#প্রেমের_ধাঁরায়
#পর্বঃ৪
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ধৃতি স্টোররুমে প্রবেশ করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। তার জীবনের এক নতুন দিগন্তের সূচনা ঘটলো এখানে। সে মনে করলো আরহাম শান্ত নামক নরপিশাচটার সাথে বাজে, তিক্ত স্মৃতি এবং অন্যদিকে আরশাদ নামক রাগী তবে উদার মানুষটার সাথে দেখা হবার পরের ঘটনা। এসব ঘটনা কি তার জীবনে বড় কোন পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে? এই প্রশ্ন নিজেকে করে কোন উত্তর পায় না সে। এরইমধ্যে মালিনী পাটোয়ারী ধৃতির উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“তোমার কি খিদে পেয়েছে ফুল? কিছু কি খাবে তুমি?”
ধৃতি হালকা হেসে বলে,
“না, আন্টি। আমি কিছু খাবো না।”
মালিনী পাটোয়ারী মুখটা বেজার করে বলেন,
“সেকি কথা! কাল রাত থেকে তো মনে হয় না খেয়ে আছ। মুখটাও তো কেমন শুকিয়ে গেছে। আবার বলছ কিছু খাবে না?”
ধৃতি কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না৷ মালিনী পাটোয়ারী বলেন,
“কোন চিন্তা করো না। তুমি এখানেই থাক। আমি দেখি ফ্রিজে যদি কোন খাবার পাই তো গরম করে নিয়ে আসছি।”
বলেই মালিনী বেগম প্রস্থান করেন। অতঃপর রান্নাঘরে এসে ফ্রিজে গতকালকের কিছু খাবার দেখতে পান এবং সেটাই গরম করে নেন। খাবারগুলো নিয়ে ধৃতির কক্ষের দিকে যেতে গিয়ে হঠাৎ আশরাফ পাটোয়ারীর মুখোমুখি হন। নিজের স্বামীকে বেশ খানিকটা ভয় পান মালিনী পাটোয়ারী। তাই তো আশরাফ পাটোয়ারীকে দেখে তার হাত-পা কাঁপতে শুরু করে।
আশরাফ পাটোয়ারী বলেন,
“এই খাবার কার জন্য নিয়ে যাচ্ছ?”
“ফুলের জন্য?”
“ফুল??”
“আরশাদ যেই মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে।”
“যতসব ঢং। কোথাকার কোন মেয়ে তুলে এনেছে তোমার ছেলে এখন তাকে নিয়ে তোমার এসব আদিখ্যেতা শুরু হয়েছে। এই বাড়িতে একটা বাইরের মেয়েও যা সম্মান পাচ্ছে আমার নিজের ছেলেও..”
বলতে গিয়ে থেমে যান আশরাফ পাটোয়ারী। বুঝতে পারেন ভুল সময় মুখ দিয়ে ভুল কথা বেরিয়ে গেছে। মালিনী পাটোয়ারী বুঝতে পারেন তার স্বামী ঠিক কি বলতে চেয়েছেন। তার বুক হাহাকার করে ওঠে। সারাটা জীবন তো স্বামীর ভালোবাসা পান নি৷ এই শেষ বয়সে স্বামীর সান্নিধ্য পেয়েছেন তাও সম্পূর্ণরূপে নয়। তার স্বামী আজও তার অন্য স্ত্রী এবং তার সন্তানকেই তার এবং আরশাদের থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়। যদিও এতে মালিনী পাটোয়ারীর এখন আর তেমন কিছু যায় আসে না। কিন্তু মনের মাঝে এক লুকানো ব্যাথা থেকেই যায়।
মালিনী পাটোয়ারী আর কোন কথা না বলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। এদিকে আশরাফ পাটোয়ারী বিড়বিড় করে বলেন,
“যতদিন আম্মা বেঁচে আছেন ততদিন আমি হয়তো নিজের ছেলেকে এই বাড়িতে আনতে পারব না। কিন্তু একদিন না একদিন আমি ওকে এই বাড়িতে নিয়ে আসবোই। এটাই আমার প্রতিজ্ঞা।”
★★★
পৃথিবীর বুকে এক নতুন দিনের আগমন। ধৃতির জীবনের অন্ধকার কি মিটবে এই আগমনী প্রভাতে? হয়তো, না।
ধৃতি সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বাইরে এলো। বাইরে এসে দেখল গোটা বাড়ি প্রায় ফাঁকা। শুধু কুলসুম একা হাতে রান্না করছে। ধৃতি এই দৃশ্য দেখে আবারো নিজের রুমের দরজা লাগাতে যাবে এমন সময় তার সামনে এসে দাঁড়ালো এক সুদর্শন ছায়ামূর্তি। ধৃতির মুখ দিয়ে আপনাআপনি বের হয়ে গেল,
“মিস্টার আরশাদ!”
