প্রেমসুধা সাইয়্যারা_খান পর্বঃ৪১

0
2

প্রেমসুধা
সাইয়্যারা_খান
পর্বঃ৪১

গটগট পা ফেলে সোহা’র রুমে সোজা ঢুকলো তৌসিফ। এখনও রেডি হওয়ার সময় সে পায়নি। সোহা’র পরণে নিজের কিনে আনা দামী লেহেঙ্গা। তৌসিফ শুরুতেই ধমকে উঠলো,

— বলেছিলাম না শাড়ী পরতে? মিনু বলেছে না? মেহেদীরা চলে আসবে যেকোনো সময়। দশ মিনিট দিলাম শাড়ী পরো যেটা মেহেদী পাঠিয়েছে।

তৌসিফে’র ধমক গুলো যেন গায়ে কাঁটার বর্ম ফুঁটালো। সোহা’র বুকটা কেঁপে উঠলো মুহুর্তের মাঝে। ঘর কাঁপানো যেন প্রতিটা শব্দ তার। শিউরে উঠে সোহা। টলমল হয় চোখ জোড়া। তৌসিফ পাত্তা দিলো না। সোহা বুকে সাহস জমা করলো। শেষবারের মতো চেষ্টা করলো বিয়েটা আটকাবার।

— আমি বিয়েটা করতে চাই না।

নিচু শব্দে বললো সোহা। তৌসিফ যেন কথাটা কানেই তুললো না। কেমন একটা চাহনি দিলো অতঃপর গমগমে গলায় বললো,

— তৈরী হও শিঘ্রই।

— আমি বলেছি মেহেদী’কে বিয়ে করব না। দেখো কি পাঠিয়েছে আমাকে। এই শাড়ীর মতো তিনটা শাড়ী আমার ড্রেস বিক্রি করলে পাওয়া যাবে।

— তাহলে নিজের ড্রেস বিক্রি করে দাও।

— মানে?

— মানে সেটাই যেটা বললাম। আমি তৌসিফের মুখের কথার উপর দিয়ে টপকে কোন কাজ করলে ছুঁয়ে ফেলে দিতে সেকেন্ড সময় ও নিব না। হয় আজ মেহেদী’কে ভদ্রমতো বিয়ে নয়তো আমার বাড়ী থেকে আউট। আর হ্যাঁ, যেই ড্রেসের বড়াই করছো সেটার উপযুক্ত কি না ভেবে দেখো। আমি ঠাই না দিলে আজ কোথায় থাকতে ভেবেছো? সদর ঘাটে গার্মেন্টসে চাকরি করে খেতে হতো। তখন এত তুলুতুলু ভাব থাকতো না। নীল দুনিয়া থেকে বের হও। কার টাকায় পা মাটিতে রাখো না ভেবে দেখো।

কাটখোট্টা গলায় কথাগুলো বলেই বেরিয়ে গেলো তৌসিফ। মেজাজটাই যেন খারাপ হয়ে গেলো ওর। মনে মনে বিশ্রী এক গালি দিতেও যেন ভুললো না। প্যান্টের পকেট হাত দিতেই দেখলো সিগারেটের প্যাকেটটা নেই। এবার বেজায় বিরক্ত তৌসিফ। মুখটা যেন বিতৃষ্ণা লাগছে তার। একটা সুখ টান এখন দিতে হবেই। ধুপধাপ পা ফেলে রুমে ঢুকেই ড্রয়ার হাতরে প্যাকেট নিলো। লাইটার দিয়ে জ্বালিয়ে মুখে গুজেই লম্বা এক টান দিলো। মুহুর্তেই নাক, মুখ দিয়ে গলগলিয়ে ধোঁয়া বের হলো। সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। কাজিও শিঘ্রই চলে আসবে। মেহেদীরা আসলেই তৌসিফ আগে বিয়েটা পড়াবে। খাওয়া দাওয়া, হাল হকিকত জিজ্ঞেস করার বহুত সময় আছে।
মাথাটা এলিয়ে দিলো তৌসিফ। সাইড থেকে চিনচিন করছে তবে খুবই অল্প। হঠাৎ কারো কাশির শব্দ পেয়ে হাতে থাকা সিগারেটটা’র দিকে তাকালো তৌসিফ। খেয়াল করলো কাশতে কাশতে ওর দিকে তেড়ে আসছে পৌষ। পরণে পাকিস্তানি এক গাড়াড়া। উল্টে পরবে নাকি উস্টা খাবে সেই খেয়াল নেই। তৌসিফ মাথাটা তুলেই কোনমতে শুধু বলেছে,

— উস্টা খাবে তো হানি….

