#প্রেমের_ধাঁরায়
#পর্বঃ৩০(শেষ পর্ব)
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ধৃতি তার জীবনে অনেকটা এগিয়ে গেছে। এখন তার বেশিরভাগ সময় যায় তার তৈরি নারী সংগঠনের দায়িত্ব পালন করার মধ্য দিয়ে। প্রতিদিন তার কাছে বিভিন্ন নারী তাদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আসে। ধৃতি মনযোগ দিয়ে তাদের কথা শোনে এবং তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নিজের সর্বাত্মক চেষ্টা করে। ধৃতি অনেক অসহায় মেয়েকেও ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে তাদের পাশে থাকে। আর এক্ষেত্রে তার সবথেকে বড় সাপোর্ট সিস্টেম হিসেবে কাজ করে আকাশ। আকাশের সাথে ধৃতির বন্ধুত্ব ইদানীং আরো বেশি গাঢ় হয়েছে। এতটা বেশি গাঢ় যে এটি বন্ধুত্বের সীমা ছাড়িয়ে জানান দিচ্ছে অন্য কোন সম্পর্কের আহ্বান।
ধৃতিও বুঝতে পারছে সে আজকাল আকাশের উপর কতোটা নির্ভর হয়ে পড়েছে। আকাশের সঙ্গ সে কতটা উপভোগ করছে। আকাশের ব্যাপারে তার যেই ব্যাপারটা ভালো লাগছে তা হলো যেভাবে আকাশ সব পরিস্থিতিতে পাশে থাকে, তাকে সম্মান এবং মর্যাদা দেয়। একটা মেয়ে তো এসবই চায়। ধৃতির কাছে এই বিষয়গুলো ভালো লাগে৷ যা তাকে ভাবতে বাধ্য করে আকাশকে নিয়ে। আকাশের প্রতি তার অনুভূতি দিনকে দিক আরো বেশি গাঢ় হচ্ছে। ধৃতি বুঝতে পারছে তার মনের অবস্থাটা। ধৃতির মন যে পুরোপুরি ভেসে গেছে আকাশের প্রেমের ধাঁরায় এখন আর সে কোনভাবেই এটা অস্বীকার করতে পারবে না। ইদানীং ধৃতির মনে হয় তার জীবনটা নতুন করে শুরু করা দরকার। অতীতের কালো ছায়া সে অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। এখন প্রতিদিনই নিত্য নতুন মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে সে অনেকটাই অনুপ্রেরণা পেয়েছে এব্যাপারে৷ তাছাড়া যেই ধৃতি এখন অনেক মেয়েকে দিনরাত পরামর্শ দিচ্ছে অতীত ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে, সেই যদি অতীতের ভয়াবহ স্মৃতি আকড়ে বাঁচতে চায় তাহলে কিভাবে হবে? তাকেও তো সমাজে একটা আদর্শ সৃষ্টি করতে হবে যে, এইভাবে মেয়েদের ভেঙে দেয়া যায় না৷ একটা মেয়ে চাইলেই সমাজকে পাশ কাটিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারে৷ এমন ভাবনা থেকেই ধৃতি সিদ্ধান্ত নিল এবার সে আকাশকে নিজের মনের সব কথা জানাবে। যেই ভাবা সেই কাজ।
আকাশকে একটা কফিশপে ডেকে পাঠিয়েছে ধৃতি। আকাশ কোর্টের কাজ শেষ করে সারাস কফিশপে আসে ধৃতির সাথে দেখা করে। এসেই ধৃতির উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“কি ব্যাপার ধৃতি? তুমি হঠাৎ এভাবে আমায় ডেকে পাঠালে কেন? কিছু কি হয়েছে?”
ধৃতি মৃদু হেসে বলে,
“তোমায় কিছু কথা জানানোর আছে।”
“হুম বলো।”
“এটা শুনতে একটু অদ্ভুত লাগতে পারে তবে..আমি নিজের জীবনটা নতুন ভাবে শুরু করতে চাই। আমি চাই অতীতের অন্ধকারকে দূরে ঠেলে সুন্দর এক ভবিষ্যতের সূচনা করতে। এই যাত্রায় কি তোমাকে পাশে পাবো?”
