#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_3
#ইয়াসমিন_খন্দকার
নিঝুম আগলে ধরে তার মা আসমানী বেগমকে। অশ্রুসিক্ত নয়নে নিজের জন্মদাতা পিতার দিকে তাকায়। আর তাকায় তার পাশে দাঁড়ানো নববধূ সাজের মহিলাটির দিকে। নিঝুম কিছু হিসাব মিলানোর চেষ্টা করে। দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়েও ফেলে। এবার আর চুপ না থেকে ভারী কন্ঠে বলে,”এটাই তাহলে তোমার পরিকল্পনা ছিল আব্বু? আমাকে আর আম্মুকে বাড়ি থেকে বের করে এই মহিলাকে বিয়ে করার?”
নিঝুমের কথায় কোন পাত্তা না দিয়ে তার বাবা নাজমুল খান বলে ওঠেন,”তোকে সেটার কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নই। দূর হ চোখের সামনে থেকে। কালকে না তোদের মা- মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দিছিলাম। তাহলে আজ কোন লজ্জায় এসেছিস এখানে তোরা?”
তাদের এলাকার একজন মুরুব্বি লোক বলে ওঠে,”এই কাজটা তুমি একদম ঠিক করো নি নাজমুল, এভাবে একটা বাইরের মেয়ের জন্য নিজের বউ মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দিলে, আল্লাহর গজব পড়বে তোমার উপর।”
“আরে রাখুন আপনার গজব! আর আপনাদের কি কোন কাজ কারবার নেই? সকাল সকাল এখানে কি সার্কাস দেখতে এসেছেন নাকি? যান তো এখান থেকে।”
একজন মহিলা বলে ওঠে,”এই অন্যায় তো মেনে নেয়া যায়না। আমরা এটা মানব না। এভাবে নিজের বউ বাচ্চার উপর তুমি এত বড় অন্যায় করতে পারো না। দেশে কি আইন কানুন বলে কিছু নেই?”
“এসব আইনের ভয় আমায় দেখাতে আসবেন না। আমার বউ শান্তি হাইকোর্টের একজন উকিল। আইনের মারপ্যাঁচ আমার ভালোই জানা আছে।”
নিঝুম বলিষ্ঠ কন্ঠে বলে,”তোমার দ্বিতীয় স্ত্রী যদি উকিল হয় তাহলে অবশ্যই তার এটা জানার কথা যে,বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাইলে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু তুমি তো মায়ের কাছ থেকে অনুমতি পত্র নাও নি৷ এখন যদি এটা কি কেইস করা হয় তখন কি করবা?”
নাজমুল খান গর্জে উঠে বলেন,”তোর তো সাহস মন্দ নয় তুই আমায় আইন শেখাচ্ছিস…তোকে তো আমি..”
বলে যেই না আগাতে যাবে ঠিক সেই সময় নাজমুলের দ্বিতীয় স্ত্রী শান্তি বলে ওঠে,”এত হাইপার হয়ো না। আমি ম্যানেজ করছি ব্যাপারটা।”
বলেই সে বাড়ির ভেতরে যায়। কিছু সময় পর হাতে একটা কাগজ নিয়ে ফিরে আসে। ততক্ষণে আসমানী বেগম এর চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনা হয়েছে।শান্তি এসেই সবার সামনে একটা পেপারস দেখিয়ে বলে,”এই দেখুন,এটা হলো আমার বর্তমান স্বামী নাজমুল খান এর সাথে তার প্রথম স্ত্রী আসমানী বেগম এর তালাকনামা। এখানে স্পষ্ট করেই লেখা আছে, তারা স্বেচ্ছায় একে অপরকে তালাক দিতে চায়। আর এই তালাক ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েও গেছে। তাই আশা করি,আপনারা আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন। যেহেতু ওদের মধ্যে তালাক হয়ে গেছে তাই আমাদের বিয়ে করতে আর কোন আইনি জটিলতা নেই।”
আসমানী বেগম বলে ওঠেন,”এসব কি বলছেন কি আপনি? আমি তো…”
হঠাৎ কিছু একটা মনে করে আসমানী বেগম বলেন,”নিঝুমের বাবা তুমি তো এটায় আমায় নিঝুমের বিয়ের জন্য ব্যাংক থেকে লোন নেয়ার পেপার বলে সাইন করিয়েছিলে। তাহলে এসব কিছুর কি মানে? তুমি কিভাবে পারলে আমায় এভাবে ঠকাতে?”
