অন্তর্নিহিত কালকূট
লেখনীতে: অনিমা কোতয়াল
১০৪ (বর্ধিতাংশ)
–
চোখেমুখে গরম পানি পড়তেই ঝাঁকি খেয়ে নড়ে ওঠে জয়। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। ঝাঁপসা লাগে সামনেটা। নড়তে গিয়ে টের পায় আটকে রাখা হয়েছে ওর হাত-পা। সঙ্গে ব্যথায় টনটন করে ওঠে মাথাটা। পিটপিটে দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে দেখে এক মানব অবয়ব বসে আছে ওর ঠিক সামনে। অস্পষ্ট। দু’বার মাথা ঝাঁকিয়ে দৃষ্টি পরিষ্কার করে নেয় জয়। দৃষ্টি স্পষ্ট হতেই চমকে ওঠে ও। ওর ঠিক সামনে কাঠের একটা চেয়ারে পায়ে পা তুলে বসে আছে রুদ্র আমের। হাতে এম.টি.নাইন। চোখদুটো কেমন লালচে হয়ে আছে। সারা শরীর জমে গেল একপ্রকার। এই একটা দৃশ্যটাই জয়ে হৃদপিণ্ডে হাতুরির আঘাত করার জন্যে যথেষ্ট।
জয়ের যতদূর মনে আছে, সন্ধ্যায় মারা গেছে ইকবাল। মারা গেছে বলতে খুন করেছে রাণী ম্যাডাম। সেদিনকার সব কাজ শেষ করে নিজের জন্য বরাদ্দ ফ্ল্যাটে ফিরেছিল ও। খুব বেশি রাত হয়নি তখনও। অন্ধকার ফ্ল্যাটে লাইট জ্বালাতেই নিচ্ছিল তখনই কেউ সজোরে আঘাত করে মাথায়। তীব্র যন্ত্রণায় অন্ধকারকেও আরও বেশি গাঢ় মনে হয় জয়ের। ঝিঁ ঝিঁ করে ওঠে ভেতরটা। এরপর? এরপর আর কিছু মনে নেই। নিজের দিকে তাকাল জয়। দুটো হাত টেবিলের ওপর টানটান করে শক্তিশালী টেপ দিয়ে আটকে রাখা হয়ে। পা সহ গোটা শরীর চেয়ারের সঙ্গে। শুকনো গলায় একটা ঢোক গিলে রুদ্রর দিকে তাকায় জয়। মাথার ব্যথাটা এখনো ভোগাচ্ছে। রুদ্র শীতল চোখে দেখছে ওকে। কিছু বলছে না।
জয় বুদ্ধিমান, চতুর। সেকারণে শুরু থেকেই প্রিয়তার খুব পছন্দের ছিল ও। নিজের ডান হাত হিসেবে জয়কে রাখার মূল কারণই ছিল জয়ের বুদ্ধি, সাহস আর পরিস্থিতি সামলানোর দারুণ দক্ষতা। সুতরাং কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি বুঝে ফেলে ও। ওকে রুদ্র এখানে তুলে নিয়ে এসেছে। এভাবে! যার অর্থ সত্যি জেনে গেছে রুদ্র। সেটা যেভাবেই হোক। এবং ওকে না খু*ন না করে এভাবে ধরে নিয়ে আসার কারণও স্পষ্ট। কিছু জানতে চায় রুদ্র। কিন্তু কী?
‘ কেমন লাগছে?’
রুদ্রর শীতল গলায় করা প্রশ্নটায় চমকে ওঠে জয়। বিভ্রান্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকে কেবল। মুচকি একটু হাসে রুদ্র। হাতে রাখা এম.টি.নাইন টা নাড়াতে নাড়াতে বলে, ‘ কী নামে ডাকব তোকে? রাজু? নাকি_ জয়!’
ঘনঘন দুটো শ্বাস ফেলে জয়। ওর ধারণাই সত্যি। সোজা হয়ে বসে রুদ্র। টেবিলের ওপর দু হাত রেখে বলে, ‘তোর প্রশংসা না করে সত্যিই পারছিনা। সোলার সিস্টেমে সবচেয়ে দীর্ঘসময় টিকে যাওয়া বিশ্বাসঘাতক তুই। এতো দীর্ঘদিন তোর ম্যাডামও টেকিনি। কনগ্রাচুলেশনস্। রেকর্ড করেছিস!’
