#প্রেমের_ধাঁরায়
#পর্বঃ১৭
#লেখিকাঃদিশা_মনি
আরশাদ ধৃতির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শোনার জন্য ধৃতির সামনে এসে হাজির হয়েছে। ধৃতির একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে বলল,
“তোমাকে দেয়া সময় তো শেষ, তো এখন তোমার সিদ্ধান্ত কি জানাও আমায়।”
ধৃতি বলে,
“আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না।”
আরশাদ জানত ধৃতির উত্তর এমন কিছুই হবে। তাই সে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। ধৃতির চোখে চোখ রেখে জানতে চায়,
“আমাকে এভাবে বারবার প্রত্যাখ্যান করার কারণটা কি জানতে পারি?”
আরশাদের এই প্রশ্নের উত্তরে ধৃতি বলে,
“কারণ আমি আপনার যোগ্য নই..আমি একজন..”
ধৃতি নিজের বলা কথা শেষ করতে পারে না তার আগেই মালিনী পাটোয়ারী এসে বলেন,
“আমি বলছি সবটা। ফুল তোমার এত স্ট্রেস নিতে হবে না। তুমি নিজের রুমে যাও।”
ধৃতি চোখের অশ্রু লেপন করে নিজের জন্য বরাদ্দ স্টোর রুমটার দিকে পা বাড়ায়। সে চলে যেতেই আরশাদ মালিনী পাটোয়ারীকে জিজ্ঞেস করে,
‘কি কারণে ধৃতি এমন করছে সেটা কি তুমি জানো আম্মু? জানলে আমায় সেটা জানাও।’
মালিনী পাটোয়ারী বলেন,”আমাদের জীবনে মাঝে মাঝে কিছু ধোঁয়াশা থাকে যেটা অনেক বড় ক্ষত সৃষ্টি করে। সেই ক্ষততে আঘাত না দেয়াই ভালো। আর সেজন্য সেই ধোঁয়াশা থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়।”
“মানে?”
“আমি তোমাকে বেশি কিছু বলতে চাই না। শুধু এটুকুই জানাবো যে ফুলের অতীত ভীষণ কষ্টের। অনেক ভয়াবহ যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে ঐ মেয়েটার মাঝে। ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়েটা অথচ তার জীবনটা..যাইহোক…তুমি কি সবটা জানার পরও ফুলকে আপন করে নেবে?”
আরশাদ একদম পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে,
“ধৃতির অতীত কি সেটা আমার কাছে কোন ম্যাটার করে। আমার কাছে ও বর্তমানে যেমনটা আছে সেটাই ম্যাটার করে, এই ধৃতিকে নিয়েই আমি একটা সুন্দর জীবনযাপন করতে চাই।”
মালিনী পাটোয়ারী আরশাদের কথায় ভরসা খুঁজে পান। মনে মনে বলেন,
“আমার আরশাদই তোমার জন্য সেরা ছেলে ফুল। আমি ওর যে পরীক্ষা নিতে চেয়েছিলাম ও সেই পরীক্ষায় জিতে গেছে। এখন আমার মনে আর কোন সংকোচ নেই এই বিয়েটা নিয়ে। এখন শুধু তোমাকে রাজি করাতে পারলেই হলো।”
★★
মালিনী পাটোয়ারী তখন থেকে ধৃতিকে বুঝিয়ে যাচ্ছেন যাতে করে ধৃতি আরশাদকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়। কিন্তু ধৃতি কিছুতেই এই বিয়েতে রাজি হতে পারছে না। যার পেছনে অবশ্য কারণও যথেষ্ট আছে যুক্তিপূর্ণ। প্রথমত, এই বিয়েটা নিয়ে সে নিশ্চিত হতে পারছে না। কারণ আরশাদের সাথে তার তেমন বনিমনা নেই। দ্বিতীয়ত, নিজের ভয়াবহ অতীত। মালিনী পাটোয়ারী যত যাই বলুন না কেন, ধৃতি তো তার অতীতকে লুকিয়ে রেখে এই বিয়েটা করতে পারবে না। তাই সে স্পষ্ট বলে দিল,
“যদি এই বিয়েটা করতেই হয় তাহলে আরশাদ সাহেবকে সমস্ত সত্যটা জানাতে হবে। উনি যদি আমার অতীত জেনেও এই বিয়েতে রাজি হন তাহলেই কেবল আমি বিয়েটা করব নাহলে নয়।”
মালিনী পাটোয়ারী ধৃতির মুখে এই কথা শুনে ভীষণ খুশি মনে বলেন,
“আরশাদকে আমি সবটা বলেছি, ও নিজের মুখেই বলেছে যে তোমার অতীত ওর কাছে ম্যাটার করে না। ও তোমাকে নিয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে চায়।”
মালিনী পাটোয়ারীর কথা কেন যেন ধৃতির শতভাগ বিশ্বাস হয় না। সে কিছু টা দ্বিধা নিয়ে বলে ওঠে,
“আপনি ঠিক বলছেন তো?! আরশাদ সাহেব সবটা জেনে এই কথা বলেছেন? আমাকে যে আরহাম শান্ত…”
মালিনী পাটোয়ারী বলেন,
“ওকে আমি সবটাই বলেছি।”
যদিও এটা ছিল অপূর্ণ সত্য। মালিনী পাটোয়ারী শুধু আরশাদকে ধৃতির অন্ধকার অতীত সম্পর্কে কিছুটা আভাস দিয়েছেন কিন্তু সম্পূর্ণ ঘটনাটা খুলে বলেন নি। তবে তিনি ধরেই নিয়েছেন যেহেতু আরশাদ বলেছে তার কাছে ধৃতির অতীত কোন ম্যাটার করে না তাই এটা নিয়ে পরে আর কোন সমস্যা হবে না। এজন্যই ধৃতিকে আশ্বস্ত করার জন্য তিনি বললেন যে আরশাদ সব জেনেই বিয়েতে মত দিয়েছে।
এদিকে ধৃতি মালিনী পাটোয়ারীর আত্মবিশ্বাস এবং তার খুশিমুখ দেখে ভাবে মালিনী পাটোয়ারী সত্যই বলছে। তবুও তার মনে কেন জানি দ্বন্দ কাজ করছিল। মালিনী পাটোয়ারী এটা বুঝতে পেরে বলেন,
“তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না ফুল?”
