অপূর্ব সমাপ্তি পর্ব-৩০

0
449

#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ৩০

পরের বৃহস্পতিবার যথারীতি সাহিত্য সংঘে উপস্থিত হলাম। সেই ছেলেটার কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায়। মাঝে দুদিন মনে পড়েছে, তবে আজ একেবারে মাথায় ছিল না। কলেজ শেষে সরাসরি ওখানে চলে গেলাম। কলেজে মিটিং ছিল বলে দেরি হয়ে গেল। এখন শীতকাল হলেও তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ঘেমে গেছি।

আমি ঢোকার একটু পরেই একজন ঘোষণা দিল যে সে আইসক্রিম খাওয়াবে সবাইকে। কিন্তু সবাই রাজি হলো না শীতে আইসক্রিম খেতে। কেউ কেউ রাজি হলো। তাকে বলা হলো অন্যকিছু খাওয়ানোর কথা, কিন্তু সে আইসক্রিমই খাওয়াবে, যে যে খাবে, হাত তোলে যেন। আমার গরম লাগছিলো। খেতে ইচ্ছেও করছিলো। কয়েকজনের সাথে আমিও হাত তুললাম। আইসক্রিমটা খেয়ে প্রাণ জুড়ালো।

মাঝখানে অপূর্বর নাম্বার থেকে মেসেজ এলো, “সভা শেষ হলে যেন দাঁড়াবেন।”

আমি দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পর সেই আইসক্রিম খাওয়ানো ছেলেটা এসে পরিচয় দিলো, “আমি অপূর্ব।”

আমি ভালো করে ছেলেটার দিকে তাকালাম। আগেও দেখেছি, তবে খেয়াল করিনি। শ্যামলা গায়ের রঙ, একমাথা ঝাঁকড়া চুল, চোখগুলো বড় বড়। সাদা ধবধবে দাঁত বের করে হাসছে। হাইট সম্ভবত পাঁচ ফিট আট বা সর্বোচ্চ নয়, মাঝারি স্বাস্থ্য। পরনে কালো জ্যাকেট যার সামনের চেইন পুরোটা খোলা, ভেতরে সাদা টিশার্ট, সাথে জিন্স, পায়ে নীল-সাদা কেডস। তাকে দেখেই আমার প্রথমে যে কথাটা মনে হলো সেটা হলো- “বাচ্চা একটা ছেলে!”

আমাকে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করতে দেখে সে বলল, “কোনো সমস্যা?”

“নাহ। কেমন আছেন?”

“ভালো।”

“ধন্যবাদ আপনাকে।”

“কেন?”

“আইসক্রিম খাওয়ানোর জন্য!”

“ওটা স্পেশালি আপনার জন্যই ছিল।”

“হুম সে আপনাকে দেখেই বুঝেছি।”

অপূর্ব হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “চলুন হাঁটি। আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেই।”

এখান থেকে আমাদের বাড়ি হেঁটেই যাওয়া যায়। তবুও একা বলে রিকশা করে যাতায়াত করি। হাঁটার প্রস্তাবে খুশিই হলাম। টুকটাক কথাবার্তা হলো। অপূর্বর কথা শুনে জানতে পারলাম, সে সত্যি সত্যি বয়সে আমার চেয়ে ছোট। মাস্টার্স পাশ করেছে সবে। ভালো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে বের হওয়ায় চাকরি হয়ে গেছে দ্রুত। বৃহস্পতি, শুক্র তার ছুটি থাকে। বাড়িতে মা বাবা আছে, ভাইবোন নেই। শখ হচ্ছে কবিতা লেখা আর ঘুরে বেড়ানো।

নিজের বৃত্তান্ত বলে আমাকে বলল, “আপনার সম্পর্কে বলুন কিছু…”

আমি মৃদু হেসে বললাম, “আমার কিছু বলার নেই। আমার জীবনে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু হয়নি।”

অপূর্ব অবাক হয়ে চেয়ে থেকে বলল, ” কী বলছেন আপনি? আপনার কথা কতো শুনেছি মৃন্ময় কাকার কাছে! আর আপনি বলছেন কিছু হয়নি? ভেরী ব্যাড! নিজের এচিভমেন্ট অপরকে ফলাও করে জানানো যেমন ভালো না, তেমন লুকিয়ে রাখাও ভালো না।”

আমি এদিকে অবাক। “মৃন্ময় স্যারকে আপনি চেনেন?”

“হ্যাঁ, আমার বাবার বন্ধু। উনি সবসময়ই আপনার গল্প করেন। আগে তো চিনতাম না আপনাকে, সাহিত্য সংঘে যোগ দেয়ার পর বুঝলাম, আপনিই তিনি।”

“কী কী বলেছেন স্যার আমার সম্পর্কে?”

