অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল
১০৩.
রুদ্র প্রিয়তাকে খু*ন করেছে। ধারণাটা নিস্তব্ধ ইন্টারোগেশন রুমটাতে যেন বজ্রপাত ঘটাল। ধাক্কাটা সামলাতে তুহিনের মতো মানুষেরও সময় লাগল। কোনমতে বিস্ময় কাটিয়ে তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্রর ঠোঁটে তখন মৃদু এক টুকরো হাসি ঝুলে আছে। তবে সে হাসি যে আনন্দ কিংবা কৌতুকের নয়, তা স্পষ্ট বোঝা যায়। চোয়াল শক্ত করে ফেলল তুহিন। বলল, ‘তুমি আমাদের বিভ্রান্ত করতে চাইছো রুদ্র?’
‘ আপনি বিভ্রান্ত হচ্ছেন?’ পাল্টা প্রশ্ন করল রুদ্র।
‘ প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন?’
‘ এই ইন্টারোগেশনে আমি আপনাকে কোন মিথ্যে কথা বলিনি। আর বাকি সময়টাতেও কোন মিথ্যে বলব না। বিনা পয়সার প্রতিশ্রুতি ধরে নিতে পারেন।’
ভ্রু কুঁচকে ফেলল তুহিন। লোকে বলে সস্তার তিন অবস্থা! অথচ রুদ্রর দেওয়ার বিনা পয়সার প্রতিশ্রুতিকে অবিশ্বাস করতে পারছেনা ওর মন। কিন্তু প্রফেশনাল মস্তিষ্ক তাই করল। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝে দোলাদুলি করলেও মুখে বলল, ‘তুমি নিজে খু*ন করেছো প্রিয়তাকে?’
তুহিনের চোখের দিকে তাকাল রুদ্র। খুবই শীতল গলায় বলল, ‘ নিজের হাতে ওর বুকে পরপর তিনটে গু*লি করেছি। তার আগে বিষ দিয়েছি। আরও পরিষ্কার করে শুনতে চান?’
হতভম্ব হয়ে গেল তুহিন। দুচোখে অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। তমালের চোখদুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে মনে হয়। রুদ্রর কথা ও কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। তুহিন কন্ঠে বিস্ময় বজায় রেখেই বলল, ‘তারমানে সত্যিই প্রিয়তা আর নেই?’
‘ নেই। অন্তত পৃথিবীতে কোথাও নেই।’
‘ ওনার কোন ডেডবডি পাওয়া যায়নি। অন্তত পুলিশের কোন রিপোর্টে নেই। কোথায় সেটা?’
‘সেটা জানার কোন প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমার মনে হয়না। ভালো আছে ও এখন। মুক্ত আছে, শান্তিতে আছে।’
এতক্ষণে একটা কথা বুঝেছে তুহিন। যে উত্তরটা দেওয়ার সেটা সরাসরি-ই দিচ্ছে রুদ্র। আর ধাঁধাময় উত্তরগুলো ও চাইলেও সরলভাবে বের করতে পারবেনা। রুদ্র বলবেনা। ব্যর্থ সেই চেষ্টা না করে তুহিন বলল, ‘ তুমি বললে ওখানে রঞ্জু আরও একজন ছিল। সে কে? কী ঘটেছিল তারপর? প্রিয়তা কী আবার ওদের কোন ক্ষতি করেছিল? সেকারণেই কী তুমি..’
রুদ্র ঠোঁটে হাসিটুকু মিলিয়ে গেল। তীক্ষ্ম চোখে কিছুটা কাঠিন্য ফুটে উঠল। মৃদু গলায় বলল, ‘বাবা সবসময় বলতেন, বিষের ধর্মই হচ্ছে বিনাশ। চিরকাল সে তাই করে। বিষ যখন বিনাশ করা থামিয়ে দেয়, তখন আর তার কোন অস্তিত্ব থাকেনা।’
‘ শেষ হয়ে যায়?’
‘ নিঃশেষ হয়ে যায়!’
*
অতীত~
বেলা বেশ অনেকটাই হয়েছে। আকাশ পরিস্কার। পুব দিকে সূর্যটা প্রকাশে জ্বলজ্বল করছে। উদাস চোখে বাইরে তাকিয়ে আছে কুহু। দৃষ্টিতে কোন লক্ষ্য নেই। চোখের জলটুকু শুকিয়ে গেছে অনেক আগেই। খানিক বাদেই পাশে এসে দাঁড়াল নীরব। কয়েক সেকেন্ড কুহুর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস চাপল। বলল, ‘জ্যোতি আপু খাবার নিয়ে আসছে। এবার খেয়ে নাও। রাত থেকে কিছু খাওনি।’
কুহু জবাব দিলোনা। একপাশ থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে মাথা এলিয়ে দিল নীরবের বুকে। নীরব আলতো করে হাত বুলালো কুহুর মাথায়। নিজেও উদাস চোখে তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে। প্রিয়তার হঠাৎ চট্টগ্রাম যাওয়ার ব্যপারটাতে ঘাবড়ে গেছে মেয়েটা। সারারাতে একবারের জন্যেও ঘুমায়নি। ফলে ঘুমোতে পারেনি নীরবও। খানিক বাদেবাদেই কেঁপে কেঁপে কেঁদে উঠেছে কুহু। নীরব জানে, সেই ভয়ংকর রাতটার স্মৃতি কাঁপিয়ে তোলে কুহুকে। সারারাত ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল এই ভেবে, প্রিয়তার সাথেও যদি এমন কিছু ঘটে! নীরব কুহুর মাথায় আলতো করে চুমু খেয়ে বলল, ‘ভয় পেওনা। কিচ্ছু হবেনা ভাবির। রুদ্র ভাইয়ের লোকেরা আছেতো সাথে। রাজু লোকটা সবসময় থাকবে ভাবির সঙ্গে। কিছু হবেনা ওনার।’
কুহু তবুও জবাব দিলোনা। মুষড়ে পড়ছে কেমন। নীরব নরম গলায় বলল, ‘ লক্ষ্মী মেয়ে। এমন করেনা। ঠিক হয়ে যাবে সব। ভাবি চলে আসবে।’
কথাটা বললেও ভেতর থেকে মন খারাপ হয়ে গেল নীরবের। বাইরে থেকে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠলেও আজও পুরোপুরি স্বাভাবিক নয় কুহু। ঘুমের মধ্যে লাফিয়ে ওঠে। কেঁদে ফেলে। ছটফট করে। ঐ একটা রাত আর দুটো জানোয়ার নরক করে দিয়েছে ওর জীবনটা। সাথে নীরবেরও। বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও আজও কুহুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়নি ওর। কারণ কুহুর ভয়। যতবার নীরব কাছাকাছি গেছে, ভয়ে কেমন সিঁটিয়ে গেছে মেয়েটা। ঐ বিভৎস স্মৃতি ভোঁতা করে দিয়েছে ওর সব অনুভূতি। সেটা বুঝে নীরবও আর এগোয়নি। মেয়েটার সময় প্রয়োজন।
‘ আসছি?’
