#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_8
#ইয়াসমিন_খন্দকার
নিঝুম যখন জানিয়ে দেয় সে কোন শর্ত মানতে রাজি না তখন হঠাৎ করেই হেসে ওঠে আবরাজ। নিঝুমকে উপহাস করে বলে,”কেন তুমি রাজি না? নাকি ভয় পাচ্ছ যে এই শর্ত মানতে গেলে তুমি আমার ধন-ঐশ্বর্য দেখে আমার সাথে সংসার করতে চাইবে কিন্তু আমি তখন তোমায় ফিরিয়ে দেব।”
নিঝুম রাগী কন্ঠে বলে,”আমাকে এমন ধরনের মেয়ে ভাবলে আপনি ভুল করছেন। আমি মোটেই লোভী নই।”
“সেজন্যই তো আমায় ফাসিয়ে বিয়ে করেছিলে।”
“দেখুন, সেটা একটা…”
ছবি বেগম তাদের মধ্যে হঠাৎ করে বলে ওঠে,”হয়েছে তোমাদের আর ঝগড়া করতে হবে না। নিঝুম, তুমি আর না করো না, এই শর্তে রাজি হয়ে যাও। পাঁচটা মাসেরই তো ব্যাপার।”
নিঝুম কিছু সময় নিয়ে ভেবে বলে,”বেশ, আমি এই শর্তে রাজি। আমি এই শর্তে জিতে প্রমাণ করে দেব যে আমি মোটেই কোন লোভী মেয়ে ছিলাম না। আমার এই লোকটার ধন-সম্পদের প্রতি বিন্দু পরিমাণ লোভ লালসা নেই৷ এটা প্রমাণ করেই আমি দম নেব।”
আবরাজও দাপটের সাথে বলে,”আমিও দেখব তুমি কি প্রমাণ করতে পারো। আমি তোমায় দেখেই বলে দিতে পারি তোমার রন্ধে রন্ধে লোভ আর লালসা মিশে আছে। কার মেয়ে সেটা দেখতে হবে না।”
নিঝুম নিজের মেজাজ হারিয়ে ফেলে। সে বলে,”সে হিসেবে তো আপনার শরীরেও আমার বাবারই রক্ত বইছে কারণ আপনি তার ভাতিজা হন। তাহলে কি আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনি নিজেও লোভী?”
“নিঝুম!”
ছবি বেগম এদের দু জনার ঝগড়া দেখে ক্লান্ত স্বরে বলেন,”এসব ঝগড়া বন্ধ করো এবার। নিঝুম, তুমি এভাবে বলো না তো। আবরাজ তুমিও নিঝুমকে খারাপ কিছু বলো না। তোমাদের কাছে তো ৫ মাস সময় আছে একে অপরকে চেনার জন্য তখন নাহয় এসব বিষয় বিবেচনা করে দেখিও।”
নিঝুম বলে,”আমি ৫ মাস তো কি ৫ দিনও এই অহংকারী লোকটার সাথে থাকতে ইচ্ছুক নই।”
আবরাজও বলে,”আর আমি যেন তোমার সাথে থাকার জন্য নাচতাছি। আমিও ইচ্ছুক নই তোমার মতো লোভী মেয়ের সাথে থাকতে। আমি তো অপেক্ষায় আছি ছয় মাস পর তোমায় ডিভোর্স দেয়ার জন্য।”
ছবি বেগম আবারও তাদের দুজনকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,”তোমরা এবার ঝগড়া থামাও। আবরাজ তুমি এত দূর থেকে এসেছ, এখন একটু বিশ্রাম নাও। আমি তোমায় খেতে দিচ্ছি।”
আবরাজ বলে,”আমাকে আজই লন্ডনে ফিরতে হবে। কোম্পানির একটা জরুরি মিটিং আছে,”
“সেকি! আজই এলে আর আজই চলে যাবে!”
