#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_4
#ইয়াসমিন_খন্দকার
নিঝুম অবাক চোখে তার বড় চাচি ছবি বেগমকে দেখছিল। ছবি বেগম একটা মৃদু হাসি দিয়ে বলেন,”দাঁড়িয়ে আছ কেন? নিজের সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। তারপর তোমার মাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলো।”
নিঝুম হতবাক হয়ে বলে,”আপনাদের বাড়িতে?!”
ছবি বেগমের মুখের হাসি চওড়া হয়। তিনি বলেন,”শুধু আমার নয় ওটা এখন তোমারও বাড়ি। হাজার হোক তুমি ঐ বাড়ির বড় ছেলের বউ।”
নিঝুমের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে ছবি বেগমের কথা শুনে। মনে পড়ে যায় আবরাজের করা ব্যবহার গুলো। তাই তো সে বলে,”যেখানে স্বামীরই কাছে মর্যাদা পাইনি সেখানে আবার শ্বশুর বাড়ি! যেই স্বামী বিয়ের পর তার বউকে রাতের আধারে একা মাঝরাস্তায় ফেলে যায় সেই বিয়ের কি আদৌ কোন মূল্য আছে চাচি?”
নিঝুমের এহেন কথা ছবি বেগমের হৃদয়ে দোলাচল সৃষ্টি করে। অতীতের কিছু বিভৎস দৃশ্য তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিভাবে তিনি ৫ বছর বয়সী ছোট্ট আবরাজকে তার ঘর থেকে টেনে টেনে বের করে দিয়ে বলেছিলেন,”তোর মা মরে বিদায় হয়েছে এবার তুইও বিদায় হ। তুই আমার নিজের পেটের ছেলে নস। তাই তোর কোন দায়িত্ব আমি নিতে পারব না।”
৫ বছর বয়সী ছোট্ট আবরাজ সেদিন ছবি বেগমের পায়ের কাছে বসে আলতো স্বরে বলেছিল,”আমি কোতায় যাব? আমাকে এবাবে বের করে দিও না নতুন মা।”
কিন্তু হিংসা ও ক্রোধে অন্ধ ছবি বেগমের মন সেদিন নিজের স্বামীর প্রথম স্ত্রীর ঘরের এই নিষ্পাপ সন্তানের আকুল আবেদনও গলাতে পারে নি। চরম নির্দয়তা দেখিয়ে তিনি নিজের স্বামীকে বলেছিলেন,”এই ছেলে যদি এই বাড়িতে থাকে তাহলে আমি তোমার সাথে সংসার করব না। একে এক্ষুনি বের করো এখান থেকে।”
স্ত্রীর ভালোবাসায় অন্ধ আলমগীর খান সেদিন তার কথা রাখতে গিয়ে নিজের রক্তের সাথে বেইমানি করল। আবরাজকে বাড়ি থেকে বের করে অবস্থায় তার কম স্বচ্ছল ছোট ভাইয়ের কাছে রেখে আসল৷ যদিওবা নাজমুল খান এমনিতে আবরাজের দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি। আলমগীর খান ব্যবসা করে ভালো টাকা জমিয়েছিলেন অপরদিকে নাজমুল খান অন্যের জমিতে বর্গা দিতেন। সেই সময় আলমগীর খান এজন্য নিজের ছোট ভাইকে লোভ দেখান যে যদি সে আবরাজের দেখাশোনা করে তবে তাকে অনেক টাকা-পয়সা দেবে। এই লোভেই তো নাজমুল খান রাজি হয়েছিলেন। তবে সেকথা তিনি কখনো আবরাজ বা তার মামাকে জানান নি৷ বরং এমন একটা ভাব নিয়ে থেকেছেন যেন তার আবরাজ এর প্রতি দয়া হয়েছিল আর সেজন্যই তিনি আবরাজ এর দেখভাল করেছেন।
নিজের অতীতের এসব কথা ভেবেই ছবি বেগমের দুচোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়। আজ এসব মনে পড়লেই নিজেকে বড্ড বেশি জালিম মনে হয় তার। অল্পবয়সে তার বাবা তাকে এক বিপত্নীক পুরুষের সাথে বিয়ে দেয়। ১৬ বছর বয়সী ছবি বেগম সেটা সহজে মেনে নিতে পারেন নি। তার মনে হয়েছিল তার সাথে অন্যায় হচ্ছে। তাই বিয়ের পর যখন দেখল তাকে একটা ছোট বাচ্চার দায়িত্বও নিতে হবে তখন সেই ক্রোধ আরো বেড়ে গেছিল। আর এই সেই সব ক্রোধ গিয়ে পড়ে ছোট্ট আবরাজের উপর।
অতীতের কৃতকর্মের জন্য যথেষ্ট অনুতপ্ত তিনি। এর জন্য শাস্তিও পেয়েছেন। আর এবার আর নতুন কোন অন্যায় হতে দিতে তিনি রাজি নন। তাই তো এসে দাঁড়ালেন নিঝুমের পাশে।
এরইমধ্যে আসমানী বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে ছবি বেগমকে দেখে বললেন,”ভাবি আপনি!”
“হ্যাঁ, আমি। তোমাকে আর তোমার মেয়েকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে এলাম। তোমার মেয়ে তো এখন আমাদের বাড়ির বউ। আমাদের বাড়ির বউ এভাবে বাইরে বাইরে ঘুরবে সেটা কি ভালো দেখায়?”