জ্যোতির গলায় আওয়াজে একেঅপরকে ছেড়ে দাঁড়াল ওরা। খাবারের ট্রে নিয়ে ভেতরে এলো জ্যোতি। অফিসের জন্যে একেবারে রেডি হয়েই এসেছে। নীরব কুহুকে নিয়ে রুমে এলো। ওকে বিছানায় বসিয়ে জ্যোতিকে নিয়ে একটু দূরে গিয়ে বলল, ‘ভাবি ফোন ধরেছিল আর?’
জ্যোতি হতাশ শ্বাস ফেলে বলল, ‘ না। উচ্ছ্বাস খোঁজ করছে। জানিনা কী হবে। মেয়েটা এমন কীকরে করল আমি জাস্ট বুঝতে পারছিনা। এতোটা হটকারিতা!’
‘ ভাবির সঙ্গে যে ছেলেটা গেছে, রাজু। সে কই? ফোনটাও কেন ধরছেনা?’
‘ কীকরে জানব? চিন্তায় এমনিতেই মাথা ছিড়ছে আমার। কিছু বুঝতে পারছিনা। রুদ্র ফিরে আসবে যেকোন সময়। এরপর কী ঘটবে আমি জাস্ট জানিনা।’
হতাশ হল নীরব। কী বলবে বুঝলনা। জ্যোতি বলল, ‘আমি অফিস যাচ্ছি বুঝলে? এদিকটা খেয়াল রেখো।’
‘ একা যাবে?’
‘ ভেবেছিলাম লোক নিয়ে যাব। কিন্তু আজাদ ভাই এসেছে নিতে। তাই আর কাউকে লাগবেনা।’
কথাটা বলে কুহুর কাছে এলো জ্যোতি। মেয়েটা কেমন উদাস মুখে বসে আছে। জ্যোতি ওর গালে হাত রেখে বলল, ‘প্রিয়তার সঙ্গে রুদ্রর লোক আছে। কিছু হবেনা ওর। চিন্তা না করে খেয়ে নে। আমি আসছি।’
বলে চুপচাপ বেরিয়ে গেল জ্যোতি। কিন্তু কুহু স্বস্তি পেলোনা। ওর সঙ্গেওতো সেদিন চারজন দেহরক্ষী পাঠিয়েছিলেন রাশেদ। তারা কী ওকে বাঁচাতে পেরেছিল?
*
ভরদুপুরে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় উপস্থিত হয়েছে সাবেক শত্রু তথা বর্তমান বন্ধুদল ডার্ক নাইট এবং ব্লাক হোল। প্রত্যেকের চেহারায় রক্তশূন্যভাব। টেবিলের সঙ্গে সাজানো চেয়ারে কেবল শওকত মীর্জা এবং করিম তাজওয়ারই বসে আছে। বাকি সবাই অস্থির হয়ে পায়চারি করছে ঘরজুড়ে। ঘন্টাকয়েক আগেই বিদ্ধস্ত অবস্থায় ফিরেছে তনুজা। রুদ্রর কাছে প্রিয়তার হাতেনাতে ধরা পরার ব্যপারটা জানিয়েছে। খুলে বলেছে রাতুলের হ*ত্যা এবং তার পরবর্তী ঘটনা। তনুজা ছেড়ে দিলেও জয়কে এখনো ছাড়েনি রুদ্র। সেকথাও জানিয়েছে। পলাশ মীর্জা ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে বলল, ‘এবার কী হবে?’