কথাটা বলেই যেন আরো ক্ষেপালো সে তার হানি’কে। এক ঝটকায় তৌসিফে’র কিছুটা উপরে উঠে এলো পৌষ। ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলো,

— আমি উস্টা খেয়ে বুস্টা হয়ে যাই। এরপর বুস্টা হয়েই চাঁন্দের দেশে চলে যাই। সেখানে গিয়ে কাঁথা বানাই। সেই কাঁথা ফিক্কে ফিক্কে পৃথিবী বাসীকে পাঠাই। তাতে আপনার কি হ্যাঁ?

তৌসিফ যে না চাইতেই সুনামি ডেকেছে তা ও খুব সহজেই বুঝে গেলো। এলোমেলো চুলে বউটাকে ঠাকুমার ঝুড়ির ডাইনীর মতো লাগছে। এই কথা অবশ্য বলা যাবে না। বললেই জাঁহাপনার হুকুম তামিল করে গর্দান যাবে। তৌসিফ আবার কঁচিতে কঁচিতে বউকে সালাম দিয়ে চলে। এই যেমন এই মুহুর্তে বউ ক্ষ্যাপাটে হয়ে আছে। যেই কোন মুহুর্তে সে হামলা দিতে পারে। তৌসিফ এই অবস্থায় শান্ত। সংসার সুন্দর করার এক মোক্ষম হাতিয়ার হলো চুপ থাকা। একজন আগুন তো অন্যজন পানি। আগুন কখনো আগুন নেভায় না আবার পানিও পানিতে কোন উদ্দীপনা সৃষ্টি করে না, তারা একদমই নিটোল। তাই তো হতে হবে বিপরীতমুখী। তৌসিফ আপাতত পানির ভূমিকায় আছে কারণ বউ আছে আগুনের ভুমিকায়। এর কারণ অবশ্য যথাযথ। সিগারেট খাওয়া পছন্দ করে না পৌষ। মেয়েটার কাশি উঠে যায়। তৌসিফও ততটা খাচ্ছে না। তবে মুখের তৃষ্ণা অথবা বহু পুরাতন অভ্যাস যাই হোক না কেন সেটার নিবারক হিসেবে খুব মাঝেমধ্যে সুখ টান দেয়া হয়। পৌষ যে এত তারাতাড়ি বেরিয়ে আসবে তা কে জানতো? জানলে বুঝি নিজের বউকে চাঁদে গিয়ে কাঁথা বানানোর মতো কাজে লিপ্ত হওয়ার মতো দুঃখ তৌসিফ দেয়? উহু। মোটেও দিতো না।

হঠাৎ ই হাতে টান পরলো। তৌসিফ দেখলো পৌষ ওর হাত ধরে টানছে সিগারেট নিতে। মুখ খুলে তৌসিফ শুধু জিজ্ঞেস করলো,

— আহা! এটা টানছো কেন? ফেলছি তো।

— ফেলবেন ক্যান? আমি খাব। দিন আমাকে। এখনই দিন। আমিও খাই। দেখি কি এমন আছে যা আপনাকে টানে। কোন সুখ আছে এটাতে যা আপানকে এটা ছাড়তে দেয় না। কি এমন মধু আছে এটাতে? বলুন আমাকে? দিন আমিও খাব। দেখব আজ।

মুখে বলতে বলতে সমান তালে টানছে পৌষ। তৌসিফ জানে বউ তার কিছুটা তারছিঁড়া তাই তো ঝট করে আগে সিগারেট নিভালো। এক হাতে পৌষ’কে আটকে রেখে অন্য হাতে থাকা সিগারেট ফেলে দিয়ে আস্তে করে বললো,

— আচ্ছা রে বাবা আর খাব না।

— আমি কেন আপনার বাবা হব? বউ লাগি বউ। ব যোগ উ। বুঝেছেন?

— বুঝেছি।

— সিগারেট খাব।

— দেয়া যাবে না।

— কেন?

— হৃদপিণ্ডে হামলা দিবে।

— ওওওওও তাই নাকি? আহা! ইহা কিতা বলিলেন আপনি? ওমা! এতো আজ প্রথমবার শুনলাম। কি আশ্চর্য, আমি তো বিস্মিত হয়ে গেলাম। এই এই ধরুন আমাকে। এই কথা শুনার আগে আমি ম’রে গেলাম না ক্যান? সিগারেট হৃদপিণ্ডে হামলা দেয়? কি অবাক করা কথা! হায় তওবা! তিনবার তওবা।

