অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে #Part_1 #ইয়াসমিন_খন্দকার

0
5

বিয়ের আসরে বরের স্থলে নিজের চাচাতো ভাই আবরাজকে দেখে চরম পর্যায়ের অবাক হয়ে গেল নিঝুম। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো শেরওয়ানি পরিহিত আবরাজের দিকে। আবরাজও ঠিক একইভাবে অবাক চোখে তাকালো নিঝুমের দিকে। নিঝুমকে ভালো ভাবে পরখ করে যখন তাকে বধূবেশে দেখলো তখন আবরাজ চরম পর্যায়ের রেগে গেলো। নিজের মাথা থেকে বিয়ের পাগড়িটা খুলে দূরে ছিটকে ফেলে বলে,”অসম্ভব,আমি কিছুতেই এই বিয়েটা করতে পারবো না। চাচা, তুমি তো বলেছিলে অনেক ভালো একটা মেয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছ, তাহলে এসবের মানে কি?”

আবরাজের মুখে এহেন কথা শুনে নিঝুম কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো এককোণায়। বোঝার চেষ্টা করলো পরিস্থিতির জটিলতা। একবার নিজের মা আসমানী বেগমের দিকে তাকাতেই দেখলো পেলো তার মায়ের চোখে ফুটে ওঠা অসহায়ত্ব।

অন্যদিকে, নিঝুমের বাবা নাজমুল খান এগিয়ে এসে আবরাজের উদ্দ্যেশ্যে বললেন,”তুমি এখন এভাবে কথা বলতে পারো না আবরাজ। এই বিয়েটা তোমায় করতেই হবে। ভুলে যেও না, তুমি আজ যেখানে পৌঁছাতে পেরেছ তার পেছনে আমার অবদান কতটা।”

আবরাজ রেগে বলে,”তার প্রতিদানে কি আমার এখন তোমার এই গাঁইয়া, আনস্মার্ট, আটকালচার মেয়েকে বিয়ে করতে হবে চাচা? আমি তো নিজের যোগ্য একটা মেয়ে খুঁজছিলাম। আর তুমিও তো আমাকে অন্য একটা মেয়ের ছবি দেখিয়েছিলে। তাহলে বিয়ের আসরে তোমার মেয়ে কেন? শুধু তোমার উপর ভরসা করে আমি এই বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম। কারণ ভেবেছিলাম, তুমি আমার ভালোটাই চাইবে। কিন্তু এটা কি ধরনের জোচ্চুরি?”

“ভদ্রভাবে কথা বলো আবরাজ! আমাকে তুমি এভাবে বলতে পারো না।”

আবরাজ গর্জে উঠে বলে,”এর থেকে ভদ্রভাবে কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয় চাচ্চু।”

এত চিৎকার চেঁচামেচিতে নিঝুম এককোণে অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে কেউ খেয়ালই করছে না। নিঝুম আলতো পায়ে হেঁটে একটু দূরে সরে আসল। ভাবতে লাগল, সে কি এতটাই অযোগ্য যে কারণে আবরাজ তাকে এভাবে অপমান করছেন?

নিঝুম তাদের গ্রামের একটি কলেজে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়াশোনা করে। পড়াশোনায় সে যথেষ্ট ভালো, এসএসসি পরীক্ষায় বোর্ড বৃত্তিও পেয়েছিল। সিলেট শহরের অনেক ভালো কলেজে পড়ার সুযোগও পেয়েছিল কিন্তু নাজমুল খান নিঝুমকে শহরে পাঠাতে চান নি তাই গ্রামেই পড়াশোনা করতে হচ্ছে।