নিস্তব্ধ ঘরটাতে কেবল নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। উত্তর দিলোনা কেউ। থাকলেতো দেবে। সকলের মনে এখন একটাই প্রশ্ন। এরপর কী হবে? করিম তাজওয়ারের ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে মেজাজও চরমমাত্রায় খারাপ হচ্ছে। মনে মনে রুদ্র-প্রিয়তা দুজনকেই বার কয়েক খু*ন করছে সে। দুটোই গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। দাঁত কিড়মিড় করে করিম বলল, ‘আমি আপনাকে বলেছিলাম শওকত সাহেব। আমের পরিবারের প্রতি আপনার মেয়ের ঐ গদগদ ভাবটাই একদিন সব ভন্ডুল করবে। শেষ মুহূর্তে এসে আজ সেটাই হল। ওর কী দরকার ছিল রাতুলকে খু*ন করতে যাওয়ার? রুদ্রর বাচ্চাটাকেইতো মেরেছে। ঐ বাচ্চার প্রতি ওরতো এতো দরদ থাকার কথা ছিলোনা। ছিলো কী? সেন্টু আর বুলেটের ক্ষেত্রেও সেই একই কাজ করেছে আপনার মেয়ে। গ্রুপের এতোগুলো কাজের ছেলেকে শেষ করে দিল।’
পলাশ ঘমার্ক্ত হাতের তালু একেঅপরের সঙ্গে ঘষে বলল, ‘ওভাবে চিন্তা করার কোন কারণ দেখছিনা আমি। রাশেদ আমেরকে কিন্তু রাণী-ই সরিয়েছে। ইকবালকেও। ঐ তিনটেকে ও খুন করেছে অনুমতি ছাড়া বেশি লাফঝাপ করায জন্যে। তাছাড়াও র*ক্ত ভালোবাসে রাণী। মানুষ খু*ন করার অযুহাত খোঁজে। সেটা ভুলে যাবেন না। ব্যক্তিগত দুর্বলতার কোন বিষয় নেই এখানে।’
করিম প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, ‘ ইকবালকে মেরে খুব বেশি উপকার করেনি ও আমাদের। বরং ক্ষতিই করেছে। আর রাশেদ আমেরকে কেন মেরেছিল; তার আগে কী ঘটেছিল মনে নেই? আর যদি ধরেও নেই যে সেন্টু, বুলেট আর রাতুলের খু*ন ঐ মেয়ের সাইকোপ্যাথের ফল। কিন্তু ঐ ছোকরা উচ্ছ্বাস? ঐটাকে মারতে দিলোনা কেন? আর রুদ্রকে মারার কতগুলো সুযোগ ছিল ওর হাতে। কাজে লাগালো না। কিন্তু এখন? এখন রুদ্র ওর কী অবস্থা করবে কেউ জানেনা। এতক্ষণে হয়তো পুঁতে দিয়েছে মাটির নিচে।’
এতক্ষণ বেজির মতো ফুঁসতে ফুঁসতে পায়চারি করছিল সম্রাট। ধপ করে জ্বলে উঠল এবার। তেড়ে এসে সশব্দে টেবিলে চাপড় বসিয়ে বলল, ‘ওকে আমি আগেই বলেছিলাম চলে এসো। ওখানেতো ওর আর তেমন কাজ ছিলোনা। ছিলো? এরপর বাকিটা আমরাই সামলাতে পারতাম। কিন্তু না, সবকিছু নিজের ইচ্ছেতে করবে।’
শান বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। এবার বিরক্ত হয়ে ভেতরে ঢুকে বলল, ‘ কী করলে কী হতো এসব আজাইরা প্যাঁচালের কোন মানে আছে এখন আর? মেয়েটা এখন রুদ্রর কবজায় আছে। ওকে কীভাবে সেইফলি বের করে নিয়ে আসবো সেটাই আমাদের ফার্স্ট প্রায়োরিটি হওয়া উচিত।’
রাগ কমেনি সম্রাটের। তবুও শানের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে বলল, ‘আই থিংক হি ইজ রাইট। রাণী কোথায় আছে সেটা আগে খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের লোক নিয়ে গ্রুপ ওয়াইজ টিম রেডি করো। সম্ভাব্য সব জায়গায় চিরুনি তল্লাশি চালাতে হবে। খোঁজ পাওয়ার পর একসঙ্গে অ্যাটাক করে_’
‘তার কোন প্রয়োজন নেই।’
শওকত মীর্জায় কথাটায় থেমে গেল সবাই। দামি সিগারেটে টান দিতে দিতে এতক্ষণ সকলের কথাই শুনছিল শওকত। ব্যপারটা নিয়ে নিজ মনেই এতক্ষণ বিশ্লেষণ চালাচ্ছিল। শান অবাক হয়ে বলল, ‘দরকার নেই মানে? রাণীর যদি কোন_’
সিগারেট ধরা হাতটা উঁচু করে শানকেও থামিয়ে দিল শওকত। বলল, ‘রাণীর সঙ্গে কিছু করার হলে এতক্ষণে তা করে ফেলেছে রুদ্র। আর যদি এখনো কিছু না করে থাকে তাহলে এখনই করবেনা। অন্যকিছু ভাবছে ও। সুতরাং, এখন যদি সত্যিই কিছু ভাবতে হয় নেক্সট মাল ডেলিভারী নিয়ে ভাব। এটাই আমাদের প্রথম অফিশিয়াল রিসিভ হবে। ইতিমধ্যে কতগুলো টিমের সঙ্গে চুক্তি করে ফেলেছি। ঠিকমতো মাল রিসিভ না করতে পারলে মাঠে মারা পড়বে সব। আড়াই বছরের পরিশ্রম নষ্ট হয়ে যাবে।’
মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিল করিম তাজওয়ার। যার পরিকল্পনা, পরিশ্রম, কাজ ধরে আড়াই বছর খেলল। জেতা খেলা বলে আজ তাকে নিয়েই মাথা ঘামানোর সময় নেই কারো! বাপ বটে একজন শওকত মীর্জা! ঐ রাণীকে এই দৃশ্যটা দেখানোর জন্যে মনটা আকুপাকু করল করিমের। গুমোর ভাঙতো ঐ মেয়ের।
তার আর কী? করিম আর সম্রাটতো তক্কে তক্কেই আছে। একবার সোলার সিস্টেম পুরোপুরি নিঃশেষ হোক। কৌশলে ডার্ক নাইটকেও চিরতরে সরিয়ে দেবে ওরা। আন্ডারওয়ার্ল্ডের রাজত্ব্য শুধু তাদের হবে। সম্রাট অধৈর্য হয়ে বলল, ‘ কিন্তু রাণী…’
‘ রাণীকে নিয়ে ভেবে এখন লাভ নেই। তনুজার কথায় যা বুঝলাম, জয় এখনো রুদ্রর কবলে। যদি রুদ্র ওকে খুন না করে থাকে তবে একটা আশা আছে। জয় খুবই চালাক এবং এক্টিভ। কোন না কোনভাবে বেরিয়ে আসবে। জয় ফিরুক। রাণীর ব্যপারে তখন আলোচনা হবে।’
সন্তুষ্ট হতে পারল না সম্রাট। কিন্তু কিছু বলার নেই সেটাও বুঝল। শান প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেল একটাই কারণে। জয়! জয় ছেলেটা গোটা ডার্ক নাইটে প্রিয়তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত। শুরু থেকে এখনো অবধি সবসময় প্রিয়তার সঙ্গে ছিল ছেলেটা। চোখেমুখে কঠিন ভাব রাখলেও প্রিয়তাযে মনে মনে জয়কে ভীষণ স্নেহ করে সেটা জানে শান। ভেতরের সুপ্ত স্নেহটা প্রিয়তা বুঝতে দেয়না জয়কে। কোনভাবে এখন জয় বেরিয়ে এলেই হলো।
শওকত বলল, ‘ অবস্থা এখন যা দাঁড়িয়েছ আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে। রুদ্র এখন ক্ষেপা হয়ে আক্রমণ করবে। নতুন কিছু জানার বা হারানোর নেই ওর। সুতরাং দ্রুত করতে হবে সব।’
করিম বলল, ‘ ওর পরিবারের কারো ওপর আক্রমণ করছিনা কেন?’
