অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল
১০৫.
শুধু প্রিয়তার মুখেই নয়, রুদ্রর ছাইরঙা শার্টেও ছিটকে লেগেছে ছেলেটার র*ক্ত। প্রিয়তা ফ্লোরে তাকিয়ে দেখল ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে গেছে সম্রাটের পাঠানো সেই চ্যালা। প্রিয়তা পুনরায় চোখে অবিশ্বাস নিয়ে তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্রর নৃশংসতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকলেও অভিজ্ঞতা নেই ওর। ওর সামনে শু*ট করে মানুষ মেরেছে; কিন্তু এভাবে গলা কে*টে_! গা গুলিয়ে উঠল প্রিয়তার, থরথর করে কেঁপে উঠল। এরচেয়েও জঘন্যভাবে, নৃশংসভাবে মানুষ খু*ন করেছে ও । কিন্তু এই সামান্যতম নৃশংসতাটুকু নিজেই সহ্য করতে পারল না। অভ্যস্ততার বাইরে গেলে আমরা অস্থির হই, ভয় পাই, দমবন্ধ লাগে। প্রিয়তার ক্ষেত্রেও তাই হলো। মনে হল এক্ষুনি বমি করে দেবে। কারণ রুদ্রকে এভাবে দেখে সে অভ্যস্ত নয়।
লাশটার গায়ে সজোরে এক লাথি বসাল রুদ্র। অতঃপর বাঘা দৃষ্টিতে তাকাল প্রিয়তার দিকে। অজান্তেই দু-কদম পিছিয়ে গেল প্রিয়তা। রুদ্র বিদ্যুৎবেগে কয়েক পা এগিয়ে ঘাড়ের ওপর দিয়ে প্রিয়তার চুলের মুঠি টেনে ধরল; খুব শক্ত করে। প্রিয়তার দৃষ্টিতে তখনও অবিশ্বাস। প্রিয়তার হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেই জয়-রঞ্জুকে উদ্দেশ্য করে রুদ্র বলল, ‘ওপরে যদি আজ কেয়ামতও হয়ে যায়। তবুও কেউ ওপরে আসবে না। আসলে তার খু*লি উড়িয়ে দেব আমি।’
নিশ্চুপ ঘরটাতে যেন ধ্বংসবাণীর মতো বেজে উঠল রুদ্র আক্রোশভরা কন্ঠস্বর। জয় আর রঞ্জু কথা বলাতো দূর, নড়ার সাহসটুকুও পেলোনা। ঐভাবে প্রিয়তার ঘাড়ের ওপরের চুলগুলো ধরেই টেনে হিঁচড়ে প্রিয়তাকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল ও। কোনকিছুর তোয়াক্কা না করে ক্ষীপ্রপায়ে ওকে ফিরিয়ে আনলো দোতলার সেই বদ্ধ ঘরে। ভেতরে প্রিয়তাকে ছুড়ে দিয়ে সশব্দে বন্ধ করল কাঠের দরজাটা। দরজাটা ধরে রেখেই জোরে জোরে দুটো শ্বাস ফেলল। প্রিয়তা ঘুরে তাকাল রুদ্রর দিকে। চোখের বিভ্রান্তি কাটার নামই নিচ্ছেনা আজ। রুদ্রও ঘুরে তাকাল। চোখে শীতল দৃষ্টি। হাতে তখনও সেই র*ক্তমাখা ছু*রিটা। ধীর, কিন্তু অন্তর্নিহিত এক হিংস্র পদক্ষেপে প্রিয়তার দিকে এগিয়ে এলো রুদ্র। প্রিয়তা অনেকটা হুরমুরিয়ে দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে দাঁড়াল। শরীর ভারি হয়ে আছে ওর। কাঁপুনি কমছেনা, বেরেই চলেছে ক্রমাগত।
দ্বিতীয়বার প্রিয়তার ঘাড়ের পেছনে নিজের র*ক্তমাখা হাতটা রাখল রুদ্র। তবে এবার চুলের মুঠি না; ঘাড়টাই চেপে ধরল মাঝারি জোরে। শীতল গলায় বলল, ‘পুরোনো প্রেমিকের প্রতি এতো বেশি টান? দুটো দিনের বিরহ সহ্য হচ্ছেনা?’
প্রিয়তার ভ্রুজোরা বেঁকে এলো, ক্রমশ অশ্রু এসে জমা হচ্ছে দুচোখে। কোনমতে উচ্চারণ করতে চাইল, ‘রুদ্_’
প্রিয়তার গলায় ছু*রিটা শক্ত করে চেপে ধরল রুদ্র। ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলল, ‘ চুপ! একটা আওয়াজ করলে গলা কে*টে ফেলব। নিচে দেখেছো নিশ্চয়ই? একটা টানই যথেষ্ট।’
প্রিয়তার দীঘল চোখে আচমকা ভীতি ফুটে উঠল। অজান্তেই! রুদ্র বলল, ‘ সেদিন বলেছিলাম গায়ের জোরে আমার কাছে তুমি বাচ্চা। তাই বুদ্ধির জোর খাটাতে গিয়েছিলে? আগে পেরেছিলে, তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। দুটো বছর আমার অন্ধ ভালোবাসা আর বিশ্বাসকে হাতিয়ার করে সেটা তুমি করতে পেরেছিলে। কিন্তু এখন; এখন না ভালোবাসা আছে, না বিশ্বাস। এখনো সেটা পারবে ভাবলে কীকরে রাণী?’
