অন্তর্নিহিত কালকূট লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল ১০১.

0
57

অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল

১০১.

প্রিয়তার মেসেজটা পড়ে থমকে দাঁড়িয়ে রইল উচ্ছ্বাস। আমের ভিলার হলরুমে তখনও থমথমে নীরবতা। জ্যোতি, নীরব, কুহু, জাফর সবাই চুপ। অস্থিরতায় হাঁসফাঁস করছে। কী বলা উচিৎ , প্রতিক্রিয়া কীভাবে দেবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা ওরা। থমকানো অবস্থাতেই ফোনটা জ্যোতিকে ফিরিয়ে দিল উচ্ছ্বাস। ফোনটা নিয়ে ফ্যাকাশে চোখে তাকাল জ্যোতি। জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল, ‘কী হবে এবার? রুদ্র কোনভাবে টের পেলে রক্ষে থাকবে?’

জাফর গম্ভীর আওয়াজে বলল, ‘ টেরতো পাবেই। সেটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ভয় হল, টের পাওয়ার পর কী হবে সেটা নিয়ে।’

মুখ কালো হয়ে গেল জ্যোতির। হতাশ হয়ে সোফায় বসে পড়ল। উচ্ছ্বাসের মুখভঙ্গি তখনও থমকানো। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল, ‘ কখন পাঠিয়েছে মেসেজটা?’

‘ সন্ধ্যার পর। আমরাতো টেনশনে পরে গিয়েছিলাম স্কুল থেকে তখনও ফিরছেনা বলে। তারপরেই এই মেসেজ।’

‘ কল করেছিলে?’

নীরব জবাব দিল, ‘ আমি করেছিলাম। ভাবি বলল, সে ঠিক আছে। চিন্তা করার কারণ নেই। সময়মতো ফেরত আসবে। বলে কেটে দিয়েছে কলটা। এরপর আর কল করে পাইনি।’

দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল উচ্ছ্বাস। পকেট থেকে ফোনটা বের করে ডায়াল করল প্রিয়তার নাম্বারে। জ্যোতি হতাশা মিশ্রিত কন্ঠে বলল, ‘উফ! এই বর-বউ মিলে কী অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছে এরা নিজেরাও জানেনা। একজন দুবাই গিয়ে বসে আছে। যোগাযোগের কোন উপায় নেই। কী অবস্থায় আছে তাও জানিনা। আরেকজন হুট করে চট্টগ্রাম চলে গেল। প্রিয়তার কান্ডজ্ঞান দেখে আমি অবাক হচ্ছি! বর্তমান পরিস্থিতি এতো ভালোভাবে জানার পরেও এমন হটকারী কাজ কীকরে করল ও? এখন ফিরে আসা অবধি নিঃশ্বাস আটকে বসে থাকতে হবে আমাদের।’

কথাটা বলে মাথাটা হাত দিয়ে চেপে ধরল জ্যোতি। মাইগ্রেনের ব্যথাটা আবার উঠবে বোধহয় আজ। মাথা তুলে আবার বলল, ‘আর রুদ্র এসে কী করবে কল্পণা করতে পারছো? ওর রাগতো জানো। হাত-পা বেঁধে ঘরে ফেলে রাখবে। স্কুলতো দূর চৌকাঠ মারাতে দেবে আর?’

উচ্ছ্বাস তখনও কলে চেষ্টা করছে। এদিকে ক্লান্তিতে শরীর ছেড়ে দিয়েছে কুহু। এসব আর নিচে পারছেনা ও। কত সহ্য করা যায়? নীরব বুঝতে পারল ব্যপারটা। তাই আর থাকল না ওখানে। ওদেরকে বলে কুহুকে নিয়ে চলে গেল ভেতরে। জাফর উঠে দাঁড়াল। উচ্ছ্বাসের কাছে গিয়ে বলল, ‘কল লাগল?’

