#প্রেমের_ধাঁরায়
#পর্বঃ২৬
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ধৃতি কোর্ট থেকে নেমে তার ভাই ও ভাবির মুখোমুখি হয়৷ ধৃতির বড় ভাই ধীরাজ তো তাকে আলিঙ্গন করে বলে,
“কেমন আছিস তুই বোন? কতদিন থেকে তোর কোন খোঁজ নেই! তুই জানিস এতগুলো দিন আমি তোকে কোথায় কোথায় খুঁজেছি? এভাবে রাতের আঁধারে কাউকে কিছু না বলে কোথায় হারিয়ে গেছিলি? মানছি আমার একটা ভুলের জন্য তোর জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে। তাই বলে এত রাগ পুষে রাখবি এই ভাইয়ের উপর?”
“আমি তোমার উপর রেগে নেই ভাইয়া। আমি তো শুধু চাইনি আমার এই অভিশপ্ত জীবন নিয়ে তোমাদের সাথে থাকতে। সেজন্যই চলে এসেছিলাম। তুমি তো জানো বলো তোমাদেরকে আমি কতটা ভালোবাসি!”
এরইমধ্যে মালিনী পাটোয়ারী, মতিয়া বিবি, আলমগীর পাটোয়ারী সবাই এগিয়ে আসেন। আলমগীর পাটোয়ারী বলেন,
“বাপরে! আমার তো মাঝখানে দমই আটকে আসছিল ধৃতির কথা শুনে। তবে শেষ অব্দি সত্যের জয় দেখে খুশি হলাম।”
মালিনী পাটোয়ারী বলেন,
“আমিও ভীষণ খুশি হয়েছি। অবশেষে ঐ আরহাম নিজের সব অপরাধের শাস্তি পেল। এবার বাকিদের পালা..”
বলেই তিনি কিছুটা দূরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা আরশাদের দিকে তাকালেন। আরশাদের আজ লজ্জায় মাথা হেট হয়ে গেছে। সে বুঝতে পেরেছে শুধু শুধু ধৃতিকে ভুল বুঝে সে কতোই না অন্যায় করেছিল। ধৃতি আসলে যে অন্যায় পরিস্থিতির স্বীকার ছিল অথচ ধৃতির কঠিন সময়ে আরশাদ তার পাশে থাকে নি৷ তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে। আরশাদ এবার এগিয়ে এসে ধৃতিকে বলে,
“পারলে সবকিছুর জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিও।”
ধৃতি হেসে বলে,
“আপনি যে কেবলই আমাকে অপমান করেছেন সেটা তো নয়, একসময় আমাকে চরম বিপদের হাত থেকে রক্ষাও করেছিলেন। এজন্য আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব আজীবন। সেই কৃতজ্ঞতার জের ধরেই আপনার প্রতি আমি কোন রাগ পুষে রাখি নি।”
ধৃতির কথায় যেন আরশাদ নিজের হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। তাই তো মাথা তুলে বলে,
“তার মানে তুমি আমায় ক্ষমা করে দিয়েছ? আমাকে বিয়ে করতেও তার মানে তোমার আর কোন আপত্তি নেই, তাই তো? আমি অতীতের সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নিতে চাই ধৃতি। সেদিন আমাদের বিয়ে তো হয়েই যেত শুধু যদি না ঐ আরহাম মেজর সময়ে এসে সবটা ভেস্তে দিত। আমি জানি, সেই সময় আমি তোমাকে অবিশ্বাস করে অনেক বড় ভুল করেছি কিন্তু আমি তার জন্য যথেষ্ট অনুতপ্ত। তুমি যেহেতু আমায় ক্ষমা করেছ তাই….”
আরশাদের পুরো কথা শেষ হবার আগেই ধৃতি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“এক মিনিট, এক মিনিট। আপনার বোধহয় বুঝতে কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। এটা ঠিক যে আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি তবে আমি কিন্তু একটিবারও এই কথা বলিনি যে, আমি আপনাকে বিয়ে করব। ন্যাড়া কয়বার বেলতলায় যায় বলুন তো? আপনার প্রতি আমার যা বিশ্বাস ছিল আপনি তা ভেঙে চূড়মাড় করে দিয়েছেন। আমি অনেক আশা নিয়ে আপনার সাথে নতুন জীবন শুরুর কথা ভেবেছিলাম কিন্তু আপনি…যাক গে সেসব কথা। আপনি এখন আপনার জীবনে এগিয়ে যান। আমিও নিজের জীবনের পথে পা বাড়াবো।”
বলেই ধৃতি আরশাদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আরশাদ কাতর কন্ঠে বলে,
“ধৃতি প্লিজ..”
কিন্তু ধৃতি দূর্বল হয় না। সে আর একটি বারও ফিরে তাকায় না। নিজের ভাই-ভাবিকে সাথে নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। যাওয়ার আগে সবার থেকে বিদায় চেয়ে নেয়। আরশাদ এবার মালিনী পাটোয়ারীকে বলে,
“আম্মু, তুমি কিছু করো। ধৃতিকে বোঝাও আমার ব্যাপারটা। আমি সত্যি ধৃতিকে ভালোবাসি আম্মু। ওকে এভাবে যেতে দিও না।”
মালিনী পাটোয়ারী বলেন,
“আমার এক্ষেত্রে কিছুই করার নেই আরশাদ। আমি আগেই তোমাকে বলেছিলাম ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে। তুমি ধৃতিকে যেভাবে অবিশ্বাস করেছিলে তাতে করে ও আর কিভাবে তোমায় বিশ্বাস করবে? ও জীবনে এমনিতেই অনেক কিছু সহ্য করেছে তাই ও যথেষ্ট বুঝদার হয়েছে বলেই আমার মত। আর আগেরবার আমি তো তোমার জন্য ওর কাছে সুপারিশ করেছিলাম তারপর যেভাবে..যদিওবা তাতে আমারই দোষ ছিল। কিন্তু এত কিছুর পর আমি কোন মুখে আবার ওকে বোঝাতে যাব, বলতে পারো?”