মাথায় এখনো যন্ত্রণা হচ্ছে। কিন্তু তবুও শান্ত থাকে জয়। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবল। চোখে প্রশংসা ফুটে ওঠে রুদ্রর। সামান্য মাথা দুলিয়ে বলে, ‘ অতীতে তোর সাঙ্গপাঙ্গ যারা ছিল তারা ধরা পড়ার পর আমার হাতে-পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেছে। তপু যদিও পাল্টা আঘাত করেছিল। তবে সেটা সাহস দেখিয়ে নয়, প্যানিক করে। এমনকি ওদের সবার মরার খবর পেয়েও পালাসনি! সেক্ষেত্রে তুই ব্যতিক্রম। বোঝা যাচ্ছে, কেন আড়াইটা বছর টিকে ছিলি।’
‘আমি জানতাম আপনি একদিন সবটা জেনে যাবেন।’
‘তবুও ভয় হয় একবারও?’ রুদ্রর কন্ঠে চাপা ক্রোধ। পারলে এক্ষুনি খু*ন করে জয়কে। ‘বেশ, সাহস আছে। যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা ঠিক কতটা সেটাও পরীক্ষা করি।’
বলেই টেবিলের জিনিসপত্রের দিকে তাকায়। রুদ্রর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকায় জয় নিজেও। কতগুলো পেরেক রাখা আছে, সঙ্গে একটু হাতুরি। রুদ্র বলে, ‘ তোকে এখানে এনেছি একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে। টানা আড়াইবছর যে এমন সাহসিকতার পরিচয় দিল তার সহ্য ক্ষমতা পরীক্ষা করব আজ। কয়েকটা প্রশ্ন করব আমি তোকে। আর সেই প্রশ্নের উত্তর যদি আমার মনমতো না হয় তবে এই টেবিলের ওপর রাখা তোর হাত দুটোতে একটা একটা করে পেরেগ বসাব আমি। খুব সময় নিয়ে, যত্ন করে। এরপর হাঁটুতে গু*লি করে একটা একটা করে পা অকেজো করব। এরপরেও যদি কাজ না হয়। তাহলে তোর আর এই ধরণীতে কোন কাজ নেই বৎস। ওপারে পাঠানোর ব্যস্ততা আমার বু*লে*টই করে দেবে। আরেকটা কথা। আমি সবটাই জানি। শুধু কিছু জিনিসটি একটু বিরিফলি শোনার আছে। সুতরাং, চালাকি করলেও লাভ হবেনা।’
বলেই টেবিল থেকে একটা পেরেগ হাতে তুলে নেয় রুদ্র। অপর হাতে নেয় হাতুরি। ভেতরে ভেতরে হৃদপিণ্ড অস্বাভাবিক গতিতে লাফাচ্ছিল জয়ের। ভয়ে টিপটিপ করছিল ভেতরটা। কিন্তু অদ্ভুত এক আনন্দও হচ্ছিল। এই দিনটার অপেক্ষাইতো করছিল ও। জয় ক্লান্ত গলায় বলে, ‘ যদি বলি এসবের কোন দরকার নেই। আমি নিজেই বলব সবটা?’
ব্যঙ্গাত্মক হাসি দেয় রুদ্র, ‘ এতো তাড়াতাড়ি ভয় পেয়ে গেলি?’
‘ একটুতো পেয়েছিই স্যার। তবে ভয়ের সঙ্গে খুশিও হয়েছি। দেড় বছর যাবত এই দিনটার জন্যে অপেক্ষা করছি আমি। তাই আজ আমি বলব সব।’
‘ আর সেগুলো যে সব সত্যি হবে, সেটা কেন বিশ্বাস করব আমি? যে নিজের মালকিনের বিশ্বাস ভাঙতে পারে। সে আমার বিশ্বাস ভাঙবেনা সেটা বিশ্বাস করব কীকরে?’
