#বিস্মৃতির_মাঝে_তুমি_আমি
#পর্ব_২
#লেখিকা_অনামিকা_তাহসিন_রোজা
এয়ারপোর্টর স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলতেই ধীরে ধীরে বাইরে পা রাখে এক রমণী। যার চোখে আত্মবিশ্বাসের ঝলক, কিন্তু আড়ালে লুকিয়ে থাকা আন্ডারকভার পরিচয়ের গোপন গাম্ভীর্য। সে এয়ারপোর্টের স্বচ্ছ দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলে সূর্যের আলো তার মুখে পড়ে। সাদা শার্টে তাকে যেন আরও দৃঢ় ও আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে। শার্টের সিম্পল, পরিপাটি কাট আর তার ওপর খাপে খাপে বসা বডি-ফিটেড ডিজাইন তার ব্যক্তিত্বকে আরও জোরালো করে তুলেছে। হাতে ধরা কালো ট্রলিং লাগেজের হ্যান্ডেল ধরে সে দৃঢ় পায়ে সামনে এগিয়ে চলে, যেন তার প্রতিটি পদক্ষেপেই আত্মবিশ্বাসের ছাপ ফুটে উঠছে।
চুলগুলো ঘাড়ের নিচে পর্যন্ত, বিনা ঝামেলায় সেট করা, যা তার কার্যক্ষমতা ও পেশাগত মনোভাবের প্রতিফলন। তার চোখে এক অদম্য তীক্ষ্ণতা, যেন যে কোনো পরিস্থিতিকে সামাল দিতে সে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। চারপাশের মানুষের ভিড় তাকে প্রভাবিত করতে পারে না—তার ফোকাস স্পষ্ট।
তার স্ট্রং পার্সোনালিটি আশপাশের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কেউ তার দিকে তাকালে নীরব সম্মান আর মুগ্ধতা চোখে পড়ে। তার হাঁটা, তার শরীরের ভাষা—সবকিছুতেই দৃঢ়তা আর আত্মবিশ্বাসের এক গভীর ছাপ। হ্যাঁ, এই রমণীই হলো আন্ডারকভার টিমের লিডার এ.জে.রোজা!
অহনা দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায়। তার পিছু পিছু সবাই আসে। সবাই রোজার কাছে এসে একসাথে বলে,
” Good morning mam!”
রোজা চোখের সানগ্লাস টা খুলে মুচকি হেসে বলে,
” Good morning guys! কী অবস্থা সবার!”
রিয়াদ হেসে বলে,
“খুব ভালো ম্যাডাম। আপনাকে দেখে তো আরো ভালো লাগছে!”
অহনা রোজার হাত থেকে লাগেজ টা নিতে নিতে বলে,
” আপনার আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো ম্যাডাম? শুনলাম ফ্লাইট টেইক অফ করতে লেট হয়েছিলো।”
” নাহ্! সমস্যা হয়নি!”
নাহিদ এবার মিনমিন করে এগিয়ে এসে ফুলের মালাটা রোজার গলায় পরিয়ে দিলো আর ফুলের তোড়াটাও এগিয়ে দিলো। রোজা হাসিমুখে বলল,
” তুমি আর বড় হলে না নাহিদ !”
নাহিদ মাথা চুলকে হাসলো।
এইবার রোজার চোখ গেলো নূরার ওপর। নূরা কে দেখিয়ে রোজা ভ্রু কুচকে অহনাকে বলল,
” এই মেয়েটা …….!”
রিয়াদ বলল,
” অহ্ হ্যাঁ, ম্যাডাম গত সপ্তাহে জয়েন করেছে। আমাদের টিমে নতুন মেম্বার! নাম হলো নূরা, বাড়ি সিলেটে।”
অহনা এবার বলল,
” ম্যাডাম আপনি যে নতুন একজন কে নিতে বলেছিলেন। এই কারণে নূরাকে নিয়েছি। আমাদের থেকে একটু জুনিয়র, কিন্তু খুবই দক্ষ! আমার মনে হয় ওর কাজে আপনি নিরাশ হবেন না!”
রোজা বলল,
” হুম, ভালো করে যাচাই করেছো তো?”
