প্রেমসুধা
সাইয়্যারা_খান
পর্বঃ৩৭-৩৮-৩৯
দুপুর গড়িয়ে সময়টা বিকেল। বাড়ীর আশপাশ ঘুরে ঘুরে তৌসিফ’কে দেখালো তার শালা শালীরা। ইনি,মিনি এখন কোল ছেড়ে দুলাভাইয়ের আঙুল ধরে হাটছে। দুটো দুই পাশে। তাদের তোতলা তোতলা কথা শুনতে তৌসিফে’র ভালোই লাগছে। মন চাইছে দুটোকে বুকে নিয়ে রাখতে। বাচ্চা দেখলেই তার এমন লাগে। তার নিজেরও এই বয়সী বাচ্চা থাকা দরকার ছিলো। আদর, যত্নে ফুলিয়ে রাখতো তৌসিফ। বাইরের মানুষের সামনের রাগী,বদমেজাজী মানুষটা যে আসলেই কতটা নরম তা তার বাড়ীর লোকজন ছাড়া কেউ জানবে না৷ পিহা সাইডে যাওয়াতে চৈত্র ডাক দিলো,
— পিহু এদিক আয়। হেমু ভাই দেখলে বকবে।
তৌসিফ ওই দিকেই এগিয়ে গেলো। পৌষদের বাড়ীর পেছন দিকটা এটা মূলত। শেষ সীমানাও বলা যায় কিন্তু বাউন্ডারি নেই। কাটা তার দিয়ে বেড়া দেয়া। বেড়ার পাশ ঘেঁষে অসংখ্য গাছ লাগালো। সবগুলোই হাবিজাবি গাছ। তৌসিফ একটু কৌতুহল গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— এখানে এরকম করা কেন? দেয়াল টেনে দিলেই হয়।
জৈষ্ঠ্য ভাবুক হলো। আনমনে বললো,
— একবার তো ইট আনা হলো কিন্তু কাজ ধরলেই তারা চিল্লাপাল্লা শুরু করে। পৌষ আপা সেবার ওনার ছেলের মাথা ফাটিয়ে দিলো এরপর থেকে লেগেই থাকে ওরা। তাই হেমু ভাই তার দিয়ে বেড়া দিলো। আর গাছগুলো পৌষ আপা লাগিয়েছে।
তৌসিফ দেখলো। বিছুটি পাতা সহ কাটা যুক্ত গাছগুলো এখানে লাগিয়েছে। তৌফিক বুঝে নিলো তার বউ একটা বিচ্ছু। ইনি,মিনির হেলদুল দেখে চৈত্র বললো,
— কিরে ঘুমাবি?
দুটোই মাথা নাড়লো। তারা ঘুমাবে না। চৈত্র ওদের কাছে আসতে আসতে বললো,
— চল দিয়ে আসি ভেতরে। চোর দুটো জেগে আছে কেমন ফইট্টার মতো!
ইনি,মিনি তবুও যাবে না৷ তারা তৌসিফে’র হাত আঁকড়ে ধরলো। দুটোকেই টেনে কোলে তুললো তৌসিফ। চৈত্র’র দিকে তাকিয়ে বললো,
— চলো ভেতরে যাই।
ওরা মাথা নাড়লো। ভেতরে ঢুকা মাত্র ই খেয়াল করলো তৌসিফে’র কাঁধে মাথা গুজে দুই বোন ঘুমে কাঁদা। তৌসিফ পুলকিত হলো। তার ভালা কাজ করলো যেন। কোল ভরা বাচ্চাকাচ্চাই না মানায় তাকে। এই বয়সে এখন খুব করে দরকার বাচ্চার। মন ভরা বউ আর কোল ভরা বাচ্চা৷ সুখের একটা জীবন। আর কি চাই?
পিহা ছোট চাচিকে ডেকে আনতেই তিনি অস্থির হলেন। নতুন জামাইয়ের কোলে মেয়ে দুটো ঘুমে কাঁদা। তৌসিফ হাসিমুখেই প্রস্তাব দিলো,
— কোন রুমে রাখব আমাকে দেখিয়ে দিন। রেখে আসছি।
চাচি বিব্রতই হলেন। পিহা রুম দেখালো। তৌসিফ পিহার সাথে যেতেই পেছনে থাকা মানুষ গুলো যেন কথা ছাড়লো। ছোট চাচি তো বড় চাচিকে বলেই ফেললেন,
— দেখলেন আপা, বয়স বা অতীত দেখে মানুষ চিনা যায় না। পৌষ’র মুখ দেখেই আমি বুঝেছিলাম ও সুখে আছে। তৌসিফ খারাপ মানুষ না। লোকমুখে শোনা কথায় কান দেয়াই উত্তম। বড় ভাই যা করেছিলেন ঠিকই ছিলো। সোনার কপাল আমার পৌষ’র।
বড় চাচির মুখটা হাসি হাসি। স্বামীর মুখে কথা বলেন না তিনি তবুও পৌষ’র কথা তুলেছিলেন৷ কথা তার একটাই ছিলো পৌষটা ভালো থাকুক। সুখে থাকুক। আর কি চাই?
