর কখনও কল্পণাও করিনি, আবার কখনও এমন দিন দেখতে পাব। আবার তোমাকে ছুঁতে পারব। তোমার কাঁধে মাথা রাখতে পারব।’

হঠাৎ চোখমুখ গম্ভীর হয়ে উঠল উচ্ছ্বাসের। কিছু একটা ভেবে বলল, ‘ তোমার শিফাত ভাইয়ের কথা মনে পড়ে?’

চোখের দৃষ্টি উদাস হয়ে উঠল নাজিফার। ঘন কুয়াশায় যেন হারিয়ে গেল সেই দৃষ্টি। অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘পরেতো। যতবার নিজের ভেতর ঐ মানুষটার অংশ অনুভব করি; ঠিক ততবার মনে পড়ে। সত্যি বলতে, অমন ভালো মানুষ খুব কম দেখেছিলাম আমি জানো? একদম একটা ফুলের মতো আগলে রাখতো আমাকে। তার এতো ভালোবাসার বদলে পাল্টা ভালোবাসতে পারিনি তাকে আমি। সব ভুলে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারিনি। মনের ওপরতো জোর চলেনা। আমার মনপ্রাণ সর্বস্বতো অনেক আগেই তোমাকে দিয়ে দিয়েছিলাম।’

উচ্ছ্বাস তাকিয়ে রইল নাজিফার দিকে। নাজিফা বলে চলল, ‘তবে বিশ্বাস করো, ওনার প্রতি দায়িত্বে পালনে কোনদিনও একবিন্দু অবহেলা করিনি। মনে মনে গুমরে মরলেও কখনও লোকটাকে বুঝতে দেইনি। পাছে সে কষ্ট পায়। সেতো সুন্দর একটা সংসারের স্বপ্ন দেখেছিল। নিজের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে বলে তার স্বপ্নকে ভাঙি কীকরে? তাই সে যতদিন ছিল ওনার স্বপ্নের সংসারই উপহার দিয়েছি আমি তাকে। একা ঘরে মুখে কাপড় গুজে কাঁদলেও উনি সামনে আসার আগেই মুছে ফেলতাম সেই চোখের জল। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে হাজির হতাম ওনার সামনে। কোনদিন ওনাকে ফেরাইনি আমি। একজন আদর্শ স্ত্রী তার স্বামীকে ঠিক যা যা দিতে পারে, সব দিয়েছি। শুধু মনটা ছাড়া। তাকে আমি শ্রদ্ধা করেছি, কিন্তু ভালোবাসতে পারিনি। এই একটা দিক দিয়েই হয়তো আমি তার কাছে অপরাধী থেকে যাব উচ্ছ্বাস। চিরকাল অপরাধী থেকে যাব।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল উচ্ছ্বাস। নাজিফার মাথাটা টেনে নিল নিজের বুকে। আলতো করে হাত বুলালো। চোখ দিয়ে নীরব ধারায় পানি পড়ছে নাজিফার। মেয়েটা আবেগি হয়ে উঠছে। পুরোনো সব কষ্ট মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে হঠাৎ। বুঝতে পারল উচ্ছ্বাস। পরিস্থিতি সামলাতে বলল, ‘বিয়েতো করবো, কিন্তু একটা ব্যপার ভাবলেইতো ধুকপুক করছে বুকটা।’

উচ্ছ্বাসের বুকে মাথা রেখেই ওর মুখের দিকে তাকাল নাজিফা। নাক টেনে বলল, ‘কী?’

উচ্ছ্বাস খুব গম্ভীর এক ভাব করে বলল, ‘ রুদ্রকে দেখছি আমি। বিয়ে করে কী ফাঁসাটাই না ফেঁসেছে বেচারা। সবার কাছে সিংহ, অথচ বউয়ের সামনে গিয়েই কেমন মিয়াও মিয়াও করে। জীবনে রুদ্রকে দিয়ে কেউ যা করাতে পারেনি, বউমণি পেরেছে। রুদ্র আমেরের বউ তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাইরে গিয়ে ঘর ভাড়া করে থাকে, তারপর আবার মাঝরাতে ঝগড়া করে বেরিয়ে যায়। ভাবতে পারো? বউ জাতির কী অসীম ক্ষমতা! আমার বউমণিটাতো তাও নম্র, ভদ্র, সহজসরল মেয়ে। কিন্তু তুমিতো একেবারে ঝাঁসির রাণী! নিজের ভবিষ্যৎ কতটা সংকটাপন্ন সেটাই ভেবে দেখছিলাম আরকি।’

উচ্ছ্বাসের দিকে কটমটে চোখে তাকাল নাজিফা। পরপর কয়েকটা কিল বসাল উচ্ছ্বাসের বুকে, ‘শয়তান একটা। বিয়েটা একবার হোক, কাঁধে চেপে ঘাড় মটকাবো।’