কথাগুলো বলতে বলতে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ছু*রিটা ক্রমশ দেবে এলো প্রিয়তা গলায়। চোখে জমে থাকা অশ্রুগুলো গাল বেয়ে গড়িয়ে নামল। কথার এই ধাক্কাটুকু সামলে নেওয়ার আগেই রুদ্র শরীরের তীব্র ধাক্কা লাগল ওর শরীরে। তাল হারিয়ে সোজা তোষকের ওপরই পড়ল ও। হালকা পেছাতেই শরীর পুনরায় গিয়ে আটকালো ধসা দেয়ালে। নির্বিকার পায়ে প্রিয়তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল রুদ্র। আরও একবার ছু*রিটা ঠেসে ধরল গলায়। বলল, ‘ কল করার খুব শখ তোমার, তাইনা? আজ একটা না, দুটো কল করাব আমি তোমাকে।’
রুদ্রর ধোঁয়াশাময় কথায় প্রিয়তার মনে প্রশ্ন ওঠার কথা থাকলেও, উঠল না। রুদ্রর কথাটা বোঝার কোনরকম চেষ্টাও করল না। নিজের অস্তিত্ব, পরিচয়, লক্ষ্য সবকিছু বেরিয়ে গেল মাথা থেকে। সব ভুলে সামনে বসে থাকা রুদ্র আমেরকে ভয় পাচ্ছে প্রিয়তা। ভীষণরকম ভয় পাচ্ছে।
ততক্ষণে একহাতে ফোন বের করে ফেলেছে রুদ্র। প্রিয়তার দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘ তোমার প্রেমিককে কল করো আবার। এইমুহূর্তে! কল করে বলো, আজকের মতো এমন আবা*গিরি যেন আর না করে। আর যদি করে, পরেবার গলাটা ওর কা*টবে। তারপর তোমার।’
প্রিয়তার চেহারায় এবার বিস্ময় ফুটে উঠল। রুদ্র সেই একই গলায় বলল, ‘কল করো!’
প্রিয়তা নড়ল অবধি না। একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নিজের স্বামীর দিকে।
‘করো!’
রুদ্রর আচমকা ধমকে ঝাঁকি খেয়ে উঠল প্রিয়তার শরীর। ছু*রির ধারে কে*টে গেল গলার খানিকটা চামড়া। আচমকা ভীতিতে ব্যথার অনুভবটুকু করতে পারল না প্রিয়তা। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হাতে নিল ফোনটা। কাঁপাকাঁপা হাতে ডায়াল করল সম্রাটের নাম্বারে। রিং হওয়ার সময় গলায় ধরে রাখা ছু*রিটা সামন্য আলগা করে রুদ্র বলল, ‘কথা বলার সময় এটা মনে রেখো, ছু*রিটা তোমার গলার কাছেই আছে। এন্ড ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন, আ’ল নট হেজিটেড!’
চোখ নামিয়ে একবার ছু*রিটার দিকে দেখল প্রিয়তা। এরমধ্যেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো সম্রাটের ব্যস্ত কন্ঠস্বর, ‘হ্যালো? কে বলছেন?’
‘ রাণী।’
‘ রাণী! বের হতে পেরেছো তুমি? গোলামকে পাঠিয়েছিলাম; দেখা হয়েছে ওর সঙ্গে তোমার? লোকেশন দেখেছি আমি। তুমি এখন_’
পুনারায় ছু*রিটা এসে চেপে বসল প্রিয়তার গলায়। প্রিয়তা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘ আমি জানি আমি কোথায় আছি। গোলাম নেই। বেশি বাড়াবাড়ি করছিল; তাই সরিয়ে দিয়েছি আমি ওকে। এসব ছাড়ো। এখন আমার বের হওয়ার আর কোন প্রয়োজন নেই। আমি যেখানে আছি; সেখানেই থাকতে চাই। আমার প্রয়োজনে। তাই_’
একটু থেমে রুদ্রর দিকে তাকাল প্রিয়তা। ছোট্ট একটা ঢোক গিলে বলল, ‘ তাই আমাকে নিয়ে ভাবা বন্ধ করে এখন কাজে মন দাও। বাকিদেরও তাই করতে বলো। আমি ঠিক আছি, ভালো আছি এবং নিজের ইচ্ছেতেই আছি।
ওপাশ থেকে হতভম্ব সম্রাট বলে উঠল, ‘ কিন্তু রাণী_’
ফোনটা কেড়ে নিল রুদ্র। লাইনটা কেটে দিয়ে সুইচড অফ করে দিল। এরপর প্রিয়তার কাছ থেকে নেওয়া, প্রিয়তার ফোনটাই বের করল ও। এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘দ্বিতীয় কলটাও এখনই করবে।’
প্রিয়তা তাকিয়ে আছে রুদ্রর নির্লিপ্ত মুখটার দিকে। নিজের স্বামীকেই যেন চিনতে পারছেনা আজ ও। রুদ্রর এই নির্লিপ্ততাতেও যেন ভয়ংকর কিছু লুকিয়ে আছে। রুদ্র যেন সত্যিই ধ্বংস হয়ে উঠেছে। সেই ধ্বংসকে নিজের অজান্তেই ভয় পাচ্ছে প্রিয়তা। প্রথমবার!
*
‘ তুমি তাহলে চট্টগ্রাম যাচ্ছো না?’