তৌসিফ ইনি,মিনিকে বিছানায় শুয়িয়ে দিতেই তারা ওর হাত আঁকড়ে ধরলো। তৌসিফ হাসলো মিষ্টি মুখো হয়ে। পা থেকে স্লিপার খুলে বিছানায় উঠে বসলো। মিনি হাত বাড়ালো এর অর্থ কোলে তুলো আমাকে। ঘুম কাতুরি মিনিকে কোলে তুলে হেলান দিলো তৌসিফ। পাশেই ওকে ঘেঁষে ইনি ঘুম৷ চৈত্র আর জৈষ্ঠ্যও উঠে বসলো। পিহার দিকে আদেশ ছুঁড়লো আবদারের স্বরে,
— পিহু সোনা? চাচিকে বল চা দিতে।
পিহা উঠে দাঁড়ালো। বের হবে তখনই দেখলো হেমন্ত চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে ঢুকছে। পিহা ভাবলো এখন সেও আড্ডা দিবে দুলাভাইয়ের সাথে কিন্তু তার কপালে বুঝি আড্ডা সয়? হেমন্ত গমগমে স্বরে বললো,
— পিহু সোনা, চাচি ডাকে যা তো।
নিচের ঠোঁটটা বের করে হাটা দিলো পিহা। হেমন্ত সবার আগে তৌসিফের হাতে চা দিয়ে বললো,
— সম্পর্কে কিছুটা ভাই হলেও এখন কিন্তু একদম সমন্ধী লাগি৷
— অবশ্যই।
জৈষ্ঠ্য আর চৈত্র বললো,
— দুলাভাই কাল পদ্মায় যাবেন? সকালে ইলিশ ধরব।
তৌসিফ চায়ে চুমুক বসিয়ে বললো,
— আজ চলে যাচ্ছি। আবার আসব তখন যাব। তোমার বোনকেও নিয়ে যাব। ওর এসবে ইনট্রেস অনেক।
তিন ভাই মুখ চাওয়া চওয়ি করলো। পৌষ’কে আজ পিটালেও পৌষ নড়বে না৷ চালাক তৌসিফ তালুকদার কি তা জানে?
ওদের মাঝেই পিহা উঁকি দিলো। তার হাতে একটা ট্রে। একদমই হালকা কিছু নাস্তা তাতে। মা পাঠালো। ওদের সামনে দিতেই তৌসিফ জিজ্ঞেস করলো,
— তোমার আপা কোথায়?
পিহা বসে উত্তর করলো,
— ভাবীর সাথে দুলাভাই। ডাকব?
তৌসিফ একটু ভেবে বললো,
— খেয়েছে?
পিহার জানা নেই আপা খেলো কি না তাই মাথা নেড়ে বললো,
— না মনে হয়।
তৌসিফ নিজেই উঠে দেখতো। গতরাতের পর বউটা দূর্বল দূর্বল কিছুটা। না খেয়ে এখন আবার কোথায় জানি বসে আছে। বুকে মিনি থাকায় উঠে যেতে পারলো না তৌসিফ। হেমন্ত অবশ্য দুই বার বললো মিনিকে তাকে দিতে কিন্তু তৌফিক দেয় নি। পিহার দিকে তাকিয়ে শুধু বললো,
— তোমার আপাকে খেতে বলে আসবে শালী সাহেবা?
“শালী সাহেবা” ডাকটা শুনা মাত্র লজ্জা পেলো পিহা। উঠে যেতে যেতে বললো,
— কেন নয় দুলাভাই।
______________________
শ্রেয়ার সাথে সেই যে ফুঁসুর ফাঁসুর শুরু হলো এখনও থামার নাম নেই। পিহা দরজা ঠেলে ঢুকলো। দেখলো শ্রেয়ার বিছানায় শুয়ে আছে পৌষ পাশেই বসা শ্রেয়া। পিহা ঢুকেই বললো,
— আপা দুলাভাই তোমাকে খেতে বলেছে।
পৌষ কপাল কুঁচকে বললো,
— কোথায় উনি?
–নিচেই আছে। ইনি,মিনি ঘুমালো ওদের নিয়েই বসে আছে। আপা জানো দুলাভাই কত্তো ভালো।
পিহার চোখে মুখে উপচে পড়া উচ্ছাস। শ্রেয়া কৌতুহল গলায় বললো,
— কি কি করলো দুলাভাই যে এত ভালো হয়ে গেলো?
পিহা পা তুলে বসলো। হাতে থাকা কাটা পেয়ারা মাখা ওদের সামনে দিয়ে বললো,
— মিনিকে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়ালো। কত সুন্দর সুন্দর কথা বলে। চৈত্র ভাই আর জৈষ্ঠ্য ভাই বলেছে পদ্মারপাড়ে যাবে৷ দুলাভাই বললো আজ নাকি থাকবে না। ও আপা থাকো না আজকে।
পিহা’র চোখ মুখ উজ্জ্বল, আশাদীপ্ত। পৌষ খিটমিট করে বললো,
— আগামী এক সপ্তাহেও আমি নড়ছি না।
পিহা দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। খবরটা দুলাভাই’কে দিতে হবে। শ্রেয়া হাসতে হাসতেই বললো,
— তুই এভাবে কতক্ষণ লুকিয়ে থাকবি?
— যতক্ষণ না ব্যাটা রাজি হয়।
শ্রেয়া পেয়ারা মুখে দিলো এক পিস। বললো,
— ভাগ্য করে পেয়েছিস পৌষ। যত্ন করে রাখিস।
— আমার বুকের ভিতর রাখি তাকে ভাবী। একদম ভারী সিন্দুকে তালা দিয়ে রাখি। সে আমার না পাওয়া সুখ। আকাশস্পর্শী প্রেম।
শ্রেয়া খেয়াল করলো পৌষ’র চোখ দুটো চিকচিক করছে। পৌষ’র হাত ধরে বললো,
— সুখী হ।
শ্রেয়া একটু থেমে জিজ্ঞেস করলো,
— একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
— এভাবে কেন বলো? বলো।
— ঐ কাজের মেয়েটা মানে যাকে নিয়ে এত বদনাম তার আচরণ কেমন দেখলি?
