অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ১০৭.

0
80

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

১০৭.

গত দুইরাত ঘুম হয়নি শওকত মীর্জার। ডেলিভারির মালগুলো ছিনতাই হয়ে যাওয়া, ক্ষতিপূরণ কীভাবে করা যায় সেই চিন্তা। তারওপর যার কাছ থেকে টাকা নেবে ভাবছিল সেও কাল পরিষ্কার বলে দিয়েছে, এই শেষ। এমন অধপতন চলতে থাকলে ডার্ক নাইটের ছায়া হয়ে থাকতে পারবেনা সে। শওকতকে অন্যপথ খুঁজতে হবে। অন্যপথতো সে খুঁজেই নিয়েছে। ডার্কনাইটযে বেশিদিন নেই, তা সে জানে। তাইতো রাজনীতিতে বছরখানেক যাবৎ সে এতো বেশি তৎপর। কিন্তু আর সাহায্য করবেনা মানে কী? রাজনীতির শুরু থেকেই ঐ লোকটাকে পরিপূর্ণ সাহায্য করে গেছে ডার্কনাইট। ভোট চু*রি থেকে এলাকায় মাস্তানি করিয়ে সুবিধা নেওয়া সবই করেছে। কেন? এরকম বিপদে যাতে পাল্টা সুবিধা পায় সেজন্যইতো। এখন এতোবড় গদি পেয়ে সব ভুলে গেছে! মুখ তেঁতো হয়ে উঠল শওকতের। বিড়বিড় করল, ‘ বেঈমান! বাইন**!’

কিন্তু চিন্তা কী একটা! তার সবচেয়ে বড় চিন্তাতো তার নিজেরই ছোট মেয়ে রাণী। ষোল বছরের নৃশংসতার ওপর নির্ভর করে উনিশ বছরের মেয়েটাকে এসবে যুক্ত হতে দিয়ে ভুলটা করেছিলেন উনি। ভেবেছিলেন ছেলের মতো মেয়েও তার উন্নতি ঘটাবে। হচ্ছিলো তাই। অদ্ভুত হলেও, কম বয়সেই রাণীর তীক্ষ্ম বুদ্ধি, অভিনব কৌশল, ব্যবসায়ীক বুদ্ধি তার লাভের অন্যতম কারণ ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি যেন উল্টোদিকে মোড় নিচ্ছে। যে দড়ির ভর করে সে ওপরে ওঠার আশা করেছিল, সেটাই এখন গলার ফাঁস হয়ে আটকে আসছে। এমনিতেই যত দিন যাচ্ছিল রুদ্রর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছিল প্রিয়তা। কিন্তু এখন! এখন সেই আসক্তি ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। আগে রাণীর উদ্দেশ্য পরিষ্কার ছিল তার কাছে। কিন্তু এখন নাতো ঐ মেয়ের উদ্দেশ্য পরিষ্কার আর না অনুভূতি। কী করছে, কেন করছে সেটা রাণী ছাড়া পৃথিবীর অন্যকেউ জানেনা। রাণীর চরিত্রে এই আমূল পরিবর্তনটা বাকিরা টের পেলে ভয়াবহ কিছু ঘটে যাবে।
এই চিন্তাটা আরও কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়ে গেছে জয়! গতকাল রাতে এসেছিল সে। জানিয়েছে, রাণীর কারণেই পালিয়ে আসতে পেরেছে সে। কিন্তু চমকপ্রদ ছিল জয়ের দেওয়া দ্বিতীয় তথ্য। রুদ্র রাণীকে আটকে রাখছেনা। বরং সে সেচ্ছায় আছে রুদ্রর সঙ্গে। পাশেই ছিলেন করিম তাজওয়ার। শুনে বেশ তেঁতে উঠেছিলেন উনি। রাগে রাগে গজগজ করে বলেছিলেন, ‘ বলেছিলাম! বলেছিলাম আপনাকে আমি। রুদ্রর প্রতি আপনার মেয়েয ঐ গদগদ প্রেমই একদিন ধ্বংস করে দেবে আমাদের। এই ডিলের সব খবরাখবর ঐ দিয়েছে রুদ্রকে। বোঝাই যাচ্ছে।’