ঠোঁটে নিষ্প্রাণ এক হাসি ফোটে জয়ের। বলে, ‘ বিশ্বাস জিনিসটা এই মুহূর্তে আপনি আর কাউকে করতে পারবেন না। সেটা আমি জানি স্যার। তবে একটা গল্প শোনাব। সেটা শুনলে আপনি বুঝে যাবেন আমি মিথ্যে বলছিনা।’
নির্বিকারছন্দে হাতুরি আর পেরেগটা নিচে নামিয়ে রাখে রুদ্র, ‘বেশ। শোনা তোর গল্প।’
এরপর জয় যা বলে তা কয়েক মুহূর্তের জন্যে হলেও স্তব্ধ করে দেয় রুদ্রকে। বিস্ময় আর অবিশ্বাসের স্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠে চোখেমুখে। একটা মেয়ে এতোটা নিকৃষ্ট হয় কীকরে! সেই মেয়েটাকে কি-না ও ভালোবেসেছে! চারপাশটা কেমন গুলিয়ে ওঠে রুদ্রর।
নিচের দিকে তাকিয়েই বলছিল জয়। কিন্তু কথা শেষ হতেই জলভর্তি চোখে তাকায় রুদ্রর দিকে। সঙ্গে সঙ্গে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে নামে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে নিজেকে। ভাঙা গলায় বলে, ‘ বিশ্বাস হচ্ছেনা স্যার? যাকে এতোটা ভালোবাসেন তার এমন ঘৃণ্য রূপ মানতে পারছেন না তাইনা?’
চোখ সরিয়ে নেয় রুদ্র। গভীর এক শ্বাস নেয়। সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হয়ে ওঠে ওর চোয়াল। কঠোর হয়ে ওঠে দৃষ্টি। গালের পেশিগুলো কেঁপে ওঠে পরপর দুবার। কঠিন দৃষ্টিতেই জয়ের দিকে তাকায় রুদ্র, ‘ যদি এতোটাই ঘৃণা করো তোমার ম্যাডামকে। তাহলে এই দেড়বছর তাকে সার্ভিস দিয়েছো কেন? আর আমার কাছে এসে কেন বলে দাওনি সবটা?’
জয় বিষাদ মাখানো হাসি দিয়ে বলে, ‘ ডার্ক নাইট ছাড়লে নিজের প্রাণ দিয়ে ছাড়তে হয়। সেটাতো আপনার জানাই আছে। আর আপনাকে বললে আপনি বিশ্বাস করতেন না। ম্যাডামের ব্যপারেতো একদমই না। প্রমাণ চাইতেন। আর সেই প্রমাণ জোগাড়ের বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলেও জেনে যেতেন ম্যাডাম। ফলাফল সেই একই হতো। মৃত্যু।’
থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকে রুদ্র। ঝট করেই নিজেকে সামলে ফেলে বলে, ‘ তুমি সোলার সিস্টেমে জয়েন করেছিলে আড়াই বছর আগে। স্বপন, তপু, সবুজ, খোকন সবাই ধরা পড়েছে, তুমি বাদে। কীকরে? টেকনিক টা কী ছিল?’
‘ কিছুই না করা। ম্যাডাম এমনটাই পরিকল্পনা সাজিয়েছিল। দলের হয়ে কিছু করবনা আমি। আর যদি কিছু না-ই করি তো ধরা পরার কোন কারণও থাকবেনা। আমাকে স্টকে রেখেছিলেন ম্যাডাম। শেষ মুহূর্তে কাজে লাগানোর জন্যে। যেমনটা আপনি দেখেছেন।’
ছোট্ট করে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় রুদ্র। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যায় সেই হাসি। পুনারায় শক্ত হয়ে ওঠে চোয়াল। কঠিন হয় দৃষ্টি। টেবিলে দুহাত রেখে ঝুঁকে গিয়ে বলে, ‘বাবাকে কে বিষ দিয়েছে?’
