বিস্তৃতির_মাঝে_তুমি_আমি #পর্ব_৯ ( অতীত- ৪) #লেখিকা_অনামিকা_তাহসিন_রোজা

0
15

#বিস্তৃতির_মাঝে_তুমি_আমি
#পর্ব_৯ ( অতীত- ৪)
#লেখিকা_অনামিকা_তাহসিন_রোজা

আহমেদের অনুরোধে রোজা সেদিন নিজেকে সাজিয়েছিল এক বিশেষ আভায়, যেন আকাশের নীলতার সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছে। নীল রঙের শাড়ি, যা আহমেদের সবচেয়ে পছন্দের, স্নিগ্ধ অথচ গভীর মায়া ছড়িয়ে দিয়েছিল তার চারপাশে। শাড়ির প্রতিটি ভাঁজ যেন একেকটি অনুচ্চারিত কবিতা, যা আহমেদের হৃদয়ের অন্দরে প্রবেশ করে তার ভালোবাসার গভীরতা জাগিয়ে তুলছিল। চোখের কোণে সেই কোমল হাসি আর রেশমের মতো নীল শাড়ির আঁচলে জড়িয়ে থাকা তার শ্যামলা ত্বক—সব মিলিয়ে যেন এক অমলিন সৌন্দর্য রচনা করছিল।

আহমেদ যখন রোজার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল, তার হৃদয় এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। সে জানতো, তার প্রিয় নীল রং রোজাকে আরও অপরূপ করে তুলবে, কিন্তু এমন সৌন্দর্য, এমন মুগ্ধতা সে কল্পনাও করতে পারেনি।

রোজা যখন ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকল, আহমেদের চোখের পলক পড়া বন্ধ হয়ে গেলো। নীল শাড়ির আঁচল যেন তার চারপাশে এক মোহময় আভা তৈরি করেছিল, যা সূর্যাস্তের নরম আলোয় আরও গাঢ় হয়ে উঠছিল। তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল মৃদু অথচ সুনির্দিষ্ট, যেন পৃথিবীর ভারসাম্যই বদলে দিচ্ছে। আহমেদ তার দৃষ্টি সরাতে পারছিল না; তার মনে হলো, এই মুহূর্তটি চিরস্থায়ী হয়ে যাক।

মুগ্ধতায় ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি ফুটল আহমেদের। সেই মুহূর্তে শহরের কোলাহল ম্লান হয়ে গিয়েছিল, গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দও যেন প্রকৃতির নিস্তব্ধতার মতো ঠেকছিল।

রোজা গাড়িতে উঠে বসতেই তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য স্পন্দন তৈরি হলো, যা ছিল পরস্পরের সান্নিধ্যের আনন্দ। কেউ কারো সাথে কথা বললো না! আহমেদ রোজার প্রতি মুগ্ধতায় হারিয়ে গিয়ে কথা বলল না আর এদিকে রোজা লজ্জায় কথা বলল না! লোকটা কেমন অ’স’ভ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে! আহমেদ মুচকি হেসে গাড়ি স্টার্ট দিল! মেয়েটার সাথে এখন কথা না বলাই ভালো!

গাড়ির জানালা দিয়ে আসা হালকা বাতাস রোজার চুলের মধ্যে খেলা করছিল, আর আহমেদ তাকে এক দৃষ্টিতে দেখছিল—তাদের মধ্যে তখন কথা প্রয়োজন ছিল না। শুধু চোখের ভাষাতেই সব বলা হয়ে যাচ্ছিল। তারা গাড়িতে চলতে থাকল, সেই কাঙ্ক্ষিত রেস্টুরেন্টের দিকে, কিন্তু মনে মনে তারা যেন কোনো অজানা, অলিখিত অনুভূতির পথে পা বাড়িয়েছিল।

এই রাতেও রেস্টুরেন্টে আলোর ঝলমলে পরিবেশ! আহমেদ এবং রোজা গাড়ি থেকে নেমে পরল। হঠাৎ আহমেদ ধীর কণ্ঠে বলল,
“তোমাকে শাড়ি পরে আসতে বলাটা আমার ভুল হয়েছে!”

রোজা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
” কেন? খুব খারাপ লাগছে?”