অমায়িক হেসে নাজিফাকে বুকে জড়িয়ে নিল উচ্ছ্বাস। যেন আর কোন দুঃখ-কষ্টকে কোনভাবেই ছুঁতে দেবেনা মেয়েটাকে।

দুপুরের খাবারটা নাজিফাদের বাড়িতেই খেতে হল উচ্ছ্বাসকে। মাংসভুনা, ডাল আর একটা ভাজি করেছে নাজমা। পছন্দের পদ পেয়ে পেট পুড়েই খেলো উচ্ছ্বাস। নাজমা প্রচন্ড উৎসাহে যত্নভরে খাবার পরিবেশন করল। খাওয়া-দাওয়া শেষে সবকিছু গুছিয়ে রাখার পরেই উচ্ছ্বাস ডাকল নাজমাকে। নাজমা হাত মুছতে মুছতে ঘরে এসে বলল, ‘হ্যাঁ, বলো বাবা!’

বিছানায় বসে আছে নাজিফা। কিছু বলার আগে নাজিফার দিকে একপলক তাকাল উচ্ছ্বাস। নাজিফা নিষ্পলক তাকিয়ে আছে উচ্ছ্বাসের দিকে। পরিস্থিতি বুঝতে পারল না নাজমা। বিভ্রান্তি নিয়ে একবার করে তাকাল নাজিফা-উচ্ছ্বাসের দিকে। লম্বা শ্বাস ফেলল উচ্ছ্বাস। নাজমার দুটো বাহু আকড়ে ধরে বসাল বিছানায়। অতঃপর হাঁটু ভেঙ্গে বসল তার সামনে। নাজমার চোখে তখনও বিভ্রান্তি। উচ্ছ্বাস নাজমার হাতদুটো নিজের দুহাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘কাকি! সেদিন তুমি আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলে। মনে আছে তোমার?’

দ্বিধা কাটতে শুরু করল নাজমার। উচ্ছ্বাস কোন বিষয়ে কথা বলতে চাইছে বুঝতে পারল। চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার। আশাপূর্ণ চোখে চেয়ে রইল উচ্ছ্বাসের দিকে। কাঙ্ক্ষিত কথাটি কী তবে শুনে মরতে পারবে সে? উচ্ছ্বাস নাজমার হাত আরেকটু শক্ত করে ধরে বলল, ‘ তুমি জিজ্ঞেস করেছিলেনা? তোমার মেয়েকে আমি বিয়ে করব কি-না? এখন আমি জিজ্ঞেস করছি, তোমার মেয়েটাকে আমার হাতে তুলে দেবে কাকি? রাজরাণী করে রাখতে পারব না। কিন্তু কথা দিচ্ছি, শেষ নিঃশ্বাস অবধি নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখব ওকে। বিয়ে দেবে ওর সঙ্গে আমার?’

চোখভর্তি অবিশ্বাস নিয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে রইল নাজমা। কখন যেন অশ্রু এসে জমা হয়েছে দুচোখে। ঘাড় ফিরিয়ে নাজিফার দিকে তাকাল নাজমা। ভরা পেটে হাত রেখে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা, নিঃশব্দে। ঠোঁটে অমায়িক হাসি রেখে তাকিয়ে আছে উচ্ছ্বাস। উত্তরের অপেক্ষায়। উচ্ছ্বাসের হাতে মৃদু চাপ দিল নাজমা। মাথা ঝাকাতেই কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে নামল চোখ বেয়ে।

*

চট্টগ্রাম। ব্লাক হোল গ্রুপটার জন্যে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা, ঠিক তেমনভাবে সবচেয়ে বিপদজনক জায়গাও। সবচেয়ে বেশি ডেরা এবং লোক থাকায় ব্লাক হোলের যেকোন সদস্যের জন্যে চট্টগ্রাম লুকানোর আদর্শ জায়গা। যেকোন সময়, যেকোনরকম সুবিধা পাবে সে। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ডিজঅ‍্যাডভান্টেজও এটাই। সবচেয়ে বেশি ডেরা থাকায় সহজেই অনুমান করা যায় যে সে চট্টগ্রাম আছে। কিন্তু চট্টগ্রামতো আর ছোট্ট জায়গা না। বুঝে গেলেও, খুঁজে বের করা অনেকটা খড়ের গাদায় সুঁচ খোঁজার মতো। স্বস্তিটা এখানেই!
কথাগুলো চিন্তা করে সন্তুষ্টমনে কাচ্চির মাংসে কামড় বসাল রাতুল। দিনকাল ভালোই যাচ্ছে। এই তীব্র ঠান্ডায় সারাদিন লেপের নিচে আয়েশ করতে পারলে কার ভালো না লাগে? লুকিয়ে থাকার বাহানায় আয়েশি জীবন যাপন করছে ও এখন। ঘর থেকে বের হয়না। যাই প্রয়োজন হয়, নিচে লোক দিয়ে আনিয়ে নেয়। বাকি সময়টা শুয়ে, বসেই কেটে যায়। কোন সিম ব্যবহার করছেনা এখন রাতুল। আদেশটা সম্রাটের। পর্যাপ্ত টাকা আর উপদেশ দিয়ে লুকিয়ে পড়তে বলেছে সম্রাট ওকে। সিম বন্ধ রাখতে বলেছে। ভুলেও যোগাযোগ করতে বারণ করে দিয়েছে সে। যোগাযোগ করার প্রয়োজনও নেই। যা টাকা দিয়েছে তাতে বেশ অনেকদিন আরাম করেই কেটে যাবে ওর।

