প্রেমসুধা সাইয়্যারা_খান পর্বঃ৪৬

0
2

প্রেমসুধা
সাইয়্যারা_খান
পর্বঃ৪৬

শীত শীত ভাব তবে ঠান্ডা নেই। সকাল থেকে রাত কুয়াশায় চারপাশ ঘেরা অথচ শীতের হদিস নেই। এমন আবহাওয়ায় তৌসিফের হাত ধরে অগাধ বিচরণ করতে মন চাইলো পৌষ’র। গাড়ীতে বসেই বাইরের আবহাওয়া দেখছে ও। এদিকে গাড়ি চলছে অতি দ্রুত বেগে। পৌষ’র জ্বর উঠেছে হঠাৎ। তৌসিফের বুকে মাথা দিয়ে চুপচাপ বাইরে দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত ও সাথে শুনতে ব্যস্ত গম্ভীর মানুষটার ঘনঘন ধুকপুক ধুকপুক শব্দ। চোখে মুখে বারবার আছড়ে পরছে তৌসিফে’র ফেলা গরম নিঃশ্বাস। লোকটা উদ্বীগ্ন হয়ে আছে। এই যে শরৎ এর কি সুন্দর বাতাস বইছে অথচ তৌসিফের খেয়াল নেই সেদিকে। আকাশটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে বহু কষ্টে কান্না চাপা রেখেছে। যেকোন সময় তার বাঁধভাঙা অশ্রুতে প্লাবিত হবে ধরণীর বুক।
আবহাওয়া আজ তৌসিফে’রই পক্ষে। তৌসিফে’র চোখ মুখেও একই ভাবে আঁধার ঘনিয়ে আছে। গাড়ির মধ্যেই কাঁপতে থাকা পৌষ’কে কম্বল দিয়ে পেঁচিয়ে বুকে নিয়েছে ও। তৌসিফে’র মনটা খুব করে কু ডাকছে। কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে জ্বরটা সুবিধার না। চোখ বুজলো তৌসিফ। সকাল থেকে ঘটে যাওয়া প্রতিটি কথা যেন ওর মস্তিষ্কে একটু একটু করে পুনরাবৃত্তি ঘটছে।

কত সুন্দর সকাল থেকে বাড়ী জুড়ে দৌড়ালো মেয়েটা। সাত সকালে বমি করার পরও তৌসিফের বারণ সত্ত্বে পৌষই ব্রেকফাস্ট বানালো। গতরাতেই নাকি ও নল্লি বসিয়েছিলো। আজ সকাল হতেই কাজের লোক থেকে বাইরে থেকে নান আনিয়ে ব্রেকফাস্টে সার্ভ করলো। মিনু’কে নিজে গিয়ে ডেকে বসালো ওদের সাথে। ঘ্রাণে তখন ক্ষুধা বেড়েছিলো তৌসিফে’র। পৌষ ওর প্লেটে বড় একটা নলি তুলে দিলো। নিজে বেড়ে বেড়ে খাওয়ালো। তখনও জ্বর নেই। শুধু খেতে খেতে পৌষ বললো,

— গলাটা জ্বলছে।

তৌসিফ অরেঞ্জ জুসটা এগিয়ে দিলো ওর দিকে৷ মুখে বললো,

— বমি করাতে হয়তো।

— হুম।

হুম বললেও জুস মুখে তুলে না পৌষ। তৌসিফ নিজেই ওর ঠোঁটের কাছে গ্লাসটা তুলে ধরে। এক চুমুক দিয়েই পৌষ বলে,

— উম, তেঁতো এটা।

কপালে ভাজ ফেলে তৌসিফ বলে,

— এটা তেঁতো? না খাওয়ার বাহানা তোমার হানি৷ শেষ করো। দেখি মুখ খুলো।

পৌষ খাবে না। জোর করেও যখন লাভ হলো না তখন তৌসিফ নিজে এক চুমুক খেলো। পৌষ’র দিকে তাকিয়ে বললো,

— নাও খেলাম আমি৷ কোন তেঁতো না এটা। পাঁচ বছর ধরে জুস খাচ্ছি এটা আমি কখনো তেঁতো লাগে নি।