আহমেদ একটু থেমে, গভীর এক দৃষ্টিতে রোজার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” হুম লাগছে! তোমাকে এতটাই খারাপ লাগছে যে… আমার নিঃশ্বাসটা থেমে গিয়েছে। হৃদস্পন্দন থমকে গিয়েছে আমার! যেন চারপাশের সবকিছু থমকে গেছে—কেবল তোমার এই উপস্থিতি ছাড়া। ভাবছি, এই পার্টিতে সবাই কীভাবে সামলাবে! যদি আমার মতো তাদেরও নিঃশ্বাস থেমে যায়! আমি তো এটা মেনে নিতে পারব না!”

রোজা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে বুঝতে চেষ্টা করল যে তাকে কি সত্যিই খারাপ লাগছে, নাকি এটা আহমেদের কোনো গভীর প্রশংসার কৌশল! কিন্তু তার ছোট্ট মাথায় এটা ঢুকলো না! দুঃখী মনে নিজেকে আরেকবার পরখ করে নিল সে!

আহমেদ রেস্টুরেন্টের দিকে তাকিয়ে আবারো বলে উঠলো,
“তোমাকে এখন দেখা না গেলেই বোধহয় আমার জন্য সবচেয়ে বেশি ভালো হতো এই মুহূর্তে!”

রোজা চোখ পিটপিট করে তাকালো। লোকটা এভাবে বলছে কেন? তাকে কি এতটাই খারাপ লাগছে যে মানুষজন তাকে দেখলে ভূত ভেবে চেঁচিয়ে উঠবে! আহমেদ রোজার চোখের দিকে তাকিয়ে আবারো বলে উঠলো,
“এক কাজ করো তো! তুমি অদৃশ্য হয়ে যাও! আমি ছাড়া যেন আর কেউ তোমাকে দেখতে না পায়! এটাই মনে হচ্ছে ভালো হবে!”

আহমেদের এমন উদ্ভট কথাতে রোজা লজ্জা পাওয়া ভুলে গেল! লোকটা কি পাগল হয়ে গেছে? কি বলছে এসব? নাকি আবার জ্বর এসেছে?

আহমেদ আর কিছু না বলে রোজার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
” চলো যাই!”

আহমেদ রোজার হাত ধরার সাথে সাথে তার ছোট্ট দেহখানা আবারও কেঁপে উঠলো! ভুলে গেল একটু আগে আহমেদের করা পাগলামো গুলো! সে মাথা নিচু করে আহমেদের পিছে পিছে চলতে থাকলো, আবার মাঝে মাঝে এক পলক করে তাকাতে থাকলো আহমেদের মুঠোয় থাকা তার ছোট্ট হাতটার দিকে! সব সময় এভাবে হাত ধরে থাকলে মন্দ হবে না! মনে মনে রোজা ভেবে নিল সারা জীবন যদি এভাবে তার হাত এই মানুষটার হাতের মুঠোয় থাকে, তাহলে কতই না ভালো হবে! কতই না সুখকর হবে! এসব ভেবে রোজা লাজুক হাসলো।

সবাই মিলে আলাদা করেই ভি আই পি কেবিন বুক করেছে তাদের পার্টির জন্য। যেখানে শুধুমাত্র তাদের পরিচিত থাকবে। আহমেদ এবং রোজা কেবিনে ঢোকার সাথে সাথে সবাই হৈ-হুল্লোড় শুরু করে দিল। আহমেদ তার বন্ধুদের সাথে হাগ করলো।

এদিকে রোজা পড়েছে মহা বিপদে! এত বড় বড় দামড়া ছেলেগুলো তাকে আপু আপু বলে ডাকছে! তখন থেকে কানের কাছে মশার মতো প্যান প্যান করে বলছে, কেমন আছো আপু! ভালো আছো তো আপু!
রোজা খুব চিন্তায় আছে! এভাবে তার থেকে বয়সে বড় ভার্সিটির সিনিয়াররা যদি তাকে আপু বলে ডাকে তাহলে তো ভার্সিটিতে বেশ সমস্যায় পরতে হবে তাকে!