‘ চুপ করুন! রাণী অকারণে কোন কাজ করেনা। সে সিঁড়ি বেয়ে এতো উঁচুতে উঠলে সেই সিঁড়িকেই নড়বড়ে বলছেন? কিছু একটা ভেবেই রুদ্রর সঙ্গে আছে ও। ও মেয়েমানুষ হতে পারে, কিন্তু ওর মগজের ধার নিয়ে আপনার সন্দেহ থাকা উচিত নয়।’

‘ ঐ ধার নিয়েইতো যত ভয়! হুসাইন আলীর সাথে মিটিংটা কবে করবেন?’

‘ ওটা রাণী করবে।’

‘ ঐ মেয়ে আর আসবে?’

‘ ভাট বকবেন নাতো! ওকে আসতে দিন আগে। বাকি আলোচনা তখন হবে।’

মুখে তাজওয়ারকে ধমকে ধামকে সামাল দিলেও সে নিজেও জানে তাজওয়ার ভুল বলেনি। রুদ্র সব সত্যি জেনে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত রাণীকে নিয়ন্ত্রণ করার তুরফের তাসটা ছিল তার হাতে। স্বস্তির ঢেঁকুর তুলছিল সে ভেবেই। কিন্তু এখন! এখন সবটাই গুলিয়ে গেছে। রাণীর সঙ্গে কথা না বলা অবধি কোন সমাধান হবেনা। কথাটা চিন্তা করতে করতে সিঁড়ির দিক ওপরে তাকাল শওকত। প্রিয়তা এখন নিজের কক্ষে আছে।

ভোরের কথা! বসার ঘরে। এভাবে সোফাতে বসেই সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে সিগারেট টানছিল শওকত। সদর দরজা দিয়ে কারো প্রবেশের আওয়াজ সেদিকে তাকিয়ে দেখল প্রিয়তা আসছে। সিগারেটটা অ‍্যাশট্রেতে ফেলে ভ্রুকুটি করে উঠে দাঁড়াল সে। পা থেকে মাথা অবধি নিজের মেয়েকে পর্যবেক্ষণ করে দেখল, কেমন বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছে ওকে। গায়ের শার্টটা এলোমেলো হয়ে কুঁচকে আছে, চুলগুলো এলোমেলো, গলার একপাশে ওয়ান টাইম একটা ব্যান্ডেজ। শওকত এগিয়ে গিয়ে ঠিক সামনে দাঁড়াল প্রিয়তার। ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘ কোথায় ছিলে এ’কদিন? রুদ্র কোথায় রেখেছিল? আর এ অবস্থা কেন তোমার?’

প্রিয়তা তাকাল না শওকতের দিকে। কেবল শান্ত-ধীর গলায় বলল, ‘ পরে কথা বলব। ক্লান্ত আছি আমি এখন।’

শওকত বুঝেছিলেন, আরকোন প্রশ্ন করলে ভয়ংকর রেগে যাবে প্রিয়তা। সেই মুহূর্তে মেয়েকে চটানো লাভজনক হয়নি তার। সেকারণেই চুপ ছিলেন তখন। প্রিয়তাও পরবর্তী কোন প্রশ্নের অপেক্ষা করেনি। চুপচাপ উঠে চলে গেছে নিজের কক্ষে। চোখ বুজে একহাতে ঘাড়টা চেপে ধরল শওকত। প্রেশারটা বেড়েছে ইদানিং খুব। তারওপর ঘুম হচ্ছেনা!
চোখ খুলতে হল ফোনের রিংটোনে। স্ক্রিনে সম্রাটের নামটা দেখে অবাক হল বেশ। বসার ঘড়ে টাঙানো বড় দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল, মাত্র সাতটা বাজে। এতো সকালে ঐ ছোকরা কেন কল করবে? কথাটা চিন্তা করতে করতে কল রিসিভ করল শওকত। বলল, ‘ কী ব্যপার?’