এভাবে গা ঢাকা দেওয়ার কারণ একটাই। রুদ্র আমের। নামটা মনে করতেই ভেতরটা কেমন শিরশির করে ওঠে রাতুলের। আন্ডারওয়ার্ল্ডের জগতে এতোকাল আছে। অমন ভয়ংকর লোক দুটো দেখেনি সে। সেই লোকটার অনাগত সন্তানকে হত্যা করেছে ও। ওকে পাতাল থেকে হলেও খুঁজে বের করবে রুদ্র আমের। সেই ভয়েই ছিল ও। তাই আর যাই হোক চট্টগ্রাম লুকোতে চায়নি। কিন্তু সম্রাট ওকে আশ্বস্ত করে বলেছে, রুদ্র খুঁজে পাবেনা ওকে। ওকে খুঁজতে হলে বাকি সবকাজ ফেলে ওকে খোঁজাতেই মনোযোগ দিতে হবে রুদ্রকে। রুদ্রর যা সোর্স, সেক্ষেত্রে কঠিন হবেনা খুঁজে পাওয়া। কিন্তু এ মুহূর্তে অতোটা সময় নেই রুদ্রর কাছে। সুতরাং আপাতত সম্পূর্ণ নিরাপদ সে।

কিন্তু রাতুল জানেনা, শুধু রুদ্র আমের নয়। রাণী মীর্জাও খুঁজছে তাকে। যে রুদ্রর মতোই ভয়ংকর। এ বিষয়ে সম্রাটও সতর্ক করেনি তাকে। সম্রাটের ধারণা, ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম যাওয়ার সুযোগ পাবেনা প্রিয়তা। অন্তত সকলের সামনে নিজের প্রিয়তা সত্তাকে ধরে রাখতে চাইলে কোনভাবেই সম্ভব না সেটা।

দরজায় টোকা পড়তেই খাওয়া থামাল রাতুল। তখনও মুখভর্তি বিরিয়ানি। ভ্রুকুটি করে তাকাল দরজার দিকে। এক বোতল হুইস্কি আর দু প্যাকেট সিগারেট কিনতে টাকা দিয়েছিল দারোয়ানকে। সেটাই নিয়ে এসেছে বোধহয়। খাবার চিবুতে চিবুতেই দরজার সামনে গিয়ে হাক ছাড়ল, ‘কে?’

‘ আমি, জয়। চিনতে পেরেছো?’

চিনতে পেরেছে রাতুল। ডার্ক নাইটের সেই ছোকরাটা না? এখানে কী করতে এসেছে? ঠিকানাই বা পেলো কোথায়? জরুরি কোন দরকার না-কি? দরজা খুলল রাতুল। দেখল সটান দাঁড়িয়ে আছে জয়। একাই এসেছে। নিরস্ত্র। বিভ্রান্ত হয়ে প্রশ্ন করল, ‘তুমি এইহানে? আমার ঠিকানা পাইলা কই?’

‘ জোগাড় করেছি অনেক কষ্টে। দুদিন তোমার ঠিকানার পেছনেই দিনরাত ছুটতে হয়েছে আমাকে। অবশেষে পেলাম।’ যান্ত্রিক কন্ঠে বলল জয়।

‘ কিল্লিগ্গা? কোন দরকার?’

‘ দরকার বলেইতো খুঁজে বের করতে বলল বস রা।’

খোঁচা দাড়িভর্তি গালটা চুলকাল রাতুল। সংশয় নিয়ে বলল, ‘সম্রাট ভাই?’

মাথা ঝাঁকাল জয়, ‘ উনিও আছেন।’

‘ আহো, ভিতরে আহো।’

ভেতরে গেল জয়। দরজা বন্ধ করে কাচ্চির থালাটা নিয়ে বিছানায় বসল রাতুল, ‘খাইছোনি রাত্রে?’

‘ খেয়েছি।’

আবার এক লোকমা মুখে পুড়ে নিল রাতুল। চিবুতে চিবুতে বলল, ‘ কাহিনী কী কও দেহি।’

‘ কাজ আছে। সামনে ইমপর্টেন্ট একটা ডেলিভারি। কাজে লাগবে আমাদের।’

‘ আর রুদ্র?’