ধৃতির কথা শুনে আকাশ পুরোপুরি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ধৃতি বলে,
“তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমি কি বলতে চাইছি?”
আকাশের মুখবিবর জুড়ে ছড়িয়ে যায় খুশির আমেজ। সে হাসিমুখে বলে,
“এটাকে কি তাহলে আমি প্রস্তাব বলেই ধরে নেব?”
ধৃতি এবার খানিকটা লজ্জা পায়। লজ্জায় তার গাল লাল হয়ে যায়। ধৃতি চোখ নামিয়ে নেয়। আকাশ ধৃতির লজ্জাটা বুঝতে পেরে স্মিত হেসে বলে,
“আমি দাদু, বাবা-মা সবাইকে জানিয়ে দেব। তুমিও নিজের ভাই-ভাবিকে জানিয়ে রেখো৷ খুব শীঘ্রই একটা ভালো দিন দেখে আমি চাই আমাদের চার হাত এক হোক। তোমার সাথে ভেসে যেতে চাই #প্রেমের_ধাঁরায়।”
ধৃতি চোখ তুলে তাকায়। অনিমেষ তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। আকাশের চোখে চোখ রেখে বলে,
“আসল কথাটা বলি?”
“জ্বি, বলো।”
“আমি তোমাকে ভালোবাসি আকাশ।”
“আমিও তোমাকে ভালোবাসি ধৃতি।”
★★★
সবেমাত্র অফিস থেকে বাড়িতে ফিরল আরশাদ। অফিস থেকে ফিরেই চেইঞ্জ করে নিয়ে ক্লান্ত শরীরে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। দীর্ঘ ৬ মাস কেটে গেছে তার জীবনে। এই ৬ মাসে আরশাদের জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগের চেয়েও আরো বেশি গম্ভীর হয়ে গেছে সে। কাজের মধ্যে আরো অনেক বেশি ডুবে গেছে। গোফ-দাঁড়ি অনেক বড় হয়ে গেছে তার কিন্তু এগুলো কাটারও সময় নেই তার কাছে। কাজে-কর্মে নিজেকে এতটাই ব্যস্ত রেখেছে সে।
মালিনী পাটোয়ারী আরশাদের সাথে দেখা করার জন্য তার রুমে আসে। আরশাদকে এভাবে দেখে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন। আরশাদের রুমে প্রবেশ করে বলেন,
“এভাবে আর কত আরশাদ? নিজেকে এত কষ্ট কেন দিচ্ছ তুমি?”
আরশাদ গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে,
“কষ্ট মানে?”
“দেখো, আমি তোমার মা। তাই আমার সামনে এসব অভিনয় করে কোন লাভ হবে না। তুমি যতোই নিজের মনের কষ্ট লুকানোর বৃথা চেষ্টা করো কিন্তু সেসব কোন কাজে দেবে না।”
আরশাদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“তোমার বুঝতে কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি মোটেই কষ্টে নেই।”
“নেই বলছ?”
“না, নেই।”
মালিনী খন্দকার একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,
“আগামী সপ্তাহে আকাশ ও ধৃতির বিয়ে।”
আরশাদের গম্ভীর মুখে হঠাৎ করে শোকের ছায়া নেমে এলো। আরশাদ সেই শোক লুকানোর জন্য গম্ভীর স্বরে বলল,
“ভালোই তো। ওদের আগামীর জীবন সুখের হোক।”
“আব্বু আজ আমায় ফোন করেছিল। গতকাল আব্বু আর ভাইয়ারা গিয়ে ধৃতির বাসায় গিয়ে বিয়ের কথা ফাইনাল করে এসেছে। ধৃতি ও আকাশ দুজনেই এই বিয়েতে রাজি আর…”
আরশাদ বিরক্তির স্বরে বলে,
“তুমি আমাকে এসব বলছ কেন আম্মু? আমি কি শুনতে চেয়েছি?”