‘ নট রিচেবল!’ হতাশ গলায় জানাল উচ্ছ্বাস।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল জ্যোতি। বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আর ভালো লাগছেনা আমার এসব। আমি গেলাম।’

উঠে সোজা কিচেনের দিকে পা বাড়াল জ্যোতি। কড়া এককাপ কফি করে রুমে চলে যাবে ও। অসহ্য লাগছে সবকিছু। হলরুমে আরও কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল জাফর। যখন বুঝল কোন লাভ নেই, আস্তে আস্তে সেও ফিরে গেল তার ঘরে।

কিন্তু নড়লনা উচ্ছ্বাস। বরাবরের মতো বিরূপ পরিস্থিতিতে রসিকতাও করল না। প্রিয়তার মেসেজটা পড়ার পর থেকে থমকানো ভাবটা যাচ্ছেনা ওর ভেতর থেকে। সবাই ব্যপারটা যতটা স্বাভাবিকভাবে দেখছে, ততটা স্বাভাবিকভাবে দেখতে পারল না ও। হঠাৎই প্রিয়তা নামক এই রমণীর মধ্যে অস্বাভাবিকতার আভাস টের পেল উচ্ছ্বাস। প্রথমবার! দুবছর যাবত আমের ভিলায় বধুরূপে প্রবেশ করেছে প্রিয়তা। এর আগেতো কখনও এমন ব্যাকুলতা দেখায়নি চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্যে। একবার মুখেও আনেনি ওর সেই অনাথ আশ্রমের নাম। এই দু’বছরে শুধু একবারই গিয়েছিল সেখানে। মীরার মৃত্যুর পর। এরপর আর না। হঠাৎ কেন সেখানে যাওয়ার এতো তাড়া উঠল প্রিয়তার? কাউকে কিছু না জানিয়ে এভাবে চলে গেল। একাকিত্বের কারণে হতে পারেনা। কারণ এর আগেও রুদ্র বাইরে গেছে। দুবাই গেছে, আফ্রিকা গেছে, বিট্রেন গেছে। অনেকদিন থেকেছেও। যতদিন থেকেছে, ততদিন যোগাযোগও করেনি কারো সঙ্গে। তখনওতো প্রিয়তার মনে হয়নি চট্টগ্রাম ঘুরে আসার কথা। তখন পরিস্থিতি আরও অনকূলে ছিল। অথচ গেল এমন সময় যখন ওদের প্রত্যেকের জন্যে প্রতি পদে পদে অপেক্ষা করছে স্বয়ং মৃত্যু! তাও এভাবে!

সন্দেহের এক সুক্ষ্ম বীজ রোপিত হয়ে গেল উচ্ছ্বাসের মনে। প্রিয়তা সেই প্রথম আগমন থেকে বাকিসব যেন দৃশ্যপটরূপে সামনে ধরা দিল। কিছু কিছু অস্বাভাবিকতা যেন স্পষ্টই ভেসে উঠল চোখের সামনে। মনের ভূল কিনা বুঝে উঠতে পারল না উচ্ছ্বাস। এতো এতো দুশ্চিন্তায় হয়তো তাই হবে। প্রিয়তা হয়তো সত্যিই এতোকিছু ভেবে করেনি কাজটা। তাছাড়া আগে ওর মানসিক অবস্থা আর এখনকার মানসিক অবস্থা এক থাকবেনা। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু খচখচানিটা রয়েই গেল মনের এক কোণে। স্বাভাবিক হয়েও যেন কোথাও কিছু একটা স্বাভাবিক না। হাড় হিম করা কিছু একটা যেন লুকিয়ে আছে এসবকিছুর মধ্যে!