“কিছু করার নেই! যাওয়াটা প্রয়োজন। মাসখানেক পরে এই মেয়েটার পরীক্ষা শেষ হলে আমায় জানাবেন আমি এসে ওকে নিয়ে যাব।”
“কিছু অন্তত খেয়ে যাও।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
ছবি বেগম খুশি হয়ে যান। আবরাজ সেদিনের মতো খানাপিনা করে বিদায় নেয়। যাওয়ার পর একটি বারের জন্যেও নিঝুমের সাথে কথা বলা তো দুরস্ত ফিরে পর্যন্ত তাকায় না। নিঝুমও কম নাকি, সেও আবরাজকে মোটেই পাত্তা দেয় না। আবরাজ ও নিঝুমের মধ্যে এই স্নায়ুযুদ্ধ চলতেই থাকে।
মাসখানেক পরে,
নিঝুমের এইচএসসি পরীক্ষা সবেমাত্র শেষ হলো। নিঝুম সব পরীক্ষাই অনেক ভালো ভাবে দিয়েছে তাই সে নিজের ভালো রেজাল্ট নিয়ে অনেক বেশি আশাবাদী। খেতে বসেও সে নিজের মা শান্তি বেগমকে উদ্দ্যেশ্য করে বলছিল,”তুমি দেখে নিও আম্মু, আমি অনেক ভালো রেজাল্ট করব। এই রেজাল্টের মাধ্যমে আমি অনেকের অবজ্ঞার জবাব দেব। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সবাইকে প্রমাণ করে দেব যে আমি মোটেও কারো থেকে কম না।”
শান্তি বেগমও আশায় বুক বাঁধেন যে তার মেয়ে জীবনে ভালো কিছু করবে। এমন সময় হঠাৎ করে ছবি বেগম এসে নিঝুমকে বলে,”নিঝুম, তুমি খেয়ে দেয়ে নিজের সব ব্যাগপত্র গুছিয়ে নাও। তোমায় এখন যেতে হবে!”
শান্তি বেগম অবাক স্বরে বলেন,”ব্যাগ গোছাবে কেন ও? কোথায় যাবে এই সময়?”
ছবি বেগম বলেন,”আবরাজ নিঝুমকে লন্ডনে যেতে বলেছে। এখন থেকে ৫ মাস তো ওদের একসাথেই থাকতে হবে।”
নিঝুম বলে,”আমাকে কি আজই যেতে হবে?”
“হুম।”
শান্তি বেগম বলে ওঠেন,”কিন্তু আবরাজের তো নিঝুমকে নিতে আসার কথা ছিল। ও তো এখনো আসল না।”
“আবরাজ ওর অফিসে কিছু জরুরি কাজের জন্য আটকা পড়েছে। এজন্য ও আসতে পারবে না। ও নিঝুমকে লন্ডনের এয়ারপোর্ট থেকে পিক করবে বলেছে।”
শান্তি বেগম আশ্চর্য স্বরে বলেন,”তাই বলে এত দূর পথ আমার মেয়েটা একা যাবে? ওর তো বিদেশে যাওয়ার কোন অভিজ্ঞতা পর্যন্ত নেই!”
“আরে কোন অসুবিধা নেই। আমি আর আবরাজের বাবা মিলে তো ওকে একেবারে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে আসব। তারপর নাহয় ও একেবারে লন্ডনে গিয়ে ল্যান্ড করবে। ওখানেই তো আবরাজ ওকে পিক করে নেবে। এত চিন্তার কিছু নেই। আর নিঝুম তোমার পাসপোর্ট, ভিসা সবকিছুর ব্যবস্থাও হয়নি গেছে। তাই তোমার কোন চিন্তা করতে হবে না।”
নিঝুম তেমন কোন বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখায় না। ছবি বেগম এগিয়ে এসে নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,”আশা করি এই ৫ মাসের সফরে তোমার জীবনে অনেক বড় পরিবর্তন আসবে। যা তোমার জীবনে ভালো কিছুই নিয়ে আসবে।”
নিঝুম বলে,”এই ৫ মাস শুধু আমার কাছে একটা পরীক্ষাক্ষেত্র। যেখানে আমার নিজের সততার পরিচয় দিতে হবে।”
~~~~~~~~~~~~~~
নিঝুমকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দিয়ে বিমান উড্ডয়নের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন ছবি বেগম ও আলমগীর খান। শান্তি বেগমের চোখে জল। আবিরও নিঝুম ও বাড়ি থেকে আসার সময় ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। নিঝুমকে বর্তমানে জড়িয়ে ধরে আছেন শান্তি বেগম। তিনি নিঝুমকে বলেন,”সাবধানে থাকিস মা। তোকে আগে কখনোই নিজের থেকে এত দূরে পাঠাই নি। জানি না, তুই ওখানে গিয়ে কিভাবে থাকবি!”