‘ রাণী এসেছে তাইনা!’ প্রশ্ন নয়, অনেকটা নিশ্চিত হওয়ার মতো করেই বলল সম্রাট।

‘ তুমি কীকরে জানলে? একমিনিট! আমার বাড়ির বাইরে নজর রাখছো।’

বিরক্ত হল সম্রাট। ‘ রাণী এসেছে কি-না সেটা বলুন।’

শওকত গম্ভীর গলায় বলল ‘ এসেছে! নিজের ঘরে আছে।’

‘ ফোন রিসিভ করছেনা কেন আমার?’

‘ জানিনা। এসে আমার সঙ্গেও কথা বলেনি। ফোন নেই হয়তো কাছে।’

ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল সম্রাট, ‘কথা বলিয়ে দিন আমার সঙ্গে। জরুরি কথা আছে।’

আরও একবার সিঁড়ির দিকে তাকাল শওকত। দরকার তারও আছে। কথা না বাড়িয়ে সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে রেখে উঠে দাঁড়াল সে। সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল প্রিয়তার ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

ঘরটাতে যেন টর্নেডো বয়ে গেছে। বিছানার চাদর, বালিশ, কুশন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ফ্লোর জুড়ে। শো-পিচ একটাও অক্ষত নেই। ঘরের একটা আসবাবপত্রও গোছানো নেই নিজের স্থানে। বিছানায় নরম ম্যাট্রেসের ওপর সটান হয়ে শুয়ে আছে প্রিয়তা। চোখদুটো স্থির হয়ে আছে সিলিংয়ের দিকে। ঠোঁটজোড়া ঘনঘন কেঁপে কেঁপে উঠছে।
রুমের চেয়েও ভয়ংকর অবস্থা প্রিয়তার শরীরের। শার্ট ছেড়ে একটা পাতলা টিশার্ট পড়েছে এখন। সারা শরীরে নিজেরই নখ দিয়ে আচড় কেটেছে মেয়েটা। ডানহাতটা কপালের ওপর দিয়ে রেখেছে। কিন্তু বাঁ হাতটা খাট ছাড়িয়ে ঝুলে আছে ফ্লোরের দিকে ঝুলে থাকা হাতের তালুতে তিন-চারটা ছু*রির গভীর টান স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেখান টপটপ ধারায় র*ক্ত পড়ছে ফ্লোরে। ঘটনার প্রমাণ দিতে ফ্লোরেই পড়ে র*ক্ত লাগা ছু*রিটা। প্রিয়তা ভাবছে গতরাতে রুদ্র যখন তাকে ওদের স্পষ্ট পরিণতির কথা জানাল, প্রিয়তার দৃষ্টি কেবল রুদ্রর ক্ষতটার দিকেই ছিল। বুকের ভেতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছিল রুদ্রর শরীর থেকে বেরিয়ে আসা র*ক্ত দেখে। কী অদ্ভুত! নিজের করা আঘাতের জন্যেই হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠছে প্রিয়তার মন। রাণী মীর্জা আর প্রিয়তার অনুভূতির দোটানা এতো নিষ্ঠুর, অসহনীয় এর আগে কখনও মনে হয়নি ওর। ঠিক তখনই ব*ন্দু*কের নলটা ওয গলা থেকে নামিয়ে নেয় রুদ্র। দূরে ছুড়ে দিয়ে বলে, ‘ যেখানে ইচ্ছা যেতে পারো এখন। কিন্তু হ্যাঁ তোমার সাধের সম্রাজ্যের ধ্বংস আমার হাতেই হবে। আর সেই ধ্বংস তুমি নিজ চোখে দেখবে।’

প্রিয়তার ইচ্ছে হল রুদ্রর বুকে লুটিয়ে পড়তে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে, ‘আমাকে আকড়ে রাখুন রুদ্র। আমি যেতে চাইনা। কোথাও যেতে চাইনা।’
কিন্তু রুদ্র দূরে সরে গেল। ওকে ওখানে একা ফেলে নির্বিকার চলনে হারিয়ে গেল জঙ্গলের ঘন অন্ধকারে। পড়ে রইল প্রিয়তা একা, ভগ্ন, দিশেহারা অবস্থায়।