*

প্রিয়তার শ্বাসনালী জ্বালাপোড়া করছে। মনে হচ্ছে অক্সিজেনের বদলে কেউ সালফিউরিক এসিড ঢেলে দিচ্ছে ফুসফুসে। বেসমেন্টের সিঁড়ির মাথায় যেন সাক্ষাৎ দাঁড়িয়ে আছে ওর স্বামী। ভালোবেসে আড়ালে যাকে ও শ্যামপুরুষ বলে ডাকে। রুদ্র আমের। এক পা, এক পা করে নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। প্রিয়তার অপূর্ব চোখজোড়ার হিংস্রতা হারিয়ে গেল, তাতে এসে ভর করল আতঙ্ক। অথচ রুদ্রর চোখজোড়া স্থির, দৃষ্টি ধারাল। সেই দৃষ্টির ধারে যেন প্রিয়তার সর্বাঙ্গ ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে, সিঁড়ির প্রতিটা ধাপে যেন পিষে নামছে প্রিয়তার হৃদয়। নিজের দিকে দেখল প্রিয়তা, দেখল পিলারের সঙ্গে বন্ধনরত রাতুলের ক্ষতবিক্ষত লাশ। র*ক্তমাখা পিশাচিনীর থেকে কোনো অংশে কম লাগছেনা ওকে। শরীরের প্রতিটা অঙ্গ জমাট হয়ে উঠল প্রিয়তার। এ কোন রূপে দেখল রুদ্র তাকে? এমনটাতো হওয়ার কথা ছিলোনা? কীভাবে হল?

জুতোর সেই ঠকঠক আওয়াজ প্রচন্ড বেগে আঘাত করছে প্রিয়তার মস্তিষ্কে। সেই হৃদয় বিধ্বংসি আওয়াজ করে প্রিয়তার ঠিক তিন ফিট সামনে এসে দাঁড়াল রুদ্র আমের। নিজের ধারাল দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্যেও সরায়নি প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনীর থেকে। প্রিয়তাও অপলকে তাকিয়ে রইল রুদ্রর চোখে। ওকে এমন ভয়াবহ অবস্থায় দেখে রুদ্রর প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু রুদ্রর চেহারা দেখে কিছু অনুমান করা গেলোনা। কেবল দেখল, খালি হাতটার আঙ্গুলগুলো কাঁপছে রুদ্রর। কাঁপছে দাঁতে চেপে রাখা দাঁতের দুটো পাটি। চোয়াল, গলার পেশিগুলো কেমন ফুলে ফুলে উঠছে। তীক্ষ্ণ চোখজোড়ায় যেন কী অদ্ভুত এক যন্ত্রণা। সে যন্ত্রণার উপলব্ধিতে কলিজা ছিড়ে গেল প্রিয়তার। কিন্তু রুদ্র নিশ্চুপ, শান্ত, স্থির।
প্রিয়তার ওপর দৃষ্টি বজায় রেখেই পিস্তলটা লোড করল ও। দ্বিধাহীন হাতে তাক করল প্রিয়তার ঠিক কপাল বরাবর। চোখভর্তি অবিশ্বাস নিয়ে রুদ্রর দিকে চাইল প্রিয়তা। দম আটকে এলো। জগত থেকে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। মস্তিষ্কে ঝিম ধরা আওয়াজ, আর চারপাশ কেবল ধোঁয়াশা। রুদ্র ওর দিকে অ*স্ত্র তুলল! রুদ্র!

রুদ্রকে ব*ন্দু*ক তাক করতে দেখে বাস্তবে ফিরল জয় আর তনুজা। ওর হঠাৎ আগমনে থমকে গিয়েছিল ওরা। দ্রুত রুদ্রর দিকে নিজেদের পিস্তল তাক করল। হ্যাঁচকা টানে প্রিয়তাকে নিজের দিকে টেনে নিল রুদ্র। উল্টো ঘুরিয়ে প্রিয়তার পিঠ ঠেকিয়ে ধরল নিজের বুকে। হাতটা উল্টো করে মুচড়ে ধরল পেছন দিকে। অপর হাতে এম.টি.নাইনের নলটা ঠেকালো প্রিয়তার গলায়। ভয়ে, উত্তেজনায় ট্রিগার চাপতে উদ্ধত হল তনুজা। সঙ্গে সঙ্গে আগুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল প্রিয়তা। পিস্তল লোড করার শব্দে ঘোর কেটেছে ওর। তনুজার উদ্দেশ্যে ধমকে উঠে বলল, ‘খবরদার!’