এমন বিশ্রী ভাবে যে পৌষ ভেঙ্গাবে তা কাশ্মির কালেও ভাবে নি তৌসিফ। মুখটাকে চার ট্যামরা করে ব্যাঙ্গ করে যাচ্ছে পৌষ। কটুক্তি গুলো খুব সহজে হজম করে চুপ করে তৌসিফ হাত বাড়ালো। পৌষ’র চুলে হাত দিলে নিলেই তড়াক করে সরে দাঁড়ালো পৌষ। একদম সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পাংশুটে মুখ করে বললো,

— আজ আমার ধারেকাছে আসবেন না আপনি। যেদিন এই সিগারেট ছাড়তে পারবেন সেদিন আসবেন।

তৌসিফ উঠে দাঁড়ালো। বেশ ঠান্ডা স্বরেই বললো,

— আর খাব না।

— এই কথা আপনি আগেও বলেছেন। কথা রেখেছিলেন?

কণ্ঠে কাঁপন বুঝা গেলো। বেইমান চোখ দুটো ভরে উঠলো। ঠোঁট দুটো সমান তালে কেঁপে যাচ্ছে। তারা ভেঙে পরে কাঁদতে চাইছে। হয় রাগ নাহয় অভিমান। কোন এক কারণে এই দশা পৌষরাতে’র। সঠিক কারণ তার জানা নেই। তৌসিফ মনোযোগ দিয়ে দেখলো ওকে অতঃপর এক হাত ধরে নিলো। পৌষ ঝটকা দিয়ে সরাতে চাইলেও সরালো না। ও এতটুকু তো বুঝেছে পুরুষ মানুষ প্রত্যাখ্যান জিনিসটা ততটা পছন্দ করে না আর সেই পুরুষ যদি হয় তৌসিফ তালুকদার তাহলে তো কিচ্ছাই খতম।
তৌসিফ পৌষ’র হাতটা নিয়ে স্থান দিলো নিজের বুকে। সময় নিয়ে অনুভব করালো তার সিস্টোল ডায়াস্টল। কিছুপল যেতেই নম্রস্বভাব নিয়ে বললো,

— কথা দিচ্ছি আর খাব না।

— যেই কথা রাখতে পারবেন না সেই কথা দিয়ে কি লাভ?

— আচ্ছা। মাঝেমধ্যে খাব।

— না।

— সপ্তাহে একটা।

— না।

— মাসে?

— না।

— ওহ প্লিজ পৌষরাত! বছরে একটা খাওয়া না খাওয়া একই কথা।

পৌষ খিটমিট করে বলে উঠলো,

— কখন বলেছি বছরে একটার অনুমতি দিব? ছাড়ুন হাত।

তৌসিফ ছাড়লো না। পৌষ’র কোমড় জড়িয়ে নিয়ে কিছু বলতে নিলেই পৌষ “ওয়াক ওয়াক” করে উঠলো। তৌসিফ কিছু বলা বা করার আগেই পৌষ ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

— আপনার মুখে গন্ধ।

তৌসিফ এই পর্যায়ে খুবই অসহায় বোধ করলো। কি এক বউ তার। পুরাই পৌষ মাসের মতো। এই বৃষ্টি তো এই গরম।

______________________

মেহেদী’রা পৌঁছাল ঘন্টা খানিক দেড়ী করে। আসার পথে গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। কেউ যদিও আহত হয়নি তবে মুরুব্বি ধাঁচের দুইজন বলাবলি করেছে পথে বাঁধা যেহেতু এসেছে এই বিয়েতে তাহলে না আগানোই ভালো। মেহেদী অবশ্য পাত্তা দেয় নি তবে ওর মা-বাবার চোখে মুখেও আতঙ্কের ছাপ দেখা গিয়েছে। মেহেদী যেন দেখেও দেখে না। তৌসিফ ভাই তার জন্য অনেক করেছে। আজ যখন তার জন্য কিছু করার পালা তখন মেহেদী পিছিয়ে থাকবে না। তার নিজের তো কোন পছন্দ নেই। বিয়ে তো করবেই তাহলে তাকেই করুক যাকে তৌসিফ ভাই পছন্দ করে দিলো। নিশ্চিত এর মধ্যে ভালো কিছু আছে।
ওরা সবাই ড্রয়িং রুম জুড়ে বসেছে। তখনই দেখা মিললো তৌসিফে’র। রুম থেকে বের হচ্ছে। পরণে তার সাদা একটা সিম্পল পাঞ্জাবী তবে হাতের কাজ করা বুকের দিকে আর হাতে। মুখ ভরা তার দাড়ী। দেখতে চমৎকার দেখালো। অতি সুন্দর একজন পুরুষ সে। তার কাছে যেন বর বেশে থাকা মেহেদীও ফিঁকে। মেহেদী যদিও ততটা সাজসজ্জা করে নি। সাধারণ এক পাঞ্জাবীই পরেছে। তৌসিফ বের হতেই পিছন পিছন পৌষ বের হলো। কাজ ছাড়া এক গাড়াড়া পরে মাথায় হিজাব পরেছে সে। সাজ বলতে শুধু ঠোঁটে একটু লিপস্টিক। তৌসিফ না করেছে সাজতে। পৌষও মেনে নিয়েছে।
তৌসিফ কাজিকে শুরুতেই বললো,

— বিয়েটা আগে হোক।

কাজি মাথা নাড়লেন। একজন মুরুব্বি বললেন,

— এত তাড়া কিসের বাবা? আগে তো….

