#প্রেমের_ধাঁরায়
#পর্বঃ৮
#লেখিকাঃদিশা_মনি
আরহাম একটু থেমে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করে অতঃপর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আবারো বলে,
“আশরাফ পাটোয়ারী যেদিন আমার মায়ের খোঁজ নেওয়ার জন্য এসেছিলেন সেদিন বড্ড দেরি হয়ে গেছিল। কারণ আমার মা যখন টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবনের কঠিন সময় পার করছিল তখন ওনার খোঁজ কেউ নেন নি। টাকার অভাবে আমার মায়ের ভালো চিকিৎসাও হয়নি৷ সেই সময় আমার বয়স ছিল মাত্র ৫ বছর। আমি নিজের চোখের সামনে আমার মাকে তড়পাতে তড়পাতে মরতে দেখেছিলাম। আর যখন আমার মা নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং তার জানাজার ব্যবস্থা করা হচ্ছিল তখনই আশরাফ পাটোয়ারী আসেন দয়া দেখাতে। আমার মায়ের মৃত্যুর খবর ওনাকে কতটা ব্যথিত করেছিল আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু উনি সেই মুহুর্তে আমার উপর পিতৃত্বের দাবি নিয়ে হাজির হন। আমার মামা-মামিরাও আমার দায়িত্ব নিতে অনিচ্ছুক ছিল। তাই আমাকেও ওনার হাতে তুলে দেন। আমি মোটেও সেই সময় এক অজানা অচেনা মানুষ..যে জন্মের পর থেকে আমার খোঁজ নেইনি তার সাথে যেতে চাইনি। কিন্তু বাধ্য হয়ে আমাকে তার সাথেই যেতে হয়। যদিওবা আমার নানু আমাকে নিজের সাথে রাখতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার হাত-পাও বাধা ছিল। কারণ সেও যে আমার মামাদের উপর নির্ভরশীল। এরপর আশরাফ পাটোয়ারী আমাকে নিয়ে আমেরিকায় চলে যান। সেখানে গিয়ে উনি..উনি আরেকজন বিদেশিনী মহিলাকে বিয়ে করেন। আমার প্রতি ওনার যা দায়িত্ব-কর্তব্য ছিল ততটুকু ঠিকঠাক ভাবে পালন করেছেন ঠিকই সেটা আমি অস্বীকার করব না কিন্তু এর পেছনে যে ওনার নিজেরও কিছু স্বার্থ ছিল বা এখনো আছে তাও অস্বীকার করার মতো নয়। এভাবেই ১৮ টা বছর উনি আমার সাথে এবং ওনার বিদেশিনী স্ত্রীর সাথে আমেরিকায় কাটিয়েছেন। এরপর একদিন ওনার স্ত্রীর সাথে ওনার ডিভোর্স হলো। আমেরিকার আইন অনুযায়ী আশরাফ পাটোয়ারীকে তার অর্ধেক সম্পত্তি দিয়ে দিতে হলো তার স্ত্রীকে। এমনিতেও ওনার ব্যবসা লসে চলছিল তার উপর এভাবে অর্ধেক সম্পত্তি হারানোয় তিনি উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে গেলেন। এই সময় তার হাতে আর কোন উপায় ছিল না। তাই তিনি তার অবশিষ্ট সম্পত্তির দায়িত্ব আমায় দিয়ে ফিরে পেলেন এই দেশে। আবারো নিজের মায়ের কাছে আশ্রয় চাইলেন। তারপর থেকে উনি এই দেশেই আছেন। আমার চোখে উনি কখনো একজন আদর্শ পিতা ছিলেন না, আজও নন। সবসময় উনি নিজের স্বার্থের কথাই ভেবে গেছেন, আজও তাই ভাবেন। মাঝখান থেকে আমার মায়ের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল।”
বলেই আরহাম শান্ত সবার সামনে আশরাফ পাটোয়ারীর সাথে তার মা নয়নার বিয়ের প্রমাণস্বরূপ কিছু ছবি এবং কাবিননামা দেখায়। তার নিজের বার্থ সার্টিফিকেটক দেখায় যা দেখে সবাই হতবাক হয়ে যায়।
আরহাম সবার সামনে প্রায় সব কথা তুলে ধরলেও লুকিয়ে গেল কিছু তিক্ত সত্য। লুকিয়ে গেল আমেরিকায় কাটানো সেই নিষ্ঠুরতম দিনগুলো। যখন আশরাফ পাটোয়ারী আমেরিকায় বহুনারী আসক্ত হয়ে জীবন পার করেছে। আরহামের উপরেও ছোট থেকে কোন খেয়াল রাখেনি। যার ফলস্বরূপ আমেরিকান বাস্তবতায় বড় হওয়া আরহাম কিশোর বয়স থেকেই মদ, জুয়া আর নারীর নেশায় মত্ত হয়ে যায়। তাকে সঠিক পথে ফেরানোর জন্য কেউ ছিল না। আরহাম মনে করে সেই দিনটা যেদিন সে প্রথমবার ড্রিংক করে বাসায় এসেছিল এবং আশরাফ পাটোয়ারীর মুখোমুখি হয়েছিল। সেদিন আশরাফ পাটোয়ারী তাকে বকাবকি করেনি, তাকে একটিবারও বলেনি এটা ভালো কাজ নয়। বরং তার পিঠ চাপড়ে বলেছিল, “Enjoy your life.”