নড়ে উঠল উচ্ছ্বাস। নাজিফাদের বাড়ির সদর দরজার সিঁড়িটাতে বসে আছে ওরা দুজন। প্রিয়তাকে আশ্রম থেকে নিয়ে আসতে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা ছিল ওর। যাওয়ার আগে দেখা করতে এসেছিল নাজিফার সঙ্গে। এসে জানল, নাজমা বেগমের জ্বর। এখন ঘুমোচ্ছেন তিনি। রাতও অনেক হয়েছে। তাই ঘরের বাইরে বসেই কথা বলছিল দুজন। কথার মাঝেই জানায় চট্টগ্রাম যাওয়ার কথা। প্রিয়তার ব্যপারটাও জানা আছে নাজিফার। তাই বারণ করেনি। তখনই প্রিয়তার নাম্বার থেকে কল আসে। প্রিয়তা জানায়, ও ঠিক আছে। বাড়িতেও নাকি কল করেছিল। করে জেনেছে, উচ্ছ্বাস কক্সবাজার যাচ্ছে আজ। প্রিয়তা বলল, কাল আশ্রমের একটা বাচ্চার জন্মদিন। সেটা অ্যাটেন করে পরশু ঢাকায় ফিরে আসবে ও নিজেই। তাই উচ্ছ্বাসকে আসতে বারণ করে দেয় ও। বলে, একরাতের জন্যে আর আসতে হবেনা। সে ব্যপারটা নিয়েই ভাবছিল এতক্ষণ। দীর্ঘক্ষণের নীরবতার পর নাজিফার হঠাৎ বাক্যে ধ্যানভঙ্গ হল ওর।
উচ্ছ্বাস সামান্য গলা ঝেড়ে বলল, ‘ না, বউমণি যখন নিজেই বারণ করল, যাওয়াটা ঠিক হবেনা। এতদিনতো কোনরকম যোগাযোগ করা যাচ্ছিলনা বউমণির সঙ্গে। রাজুও ঠিকঠাক কিছু বলছিলোনা। এরপর যেকোন মুহূর্তে রুদ্র চলে আসবে। এসে যদি এসব জানেতো কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তাছাড়াও, বউমণি কেমন আছে সেটাও জানা দরকার ছিল। ও অনেক সহজ টার্গেট ওদের জন্যে। এমনিতেও অনেককিছু ঘটে গেছে আমের ভিলায়।। মেয়েটার কোন বিপদ হলে আমরা সবাই একদম শেষ হয়ে যাব। আমার আরও আগেই যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এখন যখন খবর পেয়েছিই তখন পরশু অবধি অপেক্ষা করি।’
‘ এমন পরিস্থিতিতে ভাবি এমন সিদ্ধান্ত কেন নিল সেটাই বুঝলাম না!’
‘ রুদ্র আমেরের বউতো। ওর মতোই জেদি।’
বলতে বলতে মৃদু হাসল উচ্ছ্বাস। নাজিফাও হাসল। বলল, ‘তো এখন এখনতো আমের ভিলাতেই ফিরবে? নাকি_’
বাক্যটা শেষ করার আগেই আবার বেজে উঠল উচ্ছ্বাসের ফোন। মোবাইলের স্ক্রিনে তাকাতেই চেহারা ফ্যাকাশে রঙ ধারণ করল ওর। গলা শুকিয়ে এলো। নাজিফা তা দেখে ভ্রুকুটি করে বলল, ‘ কার ফোন?’
‘ রুদ্র! দেশি নাম্বার! তারমানে দেশে চলে এসেছে শালা! এলাহি কান্ড হবে এবার।’
বলে লম্বা করে একটা শ্বাস নিয়ে কলটা রিসিভ করল উচ্ছ্বাস। কন্ঠস্বর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল, ‘হ্যালো? কীরে শালা! কই মরছিলি? কতদিন যাবত খবর নাই কোন? দুবাই গিয়া আবার নতুন সংসার পাতছিস নাইতো? তোরতো শালা চরিত্রের ঠিক নাই।’
অপাশ থেকে গম্ভীর গলায় রুদ্র বলল, ‘এয়ারপোর্ট চলে আয়। বারোটার মধ্যে।’
রুদ্রকে এতোবেশি গম্ভীর দেখে নিজেও গম্ভীর হয়ে উঠল উচ্ছ্বাস, ‘কী হয়েছে? এনিথিং সিরিয়াস?’
‘আয়, তারপর বলছি।’
কল কেটে দিল রুদ্র। চিন্তিত ভঙ্গিতে হাত ঘড়ি দেখল উচ্ছ্বাস। সময় বেশি নেই। এখনই বের হতে হয়। কিন্তু এয়ারপোর্ট কেন? নাজিফা বলল, ‘ কী ব্যপার? কী বলল রুদ্র ভাই?’
‘ এয়ারপোর্ট যেতে বলল। সম্ভবত কোথাও যেতে হবে। জরুরি কাজ।’
কথাটা শোনামাত্র চেহারা অন্ধকার হয়ে গেল নাজিফার। রুদ্র-উচ্ছ্বাসের জরুরি কাজের অর্থ জানা আছে ওর। খু*ন, হানাহানি, গো*লাগু*লি। আর এখন যা অবস্থা তাতে অবস্থা আরও ভয়ংকর। প্রিয় মানুষটার বিপদের সম্ভাবনায় অস্থির হয়ে উঠল ও। নাজিফার অস্থিরতা টের পেয়ে উচ্ছ্বাস বলল, ‘কী হলো?’