‘ ম্যাডাম নিজে।’
‘ সম্ভব না। ঐদিন রাত থেকে সকাল অবধি আমার বুকে শুয়ে ছিল ও। এক মিনিট কেন এক সেকেন্ডের জন্যেও কোথাও যায়নি।’
ঠোঁট বাঁকিয়ে সামান্য একটু হাসে জয়, ‘ঠিক! কিন্তু রাশেদ বাবা সুগার ফ্রি খেতেন।’
বিস্ফোরিত চোখে জয়ের দিকে তাকায় রুদ্র। জয় বলে, ‘ হ্যাঁ। আগেরদিন রাতে সুগারফ্রির সঙ্গে বিষ মিশিয়ে রেখেছিলেন ম্যাডাম। উনি জানতেন সকালে চা করা হবে রাশেদ বাবার জন্যে। আর সুগার ফ্রি এই আমের ভিলায় একমাত্র রাশেদ বাবাই সুগার ফ্রি খেতেন। পরে আপনি টেস্ট করিয়ে কিছু পাননি কারণ তার আগেই ম্যাডাম ওটা সরিয়ে অন্য একটা টিউব সেখানে রেখে দিয়েছিলেন।’
অজান্তেই কখন যেন হাত মুঠো হয়ে গেছে রুদ্রর। দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে রাশেদ আমেরের সেই তেজস্বী মুখটা। একটা ঢোক গিলে রুদ্র বলে, ‘কক্সবাজার যাওয়ার পর যা হয়েছিল সে সবই ওর প্লান ছিল?’
‘ হ্যাঁ।’
মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় রুদ্র। তারমানে ওকেও মা*রতে চেয়েছিল প্রিয়তা! ওর নিষ্পাপ বোনটার সাথে_’ সর্বাঙ্গ জ্বলে ওঠে রুদ্রর। বহু কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে, ‘ রাতুলকে ওকে সিঁড়ি থেকে ধাক্কা দেওয়ার অর্ডার কে দিয়েছিল? ও নিজে?’
‘ না। সম্রাট তাজওয়ার। তবে ম্যাডামকে না বলে উনি কোন সিদ্ধান্ত সাধারণত নেননা।’
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে রুদ্র। সম্রাট! নিজের প্রেমিকা আর হবু বউয়ের গর্ভে অন্যকারো সন্তান সহ্য হয়নি বা*স্টার্ডটার! রাগে ভেতর ভেতর কেঁপে কেঁপে উঠছিল রুদ্র। এমন সময় জয় বলে, ‘ ম্যাডামের বিষয়ে আরও একটা কথা আপনি জানেন না স্যার। যদিও সেটা আপনার জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। কিন্তু হ্যাঁ, ওনার চরিত্র সম্পর্কে খুব ভালোভাবে ধারণা হয়ে যাবে আপনার।’
ভ্রুকুটি করে রুদ্র, ‘ কী সেটা?’
‘ নিজের মাকে খু*ন করেছেন উনি। তাও ষোল বছর বয়সে!’
বাক্যদুটো ভয়ংকর বজ্রপাতের মতো ধাক্কা দেয় রুদ্রর কানে। এতক্ষণ যা যা শুনেছে তাতে আহামরি চমকায়নি ও। কারণ অনেককিছুই সে আগেই মোটামুটি জানতো। কিন্তু এই কথাটা ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেয় রুদ্রকে। রুদ্রকে চমকাতে দেখে জয় বলে, ‘ আর এই কথাটা ম্যাডাম নিজে বলেছিলেন আমাকে। ব্রিটেনে থাকতে, ড্রাংক অবস্থায়। মিথ্যে হওয়ার কোন সুযোগ নেই। আর এতোটাই নৃশংসভাবে মে*রেছে শুনলেও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে। শুধু এইটুকু বলতে পারি, শরীরের একটা অঙ্গও অক্ষত ছিলোনা তার।’
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে রুদ্র। শওকত মীর্জার বউ অন্য পুরুষের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিল। এমনটাই জানতো রুদ্র। কিন্তু পালিয়ে গেলে কেউ এভাবে হাওয়া হয়ে যায় কীকরে সেটাই বুঝতে পারতো না। সেদিন বুঝতে পারল। কিন্তু এর পেছনের অন্তর্নিহিত ঘটনাটাযে এতোটা ভয়ংকর সেটা জানতোনা। মুখের সামনে ভেসে ওঠে প্রিয়তার নিষ্পাপ, মায়াবী মুখটা। যে মায়ায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছিল রুদ্র। অথচ সেই মুখের পেছনে এতোটা হিংস্রতা লুকিয়ে আছে! ও ভেবেছিল এতোটা হিংস্র প্রিয়তা কীকরে হলো ওর পরিবারের প্রতি, ওর প্রতি। যারা ওকে এতো ভালোবাসা দিয়েছে তাদের এতোবড় ক্ষতি করল কীকরে! রুদ্র কিংবা রাশেদের কথা যদি বাদও দেয়। কুহু? ওই মেয়েটার জন্যে একটুও মায়া হলোনা ওর! কিন্তু সে মুহূর্তে আয অবাক হয়নি রুদ্র। নিজের জন্মদাত্রী মাকে যে শেষ করতে পারে, সে সব পারে!