প্রিয়তাকে ঘরে প্রবেশ করতেই হৃদপিণ্ডে ধাক্কা লাগল শওকতের। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো। চোখে অবিশ্বাস নিয়ে তাকাল সারা ঘরে। তারচেয়েও বেশি বিস্মিত হল প্রিয়তার অবস্থা দেখে। একি পাগলামি! মেয়ে তার প্রচণ্ড ডেসপারেট তা সে জানে। কিন্তু এমনটা কখনও দেখেছে বলে মনে পড়ছেনা। নিজের ওপর এমন অত্যাচারের মানে কী। শওকতের মানসপটে ভেসে উঠল সেই ষোল বছর বয়সের সেই রাণী র*ক্তমাখা বিভৎস চেহারাটা। অজান্তেই শিউরে উঠল শওকত। সম্রাট লাইনেই ছিল। ফোনটা কানে ধরে ওকে জানাল, ‘ এখন কথা বলার দরকার নেই। পরে বলো?’

‘ কেন?’ রেগে উঠছিল সম্রাট।

কিন্তু ধমক দিয়ে উঠল শওকত, ‘ যা বলছি শোন। পরে কথা হবে রাখছি।’

কলটা কেটে ছোট্ট একটা ঢোক গিলল শওকত। আরও একবার চোখ বুলাল রুমটাতে। ঝড়ের পড়ে বিধ্বস্ত এলাকা যেমন শান্ত, স্তব্ধ থাকে। তেমনই এখন রুমটা। শওকত ধীরপায়ে প্রবেশ করল ঘরে। খানিকটা এগিয়ে গেল। মনে মনে অনেকটা সাহস সঞ্চার করে ডাকল, ‘রাণী?’

আস্তে করে চোখ বুজে ফেলল প্রিয়তা। এছাড়া শরীরের একটা অঙ্গ অবধি নড়ল না। আগের মতো ধীরস্থির গলায় বলল, ‘ বলেছিলাম না একা থাকতে চাই?’

‘ হাতের একী অবস্থা করেছো? কত র*ক্ত পড়েছে দেখেছো?’

‘ ফার্স্ট এইড নিয়ে নেব। যাও।’

নিজের মেয়েটাকে নিয়ে বিস্ময়ের কোন সীমা নেই শওকতের। মেয়েরা নাকি সাধারণত নাজুক হয়। বিশেষ করে ধনীর দুলালীরা আঙুলে সামান্য সূচ ফুটলেও বাড়ি মাথায় করে। তার স্ত্রীতো তাই ছিল। কিন্তু তার মেয়ে এমন কেন হলো! শওকত জানে এখন এই ঘা নিয়ে কিছু বলে লাভ নেই। তাই আসল প্রসঙ্গে আসল। ‘ কথাটা জরুরি।’

চোখ খুলল প্রিয়তা। ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে নিজের বিরক্তির জানান দিল। বাঁ হাতটা সামান্য তুলে ধরে উঠে বসে বলল, ‘ শুরু করো।’

‘ রুদ্র কোথায় নিয়ে গিয়েছিল তোমাকে?’ বিছানার এক কোণে বসল শওকত।

‘ অদরকারী প্রশ্ন। দরকারিটা বলো।’

বলে উঠে দাঁড়াল প্রিয়তা। সোজা চলে গেল ওয়াশরুমে বেসিনে। হাতটা ধুয়ে এসে ওয়ার্ডড্রবের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ড্রয়ার খুলে একটা ফার্স্ট এইড বক্স বের করে আবার এসে বসল বিছানায়। প্রিয়তার কার্যকলাপ লক্ষ্য করতে করতেই শওকত বলল, ‘সম্রাট কল করেছিল।’

‘ জানি। ডিস্টার্ব করতে বারণ করে দিও। ইচ্ছে হলে আমি নিজেই যোগাযোগ করব।’

‘ রুদ্রযে আমাদের ডিলের মালগুলো স্প্ট থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে সেটা জানো?’