অসহায় চোখে তাকাল নাজিফা, ‘ প্রথমবার বুকে পাথর চেপে সহ্য করে নিয়েছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয়বার তোমাকে হারাতে হলে আমার আর সহ্য হবেনা। আমি পাগল হয়ে যাব। ভয় করে আমার।’
উচ্ছ্বাস এবার একটু সেঁটে বসল নাজিফার সঙ্গে। কানের কাছে মাথা নামিয়ে সামান্য কৌতুকস্বরে বলল, ‘তোমার আরও ভয় পাওয়া উচিত ঝাঁসির রাণী। এতো সহজে তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাচ্ছিনা আমি। তোমার শান্তি আমার সহ্য হবেনা। আর তাছাড়াও, পাগল নতুন করে পাগল হয়না।’
মলিন একটুকরো হাসল নাজিফা। আলতো একটা কিল বসালো উচ্ছ্বাসের বাহুতে। উচ্ছ্বাস নিজের হাতের মুঠোয় তুলে নিল নাজিফার হাত। তালুর উল্টোপিঠে আলতো করে চুমু খেল। নাজিফা অবর্ণণীয় এক অনুভূতি নিয়ে তাকাল উচ্ছ্বাসের দিকে। বলল, ‘কথা দিচ্ছো?’
‘ দিচ্ছি।’
এরপর হাত বুলালো ওর ভরা পেটে। নরম গলায় বলল, ‘ ওর মুখে বাবা ডাক শোনার তীব্র ইচ্ছা আমার নাজিফা। সেই ডাকটুকু না শুনে কোথাও যেতে চাইনা আমি। কোথাও না।’
*
বারবার ঘড়িতে সময় দেখছে রুদ্র। অপেক্ষা করছে ওয়াশরুম থেকে প্রিয়তার বেরিয়ে আসার। বের হতে হবে ওকে শীঘ্রই। কিন্তু তারআগে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।
প্রিয়তাকে দিয়ে দ্বিতীয় কলটা উচ্ছ্বাসকেই করিয়েছিল রুদ্র। কারণ দূরে থাকলেও উচ্ছ্বাস এবং জাফরের ওপর বিশেষ নজরদারি আছে ওর। সেখান থেকেই জানতে পেরেছে আজ প্রিয়তাকে আনতে চট্টগ্রাম যাচ্ছিল উচ্ছ্বাস। কিন্তু সেটা হলে উচ্ছ্বাস জেনে যেতো প্রিয়তা এখন চট্টগ্রাম নেই। সেই সঙ্গে আজ রাতে উচ্ছ্বাসকে দরকার হবে ওর। সেকারণেই এই কৌশল অবলম্বন করতে হল। প্রিয়তাকে মুখে গলায় লাগা র*ক্ত ধুতে পাঠিয়েছিল রুদ্র। বলেছিল তাড়াতাড়ি বের হতে। এতো দেরী করছে কেন?
অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন বের হলোনা। তখন বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল রুদ্র। দরজায় নক করতে উদ্ধত হতেই ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজ এলো। ধীরপায়ে বেরিয়ে এলো প্রিয়তা। ভেজা চুল দেখে রুদ্র বুঝল, একেবারে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে। ভয়ে কিংবা ঠান্ডায় শরীর এখনো কাঁপছে। তবে সর্বাঙ্গে এক স্নিগ্ধ উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে ওর। হলদেটে জেল্লা, কম্পমান কমলাটে ঠোঁট আর ভেজা চুলের সৌন্দর্য যেন চারপাশটা ফিকে করে দিচ্ছে। তবে হৃদয়কে বিন্দুমাত্র দুর্বল হতে দিলোনা রুদ্র। এগিয়ে গিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল মেয়েটার কবজি। রুক্ষ স্বরে বলল, ‘পরিষ্কার হয়ে আসতে বলেছিলাম। রাত পার করে আসতে বলিনি।’
বলতে বলতে টেনে নিয়ে তোষকের ওপর প্রায় ধাক্কা দিয়ে ফেলল ওকে রুদ্র। প্রিয়তা চোখ নামিয়ে ফেলল। ওয়াশরুমে আয়নার সামনে গলাটা ধোঁয়ার আগে দেখেছিল, কেটে যাওয়া অংশটা থেকে সরু ধারায় র*ক্ত নামছে। রুদ্রও নিশ্চয়ই দেখেছে। কিন্তু কোন হেলদোল ছিলোনা ওর মাঝে। অথচ একটা সময় ছিল; সবজি কা*টতে গিয়ে সামান্য হাত কে*টে গিয়েছিল বলে আমের ভিলায় প্রিয়তার সবজি কাটাই বন্ধ করে দিয়েছিল রুদ্র। দীর্ঘশ্বাসটা ভেতরে চেপে শক্ত হয়ে সেখানে বসে রইল প্রিয়তা। খানিক বাদেই লক্ষ্য করল একটা ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে ওর ঠিক সামনে এসে বসল রুদ্র। বিরতিহীন হাতে প্রথমে তুলো, এরপর ঔষধ বের করে; ঔষধ দাবি তুলোটা ভিজিয়ে নিল। এরমধ্যে একবারও তাকিয়ে দেখলোনা প্রিয়তার দিকে। সামান্য হলেও হৃদয় হালকা হলো প্রিয়তার। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘এতোকিছুর পরেও আপনি আমাকে ভালোবাসেন রুদ্র। একটু হলেও বাসেন। একটু হলেও অনুভূতি আছে আমার প্রতি আপনার। আজও আমার কষ্ট আপনার সহ্য হয়না।’
থেমে গেল রুদ্রর হাত। এতক্ষণে তাকাল প্রিয়তার দিকে। আলতো করে হাত রাখল প্রিয়তার ঘাড়ের একপাশে। চোখদুটো আটকে আছে প্রিয়তার চোখের গভীরে। হঠাৎই অপরহাতে ঔষধে ভেজানো তুলোটা নির্দয়ভাবে প্রিয়তার কা*টা স্থানে চেপে ধরল রুদ্র। জ্বালায় চোখ বন্ধ করে ফেলল প্রিয়তা। রুদ্র নির্বিকারগলায় বলল, ‘ তোমার মতো মাস্টারমাইন্ডের এমন ভ্রমে থাকা উচিত নয়। ইনফেকশন হয়ে গেলে গলাটা কাঁটতে হবে। সে সময় এখনো আসেনি।’
চোখ খুলে রুদ্রর দিকে তাকাল প্রিয়তা। জ্বালা সহ্য করেই বলল, ‘ অনুভূতিকে রাগের আড়ালে লুকোনো আপনার পুরোনো অভ্যাস।’
‘ আর সে অনুভূতি নিয়ে খেলাটা তোমার অভ্যাস।’
চুপ হয়ে গেল প্রিয়তা। রুদ্রর ঔষধ লাগানো শেষ হতেই প্রিয়তা বলল, ‘ যদি তাই হয় এখনো কেন খু*ন করলেন না আমাকে? কেন আটকে রেখেছেন এভাবে? অকারণে একটা পাও ফেলেন না আপনি। সেখানে আমাকে এভাবে আটকে রাখাটা অকারণ; সেটা আমি বিশ্বাস করিনা। ভাইকে কল করানোর পেছনের কারণটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু সম্রাট? ওকে কল কেন করালেন আমায়? কেন ওস্কালেন ওভাবে? কী পরিকল্পনা সাজিয়েছেন আপনি রুদ্র?’