তৌসিফ গমগমে স্বরে বললো,

— কি মেহেদী? বিয়ে করবে না?

— জ্বি জ্বি ভাই।

তারাহুরো করে বলে উঠলো মেহেদী। তৌসিফ বাঁকা হেসে মিনুকে বললো,

— সোহাকে আন।

মিনিট দুই যেতেই সোহা’র আগমন ঘটলো। সেই কমদামী শাড়ীটিই তার পরণে। তৌসিফ ফিরেও তাকালো না। মেহেদী’র পাশে ফাঁকা জায়গায় তাকে বসানো হলো। সোহা শক্ত হয়ে রইলো যেন। কাজি কবুল বলতে বললেও সোহা যখন চুপ করে রইলো তখন পৌষ এগিয়ে এলো। সোহা’র পাশে বসে হাতটা ধরলো। ও জানে এই সময় কেমন লাগে। পৌষ’রও এমন দিন গিয়েছে। তার পাশে কেউ ছিলো না। কেউ না। যারা এতিম তাদের আল্লাহ বাদে কেউ নেই। এই যে সোহা। ওরও কেউ নেই। পৌষ সব খারাপ কিছু ভুলেই সোহা’র হাত শক্ত করে ধরে আস্তে করে বললো,

— কবুল বলে দিন আপু। উনি আপনার জন্য নিশ্চিত খারাপ কাউকে পছন্দ করবেন না। নিজের দায়িত্ব উনি যথাযথ ভাবেই পালন করবেন।

সরলমনা পৌষ কথাটা বলতেই সোহা মুখ ফুটে কবুল বললো। ও জানে ওর আগেপিছে কেউ নেই। এই বিয়ে ওকে করতেই হবে। সোহা কবুল বলা মাত্রই মেহেদীও কবুল বললো। সকলে আলহামদুলিল্লাহ বলতেই তৌসিফ নিজ হাতে সবার আগে জামাই বউ অতঃপর একে একে সবার মিষ্টি মুখ করালো। তার মুখটা হাসি হাসি। পৌষ চমকালো। খুব অবাক হলো। লোকটা গিরগিটি। কিভাবে রং বদলালো। এতক্ষণ মুখটা কেমন ভারী ভারী করে রেখেছিলো অথচ এখন যেই না বিয়েটা হলো ওমনিই সে রং বদলাচ্ছে।
বাকিরাও অবশ্য চমকেছে। বিশেষ করে মেহেদীর মা-বাবা। তারা যেন শো এসেছে। বলার বা করার কিছুই নেই। তাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে কেন নিজের সৎ বোন বিয়ে দিচ্ছে তৌসিফ এর উত্তর তাদের জানা নেই। না জিজ্ঞেস করার সাহস আছে।
.
খাওয়া দাওয়া হতেই সোহা’কে বিদায় দেয়া হলো। গলা ছেড়ে মিনু কাঁদলো। সোহা পাথর বনে আছে। ওর সামনে অতি কমদামী একটা গাড়ি তাও ভাড়া করা। জীবন তার কোথায় মোড় নিলো সে জানে না। মিনু’কে শুধু বললো,

— কাঁদিস না। তোকে নিয়ে যাব।

— আজ চলি আপা?

— না।

সোহা যেতে নিলেই আচমকা পৌষ এসে জড়িয়ে ধরলো। সোহা চমকালো তবে কথা বললো না। পৌষ শুধু বললো,

— মন দিয়ে সংসার করুন আপা।

পৌষ যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই সরে গেলো। তৌসিফ আগ বাড়িয়ে কথা বলে নি। ওদের বিদায় কালটা সাদামাটা ভাবেই হলো। তৌসিফ বিরবির করে শুধু বললো,

— বালা টললো।

পৌষ পাশ থেকে বলে উঠলো,

— কি বললেন?

— কি আর বলব?

— তাও ঠিক। মামাতো ভাই না আপনি আমার? আপনার কি ই বা বলার থাকতে পারে?

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here