অসহায় চোখে তাকালো পৌষ যা দেখে জোর করার সাহস পেলো না তৌসিফ। বউটার শরীর খারাপ। একটু একটু আবার আশা আছে তাদের। টেস্ট করাতে হবে। কিট আনিয়েছে তৌসিফ। কথাটা ভাবতেই ওর বুকটা কেমন দুরুদুরু করে। কেমন হাত-পা ঝিমঝিম লাগে। অসহ্য এক যন্ত্রণাময় অনুভূতি। তৌসিফের বহু বছরের শখ বাবা হাওয়া। বাচ্চাকাচ্চা তার কাছে অতি প্রিয়।
খেয়ে ওরা উঠতেই পৌষ বুয়াদের বুঝালো কি কি রান্না করতে হবে। পৌষ নিজে একপদ করবে। সবই ঠিক ছিলো তখনও। রুমে ঢুকতেই পৌষ দেখলো তৌসিফ মনোযোগ দিয়ে কিছু পরছে। গোলাপি আর সাদা রঙের কিছু তার কাছে। পৌষ দূর থেকে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,

— কি এটা?

— গুড নিউজ।

থতমত খেয়ে গেলো পৌষ। দুই লাভ দিয়ে তৌসিফে’র কাছে এসে গলায় ঝুলে যেতেই তৌসিফ ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে এক হাতে। ব্যালেন্স পায় পৌষ। পিটপিট করে তৌসিফে’র চোখে তাকিয়ে বলে,

— আপনাকে সুন্দর লাগছে।

তৌসিফ গভীর দৃষ্টি ফেলে তাকালো। কণ্ঠে এক রাশ ভালোবাসা ঢেলে দিলো অবলীলায়। জানালো লহু স্বরে,

— তোমাকে সবসময় সুন্দর লাগে পৌষরাত৷ আমার তোতাপাখিটাকে আমার কাছে বেশ লাগে দেখতে। তোমার নাক, মুখ, গলা, কান সব ভালো লাগে। তোমার প্রতিটি কথা ভালো লাগে। এই যে গলায় ঝুলে আছো, বিশ্বাস করো হানি, আমার বুকের ভেতর সুখ লাগছে।

পৌষ তৌসিফে’র কাঁধে মুখ লুকালো। তৌসিফ ওর চুলের ভাজে হাত গলিয়ে দিলো। শান্ত স্বরে বললো,

— এখন চেক করবে?

— ভয় লাগে তো।

— কেন?

— যদি হয়ে যায়?

— হলে হবে। তুমি চাও না?

— আপনি যেটা চান আমিও সেটা চাই।

— তাহলে ভয় কেন হানি? বিশ্বাস নেই তোমার আমার উপর?

এই প্রশ্নের প্রেক্ষিতে মাথা তুললো পৌষ। তৌসিফে’র ওষ্ঠে নিজ থেকে ভালোবাসা দিলো এক রত্তি। বললো,

— আপনি জানেন পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। যার মা-বাবা নেই তার কেউ নেই সেই হিসেবে আমারও কিন্তু নেই। চাচারা ভালোবাসে। সবাই আদর করে। হেমু ভাই থেকে নিয়ে ছোট্ট ইনি, মিনিও আমাকে ভালোবাসে। আমিও ওদের ভালোবাসি। আমার ভাই-বোনদের ভালোবাসা স্বার্থহীন কিন্তু চাচাদের বুঝি না। আচ্ছা ইনি, মিনি বা পিহা যদি আমার জায়গায় হতো তাহলে কি এভাবে বানের জলে ভাসিয়ে দিতো? দিতো না। আমি কেন সবাই জানে দিতো না। শুধু মাত্র পৌষ এতিম বলে দিয়েছে। ভেবেছে বড়লোক মানুষ টাকা দিয়ে সুখী রাখবে আমাকে। এটা কিন্তু নিজেদের ক্ষেত্রে ভাবতো না। এখানে আপনি আমাকে যদি এতটা ভালো না বাসতেন তাহলে আজকের পৌষরাত এভাবে আপনার বুকে থাকতো না। ঠেলায় পরে সংসার ঠিকই করা হতো কিন্তু সুখ তো পেতাম না। আপনার ভালোবাসার কাছে আমর’রণ আমি কৃতজ্ঞ থাকব। আর আপনি কি না জিজ্ঞেস করলেন, বিশ্বাস করি কি না?