অপরদিকে নিঝুমের চাচাতো ভাই আবরাজ খান। সে যখন অনেক ছোট ছিল তখন তার মা মারা যায়। এরপর তার বাবা মানে নিঝুমের বড় আব্বু দ্বিতীয় বিয়ে করে তার নতুন সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আবরাজ এর দায়িত্ব নেন নিঝুমের বাবা। তবে নিঝুমের বাবাও খুব বেশি স্বচ্ছল ছিলেন না। এমতাবস্থাতেও তিনি কয়েক বছর আবরাজকে সামলান। এরপর একদিন আবরাজ এর মামা যিনি লন্ডন প্রবাসী তিনি দেশে আসেন এবং আবরাজ ভাইয়াকে নিজের সাথে লন্ডনে নিয়ে যাবার ইচ্ছা পোষণ করেন। কারণ তার কোন ছেলে-মেয়ে ছিল না। নাজমুল খান সেসময় অমত করেনি।

অতঃপর আবরাজ খানকে তার মামা লন্ডনে নিয়ে যায়। এই ঘটনা তখনকার যখন নিঝুমের জন্মও হয়নি। আবরাজকে নিঝুম এতগুলো দিন চিনতোও না। এই তো এক সপ্তাহ আগেই আবরাজ লন্ডন থেকে সিলেটে ফিরে এসেছে। সেদিনই নিঝুম ওকে প্রথম দেখে। তবে কথা বলার সৌভাগ্য হয়নি। নিঝুমের সাথে আবরাজের বয়সের তফাৎ নাহলেও ৭-৮ বছরের হবে। তাই আবরাজের সাথে খুব একটা ভাবও জমে নি নিঝুমের! তার উপর লন্ডন থেকে ফেরত আসায় তার মধ্যে বেশ অহংকারী একটা ভাব দেখা যায়। এখানকার কারো সাথে মিশতে যে সে খুব একটা আগ্রহী নয় সেটাও তার আচরণে স্পষ্ট।

এসেছে থেকে এখানকার একটা বড় সেভেন স্টার হোটেলে থাকছে সে। প্রথম দিনই শুধু নিঝুমের বাবার সাথে দেখা করে গেছে। ছোটবেলায় নাজমুল খান আবরাজের খেয়াল রেখেছিল বিধায় তার প্রতি একটা টান আছে৷ সেই টানেই মূলত এসেছিল। জানিয়েছিল, সে দেশে এসেছে বিয়ে করার জন্য। কারণ বিদেশের সংস্কৃতিতে বড় হওয়া উশৃংখল মেয়ে তার পছন্দ না, সে এই দেশের কোন শিক্ষিত, মার্জিত, বনেদী বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করতে চায় যে তার কাধে কাধ মিলিয়ে চলতে পারবে। চাচার উপর ভরসা থাকায় নাজমুল খানকেই বলেছিলেন এমন একটা মেয়ে খুঁজে বের করতে। নাজমুল খানও তাকে কথা দিয়েছিল তার পছন্দমতো মেয়ে খুঁজে দেয়ার। নিঝুমের পাশের ঘরে বসে তারা এসব কথাবার্তা বলায় এসব নিঝুমেরও কানে এসেছিল।

নিঝুম অতীতের এসব ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের চোখের জল মুছে ফেলল। আর ভাবতে লাগলো, আজ দুপুরে হঠাৎ করেই যখন তার বাবা এসে তাকে বললো তার বিয়ে ঠিক করেছে, তখন নিঝুম কতটা অসহায় বোধ করছিল। নিঝুম তো এখন কিছুতেই বিয়ে করতে চায় না। সে চায় পড়াশোনা করতে। কিন্তু নিজের বাবাকে এবিষয়ে জানাতেই তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন তিনি নিঝুমকে আর সামনে পড়াতে ইচ্ছুক নন। এমনকি নিঝুম যদি বিয়ে না করে তাহলে তিনি নিঝুমকে বাড়ি থেকেও বের করে দেবেন। অসহায় নিঝুম, যে ছোট থেকে নিজের বাবার নিষ্ঠুর রূপ দেখে বড় হয়েছে তার পক্ষে আর প্রতিবাদ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু বিয়ের আসরে পৌঁছানোর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত সে জানতো না, তার বর কে। শুধুমাত্র নিজের বাবার কথাতেই বধূবেশে বিয়ের আসরে চলে এসেছিল। আর তারপর এত কিছু হয়ে গেল। বিনাদোষে তাকে এত কিছু শুনতে হলো।

