#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_10
#ইয়াসমিন_খন্দকার
নিঝুম এত তীব্র শীত এবং তুষারপাত আগে কখনো দেখে নি। তার শরীর এটা একদম সহ্য করতে পারল না। নিঝুম একদম গলা কা*টা মুরগীর মতো কাপছিল। ধীরে ধীরে তার শরীর ঠান্ডা বরফের মতো জমে যাচ্ছিল। সে যেন আর দাঁড়িয়েই থাকতে পারছিল না। তবুও নিজের আত্মসম্মানকে গুরুত্ব দিয়ে সে আবরাজের সাহায্য চাইল না। তখনই মনে পড়ে গেল এলার দেয়া ফোনের কথা। নিঝুম সেটা খুঁজে পেল না। সামান্য দুই পা এগোতেই ঢলে পড়ে গেল।
এদিকে আবরাজ ক্রোধে অন্ধ হলেও হঠাৎ করেই তার মনে নিঝুমের জন্য চিন্তা হতে থাকে। এতক্ষণ সে নিজের ঘরে লাইট নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে ছিল৷ কিন্তু ঘরের লাইট জ্বালিয়ে জানালার দিকে তাকাতেই থাই গ্লাসে তার চোখে স্পষ্ট ভেসে ওঠে বাইরের দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। এই তীব্র তুষারপাত দেখে তার মনে ভয় ঢুকে যায়। আবরাজ বলে ওঠে,”ঐ মেয়েটাকে তো আমি বাইরে বের করে দিলাম,,,ও ঠিক আছে তো…”
এই ভেবে আবরাজ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। দ্রুত পায়ে বাইরের দিকে রওনা দিল।
এলা ও ম্যাক্স গাড়ি চালিয়ে ফিরছিল। এলা বলে,”আমার খুব চিন্তা হচ্ছে রে। নিঝুমকে এতবার ফোন করলাম কিন্তু ও রিসিভ করছে না। নিশ্চয়ই বড় কোন ঝামেলা হয়েছে।”
ম্যাক্স বিরক্ত সুরে বলে,”তুমি অহেতুক এত চিন্তা করছ। মুভিটাও ঠিকমতো দেখতে দিলে না। টেনে টেনে নিয়ে এলে আমায় আর এখন এই তুষারপাতের মধ্যে গাড়ি চালাচ্ছ যদি কোন অঘটন ঘটে?”
এলা বলে,”কিছু হবেনা এই তো সামনেই আবরাজের এপার্টমেন্ট।”
বলেই এলা কিছু একটা দেখে গাড়ি থামায়। ম্যাক্স জিজ্ঞেস করে,”কি হলো? গাড়ি থামালে কেন?”
এলা দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় পড়ে থাকা নিঝুমের দেহ দেখে তার নাম ধরে চিৎকার করে ওঠে। অতঃপর নিঝুমের মাথার কাছে বসে পড়ে বলে,”এই নিঝুম? কি হয়েছে তোমার? চোখ খোলো!”
ম্যাক্স হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিল। এলা ম্যাক্সকে বলে,”এভাবে বোকার মতো দাঁড়িয়ে কি দেখছ? ওকে জলদি হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করো। আমি বলেছিলাম না, আবরাজের উপর ভরসা নেই৷ দেখেছ কি করেছে? ওর মনে কি দয়ামায়া বলতে কিছু নেই? মেয়েটার উপর এত বড় অবিচার করল! ছি!”
এরইমধ্যে আবরাজও বাইরে বেরিয়ে আসে। এসেই নিঝুমকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসে বলে,”কি হয়েছে ওর?”
এলা শক্ত কন্ঠে বলে,”নির্দয়, বা/স্টা/র্ড কোথাকার কি করেছ তুমি এটা? আজ তোমার জন্য মেয়েটার এই অবস্থা।”
আবরাজের মাথা গরম হয়ে যায়। সে বলে,”একদম গালি দিবে না। নাহলে আমি ভুলে যাব যে…”
ম্যাক্স তাদের মাঝে বলে ওঠে,”এভাবে এখন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে কোন লাভ নেই। আমাদের এখন নিঝুমকে সামলাতে হবে। ওর তো এত শীত সহ্য করার ক্ষমতা নেই তাই হয়তো অজ্ঞান হয়ে গেছে।”
আবরাজ বলে,”ওকে আমার এপার্টমেন্টে নিয়ে আসো তোমরা।”
এলা সাথে সাথেই গর্জে উঠে বলে,”একদম না। আমরা ওকে হসপিটালে নিয়ে যাব। তোমার উপর আমার ভরসা নেই।”
ম্যাক্স বলে,”এলা, এখন আমাদের ঠান্ডা মাথায় সবটা ভাবতে হবে৷ তুষারপাত যেভাবে বাড়ছে তাতে এতক্ষণে রাস্তায় বরফ জমে গেছে, এখন আর হাসপাতালে যাওয়ার পরিস্থিতি নেই। তাছাড়া আবহাওয়া দেখে মনে হচ্ছে না পরিস্থিতি খুব জলদি ঠিক হবে। এখন তাই নিজেদের মধ্যে ঝামেলা না করে নিঝুমকে আবরাজের এপার্টমেন্টেই নিয়ে চলো। নাহলে ওর বড় কোন ক্ষতি হয়ে যাবে।”
এলাও বুঝতে পারে ম্যাক্সের কথায় যুক্তি আছে৷ তাই সে আর বেশি বাড়াবাড়ি না করে নিঝুমকে ম্যাক্সের এপার্টমেন্টে নিয়ে যেতে সম্মতি দেয়।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
নিঝুমকে একটি উষ্ণ কক্ষে রুম হিটারের মধ্যে রাখা হয়েছে। এলা ক্রমশ নিঝুমের হাতে পায়ে মালিশ করে যাচ্ছে তার দেহ উষ্ণ করার জন্য। নিঝুমের পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। হঠাৎ করেই আবরাজ এসে এলাকে জিজ্ঞেস করে,”ওর পরিস্থিতি এখন কেমন?”