তৌসিফে’র মনে হলো ওর কণ্ঠনালী কেউ চেপে ধরেছে। পৌষ’র মনে অসংখ্য প্রশ্ন। যার উত্তর তৌসিফ এখন দিতে চায় না। শুধু মাত্র ওর চাচাদের এই সিদ্ধান্তের জন্য তৌসিফ এটাও চায় না পৌষ যাক ওই বাড়ী। চাচারা স্বার্থ তো দেখেছে। নিজেদের মেয়ে হলে অবশ্য দেখতো না কিন্তু এখানে সবচাইতে বড় হাত তো ছিলো তৌসিফে’র। ও জানে পৌষ এখন সত্যি মিথ্যা যাই জানুক না কেন তৌসিফ’কে ছাড়তে পারবে না। সেই ভয় তৌসিফ কোন কালেই পেতো না। মাঝপথে আদিত্য’র সাথে ঘটা ব্যাপারটা ওর আড়ালে ছিলো। তৌফিক যে কাজটা ইচ্ছে করে করেছে সেটাও জানে তৌসিফ। তবুও দাঁত চেপে হজম করেছে ব্যাপারটা।
তৌসিফ পৌষ’র কপালে কপাল ঠেকালো। বিমুগ্ধ চাহনি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— আমাকে বিয়ে করে পস্তাচ্ছো না তো?

পৌষ ফিক করে হেসে ফেললো। ঘাড় নাড়িয়ে মাথা ঝাকালো। তৌসিফে’র গাল চেপে ধরে চটাস করে গালে চুমু দিয়ে বললো,

— পা*গলা কু*ত্তায় কামড়েছে আমাকে? না তো। তাহলে পস্তাব কেন? আমার জামাই হলো নাম্বা ওয়ান শাকিব খান, বলি না এটা আমি? বলুন? কেন বলি? কারণ আপনাকে ভালোবাসি।

— তাই বলে শাকিব খান?

— হ্যাঁ তো। কেন ভালো লাগে না?

— ওহহো পৌষরাত। ভালো উদাহরণ দিতে।

— ওমা কাকে টেনে আনব উদাহরণ দিতে? শাকিব খান খালি ছিলো তাই তাকে টেনে আনলাম।

— খালি ছিলো মানে?

— বউ নাই একটাও। তাই সে ফ্রী।

তৌসিফ ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললো,

— তুমি এতো দুষ্ট হানি।

— মোটেও দুষ্ট না আমি।

— আচ্ছা, এবার বলো ভালোবাসো।

— হায় কপাল! ভালোবাসি এটা কেন বলব? আপনি হলেন আমার কলিজার টুকরো জামাই। ছাই দিয়ে কই মাছ ধরা গেলেও জামাই ধরা যায় না, আপনি আমার ধরা খাওয়া জামাই। জানের জান, পরাণের পরাণ। আমার কুতকুতু, লুতুলুতু,পুতুপুতু জামাই আপনি। এই দেখুন, আমার বুক ভরা কত্ত ভালোবাসা আপনাকে। সারাক্ষণ বুকটা শুধু তৌসিফ তালুকদার বলে ডাকতে থাকে। এই ধমকাই থামেই না।

একনাগাড়ে কথা গুলো বললো পৌষ। শুনলো তৌসিফ অতঃপর পৌষ’কে আস্তে করে বিছানায় নামিয়ে বললো,

— তোমার এত ভালোবাসা শুনে এখন ভালোবাসা পাচ্ছে আমার।

— ধুর মিয়া!

