প্রেমসুধা
সাইয়্যারা_খান
পর্বঃ৪৫
তারা হীন আকাশ আজ চাঁদের দখলে। ভরাট হয়নি এখনও অথচ তার সৌন্দর্য যেনো চুয়ে চুয়ে পরছে। ঠান্ডা বাতাসে শরীর মন দুলিয়ে উঠে বারংবার। বাইরের সকল সৌন্দর্য যখন চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে তখন তাদের দাপট কমাতে দরজা,জানালা আটকে রেখেছে নব দম্পতি। রুদ্ধ আবদ্ধ রুমের মাঝে যখন গভীর প্রেম হয় তখন বাইরে থাকা নিশাচর পাখি ভয়ংকর সুর তুলে গান গায়। ঝিঁঝিঁ পোকার দল যেন আক্রমণ হানতে চায়। তাদের আলোয় আলোকিত করতে চায় অন্ধকার রুমটাকে যাতে প্রেমে ডুবন্ত জোড়াটা প্রেমসুধা পান করছে। তাদের মিষ্টি মধুর ক্ষণে ফুটে উঠে শালুক ফুল। লাজে যখন মরিমরি ভাব তখনই বেলাজা ফুলটা তার কিশোরী বদন দেখাতে ব্যাস্ত। একান্ত মানুষটার কাছে যতই নিজেকে খুইয়ে দিতে চাও না কেন তৃপ্তি তো শুধু তার সেই গভীর থেকেও গভীর প্রেমে।
দরজা খুলে এদিক ওদিক উঁকি দিলো মেহেদী। নিস্তব্ধ ড্রয়িং রুমে কেউ নেই। রুমে ঢুকে সোহা’র গায়ে হাত দিয়ে ডাকলো মেহেদী,
— সোহা? সোহা?
সোহা একটু তাকিয়ে আবার ঘুমাতে চাইলো কিন্তু মেহেদী ওকে সেই সুযোগ দিলো না। হাতটা ধরে উঠালো সন্তপর্ণে। সোহা’কে তুলতে তুলতে বললো,
— ফজর হলেই সবাই উঠা শুরু করবে সোহা। কাম ফাস্ট।
এমনি সময়ই সোহা কমন ওয়াশরুম ব্যবহার করে না আজ এহেন অবস্থায় তা যেন অতি অস্তির লাগলো সোহার নিকট। মেহেদী ওকে সোজা নিয়ে ওয়াশরুমে রেখে দরজায় দাঁড়ালো। সময় কাটছে দ্রুত। মেহেদী বাইরে দাঁড়িয়েই হাসফাস করতে লাগলো। একদিকে সময় গড়াচ্ছে অপর দিকে আজান হলেই মা-বাবা উঠে যাবে। কি এক অবস্থা হবে তখন। সোহা বের হতেই মেহেদী সস্তির শ্বাস নিলো। সোহা’কে রুমে রেখেই তারাতাড়ি নিজে গোসল সারলো। কপাল ভালো বিধায় মেহেদীরও গোসল শেষ আর আজান হলো। রুমে গিয়ে দরজা লাগাতেই দেখলো এক কোণায় বসা সোহা। পরণে সাদা একটা কামিজ সেট। চুলে পেঁচিয়ে রাখা টাওয়াল দেখে মেহেদী বললো,
— চুল মুছে নাও সোহা৷ ঠান্ডা লাগবে।
চোখ তুলে তাকায় সোহা। মেহেদী’র কথা মতো চুল ছেড়ে দিয়ে বলে,
— আচ্ছা, আপনি একটা নতুন ফ্লাট নিতে পারবেন না মেহেদী?
মেহেদী’র মনে হলো বিয়ের পর ওর বায়না করলো একটা যা মেটানো অসম্ভব আপাতত। দুই পা এগিয়ে এসে বিছানায় বসলো মেহেদী। সোহা’র হাতটা ধরে নরম স্বরে বললো,
— এখন তো সম্ভব না সোহা। টাকায় পোষাবে না। এটার ভাড়াই তো অনেক।
সোহা যেন ভাবলো কিছু অতঃপর মুখ খুলে বললো,
— তাহলে এক কাজ করুন, আপনার মা-বাবাকে এই রুমে শিফট করে দিন।
মেহেদী সরাসরি নাকচ করে দিলো। একটু গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
— এটা কখনো ভাববে না সোহা। মা-বাবা বৃদ্ধ মানুষ। তোমাকে তো একটু আগেই বললাম আমি?