পৌষ ভাবুক হলো। সোহার আচরণ সে কোন কালেই সুবিধার দেখি নি। শ্রেয়াই বললো,
— আমি তৌসিফ ভাইকে এখন সন্দেহ করতে পারি না পৌষ। কিন্তু বিনা কারণে এত বড় কুৎসা রটলো?
— ওনার সৎ বোন সোহা ভাবী। ওমন কিছু নেই কিন্তু সোহা বা মিনু এদের প্রতি ওনার আচরণ ততটা বুঝি না আমি। যথেষ্ট নরম।
— তুই প্রশ্ন করিস নি?
— করেছি।
— উত্তর দেয় নি?
— দিয়েছে।
একটু চুপ থেকে পৌষ বললো,
— উনি মেয়েবাজ পুরুষ না ভাবী এটা আমিই বলতে পারি ভাবী তবে ঐ মেয়ে সোহা, ও সুবিধার না৷
শ্রেয়া কিছু একটা ভেবে বললো,
— এটাকে বিদায় করলেই হলো।
— বলেছি আমি।
কথাটা মিনমিন করেই বললো পৌষ। দরজায় দাঁড়ানো তৌসিফ সবটা শুনলো। মুখে তার বাঁকা হাসি। বউটা কাল বড়সড় একটা সারপ্রাইজ পেতে চলেছে। তৌসিফকে দেখেই শ্রেয়া বলে উঠলো,
— আরে দুলাভাই, ভেতরে আসুন।
তৌসিফ ঢুকেই বললো,
— পৌষরাত, রাতে কিন্তু চলে যাচ্ছি আমরা।
পৌষ মুখ ঘুরালো। এর মানে জানা আছে তৌসিফে’র। চালাক পুরুষ সে তাই বললো,
— আচ্ছা একটু দরকার। তোমার রুমে এসো তো।
বলেই অপেক্ষা না করে চলে গেল তৌসিফ। পিছুপিছু পা ফেলে গেলো পৌষ। রুমে ঢুকা মাত্রই দরজাটা আলগোছে বন্ধ করে দিলো তৌসিফ। পৌষ ছটফট করে বলে উঠলো,
— দরজা খুলুন। এই দরজা খুলুন মিয়া।
যেই না দরজা খুলতে যাবে তখনই তৌসিফ ওর হাত টেনে ধরলো। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— লাফালাফি করছো কেন হানি? কথা শুনো।
— মানে কি? দরজা লাগালেন কেন?
— আহা কি হলো? কিচ্ছু করব না।
— আজব! লজ্জা লাগে না আমার? কেমন দেখালো এটা? চাচারা বাসায়। তাদের সামনে দরজা কেন লাগালেন আপনি?
তৌসিফের মাথায় এতক্ষণ কথাটা ঢুকলো। বক্র হেসে দুই হাতে পৌষ’র গাল দুটো ধরলো। অতি সন্তপর্ণে ঠোঁটে চুমু দিলো একটা। ব্যস! ঠান্ডা পৌষরাত। সুযোগটা লুফে নিলো তৌসিফ। পৌষ’র মুখে লেপ্টে দিলো প্রেমময় সুধা। বোধহারা হলো পৌষ৷ মুখ লুকালো তার পুরুষটার বুকে। দুই হাতে আগলে নিলো তৌসিফ। প্রশ্ন করলো,
— আরেকবার হবে?
— উহু।
— হুয়াই হানি?
— উমমম।
তৌসিফ হাসলো। ফিসফিস করে বললো,
— আমার লজ্জাবতী।
#চলবে…..
পর্বঃ৩৮
মাথামুন্ডু সবই আপাতত খারাপ হয়ে আছে পৌষ’র। রাগে, দুঃখে কান্না পায় ওর কিন্তু কাঁদে না। তৌসিফ’কে এত করে বলছে ও থাকবে আজ কিন্তু এই মহা লোক মানতে নারাজ, পৌষও আর মানাতে নারাজ। কতক্ষণ তুলুতুলু করবে আর? মানুষের বিবেক থাকা উচিত। এতদিন পর বাবার বাড়ী এসেছে থাকাটা মাস্ট কিন্তু হায় কপাল! এই কপালে জুটেছে তালুকদার বাড়ীর ছোট ছেলে। কপালটাকে মাঝেমধ্যে মন চায় সুপ্রসন্ন ভেবে নিজেই চুমু দিতে আবার মাঝেমধ্যে মন চায় ঝামা দিয়ে ঘঁষে পরিষ্কার করতে। কি এক কান্ড! শা*লার কপালটাই খারাপ। দেখেদুখে এক জামাই জুটেছে। তৌসিফ বউকে দেখছে অনেকক্ষণ যাবৎ। বউটা যেতে রাজি না কিন্তু যেতে তো হবেই। কাল সোহা’র পাঠ চুকাবে তৌসিফ। সংসারে তার শান্তি চাই ই চাই। বউ তার ভালো মন্দ বুঝে। ভলো একটা সুযোগ বুঝেই বাচ্চাকাচ্চা চাইবে তৌসিফ। যদি বউ রাজি হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা আর যদি এখন পড়তে চায়, বাচ্চা পরে চায় তাহলে নাহয় একটু ধৈর্য ধারণ করবে তৌসিফ। জীবনে সে কমতো ধৈর্য ধরলো না। বাবা হওয়ার স্বাদটা নাহয় আর কিছু বছর পরই পেলো। ভাবনার জগৎ থেকে বের হলো তৌসিফ। দরদ মাখা কণ্ঠে বললো,
— এখন রুমে আছো যে? রাতেই চলে যাব হানি। ভাই-বোনদের সময় দাও এখন।
— আমি যাব না।
কাঠকাঠ একবাক্যে পৌষ’র। তৌসিফ খাটে হেলান দিয়ে বসা। ওভাবে থেকেই স্বাভাবিক ভাবে বললো,
— ইটস ইম্পরট্যান্ট হানি। ট্রাই টু…..