‘ দেশে নেই সে। দুবাই গেছে। এজন্যই বোধহয় তোমাকেও ডেকেছে।’

বিজ্ঞের মতো মাথা ঝাঁকাল রাতুল। সন্তুষ্ট ভাব ফুটল চেহারায় এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হয়েছে। মুখে আরও একগ্রাস তুলে নিয়ে বলল,’তা কবে দেহা করতে হইব?’

‘ আজ, এখনই।’

থমকে গেল রাতুল। সময় দেখল বিভ্রান্ত চোখে। রাত দশটা রাজে। এখন! রাতুলের চোখের ভাষা যেন পড়ে ফেলল জয়। তাই বলল, ‘ ইমার্জেন্সি।’

আবার একই ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল রাতুল। নিজের হাতে ধরা কাচ্চির প্লেটটা দেখিয়ে বলল, ‘শ্যাষ কইরা লই? তারপর উঠতাছি।’

মনে মনে হাসল জয়। তাড়া দিলোনা। জীবনের শেষ বিরিয়ানিটা আয়েশ করেই খাক বেচারা।

*

আমের ভিলার ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই চমকে উঠল উচ্ছ্বাস। রাত দশটার বেশি বাজে। অথচ সকলে ড্রয়িংরুমে বসে আছে। চোখমুখে একরাজ্যের গাম্ভীর্য। ভ্রু কুঁচকে সবার দিকে চোখ বুলালো উচ্ছ্বাস। জ্যোতি, কুহু, নীরব, জাফর সবাই উপস্থিত থাকলেও, উপস্থিত নেই প্রিয়তা। উচ্ছ্বাস সংশয় নিয়ে বলল, ‘ কী হয়েছে? সবাই এভাবে বসে আছো এখানে? কোন সমস্যা হয়েছে?’

উত্তর দিতে পারল না কেউ। চোখমুখের গাম্ভীর্যতা আরও বাড়ল কেবল। অধৈর্য হল উচ্ছ্বাস, ‘ আশ্চর্য! কেউ কথা বলছোনা কেনো? কী হয়েছে বলবেতো? আর বউমণি কই?’

অস্বস্তিকর একটা পরিবেশ তৈরী হল চারপাশে। উঠে দাঁড়াল জ্যোতি। নিজের ফোনটা এগিয়ে দিল উচ্ছ্বাসের দিকে। ভ্রুকুটি করে একবার জ্যোতির থমথমে মুখটার দিকে তাকাল উচ্ছ্বাস। অতঃপর ফোনটা নিল। স্ক্রিন অন করাই ছিল। তাতে আছে প্রিয়তার নাম্বার থেকে আসা একটা মেসেজ। যাতে লেখা আছে-

‘আমি চট্টগ্রাম যাচ্ছি। আমার সেই অনাথআশ্রমে কথা মনে পড়ছে ভীষণ। যেখানে আমি বড় হয়েছি। আমার ছোটবেলা কেটেছে। রুদ্রকে বললে কখনও যেতে দিতোনা আমায়। তাই ও না থাকার সুযোগেই যেতে হলো। তবে চিন্তা করোনা, আমার সঙ্গে সবসময় থাকার জন্যে যে ছেলেটাকে ও বলেছে, তাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি আমি। কোন বিপদ হবেনা আমার। নিজেদের খেয়াল রেখো।

প্রিয়তা।’

*

জয়ের সঙ্গে একটা গোডাউনে এসে ঢুকলো রাতুল। চারপাশে সাড়ি সাড়ি বস্তা সাজানো। যারমধ্যে অর্ধেক আটা, বাকি অর্ধেক হে*রো*ইন। ব্লাক হোলের ড্রা*গসের ব্যবসা খুব তাগড়া। আর এসব ব্যবসা অধিকাংশই চলে কোন না কোন লিগাল বিজনেসের আড়ালে। যেমন আটা, ময়দা ইত্যাদি। গোডাউনে মাঝেমধ্যে পুলিশ রেট করতে আসে ঠিকই। কিন্তু নামের একটু চেইক করেই চলে যায়, কিংবা চলে যেতে হয় তাদের। স্থানীয় এমপি, মন্ত্রীদেরও হাত করে রাখে ওরা। নিজেদের সুবিধার্থে তারাও পরিপূর্ণ সহায়তা প্রদান করে এসব মাফিয়াদের। কারণ একটাই। ভবিষ্যতে অনৈতিকভাবে চেয়ার ধরে রাখতে এরাই শেষ কাজে লাগে তাদের। সেই অন্যায় আদেশ না মেনে কেউ কিছু করতে গেলেই খু*ন হতে হয় তাকে। এজন্যইতো বছরে এক-দুটো পুলিশ, সাংবাদিক কিংবা ছাত্রের লা*শ খুঁজে পাওয়া এদেশের অলিখিত এক নিয়ম। এসব গোডাউনের নিচে তৈরী করা থাকে বিশাল আকারের বেসমেন্ট এড়িয়া। হঠাৎ রেট পড়লে মাল সরানোর উপযুক্ত জায়গা।

রাতুলকে নিয়ে বেসমেন্টেই নামল জয়। রাতুল জানে, আলোচনা সাধারণত বেসমেন্টেই হয়। তাই তখনও অবাক হয়নি ও। অবাক হল তখন, যখন দেখল বেসমেন্টটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। অজান্তেই পা থমকে গেল রাতুলের। হতবাক হয়ে বলল, ‘ অন্ধকার ক্যান এতো? আর লোক কই?’