দরজা আটকে তৌসিফ জানালা আটকে দিলো। পৌষ উঠে দৌড় দেয়ার আগেই ধরা খেলো কারো হাতে। বন্ধ ঘরটা থেকে কুটকুট করে হাসির শব্দ আসছে। এই প্রথম সেই হাসির সাথে যোগ দিয়েছে পুরুষ স্বরে কারো হাসি। দুটো হাসির শব্দ এক হয়ে সারা ঘরে যেন প্রেম ছড়ালো। সুখী, সাচ্ছন্দ্যে থাকা এক দম্পতি। যাদের ঝুলিতে সুখের অন্ত নেই।
.
কিটটা এনে তৌসিফে’র হাতে দিয়ে বিরক্ত হয়ে বিছানায় বসলো পৌষ। এটা নিয়ে পরপর চারবার হলো। প্রথম বার দাগ উঠলেও আর উঠে নি। তৌসিফ চতুর্থটা দেখেও হতাশ হলো না। বান্দার ধৈর্য আছে বলতে হবে। পৌষ’র হাতে পঞ্চম বারের মতো কিট দিয়ে বললো,

— এটাই লাস্ট।

— প্রশ্নই উঠে না।

— প্লিজ হানি।

— একটুও না। পেটে আমার বাচ্চা নেই। শুধু মাত্র নারীভুরী আছে।

— আহা। একবার আর।

— মাফ করুন ভাই। দয়া করুন। বিরক্ত লাগছে তো।

— শেষ বার তো তোতাপাখি।

চোখে মুখে চরম কাতরতা দেখা গেলো তৌসিফে’র। পৌষ শ্বাস ফেলে বলে উঠলো,

— হিসু নেই পেটে আর। একদম খালি।

বলতে দেড়ী তৌসিফ ওর মুখ চেপে এক গ্লাস পানি গিলিয়ে দিলো। পাঁচ মিনিট থম ধরে বসে রইলো পৌষ। পানি খাওয়ার পর থেকে মনে হচ্ছে ওর শরীর খারাপ লাগছে। তবুও তৌসিফে’র মন রাখতে ঢুকলো ওয়াশরুমে। পৌষ এবার নিজেও চাইলো যাতে পজিটিভ হয় কিন্তু আফসোস এবারেও ফলাফল শূন্য। পৌষ ভাবলো লোকটার কষ্ট। ফিরে এসে হতাশা ঢেলে দিলো তৌসিফে’র হাতে। তৌসিফে’র চোখ মুখ দেখে অবশ্য কিছু বুঝা যায় না৷ পৌষ ওর বুকে মাথা রেখে বলে,

— আল্লাহ দিলে হবে।

— হুম।

— কয়টা বাবু লাগবে আমাদের?

— চারটা।

— চারটা কম হলো তো?

— তাহলে তুমি বলো।

— টুইন করে তিনবারে হলে ছয়টা হবে। অনেকগুলো বাবু থাকলে আমি ওদের সাথে অনেক কথা বলতে পারব।

— হু।

তৌসিফে’র কপালে ভাজ দেখা গেলো। পৌষ’র কপালে হাত রাখতেই দেখলো অসম্ভব গরম হয়ে আছে। ওকে কিছু বলার আগেই চোখ, মুখ লাল করে বমি করে দিলো পৌষ।

__________________

ইমার্জেন্সি টেস্ট করিয়ে ডেঙ্গু ধরা পরলো। অবস্থা হঠাৎ করেই যেন বেশি খারাপ হয়ে গেলো। ভর্তি রাখা হলো পৌষ’কে। ওর কিছু মেডিক্যাল রিপোর্টের জন্য হেমন্তকে ফোন করে তৌসিফ তখনই শুনতে পায় শ্রেয়া পা পিছলে পরে গিয়েছে। পৌষ শুনেই ছটফট করে উঠলো। ফোন ধরছিলো জৈষ্ঠ্য। ও জানালো বাসায় কেউ নেই। অগত্যা চৈত্র আর জৈষ্ঠ্য রিপোর্ট খুঁজে নিয়ে আসছে। পৌষ’র বমি বেড়ে গেলো হঠাৎ। স্যালাইন দিতেই কেঁদে যাচ্ছে ও। কি থেকে কি হচ্ছে মাথায় ঢুকে না তৌসিফে’র। ও শুধু পৌষ’র হাত ধরলো। ভেজা চোখে দেখলো পৌষ’কে। ডাকলো করুন স্বরে,

— হানি?