আরশাদ বুঝতে পারে মালিনী পাটোয়ারীর কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু সেও এত সহজে হার মেনে নেয়ার ছেলে নয়। তাই তো আরশাদ বলে,
“যেভাবেই হোক না কেন, আমি ধৃতির হারানো ভরসা আবারো পুনরুদ্ধার করব।”
এদিকে কোর্টের বাইরে আসতেই এডভোকেট আকাশ পাটোয়ারীর মুখোমুখি হয় ধৃতি। তাকে দেখেই স্মিত হাসে ধৃতি। ধীরাজ এগিয়ে এসে আকাশ পাটোয়ারীকে বলেন,
“আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আজ শুধুমাত্র আপনি ছিলেন বলেই আমার বোন এত বড় একটা বিপদ থেকে রক্ষা পেল। ওর সত্যিটা সবার সামনে এলো। ওর প্রতি অবিচারকারীরা শাস্তি পেল। আমাদের জন্য আপনি যা করলেন তা কখনোই ভুলতে পারব না।”
আকাশ পাটোয়ারী সামান্য হেসে বলে,
“আমি তো নিমিত্ত মাত্র, সকল প্রশংসাই আল্লাহর। উনি চেয়েছিলেন যে আমার মাধ্যমেই ধৃতি ন্যায়বিচার পাক আর সেটাই হয়েছে।”
আকাশের কথায় সবাই ভীষণ মুগ্ধ হয়। কিছুক্ষণ কথা বলার পর তারা একে অপরকে বিদায় জানায়। ধৃতি যাবার সময় আকাশকে বলে,
“এবার তাহলে আসি…”
আকাশ হেসে বলে,
“আশা করি,খুব শীঘ্রই আমাদের আবারো দেখা হবে।”
★★
আরহামের পতনের পর আশরাফ পাটোয়ারীর পতনও অবশম্ভাবী হয়ে পড়ে৷ আরহাম শান্তর বিভিন্ন বেআইনি কাজের সাথে আশরাফ পাটোয়ারীও জড়িয়ে ছিলেন। ঠিক সেই কারণে আশরাফ পাটোয়ারীর নামেও পুলিশি তদন্ত চলছে। এসব জানতে পেরে এক রাতের আধারে আশরাফ পাটোয়ারী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার পায়তারা করেন। তবে তার প্লান ফেইল হয়ে যায়। বিমানবন্দরে পৌঁছে যাওয়ার আগেই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়। এভাবে আরো এক অন্যায়ের পতন ঘটে।
★★
আরশাদ ঠিক করে নিয়েছে যেভাবেই হোক সে ধৃতির মন আবার জয় করবে৷ সে জন্য কোন চেষ্টার কসুর রাখতে সে চায়না। আজ সে তৈরি হচ্ছিল ধৃতির সাথে দেখা করার জন্য। এমন সময় গুলশেনারা বেগম এসে বলেন,
“শুনেছ দাদুভাই, তোমার বাবাকে নাকি পুলিশ গ্রেফতার করেছে?!”
আরশাদ বিরক্ত স্বরে বলে,
“হ্যাঁ, তো..”
” তো মানে? তুমি কিছু করবে না? তোমার বাবাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনো।”
“বাবার জন্য তোমার এত চিন্তার কারণ কি দাদি? কিছুদিন আগেই তো তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলে।”
গুলশেনারা বেগম আমতা আমতা করে বলেন,
“শত হোক আমার ছেলে তো..”
“তোমার মাতৃত্বের শক্তি কেমন তা আমার আর জানা বাকি নেই। তুমি কি ভয় পাচ্ছ যে মিস্টার আশরাফ পাটোয়ারীকে রিমান্ডে নেয়ার ফলে তিনি এমন কিছু বলতে পারেন যাতে তোমার ক্ষতি হবে?”
গুলশেনারা বেগমের ঘাম ছুটে যায়। তিনি বলেন,
“এসব কি বলছ তুমি দাদুভাই? আমাকে কি তোমার অপরাধী মনে হয়?”
“মনে তো আমার অনেক কিছুই হয়। তবে একটা কথা মাথায় রাখো। যদি কোন অন্যায়ে তোমার নাম আসে তাহলে কিন্তু আমি তোমাকে মোটেই স্পেয়ার করব না।”
গুলশেনারা বেগমের ঘাম আরো বাড়ে। অতীতের করা কিছু ভয়াবহ পাপের কথা মনে পড়ে যায়। এসব কিছু প্রকাশ পেলে যে তার জীবনে মহাবিপদ আসন্ন!
এমন সময় হঠাৎ করে মালিনী পাটোয়ারী ছুটে এসে আরশাদকে উদ্দ্যেশ্য করে বলেন,
“আরশাদ! খুব বড় বিপদ হয়ে গেছে রে! ধৃতি সিঁডি থেকে পড়ে গেছে। ওর অবস্থা খুব খারাপ..ওকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আমাদের তাড়াতাড়ি যেতে হবে।”
আরশাদ হতবাক হয়ে বলে,
“কি বলছ টা কি?”
“হুম।”
আরশাদ উদ্বিগ্ন স্বরে বলে,
“এক্ষুনি চলো।”
এদিকে তারা বেরিয়ে যেতেই গুলশেনারা বেগম পালানোর পায়তারা শুরু করেন।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