তনুজা এবং জয় উভয়ই বিভ্রান্ত হল। প্রিয়তা চোখের ইশারায় সাবধান করল, একটা গু*লিও যেন না বের হয়। হাতের বন্ধন আরও শক্ত করল রুদ্র। ব্যথায় চোখ বুজে করে ফেলল প্রিয়তা। কিন্তু রুদ্র যেন তোয়াক্কাই করল না। শীতল দৃষ্টিতে তাকাল জয় আর তনুজার দিকে। থমথমে গলায় বলল, ‘তিন সেকেন্ড সময় দিচ্ছি। ব*ন্দু*ক ফেলে হাত উঁচু করে দাঁড়াও। নয়তো এরপর কী ঘটবে সেটা মুখে বলবনা আমি।’

তনুজা না জানলেও জয় জানে ফাঁকা হুমকি দেয়না রুদ্র। এ মুহূর্তে রুদ্রর মনস্থিতি বোঝা দুস্কর। আড়াই বছর রুদ্রর সান্নিধ্যে থেকে জেনেছে প্রিয়তার চেয়ে কম হিংস্র নয় রুদ্র। বরং ক্ষেত্রবিশেষে তার হিংস্রতা আরও ভয়ংকর। প্রিয়তার ভালোবাসা যে হিংস্রতায় ভাটা এনেছিল, রাণী মীর্জার বিশ্বাসঘাতকতায় তাতে প্রলয় নিয়ে আসবে। তিন সেকেন্ড পাড় হওয়ার আগেই বন্দুক নিচে ফেলে দিল জয়। হাত উঁচু করে দাঁড়াল। জয়ের কাজে আত্মবিশ্বাস গুড়িয়ে গেল তনুজার। বেস্টবেন্টের সিঁড়ির মাথায় তাকাল। গোডাউনেতো ওদের আরও লোক থাকার কথা। তারা আসছেনা কেন?
ওকে চমকে দিয়ে রুদ্র বলে উঠল, ‘ বেঁচে নেই ওরা কেউ। নামাও!’

শেষ শব্দটা এমনভাবে বলল কেঁপে উঠল তনুজা, হাত ফসকে পড়ে গেল পিস্তলটা। ঠিক সেই মুহূর্তে সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে নেমে এলো পাঁচজন যুবক। ছড়িয়ে গেল দুপাশে। স্তব্ধ বেসমেন্টে প্যারেডের মতো শোনাল তাদের আগমণ ধ্বনি। জয় আর তনুজাকে গা*ন পয়েন্টে রাখল ওরা। তীক্ষ্ম সেই চোখজোড়া জয়ের দিকে নিক্ষেপ করল রুদ্র। বলল, ‘তোমার ম্যাডামের উপযুক্ত শিষ্য তুমি। মানতে বাধ্য হচ্ছি। দুর্দান্ত অভিনয়!’

ইতস্তত করে চোখ নামিয়ে নিল জয়। বোধ হয় রুদ্রর চোখে চোখ রাখার সাহস হলোনা আর। প্রিয়তার গলা থেকে পি*স্ত*ল নামিয়ে অপর হাতটাও পেছনে মুচড়ে ধরল রুদ্র। একহাতে মুষ্ঠিবদ্ধ করল প্রিয়তার দুটো হাত। ইশারা করতেই চারজনের একজন এগিয়ে এলো দ্রুত পায়ে। যে দড়ি দিয়ে রাতুলকে বাঁধা হয়েছিল তার বাকি অংশটুকু পড়ে ছিল ফ্লোরে। সেটা তুলে এগিয়ে দিল রুদ্রর দিকে। দড়িটা নিয়ে প্রিয়তার হাতদুটো পেছন মোড়া অবস্থায় খুব শক্ত করে বাঁধল রুদ্র। শেষ গিটে প্রচণ্ড ব্যথা পেল প্রিয়তা। আবার ঘোর কাটল। আজ যেন বারবার ঘোরে চলে যাচ্ছে ও। বিভ্রান্ত চোখে তাকাল রুদ্রর দিকে। চোখে ছলছল করছে অশ্রুকণা। রুদ্র নির্বিকার। অথচ প্রিয়তার গায়ে ফুলের একটা টোকা অবধি সহ্য করতে পারতোনা রুদ্র। সে আজ ওর দিকে লোড করা ব*ন্দু*ক তাক করেছে! ওকে ব্যথা দিচ্ছে! ওর ব্যথাকে এমনভাবে অবহেলা করছে! দুঃস্বপ্ন! দুঃস্বপ্ন মনে হল সবটা ওর কাছে। ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন। রুদ্র যখন ওর কপালে ব*ন্দু*ক তাক করল, ও নিজেও তাক করতে পারতো ব*ন্দু*ক। বেরেটাটা এখনো গোজা আছে ওর প্যান্টের পেছনে। কিন্তু কার দিকে তাক করবে? যাকে ভালোবেসে নিজের সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করেছে, তার দিকে অ*স্ত্র তাক করার দুঃসাহস হবেনা প্রিয়তার। বাঁধা শেষ হওয়ার ঝাঁকিতে পুনরায় ঘোরমুক্ত হল প্রিয়তা। বহু কষ্টে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘রুদ্র…’

রুদ্র শীতল চোখে তাকাল ওর দিকে। সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে উঠল প্রিয়তার। হাঁটুজোড়া ভীষণ দুর্বল ঠেকল। ঐ দৃষ্টি সব ভ্রম ভাঙিয়ে দিল ওর। ঘোর পুরোপুরি কাটিয়ে দিল। আর সম্ভব না। আর কোন মিথ্যে, কোন অভিনয়, কোন অনুভূতি দিয়েই নিজের বাস্তবতা আড়াল করতে পারবেনা ও। হঠাৎই একটা সাদা কাপড় প্রিয়তার নাকেচেপে ধরল রুদ্র। বিস্ফোরিত চোখে রুদ্রর চোখের দিকে তাকাল প্রিয়তা। রুদ্রর চাহনী স্থির, নিষ্ঠুর, বেপরোয়া। ধীরে ধীরে শরীর ছেড়ে দিল প্রিয়তা। এরপর সব ঝাপসা, অন্ধকার।

দশ মিনিট আগেই জ্ঞান ফিরেছে প্রিয়তার। জলের ঝাপটায় জ্ঞান ফেরায় চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে মাথায়। সম্বিত ফিরে পেতেই চারপাশে চোখ বুলিয়েছে বিভ্রান্ত চোখে। অপরিচিত জায়গা। চারপাশে হলদেটে আলো। বিশাল এক কক্ষের সাদা চারটে দেয়াল। দেয়ালগুলো পুরোনো, ধসা। কোন জানালা নেই। একটাই দরজা সেটা বাইরে থেকে বন্ধ। আরেকটা ছোট দরজা আছে। সম্ভবত বাথরুম।
অতঃপর মানসপটে ভেসে ওঠে আজ রাতে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। তাই ঘটেছে, যা ও কোনদিন চায়নি। রুদ্র! ওর রাণী মীর্জা সত্তাকে পুরোপুরি প্রত্যক্ষ দর্শন করেছে আজ রুদ্র। তারপর? রুদ্র ওর দিকে ব*ন্দু*ক তাক করল, ওকে বাঁধল। ঠিক তারপরে অনেক সাহস, আর শক্তি জুটিয়ে যখন ও রুদ্রকে কিছু বলতে যাচ্ছিল তখনই ওকে কিছু একটা দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলল রুদ্র। এরপর আর কিছু মনে নেই ওর। কতক্ষণ অজ্ঞান ছিল। কতক্ষণ সময় অতিবাহিত হয়েছে। এখন কোথায় আছে, কিছুই জানা নেই ওর। এমনকি সময়টাও অনুমান করা সম্ভব হচ্ছেনা। বাইরের একফোটা আলো ঘরে প্রবেশ করার উপায় নেই।