সোহা দেখলো হঠাৎ করেই কেমন রাগী কণ্ঠে কথা বলছে মেহেদী। পুরুষ বুঝি এমনই হয়? সোহা আস্তে করে সাইড হয়ে শুয়ে পরে। চোখ বুজে কাঁথা টানে গায়ে। সম্পূর্ণ অপরিচিত এক লোকের সাথে ওর বিয়ে হলো অতঃপর ঝট করেই সোহা আবেগপ্রবণ হয়ে পরে আর নিজের শক্ত খোলস ত্যাগ করে চলে আসে বছর বছর আগের নরম সোহায়। নিজেকে সমর্পণ করে মেহেদীর নিকট। যার ফলাফল সরুপ দেখলো সোহা।
মেহেদী তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। উঠে চলে গেলো নামাজে। একবার অবশ্য সোহা’কেও পড়তে বলে গেলো। সোহা শুনলো না।
মেহেদী ফিরে দেখলো যেমনকার সোহা তেমনই৷ মনে মনে অনুতপ্ত মেহেদী। লাইট না জ্বালিয়েই সোহা’র পেছনে গিয়ে শুয়ে পরে মেহেদী। সময় গড়ায়। আলগোছে সোহা’র কাঁথার ভিতর ঢুকে শক্ত করে জড়িয়ে নেয় মেহেদী। আদর লাগিয়ে ডাকে,
— সোহা?
উত্তর আসে না অবশ্য। মেহেদী ওর কপালে চুমু দিয়ে আস্তে আস্তে বলে,
— একটু সময় দাও। একটু মানিয়ে নাও।
সোহা প্রতিক্রিয়া দেখালো না৷ ও জানে এটাই ওর জীবন। নিজের মায়ের মতো দ্বিতীয় বিবাহ করে কাউকে অন্ধকারে রাখবে না সোহা। কখনোই না।
তাই তো মেহেদী’র ডাকে সাড়া দিয়েছিলো যা এখনও মেহেদী’র বুকে মাথা রেখে দিয়ে যাচ্ছে। আগাছাদের আজন্মকাল আগাছাই থাকা উচিত। সোহা মিথ্যার পেছনে ছুটেছিলো তাই তো হাতের মুঠো খালি তার যা আদৌ কখনো মেহেদী ভরকে কি না সন্দেহ।
__________________
এই পর্যন্ত তিনবার বমি করলো পৌষ। তৌসিফ ব্যাস্ত। পাগল পাগল হয়ে গেলো। শেষ দিকে যখন বমির মধ্যে লাল তরল দেখা গেলো তখন অতি রাগে সে যা নয় তা বলেই পৌষ’কে ধমকাতে লাগলো। একেকটা ধমক যেন ঘর কাঁপানো।
সকাল মাত্র সাতটা। বাইরে সমান তালে পাখিগুলো চেঁচাচ্ছে। পৌষ’র হাত-পা কাঁপছে সমানে। তৌসিফে’র এত রাগ দেখে রীতিমতো নিজেই অবাক হয়ে গেলো। ভয়ে যেন সামনেও যেতে চাইছে না। তৌসিফে’র চিৎকারে বুয়া গুলো সব দরজার বাইরে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতর থেকে হঠাৎ কিছু ভাঙার শব্দ আসতেই মিনু ভয় পেয়ে গেলো। একবার ভাবলো হয়তো পৌষ’কে মা’রছে। গতরাত থেকে মিনু’র মনে পৌষ এক বিশেষ স্থান পেয়েছে। মিনু যখন ওর আপার জন্য কাঁদছিলো তখন মিনু’কে আগলে নিয়ে পৌষ সময় দিলো। এখন মিনু’র মন কাঁদছে পৌষ’র জন্য।
ওয়াশরুমের দরজা ধরেই দাঁড়িয়ে আছে পৌষ। ভেজা মুখটাতে চোখের পানি বুঝা যাচ্ছে না। তৌসিফ ওর বাহু টেনে ধরতেই অল্প স্বরে পৌষ বলে উঠলো,
— আহ! ছাড়ুন আমাকে।
তৌসিফ ওকে বিছানায় বসিয়ে রাগে হিসহিসিয়ে বললো,
— একটা কথা বললে জানে মেরে ফেলব।
পৌষ কাঁপে অল্প। ওর দূর্বল শরীরটা আঁকড়ে ধরে তৌসিফ’কে। রাগে ফুঁপিয়ে উঠে তৌসিফ। ধরে না পৌষ’কে। এই মেয়ে কথা শুনে না। যা মন চায় খায়। ঔষধের ঠিক ঠিকানা নেই। শুধু শুধু তৌসিফ কেন পাগল হবে?