‘ ক্ষেপা পাগলকে আরও ক্ষেপাতে চাইছো নাকি? ধারণা আছে কী হবে? ঐসব চিন্তা ছাড়ো। এখন সবচেয়ে বেশি ইম্পর্টেন্ট নেক্সট ডেলিভারীটা। সেটাই এখন মাথায় রেখো। সব যখন একসঙ্গে হয়েছোই, কীভাবে মাল রিসিভ করে গোডাউনে আনবো তার একটা প্লান রেডি করো। সময় বেশি নেই।’
কথাটা বলে সিগারেটের ছাই ঝাড়লেন শওকত। লম্বা করে একটা টান দিলেন। এরা কেউ না জানলেও উনি জানেন আন্ডারওয়ার্ল্ডে ওনাদের রাজত্ব বেশিদিন নেই। সেকারণেই নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারটা ভালোভাবে গোছাচ্ছেন। এখন যা করছেন তা কেবল ভবিষ্যতের খুঁটিটা শক্ত করতে। রুদ্রকে চরম আঘাতটা করতে পেরে তৃপ্ত সে। এখন শুধু ওর মৃত্যুর অপেক্ষা। তারজন্যে যদি নিজের মেয়ের মৃত্যুও প্রয়োজন হয়। তো হবে! লক্ষ্যে পূরণে ওটা না হয় একটা আত্মত্যাগ হিসেবে ধরা হবে।
*
বদ্ধ রুমটাতে এখনো ওভাবেই পড়ে আছে প্রিয়তা। সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুর পেরিয়ে এখন রাত। এতক্ষণ মাথায় নানারকমের চিন্তা চললেও এখন কেবল রাগ হচ্ছে। কেবল রাগ! এভাবে বন্দি থেকে অভ্যস্ত নয় ও। একদমই নয়। সেখানে এভাবে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকাটা দমবন্ধকর।
দুপুরে খাবার নিয়ে এসেছিল রঞ্জু। খাবার দেওয়ার আগে দেয়ালের হ্যাঙারের সঙ্গে শক্ত করে একটা দড়ি বাঁধে। ওর ডানহাত খুলে দিয়ে বাঁ হাত বাঁধে ঐ দড়ির সঙ্গে। এমনটাই নাকি আদেশ দিয়ে গেছে রুদ্র। খাওয়ার সময়টুকু শুধু একহাত খোলা ছিল ওর। এরপর পুনরায় পেছনমোড়া করে বেঁধে ফেলা হয় হাতদুটো। এখন পর্যন্ত সেভাবেই আছে। কত সময় পেরিয়েছে, কটা বাজে। ঠিকঠাকভাবে কিচ্ছু জানেনা ও। এভাবে থাকা সম্ভব!
রুদ্র ওর সত্যিটা জানে, অর্থাৎ বেশি সময় নেই ওর হাতে। কিন্তু কাজ এখনো বাকি। তারজন্যে বের হতে হবে এখান থেকে। জয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। কিন্তু জয় কোথায়? নিরাপদে আছেতো? বিশ্বাসঘাতকতাতো জয়ও করেছে রুদ্রর সঙ্গে। রুদ্র জয়ের সঙ্গে কিছু করেনিতো! সেরকম হলে বিপদে পড়ে যাবে ও। এইমুহূর্তে জয়কে ভীষণ দরকার প্রিয়তার। সাহায্য লাগবে জয়ের। একমাত্র জয়ই আছে যাকে ও চোখ বন্ধ করে ভরসা করে এসেছে। এবং ভবিষ্যতেও করতে পারবে। যেভাবেই হোক নিজের কাজ শেষ করতে হবে ওকে। যেকোন মূল্যে!
দরজা খুলে রুমটাতে পুনরায় প্রবেশ করল রঞ্জু। হাতে খাবারের প্লেট। রাতের খাবার! প্রিয়তা সেদিকে তাকানোর আগ্রহ পেলোনা। মাঝে কয়েকবার রঞ্জুর পেট থেকে কথা আদায়ের চেষ্টা করেছিল ও। কিন্তু ঘাড়বাঁকা ছেলেটা খুব ভেবেচিন্তে মুখ খুলছে। বোঝা গেল খুব ভালোভাবেই নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে রুদ্র!
একইভাবে হাত খুলে বাঁ হাতটা আবার হ্যাঙারের সঙ্গে বেঁধে দিল রঞ্জু। প্রিয়তা কিছু বলল না। কেবল দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। খাওয়ার মাঝে প্রিয়তা বলল, ‘ রুদ্র আসেনি আর?’
রঞ্জু মোবাইলে কিছু করছিল। প্রিয়তার দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘না, আসে নাই।’
‘ কটা বাজে এখন?’
‘ সাড়ে দশটা।’
‘ আসবে না আজ আর?’
‘ জানিনা।’
আর কোন কথা হলোনা। খাওয়া শেষে রঞ্জু আবার যখন প্রিয়তার হাত বাঁধতে গেল; প্রিয়তা বলে উঠল, ‘ওয়াশরুমে যাব আমি।’
হকচকিয়ে গেল রঞ্জু। খাওয়ার সময় কী করণীয় সে নির্দেশ দিয়ে গেছে রুদ্র। কিন্তু এমন অবস্থায় কী করতে হবে সে বিষয়ে কিছু বলে যায়নি। রঞ্জুর ভাবনার মাঝেই প্রিয়তা বলে উঠল, ‘ কী হলো? ওয়াশরুম যাব। আর্জেন্ট!’