পাশে রাখা দড়িগুলো আবার হাতে তুলে নিল রুদ্র। প্রিয়তার দুটো কবজি একত্র করে বাঁধতে বাঁধতে বলল, ‘ হাঁস যতক্ষণ সোনার ডিম দেয়, ততক্ষণ তাকে জ*বাই করতে নেই।’
প্রিয়তা এবার সামান্য অস্থির হয়ে বলল, ‘ কিন্তু এইমুহূর্তে আমার বের হওয়াটা খুব প্রয়োজন রুদ্র।’
‘ আর তোমার তোমার সব প্রয়োজনের বাড়া ভাতে ছাই ঢালাটা আমার প্রয়োজন।’ বলে প্রিয়তার পা দুটোও শক্ত করে বেঁধে ফেলল রুদ্র।
প্রিয়তা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। যখন দেখল, বক্স থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করছে রুদ্র। তার ভেতরে লিকুইড আছে। রুদ্র সামান্য চাপ দিয়ে পরীক্ষা করে নিল সেটা। সিরিঞ্জটা নিয়ে প্রিয়তার দিকে এগোতেই; বন্ধরত অবস্থাতেই খানিকটা পিছিয়ে গেল প্রিয়তা। কন্ঠে অবিশ্বাস নিয়ে বলল, ‘কী করছেন আপনি?’
কিন্তু কিছুই শুনতে না পাওয়ার ভঙ্গি করল রুদ্র। প্রিয়তার বাহু ধরে নিজের দিকে টেনে এনে হাতে পুশ করে দিল ইনজেকশনটা। বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল প্রিয়তা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল রুদ্রর দিকে। বিকারহীনভাবেই প্রিয়তাকে ধরে শুইয়ে দিল রুদ্র। ফিসফিসে আওয়াজে বলল, ‘ যে কাজটা তুমি আমার অজান্তে করতে। সেই কাজটাই আমি তোমাকে জানিয়ে করলাম। স্লিপ টাইট!’
প্রিয়তা তখনও চোখে অবিশ্বাস নিয়ে দেখছে রুদ্রকে।
*
রাত তিনটের বেশি বাজে। চট্টগ্রামের সমুদ্রের নিকটবর্তী অঞ্চলের দীর্ঘ জঙ্গল। জঙ্গলের সপ্রস্থ রাস্তাটা ধরে পায়ে হেঁটে হেঁটে গভীরে প্রবেশ করছে রুদ্র আর উচ্ছ্বাস। অন্ধকার এই রাতে ফোনের ফ্লাশলাইটটা অবধি দিতে দিচ্ছেনা রুদ্র ওকে। তাও ভালো, আকাশে আধখানা হলেও একটা চাঁদ আছে। ওটার বদৌলতে কিছুটা হলেও দৃশ্যমান হচ্ছে রাস্তা। একে প্রচন্ড ঠান্ডা, তারওপর হঠাৎ হঠাৎ জীবজন্তুর আওয়াজ অজান্তেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে গায়ের লোম। চট্টগ্রাম আসার পর উচ্ছ্বাস ভেবেছিল। গেল! এই ছেলে নিশ্চয়ই টের পেয়ে গেছে বউ তার চট্টগ্রামে এসেছে। কিন্তু এভাবে জঙ্গলের পথে ঢুকতে দেখেই বুঝল ব্যপার ভিন্ন। এবং গুরুতর কিছু। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে উচ্ছ্বাস বলল, ‘ তোর মাথায় কী চলছে বলবি আমাকে? হুট করে এয়ারপোর্টে ডেকে সোজা প্লেনে তুলে নিয়ে চট্টগ্রাম চলে এলি। কেন? কী ব্যাপার কিচ্ছু বলছিস না। দেশে কখন আসলি? টিকিট কখন কাটলি বাপ?’
রুদ্র জবাব দিলোনা। নিজের মতো এগিয়ে চলল। উচ্ছ্বাস বলল, ‘ কীরে ভাই? মাঝ জঙ্গলে নিয়ে খু*নটুন করবি নাকি আমারে?’