“এতটা রেগে যাচ্ছ অথচ এরপরেও বলবে তোমার কোন কষ্ট নেই।”
“না, নেই আমার কোন কষ্ট। আমার জীবনে কোন কষ্ট নেই। আমার এসব ফালতু বিষয়ে ভাবার কোন সময় নেই। আমার বিজনেসের জন্য অনেক ডিল করতে হচ্ছে। বিজনেসকে শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করতে হচ্ছে। আমার এখন মূল টার্গেট আমার কোম্পানিক আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। বুঝলে?”
মালিনী পাটোয়ারী বলেন,
“এত কিছু হয়ে গেল তবুও তুমি নিজের ইগো থেকে বেরিয়ে আসলে না। এই ইগোর জন্যই তোমায় সব হারাতে হলো।”
আরশাদ বলে,
“কিছু হারাই নি আমি। আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন আমি তা নিয়েই সন্তুষ্ট। হয়তো ধৃতি আমার জন্য কখনো তৈরিই হয়নি তাই আমি ওকে পাইনি।”
“এটা মুখে হয়তো বলছ কিন্তু মন থেকে কি মানতে পারছ?”
“না মানতে পারলেও কি আর করার আছে? আমি ধৃতির সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই৷ আমি চাই ও সুখী হোক। ব্যস, এবিষয়ে আর কিছু বলতে চাই না।”
বলেই আরশাদ ওয়াশরুমে প্রবেশ করে। মালিনী পাটোয়ারী ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকেন। আরশাদ ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার চালিয়ে নিজের কষ্টগুলো বিসর্জন দিতে থাকে শাওয়ারের পানিতে। যেই চোখের পানি সে কাউকে দেখাতে পারে না সেই অশ্রুর সাক্ষী হয় এই চার দেয়াল। যেখানে তার ভেসে যাওয়ার কথা ছিল কারো প্রেমের ধাঁরায়, সেখানে সে আজ ভেসে যাচ্ছে অশ্রুধাঁরায়।
★★
আকাশ ও ধৃতি বসে আছে বিয়ের আসরে। আজ তাদের দুটি জীবন একত্রে মিলে যাবার কথা। ধৃতি খুব সুন্দর একটি লাল শাড়ি পড়েছে আকাশের পড়নে সাদা কারুকাজ করা পাঞ্জাবি। ইতিমধ্যে কাজি সাহেব এসে বিয়ের সকল কার্যক্রম শুরু করেন। কবুল বলতে বলা হলেই ধৃতি কবুল বলে দেয়, আকাশও কবুল বলে দেয়। এভাবেই ইসলামী রীতিতে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়৷ তাদের বিয়ে সমাপ্ত হতেই একে একে সবাই নবদম্পতির জন্য দোয়া করতে থাকে। এরইমধ্যে ধীর পায়ে এগিয়ে আসেন মালিনী পাটোয়ারী তার পিছু পিছু আসে আরশাদও। আরশাদ এগিয়ে এসে আকাশকে শুভেচ্ছাবার্তা জানিয়ে বলে,
“তোমার বিবাহিত জীবন সুখের হোক ভাই। এই দোয়া করি।”
আকাশও হাসিমুখে কথা বলে। আরশাদ আকাশের সাথে কথা বলতে বলতেই আরচোখে ধৃতিকে দেখে নেয়। এই নারী এখন তার জন্য নিষিদ্ধ, তবুও যে বেহায়া মন মানতে চায়না। আকাশ নিজের মনের কষ্ট আর বেশিক্ষণ লুকিয়ে রাখতে পারে না। বিয়েবাড়িতে থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে আর্তনাদ করতে থাকে। জীবনে কিছু ভুলের পরিণাম এমনই হয় যা আমাদের সারাজীবন ভোগায়।
★★
অন্যদিকে ননবদম্পতি আকাশ ও ধৃতি ভেসে যাচ্ছে প্রেমের ধাঁরায়। তাদের নতুন জীবন শুরু হলো এক নতুন আশার সাথে। প্রেমের এই উপাখ্যান এখানে শেষ হলেও প্রেমের ধাঁরায় ভেসে যাওয়ার শুরু এখান থেকেই।
সমাপ্ত ✨