‘ আসছে! পৌঁছবে এক্ষুনি। তুমি এগোও, লাইট জ্বালাচ্ছি আমি।’

মন শায় দিলোনা রাতুলের। গা শিরশিরিয়ে উঠল। ভেতর থেকে কেউ যেন শতর্ক করে দিল, এগিয়ো না, আর এগিয়ো না। কিন্তু ওর শরীর শুনলোনা মনের সাবধানবাণী। অনেকটা ঘোরের মধ্যে থেকেই এগিয়ে গেল আরও কয়েক পা। সঙ্গে সঙ্গে বেসমেন্টের ঠিক মাঝখান জ্বলে উঠল একটা হলদেটে আলো। থমকে দাঁড়াল রাতুল। সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে মাটি থেকে ছাদ পর্যন্ত একটা পিলার। সেই পিলারের নিচে দাঁড়িয়ে আছে এক রমনী। হলদেটে গায়ের রঙ, পরনে কালো টিশার্ট আর জিন্স। তার ওপরে চাপিয়েছে ছেলেদের কালো জ্যাকেট। চুলগুলো উঁচু করে ঝুঁটি করা। ছোট চুলগুলো কপালের দুপাশে ছড়িয়ে আছে। চিনতে বিন্দুমাত্র দেরি হলোনা রাতুলের। শওকত মীর্জার মেয়ে। রাণী মীর্জা! কিন্তু সে এখানে কেন? বাকিরা কোথায়?

রাণীর চোখে চোখ পড়তেই কলিজায় টান পড়ল যেন রাতুলের। রাণীর এখানে আসার কারণ জানেনা ও। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক ঠেকল না। বাচ্চাটা রাণীরও ছিল। ঐ ঘটনাটা কী তবে রাণীর অমতে ঘটানো হয়েছিল? সম্রাট ভাইতো সেকথা বলেনি। এড়িয়ে গেছে? সর্বনাশ! ভীষণভাবে পালানোর তাগিদ অনুভব করল রাতুল। আগেপিছে কিছু না ভেবেই পেছন দিকে ছুট লাগালো। কিন্তু বেসমেন্টে নামার সিঁড়ির মাথায় ব*ন্দু*ক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে তনুজা। থামতে হল রাতুলকে। হতভম্ব হয়ে পেছন তাকাল। প্রিয়তা এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে নির্বিকারভাবে। লম্বা দুটো শ্বাস ফেলল রাতুল। যা করার ওকেই করতে হবে। বিদ্যুৎ গতিতে পেছন থেকে নিজের পি*স্ত*ল বের করল রাতুল। কিন্তু জয়ের হাত চলল আরও দ্রুত। সঙ্গে সঙ্গে পিস্তল বের করে রাতুলের হাতে গু*লি কর জয়। পরে গেল ব*ন্দু*ক। হাত ধরে চিৎকার করে বসে পড়ল রাতুল। বেসমেন্টে ওর চেঁচানোর আওয়াজটা বেশ ভয়ংকর লাগল সে মুহূর্তে। এগিয়ে গিয়ে রাতুলের কলার ধরে দাঁড় করালো জয়। বেধড়ক কয়েকটা কিল, ঘুষি, লাথি মেরে ধরাসাই করল ওকে। এরপর টেনে নিয়ে গেল ঠিক মাঝখানে। যেখানে প্রিয়তা দাঁড়িয়ে আছে। ধাক্কা দিয়ে প্রিয়তার পায়ের কাছে ফেল রাতুলকে। ততক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসেছে তনুজাও। পিস্তলটা সেভাবেই তাক করা রাতুলের দিকে।

ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে প্রিয়তার দিকে তাকাল রাতুল। মুখ দিয়ে তখনও আর্তনাদ বেরোচ্ছে। কোনমতে সেটা থামিয়ে বলল, ‘ আমার মাইরেন না ম্যাডাম। আমি কিছু করিনাই।’

প্রিয়তার নির্লিপ্ত মুখটাতে সামান্য হাসি ফুটল এতক্ষণে। এক হাঁটু ভেঙ্গে বসল ঠিক রাতুলের সামনে। মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিছুই করিস নি?’

মাথা নাড়িয়ে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বসল রাতুল, ‘আমি কিছু করিনাই ম্যাডাম। আসলেই করিনাই।’

‘ তাহলে চট্টগ্রাম এসে গা ঢাকা দিয়েছিলি কেন?’ শান্ত গলায় জানতে চাইল প্রিয়তা।

হাত দিয়ে দরদর করে র*ক্ত বেরোচ্ছে রাতুলের। যন্ত্রণায় কাতরাতে থেকে বলল, ‘মিছা কতা! মিছা কতা ম্যাডাম। আমি কামে আইছিলাম এইহানে।”

‘ আর গু*লি? সেটা কেন ছুড়ছিলি?’