ছবি বেগম বলেন,”তুমি চিন্তা করো না। আবরাজ ওকে ঠিকই দেখে রাখবে।”
এরইমধ্যে বিমান উড্ডয়নের সময় হয়ে যাওয়ায় নিঝুমকে যেতে হয়। সকল চেকিং শেষে সে বিমানে উঠে বসে। অতঃপর যাত্রা শুরু করে সাত সমুদ্র তেরো নদী পারে বিলেতের উদ্দ্যেশ্যে। এ যেন তার কাছে এক সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। যার ফলাফল কি হবে সেটাও নিঝুমের কাছে অজানা। নিঝুম সংকল্প নিয়ে ফেলেছে এই যাত্রায় সে নিজের নির্লোভ হওয়ার সত্যতার প্রমাণ দিয়েই আসবে।
~~~~~~~~
১২ ঘন্টা পর,
দীর্ঘ যাত্রার পর অবশেষে নিঝুম লন্ডনের মাটিতে পা রাখল। প্লেন থেকে নেমেই সে চাতক পাখির মতো এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। তার দুচোখ যেন আবরাজকেই খুঁজছিল। লন্ডন বিমানবন্দরে নানান দেশী-বিদেশী অচেনা চেহারার ভিড়ে সে নিজেকে একদম অসহায় ভাবছিল। এমন সময় হঠাৎ দুজন বিদেশী তরুণ তরুণী তার দিকে এগিয়ে আসল। নিঝুম তাদের দেখে কিছুটা চমকে গেল। বিদেশী তরুণী উৎসাহী কন্ঠে বলল,”Are you Nijhum?”
নিঝুম মাথা নাড়ালো। এবার ছেলেটি হেসে বলল,”আরে এটাই তো নিঝুম, আমাদের আবরাজের বউ। এই মেয়েটার ছবিই তো আমাদের দেখিয়েছিল আবরাজ।”
মেয়েটি হেসে বলে,”আমার নাম এলা। আর ও হলো ম্যাক্স, আমরা হলাম আবরাজের বন্ধু আমরা তোমায় নিতে এসেছি।”
নিঝুম যেন ঠিক তাদের ভরসা করতে পারে না। এটা বুঝতে পেরে ম্যাক্স বলে,”ওয়েট, আমি আবরাজকে কল দিচ্ছি।”
বলেই সে আবরাজকে কল দেয়। আবরাজকে কল রিসিভ করতেই সে বলে,”তোমার বউ মনে হয় আমাদের ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। তুমি কিছু বল।”
আবরাজ গম্ভীর স্বরে বলে, “আমার এত বাজে সময় নেই, যে তোমায় নিতে যাব। এজন্য নিজের বন্ধুদের পাঠিয়েছি। ওদের সাথে চুপচাপ চলে আসো।”
নিঝুম ভীষণ অপমানিত বোধ করে। সে মুখের উপরই বলে দেয়,”আপনার দয়ায় আমি এখানে থাকতে আসিনি। আপনার দয়ায় আমি চলবও না। তাই আমার সাথে এমন ব্যবহার করার দুঃসাহস দেখাবেন না।”
নিঝুমের এই উত্তর শুনে এলা ভীষণ খুশি হয়ে যায়। সে ভাবতেও পারেনি একটা বাঙালি মেয়ে এতটা দৃঢ় হতে পারে। এলা নিঝুমকে বাহবা দিয়ে বলে,”এই নাহলে আদর্শ নারী,”
#গল্পঃঅশ্রুজলে
to be continue…..