অহনা বলল,
“ইয়াহ্ ম্যাম সিউর। আর ওর মধ্যে অনেক দক্ষতা রয়েছে, যা আমাদের মধ্যে খুব একটা নেই!”
রোজা ভ্রু কুচকে বলল,
“যেমন?”
” হ্যাকিং করতে পারে, অভিনয় করতে পারে, দরজার লক চাবি ছাড়া খুলতে পারে, বাংলা-ইংরেজি ছাড়াও আরো তেরোটি ভাষায় কথা বলতে পারে। আবার অফিশিয়াল কাজও ভালোই করতে পারে। ওর টার্গেট অনেক ভালো, অনেক দূর থেকেও বন্দুক টার্গেট করতে পারবে। ”
রোজা মাথা নেড়ে বলে,
” গুড চয়েজ ! এরকমই একজন দরকার ছিলো।”
এরপর রোজা নূরার দিকে তাকিয়ে বলে,
” বেস্ট অফ লাক!”
নূরা ভদ্রতার সহিত উত্তর দেয়,
“Thank you mam!”
রিয়াদ তাড়াহুড়ো করে বলল,
” ম্যাডাম আপনি তো মনে হয় সকালে কিছু খাননি। চলুন তাড়াতাড়ি। আর দেরি করা ঠিক হবে না।”
সবাই সহমত পোষণ করলো।
<<<<<<<<<<<<<<<>>>>>>>>>>>>>>>
আহমেদ বারান্দায় বসে গিটার হাতে নিয়ে টুংটাং আওয়াজ করেই যাচ্ছে। আগামীকাল গান রেকর্ডিং এর জন্য তার এখন গান প্রাকটিস করা প্রয়োজন। কিন্তু কোনোভাবেই সে মনোযোগ দিতে পারচ্ছে না। বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে কোনো এক অজানা কারণে। কিছুক্ষণ পর দরজায় সৌরভ নক করলো। আহমেদ বলল,” এসো।”
সৌরভ আস্তে করে দরজা ঠেলে হাতে কিছু কাগজপত্র নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। আহমেদের কাছে গিয়ে কাগজগুলো এগিয়ে দিয়ে বলল,
” স্যার এখানে কালকের জন্য গানের লিরিক্স আছে আর বাকি দুটো কাগজ প্রোডিউসার স্বপন দিয়ে গিয়েছে যেটাতে তাদের নতুন সিনেমাটার জন্য গানের লিরিক্স আছে। উনি বলেছেন আপনি চাইলে গানের কথাগুলো আপনার পছন্দমতো পরিবর্তনও করতে পারেন। আর গানের ক্যাটাগরি হবে রোমান্টিক।”
আহমেদ গিটারটা সাইডে রেখে কাগজপত্র গুলো হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে থাকলো। সৌরভ কিছু বলার জন্য উশখুশ করতে থাকলো। আহমেদ সেটা খেয়াল করে বলল,
“কিছু বলবে সৌরভ?”
সৌরভ ধীরেসুস্থে বলল,
” একটু আগে খবর পেলাম।ম্যাম ঠিকমতো বাড়িতে পৌঁছে গেছে স্যার। আর রিয়াদ ভাই বলল ম্যাম নাকি অন্য কোনো কারণে দেশে এসেছেন। আগামী এক বছরে কাজ না থাকলে দেশের বাইরে যাওয়ার সম্ভাবনাও নেই।”
আহমেদ মনোযোগ দিয়ে শুনলো সৌরভের কথা। তারপর একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
” তোমার কী মনে হয়েছিলো তোমার ম্যাম আমার জন্য দেশে ফিরেছে?”
সৌরভ সরল মনে উপরনিচ মাথা নাড়লো। সে তো সত্যিই তাই ভেবেছিলো।
আহমেদ হাতে থাকা কাগজপত্র গুলো গিটারের উপরে রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তোমার ম্যাম আমার জন্য দেশে ফিরেনি সৌরভ। ও দেশে ফিরেছে অন্য কাজে। এটা আমি আগে থেকেই জানি। তবে এটা সত্যি তোমার ম্যাম কে দেশে আনার জন্য আমি একটা কাজ করেছি।”
“কী করেছেন স্যার?”