এতসব কিছুর মাঝে হঠাৎ করেই সেখানে উপস্থিত নিঝুমের বড় আব্বু মানে আবরাজ এর বাবা আলমগীর খান বলে উঠলেন,”অনেক হয়েছে নাজমুল আর না৷ তুই আমার ছেলের উপর কোন ধরনের জোরজবরদস্তি করতে পারিস না।”

নাজমুল খান নিজেকে সামলাতে না পেরে রেগে বলে উঠলেন,”এখন ও তোমার ছেলে হয়ে গেল? অথচ একসময় ওর দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছিলে। আমি ওকে পেলে বড় করেছি অনেকদিন। তাই তোমার থেকে ওর উপর আমার অধিকার বেশি।”

আলমগীর খান আমতা আমতা করে বলেন,”এই অধিকারের জন্যই তো এতক্ষণ চুপ ছিলাম। কিন্তু তুই যেভাবে এটার সদ্ব্যবহার করছিস সেটা তো ঠিক না। এভাবে তুই আবরাজের উপর জোর জবরদস্তি করে নিজের অযোগ্য মেয়ের দায়িত্ব তার কাঁধে তুলে দিতে পারিস না।”

এসমস্ত কথা তীরের মতো বিঁধছিল নিঝুমের বুকে। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর আসমানী বেগম এগিয়ে এসে বলেন,”ব্যস,অনেক হয়েছে। এবার অন্তত চুপ থাকুক আপনারা সবাই। আমার মেয়ে এতোটা ফেলনা নয়। নিঝুমের আব্বু তুমি দয়া করে নিজের লোভের বলি আমাদের ছোট্ট মেয়েটাকে বানিও না। আল্লাহর দোহাই লাগে। আমি তো আগেও তোমাকে বলেছি এভাবে নিজের স্বার্থের জন্য আমাদের মেয়েটার জীবন নিয়ে খেলো না৷ কিন্তু তুমি তো আমার কথা শুনলে না, উল্টে আমাকেই হুমকি ধমকি দিয়ে চুপ থাকতে বললে।”

নাজমুল খান নিজের স্ত্রীর কোন কথা যেন গায়েই মাখলেন না। বরং চেচিয়ে উঠে বললেন,”তোকে বলেছি না এসব ব্যাপারে কথা না বলতে,,তাহলে এত ফটর ফটর কেন করছিস? মেয়ে মানুষের এত বাহাদুরি আমার পছন্দ না। তুই যা এখান থেকে। আমি নিঝুমের বাবা। আমি যা বলব ওকে তাই করা লাগবে। তুই যদি বেশি ফটর ফটর করিস তো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব। তারপর রাস্তায় নেমে ভিক্ষা করে খাস।”

বলেই তিনি নিঝুমের দিকে তাকালেন। ইশারায় তাকে কাছে আসতে বললেন। নিঝুমও বাধ্য মেয়ের মতো এগিয়ে এলো। নাজমুল খান নিঝুমের কানে ফিসফিস করে বললেন,”তুই তোর মায়ের মতো আমার মুখে মুখে তর্ক করতে আসিস না। আজ যদি এই বিয়েটা নাহয় তাহলে সবার আগে আমি তোর মাকে তালাক দেব। তারপর তোদের মা-মেয়ে দুটিকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব আমার বাড়ি থেকে। তোদের দিয়ে তো জীবনে কোন উন্নতি করতে পারলাম না। এবার যখন নিজের জীবনের উন্নতির চাবি খুঁজে পেয়েছি সেটা বন্ধ করিস না একদম।”

নিজের বাবার থেকে এহেন হুমকি পেয়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো নিঝুম৷ এই লোকটা তার জন্মদাতা পিতা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। লোভ কি মানুষকে এতটা নিচে নামায়! কিন্তু নিঝুম যে বড্ড বেশ অসহায়। নিঝুমের মা আসমানী বেগম একজন এতিম মেয়ে। বড় হয়েছেন নিজের চাচা চাচির সংসারে অনেক অনাদরে। তারা তো আসমানীর বিয়ে দিয়েছেন থেকে কোন খোঁজ খবরও নেন নি। তাই এখন যদি নিঝুম এবং তার মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয় তাহলে যে তাদের তিন কূলে আর কোথাও ঠাঁই হবে না!