“শুধু প্রশংসা! আর কিছু না।”

“ও আচ্ছা। স্যার আমাকে খুব পছন্দ করেন। অন্যদের সামনে একটু বাড়িয়েই বলেন।”

“মোটেই না। আমি আগে ভাবতাম এটা, কিন্তু আপনাকে দেখার পর থেকে মনে হয়, আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মেয়ে।”

আমি হেসে বললাম, “পৃথিবীর সব মেয়ে দেখা হয়ে গেছে?”

“না, তবে মেয়ে মহলে আমার খুন সুনাম আছে। ভালো খাতির করতে পারি। অনেক মেয়ের সাথে মিশেছি। তবে আপনার মতো কাউকে কখনো দেখিনি।”

আমি পা দিয়ে রাস্তা থেকে একটা ইটের টুকরো লাথি দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললাম, “আমার মতো কারো হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মেয়ে নই, সবচেয়ে অভাগী মেয়ে।”

ছেলেটা চুপ হয়ে গেল। একটু ভেবে বলল, “কষ্ট সবসময় স্থায়ী হয় না। আপনার কষ্টও দূর হবে। আপনি সুখী হবেন।”

“সুখী হওয়ার দিন শেষ।”

“আহা! এতটুকু মেয়ে বলে দিন শেষ!”

কথার ঢঙে আমার ইচ্ছে হলো কান মলে দেই। চেহারাও অমন। দুষ্টু দুষ্টু। বললাম, “এই ছেলে যাও তো বাড়ি যাও, আমি একা যেতে পারব।”

সে হেসে বলল, “যাব তো! রাস্তাঘাট যা খারাপ! সুন্দরী মেয়েমানুষের একা চলাচল রিস্কি!”

“আমি মোটেও সুন্দরী নই।”

“আমার সাথে এসব বলে লাভ নেই। এটা হচ্ছে মেয়েদের টেকনিক। তারা জানে এভাবে বললো ছেলেরা প্রশংসা করে।”

আমি এবার রাগী চোখে তাকালাম। সে হেসে বলল, “ওইযে আপনার বাড়ি চলে এসেছে।”

“আপনি আমার বাড়ি চেনেন?”

“আবার তুমি থেকে আপনি কেন?”

“তখন ভুলে তুমি বলেছি। আগে বলুন আমার বাড়ি চেনেন কী করে?”

“একদিন এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, আপনাকে বের হতে দেখেছি।”

আমার অপূর্বর কথা বিশ্বাস হলো না। তবে কিছু বললাম না। একবার ভেতরে যেতে বললাম। সে রাজি হলো না। যাওয়ার আগে আস্তে করে বলে গেল, “আপনি কেন নিজেকে অসুন্দর ভাবেন বলুন তো? আপনি অনেক সুন্দর। সৌন্দর্যটা শরীর, মন, ব্যক্তিত্ব সব মিলিয়ে বিচার করা উচিত।”

.
সেদিনের পর থেকে অপূর্ব আমাকে প্রায় প্রতিদিন ফোন করে। প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগলেও এখন লাগে না। সে এত মজা করে কথা বলে যে শুনতেই ইচ্ছে করে। ইতিমধ্যে আমরা ভালো বন্ধুও হয়ে গেছি। অপূর্বর সাথে কথা বলার সময়টুকু মনে হয় আবার সেই আগের দিনগুলোতে ফিরে গেছি। সেই প্রাণবন্ত মনটা বেঁচে উঠেছে। অপূর্ব আমার বর্তমানের কথা কিছু তোলে না। আমার ধারণা সে সব জানে। আমিও তাই আগ বাড়িয়ে কিছু বলি না।

এমনও হয়, অপূর্ব ফোন না করলে আমিই করি। কথা না বললে ভালো লাগে না। সে কবিতা লেখে, আমি তার কবিতা তাকে পড়ে শোনাই। আমরা একে অপরকে তুমি করে বলতে শুরু করেছি।

যে সময় এই বন্ধুত্বটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে চলে গেছে, ঠিক সে সময়ে একদিন অপূর্ব আমাকে প্রপোজ করে বসল। কথা বলতে বলতে হঠাৎ বলল, “তোমাকে আমার ভালো লাগে সমাপ্তি।”

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। তার কণ্ঠ অন্য সময়ের মতো হালকা না, বরং ভারী আর গভীর। আমি হালকাভাবে নেয়ার ভান করে বললাম, “আমাকে সবারই ভালো লাগে। তুমিই তো বলো, আমি ভালো মেয়ে।”