আরশাদ গম্ভীর স্বরে ধৃতিকে বলল,
“আজ দুপুরে তুমি আমার সাথে বের হবে। আর এই নিয়ে আমি আর কোন কথা শুনব না। দুপুর ১২ টার মধ্যে যেন তোমায় একদম পরিপাটি হয়ে রেডি হয়ে থাকতে দেখি। দ্বিতীয় বার যেন এই নিয়ে আর কোন কথা বলা না লাগে।”
বলেই সে স্বভাবসূলত ভঙ্গিতে হেঁটে চলে যায়। ধৃতি আরশাদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে অবাক চোখে। এই লোকটা এত অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড ঘটায় যে কিছু বোঝা যায়না।
দুপুর বেলা,
আরশাদ স্টোররুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ধৃতির অপেক্ষায়। বারবার ঘড়িতে সময় দেখছে। ১২ টা বেজে ৫ মিনিট বেরিয়ে গেছে কিন্তু এখনো ধৃতির বেরোনোর কোন কথা নেই। আরশাদের বিরক্তির মাত্রা ততক্ষণে আরো বাড়ল। সে ভাবল এখন দরজায় নক করবে এমন সময় হঠাৎ করে ধৃতি নিজেই দরজা খুলে বের হলো। আরশাদ রক্তিম চোখে তার দিকে তাকিয়ে। ধৃতি জিভ দিয়ে গলা ভিজিয়ে বলল,
“সরি একটু লেইট…”
আরশাদ জোরে একটা ধমক দিয়ে বলল,
“একটু লেইট? পাক্কা ৫ মিনিট লেইট। কোন সময় জ্ঞান নেই তোমার?”
“সরি..”
“কি বারবার সরি..সরি করছ?”
“আর হবে না।”
“আর হওয়ার চান্সও দেব না। আমার এত বাজে সময় নেই যে তোমার পেছনে নষ্ট করব। আজ নেহাতই কিছু জরুরি দরকার ছিল তাই..নাহলে..যাইহোক, তুমি আর সময় নষ্ট না করে আমার সাথে চলো।”
“কিন্তু আমরা কোথায় যাব?”
আরশাদ আবারও গর্জে উঠে বলে,
“তোমাকে একবার বলেছি না কাউকে কৈফিয়ত দিতে আমি পছন্দ করি না। তবুও কেন বারবার প্রশ্ন করছ?”
“সরি..”
“নো সরি। কিপ কোয়াইট এবং ফলো মি।”
ধৃতি একদম চুপ হয়ে আরশাদের পিছু পিছু যেতে থাকে। এমন সময় আশরাফ পাটোয়ারীর নজরে এসে যায় দুজনে। তিনি এগিয়ে এসে বলেন,
“এই মেয়েটাকে নিয়ে তুমি কোথায় যাচ্ছ আরশাদ?”