আহমেদ রোজার এরকম ভয়ার্ত চোখ মুখ দেখে মুচকি হাসলো। হুমায়রা এবং দিয়াও আছে এখানে। হুমায়রা এসে আহমেদকে বলল,
“ভাইয়া এত লেট করলেন কেন? আপনাদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমার তো দুইবার ঘুম হয়ে গেল!”
হুমায়রার কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো। এদিকে ক্ষণিক সময় পর আহমেদের হঠাৎ চোখ গেল তার দিকে অদ্ভুত লা’ল’সার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা সারিয়ার দিকে! এই নির্লজ্জ মেয়েটা এখানে কী করছে? সে তো এই মেয়েটাকে এখানে ডাকেনি!

আহমেদ তৌসিফকে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলল,
“এই নি’র্ল’জ্জ মেয়েটা কে কেন এনেছিস?”

তৌসিফ বলল,
” আরে ভাই! আমি আনিনি! রকিরা এনেছে! সারিয়াকে তুই তো জানিসই! যখনই খোঁজ পেয়েছে তুই এখানে আসবি, তখনই রকিদের সাথে ভাব জমিয়ে পিন পিন করে কুকুরের মত ওদের পিছু পিছু চলে এসেছে। আর তুই যে সারিয়াকে পছন্দ করিস না এটা শুধু আমি জানি।রকিরা কি জানে নাকি? টেনশন নিস না, কিছু হবে না। আর আজকে তো এখানে রোজা আছে। তুই রোজার সাথে থাকবি সবসময় তাহলেই হলো!”

আহমেদ মনে মনে বলল,
“রোজা আছে দেখেই তো ভয়! এই মেয়েটাকে একদম বিশ্বাস নেই! যদি রোজার উপর নজর দেয়!কোনো ঝামেলা না হলেই হয়!”
আসলে এই সারিয়া টাকে তার বিপদের আরেক নাম মনে হয়!

এরই মধ্যে সবাই মিলে রেস্টুরেন্টে টেবিলে বসে পড়ল।আহমেদ রোজাকে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বসতে দিল, নিজেও রোজার পাশে বসলো। তাদেরকে দেখে সারিয়ার চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো। সে তো আজ শুধু মাত্র আহমেদকে সিডিউস করবে বলে এরকম খোলামেলা পোশাক পড়ে এসেছে। কিন্তু আহমেদ তো তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। সারিয়ার মেজাজটা তখন থেকে খারাপ হয়ে আছে। সে অগ্নি চোখে রোজার দিকে তাকাল। কিন্তু রোজা তো আহমেদের দিকে তাকিয়ে। সবাই খাওয়া শুরু করলে হঠাৎ আহমেদের ফোন বেজে উঠল। সে রোজার দিকে ক্ষমাপ্রার্থনায় ভরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
” তুমি একটু বসো। আমি কথা বলে আসছি।”
বলে ফোন কানে নিয়ে বাইরে চলে গেল। যাওয়ার আগে তৌসিফকে কিছু একটা ইশারা করে বলল।তৌসিফ মাথা নাড়িয়ে তাকে নিশ্চিন্তে থাকতে বলল।

এরই মধ্যে হঠাৎ আহমেদের এক ক্লাসমেট, রকি সারিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
“সারিয়া আর কতদিন এভাবে সিঙ্গেল থাকবি বলতো? তোর বিয়ে খাওয়ার ইচ্ছা কিন্ত আমাদের অনেক দিনের!”

সিয়ামও বলল,
” তাই তো! আর তুই না কার সাথে রিলেশনে গেলি! ব্রেকআপ হয়ে গেছে নাকি?”

সারিয়া দুঃখী কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ রে ব্রেকআপ হয়ে গেছে। ”

হঠাৎ রকির এক বন্ধু বলে উঠলো,
” একটা কথা বলি গাইস,,,,,”

সবাই তার দিকে উৎসাহের সাথে তাকালো। রোজাও তাকালো তার দিকে। সে বলে উঠল,
“আমাদের আহমেদ এবং সারিয়াকে কিন্তু বেশ মানায়! দুজন মিলে একটা চমৎকার জুটি হয়। কি বলিস তোরা?”

সবাই উৎফুল্লে বলে উঠল,” হ্যাঁ রে, তাইতো!” সারিয়া যেন বেশ খুশি হলো কথাটা শুনে!