‘ ডরাইয়া গেছিলাম আমি_’

বলতে বলতেই কাশতে শুরু করল রাতুল। ঠোঁটে এখনো ছোট্ট সেই হাসিটা ঝুলিয়ে রেখেছে প্রিয়তা। চোখ তুলে জয়ের দিকে তাকানোমাত্র জয় বুঝে ফেলল তার করণীয়। যে পিলারটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল প্রিয়তা, জোরপূর্বক সেটা ঘেষে বসালো রাতুলকে। অতঃপর ওটার সঙ্গেই শক্ত করে বেঁধে ফেলল। হাতদুটো সামনে রেখে পেটসহ পেঁচিয়ে বেধেঁছে খুটির সঙ্গে। পা দুটো মেলে ছড়িয়ে দিয়েছে দুদিকে। পুরোটা সময় হাতের যন্ত্রণায় পাগলের মতো আর্তনাদ করেছে রাতুল। ওকে বাঁধা হতেই পিস্তল নামিয়ে রাখল তনুজা। ওটার দরকার নেই আর। দ্রুত গিয়ে একটা কালো ব্যাগ এনে রাখল বন্দি রাতুলের পাশে। ব্যাগটা রাখার সময় হাত থরথর করে কাঁপছিল তনুজার।

কালো ব্যাগটার দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল প্রিয়তা। ঠোঁটের সেই হাসি সামান্য প্রসারিত হল। রাতুলের ঠিক মুখোমুখি গিয়ে হাঁটু ভেঙ্গে বসল ও। যন্ত্রণায় কোঁচকানো মুখ নিয়ে রাতুল তাকাল প্রিয়তার দিকে। মেয়েটা ঠিক সাপের মতো ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ভেতর থেকে কাঁপুনি ধরে গেল যেন রাতুলের। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তনুজা। জানে, এই পিশাচিনী কী করবে এখন। জানে জয়ও। কিন্তু ওর মুখোভঙ্গি দেখে মনবৃত্তি তেমন বোঝা গেলনা।

নরম, শান্ত গলায় প্রিয়তা বলল, ‘ সেদিন হসপিটালে আমাকে সিঁড়ি থেকে ধাক্কা কে দিয়েছিল?’

বুকের ভেতরটা ভয়ংকরভাবে কাঁপছে রাতুলের। হাতের তীব্র যন্ত্রণা এই ভয়ের কাছে পাত্তা পাচ্ছেনা কোনভাবেই। উত্তর না পেয়ে কোন প্রতিক্রিয়া দেখালোনা প্রিয়তা। নির্বিকারভাবে কালো ব্যাগের চেইনটা খুলল। ধীরেসুস্থে বের করে আনলো একটা প্লাস। চোখ বড় বড় হয়ে গেল রাতুলের। রাণী মীর্জার হিস্ট্রি রেকর্ড কিছুটা জানে ও। জানে কতটা নৃশংস এই মেয়ে। ভয়ে অস্থির হয়ে উঠল রাতুল। দম আটকে এলো ওর। পাগলের মতো ছটফট করে বলল, ‘ আমি জানিনা ম্যাডাম। সত্যই জানিনা।’

এবারেও শান্তই রইল প্রিয়তা। কেবল খপ করে চেপে ধরল রাতুলের গু*লিবিদ্ধ হাতটা। চিৎকার করে উঠল রাতুল। কিন্তু তাতেই থামল না ও। প্লাসটা চেপে ধরল ওর র*ক্তা*ক্ত আঙ্গুলের নখে। রাতুলের আর্তনাদ বাড়ল। প্লাস দিয়ে টেনে পরপর দুটো আঙ্গুল থেকে নখ ছিড়ে ফেলল প্রিয়তা। রাতুলের আর্তনাদে বেসমেন্টে প্রতিধ্বনিত্ব হতে থাকল। কিন্তু প্রিয়তার চেহারায় কোন প্রতিক্রিয়া নেই। যেন কিছুই করছেনা ও। একটা বাচ্চা যেমন ভঙ্গিতে খেলনা নিয়ে খেলে, তেমন ভাবেই কাজটা করছে। তৃতীয় আঙুলটায় চাপ দিতেই মুখ খুলল রাতুল। চিৎকার করে বলল, ‘ আমিই ধাক্কা দিছিলাম। মাফ কইরা দ্যান। মাফ কইরা দ্যান ম্যাডাম। আপনের পায়ে ধরি মাফ কইরা দেন।’

তনুজা পিটপিটে চোখে তাকিয়ে দেখল চোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল বেরোচ্ছে রাতুলের। লাল হয়ে গেছে মুখটা। প্রিয়তা জোরে চাপ দিল আঙ্গুলটাতে। আবার চেঁচিয়ে উঠল রাতুল। প্রিয়তা ঠান্ডা গলাতেই বলল, ‘কে বলেছিল কাজটা করতে?’