‘ জানি।’

প্রিয়তার নির্বিকারত্বে মেজাজ খারাপ হচ্ছে শওকতের। কিন্তু তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলল, ‘ কিছু করার ইচ্ছে নেই তোমার? রাণী ভুলে যেওনা তোমার ঐ বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্য কী!’

তেঁতে উঠল প্রিয়তা। ঠাস্ করে বক্সটা রাখল বিছানার ওপর। রাগী কন্ঠে বলল, ‘ গু*লি ছুড়েছিলাম ওর দিকে আজ আমি। পরপর দু’বার। আরেকটু হলে সত্যিই মে*রে ফেলতাম। আর সেটাই তোমরা চাও তাইতো?’

থতমত খেয়ে গেল শওকত। কোনমতে নিজেকে সামলে বলল, ‘ তা কেন? আমিতো তোমাকে বলেছিই আমি শুধু সোলার সিস্টেমের ধ্বংস চাই। রুদ্রর কোন ক্ষতি আমি করবনা।’

প্রিয়তার চোখজোড়া লাল হয়ে আছে। ঠোঁটের কম্পন বেড়েছে। কম্পিত কন্ঠেই প্রিয়তা বলল, ‘ তাই? তাহলে কক্সবাজারে ওকে ওভাবে কে মেরেছিল বাবা?’

পরিস্থিতিযে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝে ফেলল শওকত। ঝট করে উঠে দাঁড়াল সে। প্রসঙ্গ বদলে বলল, ‘আমের ভিলায় ফিরে যাচ্ছো তুমি আবার?’

চোখ সরিয়ে নিল প্রিয়তা। পুনরায় বক্সটা তুলে নিয়ে বলল, ‘দুপুরে কথা বলছি এসব নিয়ে।’

মাথা নাড়ল শওকত। হুসাইন আলীর বিষয়টা তখনই বলবে বলে ভেবে নিল। প্রিয়তা আরও বেশি ঘেটে যাওয়ার আগেই চুপচাপ কক্ষ ত্যাগ করল সে। প্রিয়তা তাকিয়েও দেখলনা সেদিকে। চুপচাপ তুলোয় ঔষধ লাগিয়ে ক্ষ*তবি*ক্ষত বাঁ হাতের তালুতে ছোঁয়ালো। জ্বালায় সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ফেলল প্রিয়তা। মানসপটে ভেসে উঠল রুদ্রর হাতের বাহু ছে*দ করে বেরিয়ে যাওয়া গু*লিটা। ব্যথায় কুঁচকে ফেলা রুদ্রর মুখ। চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টি। মনে পড়ল একসময় রুদ্র বলেছিল, ‘প্রিয়র ছোঁয়ায় রুদ্র সব ব্যথা ভুলে যায়।’

ঝট করে চোখ খুলল প্রিয়তা। ঠোঁটদুটো আবার অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে শুরু করল। স্যাভলনের মাঝারি সাইজের শিশিটা তুলে ধরল চোখের সামানে। আচমাই পুরো লিকুইডটা ঢেলে দিল নিজের বাঁ হাতের তালুতে। অবশেষে লালচে দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে নামল প্রিয়তার। ঝরঝর করে নামল।