রোজা যেন মুহূর্তেই স্থবির হয়ে গেল। কী শুনলো সে এটা? তার হৃদপিণ্ডের ধকধকানিটা হঠাৎ করেই থেমে যাওয়ার মতো অনুভব হলো। সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছিল না, যেন পুরো দেহ অবশ হয়ে গেছে। তার চোখের পলক একবারের জন্যও পড়ল না; সারিয়া এবং আহমেদের নাম একসাথে শুনে তার মনে হলো, যেন কেউ তার বুকের ভেতর ছুরি চালিয়ে দিয়েছে।

তৌসিফও হকচকিয়ে গেলো। এই মুহূর্তে সেরকম কিছু আশা করেনি! সে বড় বড় চোখ করে চুপসে যাওয়া রোজার দিকে তাকালো।

রোজার এই ব্যথার মধ্যেই আরেকজন বলে উঠলো,
” আরে আমি তো ভেবেছিলাম আহমেদ এবং সারিয়া রিলেশনে আছে। দুজনকে একসাথে যা মানায় না ভাই! কি আর বলবো! ”

সারিয়া লাজুক কন্ঠে বলে উঠল,
” আমিও তো তাই চাই রে! আমারও মনে হয় উই আর মেড ফর ইচ আদার! ”
শেষের কথাটা সারিয়া রোজার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বলল।

এদিকে তৌসিফের খাওয়া বন্ধ হয়ে আছে। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না! আসলে তৌসিফ ছাড়া আর কেউই জানে না যে আহমেদ রোজাকে ভালোবাসে। সবাই মনে করে আহমেদ রোজাকে বোনের মত দেখে!

রোজার হৃদয় ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে। আহমেদ আর সেই মেয়ের নাম একসঙ্গে আবার শুনে রোজার বুকের ভেতর যেন হালকা এক ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল। মুখে হাসির ছায়া টিকিয়ে রাখতে চাইলেও, তার চোখে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা নেমে এল। সে অনুভব করল, তার এতদিনের লুকানো ভালোবাসা যেন হঠাৎ করেই ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যেতে বসেছে।

এদিকে রকি আবার প্রথম দেখাতেই রোজা কে পছন্দ করে ফেলেছে। সে তো মনে মনে রোজাকে প্রপোজ করবে বলে ভেবে রেখেছে। রোজার সাথে কথা বলার অযুহাতে সে আবার রোজা কে বলে উঠলো,
” কি মনে হয় রোজা? আহমেদ এবং সারিয়াকে বেশ মানায় না?”

রোজা ম্লান চোখে হেসে বলল,
” হ্যাঁ! খুব মানায়!”

তৌসিফ অসহায় চোখে তাকালো রোজার দিকে। মেয়েটাকে এই মুহূর্তে দেখে তার খুব মায়া হচ্ছে! আসলে রকির সাথে তৌসিফের তেমন ভালো সম্পর্ক নেই, যে কারণে কিছু বলতে পারছে না! তাহলে এখনই গিয়ে তার মুখ ফাটিয়ে দিত!
এদিকে রোজা খুব কষ্ট করে নিজের চোখের পানি আটকে রেখেছে। তার জলে টইটুম্বুর মেঘলা চোখে যে কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে!

এর মধ্যে রকি আবারও সারিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” তুই চিন্তা করিস না তো! আহমেদ ফিরে আসুক! এখনই আমি তোর আর আহমেদের বিয়ের কথা বলব! কেন ও তোর মতো এত সুন্দরী, হ’ট একটা মেয়েকে বিয়ে করবে না বলতো? অবশ্যই একসেপ্ট করবে! টেনশন নিস না।”

সারিয়া লাজুক চোখে নিজের চুল কানে গুঁজলো আর বলল,
” আমার তো মনে হয় আহমেদও মনে মনে আমাকে পছন্দ করে। আসল বলতে পারেনা। ”

রকি বলল,
” হতেও পারে। আসুক তাহলে। আজ এর একটা দফারফা করতে লাগবেই! কি বলিস সবাই? ”

তৌসিফ এবং রোজা বাদে সবাই উৎফুল্লে সম্মতি জানালো। রোজার সহ্য সীমা বাইরে চলে গেল সবকিছু। আহমেদের উপর তার ভীষণ রাগ লাগছে। সে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো এবং সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“ভাইয়া আপনারা তাহলে ইনজয় করুন ।আমার একটু কাজ আছে। আমার এখনই বাড়িতে ফিরে যাওয়া দরকার।”

রকি বলে উঠলো,
“কেন রোজা? থাকো! এখনো তো কিছুই হলো না!”