— বাসায় যাব।

— হ্যাঁ যাব তো। আজ থাকতে হবে।

— না না প্লিজ আমাকে নিয়ে চলুন৷ ভালো লাগছে না।

কোনমতে কথাটুকু বলেই জ্ঞান হারালো পৌষ। তৌসিফ যেন দিকবিদিকশুন্য হলো। ডাক্তারদের দিকে হুরতার করাতে লাগলো। ওর চিল্লাপাল্লাতে অবশ্য ডক্টররা তারাহুরো করতে লাগলো।

চৈত্র আর জৈষ্ঠ্য ফাইল আনতেই না দেখানো হলো ডক্টরকে। এদিকে একাধারে তৌসিফে’র ফোন বেজে যাচ্ছে। রিসিভ করতেই কপাল কুঁচকে গেলো তৌসিফে’র। ওর জাহাজের সিপমেন্টে করে মাদকদ্রব্য পাচার হয়েছে। তৌসিফ যেন আকাশ থেকে পরলো। মামলা করা হ’য়েছে। এক নাম্বার আসামি স্বয়ং তৌসিফ তালুকদার।
ওপাশ থেকে সমান তালে বলে যাচ্ছে,

— ভাই আপনাকে লুকাতে হবে। অন্তত প্রমাণ হওয়ার আগ পর্যন্ত।

— আমি হাসপাতালে।

— ভাই সময় নেই৷

তৌসিফ ফোন কাটলো। অন্যরা কল করছে ওকে। এক মুহুর্তে থমকে গেলো তৌসিফ। আগের হলে কথা ছিলো না কিন্তু এখন? এখন ওর একটা পৌষরাত আছে। চোখ বুজে নেয় তৌসিফ। ও জানে সরাসরি এরেস্ট হবে এখন। এই কাজ যেই করেছে বুঝে শুনে করেছে। দল করা ছেড়েছে ও বহু আগে। তাই সেই ক্ষমতা কোন ভাবেই দেখাতে চায় না তৌসিফ। হসপিটালে থাকা যাবেই না। এক মুহুর্তে সবটা পরিকল্পনা করে নেয় তৌসিফ। ডক্টরের কেবিনে ঢুকে সোজা জানায়,

— বাসায় ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করুন। নার্স সাথে পার্মানেন্ট দিন। কোন প্রকার ত্রুটি চাই না।

— জ্বি স্যার।

টাকা কথা বলে। এটা অবশ্য সত্যি। এই যে টাকা দিয়ে বউকে চিকিৎসা করাচ্ছে তৌসিফ। পৌষ শুধু বমি করছে আর তৌসিফ’কে চাইছে। কেন যে এত কাঁদছে তৌসিফ বুঝে উঠতে পারছে না। ওকে বুকে নিয়ে বসে আছে। ঐ দিকে সমান তালে ওর লোকজন পুলিশের দিকটা সামাল দিচ্ছে। তৌফিক আর তৌহিদ ও ব্যস্ত ভাইকে নিয়ে। তারা বারবার পালাতে বলছে কিন্তু তৌসিফ বউ ছেড়ে নড়বে না।
বুকে থাকা অর্ধচেতা পৌষ বলে উঠলো,

— পানি।

— হু? পানি?

তৌসিফ এটা বলেই পাশ থেকে গ্লাস ভর্তি পানি নিলো। পৌষ’র ঠোঁটে দিতেই পুরো গ্লাস খেলো ও। তৌসিফ জিজ্ঞেস করলো,

— আরেকটু খাবে?