আরশাদ বরাবরের মতো গম্ভীর মুখশ্রী করে তাকিয়ে আছে। যা বুঝিয়ে দিচ্ছে সে কাউকে কোন কৈফিয়ত দেয়ার মুখাপেক্ষী নয়। আশরাফ পাটোয়ারীর সামনে থেকেই ধৃতির হাতটা শক্ত করে ধরে বাইরে বেরিয়ে এলো আরশাদ। আশরাফ পাটোয়ারী রাগী চোখে তাকিয়ে রইলেন। বললেন,
“দিন দিন এই ছেলের বেয়াদবির মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এবার আমাকেই কিছু করতে হবে। নাহলে কখনোই একে নিজের কব্জায় আনতে পারব না।”
★★
ধৃতিকে নিয়ে বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে গাড়ি থামালো আরশাদ। ধৃতি অবাক হয়ে বলল,
“আমরা এখানে কেন এসেছি?”
“গান গাইতে এসেছি।”
“কিন্তু এটা তো শপিং মল।”
“তো জানোই যখন শপিং মল তাহলে আবার জিজ্ঞেস করছ কেন? শপিং মলে মানুষ কি করতে আসে জানো না? গবেট কোথাকার।”
ধৃতি মাথা নামিয়ে বলে,
“কিন্তু আমার কাছে তো শপিং করার টাকা নেই!”
আরশাদ এবার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যায়। অতঃপর ধৃতির উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“তুমি চুপচাপ আমার সাথে চলো। যদি আর একটা কথা তোমার মুখ থেকে শুনি তো এখানেই ফেলে রেখে চলে যাব।”
ধৃতি ভয়ে আবারো চুপ হয়ে যায়। আরশাদ ধৃতিকে শপিং মলে নিয়ে গিয়ে তার পছন্দমতো ড্রেস চয়েজ করতে বলে। ধৃতি চুপচাপ নিজের পছন্দমতো কয়েকটা ড্রেস কিনে নেয়। অতঃপর আরশাদ সেসব ড্রেসের বিল মিটিয়ে দিয়ে ধৃতিকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢোকে। অতঃপর ধৃতির উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“কি খাবে তুমি?”
“আপনি যা অর্ডার দেবেন।”
আরশাদ একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজের পছন্দমতো কিছু ওয়েস্টার্ন কাজিনস অর্ডার করে।
★★★
আশরাফ পাটোয়ারী ও গুলশেনারা বেগম দুজনে সোফায় বসে। গুলশেনারা বেগম নিউজ পেপারস পড়ে চলেছেন আর আশরাফ পাটোয়ারী বলে চলেছেন,
“আম্মা, এবার আপনিই কিছু বলুন। আপনার নাতি কিন্তু ঐ মেয়েটাকে নিয়ে এবার বাড়াবাড়ি করছে। আমার কাছে ব্যাপারটা সুবিধার লাগছে না। কিভাবে যে আমার সামনে দিয়ে ঐ মেয়েটার হাত ধরে বেরিয়ে গেল দেখলে আপনি নিজেই বুঝতেন। এখনই এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিৎ। এই মেয়েকে আমার সুবিধার লাগছে না।”
গুলশেনারা বেগম কথাগুলো শোনেন কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া জানান না। এরইমধ্যে আরশাদ ধৃতিকে নিয়ে চলে আসে। তাদের হাতে অনেকগুলো শপিং ব্যাগ। আশরাফ পাটোয়ারী বলেন,
“ঐ যে এসে গেছে আপনার গুণধর নাতি। হাতে আবার শপিং ব্যাগ। নিশ্চয়ই ঐ মেয়েকে নিয়ে শপিং করতে গেছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন?”
গুলশেনারা বেগম আরশাদকে উদ্দ্যেশ্য করে বলেন,
“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে আরশাদ।”
আরশাদ ঘুরে তাকিয়ে বলে,
“জ্বি, বলো।”
“আগামীকাল আমি মিস্টার আশিকুর চৌধুরীকে ডেকে পাঠিয়েছি তোমার এবং আনিকার এনগেজমেন্টের ডেট ফিক্সড করার জন্য। তুমিও উপস্থিত থাকার চেষ্টা করব।”
আরশাদ গম্ভীর এবং ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
“আচ্ছা।”
বলেই ধৃতির হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। ধৃতি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