— না না না। আমি কিছুই বুঝব না। যাব না মানে না।
এই দফায় তৌসিফ উঠলো। বউ তার এত জেদী হয়েছে। এসে ধরার আগেই ছ্যাঁত করে উঠে পৌষ। তৌসিফ’কে ছুঁতেও দিলো না। ব্যপারটা একজন পুরুষের জন্য গায়ে লাগার মতো হলো তারমধ্যে সামনের জন স্বয়ং তৌসিফ তালুকদার। দাঁত চেপে অপমানটুকু গিলে নিলো তৌসিফ যা সে বিয়ের প্রথম দিন থেকে গিলছে। একটা টু শব্দ না করে গিলছে সে। শুধু মাত্র পৌষ’র জন্য। প্রথম হয়তো ভালোবাসা ছিলো না কিন্তু এখন? এখন তো তৌসিফ জান হারায় এই পৌষ’র মাঝে। তার রাগ, জেদ সবটা শিরোধার্য। তৌসিফ পৌষ’র হাতটা জোর করে ধরে নরম স্বরে বললো,
— তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে হানি। আমরা আবার আসব। বলছি না আমি? তোতাপাখি আমার না তুমি?
ঝটাক মে’রে হাত সরালো পৌষ। চোখ দুটো তুলে রাগী দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে বললো,
— আপনার বিবেকও বাঁধে না এমন আচরণ করতে? বিয়ের ঠিক কয়মাস পর আনলেন এখানে? আপনিই বলুন। আর সারপ্রাইজ? নিশ্চিত কোন নাইটি ধরিয়ে দিবেন আমার হাতে…….
রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে কথাগুলো বলতে নিলেই স্ব জোড়ে এক ধমক খেলো পৌষ,
— অ্যাই চুপ!
আচমকা তৌসিফে’র গলার সুর বদলালো। পৌষ বড়বড় চোখে তাকিয়ে তখনও। তৌসিফ পুণরায় ধমক দিলো,
— চোখ নিচে নামাও!
ভয়ে মিহিয়ে গেলো পৌষ। এই মানুষটার রাগ সে ভয় পায় তাই যথেষ্ট সমীহ করে চলে। তৌসিফের তোপের মুখে বার কয়েক পরেছিলো পৌষ। ভয়ে তার বুকটা এখনও ধুকধুক করছে। মাথাটা নামিয়ে গুটিয়ে গেলো একদম। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো কান্না আটকাতে। কিন্তু সেই কপাল বুঝি আছে তার? চোখ দুটো বেইমানি করে বসলো। পানির ধারা গড়িয়ে পরলো। তৌফিক’কে মন, প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে ও। তৌসিফ ছাড়া যে ওর গতি নেই তা খুব ভালো করেই জানা পৌষ’র। নিজেকে খুব সাবধানে তৌসিফে’র হাতে সপেছে পৌষ। তৌসিফ অবশ্য মান রাখে। যত্নে আগলে রাখে। পুরুষ মানুষ রাগ থাকাটাই স্বাভাবিক। এখনকার বেয়াদবির ফলে ধমকটাও প্রাপ্ত তার। পৌষ জানে এটা কিন্তু ঐ যে ভয়। তৌসিফে’র ভয় তার আজও কাটে নি।
তৌসিফ তাকিয়ে পৌষ’র পানে। ওর থেকে বেশি না দুই হাত দূরে বসা। চোখে মুখে ভয় তার। কিছুটা আতঙ্ক। তৌসিফ ধমকটা শুধু শুধু দেয় নি। তার বিশ্বাস সম্পর্কে সম্মান জিনিসটা দরকার। একটু বেশিই দরকার। পৌষ’কেও সম্মান করে তৌসিফ। স্বামী হিসেবে হোক বা বয়সের হিসেবে তৌসিফ বড় সেই সুবাদে এহেন উচ্চবাক্য বেয়াদব বৈ কিছুই না। মাঝেমধ্যে অবশ্য তৌসিফের নিজের উপর ই রাগ হয়। বিয়ের পরপরই পৌষ’র সাথে একদিন জঘন্য এক কাজ করেছিলো সে। সেই থেকে হয়তো মেয়েটা ভয় পায় বেশি। রাগ উঠলে তার মাথা ঠিক থাকে না। তবে হ্যাঁ, এতটুকু ভয় কিন্তু সম্পর্কের সৌন্দর্য। এতটুকু ভয় প্রতিটা দাম্পত্য জীবনে দরকার। এটা সম্পর্কের মাধুর্য ধরে রাখে। একটা ব্যালেন্স হয়।
চাইলেই এখন বউকে বুঝিয়ে মানিয়ে নিতে সক্ষম তৌসিফ তবে নিজের পায়ে কুড়াল মা’রার পাবলিক তৌসিফ না। গটগট পায়ে রুম ত্যাগ করলো ও। পৌষ নাক টানলো। মানুষটা কি বেশিই রেগে গেলো? পৌষ কি করবে? ওর যে মুখটা বেশিই চলে একটু। এত বছরের তৈরী করা মুখ চাইলেই কি কম চালানো যায়? সে তো জানে তার তোতাপাখি মন থেকে বলে নি তবুও রাগ কমলো না? নিজেকে অপরাধী ভাবলো পৌষ। মনটা বেজার হলো নিমিষেই। চোখের পানি মুছতেই দেখলো পিহা ঢুকছে। হাসি মুখে আপা’কে দেখেই বললো,
— বাইরে এসো আপা। নাস্তার জন্য ডাকে।
— তোর দুলাভাই কি চলে গেল?