আসমানী বেগম আমতা আমতা করে বলেন,”কিন্তু এই বিয়েটা তো..”
ছবি বেগম মাঝপথেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,”বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেন হয়েছে তো। এটা অস্বীকার করার তো কোন উপায় নেই।”
“তা ঠিক তবে…”
“ব্যস, এই নিয়ে আর কোন কথা শুনতে চাই না। এভাবে আর কতদিন অন্যের ঘরে পড়ে থাকবে? আর এই বিয়ের কথা নাহয় বাদ দিলাম। তাছাড়াও তো আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। তুমি আমার ছোট যা হও। সেই সম্পর্কের খাতিরেই নাহয় চলো।”
দিশেহারা আসমানী বেগম যেন একটা পথের দিশা খুঁজে পেলেন। ছবি বেগম যেন তার সামনে সাক্ষাৎ ফেরেশতা হয়ে উদয় হলেন। মেয়েকে নিয়ে অন্তত কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই তো পেলেন! তাই আর আপত্তি করলেন না। বললেন,”বেশ, চলুন তবে।”
নিঝুমের অবস্থাটাও অনেকটা মায়েরই মতো। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে রাজি হলো ছবি বেগমের সাথে যেতে। তবে নিঝুম এটাও ঠিক করে নিয়েছে জোর করে সে আবরাজের বউয়ের অধিকার নেবে না। আবরাজ যদি তাকে স্বীকৃতি দেয় তবেই সে এই সম্পর্ককে মান্যতা দেবে নচেত নয়। এতটুকু আত্মসম্মান অন্তত তার আছে।
~~~~~~~~~~~~~~~~
সকাল সকাল জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে নিজের রুমে আবিষ্কার করে আবরাজ। গতকাল রাতে অতিরিক্ত মদ্যপানের জন্য সে একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে৷ সকালে উঠেই মাথায় তীব্র ব্যথা অনুভব করে আবরাজ। সে মাথা চেপে ধরে বসে থাকে এমন সময় কেউ এসে তার সামনে এক কাপ কফি এগিয়ে দেয়। আবরাজ মাথা তুলে হতবাক স্বরে বলে,”এলা তুমি!”
এলা স্মিত হেসে বলে,”কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
“তুমি এখানে কি করছ?”
“আমি আর ম্যাক্স মিলে কাল রাতে তোমায় বাসায় নিয়ে এসেছি। নাহল তোমার যা অবস্থা ছিল। কাল রাতে আমরা তোমার বাসাতেই ছিলাম। সারারাত মুভি দেখে কাটিয়েছি। ভোর হতে হতেই ম্যাক্স ঘুমিয়ে পড়ে। তবে আবার কেন জানি ঘুম পায়নি। তাই কফি বানাতে চলে গেলাম। নিজেও খেলাম আর তোমাদেরও জন্যেও নিয়ে এলাম।”
ম্যাক্স কক্ষে প্রবেশ করতে করতে বলে,
“খেয়ে দেখ, কফিটা কিন্তু খুব সুন্দর হয়েছে।”
আবরাজ কফিতে চুমুক দিয়ে বলে,”আসলেই ভালো হয়েছে।”
এলা আবরাজের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তোমার এরপরের প্ল্যান কি আবরাজ?”
“কোন ব্যাপারে?”
“ম্যাক্সের কাছে কাল আমি সব শুনেছি৷ তুমি এই বিয়েটা নিয়ে কি ভাবছ?”
আবরাজ শক্ত কন্ঠে বলে,’এই বিয়েটা আমি মানি না। যদি প্রয়োজন হয় তো আমি মেয়েটাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেব।’
এলা রাগী কন্ঠে বলে,”এটা তুমি একদম ঠিক কাজ করছ না। এভাবে একটা মেয়ের জীবন কেন নষ্ট করতে চাইছ? আমি তোমাদের দেশের কালচার সম্পর্কে জানি সেখানে মেয়েদের জীবন কেমন তাও জানি। তাই বলছি এভাবে মেয়েটার সাথে অন্যায় করো না।”
আবরাজ এলার এহেন আচরণের কারণ জানে। এলা মেয়েটা প্রচণ্ড নারীবাদী স্বভাবের। লন্ডনে ও একটা নারী অধিকার সংগঠনের কর্ণধারও। তাই ওর অনুভূতি আবরাজ বুঝতে পারে। তবুও নিজের স্বপক্ষে বলে,”আর আমার সাথে যে প্রতারণা হয়েছে সেটাকে তুমি কি বলবে? মেয়েটা ঠকিয়েছে আমায়।”
এলা বলে,”এটা তুমি এত নিশ্চিত ভাবে বলতে পারো না যে মেয়েটা তোমায় ঠকিয়েছে। আগে সত্যটা জানার চেষ্টা করো।”
“কোন সত্য জানার নেই আমার। যা বলার বলে দিয়েছি।”
এলা ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে যায়। মেয়েদের প্রতি কোন অন্যায়ই সে মেনে নিতে পারে না। এলাকে বোঝানোর জন্য ম্যাক্স তার পেছন পেছন ছোটে। এদিকে আবরাজের এবার একটু হলেও টনক নড়ে। সে এলার বলা কথাগুলোই ভাবতে থাকে। হঠাৎ তার মনে প্রশ্ন আসে,”এমন কি হতে পারে যে ঐ মেয়েটা মানে নিঝুমও পরিস্থিতির স্বীকার?”
#গল্পঃঅশ্রুজলে
to be continue…..