রঞ্জু বিপাকে পড়ল। যাওয়া যাবেনা সেকথা বলা যায়না। দীর্ঘক্ষণ বেঁধে রাখা হয়েছে প্রিয়তাকে। সুতরাং যাওয়ার প্রয়োজন এখন হওয়ারই কথা। খানিকটা চিন্তা করল রঞ্জু। অ*স্ত্র নেই প্রিয়তার হাতে। বাইরে দ্বিতীয়জন আছে। বের হওয়ার সময় অবশ্যই বাঁধার সম্মুখীন হতে হবে ওকে। তাছাড়া একা নিরস্ত্র অবস্থায় কী-ই বা করবে? কথাগুলো চিন্তা করে প্রিয়তার বাঁধন খুলতে শুরু করল রঞ্জু। প্রথমে হাত খুলল। অতঃপর পা। পায়ের বাঁধন খোলার সঙ্গে সঙ্গেই যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল প্রিয়তার শরীরে। পা উঠিয়ে সজোরে লাথি মারল রঞ্জুর বুকে। ছিটকে অনেকটা দূরে গিয়ে পড়ল রঞ্জু। আকস্মিক এই আক্রমণ কোনভাবেই আশা করেনি রঞ্জু। শরীর এমনিই সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। কী ঘটেছে বুঝে ওঠার আগেই উঠার আগেই উঠে দাঁড়াল প্রিয়তা। একছুটে বেরিয়ে গেল ঘরটা দেখে। রঞ্জু কোনমতে উঠে এসে আটকাতে চাইল। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে প্রিয়তা।
এখানের করিডরটা প্রথম দেখল প্রিয়তা। অপরিচিত। গোটা করিডরের মাঝে মাত্র একটা কম পাওয়ারের হলদে বাল্ব জ্বলছে। ব্যস্ত চোখে দুপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল বের হওয়ার রাস্তা কোনদিকে। ডুপ্লেক্স হলেও বাড়িটা খুব বেশি বড় নয়। রঞ্জুর দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে বের হওয়ার তাগিদ অনুভব করল প্রিয়তা। দ্বিতীয়জন যেকোন মুহূর্তে চলে আসবে। প্রিয়তা ডানদিকে তাকাল। ওদিকেই সিঁড়ির অস্তিত্ব চোখে পড়েছে ওর। সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়াতেই পা থেমে গেল প্রিয়তার। দ্বিতীয়জন আশেপাশে আছে কি-না দেখার চেষ্টা করল। নিচেও আবছা হলদে বাল্বের আলো। দেয়ালগুলো সব একইরকম। কোথা থেকে ভেসে আসছে জেনারেটরের মৃদু গুঞ্জন। ডিজেলের হালকা গন্ধও নাকে এসে লাগছে। দেয়ালগুলো সব একইরকম। অযত্নে পড়ে থাকার মতো! যতখানি দেখা যাচ্ছে কারো উপস্থিতি নেই। নেই লক্ষ্য করে যখনই ছুটতে উদ্ধত হবে, পেছন থেকে আওয়াজ এলো, ‘ম্যাডাম?’
চমকে উঠল প্রিয়তা। পা থমকে গেল। পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে ঝট করে পেছন ফিরে তাকাল ও। ঝাকরা চুলের শ্যামবর্ণের ছেলেটাকে চিনতে সময় লাগলনা। বিস্ময়ে কপাল কুঁচকে ফেলল প্রিয়তা। জয়! জয় এখানে কীকরে এলো? রঞ্জুর দরজা ধাক্কানোর মৃদু আওয়াজ তখনও শোনা যাচ্ছে। প্রিয়তা হতবাক গলায় বলল, ‘তুমি এখানে কীকরে পৌঁছলে?’
‘ আপনাকে নিতে এসেছি আমি।’ নির্বিকার, যান্ত্রিক কন্ঠে বলল জয়।
‘ এখানে পৌঁছলে কীকরে? রুদ্র কোথায় ছেড়েছে তোমাদের? তনুজা কোথায়?’
‘ বলব ম্যাডাম। কিন্তু এখন বোধ হয় উপযুক্ত সময় নয়।’
প্রিয়তা বিভ্রান্ত চোখে চারপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কেউ দেখে ফেলেনিতো তোমাকে?’
‘ না।’
‘ গান আছে তো?’
হোলস্টারে একবার হাত বুলিয়ে মাথা নাড়ল জয়। আর অপেক্ষা করল না প্রিয়তা। দ্রুত নামতে শুরু করল। পেছনে সমানতালে নামছে জয়। হোলস্টার থেকে বের করে নিয়েছে পিস্তল। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই এক্সিট ওয়ে চোখে পড়ল প্রিয়তার। বাঁ দিকে একটাই করিডর চোখে পড়ছে। বাকি তিনপাশে দেয়াল। সেদিকেই এগুলো প্রিয়তা। পেছনে জয়!
করিডরে পা ফেলে বের হওয়ার দরজাটা চোখে পড়লেও থামতে হল প্রিয়তাকে। কারণ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র আমের। তালা লাগাচ্ছে। তালা লাগিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে পেছনে ফিরে তাকাল রুদ্র। প্রিয়তা এবং জয়কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও অবাক হওয়ার কোন লক্ষণ নেই ওর চোখেমুখে।
কিন্তু অবাক হয়েছে প্রিয়তা। রুদ্র হঠাৎ এভাবে চলে আসবে আশা করেনি ও। দেরী হয়ে গেছে। প্লানটা আরও আগে করা উচিত ছিল। রুদ্র চাবির গোছাটা পকেটে রাখতে রাখতে বলল, ‘ গেরিলা আক্রমণ ততক্ষণ সফল হয়, যতক্ষণ শত্রু তোমার সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকে। কিন্তু একবার সম্মুখসমর ঘটে যাওয়ার পর সে চেষ্টাটা বোকামি। তাইনা?’