অথচ কী নিঁখুত মিথ্যে বলেছিল প্রিয়তা ওকে। ওর নাম, পরিচয় সবটাই ছিল মিথ্যে দিয়ে ঘেরা! নিজেকে এতিম দাবি করেছিল। মাকে হারানোর যন্ত্রণার কথা বলেছিল। নিজেকে যতটা অসহায়, নিষ্পাপ দেখানো সম্ভব দেখিয়েছে সে। আর রুদ্রও বোকার মতো বিশ্বাস করেছে সব। সবহারা মেয়েটাকে সবকিছু দিয়ে আগলাতে চেয়েছিল ও। কিন্তু সবটাই ছিল ছলনা! প্রতারণা! সেই মিথ্যে, ছলনা, প্রতারণার খেলা টানা দুটো বছর! সারা শরীর গরম হয়ে ওঠে রুদ্রর। বুকটা অসম্ভব ভারী মনে হয়। প্রচণ্ড ঘৃণায় ভেতরসহ কেঁপে ওঠে ওর।
জয় বলে, ‘ ম্যাডাম কোন সাইকোর চেয়ে কম না স্যার। র*ক্তের পিপাসা উঠলে পাগল হয়ে যায় সে। তখন শুধু খু*ন করার বাহানা খোঁজে। ঐ মুহূর্তে একমাত্র রক্ত দেখলেই শান্ত হন উনি।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুদ্র। এ বিষয়ে আর কিছু শুনতে চাইছিলনা ও। সবচেয়ে বড় কথা মেনে নিতে পারছিলনা। ভেতরটা ঝলসে যাচ্ছে জয়ের একেকটা কথায়।
‘ আপনি হয়তো এখন আমাকে মেরে ফেলবেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন এখন আমার মরলেও আর কোন আফসোস নেই। যে কারণে এতোদিন বেঁচে ছিলাম তা আজ পূরণ হয়েছে। জীবন থেকে আর কিছু চাওয়ার বা পাওয়ার নেই আমার।’
জয়ের দিকে স্থির চোখে তাকায় রুদ্র। থমথমে গলায় বলে, ‘কেউ নিজে মরতে চাইলে তাকে মারতে ইচ্ছা করেনা আমার। তোমাকে মারবনা আমি আজকে। কিন্তু আমার কথামতো কিছু কাজ করতে হবে তোমাকে। ঠিক আমি যা, যা বলব তাই। তবে মনে রেখো, তোমার প্রতিটা পদক্ষেপের ওপর নজর থাকবে আমার। সামান্যতম চালাকি করলে সেদিনটাই তোমার শেষ দিন হবে।’
–
থেমে গেল জয়। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে দেখল অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। চোখেমুখে অন্যমনস্ক একটা ভাব। কিন্তু প্রিয়তা ওর কথা শুনতে সেটাও টের পেল স্পষ্ট। তাই বলে চলল, ‘ তাদের পরেরদিন সকালে স্যার দুবাই চলে গেলেন। এরপর থেকে ওনার ইনস্ট্রাকশন অনুযায়ীই সব করেছি। রাতুলকে আপনি কোথায়, কীভাবে মারতে চেয়েছিলেন সেটাও আমিই জানিয়েছি স্যারকে। তবে সেসব প্রাণের ভয়ে নয়; নিজের ক্ষোভ থেকে। ঐযে বললাম দেড় বছর যাবত এই দিনটার অপেক্ষা করেছি আমি।’
এবার জয়ের দিকে তাকাল প্রিয়তা। চোখদুটো লালচে হয়ে আছে। শান্ত গলায় বলল, ‘ দুবাই কেন গিয়েছিল ও। জানো?’