“একটা কথা শোনোনি? কান টানলে মাথা আসে। বিষয়টা তেমনি। তোমার ম্যাম যাকে পুরো পৃথিবীতে তন্নতন্ন করে খুঁজছিলো, যাকে খোঁজার জন্য প্রতি মাসে একটা করে দেশে যেত,সেই মানুষটার দেশে আসার ব্যবস্থা আমি গত সপ্তাহে করে দিয়েছি। হয়তোবা সে চলেও এসেছে। আর এই খবর পেয়েই তোমার ম্যাম দেশে ফিরেছে।”
সৌরভ কৌতূহলী মন নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“সে কে স্যার?”
আহমেদ একবার সৌরভের দিকে তাকিয়ে আবারো বারান্দা থেকে ব্যস্ত শহরের দিকে তাকিয়ে বলল,
” জেকে ! জাভেদ রায়ান খান ! ”
<<<<<<<<<<<<<<<<>>>>>>>>>>>>>>>>>>>
বিছানার ওপর বসে এক হাতে কফির কাপ নিয়ে, আরেক হাত দিয়ে ল্যাপটপের কিবোর্ড টাইপ করচ্ছে রোজা। গত এক ঘন্টা ধরে সে জাভেদ রায়ানের সব ডিটেইলস চেক করচ্ছে। কিন্তু কোনোভাবেই তার কাঙ্খিত তথ্য টি খুঁজে পাচ্ছে না! একটু পরেই অহনা হাতে কিছু ফাইল নিয়ে হাজির হলো রোজার ঘরে।
অহনা, রিয়াদ, নাহিদ আর নূরা সবাই রোজার বাড়িতেই থাকে। আসলে শুধু তারাই নয়, তাদের টিমে যারা আছে সবাই এক বাড়িতেই থাকে। বাড়িটা বড় হওয়ায় সবাই স্বাচ্ছন্দ্য থাকতে পারে। সবারই আলাদা ঘর রয়েছে। তবে রোজা মাঝে মাঝে একা তার নিজস্ব ফ্লাটে গিয়ে থাকে। কিন্তু কোনো কেস হাতে থাকলে এই বাড়িতেই থাকে। এ বাড়িতে তাই সার্ভেন্টস, বডিগার্ড আর সিকিউরিটি গার্ডেরসংখ্যা অনেক বেশি!
অহনা হাতে থাকা ফাইল গুলো রোজার বিছানার পাশে দিয়ে বলল,
“ম্যাম আপনার অনুপস্থিতিতে আমরা সাধ্যমতো কেস সলভ করেছি। কিন্তু এই কয়েকটা কেস একটু বেশি কম্পলিকেটেড। এগুলো পেন্ডিং রয়ে গেছে!”
রোজা কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে ফাইলগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,
” কয়টা রয়েছে?”
” ম্যাম ছয়টা !”
রোজা ল্যাপটপে টাইপ করতে করতেই বলল,
” আমাকে কেস গুলোর মূল থিম গুলো বলো।”
” সিউর ম্যাডাম!” বলেই অহনা ফাইলগুলো হাতে নিয়ে রোবটের মতো বিরতিহীন ভাবে বলতে থাকলো,
“কেস নাম্বার ওয়ান- সু’ই’সা’ইড কেস, ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্ম’হ’ত্যা করেছে, কিন্তু পরিবারের দাবি এটা মা’র্ডা’র।”
রোজা কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
” নেক্সট?”