*

গতরাতে বাড়ি ফেরেনি রুদ্র। প্রিয়তাকে ওখানেই ছেড়ে দিয়ে ফিরে এসেছিল হুসাইন আলীর সেই বাড়িতে। রঞ্জুর কী অবস্থা দেখার দরকার ছিল। তারসঙ্গে নিজের হাতের ফার্স্ট এইডটাও জরুরি ছিল। সকালে জয় ফিরে আসে। রুদ্রকে জানায় সব ঠিক আছে। রুদ্র যেভাবে বলেছিল সেভাবেই সব করেছে জয়। এরপর সারাদিন ভীষণ ব্যস্ততাতেই কেটেছে ওর। কিন্তু শরীর বেশিক্ষণ শায় দিচ্ছিল না। হাতের ব্যথাটা বাড়ছিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। সেকারণেই আজ তাড়াতাড়ি ফিরে আসে রুদ্র। বসার ঘরে তখন জ্যোতি আর উচ্ছ্বাস ছিল। দুজনের চোখ সবার আগে রুদ্রর ব্যান্ডেজ বাঁধা বাহুতেই পড়ে। ব্যপারটা রুদ্রর জন্যে স্বাভাবিক। তাও জ্যোতি আঁতকে উঠে বলে, ‘ এটা কখন হল! আবার কী করে এসেছো?’

উচ্ছ্বাস নিজেও অবাক হয়েছে। তাই ভ্রুকুটি করে বলল, ‘গতকাল আবার কোথাও টার্গেট ছিল নাকি?’

দুজনের প্রশ্ন সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে রুদ্র বলল, ‘ নীরব আর কুহু কোথায়? ঘুমোচ্ছে?’

জ্যোতি জানাল, ‘ হ্যাঁ ঔষধ খেতে হয়তো মেয়েটাকে। তাই দ্রুত শুয়ে পড়ে।’

মাথা নাড়ল রুদ্র। পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই জ্যোতি বলে উঠল, ‘ প্রিয়তা এসেছে।’

থমকে দাঁড়ার রুদ্র। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড বিস্ময় অনুভব করলেও ওদের সামনে স্বাভাবিক করে রাখল নিজেকে। উচ্ছ্বাস বলল, ‘ বকবকি করিস না কিন্তু। তোর হাতে ব্যান্ডেজ দেখে মেয়ে এমনিতেই নাকের জলে চোখের জলে হবে।’

জ্যোতিও বলল, ‘ হ্যাঁ রুদ্র। এখন বলোনা কিছু। ঠিকঠাকভাবে ফিরে এসেছেতো। এবারের মতো বাদ দাও।’

রুদ্র আর দাঁড়াল না। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে সোজা পা বাড়াল নিজের রুমের দিকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কেমন উশখুশ করল ওর ভেতরটা। লম্বা শ্বাস ফেলে ঘরে ঢুকল। রুমে একপলক চোখ বুলিয়ে দেখল, প্রিয়তা নেই। রুদ্র জানে কোথায় আছে। চোয়াল শক্ত করে দৃঢ় পায়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ল রুদ্র। ওর ধারণাই সঠিক প্রমাণিত হল। রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা। পরনে সেই আগের মতো কুর্তি আর স্যালোয়ার। পিছ ছাড়ানো খোলা চুল। বুকের মধ্যে সবকিছু ভেঙ্গেচূড়ে এলো রুদ্রর। একদিন রাগ, ঘৃণা, বিতৃষ্ণায় নিজেকে মুড়িয়ে রাখলেও আজ সব এলোমেলো লাগল।। সমস্ত সত্যিকে অস্বীকার করে মেয়েটাকে আবার আকড়ে ধরতে ইচ্ছে হলো। ভালোবাসতে ইচ্ছে করল। কিন্তু চরম সত্যিকে অস্বীকার করা যায়না। এই মেয়েকে ভালোবাসা মানে নিজের বাবা, সন্তান, বোনের সঙ্গে প্রতারণা করা। যা ও করতে পারবেনা। নিজেকে সংযত করল রুদ্র। এগিয়ে গিয়ে খপ করে ধরল প্রিয়তার হাত। এক ঝটকায় নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল, ‘কেন এসেছো এখানে?’

রুদ্রর চোখের দিকে তাকাল প্রিয়তা। মুচকি হেসে বলল, ‘নিজের স্বামীর বাড়িতে আসব না? কথায় আছেনা, স্বামীর বাড়ি থেকে মেয়েরা একমাত্র খাটিয়াতেই বিদায় হয়।’

রুদ্র দাঁতে দাঁত পিষে বলল, ‘মশকরা করছো?’