পৌষ মৃদুস্বরে বললো,
— শুনুন কুট্টুসের আব্বু, আপনি আমাকে এত কেন বকছেন?
এত রাগের মধ্যে পৌষ’র কথায় ভ্রুঁ কুঁচকায় তৌসিফ। শীতল হয় বরফের মতো। জিজ্ঞেস করে,
— কে কুট্টুস?
— আমাদের না হওয়া বাবু।
— পিরিয়ড ঠিকঠাক আছে?
— হু।
— শিওর?
— হুম।
— কথা তো শুনো না আমার।
— এই যে শুনছি।
— পৌষরাত?
ডাকটা ভিন্ন শোনালো। পৌষ মাথা তুলে তাকাতেই তৌসিফ বললো,
— কিট আনাই একটা? টেস্ট করবে?
পৌষ অবাক স্বরে বললো,
— কোন দুঃখে?
— যদি হয়।
— কেন হবে?
— মানে কি কেন হবে? হতেই পারে।
— কোন সুযোগ নেই।
— সুযোগ নেই মানে? কি বলতে চাও? আমি পারি না?
পৌষ হেসে ফেললো। বললো,
— হতাশ হবেন তো।
— তবুও একবার দেখি।
তৌসিফ কাউকে কল দিলো কিট আনতে। পৌষ গা এলিয়ে দিলো। ওর শরীর খারাপ লাগছে। তখনই কল আসে তৌসিফে’র। তৌফিক কল করেছে। কথা বলতে বলতে বারান্দায় গেলো তৌসিফ। একদফা কথা কাটাকাটি হলো। রাগে যখন টবে লাত্থি দিয়ে ভেঙে ফেললো তখনই ছুটে এলো পৌষ। কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসটুকু অবশ্য হলো না। ফাঁকা ঢোক গিললো একটা। শুধু শুনতে পেলো,
— ঐ জা***র তো আমাকে চিনে না। চাপা’তি দিয়ে বটি বটি করব ওকে।
ভয়ংকর সব কথা শুনে পৌষ’র গা গুলিয়ে উঠলো। তখনই তৌসিফ আরো কিছু জঘন্য উচ্চারণ করতেই সেখানেই গলগল করে ঢেলে দিলো পৌষ। তৌসিফ তখন ফোন রেখেছে। পৌষ’কে ধরতেই দূর্বল পৌষ বলতে লাগলো,
— ছাড়ুন আমাকে। ছাড়ুন। কাকে খু*ন করবেন আপনি? অ্যাই আপনি মানুষ মা’রেন? আমি গুলি দেখেছি আপনার কাছে। সত্যি বলুন। আপনি কি করেন?
তৌসিফ উত্তর দিলো না। পৌষ ছটফট করে উঠলো। শক্ত করে ওকে ধরে বুয়াকে ডাকলো তৌসিফ। এক ডাকে হুরমুর করে তিনজন বুয়া ঢুকলো। তৌসিফ পাত্তা না দিয়ে বললো,
— রুম পরিষ্কার করো।
পৌষ নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। সরতে সরতে বললো,
— আমারটা আমিই পরিষ্কার করব।
তৌসিফ সরল দৃষ্টি ফেলে বললো,
— ওকে ফাইন।
পৌষ নিজেই সবটা পরিষ্কার করলো। বুকে হাত বেঁধে দেখলো তৌসিফ। বুয়াদের চলে যেতে বলতেই তারা চলে গেল। ছপাৎ করে শব্দ হতেই দৌড়ে ঢুকলো তৌসিফ ততক্ষণে চিৎ হয়ে ফ্লোরে পরেছে পৌষ।
#চলবে…..