” কেস নাম্বার টু- ছাদে লা’শ পাওয়া গেছে, লা’শের বুকে ছুরি মা’রা হয়েছে। কিন্তু আশেপাশে কোথাও অ’স্ত্র পাইনি। কেস নাম্বার থ্রি- ড্রেনে একটা লা’শ পাওয়া গেছে, লা’শটা অনেকদিনের। এই কারণে চেহারা নষ্ট হয়ে গেছে। পরিচয় পাওয়ার জন্য তেমন কিছুই পাইনি। আর কেস ফোর ফাইভ একই। চুরির কেস। হাইস্কুলের এক টিচারের বাড়িতে আর একজন ব্যাংকারের বাড়িতে একই রাতে চুরি হয়েছে। আর কেস নাম্বার সিক্স- একই বাড়িতে থাকা কলেজপড়ুয়া দুই ভাইকে খু’ন করা হয়েছে।”
কফির কাপটা সাইডে রেখে রোজা বলল,
” এখানে আমার কাছে কম্পলিকেটেড মনে হয়েছে শুধু দুটো কেস। একটা হলো ড্রেনে পাওয়া লা’শ আরেকটা ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্ম’হ’ত্যা! এই দুটো কেস আমি দেখব। কিন্তু বাকি কেস গুলো তোমার চারজন সামলাবে। এগুলো একটু সহজ।”
অহনা মাথা নাড়লো। আর অসহায় হয়ে বলল,
” ম্যাম আমরা তো চেষ্টা করেছিলাম, কোনো ক্লুই পাইনি।”
রোজা মুচকি হেসে বলল,
” অহনা, আমি চাইলেই এই সব কেস হ্যান্ডেল করতে পারি। কিন্তু আমি ইচ্ছে করে তোমাদের দিচ্ছি। কারণ আমি চাই না যে তোমরা আমার ওপর এতোটাই নির্ভরশীল হয়ে পরো যে আমাকে ছাড়া একদম দুর্বল হয়ে পড়বে। আমার অনুপস্থিতিতেও তোমরা যেনো দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারো, সেটাই আমি চাই। মনে করো, বাই এনি চান্স, আমি কোনো বিপদে পড়লাম বা আমার কিছু হয়ে গেলো। তখন তোমরা কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে না?”
অহনা মাথা নেড়ে বলল,
” অবশ্যই চেষ্টা করব ম্যাম। জীবন দিয়ে চেষ্টা করব। ”
রোজা শান্ত কন্ঠে বলল,
“সেটার জন্য তো তোমাদের তৈরি হতে হবে। একটা হাতের বুড়ো আঙুল ভেঙে গেলেও কিন্তু বাকি আঙুল গুলো কাজ করে অহনা। আমিও চাই আমার অনুপস্থিতিতে তোমরাও সেভাবে কাজ করো। তোমাদের শেখানোটাই আমার মূল উদ্দেশ্য। বুঝেছো ?”
অহনা বলল,
” জ্বী ম্যাম। বুঝতে পেরেছি।”
রোজা বলল,
” এই কেস গুলোর মধ্যে সবচেয়ে সহজ কেস হলো চুরির দুটো কেস। আমাদের যেই নতুন মেয়েটা এসেছে, নূরা। তাকে এই কেস গুলো হ্যান্ডেল করতে দেবে। তোমরাও সাহায্য করো, কিন্তু ওর দক্ষতা কাজে লাগাতে দেবে।আমি দেখতে চাই তোমরা পারো কিনা!”
“সিউর ম্যাম!”
রোজা আবারো ল্যাপটপে কাজ করতে শুরু করলো। অহনা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” ম্যাম আপনি কী খুঁজছেন তখন থেকে?”
রোজা চিন্তিত স্বরে বলল,
” জেকে এর দেশে ফিরে আসার কারণটা খুঁজছি অহনা। দেশে তো ওর এখন কোনো কাজই নেই,তাহলে কেনো ও দেশে আসলো। এভাবে নিজে থেকে শিকারির ফাঁদে পা দেওয়ার মতো ওতো গাধা ও নয়। হঠাৎ করে দেশে ফিরে আসার কারণটা কী?”
“আমরাও এ বিষয়ে খোঁজ নিয়েছি ম্যাম। কিন্তু সন্দেহজনক কিছু পাইনি!”
রোজা আরো চিন্তায় পড়ে গেল। নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে এর পেছনে। যে করেই হোক তাকে জানতে হবে।
চলবে………………….
–<-আমার ফোনে একটু সমস্যা হয়েছে পাঠকগণ😥! এঈ জন্য পর্ব ছোট হচ্ছে। পরশু থেকে বড় পর্ব আসবে ইনশাআল্লাহ্ 😊