বলতে বলতে টেনে ছিড়ছে আঙুলের নখ। ব্যথায়, যন্ত্রণায় চারপাশ অন্ধকার হয়ে উঠল রাতুলের। নার্ভগুলো চিৎকার করে বলল, প্রিয়তার কথামতো উত্তর দিলেই এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। জানে একথা সত্যি নয়, তবুও বলে ফেলল, ‘ সম্রাট ভাই কইছিল, সম্রাট ভাই।’

সেকেন্ডের জন্যে শরীর স্থির হয়ে গেল প্রিয়তার। পরমুহূর্তেই চলল নিজের গতিতে। আর কিছু জানার নেই ওর। তাই এবার নিজের সেই ভয়ানক পৈশাচিকতা শুরু করল। আশেপাশে তাকালনা, কোন আওয়াজ কানে তুলল না। প্লাস দিয়ে টেনে টেনে রাতুলের নখগুলো সব ছিড়ে ফেলল। তবে এবার নির্লিপ্ততা ছিলোনা মুখে। দুচোখ ভর্তি ছিল জ্বলজ্বলে আক্রোশ। বেসমেন্টে বাজতে থাকা রাতুলের চিৎকার যেন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল সেই আক্রোশকে। কাজটা শেষ করে লম্বা শ্বাস ফেলল প্রিয়তা। অকল্পনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করছে রাতুল। মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে মৃদু আর্তনাদ। ব্যাগটাতে আরও একবার হাত দিল। বেরিয়ে এলো একটা প্যাকেট। ভেতরে লাল পাউডার। বিস্ফোরিত চোখে তাকাল রাতুল। মাথা নেড়ে না করল। কথা বলতে গিয়ে বিকৃত আর্তনাদ ধ্বনি করে ফেলল মুখ দিয়ে। প্রিয়তা তাকাল রাতুলের ক্ষ*তবিক্ষ*ত আঙুলগুলোর দিকে। বলল, ‘ রক্ত বেরোচ্ছে। কিন্তু রঙটা ভালো না। এটা দিলে চমৎকার রঙ আসবে।’

বলতে বলতেই চিলি পাউডার সবটুকু ঢেলে দিল রাতুলের দু হাতের আঙ্গুলে। ভয়ানক আর্তনাদে টেকা দায় হল বেসমেন্টে। চোখ বন্ধ করল তনুজা। উঠে দাঁড়াল প্রিয়তা। জয়ের দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারা করল। ইশারা পেতেই সঙ্গে সঙ্গে একটা সিগারেট বের করল জয়। লাইটার দিয়ে জ্বালিয়ে দ্রুত এগিয়ে দিল প্রিয়তাকে। দু আঙুলের মাঝে সেটা তুলে নিল প্রিয়তা। এদিক ওদিক হাঁটতে হাঁটতে ব্যস্ত হাতে টান দিল সিগারেটে। চোখ দিয়ে জল বের হচ্ছে প্রিয়তার। স্পষ্ট দেখতে পেল সেটা জয়।
এদিকে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করেই চলেছে রাতুল। সেই আর্তনাদকে উপেক্ষা করে কিছুক্ষণ আপনমনে সিগারেট টানল প্রিয়তা। অর্ধেকর মতো সিগারেটটা টেনে আবার বসল রাতুলের সামনে। আর্তনাদ করতে করতে, প্রাণভিক্ষা চাইতে চাইতে; ততক্ষণে ক্লান্ত হয়ে গেছে রাতুল। প্রিয়তাকে আবার কাছে আসতে দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠল ও। ছটফট করে মিনতি করল, ‘ম্যাডাম মাফ কইরা দ্যান। দয়া কইরা মাফ কইরা দ্যান ম্যাডাম। আর পারতাছি না..’

দাঁতে দাঁত চেপে রাতুলের মুখের দিকে তাকাল প্রিয়তা। চোখে তখনও পানি জমে আছে। রাতুলের চুলের মুঠি ধরে মাথাটা উঁচু করে ধরল প্রিয়তা। হিসহিসিয়ে বলল, ‘আমার কলিজা কে*টে নিয়ে গেছিস তুই শু***বাচ্চা!’