খানিকটা ভরকে গেলেও নিয়ন্ত্রণ হারায়নি প্রিয়তা। শক্ত কন্ঠে বলল, ‘ বন্দি আমি থাকতে পারব না রুদ্র। কোনভাবেই না।’
কৌতুক খেলে গেল রুদ্রর চোখে, ‘ কী করবে?’
রুদ্রর দিকে আক্রোশ নিয়ে তাকিয়ে থাকল প্রিয়তা। মস্তিষ্কে অন্যকিছু চলছে ওর। সেই ছোটবেলা। সেই মুখটা। সেই ঘৃণ্য স্মৃতি। গা গুলিয়ে বমি পেল যেন। সেই সঙ্গে রক্ত চড়ে গেল মাথায়। ভুলে গেল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা ওর স্বামী।
পেছনে না তাকিয়েই হাত বাড়াল প্রিয়তা। জয়কে উদ্দেশ্য করে পি-স্ত-লটা চাইল। কিন্তু প্রিয়তার হাতে কিছু এলোনা। ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে পেছনে তাকাল প্রিয়তা। কিন্তু তাকানোর পরপরই থমকে গেল ওর দৃষ্টি। ক্ষিপ্ত চোখজোড়ায় মুহূর্তেই এসে ভর করল বিস্ময়। জয় ওর দিকে বন্দুক তাক করে আছে!
জয় যান্ত্রিক কন্ঠে নির্বিকারভাবে বলল, ‘ স্যারের সঙ্গে ভেতরে ফিরে যান ম্যাডাম।’
প্রিয়তার দুচোখ ভর্তি অবিশ্বাস। চোখে যা দেখছে সেটা কিছুতেই মানতে চাইছেনা। জয় ওর দিকে ব*ন্দু*ক তাক করে আছে! এমন দৃশ্য ভ্রম কিংবা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কী? কিন্তু ভ্রম কাটাতে গিয়ে প্রিয়তা বুঝল এটাই বাস্তব। ফ্যাঁসফ্যাঁসে আওয়াজে প্রিয়তা বলল, ‘কী করছো তুমি?’
‘ ভেতরে চলুন।’
জয়ের দিকে তেড়ে যাচ্ছিল প্রিয়তা। সঙ্গে সঙ্গে সেফটি ক্যাচ অফ করে ফেলল জয়। যেটা স্পষ্ট হুমকি দিচ্ছে; গু*লি করতে সে দ্বিধা করবেনা। থমকে দাঁড়াল প্রিয়তা। দুচোখে আরও একবার অবিশ্বাস খেলে গেল ওর। অথচ জয়ের মুখটা খুবই ভাবলেশহীন। পুরো গল্প না জানলেও প্রিয়তা এইটুকু বুঝল, শুধু চাল নয়। পুরো খেলাটাই ঘুরিয়ে দিয়েছে রুদ্র।
হঠাৎ অসম্ভব এক কাজ করে বসল প্রিয়তা। পা উঁচু করে সজোরে একটা লাথি বসালো জয়ের হাতে। জয়ের হাত থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল পি*স্তলটা। প্রিয়তার পরের লাথিটা পড়ল জয়ের পেটে। ফ্লোরে বসে পড়ল জয়। রুদ্র প্রস্তুত ছিল প্রিয়তার এমন আচরণের জন্যে। পরে আঘাত করার আগেই নিজের এম.টি.নাইন ঠিক প্রিয়তার দিকে তাক করে বলল, ‘থামো!’
থেমে গেল প্রিয়তা। রক্তিম চোখে রুদ্রর দিকে চাইল। তাকিয়ে পেছাতে পেছাতে বলল, ‘ যেতে দিন আমায়! নইলে…’
বলতে বলতেই জয়ের পিস্তলটা আত্মসাত করতে যাচ্ছিল প্রিয়তা। কিন্তু ঝড়ের গতিতে এসে হ্যাঁচকা টানে ওকে নিজের দিকে টেনে নিল রুদ্র। শক্ত করে নিজের সঙ্গে চেপে ধরল। প্রিয়তা চিৎকার করে বলল, ‘লেট মি গো!’
রুদ্র দাঁতে দাঁত পিষে বলল, ‘ বাড়াবাড়ি করোনা। এতক্ষণ খু*ন করিনি, তারমানে এখনো করবোনা সেটা ভাবার কারণ নেই।’
ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে জয়। শার্ট ঝেড়ে সামলে নিয়েছে নিজেকে। রুদ্র জানে ওর বাহুবন্ধনে যে আছে সে ঠিক কী। এক মুহূর্তের জন্যে ছাড়া পেলে যে কাউকে খু*ন করে ফেলতে পারবে এই মেয়ে। জয়ের বিশ্বাসঘাতকতা আরও বেশি বিগড়ে দিয়েছে ওর মাথা। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বিষয়টা মানতে পারেনি ও। খু*ন চেপে গেছে মাথায়। এই মেয়েটার সঙ্গে দুটো বছর সংসার করেছে ও। বুকে নিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। পরম যত্নে আগলে রেখেছে। ওর কোমলতায় বারবার মুগ্ধ হয়েছে! চিন্তা করেও ভেতরটা কেমন করে উঠল রুদ্রর। কিন্তু দুর্বল হলোনা।
নিজের সঙ্গে চেপে ধরেই টেনে-হিঁচড়ে প্রিয়তাকে নিয়ে সেই ঘরটাতে ফিরে এলো রুদ্র। দরজা খুলে দেখল অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্রর সঙ্গে প্রিয়তাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও। চুপচাপ সরে দাঁড়াল।
প্রিয়তা তখনও ধস্তাধস্তি করে চলেছে রুদ্রর সঙ্গে। কিন্তু গায়ের জোরে পেরে উঠছে না। আর সেটা না পেরে সমানে চিৎকার করছে। রাগে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এসেছে ওর। রুদ্র ইশারা করতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রঞ্জু, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা জয়ও দরজাটা ফিরিয়ে দিয়ে ফিরে গেল। হঠাৎই ধস্তাধস্তি থামিয়ে দিল প্রিয়তা। ভেজা চোখে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মেরে ফেলুন আমাকে।’
রুদ্র জবাব দিলোনা। কেবল তাকিয়ে রইল ওর দিকে। প্রিয়তা আরও জোরে চেঁচিয়ে বলল, ‘ ঠকিয়েছি আপনাকে, আপনার পরিবারটাকে শেষ করেছি, সোলার সিস্টেম শেষ করেছি। সবটাই যখন জানেন তখন এতক্ষণ বাঁচিয়ে রেখেছেন কেন আমাকে? জাস্ট কিল মি!’