অপূর্ব খানিকটা অধৈর্য হয়ে বলল, “উহু, সেই ভালো লাগা না। অন্যরকম ভালো লাগা। ভালোবাসার মতো ভালো লাগা।”

আমি অপূর্বর ফোন কেটে দিলাম। ভালোবাসা শব্দটা অন্য কারো মুখ থেকে শুনতে আমি রাজি নই।

অপূর্বকে আমি ইগনোর করতে শুরু করলাম। কয়েক সপ্তাহ সাহিত্য সংঘে গেলাম না। ওর সাথে কথা বলে অভ্যাস হয়ে গেছিলো। নিজেরই খারাপ লাগা শুরু হলো। তবে পাত্তা দিলাম না।

একদিন ইভা আমার ঘরে এসে বলল, “একটা কোঁকড়াচুলো ছেলে প্রতিদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে তোমার ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। খেয়াল করো না?”

আমি সত্যি খেয়াল করিনি। জানালার কাছে গিয়ে দেখি আসলেই একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটি আর কেউ নয়, স্বয়ং অপূর্ব।

এবার খুব রাগ হলো। সোজা বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় গেলাম। অপূর্বর সামনে গিয়ে কোনো ভূমিকা ছাড়াই সজোরে একটা চড় মারলাম গালে। ছেলেটা হতভম্ব হয়ে গেল। চোখে চাপা বিষ্ময় আর বেদনা মিলেমিশে আছে। বললাম, “আর কোনোদিন আমার সামনে আসবে না। খুব খারাপ হয়ে যাবে তাহলে।”

বলে আর দেরি করলাম না। সোজা ভেতরে চলে এলাম। তবে আমার নিজেরই তারপর থেকে খারাপ লাগা শুরু হলো। ছেলেটাকে বুঝিয়ে বললেই হতো। এভাবে অপমান না করলেও চলতো। তাকে ফোন করব করব করেও করলাম না শেষ পর্যন্ত। প্রশ্রয় পেলে আবার যদি সেসব বলে?

.
আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী। প্রথম বছর এই দিনটা আমি কেঁদেই ভাসিয়েছিলাম৷ সারাদিন শেষে ফোলা চোখ নিয়ে ঘুমিয়ে গেছিলাম। পরদিন আবার কেঁদেছি তার আত্মার মাগফিরাতের জন্য কিচ্ছু করিনি বলে।

পরের বছর অবশ্য সেটা শুধরে নিয়েছি। সেবার অনেকগুলো পথশিশুকে খাইয়েছি পেট ভরে। আর বলেছি দোয়া করতে। তারা খেয়েদেয়ে হাত তুলে দোয়া করেছে আমার স্বামীর জন্য। এ দৃশ্য যে কি শান্তির! না, তারা কোনো দোয়া, কালাম কিছুই জানে না। তবুও আমি বুঝি, তাদের দোয়াটুকু ঠিক জায়গামতো পৌঁছে গেছে সাথে সাথেই।

এই বছরও ব্যতিক্রম হলো না। দিনটা কাটলো ব্যস্ততায়। দুপুরের পরপর ইচ্ছে হলো একাকী সময় কাটাতে। আমি বাসে চড়ে রওনা দিলাম। যেদিকে বাস যায়, যাব। কীভাবে কীভাবে যেন চলে গেলাম আশুলিয়ার দিকে। তুরাগ নদীর পাড়ে বিরুলিয়া ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে মনে হলো এটা সেই স্বপ্নে দেখা ব্রীজটা!

সন্ধ্যে নামলো চোখের সামনে। ক্লান্ত সূর্যটা ডুবে গেল। গোধুলীর রঙে রাঙা হলো আকাশ। আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা লাগছে চোখেমুখে। হঠাৎ মনে হলো সে এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। মৃদু শব্দে বলছে, “এখনো ভালো নেই তুমি। খুঁজে নাও নিজের সুখ। যতটুকু আনন্দ তোমার কাছে নিজে থেকে ধরা দেবে, ততটুকু লুটে নাও!”

ব্যাস, তারপর গায়েব।

অনেক সময় নিয়ে ভাবলাম কথাটা। একসময় মনে হলো, এটা সে বলেনি, আমার অবচেতন মন আমায় বলেছে। অপূর্বকে দেখে আমার নতুন করে সুখ খোঁজার যে ইচ্ছেটা তৈরি হয়েছে, সেটা আমার মস্তিষ্ক কাল্পনিক তার মুখ থেকে শুনিয়ে বৈধতা পেতে চাইছে!
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here