রোজার সাথে সাথেই টেবিল থেকে এক গ্লাস জুস উঠিয়ে নিল এবং ঢকঢক করে পুরোটা খেয়ে ফেলল সে। এরপরে মুখ মুছে বলল,
” আবার কোনো একদিন হবে ভাইয়া। আমার এখন খুব যাওয়া দরকার। আসছি।”

কোন মতে এলোমেলো ভাবে কথাগুলো বলে তড়িঘড়ি করে সে হাতের ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রেস্টুরেন্ট থেকে। তৌসিফ আটকাতে গিয়েও আটকাতে পারল না।রোজা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর তৌসিফ সাথে সাথেই তার ফোন বের করে কিছু একটা টাইপ করলো।

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে রোজা ফুটপাতে হাঁটতে থাকল। তার ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। সে কখনোই এমন কিছু ভাবে নি! তার এখন মনে পড়ছে সেই দিনগুলোর কথা যখন সারিয়া সবসময় আহমেদ এবং তার মাঝে চলে আসতো! রোজা মনে মনে নিজেকেই ধিক্কার জানালো! আসলেই তো! আহমেদ কত বড় একজন স্ট্যাটাসের ছেলে! সে কত উচ্চবিত্ত ফ্যামিলির ছেলে! তার মতো একটা মধ্যবিত্ত মেয়ের সাথে তাকে তো কোনোভাবেই মানায় না! সে কিভাবে এরকম অসম্ভব চিন্তা ভাবনা করেছিল! কে জানে? বারবার চোখ মুছতে মুছতে রোজার চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে! আশেপাশে গাড়ি থাকলেও সে এখন হেঁটে হেঁটে বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা করলো!

কিছুক্ষণ পর আহমেদ যখন ফোনে কথা শেষ করে পার্টির ভেতরে ফিরে এল, চারপাশের উজ্জ্বল আলো আর মানুষের কোলাহলের মাঝে তার মন অস্থির হয়ে উঠল। কিছু একটা যেন ঠিক নেই। সবার মধ্যে হাসি-মজার ছড়াছড়ি, কিন্তু রোজার সেই শান্ত, নীল শাড়ির আভা খুঁজে পাচ্ছিল না সে। তার বন্ধুরা তখনও মজা করছিল।
রোজার চেয়ারটা খালি দেখে সে তৌসিফের কাছে গিয়ে উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ও কোথায়? ”

তৌসিফের বলার আগেই রকি বলে উঠল,
“ওর নাকি একটা কাজ আছে! এজন্য চলে গেল। তুই এইদিকে আয়। তোর সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”
সারিয়া লাজুক আসলো।

তৌসিফ সাথে সাথে আহমেদকে বলল,
” তোর ফোনে আমি একটা মেসেজ পাঠিয়েছি। একটু দেখ!”

আহমেদ সবার দিকে এক পলক তাকিয়ে ভ্রু কুচকে নিজের ফোনটা বের করে তৌসিফের পাঠানো মেসেজটা দেখল। ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখতেই তার বুকের ভেতর শূন্যতার ঝড় বয়ে গেল।এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল, যেন তার পা-দুটি মাটির সঙ্গে আটকে গেছে।

পুরো মেসেজটা ভালো করে পড়ে একটু পরে আহমেদ চোখ বন্ধ করে নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণ থমথমে কণ্ঠে ডেকে উঠলো,
“রকি! ”

সবাই তার দিকে তাকালো। আহমেদ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
” রোজা আমার ভার্সিটির জুনিয়র অথবা আমার শুধুমাত্র পরিচিত বলে আজ এখানে আসেনি। ”

সবাই ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রয়েছে আহমেদের দিকে। আহমেদ শক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
” রোজা আমার হবু বউ! ভালোবাসি আমি ওকে!”

