#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_6
#লেখিকা:ইয়াসমিন_খন্দকার
নিঝুম রাতের আধারে একা বসে ছিল বেলকনিতে। সেখানে বসে বসে নিজের জীবনের অমিমাংসিত হিসাব গুলো মিলাচ্ছিল। এমন সময় কেউ তার কাঁধে হাত রাখল। নিঝুম পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল ছবি বেগমকে৷ ছবি বেগমকে দেখে সে সামান্য হেসে বলল,”চাচি, কিছু বলবেন?”
“আমার আবীর এসেছিল তোমার কাছে?”
নিঝুম বলে,”হুম,এসেছিল তো৷ অনেকক্ষেত্র আমার সাথে গল্প করেছে। ওর সাথে গল্প করে আমার মনটা ভালো হয়ে গেল। অদ্ভুত একটা শান্তি অনুভব করতে পারছি।”
ছবি বেগম স্মিত হেসে বলে,”আমার ছেলেটাই এমন যেখানে যায় সেখানেই মাতিয়ে রাখতে পারে। সবসময় কত হাসিখুশি থাকে। কিন্তু ওর জীবনটা…সবই আমার পাপের ফল। আমি আবরাজ এর সাথে যেই অন্যায় করেছি তার ফল পাচ্ছে আমার ছেলেটা।”
বলেই ছবি বেগম চোখের জল ফেলতে থাকেন। তাকে এভাবে দেখে নিঝুমের অনেক খারাপ লাগে। নিঝুম ছবি বেগমকে আশ্বাস দিয়ে বলে,”এত চিন্তা করবেন না, চাচি। দেখবেন একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। আবির ওর এই প্রতিবন্ধকতা ঠিক একদিন জয় করতে পারবে। আপনি স্টিফেন হকিং এর নাম শোনেন নি? সেও তো এই হুইলচেয়ারে বসেই জীবনে অনেক কিছু করেছিল। আমার বিশ্বাস আবিরও পারবে।”
নিঝুমের কথা শুনে ছবি বেগম বলেন,”তাই যেন হয়। তবে আমার জীবনের সবথেকে বড় ইচ্ছাটা কি জানো? একবার হলেও আবরাজ এর কাছে নিজের অতিতের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইব। জানি, আমি যা করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু তবুও…”
বলেই দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। অতঃপর নিঝুমকে বললেন,”এত রাতে জেগে আছ কেন? ঘুমাবে কখন?”
“একটু পর ঘুমাবো।”
“আচ্ছা, ঘুমাও। কিন্তু কাল সকাল সকাল উঠে তৈরি হয়ে নিও। অনেক কাজ আছে।”
‘কাজ আবার কি কাজ চাচি?’
“কেন? তোমার মতে নেই? হিসাব মতো তো কাল তোমার সাথে আবরাজের বৌভাত হবার কথা!”
নিঝুম কন্ঠে গম্ভীরতা এনে মলিন স্বরে বলে,”যেখানে এই বিয়েরই কোন মূল্য নেই সেখানে আবার বৌভাত!”