দেয়াল ঘেষে ফ্লোরে মোটা একটা তোষক বেছানো। সেই তোষকে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে প্রিয়তা। হাটুজোড়া গোটানো। হাতদুটো এখনো পেছনমোড়া করে বাঁধা। চোখ খুলে রুদ্রকে ভালোভাবে দেখতে পায়নি ও। প্রিয়তার মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরায় রুদ্র। ভালোভাবে চোখ খুলতে খুলতেই বেরিয়ে যায়। একবার ফিরেও তাকায়নি। বুকের মধ্যকার যন্ত্রণাটা বেড়ে যায় প্রিয়তার। শরীরে এখনো সেই র*ক্তমাখা টিশার্ট আর জিন্স। গলায়, মুখে শুকিয়ে গেছে র*ক্ত। টান ধরেছে চামড়ায়। শীত করছে। শরীর ভীষণ দুর্বল লাগছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মাথার চিনচিনে ব্যথাটা বাড়ল।
হাটুতে মুখ গুঁজে বসে রইল ও। স্বীকার না করলেও প্রিয়তা জানতো, এই দিনটা একদিন না একদিন আসতোই। শুধু আসন্ন সেই দিনটা পেছানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গিয়েছিল প্রিয়তা। যেকোনমূল্যে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। কোথাও একটা চুখে গিয়েছিল প্রিয়তা। কিন্তু কোথায়? কোথায় হল এতোবড় ভুল?
রুদ্রর আদালতে প্রতারণার শাস্তি জানা আছে প্রিয়তার। সেই একই শাস্তি কী ওর জন্যেও বরাদ্দ? রুদ্র পারবে ওকে ওভাবে আঘাত করতে? তার প্রিয়কে আঘাত করতে? হাত কাঁপবে না? বিশ্বাসঘাতকতদের প্রতি রুদ্রর সেই ঘৃণা কী, প্রিয়র প্রতি তার ভালোবাসার চেয়েও তীব্র?

দরজা খোলার শব্দে চোখ তুলে তাকাল প্রিয়তা। রুদ্র এসেছে। হাতে একটা পানির বোতল। রুদ্রর চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে ফেলল প্রিয়তা। যে পুরুষের দিকে তাকালে মুগ্ধতায় প্রিয়তার চোখ আটকে যায়। সে পুরুষের দিকে তাকিয়ে থাকার জোর পেলোনা আজ। পায়ের আওয়াজে বুঝল রুদ্র ওর দিকেই আসছে। নিঃশ্বাস আবার ভারী হতে শুরু করল প্রিয়তার। শরীর কাঁপছে।

রুদ্র হাঁটু ভেঙ্গে বসল প্রিয়তার সামনে। অপলকে তাকিয়ে রইল শুকনো র*ক্তমাখা মুখটার দিকে। যে মুখে রুদ্র শুধুমাত্র মায়া দেখেছিল। সে মুখে আজ কী দেখেছে ব্যাখা করার মতো ভাষা জানা নেই রুদ্রর। জীবনে অসংখ্য মানুষকে হাড় হিম করা যন্ত্রণার মৃ*ত্যু দিয়েছে রুদ্র। কিন্তু যেই চোখের মায়ায় নিজেকে উজার করেছিল, সেই চোখেই নিজের ধ্বংস দেখতে পাওয়ার যন্ত্রণা সেসকল মৃত্যু যন্ত্রণাকে একসঙ্গে জুড়ে দিলেও একপাল্লায় আনা যাবেনা। সেই বিধ্বংসি মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকেই পানির বোতলটা খুলল রুদ্র। এগিয়ে ধরল প্রিয়তার মুখের সামনে।
প্রিয়তা চোখ তুলে তাকাল রুদ্রর দিকে। চোখে প্রশ্ন। সামান্য ব্যঙ্গাত্মক হাসি ফুটল রুদ্রর নিষ্ঠুর ঠোঁটের কোণে। বলল, ‘বিষ নেই। আমি তুমি নই।’

প্রিয়তা মুখ এগিয়ে পানি খেল বেশ খানিকটা। তেষ্টা পেয়েছিল খুব। বোতলের ছিপি লাগাতে লাগাতে পুনরায় প্রিয়তার দিকে তাকাল রুদ্র। মৃদু, থমথমে গলায় বলল, ‘আমাদের বিয়ের আগে তুমি একটা কথা বলেছিলে। মনে আছে? “ভালোবাসাহীন সম্পর্ক হয়, কিন্তু বিশ্বাসবিহীন সম্পর্ক তাসের ঘরের চেয়েও দুর্বল।” আমাদের এই তাসের ঘর একটু বেশিই লম্বা সময় টিকে গেল। কী বলো?’

‘ আগেই জেনেছিলেন। তাইনা?’