ধৃতি জবাবে বলে,
‘না, না এমনটা মোটেই নয়। কিন্তু কি বলুন তো, ঘরপোড়া গরু তো তাই সিঁদূরে মেঘ দেখলেই মনটা কু ডাকে।’
“যদি আরশাদ অতীতের সবটা জেনেও তোমায় বিয়ার করতে চায়, তাহলে নিশ্চয়ই তোমার আপত্তি নেই?”
“না, নেই।”
“বেশ যদি তোমার আমার কথা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে তাহলে তুমি নিজেই আরশাদকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখো যে ও তোমার অতীতটা জেনেও এই বিয়েতে রাজি কিনা।”
ধৃতি কিছু সময় নিয়ে ভেবে দেখল এমনটা করাই ঠিক হবে। যদি ধৃতি এই বিষয়টা নিয়ে একটু খোঁজ লাগায় তাহলে আসল সত্য সামনে আসবে। তখন তার মনের মধ্যে চলা লড়াইটাও থেমে যাবে। এজন্য ধৃতি আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত হেটে আরশাদের রুমের বাইরে আসে। আরশাদ রুমের বাইরের দাঁড়িয়ে ছিল। ধৃতি এসেই আরশাদকে জিজ্ঞেস করে,
“আপনার সাথে কিছু জরুরি কথা ছিল।”
“হুম, বলো।”
“আপনি কি আমার অতীতের সমস্ত কিছু জেনে সজ্ঞানে আমাকে বিয়েটা করতে চান?”
আরশাদ ধীরে ধীরে ধৃতির একদম কাছে চলে এসে ধৃতির কাঁধে হাত রেখে বলে,
“হুম, তোমার অতীতে কি হয়েছে না হয়েছে সেটাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার কাছে শুধু এখনকার তুমিটাই সত্যি।”
আরশাদের এহেন কথায় ধৃতি চূড়ান্ত পর্যায়ের অবাক ও সাথে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে,
“এতটা সুন্দরও হওয়ার ছিল আমার ভাগ্যটা?!”
আরশাদ গম্ভীর খোলস পালটে বেশ সুন্দর একটা হাসি উপহার দিয়ে ধৃতির চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে,
“তোমার চোখে এই জল আর আমি এই দেখতে চাই না। এটা তোমার চোখে শোভা পায়না। তুমি কি একটু হেসে দেখাবে আমায়?”
ধৃতি হাসে, বেশ তৃপ্তিদায়ক হাসি। আরশাদ সেই হাসি দেখে বলে,
“সাচ আ বিউটিফুল স্মাইল।”
বলেই সে ধৃতিকে নিজের অনেক কাছে টেনে নেয় এবং বলে,
‘তাহলে তোমার আর আমাকে বিয়ে করার কোন আপত্তি নেই, তাই তো?’
ধৃতি দুদিকে মাথা দুলিয়ে না-বোধক ইশারা করে। যার অর্থ তার আর এই বিয়েতে কোন আপত্তি নেই। আরশাদ যেন এই মুহুর্তের অপেক্ষাতেই ছিল। ধৃতিকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে বলে,
“ধন্যবাদ তোমায়! অবশেষে তোমার মনের বরফ গলল!”
ধৃতি বলে,
“আপনি যে আমার অতীতের ভয়াবহ সত্যটা জেনেও আমাকে আপন করে নিচ্ছেন এটাই আমার কাছে অনেক।”
দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে মালিনী পাটোয়ারী ভীষণ খুশি হয়ে যান। বলেন,
“যাক আমার বলা অর্ধসত্য এদের দুজনকে তো অন্তত মিলিয়ে দিল।”
আর অন্যদিকে গুলশেনারা বেগম দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে ভীষণ রেগে বলেন,
“আমি বেঁচে থাকতে কিছুতেই কোন ক্লাসলেস মেয়েকে এই বাড়ির বউ হতে দেব না। এর আগে তো ঐ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে নয়নাকে নিজের বাড়ির বউ হতে দেইনি, সেখানে এই চাল-চুলোহীন মেয়েকে হতে দেব..কিছুতেই না। আর এজন্য আমায় যা করতে হয় করব। প্রয়োজনে শত্রুর সাথে হাত মেলাবো তাও এই বিয়েটা আমি হতে দেব না। পাটোয়ারী বাড়ির আভিজাত্য আমি রক্ষা করবোই।”
★★
আরহাম নিজের আলিশান বাড়ির জিমে ব্যায়াম করতে ব্যস্ত ছিল। এমন সময় তার সেক্রেটারি তার জন্য কিছু জরুরি খবর নিয়ে আসে। আরহাম শান্ত ব্যায়াম করতে করতেই বলে,
“কি বলবে বলো.?”
“খবর পেয়েছি আপনার সৎ ভাই আরশাদ বিয়ে করতে চলেছে। তাও তাদের বাড়ির একটা আশ্রিত মেয়েকে..কি যে নাম..উম ধৃতি.. ”
নামটা শুনতেই আরহামের হাত যা ডাম্বেল তুলতে ব্যস্ত ছিল সেটা থেমে যায়। আরহাম হতবাক স্বরে বলে,”কি বললে! ধৃতি!”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