— কই যাবে? দুলাভাই তো চৈত্র ভাইয়ের সাথে বসা। আমরা সবাই আছি। মা পিঠা বানিয়েছে। আসো তুমি।
পৌষ’র বুকটা একটু হলেও শান্ত হলো। ও তো ভাবলো রাগে বুঝি জামাই তার ফুড়ুৎ হয়ে গেলো। সুন্দর মুখো এক জামাই। জ্বালা সব পৌষ’র৷ ভয়ই লাগে। কখন না উঁড়ে যায়। হায়! সে যে কি জ্বালা তা নারী মন বৈ কেউ বুঝবে না। জামাই আগলে রাখাও এক তপস্যার বিষয় যা রোজ করে বেড়াচ্ছে পৌষরাত হক তালুকদার।
_____________________
মাগরিবের আজান দিলো মাত্র। চোখে, মুখে পানি দিয়ে রুম ত্যাগ করলো পৌষ। চোখ দুটো ভালো করে মুছে নিলো যাতে কেউ বুঝতে না পারে। সবসময় অল্পতে বাড়ী মাথায় তোলা পৌষ এখন কান্না লুকাতে জানে। কেউ বুঝলেই জিজ্ঞেস করবে চোখ ফুলার কারণ তখন পৌষ কিভাবে উত্তর দিবে? হাতে নিজের পার্সটা নিয়েই বের হলো। ড্রয়িং রুমে দুমসে আড্ডা চলছে। সবাই বেশ খোশমেজাজে আছে। পৌষ’র বুকটা ফেটে কান্না পায়। সে থাকতে চায় কিছুদিন কিন্তু তৌসিফ মানবে না। একেতো থাকা হবে না তার উপর তৌসিফ উল্টো রেগে গেলো। নাক টেনে উপস্থিত হলো পৌষ। জৈষ্ঠ্য বোনকে দেখেই বলে উঠলো,
— আপা এখানে বসো। দেখো তোমার না ডিম পিঠা পছন্দ।
পছন্দের ডিম পিঠাটাও আজ ওর খেতে মন টানলো না। মনটা তার কাছে আজকাল থাকেই না। তৌসিফ তালুকদার চুরি করেছে সেটা। ব্যাটা পাক্কা চোর একটা। ইনি, মিনি তৌসিফে’র পাশে বসা। তৌসিফ ছিত পিঠায় হাঁসের মাংস দিয়ে শালী দুটোর মুখে দিলো। মিনি আপাকে ডাকলো,
— আপা আপা আথো না।
ইনিও তাল মিলিয়ে ডাকলো। তৌসিফে’র পাশে বসার সাহস পৌষ’র নেই। সবার সামনে যদি তার রাগ প্রকাশ করে বসে তখন?
হেমন্ত হঠাৎ খেয়াল করলো পৌষ’র হাতে ব্যাগ। কপাল কুঁচকে তাকালো ও। জিজ্ঞেস করলো বোনকে,
— কোথাও বের হচ্ছিস?
মাথা নাড়ে পৌষ। হালকা শব্দে বলে,
— চলে যাচ্ছি হেমু ভাই।
এক সাথে অনেকগুলো চোখ তাকালো ওর পানে। তৌসিফ ও তাকালো। মুখে তার বক্র এক হাসির রেখা। ও জানতো এটাই হবে। পৌষ’কে এখান থেকে নেয়া যতটা সহজ ঠিক ততটাই কঠিন। তখন যদি বউকে ভয় ভাঙাতে বুকে আগলে নিতো তাহলেই এক লাফে তৌসিফে’র মাথায় চড়ে বসতো সে তাই তো তখন রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে এলো। এখন বউ উল্টো নিজে রাজি। হেমন্ত কিছুটা ধমকের গলায় বললো,
— ফাইজলামি করিস? যা ঘরে ব্যগ রেখে আয়। পিহু সোনা তোর আপা’র ব্যাগ রেখে আয় তো।
পিহা দৌড়ে এগিয়ে এলো। ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করলেও পৌষ দিলো না। পৌষ থমকানো গলায় বললো,
— আবার আসব। আজ যাই। কাজ আছে একটু।
শ্রেয়া তৌসিফে’র দিকে তাকালো। বুঝার চেষ্টা করলো অতঃপর জিজ্ঞেস করলো,
— তুই না বললি থাকবি?
— কাজ আছে ভাবী নাহয় থাকতাম।
তৌসিফ পিঠা মুখে দিলো। ইনি, মিনি খাবে না আর। টেবিল ভর্তি হরেক রকমের পিঠা। বড় চাচা উঠে এলেন। পৌষ’র মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
— কিছু নিয়ে রেগে আছিস আম্মা? থেকে যা না আজ।
চোখ দুটো টলমল করে উঠলো হঠাৎ। বড় চাচার অনুরোধ ভালো লাগলো না ওর। চাচার হাত ধরে পৌষ নরম স্বরে বললো,
— আবার আসব তো।
— বেশি জরুরি?
— হু।
চৈত্র এসে আপার বাহু জড়িয়ে ধরলো। জৈষ্ঠ্য গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে রইলো পাশে। পিহা নাক, মুখ লাল করে ফেললো। ইনি, মিনি বুঝলো কিছু হয়েছে। নেমে আপার কাছে এসেই হাঁটু জড়িয়ে ধরলো দুটো। তোতলানো শব্দে বললো,
— আপা? আপা, কি হয়েতে?
চাচিরা তৌসিফে’র মাথায় হাত রাখতে সঙ্কোচ করলেন। মুখেই বললেন,
— বাবা যদি আজ….