নাজমুল খান বিরক্তির সাথে বলেন,”এই তোরা মা মেয়ে আপদ দুটি বিদায় হ তো৷ তোদের এত প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই। জীবনে তো তোরা আমার কোন কাজে আসলি না। এখন যখন আমি নিজের জীবনটা নতুন করে শুরু করেছি তখন আর সেই জীবনে বাঁধা হতে আসিস না।”
গ্রামের একজন মুরুব্বি বলে ওঠেন,”কিন্তু ওরা এখন কোথায় যাবে? বউয়ের সাথে নাহয় তোমার ডিভোর্স হয়েছে কিন্তু মেয়ের সাথে তো তোমার রক্তের সম্পর্ক তার কথা অন্তত ভাবো।”
নাজমুল খান ভাবলেশহীন ভাবে বলেন,”ঐ মেয়ের বিয়ে আমি দিয়ে দিয়েছি। তাই ওর উপর আমার আর কোন দায়িত্ব নেই। ওকে ওর স্বামীর ঘরে যেতে বলুন।”
একজন মহিলা বলেন,”আপনি কোন মুখে এসব বলছেন? কাল বিয়েবাড়িতে কি হলো আমরা সবাই তো তার সাক্ষী। তাছাড়া আপনার মেয়ের কাছে যা শুনলাম তাতে তো তার স্বামী তাকে ফেলে লন্ডনে চলে গেছে। এখন তো ওর যাওয়ার কোন যায়গা নেই।”
নাজমুল খান বলেন,”দেখুন, আপনাদের যদি এদের প্রতি এত দয়া হয় তো এদের নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখুন। আমি নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে দিচ্ছি। যেহেতু আসমানীর সাথে আমার ডিভোর্স হয়েছে আর নিঝুমের বিয়েও আমি দিয়ে দিয়েছি তাই ওদের কারো লিগ্যাল অভিভাবক আমি না এবং ওদের দায়িত্বও আর আমার উপর বর্তায় না৷ তাই আমাকে এসব কিছু বলতে আসবেন না।”
বলেই তিনি সবার মুখের উপর গেইট লাগিয়ে দেন। নিঝুম এবং আসমানী বেগম অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। গ্রামের মানুষ তাদের জন্য হাপিত্যেশ করতে থাকে। কেউ কেউ তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনার বানি শোনায়৷ কেউ বা একবেলা আশ্রয় দিতে চায়, খাবার দিতে চায়। কিন্তু সামনে তাদের অনিশ্চিত জীবন নিয়ে সন্দিহান থাকায় এসব কিছু বড্ড সামান্যই মনে হয়।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আবরাজ বিরতিহীন ভাবে একের পর এক বিয়ার খেয়ে চলেছিল। নেশায় চরম ভাবে আসক্ত হয়ে পড়ছিল সে৷ ম্যাক্স আবরাজের এই অবস্থা থেকে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। কিন্তু আবরাজকে থামানোর কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না সে৷ আবরাজ একের পর এক বিয়ারের বোতল ফাঁকা করেই চলেছে। আবরাজের অবস্থা যখন এমন তখন ম্যাক্স আর কোন উপায় না দেখে তাদের আরেক ফ্রেন্ড এলাকে কল লাগায়। এলা কল রিসিভ করতেই ম্যাক্স বলে ওঠে,”আবরাজের অবস্থা বেশি ভালো না, তুমি জলদি ব্লু লাইট বারে চলে এসো।”
কিছু সময়ের মধ্যেই এলা হাফাতে হাফাতে বারে চলে আসে৷ সে পাশেই একটি রেস্টুরেন্টে জব করে। এলা ছুটে আসতেই ম্যাক্স বলে,”দেখো আবরাজ এর কান্ড। একের পর এক মদ গিলেই চলেছে। আমি ওকে কোন ভাবেই থামাতে পারছি না।”
এলা বলে,”আমি এসে গেছি না! আর কোন চিন্তা নেই ”
বলেই এলা এগিয়ে গিয়ে আবরাজ এর হাত থেকে বিয়ারের ক্যান কেড়ে নেয়৷ আবরাজ রেগে গিয়ে বলে,”কে তুই? আমার বিয়ারটা কেড়ে নিলি কেন? দে বলছি”
এলা বলে,”তোমার আর এটা খাওয়া চলবে না৷ উঠে দাড়াও।”
আবরাজ তবুও বসে থাকে। এলা ম্যাক্সের সাহায্য নিয়ে তাকে টেনে তোলে। অতঃপর ম্যাক্সের সাহায্য নিয়ে আবরাজকে তার বাড়িতে নিয়ে যায়।
~~~~~~~~~~~~~
নিঝুম ও আসমানী বেগম তাদের গ্রামের এক লোকের বাড়িতে সাময়িক আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু তাদের এরপরের গন্তব্য একেবারেই অজানা। তারা জানে না এরপর কোথায় যাবে৷ আসমানী বেগম সমানে কেদে চলেছেন তবে নিঝুম নিজেকে শান্ত রেখেছে৷ এরইমধ্যে গ্রামের কিছু লোক তাদের ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টসে জব করার পরামর্শ দিয়েছে৷ তবে নিঝুম অসহায় চোখে তাকিয়েছে শুধু। তার যে স্বপ্ন ছিল একদিন মস্ত বড় ডাক্তার হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সেই স্বপ্ন কি তাহলে স্বপ্নই থেকে যাবে?
এই প্রশ্নের কোন উত্তর খুঁজে পায় না সে।
নিঝুম যখন এতটা অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিল তখনই হঠাৎ করে তার সাথে দেখা করতে আসে তার বড় চাচি অর্থ্যাৎ আবরাজ এর সৎ মা ছবি বেগম। তিনি এসেই নিঝুমের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”তাড়াতাড়ি নিজের সব ব্যাগপত্র গুছিয়ে নাও। তারপর আমার সাথে আমাদের বাসায় যাবে তুমি।”
নিঝুম অবাক স্বরে বলে,”চাচি আপনি!”
“হ্যাঁ, আমি। অতীতে অনেক বড় একটা অন্যায় করেছিলাম ৫ বছরের ছোট্ট একটা শিশুর সাথে। আজ তার প্রায়শ্চিত্ত করতে এলাম। কারণ আজ যে আবার এক অসহায় মেয়ের সাথে অন্যায় হচ্ছে,”
#গল্পঃঅশ্রুজলে
to be continue…..