‘ সময় নেই। তাড়াতাড়ি পা না চালালে সেটাই করব।’
বলতে বলতে পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল রুদ্র। হতাশ হয়ে হাঁটার গতি বাড়াল উচ্ছ্বাসও। এই অল্প কয়েক ঘন্টার মধ্যে যা যা ঘটে গেল সবটাই মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে ওর।
কিছুক্ষণ পর, আলোকিত একটা জায়গা চোখে পড়ল ওদের। খানিকটা এগোতেই বোঝা গেল সাময়িক একটা ডেরা। চট করে একটা মোটা গাছের আড়ালে আশ্রয় নিল রুদ্র। স্বয়ংক্রিয়ভাবে একই কাজ করল উচ্ছ্বাসও। চারপাশটা লক্ষ্য করল ভালোভাবে। এখানে আসার কারণ অর্ধেকটা আন্দাজ করে ফেলল ও। তবে তখনই কোন প্রশ্ন করল না। দেখল, দূরে একটা তাঁবু। মশাল জ্বালিয়ে বাঁধা হয়েছে বেশ কয়েকটা গাছের সঙ্গে। চারপাশে ঘুরঘুর করছে অ*স্ত্রধারী অনেক মানুষ। এমনভাবেই কেটে গেল বেশ খানিকটা সময়। চটাস করে পায়ে একটা চাপড় বসাল উচ্ছ্বাস। কন্ঠে বিরক্তি ঢেলে বলল, ‘ভাই তোর গুলশান লেকেপাড়ের মশা পছন্দ হচ্ছিলনা? চাঁটগাইয়া মশার কামড় খাওয়াতে নিয়া আলি। চাঁটগাইয়া মেয়ের প্রেমে পড়ছিস সেটা দুইবছরের বাসি ঘটনা। চাঁটগাইয়া মশার প্রেমে পড়লি কবে?’
চোখ গরম করে তাকাতেই দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল উচ্ছ্বাস। ভ্রুর ওপরে হাত তুলে তাঁবুর দিকে কিছু একটা দেখার ভান করল। কিন্তু সত্যিই দেখতে পেল। তাঁবুর ভেতর থেকে একে একে বেরিয়ে এলো দুই যুবক। প্রথমে চেনা গেলোনা। কিন্তু খানিকটা এগিয়ে আসতেই স্পষ্ট হয়ে উঠল দুজনের চেহারা। সম্রাট তাজওয়ার এবং শান মীর্জা! দুটো অনেকটা ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে আসছে। উচ্ছ্বাস চোখ কপালে তুলে বলল, ‘ বাপরে! চিন্টু-মিন্টু একসাথে?’
কিছু বলতে যাচ্ছিল উচ্ছ্বাস। কিন্তু রুদ্র ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ থাকার ইশারা করতেই থেমে যেতে হল ওকে। দুটো ট্রাক থামল নির্দিষ্ট স্থানে। সুনির্দিষ্ট ছন্দে ট্রাক থেকে নেমে এলো বেশ কিছু লোক। সতর্ক ভাবে এগিয়ে গেল এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোও। এরপর অতি পরিচিত নিয়মেই ঘটতে দেখল সবকিছু। প্রথমে একে-অপরকে পাসকোড বলার মাধ্যমে নিশ্চিত হল পরিচয়। অতঃপর ট্রাক থেকে নামানো হলো মাল। শান হালকার ওপর একটু আধটু পরীক্ষা করল সেগুলো। কিন্তু সম্রাটের যেন একদম মনই নেই এসবে। অস্থির লাগবে ওকে খুব। মাল তুলে ট্রাকের লোকগুলো বিদায় নিল। তারপরেও কেটে গেল অনেকটা সময়। সেই সময়টাতে মাল গোছাচ্ছিল ওরা। শান সতর্কভাবে সবদিকটা খেয়াল রাখার চেষ্টা করলেও সম্রাট বারবারই অস্থির হয়ে উঠছে। অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। তা দেখে ঠোঁটে রহস্যময় এক বাঁকা হাসি ফুটল রুদ্র।
এরমধ্যেই আরও দুটো ট্রাক এলো। ট্রাকদুটো দেখেই সোজা হয়ে দাঁড়াল ওরা সবাই। মাল গোছানো শেষ। এবার এই ট্রাকে জঙ্গল পেরিয়ে মেইনরোডে উঠবে ওরা। এরপর ধাপে ধাপে গাড়িবদল। যেমনটা হয় সাধারণত। কেউ ধরতেও পারবেনা মালগুলো কোথায়, কীভাবে, কোনদিকে গেছে। সবগুলো মাল তোলা শেষ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই যেন আচমকা সুনামির ধাক্কা লাগল জঙ্গলে এই জায়গাটায়। চারদিক থেকে আচমকা আক্রমণে ওদের ঘিরে ধরল কতগুলো লোক। উপস্থিত ডার্ক নাইট আর সোলার সিস্টেমে লোকসহ সম্রাট আর শান হতবিহ্বল হয়ে গেল। কিন্তু নিজেদের সামলে নিল খুবই দ্রুত। কিন্তু অবাক হয়ে দেখল, ওরা যতজন এসেছে তারচেয়ে দ্বিগুণ লোক ঘিরে ধরেছে ওদের। সুতরাং একেকজনের বিপরীতে দুজন। গু*লি চালানোর মতো ভয়ংকর রিস্ক এই মুহূর্তে আর হয়না। শান ব্যপারটা বুঝতে পারলেও সম্রাট বুঝতে পারল না। ‘ফায়ারিং’ এর আদেশ দিয়ে বস হঠাৎ উত্তেজনা আর ঝোঁকের মাথায়। নিজেদের অস্ত্র বের করে যে যার মতো আড়াল ফায়ারিং শুরু করল।
রুদ্র নিজের প্যান্টের পেছন থেকে নিজের পি*স্ত*ল বের করতে করতে বলল, ‘ গাঁধার পেছনে দশটা লাথি মারলেও সে গাঁধাই থাকে।’
উচ্ছ্বাসও নিজের ব*ন্দু*কটা লোড করতে করতে বলল, ‘তুই একটা চিজ ভাই। ঢাকা থেকে প্লেনে তুলে সোজা চট্টগ্রাম নিয়ে এলি তাও মিশনে। অন দ্য স্পট জানতে পারছি আ’ম ইন আ মিশন! একেবারে মচৎকার!’