তৌসিফ সাধু রইলো বটে। বললো,
— পৌষরাত থাকলে আমার সমস্যা নেই।
পৌষ’র বুক ফেটে কান্না পেলো। পৌষ থাকলে নাকি ব্যাটার সমস্যা নেই। কেন নেই? থাকতে হবে সমস্যা। একশত বার থাকতে হবে।বউ থাকতে তুই ব্যাটা কেন বউ ছাড়া থাকবি?
হতাশ চাচিরা দ্রুত হাতে খাবার প্যাক করলো। তৌসিফ যা যা পিঠা পছন্দ করেছে সব দিলো সাথে। ফোন আসাতে তৌসিফ বিদায় জানিয়ে বের হলো। ও বের হতেই পৌষ ছাড়াতে চাইলো ভাই বোনদের কিন্তু হায় তা বুঝি হয়? কান্নার রোল পরে গেলো মুহুর্তেই। পৌষ শক্ত হাতে সামলালো কিন্তু সম্ভব হলো না। হঠাৎ ই তৌসিফ ফিরে এলো। পৌষ ভেবেছিলো লোকটা ফিরবে না ভেতরে। তৌসিফ এসেই ইনি, মিনিকে কোলে তুললো। আল্লাহ মালুম সে কি বুঝালো তারা থামলো। তৌসিফের দুই গালে দুটো চুমু দিয়ে আদর লাগিয়ে বললো,
— দুলাভাই থাতো না পিলিত।
#চলবে……
পর্বঃ৩৯
গাড়ির এক কোণায় লেগে বসে আছে পৌষ। শেষ বেলায় তাদের থাকাটা হলো না। ইনি, মিনিকে কোন এক জাদু বলে বুঝ দিয়েছে তৌসিফ। পৌষ তো মুখে তালা দেয়া সেই কখন থেকে। মনটাও তার ভার ভার।লোকটা রেগে তার উপর। কথা বার্তাও ততটা বলছে না। শেষবার মনে হয় বুঝি সিট বেল্টটা লাগালো। এই তো। পৌষ তখনকার চোখ গরমই এখনও ভুলতে অক্ষম। ঢোক গিলে জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলো ও। সারি সারি কাশফুল দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারে অবশ্য ততটা দেখা গেলো না। তৌসিফকে নিয়ে ঘুরতে মন চাইলেও পৌষ কথা বললো না। মূলত সাহসটাই হচ্ছে না।
একমনে ড্রাইভিং করছে তৌসিফ। তার নজর সড়কে। একটুও হেরফের হয় নি। মনোযোগ সম্পূর্ণ ড্রাইভিং এ হলেও তার ধ্যান আছে পৌষ’র উপর। চুপচাপ থাকার মেয়ে পৌষ না। তখনকার ধমকে এখনও থমকে আছে ও। তৌসিফ ভেবে নিলো বাসায় গিয়েই মানিয়ে নিবে। সেটা মুশকিল কিছু না অবশ্য।
গাড়িটা বাড়ীর সামনে থামতেই তৌসিফ নামলো। দারোয়ান এসে আগেভাগে পৌষ’র সাইডে ডোর খুলে দিতেই বেরিয়ে এলো পৌষ। সোজা হাটা দিলো উপরে। তৌসিফ সেদিকে নজর দিয়ে ফোন বের করে কাউকে কল লাগালো। কথা বলতে বলতে হাটা দিলো উপরে।
রুমে এসে পোশাক বদলে বারান্দায় চলে এলো পৌষ। শরৎ কাল চলমান। শারদীয় বাতাসে বুনো এক গন্ধ। বাড়ীটার চারপাশই গাছ গাছালিতে ভরপুর। কৃষ্ণচূড়া গাছটা নজর কাড়ার মতো বটে। রাতের আকাশপানে তাকিয়ে পৌষ৷ মেঘগুলো ফুলা ফুলা। ঠান্ডা বাতাস বইছে হঠাৎ ই। বৃষ্টি বৃষ্টি একটা ভাবও বিরাজমান৷ তবে আদৌ বৃষ্টিপাত হবে কি না বুঝা দায়। ঠিক যেমন বুঝা দায় তৌসিফ তালুকদার’কে। এবছর কাশফুল দেখা হয় নি পৌষ’র। প্রতি বছরই এসময় হেমন্ত সব ভাই-বোন নিয়ে বিকেলে বেরিয়ে যায়। দুপুরের রোদ গড়িয়ে যখন বিকেল তখন থেকে সন্ধ্যা অবদি ওর কাঁশবনে ঘুরে। পৌষ’র অবশ্য দিয়া বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো যা কোনদিন পূরণ হয় নি। ইনি, মিনি এতদূর যেতে পারবে না। ওদের নিয়ে সর্বোচ্চ সারিঘাট অবদি যায় হেমন্ত। সেখানেই সারা বিকেল ঘুরে ওরা। খাল জাতীয় জায়গাটাতে নৌকা ভাড়া করে চড়ে বেড়ায়। এবছর বুঝি ঐ আনন্দটা মাটি চাপা যাবে। কথাগুলো ভেবেই ভেতর থেকে চাপা শ্বাস ছাড়লো পৌষ।
সম্মুখে রাখা কেদারায় গা এলিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। পুকুর ভরা কচুরিপানা ছিলো যা আজ নেই। হয়তো তারা পরিষ্কার করালো। নৌকাটাও আজ একদম এই সাইডে কিণারায় বাঁধা। পৌষ ততটা ভাবলো না। দেখা যাবে তৌসিফ’কে কিছু বললে দিবে আবার এক ধমক। এমনিতেই লোকটা রেগে আছে। যদিও পৌষ নিজের দোষ স্বীকার করে তবুও অবুঝ মনটা বড়ই লোভী। সে আহ্লাদ পেলেই আহ্লাদী হয়ে উঠে। এই যেমন তৌসিফে’র প্রেমসুধা পানের পর থেকে তার মনে গভীর লোভ জাগ্রত হয়েছে। নিজের দোষ জানা সত্ত্বেও অভিমান জমেছে মনের কোণে। এই অভিমান তালুকদার বাড়ীর ছোট ছেলে ছাড়া কেউ ভাঙতে পারবে না। কিন্তু কথা হলো সেই তৌসিফ তালুকদার কি আদৌ রাগ ভাঙাবে? সে তো নিজেই টম্বুস হয়ে আছে ফুলে।
.