নাজমুল খান নিঝুমকে হুমকি দিয়ে, আবরাজের সামনে গিয়ে বলেন,”তোমাকে এই বিয়েটা করতেই হবে৷ তুমি সেদিন আমায় বলেছিলে না, আমার ঋণ শোধ করতে চাও। তো এখন সেই সুযোগ দিচ্ছি তোমায়। এই বিয়েটা করে আমার ঋণ শোধ করো।”

আবরাজ কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো নিঝুমের দিকে। সে একদম চুপ ছিল। নাজমুল খান আবারো বললেন,”আশা করি, তুমি নেমোকহারামি করবে না। যদি এমনটা করো তাহলে আমি মনে করবো তোমার ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই। লন্ডনে গিয়ে টাকা তো কামিয়েছ কিন্তু ভালো কিছু শেখো নি৷ আমার জন্য যে বেঁচে আছ সেই অবদানকে অস্বীকার করছ।”

আবরাজ বেশ ক্রোধ নিয়ে বলল,”বেশ, যদি এভাবে তোমার ঋণ শোধ করতে হয় তো ঠিক আছে।”

বলেই সে সামনে এগিয়ে গেলো। নিঝুমের একদম মুখোমুখি এসে তার হাতটা শক্ত করে ধরে টানতে টানতে বিয়ের আসরের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। নিঝুমের চোখ থেকে টুপটাপ জল পড়ছে। আসমানী বেগমও মুখে আঁচল গুজে কাঁদছেন।

আবরাজ কাজির সামনে এসে নিঝুমের হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলে,”আপনি বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।”

কাজি তাই করে। নিঝুম অনবরত কেঁদে চলেছে। কাজি আবরাজকে “কবুল” বলতে বলার সাথে সাথেই সে কবুল বলে দিল। কিন্তু নিঝুম সহসা কবুল বলল না৷ পাথরের মতো জমে রইল। ক্রমেই আবরাজ ধৈর্য হারিয়ে ফেলল। নিঝুমের হাত শক্ত করে ধরে বলল,”এই মেয়ে! নাটক বন্ধ করে তাড়াতাড়ি কবুল বলো৷ এটাই তো চেয়েছিলে তুমি, তাইনা। আমি ঠিকই বুঝতে পারছি তোমাদের পুরো পরিবারটাই ফ্রড। খুব শখ না, আমার বউ হওয়ার! এবার তোমার সেই সাধ আমি মেটাবো। তোমাদের লোভী বাপ-মেয়ের উচিৎ শিক্ষা দিব।”

নাজমুল খানও রক্তিম চোখে নিঝুমের দিকে তাকিয়ে। নিঝুমকে যেন চোখ দিয়েই হুমকি দিচ্ছেন। নিঝুম একবার নিজের মায়ের দিকে তাকালো। নিজেকে নিয়ে তার কোন চিন্তা নেই কিন্তু সে চায়না তার জন্য তার মায়ের সংসারটা ভাঙুক। তার জন্য যদি নিজের কপাল পোড়াতে হয় তো তাই সই! এমন ভাবনা থেকেই নিঝুম চোখ বন্ধ করে অস্ফুটস্বরে বলল,”কবুল,,কবুল,,কবুল।”

কবুল বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। যেন এখান থেকেই তার নারকীয় জীবনের সূচনা ঘটলো।

To be continue……

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_1
#ইয়াসমিন_খন্দকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here