বলেই আধখাওয়া সিগারেটটা ঢুকিয়ে দিল রাতের নাকের ফুটোয়। চোখ বড় বড় হয়ে গেল রাতুলের। মস্তিষ্কে যেন বিস্ফোরণ ঘটল। ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরিয়ে এলো গলা দিয়ে কিন্তু কিছু বলতে পারল না। কিছুক্ষণ এভাবেই ধরে রাখল প্রিয়তা। সিগারেটটা বের করে আনতেই নাক, কান দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো রাতুলের। তখনও গলা দিয়ে গরগর আওয়াজ করছে ও।

আবার উঠে দাঁড়াল প্রিয়তা। পাগলের মতো পায়চারি করল কিছুক্ষণ। গায়ের জ্যাকেটটা খুলে আছাড় মারল নিচে। খামচে ধরল নিজের চুল। অস্থির হয়ে খুলে দিল চুলের ঝুটিটাও। লাল হয়ে উঠেছে হলদে ফর্সা মুখটা। অপূর্ব সুন্দর চোখটা দিয়ে যেন রক্ত উঠে আসবে। পাগলের মতো আবার রাতুলের সামনে গিয়ে বসল প্রিয়তা। দ্রুত হাতে কালো ব্যাগটা থেকে বের করল একটা ছু*রি। এবার ধীরেসুস্থে, প্ল্যান করে নয়। অপরিকল্পিতভাবে এলোপাথাড়ি ছু*রি চালাল রাতুলের গায়ে। যার বেশিরভাগই পড়ল পেটে। মুখ দিয়ে রক্ত উঠে এলো রাতুলের। ওর আর্তনাদ ধ্বনিতে যেন আক্ষরিক অর্থেই কেঁপে উঠল গোডাউনের বেসমেন্ট। চোখ সরিয়ে নিল জয়। তনুজার গা গুলিয়ে বমি পেয়ে গেল। প্রতিটা আঘাতে ভেতরের তীব্র ক্ষোভ মেটাচ্ছে যেন প্রিয়তা। আঘাতে আঘাতে র*ক্ত ছিটকে আসছে ওর মুখে, গলায়, শরীরে। পাল্লা দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে চোখ বেয়ে।

অবশেষে ক্লান্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল প্রিয়তা। হাঁপাচ্ছে ও। চোখের জলে ভিজে একাকার হয়ে গেছে গাল, গলা। সেইসঙ্গে রাতুলের র*ক্তের বড় বড় ছেটা লেগে আছে মুখ, গলা, শরীরছুড়ে। ভয়ংকর দেখতে লাগছে ওকে। তনুজা দেখল, ভয়ংকর এই অবস্থাতেও রূপ বিন্দুমাত্র কমেনি এর। সুন্দরী পিশাচিনী যেন একারণেই বলে ও প্রিয়তাকে।

ঘড়ঘড় আওয়াজ করতে করতে তখনও ছটফট করছে রাতুল। প্রাণ অবশিষ্ট আছে এখনো। লম্বা শ্বাস নিতে নিতে হাতের ছু*রিটা পজিশন করে ধরল প্রিয়তা। ছুড়ে ঠিক রাতুলের মগজ ভেদ করবে ও। লক্ষ্য স্থির করল। যখনই ছু*রিটা ছুড়তে যাবে। বেসমেন্ট কাঁপিয়ে আওয়াজ করে উঠল একটা পি*স্ত*ল। চমকে উঠল প্রিয়তা। কেঁপে উঠল জয় আর তনুজাও। গুলিটা সোজা রাতুলের কপালের মাঝখানে লেগেছে।

রাতুলের দিকে চেয়ে থেকে কেন যেন নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো প্রিয়তার। এই লক্ষ্য, লক্ষ্যেভেদ খুব ভালোভাবেই চেনে ও। শিরশিরে এক অনুভূতি ছেয়ে গেল সারা শরীরে। বুকের মধ্যে কেমন অদ্ভুত যন্ত্রণা করে উঠল ওর। আস্তে আস্তে চোখ তুলে তাকাল জয় আর তনুজার দিকে। ওরা হতবাক চোখে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার ঠিক পেছনে। আরও জোরে শ্বাস নিল প্রিয়তা। দাঁড়িয়ে গেছে শরীরের সবকটা লোম। সমস্ত ইচ্ছাশক্তিকে একত্রিত করে ধীরে ধীরে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল পেছনে। চোখ গেল সোজা বেসমেন্টের সিঁড়ির ঠিক মাথায়। সেখানে হাতে এম.টি.নাইন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক সুঠামদেহী, লম্বা, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের যুবক। পরনে কালো গেঞ্জি, জিন্স; ওপরে কালো লেদার জ্যাকেট। তীক্ষ্ণ, জ্বলজ্বলে চোখজোড়া ওর ওপর দৃঢ়, স্থির। ঐ দৃষ্টিই যেন অন্তরাত্মাসহ পড়ে ফেলছে ওর।
ফুসফুস অবধি বাতাস পৌঁছতে সংঘর্ষ করতে হলো প্রিয়তাকে। র*ক্তা*ক্ত হাত থেকে ফসকে পড়ে গেল র*ক্তমাখা ছু*রিটা। অস্ফুট স্বরে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘ন-নাহ্।’

#চলবে…

[ রি-চেইক হয়নি। এতো রাত করে দিলাম বলে দুঃখিত। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here