তৌসিফ রুমে ঢুকলো রাত দশটা নাগাদ। ক্ষুধা লেগেছে তার। কাল বাসায় গেস্ট আসবে তার জন্যই মূলত দেড়ী হলো একটু। বউটা সেই কখন থেকে তার অপেক্ষায় আছে। নিশ্চিত নিজেও খায় নি। এতটুকু তো তৌসিফ চেনে তার বউকে। আজ আবার তার উপর অভিমানও করেছে নিশ্চিত। মুখ দেখেই বুঝা যায়। তৌসিফ অবশ্য এ ব্যাপারে মাথা ঘামাবে না। বেয়াদবি করবা তো ধমক খাবা। মাঝেমধ্যে ধমক খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো আর তৌসিফ খুব করে চায় তার বউ সুস্থ থাকুক।
রুমে ঢুকবে ঠিক সেই সময় আবারও মুঠোফোন টা বেজে উঠলো। ওর পিএ ইমু কল দিয়েছে। রিসিভ করে কথা বলতে বলতে রুমে ঢুকে তৌসিফ। সারা রুম জুড়ে নীরবতা। তৌসিফ কানে ফোনটা ধরেই ডাকলো,
— হানি? আর ইউ দেয়ার?
উত্তর এলো না। তৌসিফ লাইন অন করে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো। বিছানা খালি। ওয়াশরুম ও খালি। ইমুকে গম্ভীর কণ্ঠে তৌসিফ বললো,
— কাল সকাল সকাল পার্লার গার্ল বাসায় পাঠিয়ে দিবে। আর হ্যাঁ, তুমিও চলে এসো। কাজ আছে। আর এখন কল দিবে না।
উত্তরের আশা না করেই খট করে কলটা কেটে দিলো তৌসিফ। ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে পরণে থাকা শার্টের বোতাম খুললো দুটো। বারান্দায় যেতেই দেখা মিললো পৌষ’র। রেলিং এ মাথা ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে সে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সেদিকে এগিয়ে এলো তৌসিফ। ঘুমন্ত ক্লান্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো কৃয়ংকাল। নিজির অজান্তেই হাত চলে গেল ওর মাথায়। পৌষ’র চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ক্ষীণ শব্দ করে ডাকলো তৌসিফ,
— তোতাপাখি উঠবে না?
ডাকটা শুনলো না। শুনানোর জন্য অবশ্য পৌষ’কে ডাকে নি। নিজে ওর পাশে গা এলিয়ে বসে আলতো হাতে বউকে টেনে নিলো বুকে। অল্প ঘুমে থাকা পৌষ হয়তো কিছুটা সজাগ হলো। নাকে ঠেকলো তীব্র পুরুষনালী গন্ধ। সেই বুকটার উপরের দিকে দুটো বোতাম খোলা। খোলা বুকে তখন লোম উঁকি দিচ্ছে যা আস্কারা দেয় পৌষ’কে। সে মুখটা ঠেকায় উন্মুক্ত স্থানে। বুকে মুখ গুজে চুপ করে রয়। তৌসিফ বউকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলো। কিছুটা শক্ত করে। কিছুটা নরম হাতে।
মৃদু মৃদু বাতাস বয়ে চলছে তখন। নড়চড় নেই পৌষ’র। তৌসিফ অনুভব করলো বুকে থাকা নারীটিকে যার চাওয়া পাওয়া অতি নগন্য। ওর সিঁথিতে চুমু দিলো তৌসিফ। ডাকলো,
— পৌষরাত?
— হুউ।
— উঠো খাবে না?
— উহু।
— ক্ষুধা লেগেছে হানি।
পৌষ সরে যেতে চাইলো তবে তৌসিফ না ছাড়ায় পৌষ বলে উঠলো,
— ছাড়ুন। আমি রুমে যাই। আপনি খেয়ে আসুন।
— আমি খেয়ে আসব মানে? তুমি খাবে না?
— না।
— কারণ?
— ক্ষুধা নেই।
— মিথ্যা কাকে বলছো?
— সত্যি….
— চুপ!
অতি ঠান্ডা ধমক। পৌষ সরে যেতে চাইলো তবে ছাড়া হলো না তাকে। এক টানে নিজের উপর নিয়ে উঠে দাঁড়ালো তৌসিফ। রুমে নিয়ে ধপ করে ফেললো খাটে। নরম তুলতুলে গদিতে ব্যথার ব টাও লাগলো না পৌষ’র কিন্তু তৌসিফ যখন ওর উপর চড়াও হলো তখন একটু ব্যথা পেলো বটে।
তৌসিফ’কে নিজের উপর দেখে মুখ ঘুরায় পৌষ। অনীহা তাও কি না তৌসিফে’র প্রতি? সেটা আবার এক রাতে? মানা যায়? উহু। তৌসিফ মানে না। ঘুরানো মুখটা হাত দিয়ে নিজের বরাবর করে ও। দৃষ্টি পৌষ’র চোখের দিকে। পৌষ বেশিক্ষণ তাকাতে পারলো না। অল্প স্বরে বললো,
— উঠুন। ব্যথা পাচ্ছি আমি।
— ব্যথা পাচ্ছো? কই কাল রাতে তো এরচাইতেও বেশি ওজন সহ্য করেছো?