এমনকি আরহাম যখন নারীসঙ্গে মিশে যাচ্ছিল সেই সময়েও আশরাফ পাটোয়ারী এসব জেনে চুপ ছিলেন। আরহামকে বলেছিলেন,
“এটা তো তোমার এইসব করারই বয়স। যা ইচ্ছা হয় করো। যখন যা টাকা লাগবে আমায় বলবে। তারপর সেই টাকা দিয়ে মদ খাবে, জুয়া খাবে, মেয়ে নিয়ে ঘুরবে সবটাই তোমার ইচ্ছা অনুযায়ী।”
এভাবেই ধীরে ধীরে আরহাম একসময় অন্ধকার জগতে প্রবেশ করে। মদ-জুয়ার নেশায় বুদ নয়, নারীদেহে মত্ত হয়। তবে একসময় তার এই জীবন বদলাতে আগমন ঘটে একজনের। যে তার জীবনে পরশপাথরের মতো ছিল। কিন্তু অদৃষ্টের খেয়াল সেই পরশপাথরকেও হারিয়ে ফেলে আরহাম। তারপর হয়ে ওঠে এক অদম্য,অমানুষ, বিশৃঙ্খল পুরুষ। যেই পরিণতি তাকে নিয়ে যায় পাপ-পূন্যের ঊর্ধ্বে। ন্যায়-অন্যায় সব ভুলে সে যুক্ত হয় পাপের নিকৃষ্ট জগতে। এসব কথা আরহাম আজ আর তুলে ধরে না।
নিজের এই গোপন কথাগুলো সে গোপনই রাখে।
এদিকে গুলশেনারা বেগম এগিয়ে এসে আরহামের হাত থেকে সমস্ত কাগজপত্র কেড়ে নিয়ে সেসব ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বলেন,”মিথ্যে, মিথ্যে, এইসব কিছু মিথ্যে। এই ছেলে মিথ্যে বলছে। আপনারা কেউ এর কথায় বিশ্বাস করবেন না। আমার আরশাদ দাদুভাই এই পরিবারের একমাত্র বংশধর। এ কেউ নয়। এই ছেলেটা টাকার লোভে এসব বানোয়াট কথা বলছে। এই ছেলে..তোমার কত টাকা লাগবে বলো। টাকার জন্যই তো তুমি এসব করছ তাইনা? তোমার যত টাকা লাগবে সেই টাকা আমি দেব। কিন্তু তুমি এসব নাটক করা বন্ধ করো। আমার পরিবারের উপর এসব কালি ছিটানো বন্ধ করো।”
মালিনী পাটোয়ারী এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার আর চুপ থাকতে পারেন না৷ এগিয়ে এসে বলেন,
“অনেক হয়েছে আম্মা, এবার আপনি থামুন। জীবনে তো অনেক পাপ করেছেন। শেষ বয়সে এসে অন্তত পাপের বোঝা কমানোর চেষ্টা করুন।”
গুলশেনারা বেগম গর্জে উঠে বলেন,”মালিনী!”