‘ জেনেছিলাম।’

‘ কবে?’

‘ সেটা কী আদোও কোন গুরুত্ব রাখে?’

‘ দুবাই যাননি তাহলে?’

‘ গিয়েছিলাম।’

‘ ফিরলেন কবে?’

‘ গতকাল।’

চমকে ওঠে প্রিয়তা, ‘ অথচ জানাননি আপনি আমাকে!’

পুনরায় সেই ব্যঙ্গাত্মক হাসল রুদ্র। বলল, ‘ জানালে আজ, আমার সামনে এভাবে থাকতে তুমি?’

চোখ নামিয়ে ফেলল প্রিয়তা। এর উত্তর জানা নেই ওর। রুদ্র নেই বলেইতো অসম্পূর্ণ কাজটা সম্পূর্ণ করতে গিয়েছিল ও। কিন্তু চালে ভুল হয়ে গেছে তার অনেক আগে। ফোন বেজে উঠল রুদ্রর। প্রিয়তা স্ক্রিনে নামটা দেখার আগেই রিসিভ করে কানে তুলে ফেলল রুদ্র। প্রিয়তার দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল, ‘বল।’

ওপাশ থেকে কিছু বলল। যার উত্তরে রুদ্র বলল, ‘ আমি এখানো অনেকটা সময় থাকব এখানে। গেলে এখনই যা। একেবারে বেশি করে নিয়ে আসবি। দুদিনের মধ্যে যাতে যেতে না হয়। পেট্রোল পাম্প এখান থেকে বেশ দূরে। জেনার‍েটর এক মিনিটের জন্যেও যেন বন্ধ না হয়।– তাড়াতাড়ি ফিরবি। ব্রেকফাস্ট টাইমের আগে। ঐসময় বেরিয়ে যাব আমি।’

প্রিয়তা ভ্রুকুটি করল। কার সঙ্গে কথা বলছে রুদ্র? রুদ্র ছাড়া কে আছে এখানে আর? এখানে সবকিছু জেনারেটরে চলছে? কোথায় রেখেছে রুদ্র ওকে? আর রুদ্রর ওকে এখানে আনার পেছনে কী কারণ? প্রিয়তা ঘোরের মধ্যেই প্রশ্ন করল, ‘ জয় আর তনুজা কোথায়?’

‘ মা*রিনি। তোমার সঙ্গীদের জানা উচিত যে তাদের তুরুফের তাস এখন আমার হাতে।’

চোখ নামিয়ে নিল প্রিয়তা। ওর সত্যিটা জানে রুদ্র। কিন্তু কতটা জানে? সবটাই? নাকি আংশিক? ও চোখ নামিয়ে রেখেই আবার বলল, ‘ সময় কতো?’

‘ ভোর হচ্ছে।’

‘ কোথায় আছি?’

‘ সেটা বলার হলে অজ্ঞান করতাম না। তোমাকে তুলে আনার মতো গায়ের জোর আছে আমার। মন দুর্বল হয়েছিল, শরীর না।’

রুদ্রর মুখের দিকে তাকাল প্রিয়তা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘তো এবার? খু*ন করবেন আমায়?’

জবাব দিলোনা রুদ্র। পানির বোতলটা রেখে দিল সাইডে। নিজের এম.টি.নাইন পিস্তলটা হাতে নিল আবার। ওটার দিকে তাকিয়ে রইল প্রিয়তা। অ*স্ত্রটা প্রিয়তার থুতনির ঠিক নিচে ধরে বলল, ‘ হাত খুলে দেব এখন। শাওয়ার নিয়ে ক্লিন হয়ে এসো। আর হ্যাঁ, কোনরকম চালাকি করার চেষ্টা করোনা। এখনই চাইছিনা। তবে প্রয়োজনে তোমার বুকে গু*লি চালাতে আমার হাত কাঁপবে না।’

প্রিয়তা বুকে যেন কেউ ছু*রি চালাল। রুদ্রর এতো নির্দ্বিধায়, শান্ত গলায় বলা কথাটা গলা চেপে ধরল ওর। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। রুদ্র বলল, ‘কাজটা আমিই করতে পারতাম। কিন্তু তোমাকে ছুঁতে এখন আমার ঘেন্না করবে।’