‘ নাহ্। সত্যি বলছি।’ প্রিয়তার ঠোঁটে তখনও মুচকি হাসি।

‘ সত্যি বলার অভ্যেস তোমার নেই।’

‘ বলব সত্যি। তার আগে আপনি বলুন এতোবড় সত্যি জেনেও, কেন এখনো কোন ক্ষতি করেননি আমার? বাড়ির কাউকে এখনো অবধি কেন বলেননি আমার সত্যিটা? কেন মে*রে ফেলছেন না এখনো আমাকে?’

প্রিয়তার হাত ছেড়ে দিল রুদ্র। প্রিয়তা আলতো হাতে স্পর্শ করল রুদ্রর হাতের ব্যান্ডেজটা। মুখ এগিয়ে নিয়ে ছোট্ট করে একটা চুমু খেল সেখানে। রুদ্র বাঁধা দিলোনা। তাকিয়ে দেখল কেবল। প্রিয়তা রুদ্রর দিকে তাকাতেই রুদ্র বলল, ‘ প্রিয়র স্পর্শে রুদ্র সব ব্যথা ভুলে যেতো তা ঠিক। কিন্তু রাণী মীর্জার স্পর্শ রুদ্রর সমস্ত ব্যথাকে বাড়িয়ে দেয়। হাজারগুন বাড়িয়ে দেয়।’

প্রিয়তা কোন জবাব দিলোনা। আস্তে করে দূরে সরে এলো খানিকটা। রুদ্র গম্ভীর গলায় বলল, ‘তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার কারণ গতরাতেই বলেছি। আর বাড়ির সকলে এমনিই অনেকটা ট্রমার মধ্যে দিয়ে গেছে। তোমার কুৎসিত সত্যিটা জানিয়ে সেটা এইমুহূর্তে বাড়াতে চাইনা আমি। সময় এলে ওরা সবটাই জানবে।’

প্রিয়তা বলল, ‘ সেটা হলেওতো আমার এবাড়িতে থাকা দরকার। তাইনা?’

মেজাজ খারাপ হল রুদ্রর। একহাতে খপ করে প্রিয়তার গাল চেপে ধরল রুদ্র। অন্যহাতে বাঁ হাতের কবজি। রাগে হিসহিসিয়ে বলল, ‘ ওদের আর কোনরকম ক্ষতি করার চেষ্টাও যদি করো, তোমাকে স*ত্যি স*ত্যিই খুন করব আমি।’

ব্যথায় চোখটা ভিজে এলেও ঠোঁটের মুচকি হাসিটা যেন সরছেই না প্রিয়তার। ও ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ আপনার হাতে খু*ন হতেইতো এসেছি।’

হাত আলগা হল রুদ্রর। অনুভব করল ওর ধরে রাখা হাতটায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। ভেতর থেকে প্রশ্ন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইলেও প্রশ্ন করল না রুদ্র। শুধু তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা চোখে চোখ পড়তেই আবার সবটা গুলিয়ে গেল ওর। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল। ভীষণ অসহায় মনে হল নিজেকে। সবার্ঙ্গে অব্যক্ত এক যন্ত্রণা অস্থির করে তুলল ওকে। ঐ অসম্ভব মায়াবী চোখদুটোর কাছেই রুদ্র বারবার বারবার হেরে যায়। জঘন্যভাবে হেরে যায়। ভেতর ছিটকে আসা আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না রুদ্র। প্রিয়তার দুগালে শক্ত করে নিজের দুহাত রেখে বলল, ‘কেনো করলে এরকম? কেন? বিশ্বাসঘাতকতাকে চিরকাল ঘৃণা করেছি আমি। এই একটা অপরাধের কোন ক্ষমা ছিলোনা আমার কাছে। কিন্তু যাকে আমি আমার সবটা দিয়ে ভালোবেসেছি। আমার অস্তিত্বের সবটুকু যার জন্যে প্রকাশিত হয়। যাকে ছাড়া আমি আমার একটা নিশ্বাসও কল্পণা করতে পারিনা সেই আমার সঙ্গে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছে! এই নিষ্ঠুর সত্যিটা কীকরে মেনে নেব আমি? কীকরে? তোমাকে ক্ষমা করার সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছো তুমি। সব রাস্তা। আর তিনটে মাস আগেও যদি তোমার সত্যি আমার সামনে আসতো আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারতাম। সমস্ত নিয়মকে উপেক্ষা করে হলেও পারতাম। কিন্তু সবটা শেষ করে দিয়েছো তুমি, সবটা। আমার বাবা, বোন। আমি ছোট্ট বাচ্চাটা। পৃথিবীর আলোটাও দেখতে দাওনি তুমি ওকে। শুধুমাত্র আমার সন্তান ছিল বলে! বেঁচে থাকার কোন কারণ অবশিষ্ট রাখোনি আমার জন্যে। আর না তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার কোন কারণ রেখেছো? কেন করলে এসব? কেন?’