‘ না। জানলেও বলতাম না।’
‘ আরেকটা ফাঁদের কথা বলছিলে তুমি। যেটা দিয়ে রুদ্র আমার রাণী মীর্জা পরিচয় জেনেছিল। সেটা কী?’
‘ সেটা স্যার আমাকেও বলেনি।’
চাপা শ্বাস ফেলল প্রিয়তা, ‘আমার প্রতি তোমার এতো ক্ষোভ কীসের জয়? যতটুকু মনে পরে তোমার কোন ক্ষতি করিনি আমি।’
তাচ্ছিল্য করে হাসল জয়, ‘ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা আপনিই করেছেন ম্যাডাম।’
‘ কী সেটা?’ সত্যিই অবাক হয়েছে প্রিয়তা।
হালকা করে মাথা নাড়ল জয়, ‘ এখন না। যদি কখনও আপনাকে দেখে আমার করুণা হয়,সেদিন বলব।’
‘ জয়!’
আর কিছু বলল না জয়। উঠে এঁটো প্লেটটা নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘরটা থেকে। সঙ্গে সঙ্গে তোষকের কোণায় তাকাল প্রিয়তা। যেখানে জয় বসেছিল, সেখানে জয়ের বাটন ফোনটা রাখা। ফোনটা প্রিয়তাই দিয়েছিল জয়কে। ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যে।
ফোনটা শুরু থেকেই লক্ষ্য করেছে প্রিয়তা। মনে মনে চাইছিল যেন ঝোঁকের ফেলে যায় জয়। হয়েছেও তাই। বসা অবস্থাতেই দ্রুত ফোনটার দিকে এগিয়ে গেল প্রিয়তা। দরজার দিকে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। এরপর পা দিয়ে কাছে টেনে নিল ফোনটা। আগে থেকেই ভেবে রেখেছিল কী করবে। পায়ের আঙুল দিয়েই ডায়াল করল একটা নাম্বারে। কয়েকবার উল্টোপাল্টা চাপ লাগল, ফোন সরে গেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেক কসরত করে সফল হল প্রিয়তা। কল রিসিভ হতেই প্রিয়তা বলল, ‘ রাণী বলছি।’
সঙ্গেসঙ্গে ব্যস্ত হয়ে উঠল কলের ওপাশে থাকা সম্রাট। উত্তেজিত গলায় বলল, ‘ রাণী! ঠিক আছো তুমি? তোমার কিছু হয়নিতো। ঐ বা*স্টার্ডটা _’
‘ শাট আপ সম্রাট!’ রেগে উঠল প্রিয়তা। ‘ বেশিক্ষণ কথা বলতে পারবনা আমি। শর্টকাটে যা বলছি শোন। কোথায় আছি আমি জানিনা। যে নাম্বারে কল করেছি তার লোকেশন ট্রাক করে জানার চেষ্টা করো আমি কোথায় আছি। দ্রুত! জানার সঙ্গে সঙ্গে কাউকে পাঠাও এখানে। কিছু করার জন্যে না নজর রাখার জন্যে। তোমরা কিছু করতে আসলে বিপদে পড়ব আমি। আমি নিজেই বের হওয়ার চেষ্টা করব রাতের মধ্যে। তখন বাইরে কাউকে দরকার হবে আমার। যদি আজ নাও বের হতে পারি; প্রতিদিন পালা করে একজন করে থাকতে বলবে। ফর গট সেইক, যেটুকু বলেছি শুধু সেইটুকু করবে। নয়তো খু*ন করব তোমাকে আমি।’
কথাটা বলেই বুড়ো পায়ের আঙুল দিয়ে কল কেটে দিল প্রিয়তা। কল হিস্ট্রি থেকে মুছে ফেলল নাম্বারটা। এরপর আবার পিছিয়ে গিয়ে বসল নিজের জায়গায়। জানেনা কতটা কী লাভ হবে। তবে বের হওয়ার চেষ্টা ওকে করতেই হবে। সময় ঘনিয়ে আসছে।