শক্ত করে প্রিয়তার বাহুদয় খামচে ধরল রুদ্র। সাধারণ কেউ হলে যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠার কথা। কিন্তু প্রিয়তা নড়ল অবধি না। সেভাবেই তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। রুদ্র শক্ত গলায় বলল, ‘আমার গোটা জীবনটা পাপে পরিপূর্ণ। তবে এই সমস্ত পাপের মধ্য সবচেয়ে বড় পাপ ছিল তোমাকে ভালোবাসা। এই পাপের কাছে বাকিসব পাপই তুচ্ছ। পাপটাই যখন এতোবড়, তার শাস্তি একপলকে শেষ করি কীকরে বল? তোমাকে জীবিত রেখে আমি নিজেকে শাস্তি দিচ্ছি।’
কথাটা বলে একটু থামল রুদ্র। হাতের চাপ আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘ জানে না মারলেও হাতে মারতে কিন্তু এখন বিন্দুমাত্র অসুবিধা হবেনা আমার এখন আর। বাধ্য করোনা আমাকে।’
প্রিয়তা ঘোলাটে চোখে তাকালো রুদ্রর দিকে। রুদ্রর কাছ থেকে এধরণের বাক্য শুনে ও অভ্যস্ত না। এই লোকটা ওকে ভালোবাসতো। চমৎকার কোন ফুলের মতো যত্ন করতো। ওর চোখে একফোঁটা অশ্রু দেখলে অস্থির হয়ে যেতো। শরীরটা কেমন ছেড়ে দেয় ওর। শারীরিক, মানসিক উভয়ভাবেই যেন খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অতীত, বর্তমান সব গুলিয়ে গেল যেন। ঝাপসা হয়ে ওঠল সব চোখের সামনে।
–
ভেন্টিলেটর দিয়ে সূর্যের আলোটুকু চোখে পড়তেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল প্রিয়তা। ধীরেসুস্থে চোখ খুলল। নড়তে গিয়ে বাঁধা পেল হঠাৎ। টের পেল হাত-পা আবার সেই আগের মতোই বাঁধা। আস্তেধীরে রাতের কথা মনে পড়ল সব। রাতে একবার ওয়াশরুমে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিল রুদ্র ওকে। এরপর বেঁধে ফেলে আগের মতোই। তারপর সেভাবে কিছু মনে নেই প্রিয়তার। অতিরিক্ত দুর্বলতায় কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানেনা।
কোনমতে উঠে বসল ও। বসতে গিয়ে খেয়াল করল বাহুদয়, চোয়াল সব ব্যথায় টনটন করছে। চোয়ালটা বোধ হয় হালকা ফুলেও গেছে। রেগে গেলে রুদ্র জানোয়ার হয়ে যায়। সেকথা প্রিয়তা রুদ্রর জীবনে আসার আগে থেকেই জানে। কিন্তু সেই জানোয়ারকে প্রত্যক্ষ দর্শন যেন এই একদিনেই করল। কিছুটা হলেও। তেষ্টা পেয়েছে কিন্তু রুমে কাউকে দেখতে পেলোনা ও।
রঞ্জু এলো তার ঠিক আধঘন্টা পরে। রঞ্জুকে দেখেও না দেখার ভান করল প্রিয়তা। একদম শান্ত হয়ে বসে রইল। কোন প্রশ্ন করল না এবার আর। বিষয়টাতে একটু অবাক হলেও বাঁধন খুলে দিতে শুরু করল রঞ্জু। খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘ কাইলকা রাইতে যা করছেন, সেইটা এখন আর করার চ্যাশ্টা কইরেন না ভাবি। দরজার দিকে তাকান।’
প্রিয়তা ক্লান্ত চোখে তাকাল দরজার দিকে। সোজা ওর দিকে ব*ন্দুক তাক করে জয় দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে ফেলল জয়। তপ্ত শ্বাস ফেলল প্রিয়তা। বুঝল, রুদ্রই এবার শিখিয়ে দিয়ে গেছে ওদের। এমন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে।
বন্ধনমুক্ত হতেই উঠে ওয়াশরুমে গেল প্রিয়তা। ফ্রেশ হয়ে একেবারে শাওয়ার নিয়ে বের হল। বের হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই আবার ওর দিকে ব*ন্দু*ক তাক করেছে জয়। দেখে এই অবস্থাতেও হাসি পেল প্রিয়তার। জয়ের প্রতারণায় নয়। একটা মেয়েকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে শক্ত-সামর্থ দুজন পুরুষকে সশস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে, সেটা ভেবে।
কোনরকম তর্ক, কথাবার্তা কিংবা প্রশ্ন না করে চুপচাপ আবার বসে পড়ল ও তোষকের ওপর। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল রঞ্জু। প্রিয়তা সম্পর্কে পরবর্তীকালে যা জেনেছে তাতে এতক্ষণে জয়ের ওপর ঝাপিয়ে পড়ার কথা তার। জবাব চাওয়ার কথা। রঞ্জুকে হাজারটা প্রশ্ন করার কথা। কিন্তু সেসব কিছুই করছেনা মেয়েটা!
রঞ্জুকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রিয়তা প্রশ্ন করল, ‘বাঁধবে না?’