চোখে জমা জলগুলো গালগুলো গাল গড়িয়ে নামল প্রিয়তার। তবে ঠোঁটে সেই মুচকি হাসি ধরে রেখেই বলল, ‘আমাকে মা*রতে পারবেন না আপনি রুদ্র। যতক্ষণ না আমি চাইছি, আমাকে আপনি মা*রতে পারবেন না। সে ক্ষমতা আপনার হৃদয়ে নেই। কিন্তু যেদিন আমি চাইব। সেদিন আমি ম*রব। আপনার হাতে। আপনার সমস্ত রাগ, অভিযোগ, অভিমান, আক্রোশের অবসান ঘটিয়ে; সেদিন আমি মুক্ত হব। আর সেদিন আপনার হাতে আমার মৃ*ত্যু কেউ আটকাতে পারবেনা। স্বয়ং আপনিও না। যদি সম্ভব হয়, সেদিন আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। আর নিজের করা সেই প্রতিশ্রুতির রক্ষা করবেন।’

*

বর্তমান ~

বুকের ভেতরে কেমন অস্থির লাগতে শুরু করল তুহিনের। অদ্ভুত এক চাপা যন্ত্রণা চিপে ধরল ভেতরটা। কী নিষ্ঠুর সত্যি! কী নিষ্ঠুর নিয়তি! যারা একে অপরের বুকে লেপ্টে থেকে নিজেদের জীবন পাড় করার স্বপ্ন দেখেছিল, তারা নিজেদের মৃত্যু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল! নিজেদের প্রনয়ের সুন্দরমহলের ধ্বংস কিনা নিজের হাতেই করেছিল! ভাগ্য এতো নির্মম হতে পারে! দুজন একে অপরকে এতোটা ভালোবেসেও নিয়তির বেড়াজালে এভাবে হেরে যেতে পারে!

‘ প্রিয়তাকে নিজের কাছে আটকে কেন রেখেছিলে তুমি? আর রেখেছিলেই যখন, ছেড়েছিলে কেন?’

তমালের প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পায় তুহিন। জবাবের আশায় তাকায় রুদ্রর দিকে। রুদ্র একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে টেবিলের দিকে। জবাব দিচ্ছেনা। তুহিন বলল, ‘এরপর কী প্রিয়তা_’

প্রশ্নটা শেষ করতে পারল না তুহিন। তার আগেই বেজে উঠল ওর সেলফোনটা। ফারিয়ার কল। ভ্রু কোঁচকালো তুহিন। কলটা রিসিভ করে বলল, ‘ হ্যাঁ বলো?’

ওপাশ থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে ফারিয়া জানাল, ‘ স্যার! নাঈম! আপনার গাড়িটা নিয়ে নাঈম বেরিয়েছিল রিপোর্ট আনতে। আসার পথে_’

‘ কম্প্লিট করে ফারিয়া।’

ফারিয়া কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘গাড়িটা ব্ল্যাস্ট করেছে। ভেতরে নাঈম ছিল।’

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here