‘ একমিনিট আগেও কাউকে এবিষয়ে জানাতে চাইনি। বাকিটা পরে বলব।’
দক্ষ পায়ে এগিয়ে গেল ওরা। কভার ছাড়াই ওপেন ফায়ার করল। একই তালে দক্ষ পায়ে এগোচ্ছে দুজন। ওদের দুজনকে দেখে সম্রাট এবং শান দুজনেই কিছুক্ষণের জন্যে স্তম্ভিত হয়ে গেল। পুনরায় মনবল যুগিয়ে যুদ্ধে ফিরতে বেগ পেতে হলো বেশ। কিছুক্ষণ চলল এই বন্দুকযু*দ্ধ। হাতে কয়েকজন নিহত হলো, কিছু লোক গু*লিবিদ্ধ হল। লোকবলের সঙ্গে না পেরে বাকিরা সেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল।
তবে অ*স্ত্র ত্যাগ করল না ঘাড়বাঁকা সম্রাট আর শান। তবে গু*লি চালানোরও সাহস পেলোনা। কারণ চারদিক থেকে ঘেরা হয়েছে ওদের। এতোটা অবাক এরআগে হয়নি ওরা। দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে গোটা ব্যপারটা। কারণ রুদ্র আর উচ্ছ্বাসের এই মুহূর্তে এতোবেশি লোক নিয়ে আক্রমণ করা একপ্রকার অসম্ভব ছিল। সম্রাট রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলল, ‘রাণী কোথায়?’
রুদ্র চোয়াল শক্ত করে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘ ব*ন্দু*কটা পাস কর দুজন।’
‘ রাণী কোথায়?’ একই প্রশ্ন করল সম্রাট।
উচ্ছ্বাস একহাতে গাল চুলকে বল, ‘ রাণী আবার কে? শালা তুই ডুবাই থিকা ওর গার্লফ্রেন্ড ভাগাইয়া আনছোস নাকি?’
রুদ্র এগিয়ে গেল দুজনের দিকে। শানের সামনে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ নাইস টু মিট ইউ ডিয়ার সম্বন্ধী সাহেব। বোনকে লুকিয়ে-চুরিয়ে পাঠাতে হলো; এতো লজ্জা কীসের? নিজের হাতে তুলে দিলে কী আমি নিতাম না?’
শানের ইচ্ছে করল রুদ্রর গালে ঠাটিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিতে। কিন্তু ঠান্ডা মগজের মানুষ ও। অবস্থাযে অনুকূলে নেই তা বুঝতে সময় লাগল না ওর। তাই চুপ থাকল। রুদ্র এপার সিরিয়াস কন্ঠে বলল, ‘ গানটা দাও।’
নড়ল না শান। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শানের মুখ বরাবর সজোরে একটা ঘুষি বসালো রুদ্র। দাঁতে দাঁত পিষে বলল, ‘ দে শুয়*রের বাচ্চা।’
মুখে বলল ঠিকই। কিন্তু দেওয়ার অপেক্ষা করল না রুদ্র। কেড়ে নিল শানের অ*স্ত্র। চিরকালীন র*ক্তগরম সম্রাট সে মুহূর্তেও একই কাজ করল। এই অবস্থাতেই সোজা রুদ্রর মাথা বরাবর গু*লি করতে গেল। কিন্তু উচ্ছ্বাসের নজর সম্রাটের দিকেই ছিল। সম্রাট ট্রিগার প্রেস করার আগেই উচ্ছ্বাস গু*লি কর ওর হাতে। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে গিয়ে একটা লাথিও বসাল সম্রাটের পেটে। ফরসরূপ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সম্রাট। উচ্ছ্বাস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ বেঁচি গেলি বস্। এই খুশিতে কাচ্চি খাইয়ে দিস।’ এরপর তাকাল মাটিতে পড়ে কাতরাতে থাকা সম্রাটের দিকে। আফসোসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘রুদ্র ঠিকই বলে। তুই শালা আসলেই একটা গাধা।’
যন্ত্রণায় ছটফটরত অবস্থায়ও জ্বলন্ত চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকাল সম্রাট। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ‘মরা মায়ের নামে কসম কাইটা কইতাছি। তোর মরন আমার হাতেই লেখা আছে বেজ*র বাচ্চা।’
কথাটা শুনে হাঁটু ভেঙে বসল উচ্ছ্বাস। সম্রাটের আঞ্চলিক ভাষা শুনে নিজেই প্রমিত বাংলা ভুলে গেল যেন। ওর ফ্যাসফ্যাসে গলা নকল করে বলল, ‘ আমার কিছু হইলে ঐদিন তোগো কফিনে শেষ পেরেগ পইড়া যাইব। নিশ্চিত থাক।’ অতঃপর স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘ ঐযে ঐ ছেলেটাকে দেখছিস? রুদ্র! আমার কিছু হলে ও এমন উন্মাদ হবে যে তোরা নেংটি ইঁদুরের মতো গর্তে গিয়ে লুকোবি। কিন্তু তারচেয়েও মজার ব্যপার হল ও সেই গর্তে ঢুকে ঢুকে মানুষের নাকের ডগা দিয়ে তোদের একেকটাকে মা*রবে। কেউ কিচ্ছু করতে পারবেনা।’