“আমি কোন কথা শুনতে চাই না। কাল তুমি সকাল সকাল তৈরি থেকো। আমাদের কিছু নিকটাত্মীয় আসবে যাদের না জানালেই নয়। হাজার হোক এই বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে হয়েছে তোমার সাথে। এই কথা তো সবার জানা উচিত।”
নিঝুম আর কিছু বলে না। কিন্তু তার মনের দ্বিধাগুলোও দূর হচ্ছিল না। কি আছে নিঝুমের ভাগ্যে? এই বিয়েটার কি আসলেই কোন ভবিষ্যত আছে নাকি এটা সম্পূর্ণ অন্তঃসারশূন্য। সেই প্রশ্নের উত্তর তো সামনেই পাওয়া যাবে। তবে নিঝুম এটুকু নিশ্চিত তার জীবনে কোন না কোন আশা আছেই।
~~~~~~~~~~~~~
পরের দিন,
পুরো খান বাড়ি আজ সেজে উঠেছে নতুন রঙে। ছবি বেগম নিজ হাতে আজ সবকিছুর আয়োজন করছেন। বৌভাতের সকল আয়োজন প্রায় শেষের দিকে।
নিঝুম একটা লাল সিল্কের শাড়ি পড়ে এক কোণায় মুখ গোমড়া করে বসেছিল। মাঝেমধ্যে দু একজন আসলে তাদের সাথে একটু হু-হা করছে এটুকুই। ছবি বেগম এর কথায় শেষ পর্যন্ত সে রাজি হয়েছে। নিঝুমের মা শান্তি বেগমও তাকে বলেছে নিজের শ্বাশুড়ির কথা মতো চলতে। তাই সেও আর কোন আপত্তি করে নি। নিঝুমের নিজেকে নিয়ে ভীষণ অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। কারণ এই অনুষ্ঠানে আসা অনেকেই তাকে বাকা নজরে দেখছে। মূলত তারা বিয়েটা কোন পরিস্থিতিতে হয়েছিল সেটা জেনেই এমন করেছে। আবার অনেকে তো তার কাছে মুখের উপরই জানতে চেয়েছে আবরাজ কেন বিয়ের পরই তাকে ফেলে লন্ডন চলে গেল। কিন্তু নিঝুম এসব কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারছে না।যার কারণে তার অনেক খারাপ লাগছে। নিঝুমের এই মন খারাপ বুঝতে পারছিলেন ছবি বেগম। তাই তো তিনি দূর থেকেই বিড়বিড় করে বললেন,”তুমি চিন্তা করো না। তোমার জীবনটা আমি নষ্ট হতে দেব না। যেভাবেই হোক না কেন তোমার এই জীবনটা পুনরায় গুছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমি সঠিক ভাবে পালন করবোই। আমি নিশ্চিত তোমার সাথে আবরাজের অনেক সুখের সংসার হবে।”
এরইমধ্যে নিঝুমও তার দিকে তাকানোয় দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। ছবি বেগম সামান্য হাসেন। নিঝুম কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না।
একটু পরেই ছবি বেগম সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন,”আপনারা তো অনেক ক্ষণ হল এসেছেন বৌ ভাতের আনুষ্ঠানিকতার দাওয়াত রক্ষা করতে। তো যেমনটা আপনারা জানেন, আমার বড় ছেলে আবরাজের সাথে আমার দেবরের একমাত্র মেয়ে নিঝুমের বিয়ে হয়েছে তো আজ তাদের বৌভাত। আর…”
তিনি আর কিছু বলতে যাবেন সময় হঠাৎ করে সেই স্থানে উপস্থিত হন নাজমুল খান। তিনি এসেই বললেন,”আমার মেয়ের বৌভাত অথচ আমাকেই দাওয়াত দেয়া হলো না! এটা কেমন কথা?!”
নিঝুম তো হঠাৎ এভাবে এখানে নিজের বাবাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। অবাক হয়ে বলে,”বাবা!”
নাজমুল খান এগিয়ে আসতে বলে,”চলে এলাম বিনা আমন্ত্রণে। আমারও তো কিছু দায়িত্ব আছে।”
ছবি বেগম বেশ উপহাস করে বলেন,”আমি তো ভেবেছিলাম যে, তুমি নিজের নতুন বউকে সময় দিতে এতই ব্যস্ত যে আসতেই পারবে না। তা বিনা আমন্ত্রণেই চলে এলে! তোমার নতুন বউ আসতে দিল।”
নাজমুল খান অপমানটা হজম করে নিয়ে বলল,”আমি স্ত্রেয় পুরুষ নই যে স্ত্রীর কথা মতো নাচব। যেমনটা ছিল ভাইয়া।”
“নাজমুল! মুখ সামনে কথা বলো৷ ভুলে যেও না,ঐ লোকটা তোমার বড় ভাই হয়।”
নাজমুল খান উপহাস করে বলেন,”আরে রাখেন তো বড় ভাই। ভাইয়েরা কোন দায়িত্বটা ও পালন করেছে? নিজে তো এদিকে এত বড় একটা বিশাল অট্টালিকা তৈরি করেছে, আমার খোঁজ নিয়েছে একবারও। ছোটবেলায় যে ওর ছেলের দায়িত্ব আমি নিয়েছিলাম সেটার ঋণ শোধ করেছে?”