*
কিছুক্ষণের আগেই রাতের খাবার নিয়ে এসেছিল রঞ্জু। খায়নি প্রিয়তা। হাজার খুঁজেও বের হওয়ার কোন উপায় খুঁজে পায়নি। ভাবসাব দেখে মনেও হচ্ছেনা আজ বের হতে পারবে। জয়ের বিষয়টা নিয়ে এখন আর ভাবছেনা প্রিয়তা। জয় কেন এসব করেছে তা জানার ইচ্ছা নেই এখন ওর। এখন মনে-প্রাণে শুধু মুক্তির পথটাই খুঁজছে ও।
শটান করে দরজা খোলার শব্দ হতেই চমকে উঠল প্রিয়তা। একপ্রকার ঝড়ের বেগেই ভেতরে প্রবেশ করল রুদ্র। রুদ্রর রাগে ভয়ংকর হয়ে ওঠা চোখমুখ দেখে কেঁপে উঠল প্রিয়তা। অবাক হওয়ার সুযোগটা অবধি পেলোনা ও। তার আগেই ওর পা ধরে নিজের দিকে টেনে নিল রুদ্র। দ্রুতগতিতে খুলতে শুরু করল পায়ের বাঁধন। প্রিয়তা কিছু বলবে তার আগেই হাতের বাহু ধরে টেনে দাঁড় করাল ওকে রুদ্র। রাগে হিসহিসিয়ে বলল, ‘ এতোদিন শুনেছো। আজ দেখাব তোমাকে। চলো!’
বলেই টেনেহিঁচড়ে প্রিয়তাকে নিচে নিয়ে গেল রুদ্র। আচমকা হামলায় স্তব্ধ হয়ে গেছে প্রিয়তা। বিস্ময়ে একটা শব্দও বের হলোনা মুখ দিয়ে। কিন্তু নিচে যেতেই সে বিস্ময় আরও বাড়ল। দেখল, একটা ছেলে হাত বেঁধে গেড়ে বসিয়ে রাখা হয়ে। তার দিকে ব*ন্দু*ক তাক করে আছে রঞ্জু। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে জয়। ছেলেটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ জোরে মারা হয়েছে ওকে। ওকে চেনে প্রিয়তা। সম্রাটের সঙ্গে দেখেছে বহুবার। শুধু নামটা মনে পড়ছেনা। সুতরাং যা বোঝার বুঝে যায় ও।
প্রিয়তাকে ঝাড়ি দিয়ে ছেড়ে দেয় রুদ্র। এগিয়ে গিয়ে কলার ধরে দাঁড় করায় সেই ছেলে। টেনে নিয়ে এসে দাঁড় করায় প্রিয়তার সামনে। শক্ত চোখে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বলেছিলাম কোনরকম চালাকি করোনা। ক্ষতিটা তোমারই হবে। কিন্তু কেমন ক্ষতি হবে সেটা বোঝনি, তাইনা? বোঝাচ্ছি!’
বলতে বলতে পকেট থেকে একটা নাইফ বের করল রুদ্র। প্রেস করতেই বেরিয়ে এলো ধারালো ফ*লা। থতমত খেয়ে গেল প্রিয়তা। অস্ফুট স্বরে বলল, ‘ রুদ্র_’
বিদ্যুৎ গতিতে পরপর দুটো ছু*রির টান পড়ল ছেলেটার গলায়। র*ক্ত ছিটকে এলো প্রিয়তার মুখে। পেছনমোড়া করে হাত বাঁধা অবস্থায় মাটিয়ে পড়ে ছটফট করতে থাকল ছেলেটা। ঠিক গলা কা*টা মুরগির মতো। প্রিয়তা বিস্ফোরিত চোখে তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্র দু’কদম এগিয়ে গেল প্রিয়তার দিকে। শীতল গলায় বলল, ‘এরকম ক্ষতি হবে।’
#চলবে…