“আজ আর আপনার এই চোখ রাঙানিতে আমি চুপ হবো না আম্মা। সারাটা জীবন আপনি আমার সাথে অনেক অন্যায় করেছেন৷ আপনার দাম্ভিকতা, অহংকার, বংশমর্যাদা এসবের জন্য কম ভোগান্তি পোহাতে হয়নি আমায়। সারাটা জীবন আমি স্বামীসুখ পাইনি। এতদিন তাও চুপ ছিলাম কারণ ভেবেছিলাম আমি একাই বোধহয় এসবের ভুক্তভোগী কিন্তু এখন তো দেখছি আমি একা নই আরো একটা নিরপরাধ মেয়ে আপনার এই দম্ভের স্বীকার। যাকে আমি সারাটা জীবন ভুল বুঝেছি।”
“তুমি এই ছেলের কথা বিশ্বাস করো না মালিনী। এ সব মিথ্যা বলছে।”
মালিনী আশরাফের সামনে গিয়ে বললেন,
“শুনলেন তো আপনার মায়ের কথা? এবার আপনি কিছু বলুন। কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা সেটা বলুন সবাইকে। সারাটা জীবন তো আমার প্রতি, নয়নার প্রতি অনেক অন্যায় করলেন। এখন অন্তত নিজের সন্তানদের প্রতি সেই একই অন্যায় করবেন না। নাহলে যে আপনার খাটিয়া বহন করার জন্যেও কাউকে পাবেন না। আজ অন্তত সবার সামনে নিজের সন্তানকে স্বীকৃতি দিন।”
আশরাফ পাটোয়ারী করুণ চোখে আরহামের দিকে তাকায়। আরহাম শক্ত মুখে তাকিয়ে ছিল তার পানেই। চোখ ঘুরিয়ে গুলশেনারা বেগমের দিকে তাকাতেই তিনি দেখতে পেলেন গুলশেনারা বেগম তাকে ইশারা করে বলছে সত্যটা গোপন রাখতে। কিন্তু আশরাফ পাটোয়ারী আজ তার মনের কথা শুনলেন। চোখ বন্ধ করে, বুকে সাহস সঞ্চার করে সবার উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
“আরহাম শান্ত আমার এবং আমার প্রথম স্ত্রী নয়নার বৈধ সন্তান।”
আশরাফ পাটোয়ারীর এই একটা কথাতেই যেন নড়ে গেল পুরো পাটোয়ারী পরিবারের ভিত। গুলশেনারা বেগমের এতদিনের জমানো সম্মান ধুলোয় মিশে গেল।
এদিকে এককোণে দাঁড়িয়ে এইসব দৃশ্যের নীরব সাক্ষী হলো ধৃতি। অস্ফুটস্বরে বলল,
“এই লোকটা তাহলে এই বাড়িরই ছেলে! যদি এমন হয় তাহলে আমি আর এক মুহুর্ত এই বাড়িতে থাকব না।”
এরইমধ্যে আরশাদ এত চেচামেচির আওয়াজ শুনে নিজের ঘর থেকে বের হয়ে নিচে আসে। এখানে আরহামকে দেখামাত্রই সে ক্ষেপে ওঠে। তেড়ে এসে আরহামের কলার ধরে বলে,
“তোর সাহস কি করে হলো এই বাড়িতে পা রাখার?”
আরহাম আরশাদের থেকে তার কলার ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আমার সাহসের কিছুই এখনো তুই দেখিস নি। যদি আমি আমার পরিপূর্ণ সাহস দেখাতে শুরু করি তাহলে এই পাটোয়ারী বাড়ি আর পাটোয়ারী এন্টারপ্রাইজ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে মাটির সাথে মিশে যাবে।”
গুলশেনারা বেগম চিৎকার করে বলেন,
“এই আপদটাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দাও দাদুভাই। ও আমাদের বাড়ির মান-মর্যাদা ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। ইচ্ছেতো করছে ওকে..”
আরহাম শান্ত বেশ অহম ভাব নিয়ে বলল,
“কাউকে আমায় এখান থেকে বের করে দিতে হবে না। আমি নিজেই এখান থেকে চলে যাচ্ছি। তবে একটা কথা মনে রাখবেন, আমার এই যাওয়া শেষ যাওয়া নয়। আমি আবারো এখানে ফিরবো। নিজের পরিপূর্ণ অধিকারের সাথেই ফিরব।”
বলেই আরহাম ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। ধৃতির সাথে তার চোখাচোখি হয়। ধৃতি প্রবল ঘৃণার সাথে চোখ সরিয়ে নেয়। আরহাম একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে চলে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