সঙ্গে সঙ্গে সবার মাথায় যেন বাজ পড়লো, শুধুমাত্র স্বাভাবিক থাকলো তৌসিফ। আহমেদ আবারো বলে উঠলো,
” শুধুমাত্র তোদের জন্য হয়তোবা ও আজ আমাকে ভুল বুঝবে! ভালোবাসা পাওয়ার আগেই মনে হয় হারিয়ে ফেলবো! আর দয়া করে আমাকে নিয়ে সারিয়ার সাথে এরকম উদ্ভট মজা করাটা বন্ধ করো।সারিয়াকে আমি কখনো অন্যরকম চোখে দেখিনি। সারিয়ার সাথে আমার কিছুই নেই! আর না আমি সারিয়াকে পছন্দ করি!”

সিয়াম বলে উঠলো,
” তুই তো আমাদের এরকম কিছু বলিস নি আহমেদ! আমরা তো জানতাম না!”

সবাই সহমত প্রকাশ করল। তারা তো আসলেই জানতো না। তারা যদি জানত তাহলে কি তারা এমন করত? বরং তারা রোজা কে অনেক ভালো করে ট্রিট করতো! এদিকে সারিয়ার চোয়াল আবারও শক্ত হয়ে আসলো! তার মাথায় দপদপ করে আগুন জ্বলছে! যেই ভয়টা পাচ্ছিল সেটাই সত্যি হলো!

কারোর কথাই এখন আহমেদের কানে যাচ্ছে না। সে এখন শুধুমাত্র ভাবছে ওই পরিস্থিতির কথা! সবাই যখন তাকে আর সারিয়াকে নিয়ে এসব বলছিল, তখন রোজা নিশ্চয়ই চুপ ছিল! সে তো অনেক নরম মনের! সবাই মিলে ওকে অপমান করলেও তো সে কখনোই গলা উঁচু করে কিছু বলতে পারবে না! নিশ্চয়ই সে নীরব থেকে শুধুমাত্র কষ্ট পেয়েছে—এই ভাবনাই তার অন্তরকে ভেঙে চুরমার করে দিল। সে বুঝতে পারল, রোজা তার এই কষ্ট আর সহ্য করতে না পেরে চলে গেছে। হৃদপিণ্ড টা কেঁপে উঠল আহমেদের!

আহমেদ সবার উদ্দেশ্যে আবার বলল,
” আমাকে এখন যেতে হবে! তোরা ইনজয় কর!তৌসিফ কালকে দেখা হবে। হুমায়রাকে বাড়িতে পৌঁছে দিস।” বলেই আর এক মুহূর্ত সেখানে থাকলো না আহমেদ।
এক অজানা শঙ্কায় তাড়িত হয়ে আহমেদ দ্রুত বাইরে ছুটল, কিন্তু রোজা কোথাও ছিল না। চারপাশের পথ ঘাট ফাঁকা, রাতের হালকা হাওয়া তার শ্বাসকে ভারী করে তুলছিল। আহমেদ সিওর রোজা এখন কোনো রকম ট্যাক্সি নিয়ে তাহলে যেতে পারবে না! সে নিশ্চয়ই হেঁটে এদিকে গিয়েছে!

আহমেদ রাস্তা ধরে ছুটতে লাগল। প্রতিটি মুহূর্ত তার কাছে এক শাস্তির মতো লাগছিল। রোজার স্তব্ধ মুখ, তার চোখের সেই নীরব ব্যথা—সবকিছু তার মনে ভেসে উঠছিল। সে তো আসলেই মেয়েটাকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। তার আগেই সব কিছু বলা উচিত ছিল। “আমি কেন আগে কিছু বলিনি?”—এই প্রশ্নটা যেন তার মনের প্রতিটি কোণে আঘাত করতে লাগল। সে জানত, আর কোনো সময় নষ্ট করা চলবে না। আজকেই তাকে বলতে হবে—তার সমস্ত ভালোবাসা, তার মনের গভীরের অনুভূতি।

বেশ কিছুটা পথ পেরিয়ে, আহমেদ অবশেষে রোজাকে খুঁজে পেল। রোজা দ্রুত গতিতে হেঁটে যাচ্ছে। আহমেদ আর বেশি দেরি না করে দ্রুত গতিতে রোজার পিছে পিছে চলে গিয়ে রোজার হাত ধরল আর বলল,
” রোজা দাঁড়াও! কথা আছে তোমার সাথে।”