প্রিয়তার শরীরটা শক্ত হয়ে জমে গেল। রুদ্র হাঁটুতে ভর দিয়ে এগিয়ে এসে খুলতে শুরু করল প্রিয়তার হাতের বাঁধন। সেই ফাঁকে একদৃষ্টিতে নিজের প্রাণপ্রিয় স্বামীকে দেখে গেল প্রিয়তা। আজকের রুদ্রকে চিনতে পারছেনা ও। রুদ্রর মুখের ভাষা, চোখের ভাষা সব গুলিয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। বাঁধন খুলে প্রিয়তাকে সোজা করে দাঁড় করাল রুদ্র। প্রিয়তা কেঁপে ওঠা গলায় বলল, ‘কথাগুলো বলতে পারলেন আপনি?’

চোখ সরিয়ে নিল রুদ্র। নিরুত্তর। প্রিয়তা রুদ্রর হাত ধরল। অনুনয়ের সুরে বলল, ‘ভুলে যাননা সব। আমি প্রিয়। আপনারই প্রিয়। তাকিয়ে দেখুন একবার। ‘

রুদ্র তাকাল। পা থেকে মাথা অবধি একবার দেখল প্রিয়তাকে। তাচ্ছিল্য করে হাসল কেবল। চোখ থেকে জল গড়িয়ে নামল প্রিয়তার। রুদ্র হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘ ওয়াশরুমে পোশাক রাখা আছে তোমার।’

‘ তারমানে সবটা পরিকল্পনা করাই ছিল?’ অবাক হল প্রিয়তা।

‘ কেন? পরিকল্পনা কেবল তুমিই করতে পারো?’

রুদ্রর ধারাল জবাবের উত্তর নেই প্রিয়তার কাছে। তাই চুপ থাকল। রুদ্র বলল, ‘তোমার বেরেটা আমার কাছে আছে। তোমার কাছে রাখার রিস্কটা নিতে পারিনি।’

প্রিয়তা সপ্রশ্ন চোখে তাকাল আবার। কাঠকাঠ গলায় রুদ্র বলল, ‘তোমাকেতো আবার ভরসা নেই। নিজের সন্তানকে যে চিবিয়ে খেতে পারে, তার কাছে আমিতো দুধভাত!’

চকিতে চাইল প্রিয়তা। আজ রুদ্র কথা বলছেনা। একের পর এক বিষাক্ত ছু*রি চালাচ্ছে প্রিয়তার বুকে। ভেতর থেকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলছে । আঘাতটা সামলে ওঠার সময় দিলোনা রুদ্র ওকে। নিষ্ঠুর গলায় বলল, ‘দাঁড়িয়ে না থেকে, যাও!’

প্রিয়তা স্থির দাঁড়িয়ে রইল। কিছু বলতে চাইল কিন্তু পারল না। মনে হল গলাটা কেউ শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে।

‘ যাও!’

ধমকে উঠল রুদ্র। প্রিয়তা তাকিয়ে দেখল রুদ্রর নিষ্ঠুর রূপ। বিগত দুটো বছর এই দিনটার ভয়ইতো পাচ্ছিল প্রিয়তা। এই দিনটাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে প্রাণপণ করে দিয়েছিল। তাই তাই করেছিল যা আবশ্যক। কিন্তু কী লাভ হল? ভাগ্য আজ ওকে সেখানেই দাঁড় করাল। দুবছর যাবত সাজানো পরিকল্পনা সব একরাতের ঝড়ে এলোমেলো হয়ে গেল। মীরা বলেছিল, অন্ধকারময় রাত যত দীর্ঘই হোক, সূর্যকে আড়াল করতে পারেনা। সময় এলে তার উদয় নিশ্চিত। প্রিয়তার সব বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা, ছলনার রাতকে কাটিয়ে দিয়েই যেন আজ রুদ্র নামক সূর্যের উদয় ঘটেছে।

#চলবে…

[ রি-চেইক করিনি। টাইপিং মিস্টেক থাকতে পারে। একটু বুঝে নেবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here