এলা রেগে বলে,”সেটা জেনে তুমি কি করবে? তুমি তো মেয়েটাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছ? এখন এসেছ নাটক করতে? ওকে এই পরিস্থিতির মধ্যে বের করে দেওয়ার সময় একবারো এসব মনে হয়নি?”
আবরাজ বলে,”আমি ওকে বের করে দেইনি ও নিজেই রাগ দেখিয়ে বের হয়ে গেছে। তার থেকে বড় কথা আমি জানতামও না হঠাৎ করে এভাবে স্নো ফল শুরু হবে।”
“বের না করে দিলেও নিশ্চয়ই এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছ যাতে নিঝুম বের হতে বাধ্য হয়।”
আবরাজ আর কিছু বলে না। এরইমধ্যে নিঝুম আলতো করে চোখ খুলে তাকায়। নিঝুম চোখ খুলতেই এলা বলে ওঠে,”এই তো নিঝুম চোখ খুলেছে।”
নিঝুম ধীরে ধীরে উঠে বসে বলে,”আমি কোথায়?”
এলা বলে,”তুমি চিন্তা করো না। তুমি এখন একদম সেইফ আছ। তুমি এখন আবরাজের এপার্টমেন্টে। আর একটা কথা বলো, তুমি কি পাগল নাকি? বাইরে এত তুষারপাতের মাঝে কেন দাঁড়িয়ে ছিলে? যদি আমরা ঠিক সময় না আসত তাহলে কি হতো বলো তো?”
নিঝুম বলে ওঠে,”আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন। এই লোকটার এপার্টমেন্টে আমি আর এক মুহুর্ত থাকব না।”
আবরাজের মাথা আবার খারাপ হয়ে যায়। সে এগিয়ে এসে নিঝুমকে বলে,”কি বললে আরেকবার বলো।”
নিঝুম বলে,”কেন শুনতে পান নি? আপনি কি ভাবেন নিজেকে? আমাকে সবসময় যাচ্ছেতাই বলে অপমান করবেন আর আমি আপনার সব অপমান মুখ বুজে মেনে নেব? কেন? কি দোষ ছিল আমার?”
“নিজের দোষ কি তুমি সেটা জানো না?”
নিঝুম একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”হুম, জানি। আমি খুব ভীতু ছিলাম। নিজের বাবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারিনি। আর এটাই ছিল আমার দোষ। আমি যদি সেই সময় প্রতিবাদটা করতে পারতাম তাহলে আজ আমায় এই দিনটা দেখতে হতো না। কিন্তু আপনি একটা কথা সত্য করে বলুন তো, আমার বাবা আপনার সাথে যে অন্যায় করেছে তার কোন দায় কি আমার আছে? যদি আপনি এখানে একজন ভিকটিম হন তাহলে আমিও একজন ভিকটিম। বরঞ্চ আমাকে এবং আমার মাকে আপনার থেকেও আরো অনেক গুণ বেশি সাফার করতে হয়েছে। আপনার সাথে নাহয় প্রতারণা হয়েছে কিন্তু এর কোন দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কি আপনার উপর পড়েছে? আর এদিকে আমাকে আর আমার মাকে দেখুন। আমরা আজ সহায় সম্বলহীন হয়ে আশ্রিতা হয়ে আছি। তাহলে আপনিই বলুন এখানে আসল ভিকটিম কে?”
আবরাজ নিঝুমের এই তীক্ষ্ণ প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারে না। এলা নিঝুমের কাধে হাত রাখে। নিঝুম বলে,”আমি আপনার এখানেও আসতে চাই নি৷ আপনি তথাকথিত চ্যালেঞ্জের কথা বলেই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। তবে আমি এখনো বলছি,এসব চ্যালেঞ্জের কোন দরকার নেই। আপনার যদি মনে হয়, এই সম্পর্কটা আপনার কাছে শুধুই একটা প্রতারণা তাহলে আপনাকে এই প্রতারণাটা মেনে নিতে হবে না। আমি আবার সিলেটে ফিরে যাব। আপনি নাহয় ৫ মাস পর আমায় ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েন।”
এলা বলল,”আমিও তোমার সাথে একমত নিঝুম। আবরাজ তুমি নিঝুমের কথাটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখো। ও কিন্তু ঠিকই বলেছে। তোমার যদি ওর সাথে এই সম্পর্কটা নিয়ে সমস্যা হয়ে তাহলে ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিও। কিন্তু ওকে এভাবে অপমান করার তো কোন মানে হয় না। কারণ ও নিজেও এই পরিস্থিতির মধ্যে ভুক্তভোগী।”
আবরাজ বলে,”ডিভোর্স তো ওকে আমি দেবোই। তবে আমি যেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছি সেটাতেও হারব না। এই পাঁচ মাস ওর সাথে আমি থাকবোই। আর এই চ্যালেঞ্জ পুরো করবোই।”
নিঝুম বলে,”কিন্তু আমি রাজি না। আমি এখনই সিলেটে ফিরব।”
“শুধু এই রুমের বাইরে এক পা রাখো তারপর আমি তোমায় বোঝাচ্ছি…”
#গল্পঃঅশ্রুজলে
to be continue…..