শানকে নজরদারিতে রেখে সম্রাটের দিকে এগিয়ে এলো রুদ্র। থমথমে গলায় সম্রাটকে জানাল, ‘ হতাশ হওয়ার কিছু নেই।তোর সঙ্গে অনেক ব্যক্তিগত হিসেব বাকি আছে আমার। আর সেটা ব্যক্তিগতভাবেই মেটাব। ভবিষ্যতে আরও একটা সুযোগ পাবি।’
কিছু বলল না সম্রাট। প্রচণ্ড রাগে মাটিতে একদলা থুথু ফেলল কেবল। সম্রাট আর শানকে ছেড়ে উঠে দূরে সরে দাঁড়াল রুদ্র আর উচ্ছ্বাস। ওদের দুজনসহ বাকি সকলকে নিরস্ত্র করে বেঁধে ফেলল ওদের লোকেরা। একজন বাদে। সেই একজনকে উদ্দেশ্য করে রুদ্র বলল, ‘তুমি আমাদের সঙ্গে মেইনরোড অবধি যাবে খোকা। এরপর ফিরে এসে বসসহ বাকি সঙ্গীদের ছাড়িয়ে নিও।’
*
শানের ফোনে কলে আছে শওকত মীর্জা, করিম তাজওয়ার এবং পলাশ। ওরা সবাই ঢাকাতে। চট্টগ্রামে শুধু শান আর সম্রাটই এসেছিল। একটু আগেই সম্রাটের হাতের ড্রেসিং করে গেছে ডক্টর। ঘরটাকে এখন একদম থমথমে নীরবতা। আচমকা ঝড়টাতে স্তব্ধ, বাকহীন হয়ে পড়েছে সবাই। যে মুহূর্তে সবকিছু এতো সুন্দর প্লানমাফিক; সাজানো-গোছানো চলছিল। সে মুহুর্তেই এমন একটা ঘটনা এলোমেলো করে দিয়েছে। চরম ক্ষতি করে দিয়েছে। এতক্ষণ এই ক্ষতির হিসেবটাই কষা হচ্ছিলো। পলাশ বলে উঠল, ‘ কীভাবে সম্ভব হলো এটা? এমন মুহূর্তে রুদ্র ওখানে গেল কীকরে? আর এতো লোকবল আর অস্ত্র পেল কোথায় ও? এফোর্ড করল কীভাবে? ডুবাই গিয়ে কী করে এসেছে?’
করিম তাজওয়ার বলল, ‘ কেন? ভুলে গেছো তোমাদের রাজরাণী এখন ওর কাছেই আছে। সেতো আবার রুদ্র নামে দুঢোক বেশি পানি খায়। দেখো, প্রেমের টানে সব বলে দিয়েছে।’
শান সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, ‘ রাণী এধরণের কিছু করার মেয়ে না। ওর কিছু করার হলে আমাদের বলেই করতো। আজাইরা কথা বলবেন না।’
সম্রাটও রাণীর পক্ষ নিয়ে বলল, ‘ হ্যাঁ, রাণী আর যাই হোক এমন কিছু করেনি। আর তাছাড়াও; শুধু ইনফরমেশন না পাওয়ার দিয়েও কাজ করেছে ও এখানে। এতো লোক, এতো অস্ত্র হঠাৎ কোথায় পেল ও? সোলার সিস্টেমের বেশিরভাগ লোক দল ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এরমধ্যে এসব কীভাবে সেটাই প্রশ্ন।’
তেঁতে উঠল করিম। ঝাঁজালো গলায় বলল, ‘তুই একটাও কথা বলবি না। কতবার বলছি এই আলগা মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখ। এই মেজাজই ডোবাকে একদিন তোকে। নিজেতো ডুববি, সঙ্গে আমাদেরও ডোবাবি। কাল কী এমন হয়েছিল যে এতো বেখেয়ালি ছিলি, চটে ছিলি? কে মরছিল তোর?’
রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করতে গিয়ে ব্যথায় গাল কুঁচকে ফেলল সম্রাট। কিছু বলতে গিয়েও বলল না। শান বলল, ‘ এসব ছাড়ো। মাল কোথায় পাব এখন? সাপ্লাই দেব কী? দেওয়ার ডেট পরশুই। এরমধ্যে মালজোগাড় কোনভাবেই সম্ভব না। সঙ্গে কতগুলো টাকা লোকসান হলো চিন্তা করেছো?’
পলাশ কপালে ভাজ ফেলে বলল, ‘ সেই একই খেলা মনে হচ্ছেনা ভাইজান? মনে হচ্ছে যেন আমাদের বি*ষই আমাদের গেলাচ্ছে। আমরাও ঠিক সেইভাবে ফেঁসে যাচ্ছি যেভাবে আমেরদের ফাসিয়েছিলাম। কোন পার্থক্য নেই।’
এতক্ষণে মুখ খুলল শওকত। এতক্ষণ নিজের আচমকা এক হারের ধাক্কাটা হজম করছিল চুপচাপ। ক্ষতিটা কীভাবে পোষাবে ভাবছিল। এবার থমথমে গলায় বলল, ‘আছে। পার্থক্য আছে। আমরা শেয়ালের মতো চু*রি করে নিয়ে এসেছিলাম। আর ও সিংহের মতো এসে সামনে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।’
#চলবে…
[ রি-চেইক হয়নি। ভেতরে টাইপিং মিস্টেকস্ থাকার সম্ভাবনা আছে। ]