চমকে উঠল রঞ্জু। চোখেমুখে একটা অস্বস্তি ফুটে উঠল ওর। সামনে বসে থাকা মেয়েটাকে ও সম্মান করতো। শ্রদ্ধা করতো। এই ভয়ংকর সত্যিটা জানার পরেও সেই সম্মান, শ্রদ্ধা কমাতে পারছেনা। পাশ থেকে খাবারের থালাটা এগিয়ে এনে বলল, ‘আগে খেয়ে নিন।’
প্রিয়তা বলল, ‘বেঁধে নাও আগে।’ কথাটা বলে তীক্ষ্ম চোখে জয়ের দিকে তাকাল প্রিয়তা, ‘অতক্ষণ বন্দুক ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হবে ওর।’
এবার অস্বস্তি এসে ভর করল জয়ের মধ্যেও। ব*ন্দু*কটা নামিয়ে রাখবে কি-না সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। তখনই মেসেজ এলো রঞ্জুর ফোনে। মেসেজটা দেখে সময় নষ্ট করল না রঞ্জু। শালীনতা বজায় রেখেই আবার বাঁধল ওকে। পা দুটো একত্রে আর বাঁ হাতটা ওপরে হ্যাঙারের সাথে। উঠে দাঁড়িয়ে জয়কে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ আমার যাইতে হইব। দুপুরের আগেই আইয়া পরুম। তুমি থাকো।’
মাথা নাড়ল জয়। রঞ্জুও বেরিয়ে গেল। কোনরকম প্রতিবাদ না করে একহাতে গিলতে শুরু করল প্রিয়তা। জয় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল দরজায়। প্রিয়তার নীরবতায় রঞ্জু অবাক হলেও জয় খুব একটা অবাক হয়নি। খুব ভালোভাবেই চেনে ও রাণী মীর্জাকে। মনে মনে নিশ্চয়ই ভয়ংকর রাগ পুষে রেখেছে। সুযোগ পেলে ওর গলাটা কে*টে ফেলতে বিন্দুমাত্র সময় নেবেনা। ঠান্ডা মাথায়, বাচ্চাদের মতো খেলার ভঙ্গিতে খু*ন করতে পারে রাণী। শুধুমাত্র তিনটে খু*নই প্রিয়তাকে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে করতে দেখেছে জয়। সেন্টু, বুলেট আর রাতুল।
খাওয়াদাওয়া শেষে সব গুছিয়ে প্রিয়তার হাত বাঁধতে শুরু করে জয়। চোখেমুখে অস্বস্তি ভাবটা এখনো লেপটে রয়েছে। কেমন এক জড়তা। প্রিয়তা হঠাৎ বলে উঠল, ‘কত টাকা দিয়েছে রুদ্র?’
থমকে গেল জয়। চোখ তুলে তাকাল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা কথা বলে উঠবে হয়তো ভাবতে পারেনি। তবে জড়তা আয অস্বস্তিটা কেটে গেল নিমেষেই। মুচকি হেসে শেষ গিট দিতে দিতে বলল, ‘ আমাকে না হয় চেনেননি। কিন্তু স্যারকেও যে এতোটা ভুল চিনেছেন, জানতাম না।’
কথাটার তাৎপর্য ধরতে সময় লাগল না প্রিয়তার। ও শুধু জয়ের দিক দিয়ে ভাবছিল। রুদ্র আর যাই হোক টাকা দিয়ে লোক কেনেনা। জয়ের দিকে শীতল চোখে তাকাল প্রিয়তা। কন্ঠেও সমপরিমাণ শীতলতা বজায় রেখে বলল, ‘তাহলে কেন?’
ঠোঁটের হাসিটা প্রসারিত হল জয়ের অথচ চোখে রাজ্যের বিসাদ। উত্তর না পেয়ে প্রিয়তা বলল, ‘তারমানে তুমিই বলেছো সবটা রুদ্রকে?’
মাথা নাড়ল জয়, ‘ না ম্যাডাম। স্যারকে যখন আমি সব বলেছি, তখন উনি ইতিমধ্যেই অর্ধেক সত্যি উনি জানতেন।’
সব কেমন গুলিয়ে গেল প্রিয়তার। জয়কে দেখে ও ভেবেছিল রুদ্রকে সব সত্যি বলেছে জয়। কিন্তু তারআগেই যদি রুদ্র কিছু জেনে থাকে, সেটা কীকরে জানলো? কবে? কার কাছ থেকে? চোখে বিভ্রান্তি নিয়ে জয়ের দিকে তাকাল প্রিয়তা। বলল, ‘ অন্ধবিশ্বাস কাউকে করিনা আমি। তবে বিশ্বাস করতাম তোমাকে। তার দাম এভাবে দিলে?’
এবার প্রিয়তার চোখে চোখ রাখল জয়। এতোদিনে এই প্রথমবার। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল, ‘ আপনাকে এই অবস্থায় দেখার সাধ আমি দেড় বছর যাবত পুষছি ম্যাডাম।’
অনেকক্ষণ পর চোখে আবার বিস্ময় প্রকাশ পেলো প্রিয়তার। কথা বলতে পারল না কিছুক্ষণ। যখন বলতে পারল তখন, অস্ফুট স্বরে বলল, ‘ কেন?’
জয়ের বিশাদমাখা হাসিটা যেন বৃদ্ধি পেল। প্রিয়তার থেকে তিনহাত দূরে বসল আয়েশ করে। প্রিয়তার চোখের প্রশ্ন, অসহায়ত্ব যেন অদ্ভুত তৃপ্তি দিচ্ছে ওকে। কন্ঠে সেই তৃপ্ততা বজায় রেখেই বলল, ‘ সেটা জানার সঠিক সময় এখনো আসেনি ম্যাডাম। তবে বসেই যখন আছি তখন আপনার আরেকটা কৌতূহল মেটাই। স্যার কীকরে সবটা জানলো, সেটাই জানতে চানতো?’
ভ্রুকুটি করল প্রিয়তা। জয়ের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করল। জয় কৌতুকপূর্ণভাবে বলল, ‘ চলুন সেদিন থেকেই শুরু করি, যেদিন আড়াই বছরে প্রথম ভুলটা করেছিলেন আপনি। আর আপনার কফিনে পড়েছিল প্রথম পেরেক!’
#চলবে…
[ রি-চেইক করিনি। ]