রোজার মনে খুব ভালো করেই অভিমান জেঁকে বসে ছিল।সে বলল,
“আমরা পরে কথা বলি। এখন বাড়ি যেতে হবে।”

আহমেদ অবাধ্য হয়ে তার হাত আরো বেশি করে চেপে ধরে তাকে সামনে ঘুরিয়ে বলল,
” নাহ! আজকেই বলব। এমনিতেই অনেক দেরি করে ফেলেছি। তুমি একটু কথাটা শোনো আমার। আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আমি এক্ষুনি বলবো। একটু কথাটা শোনো প্লিজ! ”

রোজা আর সহ্য করতে না পেরে ঝাড়ি মেরে আহমেদের কাছ থেকে তার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে কান্না করতে করতে বলে উঠলো,
” আপনাকে কিছু বলতে লাগবেনা! আমি জানি! আমি জানি আমি ভুল করেছি! আমার চিন্তা ভাবনা ভুল ছিল! আমি খুব ভালো করেই জানি যে আমি আপনার সাথে যাই না! আপনার লেভেল, স্ট্যাটাস অনেক উঁচু! আমার মত এত মধ্যবিত্ত একটা ফ্যামিলির মেয়েকে আপনার সাথে মানায়না,আমি খুব ভালো করেই জানি। ”

আহমেদ নীরব থেকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো রোজার দিকে। রোজা আবারও নাক টেনে বলল,
“আমি এটাও জানি যে সারিয়ার সাথে আপনাকে অনেক ভালো মানায়। সারিয়া অনেক বড় লোকের মেয়ে, তার অনেক কিছু আছে, দেখতে সুন্দরী, স্মার্ট, বুদ্ধিমতী! অন্তত আমার মত বোকা না! আমি খুব ভালো করেই জানি! আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিতে লাগবেনা! ”

আহমেদ এখনো নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে রোজার দিকে। তার প্রিয়তমা কত সহজ সরল মনে গড়গড় করে সবকিছু বলে দিচ্ছে তাকে। আবার চোখ ঘষতে ঘষতে একদম লাল বানিয়ে ফেলেছে মেয়েটা! শুধুমাত্র চোখ নয়, কাঁদতে কাঁদতে পুরো মুখ লাল হয়ে গিয়েছে! ফর্সা ত্বকে লাল আভাটা একদম ফুটে উঠেছে।

আহমেদের ইচ্ছা করলো একটু ছুঁয়ে দিতে। একটু ভালোবাসার পরশ এঁকে দিতে! কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি নেই! এই কারণে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল সে।

রোজার কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে। সে আবারো চোখ মুছে হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল,
” আমি ভুল করেছি। আমার চিন্তা ভাবনা ভুল ছিল। আপনাকে আর কিছু বলতে লাগবে না। আর আমি জানি আপনাদের দুজনকে অনেক ভালো মানাবে। এটাও জানি যে আপনারা মেড ফর ইচ আদার!”

আহমেদ একইভাবে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলো,
” তোমার তাই মনে হয়? ”

রোজা তড়িৎ গতিতে বলে উঠলো,
” তাছাড়া আর কি? ”

আহমেদ মুচকি হেসে রোজার বাহু টেনে ধরে তাকে নিজের বুকে ফেলে দিল। রোজা তাল সামলাতে পারল না। হুমড়ি খেয়ে তার ছোট্ট দেহখানা আহমেদের বুকের উপর পড়লো। আহমেদ তার মাথাটা নিজের বুকের ঠিক বাম পাশে চেপে ধরে বলল,
” একদম নড়বে না! ”

চলবে…………………….

*বিশেষ দ্রষ্টব্য: প্রিয় পাঠক মহল, আহমেদের ভালবাসা প্রকাশ করাটা আজকের পর্বেই দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পর্ব টা দেখছি অনেক বড় হয়ে গেছে।🫠 আগামী পর্বে তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করব ইনশাআল্লাহ 🥹 কালকের পর্ব টা বেশ রোমান্টিক হবে🙂 আহমেদ এবং বর্তমানের কঠিন ব্যক্তিত্বের রোজার অতীতটা অনেক কিউট তাই না!🥹

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here