— হু।

আরেক গ্লাসের অর্ধেক খেলো পৌষ। গলা শুকিয়ে কাঠ তৌসিফে’র। নিজে বাকিটুকু গিলে নিতেই পৌষ কাতরায় ওর বুকে। বসে পৌষ’কে বুকে নিয়ে চিৎকার করে নার্স’কে ডাকে তৌসিফ। নার্স দু’জন ছুটে আসে। পৌষ’কে ততক্ষণাৎ ইনজেকশন পুশ করা হলেই ও ঘুমিয়ে যায়।
তৌসিফ ওর কপালে চুমু খায়। গালে চুমু খায়। সকলের আড়ালে চোখ ছাপিয়ে দুই ফোটা পানি পরে। কানে মুখ লাগিয়ে বলে,

— তোমার তৌসিফ খারাপ কাজ করে নি পৌষরাত। আমার জান, আমার উপায় নেই এখন। আমি যদি না যাই তাহলে বাসায় চলে আসবে ওরা। তোমাকে তখন জঘন্য পরিস্থিতিতে পরতে হবে। ভরসা রেখো। আসব আমি৷ ফিরে আসব তোমার হয়ে। তোমার প্রেমসুধা পাওয়া আমার আজও বাকি।

তৌসিফ কালো হুডি লাগিয়ে বেরিয়ে গেলো। সময়টা তখন সন্ধ্যা। বাইরে তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। তৌসিফে’র গাড়ি রওনা দিলো চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে।
.
মাথায় এক ভোতা যন্ত্রণা নিয়ে চোখ খুলে পৌষ। এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজে তৌসিফ’কে। দূর্বল হয়ে ডাকেও দুইবার। সাড়া শব্দ নেই। নার্স দু’জন ওকে মেডিসিন দিতে চাইলেই পৌষ খিটমিট করে। কোনমতে উঠে দাঁড়ায়। টলতে টলতে মিনু’কে ডাক দিতে নিলেই মিনু’র চিৎকার শুনা যায়। ড্রয়িং রুমে তাকায় পৌষ। টিভিতে দেখা যাচ্ছে তৌসিফ’কে। পৌষ বুঝে না। হেডলাইনে উঠে আছে, “মাদকদ্রব্য পাচারে ধরা খেয়ে চট্টগ্রাম পালাতে গিয়ে আটক সাবেক মন্ত্রী এবং বিশিষ্ট ব্যবসায়ী তৌসিফ তালুকদার”।

পৌষ ঠিক এটাই দেখলো। সাংবাদিকও এটাই বলছে। মৌমাছির মতো তৌসিফে’র চারপাশে মানুষ যারা ওকে ছাড়বে না পুলিশের কাছে। হাতে হ্যান্ডকাফ তুলার সাহসও পুলিশের হয় নি। পৌষ সেই মানুষটার দিকে তাকিয়ে ঢলে পড়ে মাটিতে। তীব্র হাহাকার করে উঠে বুকটা। মাথাটা গিয়ে লাগলো ঠিক সেল্ফের কোণায়। র’ক্তের শ্রোত বইলো সেখান দিয়ে। অস্পষ্ট স্বরে শোনা যায়,

— আপনি কোথায়?

শরৎটা তাদের ভালো গেলো না। তীব্র প্রেমের পাতা ঝরলো। সুখের মাঝে কালো একটা দাগ পরলো। যেই দাগ থেকে এত সুন্দর চাঁদ মুক্তি পেলো না সেই দাগ বুঝি তৌসিফ-পৌষ’কে ছাড়ে? অসীম প্রেমে তো জ্বালা হবেই। পৌষ’র কপালে সুখগুলোর বড়ই দাপট। মন চাইলে থাকবে নাহলে নাই। সুখেরা এখন ছুটিতে। তারা পৌষ’র আঁচলে আসবে না৷ ধরা দিবে না এই ছটফটে আদর পা*গল মেয়েটাকে।

“আপনাকে চেয়েছিলাম আমি এক কুয়াশাজড়ানো ভোরে, তীব্র রোদের খরখরে তাপে, শরৎ কালের সেই বাতাসে যা বিষাদ উঁড়িয়ে আনে। আপনার প্রেমে আজও উন্মুখ হয়ে আছি। সেই প্রেমসুধা একবার পানে যে প্রশান্তি নেই। দেখা আবার হোক৷ মিলন আবার ঘটুক। হয় এপারে নাহয় ওপারে। আরেকটি বার প্রেমসুধা পান করা হোক। হাতে হাত রেখে অতলে হারিয়ে যাওয়া হোক”

প্রথম_পরিচ্ছেদের_সমাপ্তি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here