লজ্জায় লাল রঙা হতে পারলো না পৌষ। অতটা ফর্সা সে না। তৌসিফ ওর এক গালে হাত দিয়ে বললো ভেজা নরম স্বরে,
— তখনকার ধমকটা তোমার পাওয়া ছিলো পৌষরাত। আশা করি এটা তুমিও জানো। আমি তোমার কত বড় তা তো জানো। সেই সুবাদেও তোমার আমাকে চোখ তুলে উচ্চবাচ্য তাও কি না ওমন ফালতু কথা বলার সাহস থাকা উচিত না। আর কি বলেছিলো নাইটি? সিরিয়াসলি হানি? এতটা বছর নারী ছাড়া ছিলাম আমি। কখনো চরিত্র খারাপ করি নি অথচ একরাত তোমার কাছে আসাতে কি বললে তুমি?
অনুমতি তো তুমি অনেক আগেই দিয়েছিলে আমি সময় দিয়েছি তাতেও তবুও তুমি এই কথা বললে আমাকে? স্বামী’কে এসব বলা কি বেয়াদবি না? আর বেয়াদবি করলে কি তোমাকে শাসন করার অধিকার আমার নেই? বাকিসব স্বামীদের মতো এখন তোমার কাছে নিচু হয়ে সরি বলতে পারছি না পৌষরাত। ক্লান্ত লাগছে। ঘুমাব আমি।
টলমলে চোখ দুটি দিয়ে তাকিয়ে রইলো পৌষ। ওর দোষ তো ও জানে তবুও মনটা বড্ড বেইমানি দেখালো আজ। তৌসিফ যে এতটা হার্ট হয়েছে তা ও বুঝতে পারে নি। বুঝলে অন্তত নিজে অভিমান করে থাকতো না। তৌসিফ ওর উপর থেকে সরে যেতে নিলেই পৌষ আটকালো। তৌসিফ অবশ্য ছাড়িয়ে নিলো। বিছানা ছাড়তে নিলেই আচমকা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে পৌষ। পিঠে চুমু দিয়ে ক্ষীণ স্বরে জানায়,
— সরি।
তৌসিফ উত্তর দেয় না অথচ ওর ঠোঁটে চোরা হাসি। তৌসিফে’র উত্তর না পেয়ে হতাশ হলো পৌষ। লোকটা কি বেশিই রেগে আছে? পৌষ ওকে ছেড়ে সামনে এলো। শার্টের বোতাম গুলো খুলতে খুলতে বললো,
— ফ্রেশ হবেন না?
তৌসিফ নিরুত্তাপ। ওর উদাসীনতা আঘাত করে পৌষ’কে। ওর জামাই যে একটা ধরিবাজ তা ধরতে পারে না পৌষ। তাই তো জামাই এর মন মানাতে এত কাজ করছে। শার্ট খুলে দিতেই হাটু গেড়ে বসে পৌষ। তৌসিফে’র সু আর মুজা খুলে রেখে আসে। তৌসিফ ততক্ষণে ওয়াশরুমে। টাওয়াল হাতে দাঁড়িয়ে থাকে পৌষ। কপাল একটা। জামাই কি মান ভাঙাবে উল্টো জামাই এর মান ভাঙাতে তৎপর পৌষ।
তৌসিফ বের হতেই টাওয়াল এগিয়ে দিলো পৌষ। নিজের চুলগুলো খোঁপা করে বললো,
— চলুন খাবেন।
তৌসিফ ভাবশালীন ভাবে তাকিয়ে গা ঝাড়া ভাবে বললো,
— তুমি যাও।
পৌষ হতাশ হলো। এ কেমন মেয়েদের মতো জেদ? তেল না দিয়ে পৌষ বেরিয়ে গেলো। তৌসিফ হতবাক হলো। বউ কি তাকে পাত্তা দিলো না? এটা কিছু হলো? পাত্তা পেতে তখন মরিয়া তৌসিফ তালুকদার ঠিক তখনই তার ছটফট করা হৃদয় শান্ত হলো। খাবার হাতে পৌষ এসেছে। টেবিলে বসে তৌসিফে’র হাত ধরে বসালো। মেখে মুখে তুলে দিলো তো গিললো তৌসিফ। পৌষ হতাশ! খুবই হতাশ! জামাই পেয়েছে একখানা। পুরাই চমলোক্ক।
খাওয়া শেষ হতেই নিজে খেয়ে রুমে এলো পৌষ। তৌসিফ আধ শোয়া হয়ে বসা বিছানায়। পৌষ চুপচাপ গিয়ে তার পাশে বসলো। লাইট অফ করে তৌসিফে’র পাশে শুতেই হঠাৎ টের পেলো ওর পা দুটো কারো শক্ত পা দ্বারা বদ্ধ। মৃদু শ্বাস ফেললো পৌষ। তৌসিফ গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ করলো,
— বুকে এসো।
পৌষ মাথাটা বুকে রাখতেই তৌসিফ আচমকা বো’ম ফাটালো,
— কাল সোহার বিয়ে। মেহেদীর সাথে। পারিবারিক ভাবেই আপাতত বিয়ে সেরে তুলে দিব কাল।
বাকরুদ্ধ, হতভম্ব, বিস্মিত পৌষ। আচমকা খুশি সে এতটাই হলো যে কথা বলার ভাষা পেলো না।
#চলবে…..