এমন সময় আলমগীর খান সেখানে উপস্থিত হন। তিনি এসেই বলেন,”তার বিনিময়ে তুই যে আমার থেকে মোটা অংকের টাকাও নিয়েছিলি এর বিনিময়ে সেটাও বল।”
নাজমুল খান এবার একটু দমে যান। তবে একেবারেই হার মানেন না। বরং বলেন,”সে যাইহোক। তবে এখন কথা হচ্ছে তোমরা সবাই মিলে আমার মেয়ের জীবন নিয়ে কেন খেলছ? ওকে কেন ওর স্বামীর কাছে পাঠাচ্ছ না। আমি এর জবাব চাই।”
নিঝুম এবার প্রতিবাদ করে বলে ওঠে,”নিজের এসব নাটক বন্ধ করো মিস্টার নাজমুল খান। তোমাকে তো এখন আমার নিজের বাবা বলতেও ঘৃণা করে। তুমি তো বাবা নামের কলংক। বাবারা তো নিজেদের সন্তানদের আগলে রাখে। আর তুমি কি করেছ? নিজের একমাত্র মেয়েকে বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছ। আমার জীবন নিয়ে খেলেছ নিজের স্বার্থের জন্য। আমাকে আর মাকে রাতের আধারে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে তো তুমি সব সীমাই অতিক্রম করে ফেলেছ। তারপরও এসব কথা বলছ কোন মুখে? তোমার কি লজ্জা বলে কিছু নেই?”
নিঝুমের কথা শুনে নাজমুল খান ভীষণ রেগে গিয়ে নিঝুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার মাথার চুল টেনে ধরে বলেন,”তোর এত বড় সাহস আমার সাথে এভাবে কথা বলিস! দ্বারা এবার তোর মজা আমি দেখাচ্ছি।”
“বাবা ছাড়ো লাগছে।”
সেখানে উপস্থিত শান্তি বেগম এহেন পরিস্থিতি দেখে দৌড়ে গিয়ে নিজের মেয়েকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেন। নাজমুল খান আরো বেশি জোর দেখিয়ে কিছু বিশ্রী গালাগালি দিলে শান্তি বেগম ঠাস করে নাজমুল খানের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেন। নাজমুল খান সহ উপস্থিত সবাই চমকে ওঠে। নাজমুল খান তো অবাক হয়ে শান্তি বেগমকেই দেখছিল। শান্তি বেগমের এই কি রূপ! বিয়ের পর যেই মেয়ে কখনো সাত চড়ে রা কাটেনি আজ কিনা সেই তার গায়ে হাত তুলল। নাজমুল খান রক্তিম চোখে তাকিয়ে কিছু বলবেন তার আগেই শান্তি বেগম বললেন,”একদম চোখ রাঙাবি না। এতদিন তুই আমার স্বামী ছিলি জন্য তোর সব অপমান আমি মুখ বুজে মেনে নিয়েছি। তেমন প্রতিবাদ করতে পারিনি। কিন্তু এখন যখন সম্পর্কটা নেই তখন তোকে সম্মানও দেব না। যদি আমার বা আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়াস তবে তোর সেই হাত কে/টে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেব।”
বলেই ক্রোধে ফুসতে থাকেন।
to be continue…..
[প্রথম পর্বে অনেকেই বলেছিল আবরাজ ও আবির নাম দুটো এক রকম শোনাচ্ছে। তাই আবরাজ এর সৎ ভাই এর নাম পরিবর্তন করে আবির রাখা হলো।]